তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব -০৪

#তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
সকালে সূর্যের মিঠে আলো চোখে-মুখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল নিতুর। সে চোখ-মুখ কুঁচকে উঠে বসল। ঝাপসা দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বু্লিয়ে বোঝার চেষ্টা করল এই মুহূর্তে সে কোথায় আছে। এটা তো হাসপাতাল নয়। পরিপাটি করে গোছানো রুম। জানালার কাচ খোলা। মৃদু বাতাসের তোড়ে জানালার শুভ্র রঙা পর্দাটি বিরতিহীন নড়ছে। বাবা-মা কি তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে? কিন্তু এটা তো তার বাড়ি নয়। তার রুমও নয়। তবে?

সে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেল। বাইরে চোখ রাখতেই দূর-দূরান্তে শুধু গাছপালা এবং অদূরে কিছু বাসা দেখা যাচ্ছে। তবে সে যেখানেই এখন থাকুক না কেন, এই বাড়িটা তার পরিচিতি নয়। এমনকি এই জায়গাটিও নয়। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সে পেছনে ফিরে তাকাল। জিয়ানকে দেখেই তার মাথা ফের গরম হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে,

“আপনি!”

জিয়ান কী বলবে বুঝতে পারছে না। নিতুর চোখের দিকে তাকানোর সাহসও তার নেই। তবুও সে সংকোচের সহিত অপরাধীর ন্যায় নিতুর চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখে রয়েছে জিয়ানের জন্য ঘৃণা এবং সীমাহীন রাগ। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“মাথা গরম কোরো না। শান্ত হয়ে বসো। খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।”

“শান্ত হয়ে বসব মানে কী? আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন?”

জিয়ান বাইরে থেকে আনা খাবার প্লেটে ঢালতে ঢালতে বলল,

“অনেক দূরে।”

নিতু সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল,

“অনেক দূরে কোথায়? এই জায়গার নাম কী?”

“তুমি চিনবে না। নাস্তা করো।”

প্লেট সজোরে দূরে ছুঁড়ে মারল নিতু। রাগে কাঁপছে সে। জিয়ান শূন্য দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে অন্য প্লেটে নিজের জন্য আনা খাবার ঢালল। নিতু এবারও খাবার ফেলে দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই জিয়ান নিতুর হাত আলতো করে চেপে ধরল। শান্তকণ্ঠে বলল,

“খাবার এভাবে নষ্ট করা ঠিক নয় নিতু।”

“আপনি যে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন তার বেলায়?”

“তুমি এভাবে কেন বলছ? আগের বিয়ের কথা তোমার থেকে লুকিয়ে আমি ভুল করেছি। চরম অন্যায় করেছি এটা আমি মানছি। তাই বলে তোমার জীবন নষ্ট তো করিনি। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি নিতু।”

“ভালোবাসা? কোনটাকে ভালোবাসা বলছেন আপনি? যাকে মিথ্যে বলে, ঠকিয়ে বিয়ে করেছেন তাকে আবার ভালোবাসেন বলেও দাবি করছেন?”

“এই সত্যটা লুকাতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম।”

“কে বাধ্য করেছিল আপনাকে?”

“তোমার প্রতি তৈরি হওয়া আমার ভালোবাসা। তুমি যদি জানতে আমি আগে বিয়ে করেছিলাম একটা, তাহলে কি আমায় বিয়ে করতে তুমি? তোমার বাবা-মা কেন এত ভালো ভালো অপশন রেখে তোমায় আমার হাতে তুলে দিত?”

“এজন্য আপনি আমায় ঠকাবেন? মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যেই সম্পর্ক শুরু হয় সেই সম্পর্ক কখনও টিকে থাকতে পারে না। আমি আপনার সঙ্গে সংসার করব না। ডিভোর্স চাই আমার।”

জিয়ান আকুল হয়ে নিতুর হাত ধরল। তার দু’চোখ ছলছল করছে। সে বিষণ্ণ হয়ে বলল,

“যা ইচ্ছে করো নিতু। আমায় বকো, মারো যা ইচ্ছে হয়। তবুও প্লিজ আমায় ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।”

“আর আপনার সঙ্গে আমি থাকতে পারব না। আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসেন।”

“তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে কোথাও যাওয়া হবে না।”

নিতু পরিহাস করে বলল,

“আপনি আর ক্ষমা? হাহ্! কতদিন এভাবে আমাকে আপনার কাছে আটকে রাখবেন আপনি? একদিন, দু’দিন, এক মাস, এক বছর? যেদিন আমি সুযোগ পাব সেদিনই আমি চলে যাব। আপনার মতো প্রতারকের সাথে আমি কোনোমতেই সংসার করব না।”

কথার আঘাতে জর্জিত হয়েও জিয়ান কিছু বলতে পারল না। কী-ই বা বলবে সে? কী-ই বা বলার আছে? সে যা করেছে তার তুলনায় হয়তো এসব কথা কিছুই নয়। সে নিতুর জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে নিতুর কষ্ট, মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ একটাবার তার জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকে বোঝার চেষ্টা করছে না। কেউ বুঝতেই চাইছে না কতটা ভালো সে নিতুকে বাসে। জিয়ান পাশের রুমে গিয়ে বসে রইল।

নিতু ফ্লোরে বসে কাঁদছে। সে এসব কিছুই মানতে পারছে না। বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। শুরুটাই তাকে দং’শ’ন করতে শুরু করে দিয়েছে, সমাপ্তি তাহলে কেমন হবে? কতক্ষণ সে এভাবে কেঁদেছে সে জানে না। একটা সময় সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শরীরে এতটুকুও শক্তি নেই বলে মনে হচ্ছে। খুব খিদেও পেয়েছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সে খাবার খেয়ে নেয়। মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে তাকে শারীরিকভাবেও সুস্থ থাকতে হবে ভেবে সে ওষুধগুলোও খেয়ে নিল। এখান থেকে কী করে বের হওয়া যায় সেই চিন্তায় সে অস্থির হয়ে পড়েছে।

শুয়ে থাকতে থাকতে তন্দ্রাভাব চলে এসেছিল নিতুর। সেই সময়ে সে অনুভব করল কেউ কাঁদছে। সে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল ফ্লোরে বসে নিতুর হাত ধরে অঝোরে কাঁদছে জিয়ান। নিতু উঠে বসতে চাইল। বাধা দিল জিয়ান। ক্রন্দনরতস্বরে বলল,

“উঠো না। শুয়ে থাকো।”

কাঠের পুতুলের ন্যায় চুপ করে শুয়ে রইল নিতু। জিয়ান নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল,

“আমার প্রাক্তন ওয়াইফের নাম মাহিরা। ভাবির ছোটো বোন। ভাইয়া-ভাবির বিয়েটা ছিল অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। ওদের বিয়ের মাধ্যমেই মাহিরাকে আমি চিনি। সম্পর্কে বেয়াইন লাগত তাই হাসি-ঠাট্টা করতাম। ও বাসায় আসত প্রায়ই। একেক সময় একেক রকমভাবে মনের ভাব বোঝানোর চেষ্টা করত। প্রথম প্রথম আমি এসব আমলে নিতাম না। একদিন সরাসরি বলে দিল ও আমাকে ভালোবাসে। আমি সেদিন খুব একটা অবাক হইনি। কারণ ওর ভাবসাব, চোখের ভাষায় আমি আগেই বুঝেছিলাম যে ও আমাকে পছন্দ করে কিংবা ভালোবাসে। সত্যি বলতে ওকেও আমার ভালো লাগত। কিন্তু বিয়ে করার মতো ভাবনা কিংবা রিলেশন করব এসব আমি কখনও ভাবিনি। সেদিন ওর ভালোবাসার কথারও কোনো জবাব দিতে পারিনি। ও ধরে নিয়েছিল, উত্তর নেগেটিভ। তাই ভীষণ কান্নাকাটি করেছিল। আমাদের বাসায় আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার ফোন ধরত না, ম্যাসেজের রিপ্লাই করত না। পরে তখন আমি ওর একাকীত্ব অনুভব করতে শুরু করি। প্রচণ্ড মিস করতাম। একটা সময়ে ফিল করলাম, হ্যাঁ ওকে আমিও ভালোবাসি। ওকে আমার চাই। কিন্তু কীভাবে ওকে এটা বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমার দোনামোনার মাঝেই ভাবি তার বাবা-মাকে নিয়ে সরাসরি আমার বাবা-মায়ের সাথে আমার এবং মাহিরার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে বসল। আমি বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে খুশিও হয়েছিলাম। মাহিরাকে বাবা-মায়েরও ভীষণ পছন্দ ছিল। তাই তারা আপত্তি করেনি। আমাকে মতামত জানাতে বললে আমিও হ্যাঁ বলে দেই। আমাদের যখন বিয়ে হয় মাহিরা তখন ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বিয়েটা হলো একদম ঘরোয়াভাবে। একদম ঘরোয়াভাবে মানে দুই পরিবার আর আমার খুব কাছের দুই বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানত না। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীরাও নয়। কথা ছিল, মাহিরার ইন্টার কমপ্লিট হলেই অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে আর তখনই সবাইকে জানানো হবে। বিয়ের পর সময়টা যাচ্ছিল স্বপ্নের মতো। আমি নিজেই তখন ওর চেয়ে বেশি পাগল হয়ে গেছিলাম। সারাক্ষণ ওর কথা ভাবতাম। ওর সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতাম। এমনভাবে ওর মাঝে বিলীন হয়ে গেছিলাম যে তখন আমি মাহিরা ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝতাম না। ও সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর সব এলোমেলো হতে শুরু করে। অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক জড়ায়। কল ওয়েটিং পেতাম। ভীষণ ব্যস্ততা দেখাত। সম্পর্কের কথা জানার পর ওকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সরাসরি আমায় বলে দিয়েছিল, ওর নাকি এখন আর আমাকে ভালো লাগে না। আমার সাথে সংসার করবে না। কত হাতে-পায়ে ধরে কেঁদেছি তবুও ওর মন গলাতে পারিনি। দুই পরিবারের কেউই ওকে ওর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। কেউ থাকতে না চাইলে তো আর জোর করে তাকে রাখা যায় না। তাই ওর ইচ্ছেতেই ডিভোর্স হয়ে গেল আমাদের। আমি হয়ে গেলাম ছন্নছাড়া। কী করি, না করি নিজেরই কাজের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। মা কান্নাকাটি করত ভীষণ। মাস ছয়েক যাওয়ার পর ভাবলাম নিজেকে আবারও গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন এবং আর কোনো নারীকে জীবনে ঠাই দেবো না। আমার এই সিদ্ধান্তে আমি ততদিন পর্যন্তই স্থির থাকতে পেরেছিলাম, যতদিন আমি তোমায় দেখিনি। তোমায় চিনতাম না। আসিফের বাসায় লাল ড্রেস পরা তোমাকে দেখে আমার কী যে হয়ে গেল আমি বুঝতেই পারিনি! নতুন করে ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করল মনে। অনেকবার চেষ্টা করেছি তোমাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার কিন্তু পারিনি। তোমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে বুঝলাম, তুমি রিলেশনে কখনও রাজি হবে না। সত্যি বলতে রিলেশনে আমিও আগ্রহী ছিলাম না। বিয়ে নিয়ে আরও বেশি ভয়ে ছিলাম যে, সব জানলে তোমার বাবা-মা তোমাকে আমার কাছে বিয়ে দেবে নাকি। তুমিই রাজি হবে কিনা সব নিয়ে আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম। আর তাই বাধ্য হয়েই আগের বিয়ের কথাটা লুকিয়েছিলাম।”

একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে থামল জিয়ান। কয়েক সেকেন্ড পর মৌনতা কাটিয়ে নিতু কঠিনস্বরে বলল,

“প্রতারকের কোনো ক্ষমা হয় না। আপনার সাথে যা-ই হয়ে যাক না কেন, আপনি মিথ্যে দিয়ে আমার সাথে সম্পর্ক শুরু করে একদম ঠিক করেননি। যতটা মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তারচেয়েও অধিক তাড়াতাড়ি মন থেকে উঠে যাচ্ছেন। আপনাকে আমি সহ্য করতে পারছি না।”

চলবে…
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here