তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব -০৬ ও শেষ

#তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#পর্ব_৬ (অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
জিয়ান-নিতুর ছোট্ট ফ্ল্যাটটির আনাচে-কানাচে আনন্দ ও খুশির ছোঁয়া। খবর পেয়ে দু’জনের পরিবারই ছুটে এসেছে। মিষ্টিতে ভরে গেছে ঘর। নিতু স্তব্ধ, নিশ্চুপ। মা হওয়া নিয়ে তো এক সময় তার মাঝেও অনেক স্বপ্ন ছিল। তাহলে এখন সে কেন খুশি হতে পারছে না? জিয়ানের একটা ভুলের জন্য? একটা ভুল কি মনের মাঝে এতটাই দাগ কাটতে পারে?

সবাই একসঙ্গে বসে আছে। নিতুর মা মমতা বেগম বললেন,

“জিয়ান, নিতুকে তাহলে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই এখন? তুমি তো সারাদিন অফিসে থাকো। ওর দেখভাল করার জন্য তো কাউকে প্রয়োজন।”

জিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল,

“না, মা। নিতু আমার কাছেই থাকবে। আমি ওর দেখাশোনা করার জন্য আলাদা লোক রাখব।”

নিতু এই প্রসঙ্গে কিছুই বলল না। সে এখানেই থাকুক কিংবা বাপের বাড়িতেই থাকুক না কেন তা নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নিতুর বাবা-মা এতটুকু বুঝতে পেরেছে এতদিনে, জিয়ান তাদের মেয়েটাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে! সত্যি বলতে এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান দুই পরিবারেরই ছিল। বাচ্চা হলে হয়তো নিতু আর এমন থাকবে না। তার মন পালটে যাবে। আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। জিয়ান খুব করে চায়, তার নিতু আগের মতো হয়ে যাক। তাই তো এভাবে বাচ্চা নেওয়া। কেউ আর নিতুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করল না। মাঝে মাঝে তারা এসে কয়েকদিন করে থেকে যাবে। নিতুর মা যাওয়ার পূর্বে মেয়ের হাতে চুমু খেলেন। তার চোখে অশ্রু। আনন্দের অশ্রু। তার সেই ছোটো মেয়েটা কত বড়ো হয়ে গেছে! তার চোখের দৃশ্যপটে এখনও ভাসছে এইতো কিছুদিন আগেও মেয়েটা তার আঁচল ধরে ঘুরত। সারাক্ষণ মা, মা ডেকে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলত। আর সেই মেয়েটাই এখন মা হবে। তাই আনন্দে, খুশিতে চোখে পানি এসে পড়েছে। তিনি নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“এবার একটু স্বাভাবিক হ মা। আগের মতো হাসি-খুশি থাক। অতীত ভুলে যা। জিয়ান তো আর তোকে ছেড়ে যায়নি। দুনিয়ার সমস্তকিছু একদিকে আর অন্যদিকে তুই। কেন জেদ করে শুধু শুধু ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছিস আর নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস? জীবনটা ভীষণ ছোট্ট রে মা। এক জীবনে যদি রাগ-অভিমান করেই সময় নষ্ট করে ফেলিস তাহলে ভালো আর থাকবি কবে? নিজের ভালো থাকাটা নিজেরই তৈরি করে নিতে হয়। অন্য কেউ তোর ভালো থাকা তৈরি করতে পারবে না। আমার কথাগুলো একটু শুনিস মা। নিজের যত্ন নিস। খাওয়া-দাওয়া করিস ঠিকমতো। এখন আর তুই কিন্তু একা না। তোর মাঝে আরেকটা প্রাণ বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। নিজের জন্য না হলেও ওর জন্য তোকে ভালো থাকতে হবে।”

নিতু মায়ের সবগুলো কথা চুপচাপ শুনে গেছে শুধু। সবাই চলে যাওয়ার পর আবার বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। দু’দিনের ভেতরেই জিয়ান ১৯/২০ বছরের একটা মেয়ে ঠিক করে। জিয়ান অফিস থেকে না আসা অব্দি শুধু মেয়েটা নিতুর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে এবং খেয়াল রাখবে। আরেকজন কাজের খালা ঠিক করে যিনি তিনবেলা এসে শুধু বাড়ির কাজ করে যাবে।

নিতুর মাঝে আরেকটা প্রাণ আছে এটা সে মন থেকে অনুভব করতে পারে না। হয়তো এমনিতেও এই অনুভূতি হতো না, যদি না প্রেগন্যান্সীর সিনড্রোম তার মাঝে দেখা যেত। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই তার অস্বস্তি শুরু হয়। কিছুই খেতে পারে না। সারাক্ষণ মুখ তিতকুটে হয়ে থাকে। পেটে কিছুই থাকে না তবুও সারাক্ষণ বমি, বমি একটা ভাব থাকে। মাথা কেমন ঝিমঝিম করে। তেঁতুল ছাড়া আর কিছুই তার ভালো লাগে না। যেকোনো খাবারের গন্ধই তার বিরক্ত লাগে। বিশেষ করে মাছের গন্ধ সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। এজন্য জিয়ান বাড়িতে মাছ আনা বন্ধ করে দিয়েছে। সে নিজেও নিতুর জন্য মাছ খায় না। নিতু যখন একা একা থাকে তখন আনমনে সে পেটের ওপর হাত রাখে। বোঝার চেষ্টা করে, এখানেই বুঝি আছে সেই ছোট্ট প্রাণ? কিন্তু মা হওয়া যে সহজ বিষয় নয়। এই যে এত এত অসহ্য যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হচ্ছে এগুলো তো সে আগে কখনও অনুভব করেনি। তবে এখন জিয়ানের কেয়ার করার পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। এক কথায় বলতে গেলে, নিতুকে সে চোখে হারায়। দুই একদিন পরপরই বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ী, বোন-দুলাভাই এসে নিতুকে দেখে যায়। আসার সময় একগাদা করে খাবার নিয়ে আসে। এত খাবার দেখে গা গুলিয়ে ওঠে নিতুর।

নিতু যে মা হচ্ছে, তার মাঝেও যে আরেকটা প্রাণ আছে এটা সে সত্যিকার অর্থে মন থেকে অনুভব করে একদিন মাঝরাতে। হঠাৎ করেই সে পেটে আঘাত পায়। ঘুমের ঘোরে তখন বুঝতে না পারলেও ঘুম ভাঙার পরে বুঝতে পারল, তার সেই ছোট্ট প্রাণ পেটে কি-ক দিচ্ছে। সে ব্যথা পাচ্ছে তবুও অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে তার মাঝে। সে তার বড়ো পেটটির ওপর হাত রাখল। এইতো আবারও কি-ক দিল! নিতু উঠে বসতে চাইল। কিন্তু একা উঠতে, বসতে, শুতে তার এখন অনেক সমস্যা হয়। সে জিয়ানকে ডেকে তুলল। জিয়ান কিছুটা ভয় পেয়ে বলল,

“কী হয়েছে? কিছু লাগবে?”

নিতু ক্ষীণস্বরে বলল,

“আমি বসব।”

জিয়ান নিতুকে ধরে বালিশের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। নিতুর এক হাত ধরে বলল,

“খারাপ লাগছে?”

নিতু কিছু বলল না। জিয়ানের হাতটা নিজের পেটের ওপর রাখল। জিয়ান আনন্দ চিৎকার করে বলল,

“বাবু কি-ক দিচ্ছে!”

নিচু ছলছল নয়নে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। নীল রঙের ডিম লাইটের মৃদু আলোতে নিতুর হাসি, ছলছল করা নয়ন সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল জিয়ান। সে নিতুর পেটে আলতো করে চুমু খেয়ে নিতুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। এভাবে কতটা সময় পার হয়েছে কেউই জানে না। নিতুর সকল অভিমান, গ্লানি, কষ্ট মনে হচ্ছে আজ নেই হয়ে গেছে। নতুন প্রাণের অস্তিস্ত তাকেও নতুন একটা জীবন উপহার দিয়েছে। জিয়ানের বুকে মাথা রেখেই নিতু বলল,

“বাচ্চা হওয়ার সময় তো অনেক মেয়েরা মা-রা যায়। যদি আমি মা-রা যাই আপনি কী করবেন?”

জিয়ানের বুক কেঁপে ওঠে। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার বাঁধন। মৃদু ধমকেরসুরে বলে,

“একদম আজেবাজে কথা বলবে না নিতু। এসব কথা আমার একদম ভালো লাগে না।”

“এগুলো তো সত্যি কথা। আপনিই বলেন, এমনটা কি হয় না?”

“হলে হয়। কিন্তু আমার নিতুর সাথে এমনটা কখনও হবে না। আমার আল্লাহ্ এত নিষ্ঠুর না।”

নিতুর গলা ধরে আসছে। এর আগে তো কখনও তার এমনটা অনুভব হয়নি। মা-রা যাওয়ার কথা তাহলে আজই কেন মনে এলো? এই সুন্দর মুহূর্তেই কেন? হারানোর ব্যথায় বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই যদি সে ম-রে যায় তখন তাহলে জিয়ানের কী হবে? সে কি তার অনাগত বাবুটাকে দেখেও ম-র-তে পারবে না? সে তো জিয়ানের থেকে হারিয়ে যেতে চায় না এভাবে।

নিতু কণ্ঠস্বর শক্ত করে বলল,

“যদি ডাক্তার বলে, বাচ্চা আর মায়ের মধ্যে যেকোনো একজনকে বাঁচানো যাবে তাহলে আপনি কাকে বাঁচাবেন তখন? খবরদার! ভুলেও কিন্তু আমাকে বাঁচানোর কথা বলবেন না। আমি তো অনেকটা সময় পৃথিবীতে থেকেছি। পৃথিবীর আলো দেখেছি। কিন্তু আমাদের বেবি তো দেখেনি। কথা দিন, এমন সিচুয়েশন এলে আপনি ওকেই এই পৃথিবী দেখার সুযোগ করে দেবেন?”

জিয়ান এবার কেঁদে ফেলে। নিতুর মুখ চেপে ধরে বলে,

“চুপ! এসব কথা একদম বলবে না। এমন কিছুই হবে না। আমি কাউকেই হারাতে চাই না। হারাতে পারবও না। আমার তোমাকেও লাগবে আর আমাদের বেবিকেও। কত স্বপ্ন আছে আমাদের। আমরা তিনজনে একসাথে সেই স্বপ্ন পূরণ করব।”

“স্বপ্ন আমারও আছে। কিন্তু…”

জিয়ান নিতুকে থামিয়ে দিতে নিতুর ঠোঁটে গভীর চুম্বন দিল। আর কোনো কিন্তু সে মাঝে আনতে চায় না। নিতু তার। সর্বদা নিতুকে তার কাছেই থাকতে হবে।
_______
সকালে জিয়ান ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে নিল। অফিসে যাওয়ার পূর্বে নিতুকেও উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে অল্পকিছু খাবার খাইয়ে দিল। এর মাঝেই নিতুর দেখাশোনা করা মেয়েটি চলে আসে। ওর নাম শাপলা। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমনই ওর যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা। জিয়ান বাসায় আসার আগ অব্দি নিতুর সময়টা শাপলার সাথে বেশ ভালোভাবেই কেটে যায়।

“শাপলা, নিতুর কিন্তু ভালোভাবে খেয়াল রাখবে। ও খেতে চায় না জানোই তো। জোর করে হলেও খাওয়াবে। আর যেকোনো প্রয়োজনে যখন দরকার হবে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কল করবে। মনে থাকবে?”

শাপলার উদ্দেশ্যে বলল জিয়ান। শাপলা মাথা দুলিয়ে বলল,

“হ ভাইজান, মনে থাকব। আমার আর কী মনে থাকব, আপনে তো একটু পরপর নিজেই ফোন কইরা আপার খোঁজখবর নেন।”

জিয়ান নিতুর দিকে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জা পেল। সে শাপলাকে বলল,

“রান্নাঘর থেকে ওকে দুধটা এনে দাও।”

শাপলা রান্নাঘরে চলে গেল। নিতু বলল,

“একটু আগেই না দুধ খেলাম?”

জিয়ান নিতুর কাছে এগিয়ে বসল। দু’হাত ধরে বলল,

“হ্যাঁ। ওর সামনে তো আর বউকে চুমু খাওয়া যাবে না। একটা চুমু খাই?”

নিতু হেসে ফেলে। দৃষ্টি নামিয়ে বলে,

“আজ যে খুব অনুমতি নেওয়া হচ্ছে? এতদিন কি আপনি চুমু খাননি? প্রতিদিনই তো অফিসে যাওয়ার আগে ঘুমের মধ্যে চুমু খেয়ে যেতেন।”

জিয়ান অবাক হয়ে শুধায়,

“তুমি জানলে কীভাবে? তুমি তাহলে তখন জেগেই থাকতে?”

“উঁহু! জেগে যেতাম আপনার স্পর্শে।”

জিয়ান হাসে। প্রশান্তির হাসি। নিতুর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে সে জড়িয়ে ধরে। শাপলার আসার পায়ের শব্দ শুনে ছেড়ে দেয়। গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,

“নিজের খেয়াল রেখো জান। আসছি।”

“সাবধানে যাবেন।”

জিয়ান অফিসে চলে যায়। শাপলা দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,

“আপা,নেন।”

“রেখে দাও। পরে খাব।”

“পরে ক্যান? ভাইজান কইছে, এখনই খাওয়াইতে। আপনে এখনই খাইবেন।”

“তোমার ভাইয়া একটু আগেই খাইয়ে গেছে। এখন আর পেটে জায়গা নেই।”

“অল্প হইলেও খাইতে হইব। ভাইজান আমারে দায়িত্ব দিয়া গেছে না?”

নিতু বুঝল, শাপলা নাছোড়বান্দা। তাই সে কয়েক ঢোক খেয়ে টেবিলের ওপর গ্লাসটি রেখে দিল। শাপলাকে ধরে সে খাট থেকে নিচে নামে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের উঁচু পেটের ওপর হাত রেখে আনমনেই মুচকি হাসে। পেটে হাত বুলিয়ে বলে,

“বলো তো শাপলা, আমাদের ছেলে হবে নাকি মেয়ে?”

শাপলা মাথা চুলকে ভাবুক হয়ে বলল,

“উমম! মেয়ে। আপনাগো পরীর লাহান একটা মাইয়া হইব।”

“কেন বলো তো? ছেলে হবে না কেন? তোমার ভাইয়াও বলে মেয়ে হবে।”

“জানি না তো। আমার মন কইল তাই কইলাম। আপা, এহন তো আলতা না কী জানি করে। আপনে করেন নাই? তাইলেই তো জানতে পারতেন, পোলা হইব নাকি মাইয়া।”

নিতু হেসে বলল,

“আলট্রা সনোগ্রাফি। এখনও করিনি। তোমার ভাইয়া অনেকবার বলেছে। রাজি হইনি।”

“ক্যান?”

“সে তো অনেক কারণ। পরে অবশ্য ভেবেছিলাম, সারপ্রাইজ থাকুক। বাবু হওয়ার পরই জানা যাবে। কিন্তু এখন বাবা-মা, আব্বু-আম্মু সবাই জোর করছে। বাবু কেমন আছে সেটাও তো জানতে হবে। তাই এই শুক্রবার যাব বলেছি।”

“ভালো হইব। তাইলে জানা যাইব।”

নিতু হঠাৎ পেটে হাত রেখে আর্তনাদ ওরে ওঠে। শাপলা ভয় পেয়ে যায়। উঠে গিয়ে নিতুকে ধরে বিছানায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“আপা কী হইছে? ভাইয়ারে ফোন দিমু?”

নিতু শাপলার হাত চেপে ধরে মৃদুস্বরে বলল,

“আহা! ব্যস্ত হচ্ছো কেন? কিছু হয়নি আমার।”

“তাইলে আপনে এমন করতাছেন ক্যান?”

“পেটের ভেতর বাবু কি-ক দিচ্ছে।”

“কী দিতাছে?”

“লা-থি দিচ্ছে। এবার বুঝেছ?”

শাপলা হেসে বলে,

“ওহ। এবার বুঝছি। আমি একটু দেহি?”

নিতু হেসে বলে,

“দেখো।”

শাপলা নিতুর পেটের ওপর হাত রাখল। বাবু কি-ক দেওয়ার পর সে আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,

“হ, হ! এইতো বাবু লা-থি দিতাছে। এহন মনে হইতাছে আপা, পোলা বাবু হইব।”

একটু থেমে সে নিতুর পেটে হাত বুলিয়ে বলল,

“এইযে দুষ্টু, মায়রে এমনে লা-থি দিতাছো ক্যান? মায় কষ্ট পায় না? শান্ত হও। শান্ত হও। চুপ করে শুয়ে থাকো।”

নিতু শাপলার কথার ধরণ শুনে খিলখিল করে হাসতে থাকে।
.
.
নিতুর এখন নয় মাস চলছে। তার চলাফেরায় বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অবশ্য এতে খুব একটা কষ্ট তাকে করতে হয় না। মমতা বেগম এবং আফরোজা বেগম দেখাশোনা করার জন্য এক মাস যাবৎ এই বাড়িতেই আছেন। যত্নের কোনো ত্রুটি রাখেনি এই দুই মা। রোজ রোজ দুই বেয়াইন গল্প জুড়ে দেয় তাদের নাতিনকে নিয়ে। রাজপুত্র আসবে বাড়িতে। কতশত নাম ভেবে রেখেছে সবাই। কিন্তু এখনো কোনো নাম ফাইনাল করা হয়নি।

জিয়ান অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। নিতু খাটের ওপর হেলান দিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি জিয়ানের দিকে। জিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জিজ্ঞেস করল,

“কিছু বলবে?”

নিতু মুখ গোমড়া করে বলল,

“এখনো তো আমাদের ছেলের কোনো নাম রাখা হলো না।”

জিয়ান হেসে বলল,

“রাখব তো। সবাই কত কত নাম রাখছে। একটা না একটা সিলেক্ট তো করা হবেই।”

“সেটা কবে?”

“উমম! যেদিন আমাদের বাবু দুনিয়াতে আসবে। সেদিন ওর মুখ দেখার পর যেই নামটা আমার প্রথম মনে আসবে সেই নামটাই রাখব।”

“বাবুকে কি সবার আগে আপনি কোলে নেবেন?”

“জানিনা। সবার আগে আমি তোমাকে দেখব। তুমি সুস্থ আছো কিনা সেটা জানা বেশি জরুরী আমার।”

“যদি দেখেন আমি মা-রা গেছি?”

জিয়ানের মুখের রঙ পাল্টে যায়। সে চোখ-মুখ শক্ত করে বলে,

“তোমার এসব কথা আমার ভালো লাগে না নিতু। আর কতবার বলব তোমায় এ কথা? কেন এভাবে আমাকে কষ্ট দাও তুমি?”

নিতু চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,

“আচ্ছা সরি। আর বলব না। একটু কাছে আসেন।”

জিয়ান কাছে এসে বসল। নিতুর চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল,

“আমি তোমায় হারাতে পারব না। কেন বোঝো না তুমি?”

নিতু এবার আর কিছু বলল না। নিঃশব্দে মাথা রাখল জিয়ানের বুকে। মিনিট পাঁচেক পর জিয়ান ঘড়ি দেখল। অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সে বলল,

“নিতু, আজকে অফিসে না যাই?”

নিতু মাথা তুলে বলল,

“কেন?”

“তোমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।”

“ইশ! ঢং।”

জিয়ান হেসে নিতুর কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“আচ্ছা যাচ্ছি আমি। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ্ হাফেজ।”

জিয়ান অফিসে যাওয়ার পর নিতু মা, শাশুড়ি এবং শাপলার সাথে বসে গল্প করছিল। আচার খাওয়ার সময় নিতুর লেবার পেইন উঠে। তৎক্ষণাৎ নিতুকে হাসপাতালে আনা হয়। প্রচন্ড ব্যথায় সে চিৎকার করে কাঁদছিল এবং বারবার জিয়ানকে দেখার জন্য আর্তনাদ করছিল। আফরোজা বেগম নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“একটু সহ্য করো মা! জিয়ানকে ফোন করেছে তোমার বাবা। ও এখনই আসছে।”

নিতুর নরমালে ফুটফুটে একটা সুন্দর ছেলে বাবু হয়েছে। ঠিক যেন রাজপুত্র। ডাক্তার এবং নার্স বাইরে এসে দেখলেন কারও মুখে কোনো হাসি নেই। সবার চোখে পানি। ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বললেন,

“আপনারা সবাই কাঁদছেন কেন? পেশেন্ট এবং বেবি দুজনই সুস্থ আছে।”

পাশ থেকে তখন অন্য একটি নার্স এসে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে মলিনকণ্ঠে বললেন,

“স্যার, পেশেন্টের হাজবেন্ড হাসপাতালে আসার সময় রোড এ-ক্সি-ডে-ন্টে মা-রা গেছেন। এই হাসপাতালেই তাকে আনা হয়েছে।”

ডাক্তার এবং বাকি নার্স কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাদের কথা বলার মতো কোনো ভাষা নেই। ভাগ্য কি এতটাই নির্দয় হতে পারে? সদ্য নবজাতক শিশু, যে অল্প কিছুক্ষণ আগেই দুনিয়ার আলো দেখল, তার বাবা আর এই দুনিয়ায় নেই! স্ত্রী হয়তো স্বামীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। যখন জানবে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটাই আর নেই তখন কী হবে তার?

বড্ড অভিমান নিয়ে নিতু বেডে শুয়ে আছে। এই পর্যন্ত কেউ তাকে দেখতে ভেতরে এলো না। সবাই বাবুকে পেয়ে তাকে ভুলে গেছে। সবার কথা বাদ। জিয়ান! সে কী করে এমনটা করতে পারল? সকালে কী বলেছিল সব ভুলে গেছে এখন? কিন্তু মন যেন বলছিল অন্যকিছু। কোথাও একটা গড়মিল হচ্ছে। কিন্তু সেটা কী? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পূর্বেই নার্স বাবুকে এনে নিতুর কোলে দিয়ে বলল,

“ম্যাম, আপনার ছেলে। কী সুন্দর হয়েছে দেখতে!”

নিতু ছেলেকে কোলে নিয়ে জাগতিক সকল দুঃখ-ই যেন ভুলে গেল। কী আদুরে মুখ! ঠিক যেন জিয়ানের মতোই হয়েছে। নিতু অজস্র চুমু খেল। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে নার্সকে শুধাল,

“আমার কি কেউ নেই এখানে?”

“সবাই আছে ম্যাম। উনারা কিছু ফর্মালিটি নিয়ে ব্যস্ত আছেন তো। তাই আপনার কাছে আসতে পারেনি।”

“আর আমার হাজবেন্ড? সেও ব্যস্ত?”

নার্স ইতস্তত করে বলল,

“সে সম্ভবত এখনো আসেনি। সবাই আসবে। এখন আপনাকে বিশ্রাম নিতে হবে। বাবুকে আমার কাছে দিন।”

নার্সটি অন্য এক নার্সকে ইশারা করল। সে এসে নিতুকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আপাতত আর কোনো সমাধান নেই তাদের কাছে। এমতাবস্থায় জিয়ানের মৃ-ত্যু-র খবর জানানো ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু আফসোস এবং কষ্ট এতটুকুই, যেই মানুষটা জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো সেই মানুষটাকে শেষবারের মতোও দেখতে পাবে না এই হতভাগী নারী। সময়, জীবন এবং নিয়তি যখন নিষ্ঠুর হয় তখন বুঝি শেষটাও দেখিয়ে দেয়। কী নির্মম এই সত্য!

পরিশিষ্টঃ জিয়ানের মৃ-ত্যু-র খবর পেয়েছে নিতু একদিন পর। জিয়ানকে কবর দেওয়া হয়েছে বাড়িতেই। নিতুর অবস্থা পাগলপ্রায়। সে কবরের ওপর মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদছে। আর্তনাদ করে বলছে,

“বারবার কেন ঠকান আমায়? প্রথমবার ক্ষমা করলেও এবার আর আপনাকে আমি ক্ষমা করব না। তিনজনের একসঙ্গে বাঁচার কথা ছিল, একসাথে স্বপ্ন পূরণ করার কথা ছিল? তাহলে কেন চলে গেলেন আমাদের একা করে? কী করে থাকব আমি আপনাকে ছাড়া? আপনার মতো করে আমাকে আর কে ভালোবাসবে? আপনি তো আমায় জীবন্ত লা-শ বানিয়ে গেলেন। জীবন্ত লা-শ! আমি যে বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই। খুব তো রাগ করতেন আমি ম-রা-র কথা বললে। আর এখন আপনি কী করে পারলেন আমায় এভাবে ছেড়ে যেতে? আমি তো হাজারবার বলেও যাইনি। আর আপনি একবারও না বলে চলে গেলেন এভাবে আমাকে নিঃস্ব করে। বাবুকে প্রথম কোলে নিয়ে নাম দেওয়ার কথা ছিল না? কই আপনি তো কোনো নাম দিলেন না। আপনি কোনো কথাই রাখেননি। আপনি মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদী!”

নিতুর গলা ভেঙে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। তার চারপাশে বসে রয়েছে সবাই। সবার মাঝে থেকেও সে একা। কেউই তাকে মানাতে পারছে না। সরাতে পারছে না এখান থেকে। কবরের ওপর মাথা রেখে নিতু ফুঁপিয়ে বলে,

“আপনাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি জানেন? কখনো বলা হয়নি। বলার সুযোগটাও দিলেন না আমায়। আপনাকে ছাড়া এমন দ্বিধা নিয়ে আমি বাঁচব কী করে বলতে পারেন?”

(সমাপ্ত)

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।

বিঃদ্রঃ অনিচ্ছা সত্ত্বেও লেখালেখিতে অনিয়মিত হয়ে গেছি। জব, স্টাডি, লেখালেখি সব একসাথে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। তাই গল্প লেখারও ফুরসত, মনোযোগ মিলছে না। যার দরুণ দীর্ঘ গ্যাপে হয়তো লেখায় ছন্দপতন ঘটছে। মাধুর্যও নষ্ট হচ্ছে। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here