নিবিদ্রিতা কাহন পর্ব -১৭

#নিবিদ্রিতা কাহন—-১৭
®মেহরুমা নূর

★মিষ্টি রোদের হাতছানি ঘরের মাঝে পড়তেই কোমল বদন মুচড়ে আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকালো আদ্রিতা। কার্তিক মাস পড়ে গেছে। পরিবেশে হেমন্তের শীতল বাতাস অনুভব হয়। চোখ খুলতেই প্রথমেই চোখে পড়লো সামনে রাখা ল্যাপটপে তার মা-বাবার চেহারাটা। কাল রাতে বাবার সাথে কথা বলতে বলতেই কখন ঘুমিয়ে গেছে তা নিজেও জানে না আদ্রিতা। ল্যাপটপের ভিডিও কল এখনো অনই আছে। স্ক্রিনে মা-বাবাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। রাতে মেয়েকে দেখতে দেখতেই হয়তো তারাও ঘুমিয়ে গেছে। আদ্রিতা মুগ্ধ হাসি টেনে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তার মা বাবাকে দেখতে লাগলো।নূর আদিত্যর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে আর আদিত্য এক হাতে নূরকে জড়িয়ে নিয়ে তার মাথার উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে আছে। একসাথে কত শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে দুজন। কতশত প্রশান্তি বিরাজ করছে তাদের ঘুমন্ত মুখদ্বয়ে। দেখলেই যেন মনটা ভরে যায়। আদ্রিতা মনে মনে ভাবে,তার মা বাবার মতো এতো ভালোবাসাময় দাম্পত্য জীবন কারোর আছে কিনা সন্দেহ। তার বাবা যেভাবে তার মাকে ভালোবাসে এমন ভালোবাসা আদৌও আর কেউ পারবে কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।বেশিরভাগ মেয়েরাই তাদের জীবন সাথীর মাঝে বাবার ঝলক দেখতে চায়। আদ্রিতাও তার ব্যাতিক্রম না৷ সেও চায় তার জীবন সাথীও যেন তার বাবা আদিত্যর মতোই হয়। সেটা ভাবতেই হঠাৎ আদ্রিতার চোখের সামনে নিবিড়ের চেহারা ভেসে উঠলো। যেন নিবিড়ের মাঝেই আদিত্যর ঝলক দেখতে পায় আদ্রিতা। হ্যাঁ নিবিড়ই হয়তো সেই পুরুষ। সেদিনের কথা মনে পড়তেই আনমনে হাসে আদ্রিতা।নিবিড়ের মনের কথা জানতে কি বোকামি করেছিল সে! পনেরো দিন পূর্বের সেই কথা ভেবে এখন হাসি পায় তার। তবে এখন আদ্রিতা বুঝে গেছে ওসব বোকামি করে কখনো কারোর মনের খবর জানা যায়না। তাই এখন আর সে চেষ্টাও করতে চায়না সে। যদি নিবিড় ভাইয়া ওর ভাগ্যে থাকে তাহলে সময় হলে একদিন নিবিড় ভাইয়া নিজেই তার মনের কথা ওকে জানাবে। সেদিনের অপেক্ষায় থাকবে আদ্রিতা। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে থাকা মা-বাবার মুখয়বের উপর চুমু খেয়ে আদ্রিতা বিড়বিড় করে বলল,
“লাভ ইউ সো মাচ, মা-বাবা।”

বিছানা থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হেলেদুলে রুমের বাইরে আসলো আদ্রিতা।এখনো যেন রাজ্যের আলসি তার শরীরে। সারা অঙ্গে যেন অলসতা খেজুরের কাঁ,টা,র মতো গেঁথে আছে। মাথার চুল গুলো কালবৈশাখী ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উপড়ে পড়া গাছের মতো আউলা ঝাউলা হয়ে আছে। ঘুমো ঘুমো চোখের পাপড়িগুলো এখনো লাল আর ফুলো ফুলো ভাব লেগে আছে। আদ্রিতা কি জানে তার এই এলোমেলো মুখখানি কারোর সর্বত্র ভস্ম করে দিচ্ছে! যার চোখে আদ্রিতা এখন প্রলয়ঙ্কারী, আবেদনীয় নারীর রুপ। যে নারী প্রতিমুহূর্ত তাকে ধ্বংস করায় লিপ্ত থাকে।
আদ্রিতার আড়মোড়া ভাঙার মাঝেই সামনে থেকে কারোর ধমকের সুর ভেসে এলো।
“এই বলদি, সকাল সকাল এমন পেত্নীর দাদী সেজে বের হয়েছিস কেন! বাসার সবাইকে কি হার্ট অ্যাটাক দিয়ে মারতে চাস নাকি!”

আদ্রিতা ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে স্কাই ব্লু কালারের শার্ট আর এ্যাশ কালারের প্যান্টে, ফর্মাল লুকে আবৃত নিবিড়কে দেখতে পেল। হয়তো অফিসের জন্য রেডি হয়ে মাত্র বের হলো। তাকে দেখে আদ্রিতার মনে বরাবরের মতোই সেই একই প্রশ্ন উঁকি দিলো, উনি এতোটা সুদর্শন কেন! কিন্তু লোকটা যতো সুন্দর তার কথাগুলো ততই তিক্ত, বিরক্তিকর আর অসহ্যকর। অসহ্য আসলে কি জিনিস তা এই লোকটার কথা না শুনলে বোধহয় জানা হতোনা। বলে কিনা আমাকে পেত্নীর মতো লাগছে! প্রতিত্তোরে আদ্রিতা মুখ গোমড়া করে বলল,
“বিদেশে গিয়ে চোখের জ্যোতি হারিয়ে এসেছেন নির্ঘাত। আমাকে কোনদিক দিয়ে পেত্নী মনে হচ্ছে আপনার? উল্টো সোনা মা আর চাচ্চুসহ সবাই বলে আমাকে নাকি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পর অনেক কিউট লাগে দেখতে। ”

আদ্রিতার সগর্বপূর্ণ কথা শুনে নিবিড় যেন মজা পেল খুব। যার দরুন হাসলো কিছুটা। কদম অগ্রসর করে এগিয়ে এলো আদ্রিতার কাছাকাছি। আদ্রিতার মুখপানে তীক্ষ্ণ, পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলল,
“মা বাবা তো তোর মন রাখতে ওসব বলে আর এই সামান্য জিনিসটাই বুঝতে না পারার মতো বলদি হলো তুই। নাহলে কিউট আর তুই! কিউট শব্দটার আবিষ্কারকারী নিজের আবিষ্কারের এমন অপপ্রচার দেখে নির্ঘাত ফিনাইল সেবন করে মরে যাবে। আর একজন সচেতন ব্যাক্তি হিসেবে একজন আবিষ্কারককে এভাবে মৃত্যুর মুখে যেতে দিতে পারি না। তাই আজকের পর এমন ভয়ংকর পেত্নীর রুপ ধরে আর কখনো সামনে আসবিনা। বাসায় বাচ্চা,বৃদ্ধ দুটোই আছে। আতঙ্কে হার্ট এটাক খেয়ে বসবে।”

রাগে আদ্রিতার দাঁত কিড়মিড়িয়ে এলো। নিবিড় নামক এই বান্দাটাকে উগাণ্ডায় ছুড়ে মারার তীব্র বাসনাও জাগছে। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আচ্ছা! তা এতোই যদি ভয়ংকর লাগছি তাহলে আপনি হার্ট ফেল করছেন না কেন?”
“আমার হার্ট এতো দূর্বল না বুঝেছিস! কারণ আমার কাছে হার্টই নেই। সেটা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে আমার কাছ থেকে।”
আদ্রিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মানে? হার্ট কি কোনো চাবির গোছা নাকি যে হারিয়ে যাবে!”
নিবিড় আদ্রিতার মাথায় আলতো করে তিন আঙুলের মাথা ঠেকিয়ে টোকা দিয়ে বলল,
“মানে যদি বুঝতি তাহলে হতোই। বলদি কোথাকার! ভয় দেখিয়ে না মারতে পারলেও তোর এই বলদিগিরিতে একদিন আমাকে সর্বশান্ত করেই ছাড়বি।”

নিবিড়ের এই কথা বোঝার জন্য আদ্রিতার যেন সাবটাইটেলের প্রয়োজন বোধ হচ্ছে। নাহলে সব বাউন্সার যাচ্ছে। এই লোকটাকে কখনো কি সে বুঝতে সক্ষম হবে!
__

দুটো ক্লাস শেষ করে বাইরে এসে বান্ধবীদের সাথে মাঠে হাঁটতে বের হলো তানহা। দূর্ভাগ্যবশত আদ্রিতা, সানভি আর তানহা কেউই একসাথে একই কলেজে সিলেক্ট হয়নি। তিনজন আলাদা আলাদা কলেজে চান্স পেয়েছে। তানহার প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও সময়ের সাথে মানিয়ে নিয়েছে সে। মাঠের মাঝে আসতেই তানহার বান্ধবী বলে উঠলো,
“আজ না কলেজে ডাক্তারদের ফ্রী ক্যাম্পেইন হচ্ছে।শুনেছি হ্যান্ডসাম একটা ডাক্তার এসেছে। চলনা আমরাও চেকাপ করিয়ে নেই।”
তানহার আরেক বান্ধবী বলে উঠলো,
“ক্যান তোর আবার কি হলো? হাঁটুতে গ্যাস্টিক হয়েছে, নাকি মগজে ডায়রিয়া হয়েছে? বেডা মানুষ দেখলেই তোর রোগ জাইগ্গা যায় তাইনা! শালী লুচ্চি ছেড়ি!”
“আরে সত্যি বলছি আমার শরীর টা অনেক দিন হলো কেমন দূর্বল লাগছে। চলনা গিয়ে দেখাই। বাঙালি হয়ে মাগনা জিনিস না নিলে জাতি মেনে নিবে না। বহিষ্কার করে দিবে আমাদের। চল চল…
তানহার বান্ধবী একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল তানহাকে। ক্যাম্পেইনের সামনে এসে দেখলো কয়েকজন সহকারী ডাক্তারদের সাথে অপরাহ্নও এসেছে। ক্যাম্পেইনের মূল তত্ত্বাবধানেই সে। মিষ্টি রঙের শার্টের উপর সাদা এপ্রন পড়ে রোগিদের মনোযোগ সহকারে চেকাপ করছে। বরাবরের মতোই মুখে সন্তুষ্টি মিশ্রিত হাসি লেপ্টে আছে। এটাও যেন অপরাহ্নের বৈশিষ্ট্য। তাকে কখনো কোন সময় বিরস মুখে দেখা যায় না। লোকটার নিজের কাজের প্রতি নিঃস্বার্থ একনিষ্ঠতা দেখে তানহার মাঝে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আর মুগ্ধতা কাজ করে। রোগীদের দুটো লাইন করা হয়েছে। অপরাহ্ন শুধু পুরুষ লাইনের চেকাপ করছে। নারীদের চেকাপ করছে অন্য এক সহকারী ডাক্তার। তা দেখে তানহার বান্ধবী আপসোস ব্যক্ত করে বলল,
“ধুরর! যার জন্য হইলাম রুগী সেই হইলো পর। এই রোগ রেখে কি লাভ!”
তার কথায় আরেক বান্ধবী হো হো করে হেঁসে উঠল৷ তানহাও ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে হালকা হাসলো। হাসির শব্দে রুগি দেখার মাঝেই ক্ষনিকের জন্য মাথা তুলে পাশে তাকাতেই তানহাকে দেখে থমকে গেল অপরাহ্ন।হঠাৎ বসন্তের মতো উদয় হলো যেন মেয়েটা। এটা যে তানহার কলেজ তা জানাই ছিলোনা ওর। তানহা মেয়েদের সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছে। যাদের চেকাপ ওর সহকারী ডাক্তার আসাদ করছে। তানহার চেকাপও সেই করবে। সেটা ভাবতেই অপরাহ্নের অবচেতন মন তৎপর হয়ে উঠল হঠাৎই। তানহাকে অন্য কেউ চেকাপ করবে সেটা তার মন মানতেই নারাজ। আর একজন মেয়ের পরেই তানহার নাম্বার। অপরাহ্ন তড়িঘড়ি করে পাশের সহকারী ডাক্তার, আাসাদকে বলল,
“শোনো আসাদ, তুমি আমার সাইডটা দেখোতো একটু। আসলে উনার সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছিনা ঠিকমতো। তুমি ভালো পারবে। ততক্ষণে আমি তোমার সাইড দেখছি।”
অপরাহ্নের কথায় আসাদ বোধহয় বিস্মিত হলো বটে। এতো বিজ্ঞ ডক্টর কিনা জুনিয়র ডাক্তারকে বলছে সে বুঝতে পারছেনা! বিষয়টা হজম করতে অনেকটা কষ্ট হলেও সিনিয়রের সামনে তা ব্যাক্ত করতে পারলোনা। অপরাহ্নের কথা মেনে সে মেনস সাইডে চলে এলো। আর অপরাহ্ন তার জায়গায় উইমেন সাইডে এসে বসলো। অপরাহ্ন বসতেই তানহার নাম্বার এলো। সে এসে বসলো অপরাহ্নের সামনে। অপরাহ্নকে এই জায়গায় দেখে তানহা চশমার কোন ঠেলে সৌজন্যমূলক মুচকি হাসলো। অন্য ডাক্তারের জায়গায় অপরাহ্নকে দেখে তানহারও যেন কোথাও না কোথাও ভালো লাগলো। অন্য কারো সামনে কম্ফোর্টেবল হতে পারতোনা সে। তবে এসাইনমেন্টের কাজে অপরাহ্নের সাথে গত কয়দিনে অনেকটাই কম্ফোর্টেবল হয়ে গেছে তানহা। এসাইনমেন্টের কথায় মনে পড়লো তানহার,সেতো এসাইনমেন্টে সহযোগিতার জন্য লোকটাকে আর ধন্যবাদও জানায়নি। উনার সহযোগিতার কারণেই তানহার প্রজেক্ট সবচেয়ে ভালো হয়েছে ক্লাসে। স্যার অনেক প্রশংসাও করেছে ওর। অথচ উনাকে এরপর আর ধন্যবাদই দেওয়া হয়নি। আজই বলে দিবে বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো।

অপরাহ্ন তানহার চেকাপ করতে করতে মুচকি হেঁসে বলল,
“কেমন আছ? স্বাস্থ্য ঠিক আছে তো?”
“জি,ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই।”
অপরাহ্ন তানহার হাতে বিপি মেশিন লাগিয়ে বিপি মেপে বলল,
“হুম,বিপিতো লো। খাওয়া দাওয়া করোনা ঠিকমতো? মনে হচ্ছে আন্টিকে জানাতে হবে তার মেয়ের বিপি পরিক্ষায় কম মার্ক আসার ব্যাপারে।”
তানহা স্মিথ হেঁসে বলল,
“না না এমনটা ভুলেও করবেন না প্লিজ। নাহলে মা আমাকে সোজা খাবারের ডেক্সিতেই বসিয়ে দিবে।”
হাসলো অপরাহ্ন। তানহা ওর কাছে থাকলে যেন পাগলের মতো অকারণেই হাসতে মন চায় ওর। মেয়েটা যে ওকে দিন দিন পাগলের কাতারে ফেলে ঠেলে দিচ্ছে তা ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে ৷ ডক্টর হয়েও শেষমেশ রুগিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে সে। সেদিন দূর নেই যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গান গাইবে, ♬ রুগী হইলাম তোর কারণে, পরানের বান্ধব রে বান্ধব, রুগী হইলাম তোর কারণে।

চেকাপ শেষে তানহা বলল,
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সহযোগিতায় আমার এসাইনমেন্ট ক্লাসে সবচেয়ে বেস্ট সিলেক্ট হয়েছে। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
“শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবেনা বুঝেছ! এমন খড়খড়ে ধন্যবাদে কাজ হবে না।আমি আবার এসব ব্যাপারে খুব ঘুষখোর। পয়সা খরচ করতে হবে। ট্রিট দিতে পারলে বলো। নাহলে কাজ হবে না।”
তানহা মুচকি হেঁসে বলল,
“ঠিক আছে বলুন কীভাবে ট্রিট দিবো? কি খাবেন বলেন?”,
” বলবো,কলেজ শেষে গেটের কাছে ওয়েট কোরো।ততক্ষণে আমার ক্যাম্পেইন শেষ হয়ে যাবে। তারপর বলবো কোথায়, কি খাবো। যদি সমস্যা না থাকে আরকি।”
“সমস্যা নেই। আমি ওয়েট করবো।”

যথা সময়ে তানহা ক্লাস শেষ করে গেটের কাছে এসে দাঁড়াল অপরাহ্নের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পরই অপরাহ্ন তার বাইক নিয়ে হাজির হলো তানহার সামনে। তানহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাইকে বসতে সমস্যা হবে নাতো! সমস্যা হলে আমরা রিক্সা নিতে পারি।”
তানহার ভেতরে ভেতরে একটু ইতস্তত লাগলেও সে নরম সুরে বলল,
“সমস্যা হবে না।নাহলে আপনাকে আবার বাইক নিতে ফিরে আসতে হবে।”
অপরাহ্ন মনে মনে প্রফুল্লিত হলো। যদিও তার বাইক নিতে কোনো সমস্যা হতো না। তবে তানহা ওর বাইকে বসবে, এই অভূতপূর্ব অনুভূতিটার লোভ তাকে কিছুটা স্বার্থপর করে দিলো। তাইতো এতো তালবাহানা তার। মেয়েটার জন্য শেষমেশ ডক্টর অপরাহ্ন ছ্যাচড়া রোমিওতে পরিণত হচ্ছে। তানহা কাচুমাচু ভঙ্গিতে আস্তে করে অপরাহ্নের বাইকের পেছনে দুই পা একপাশে ঝুলিয়ে উঠে বসলো। অপরাহ্নের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলো। যদিও বাইকে উঠার অভিজ্ঞতা আছে তার৷ নিবিড় আর তাসান ভাইয়ার, বাইকে অনেকবার উঠেছে সে। তবে অপরাহ্নের সাথে এভাবে বাইকে বসে কেমন অন্যরকম একটা নার্ভাসনেস কাজ করছে ওর। বুকের মাঝে দুরুদুরু করছে যেন। অপরাহ্ন বলল,
“ঠিক করে বসেছ? স্টার্ট দিবো?
” জি।”
তানহা বাইকের একেবারে পেছনে এসে অল্প জায়গার উপর কোনরকমে বসেছিল। তাই অপরাহ্ন বাইক স্টার্ট দিয়ে অগ্রসর হতেই তানহা ব্যালেন্স রাখতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে অপরাহ্নের কাঁধের উপর গিয়ে পড়লো। দুই হাতে অপরাহ্নের কাঁধ আঁকড়ে ধরে নিজেকে বাঁচাল সে। অপরাহ্ন বাইক থামিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“ঠিক আছ তুমি? ”
তানহা দ্রুত সোজা হয়ে বসে চশমা ঠেলে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ ঠিক আছে আমি। সরি। ”
“আরে সরি কেন বলছ? আর এবার একটু আরাম করে বসো যাতে পড়ে না যাও।”
তানহা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো। অপরাহ্ন আবার বাইক স্টার্ট দিলো। তানহার আবারও কেমন ব্যালেন্স টলমল করছে। শেষমেশ আর উপায় না পেয়ে এক হাত অপরাহ্নের কাঁধে রেখে অপরাহ্নের কাঁধের সাপোর্ট নিতে বাধ্য হলো। অপরাহ্ন সেটা বুঝতেই সামনের মিররে তাকিয়ে তার কাঁধে রাখা তানহার কোমল হাতখানি দেখতে পেল। ঠোঁটের কোণের হাসির রেখাটা আপনাআপনিই বিস্তৃত হয়ে গেল। আজ যেন ওর বাইকটাও নিজের উপর গর্বিত হচ্ছে। শ্যামকন্যার সান্নিধ্য পেয়েছে যে সে। আর অপরাহ্নের অনুভূতিতো ঝুম বৃষ্টির মতো ঝড়ে পড়ছে। মন চায় এই পথ যেন কখনো শেষ না হয়। চাশমিশটাকে এভাবে সাথে নিয়ে আজীবন ঘুরে বেড়ালে মন্দ হবে না।
__

বিকাল বেলা, তানি সোফায় বসে মটরশুঁটি সিলছে। আর তার কোলের উপরে মাথা রেখে শুয়ে থেকে টিভি দেখছিল আদ্রিতা৷ টিভিতে তেমন ইন্টারেস্টিং কিছু না থাকায় বোর হয়ে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো সে। কিছুক্ষণ পরই সেখানে আবিরের আবির্ভাব ঘটলো। সে এসেই তানির গা ঘেঁষে বসে ফট করে তানির গালে চুমু খেয়ে বসলো। আচমকা এহেন কাজে তানি হকচকিয়ে উঠে আবিরের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে চাপা স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“এই কি করছ! বয়সের সাথে সাথে কি আক্কেল জ্ঞান সব লোপ পাচ্ছে তোমার! দেখছনা অরি আছে এখানে!”
আবির ভাবলেশহীন ভাবে এক হাতে তানির কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
“আরে ধুরর! অরিতো ঘুমিয়ে গেছে। ওর কানে এখন ড্রামস বাজালেও টের পাবেনা। চিন্তা কোরোনা। আচ্ছা শোননা, আমার না আজ অনেক জোরে প্রেম প্রেম পাচ্ছে বুঝেছ! চলনা একটু প্রেম করি!”
“বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে ধরেছে তোমার! এই বয়সে এসব বলতে লজ্জা করে না তোমার! দুই কদম হাঁটলেই নিঃশ্বাস নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে, আবার প্রেম! ”
“দেখ কথায় কথায় বুড়ো বলা এটা তোমার মুদ্রা দোষ হয়ে যাচ্ছে। আরে মন দেখ মন! মন থেকে আমি এখনো সেই দ্য গ্রেট হট হ্যান্ডসাম, লাখো মেয়ের একমাত্র ক্রাশ আবিরই আছি। আরে ভাই ভাবিকে দেখ, এখনো হানিমুন করে বেড়াচ্ছে। আর এক তুমি! ছেলে মেয়েকে দেখতে গিয়ে এই আমাকে তো তুমি ভুলেই গেছ। একটুও ভালোবাসনা আর।”
“হইছে, আর মেলোড্রামার দোকান খুলতে হবে না।”
“তাহলে চলো প্রেম করি।”
বলেই আবারও তানির গালে টুপ করে আরেকটা চুমু খেয়ে বসলো।তানি চোখ পাকড়িয়ে বলল,
“পাগল হয়ে গেছ! অরি দেখে ফেললে কি ভাববে!”

তখনই হঠাৎ আদ্রিতা ফট করে বলে উঠল,
“আমি কিছুই দেখিনি সোণা মা, তোমরা কন্টিনিউ করো।”
আদ্রিতার কথায় ঝট করে তানিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আবির। তড়িঘড়ি করে ফোন কানে নিয়ে হ্যালো হ্যালো করতে করতে কেটে পড়লো সে। তানি বেচারিও অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আবিরের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। অসভ্য লোকটার জন্য মেয়ের সামনে লজ্জায় পড়তে হলো তাকে। আদ্রিতা উঠে বসে তানিকে টিজ করে বলল,
“এটা কিন্তু ঠিক না সোনা মা, বেচারা চাচ্চুর কত জোরে প্রেম পাচ্ছিল। আর তুমি তাকে একটুও প্রেম দিলে না!”
তানি আদ্রিতার মাথায় আলতো করে চাটি মেরে বলল,
“চুপ বদমাশ। অনেক দুষ্টু হয়ে গেছিস।”

হি হি করে হেঁসে উঠল আদ্রিতা। কিছুক্ষণ পর জুহি এসে বলল,
“অরি আমার সাথে একটু মার্কেটে চলনা! কিছু কেনাকাটা করতে হবে।ফিরোজের ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তিন্নিকে একা সামলাতে পারিনা আমি। একটু চল আমার সাথে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে চলো। আমি এখুনি রেডি হয়ে আসছি।”
__

ছোটবেলার এক বন্ধুর বিয়েতে এসেছে নিবিড়। অপরাহ্নের সাথে এসেছে সে। এখানে স্কুল লাইফের আরও অনেক ফ্রেন্ডরাও এসেছে। অনেকটা রিইউনিয়নের মতো মহল জমেছে। অনেক বছর পর সবার সাথে আবার মিলিত হয়ে অনেক ভালো লাগছে নিবিড়ের। অপরাহ্ন কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে উঠলো,
“ইয়ার এই ঘেঁচুটার কপালে বউ কীভাবে জুটলো! এটাযে মরদ জাতিতে পরে এটা নিয়েইতো আমার সন্দেহ আছে।”
এক বন্ধু জমির বলে উঠলো,
“তোর আবার সন্দেহ কেন জাগলো! ঘটনা কি মামু! তুই কি হ্যার লগে প্রাকটিস প্রক্রিয়া করছিলি নাকি!”
“অসতাগফিরুল্লা! জমির! আমারে কি তোর “গে” মনে হয়! হালা জুঙ্গলি কোনহানকার! সারাজীবন জুঙ্গলির জুঙ্গলিই থেকে গেলি। মাখামাখিও করস জুঙ্গলি মাইয়াগো লগেই। ”
“কি আর করমু ভাই! আমরা তো আর নিবিড়ের মতো হলিউড হিরো টাইপ না। আমগো লাইগা কি আর অ্যাঞ্জেলিনা জলি অপেক্ষা করবো নাকি। আমগো মতো মিসকিনদের তো একটাই ফান্ডা। পার্টির সবচেয়ে সস্তা আইটেম দেখে লাইন মারো। ফটাফট পটেও যায় আর প্রেমে ছ্যাঁকাও দেয়না।”
জমিরের সাথে সায় দিয়ে আরেক বন্ধু কবির বলে উঠলো,
“হ ভাই জমিইরা ঠিকই কইছে। হালার মাইয়াগুলা নিবিড়ারে পাইলে ভ্যানিটি ব্যাগে তুইলা নিয়া যায়। কলেজের একটা মাইয়াও ওই বেটার জন্য আমগো দিকে ফিরাও তাকাইতো না। ভালো হইছে শালা বিদেশ চলে গিয়েছিল। নাহলে দেশের পোলারা আর মাইয়া পাইতো না।”
অপরাহ্ন বলে উঠলো,
“মাইয়ারা যতই হায়হুতাশ করুক, তাগো হাতে খালি ছাইই পড়বে। নিবিড় তার পিচ্চি বউ ছাড়া পর নারীতে নজর দেয়না। ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করা বউ কি আর সবার কপালে জোটে নাকি!”
আরেকজন বলে উঠলো,
“হ্যাঁরে ভাই তা আর বলতে। তোদের সেই অনামিকার কথা মনে আছে? কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মাইয়া ছিল সে। এই মাইয়াতো নিবিড়ের জন্য একেবারে দিওয়ানি হয়ে গিয়েছিল। কতভাবে যে নিবিড়ের মন পাওয়ার চেষ্টা করছে বেচারি। হাত কেটে, র,ক্ত দিয়ে লাভ লেটার পর্যন্ত লিখেছে। কিন্তু আমগো হিরো সাহেবতো অন্য জগতের প্রাণী। একবার তার দিকে তাকিয়েও দেখেনি। বিদেশে চলে যাওয়ার পরও বেচারি বারবার এসে তোর কথা জিজ্ঞেস করতো। তারপর হঠাৎ আর কলেজেই আসা বন্ধ করে দিলো। নিবিড় সাহেবের জন্য বেচারির দিল টুট গায়া।”
সবার হাসি ঠাট্টায় নিবিড় শুধুই স্মিথ হাসে। আদ্রিতার ভাষায় হাসিতে তার কার্পণ্য আছে। অপরাহ্ন কিছুটা দূরে অনেকটা ভীতু চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে ইশারা করে নিবিড়কে বলল,
“ওই দেখ, চিনতে পেরেছিস ওকে!
নিবিড় সেদিকে তাকিয়ে বলল,
” উহুম, কে ও?”
“আরে ভাই ভুলে গেলি! এইডারে হাত পা বেঁধে বট গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখছিলি সারারাত। কারণ সে তোর পিচ্চিরে দেখে মজা করে বউ বলে আদর করে গাল টেনে দিয়েছিল বলে। বেচারা! আজও সে বটগাছ দেখলেই ভয়ে দৌড় দেয়। নিজের বউরেও বউ কইয়া ডাকবোনা ভয়ে।তোর ভয়ানক রুপের দর্শন যার একবার হয়েছে, সেকি আর আজীবনও ভুলতে পারে! দেখছ না তোরে দেইখাই বেচারার হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেছে।”
জমির বলে উঠলো,
“খালি কি এই বেচারা নাকি! তোর ত্রাসের শিকার কত লোক হয়েছে তার হিসেব আছে নাকি!”
নিবিড় কিছু বললো না। বরাবরের মতোই স্মিথ হেঁসে কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাসে চুমুক দিলো। হঠাৎ জমির ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখে বলল,
“আরে এটা অরি না?”
জমিরের কথায় ভ্রু কুঁচকে আসলো নিবিড়ের। জমিরের হাত থেকে ফোন টা ঝট করে নিয়ে স্ক্রিনে নজর রাখলো সে৷ মুহুর্তেই মুখয়বের ছবি পরিবর্তিত হয়ে গেল তার। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, জোভান অরির সাথে মার্কেটের কোনো ফুড কর্নারে বসে সেলফি নিয়েছে। ক্যাপশনে লেখা, “স্পেশাল টাইম, উইথ স্পেশাল ওয়ান।”
নিবিড়ের চোখ মুখ তরতর করে তীব্র কঠিন হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতেই ফোনটাকে শক্ত করে হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো। তারপর সজোরে মাটিতে আছাড় মেরে হনহন করে ওখান থেকে বেড়িয়ে গেল। তা দেখে অপরাহ্নও ওর পিছে ছুটলো। বেচারা জমির তার সদ্য শহীদ হওয়া ফোনের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here