বাসন্তীগন্ধা পর্ব -২৭

#বাসন্তীগন্ধা
|২৭|
লাবিবা ওয়াহিদ

এখন মেহের পুরোপুরি সুস্থ। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলে নিজেদের ব্যস্ত জীবনে ফিরে গেলো। শুধু মেহের ব্যতীত। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ। এডমিশনের জন্যে টুকটাক পড়াশোনা ছাড়া আর সারাদিন শুয়ে বসে কাটায়৷ মাহিম থাকে কলেজে। সারিম, সাইয়ান থাকে অফিসে। রোজাও ঘরে বসে অফিসের কাজ করে। সামিরা গেছে ফুফুর বাসায়৷ মেহের যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সারিমের নিষেধাজ্ঞা। এডমিশনের পুরো প্রস্তুতি থাকতে হবে। এমনিতেই অনেকগুলা দিন নষ্ট হয়ে গেছে। আর নষ্ট করা যাবে না।

এদিকে মেহের যখন পারে তখনই মাহিমকে খোঁচা দেয়। খোঁচা এরকম,
–“আহারে। আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিলাম আর আমার দেড় মিনিটের বড়ো ভাইটা সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উত্তীর্ণ হলো। খুব কষ্ট লাগে বুঝি বড়ো ভাই?”

মাহিম তখন না পারে সইতে আর না পারে কিছু বলতে। শুধু তেলে-বেগুনে জ্বলতে জ্বলতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“সময় আমারও আসবে!”
মেহের তখন ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“যতই সময় আসুক না কেন, আমার উপরের ক্লাসে উঠতে পারবে না বৎস।”
মাহিম এবার মেহেরের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
–“এই বিবাহিতা মহিলা, প্যানপ্যান না করে স্বামীর সেবা কর গিয়া। এইটুকুনি বয়সে বিবাহিত হয়ে গেছোস। বুড়ি!”

মেহের মাহিমের চুল টেনে দিয়ে কর্কশ কন্ঠে আওড়ায়,
–“বুড়ো!”

মেহেরের মন-খানা আজকাল খুব আঁকুপাঁকু করছে বাইরে ঘোরার জন্যে। মাহিমের সঙ্গে নয়, সারিমের সঙ্গে। এই ফুল সদ্য বিবাহিতা নারীর জন্যে স্বাভাবিক। তাদের এক চাপা আকাঙ্খা থাকে, তাদের একমাত্র সঙ্গী তাদের সময় দিবে, তাদের আবদার শুনবে, মন ভরে তাদের হাসবেন্ডের সেবা করবে, সময় কাটাবে, ঘুরবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের সখ এবং আবদার শত ছুঁয়ে যাবে যেন। মেহের তাদের থেকে ব্যতিক্রমধর্মী নয়। কিন্তু সারিম সারাদিন অফিসে পরে আসে। বাড়ী ফিরে রাত ন’টার পর। মেহেরের মন বিষণ্ণ থাকলেও রাত বাড়লে ঘুমানোর সময় সারিম তাকে আগলে নেয়। সেই মুহূর্ত খুব সুন্দর, সুখের। তাও সারাদিনের আকাঙ্খা তো থেকেই যায়। আবদার গুলো পূরণ না হোক, অন্তত প্রাণভরে কথাও তো বলতে পারে। তা-ই বা হয় কোথায়?

শুধু তিন বেলা কল করে সারিম মেহেরের খবর নেয়। এখন আপাতত মেহেরের একমাত্র সঙ্গী মেহেরের দাদী রোকসানা। মেহের রোজ দাদীর কোলে মাথা রেখে সারিমের নামে কত কত অভিযোগ করে। মেহেরের এই ধরণের অভিযোগ শুনলে রোকসানা শুধু হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
–“বিয়ের এক মাসও পেরুলো না, এতেই এত অভিযোগ? তুই কী বাচ্চা নাকি মেরু?”

মেহের তখন চোখে-মুখে অভিমান ফুটিয়ে বলে,
–“তোমার নাতীটাই এমন। না চাওয়া সত্ত্বেও এক ঝুঁড়ি অভিমান মন আকাশে ভীড় করে। তাও দেখো কী অবস্থা? অভিমান, অভিযোগ করার আগেই তোমার সারিমের ক্লান্তিমাখা মুখখানা দেখে সব উধাও হয়ে যায়। একা থাকলেই আবার ঝেকে বসে!”

রোকসানা আবার হাসলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
–“আচ্ছা। তাহলে আজ ঘুরে আয় কোথাও। সারিমকে কল করে জানিয়ে দে।”

মেহের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে ভাবলো। অতঃপর কিছুটা নড়েচড়ে চোখ বুজে বললো,
–“রাখো এসব কথা দাদী। ঘুম পাচ্ছে।”

—————–
মেহের দাদীর বলা কথামতো বিকালেই রেডি হয়ে তাদের বাড়ির বাইরের বড়ো গেটে গিয়ে দাঁড়ালো। বোরকা, হিজাব পরে একদম ফিটফাট। দারোয়ান তার ম্যাছ সামলাতে ব্যস্ত। সেদিন মেহের তার ম্যাছ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। সেই ম্যাছটা ছিলো দারোয়ান চাচার শেষ ভরসা। এমনিতেই রাত-দিন এক করে ডিউটি করতে গিয়ে ম্যাছ কেনার সময় পায় না। কিনলেও একসাথে কয়েকটা করে কিনে। সে আবার ধূমপানে আসক্ত। ধূমপান ছাড়া চলাটা তার নিঃশ্বাস আটকে যাবার মতোই লাগে। তার ওপর সব ম্যাছ শেষ করে একটাই অবশিষ্ট আছে তার। এজন্যে যে করেই হোক তাকে সেটা সুরক্ষিত করতেই হবে।

মেহের যদি চায় তাহলে সোজাসুজি বলে দেবে তার ম্যাছ শেষ, কিনতে যাবে যাবে বলেও যাওয়া হচ্ছে না। আবাসিক এলাকা হওয়ায় আশেপাশে টঙের হুঁদিশও নেই।

মেহের লোহার গেটে পিঠ এলিয়ে সারিমকে কল করলো। দু’বার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো। মেহের তখন খুব আবদারের সাথে বললো,
–“আমি ঘুরতে যেতে চাই!”

ওপাশ থেকে সারিমের শীতল গলা শোনালো। বললো,
–“মাহিম কোথায়?”
–“আমি তো আপনার সাথে যেতে চাইছি।”
সারিম বললো,
–“মিটিং আছে।”

মেহের অত্যন্ত অভিমান করে বসলো সারিমের এই কথায়। জেদটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। নাক কুচকে দৃঢ় গলায় আওড়ায়,
–“সেটা আমার জেনে কাজ নেই। আমি গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। এক পাও নড়ার ইচ্ছে নেই।”
–“মেরু। জেদ কেন করছো?”

মেহের কোনো কথা না শুনে কল কেটে দিলো। কতক্ষণ একভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। এরকম করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এলো। পাখিরা তখন নিজ নীড়ে ব্যস্ত হয়ে ফিরছে। দারোয়ান হঠাৎ কানে ফোন নিয়ে মেহেরের কাছে ছুটে এলো। তার সাধারণ বাটন ফোনটা মেহেরের দিকে দিয়ে বললো,
–“সারিম বাবা কল করছে!”

মেহের দারোয়ানের থেকে মোবাইলটা নিয়ে কানে দিলো। হ্যালো বলতেই ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
–“এত অবাধ্য কেন? কল দিচ্ছি দেখছো না?”

মেহের সহজ হয়েই বললো,
–“ফোন সাইলেন্ট। ব্যাগে। দেখিনি!”
সারিম চোখ বুজে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
–“আমি আসছি। আর হাঁটাহাঁটি করার দরকার নেই। আপাতত ভেতরে যাও নয়তো দারোয়ান চাচার রুম থেকে একটা চেয়ার এনে বসো।”

মেহের সঙ্গে সঙ্গে বললো, “আচ্ছা।”

সারিম কল রেখে দিলো। আর মেহেরের হাসি যেন ঝুলে পরছে। অবশেষে সারিম তার মিটিং ফেলে আসছে। মেহের অত্যন্ত খুশি। এর সাথে আফসোসও করলো এই ভেবে, সারিমকে মেহের শুধু শুধু ভয় পেত!!

মেহের চেয়ার এনে বসলো না। আগের মতোই হাঁটা-চলা করলো। মিনিট দশেকের মধ্যেই সারিমের গাড়ি গেটের বাইরে এসে থামলো। সারিম গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। মেহের সারিমকে লক্ষ্য করতেই হাঁটা থামিয়ে দিলো। মেহেরকে বসতে না দেখে সারিম চোখ রাঙালো। মেহের বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে নিজেই গেট খুলে বেরিয়ে আসলো। যেন অপেক্ষা করতে করতে সে ক্লান্ত।

মেহের হাসতে হাসতে সারিমের পাশ কেটে গাড়িতে উঠতে যেতে যেতে বললো,
–“চলুন।”

সারিম মেহেরকে পিছু ডেকে থামালো। এরপর সারিম এগিয়ে এসে মেহেরের কালো বোরকার পিঠে থাকা সাদা ময়লার দাগ ঝেড়ে দিতে দিতে বললো,
–“গেটে কতদিনের ময়লা জমে আছে। সেটায় হেলান দিয়েছো কেন? জানো না কালো জিনিস কতো সেন্সিটিভ? সামনে থেকে খেয়াল রাখবে।”

মেহের আসলেই খেয়াল করেনি। তবে সারিমের সূক্ষ্ম দৃষ্টির প্রসংশা মনে মনে ঠিকই করলো। কত খেয়াল রাখে সারিম৷ মেহের আপনমনে আওড়ালো,
–“আপনার স্পর্শ পাওয়ারর জন্যে এক ভুল বারবার করতে রাজি!”

ওরা ঘুরতে বেশি দূর গেলো না। ধানমন্ডি লেকেই গেলো। আশেপাশে অসংখ্য কপোত-কপোতীর ছড়াছড়ি। সারিম মেহেরের আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল গুলো গুজে হাঁটছে। আর মেহেরকে অনুভূতিরা সুঁড়সুঁড়ি দিচ্ছে। কত কল্পনা করতো এই দিন গুলির। কল্পনার চাইতেও সুন্দর প্রতিটা মুহূর্ত। মেহেরের ভাবনার মাঝে হঠাৎ-ই সারিম বলে ওঠে,
–“খুব জেদী হয়ে গেছিস মেরু। শেষমেষ বাধ্য হয়ে মিটিং ফেলে তোর কাছে ছুটে আস্পতে হয়েছে!”

মেহেরের মন ভার হয়ে গেলো। সারিম আবারও তাকে তুই সম্বোধন করেছে। মেহের হাত ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু সারিম আরও শক্ত করে ধরলো। থেমে গিয়ে বললো,
–“কী হলো?”

মেহের হাত মোঁচড়াতে মোঁচড়াতে বললো,
–“আপনি এমন বিশেষ কেউ নন যে আপনি ছাড়া আপনার অফিস অচল, আপনার ব্যবসা অচল। আপনি ছাড়াও সাইয়ান ভাই, বাবা সব দেখছে। তাই মিটিং-এ আপনি না থাকলেও তা দেখার জন্যে আরও দুজন আছে!”

সারিম শুধু অবাক হয়ে দেখলো মেহেরকে। মেহেরের থুঁতনি ধরে মেহেরের নত মুখখানা তুলে চোখে চোখ রেখে বললো,
–“এত বড়ো কবে হলি? আজকাল কথাও গুছিয়ে বলতে পারিস!”
–“আগে থেকেই বড়ো ছিলাম। শুধু আপনার নজর ছোটো দেখে ছোটো-ই দেখে গেছেন!”

সারিম চাপা হাসলো। আবার হাঁটতে শুরু করলো। এর মাঝে হঠাৎ বললো,
–“অভিমান করাও শিখে গেছো। ভালো তো।”

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

দু’দিন যাবৎ রাইটিং ব্লকে। আজ টেনে-টুনে এই অবধি-ই লিখতে পারলাম। অত্যন্ত দুঃখিত। আমার দ্বিতীয় ই-বই” প্রেম ছুঁয়েছে মন এসেছে। সম্পূর্ণ রোমান্টিক জনরার। জুনিয়র প্রেমিককে ঘিরে লেখা। দ্রুত কিনে ফেলুন। লিংক কমেন্টে দিলাম।♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here