#অপেক্ষারা
২.
লেখা – অতন্দ্রিলা আইচ
তারা আজই ঢাকায় চলে যাচ্ছে খবরটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন নাজের মা আয়েশা বেগম। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে কাঁদছেন যেন জীবনে এই তাদের শেষ দেখা।
নাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আহ্ মা! কী শুরু করলে? তোমার মরাকান্না থামাও তো এবার।”
আয়েশা বেগম কান্নার গতি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “মা রে, তুই এত দূরে চলে যাচ্ছিস। তোকে ছাড়া আমি বাঁচবো কী করে?”
“এ কথা কাল রাতে মনে ছিল না? খুব তো খুশি খুশি গলায় বলেছিলে, মেয়েটার একটা গতি করে দিতে পেরেছি, আমার সব দায়িত্ব শেষ!”
“তুই আমার ওপরে রাগ করে থাকিস না মা। আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্যেই করেছি। সেটা তুই আজ বুঝতে না পারলেও একদিন ঠিকই পারবি।”
বাসস্টেশনে বাড়িসুদ্ধ সকলে এসেছে দুজনকে বিদায় জানাতে। হাসনা বেগম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ছেলেকে আটকে রাখার। সায়েম এক পর্যায়ে বিরক্ত করে বাসে উঠে বসলো।
হাসনা বেগম পরাজয়ের দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাজের মাথায় হাত রেখে বলল, “মা, আমার ছেলেটার খেয়াল রেখো।”
“নিজের খেয়ালই ঠিকমতো রাখতে পারি না, তার খেয়াল রাখবো কী?”
হাসনা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আয়েশা বেগম বিব্রত গলায় বললেন, “কিছু মনে করবেন না ভাবি, আমার মেয়েটা এমনই। আপনার কাছে তো আর অজানা নয়।”
হাসনা বেগম বললেন, “না না, কিছু মনে করিনি। নাজ তুমি এবার বাসে গিয়ে বসো, একটু পরেই বোধ হয় বাস ছেড়ে দেবে। সাবধানে যেও মা।”
বাস যে একটু পরেই ছেড়ে দেবে তেমনটা মনে হচ্ছে না। বাস মোটামুটি ফাঁকা। বাসে উঠতেই নাজের চঞ্চল চোখদুটো খুঁজতে লাগলো সায়েমকে। খুঁজে পেতেই সরু চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। চোখে সানগ্লাস, পরনে কালো শার্ট। গম্ভীর ভঙ্গিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। নাহ্! লোকটা হ্যান্ডসাম আছে। আশেপাশের মেয়েগুলোর তার ওপরে ক্রাশ খাওয়ার হাজারটা কারণ আছে। তার মানে এই নয় যে নাজও ক্রাশ খেতে যাচ্ছে। খাবার এত জিনিস থাকতে সে ক্রাশ খাবে কেন?
নাজ সায়েমের কাছে এগিয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলল, “আপনি এখানে বসেছেন কেন?”
সায়েম ফোনের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, “কেন বসতে নিষেধ আছে?”
“হ্যাঁ আছে।”
“কীসের নিষেধ?”
“আমার নিষেধ! ওটা জানালার পাশের সিট, ওখানে আমি বসবো।”
সায়েম আর কথা না বাড়িয়ে উঠে গিয়ে পাশের সিটটায় বসলো। নাজ জানালার বাইরে মাথা বের করে সকলকে হাত নাড়ছে। সায়েম তাকিয়ে আছে তার দিকে একদৃষ্টিতে। একটা ঘটনা যে কতগুলো জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে, সেই ভাবনাই ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়।
এই মেয়েটা যখন গতকাল সায়েমের বিয়েতে অতিথি হয়ে এসেছিল, তখন কি সে একবারের জন্যেও টের পেয়েছিল মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে তার জীবন ভয়ঙ্করভাবে বদলে যাবে। সায়েমের অবশ্য ধারণা মেয়েটার জীবন যে পুরোপুরি বদলে গেছে এটা সে এখনো বুঝেই উঠতে পারেনি। বুঝবেই বা কী করে? বাচ্চা একটা মেয়ে! বিয়ের মতো কঠিন বিষয়ের জন্যে তাকে কখনোই প্রস্তুত করে তোলা হয়নি।
বাস চলতে শুরু করেছে মিনিট দশেক হলো। সায়েম সেই আগের মতোই ফোন ঘেঁটে যাচ্ছে। আচ্ছা, এই মানুষটা কী সবসময়ই এমন চুপচাপ গম্ভীর ভঙ্গিমায় ঘোরাফেরা করেন। যদি তা-ই হয় তাহলে তো সর্বনাশ! কারণ নাজের মতো বাঁচাল মেয়ে পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। অনবরত ছয় ঘণ্টা কথা বলে যাওয়ার রেকর্ড তার আছে। বেশিক্ষণ চুপ করে থাকলে তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে, মাথা ভনভন করে।
এই মুহূর্তে ভরসার কথা হলো তারা বাসে আছে। লম্বা জার্নিতে আবার নাজ বেশিক্ষণ জেগে থাকলে পারে না। গাড়ি চলতে শুরু করলেই ঘুম জড়িয়ে আসে তার দুচোখে। তাই এই সময়টুকু চুপ করে থাকলেও ক্ষতি নেই।
নাজ যে কখন ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছে তার নিজেরও জানা নেই। তবে ঘুম ভেঙে চোখ মেলতেই তার বুকটা ধক করে উঠলো। আশেপাশে কেউ নেই। কী সাংঘাতিক, পুরো বাস তো যাত্রীতে ভরে গিয়েছিল। এরা সকলে গেল কোথায়? ছাড়া সায়েমকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। লোকটা কি তাকে ফেলে চলে গেছে না-কি? হয়তো বউ পছন্দ হয়নি বলে তাকে ফেলে রেখে গেছে। বাসটা থেমেও আছে জংলা টাইপ একটা জায়গায়। জায়গাটা নাজের কাছে অচেনা। এখান থেকে তো সে বাড়ি ফিরেও যেতে পারবে না।
ভয়ে নাজের চোখে জল চলে এল। কল্পনায় সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, রাক্ষসের মতো দেখতে একটা লোক বাসে উঠে তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে।
ভয়ে ভয়ে বাসের বাইরে পা রাখলো নাজ। আশেপাশে একটি প্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। নাজের হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সে নিশ্চিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে সে।
কিছুদূর এগোতেই অবশ্য তার ভয়টা কেটে গেল। গাড়িটার পেছন দিকে একটা রেস্টুরেন্ট। এমন জংলা জায়গায় এই রেস্টুরেন্ট কেন তৈরি করা হয়েছে কে জানে? প্রচুর মানুষের প্রবেশ-প্রস্থান হচ্ছে সেখান থেকে। বাসের যাত্রীরা নিশ্চয়ই সেখানেই গেছে মধ্যাহ্নভোজের জন্যে। প্রাথমিক ভয়টা কেটে গেলেও নাজের মনটা এখনো অস্থির হয়ে আছে। উনি আবার কোথায় গেলেন? ওই রেস্টুরেন্টের ভেতরে? নাজ কি একবার সেখানে গিয়ে তাকে খুঁজে আসবে? না থাক! শেষমেশ দেখা গেল রাক্ষুসে চেহারার কিডন্যাপরা সেখানেই তার জন্যে অপেক্ষা করছো।
“তুমি এখানে কী করছো?”, পেছন থেকে ধমকের সুরে সায়েমের গলায় কথাটা শুনে আঁতকে উঠলো নাজ।
“আপনি এখানে? আমাকে ভেতরে একা ফেলে এসেছেন কেন?”
“স্মোক করতে। বাসের ভেতর স্মোকিং নিষেধ।”
“একটা মানুষের জীবনের থেকে সিগারেট খাওয়া আপনার কাছে বড়ো হয়ে গেল? জানেন কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে একটাবার ডেকে আসলেও তো পারতেন।”
সায়েম শেষ হওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলল, “একবার আর দুবার ডেকেছি? কিন্তু তুমি মাশাল্লাহ যেভাবে গন্ডারের মতো ঘুমাও, তাতে মাইকিং করলেও তোমার ঘুম ভাঙবে না।”
নাজ কঠিন গলায় বলল, “একে তো আমাকে একা ফেলে এসেছেন আবার আমাকেই গন্ডার ডাকছেন? আমাকে যদি কেউ এসে কিডন্যাপ নিয়ে যেত, তখন কী হতো?”
“কিডন্যাপদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই তো, যে তোমার মতো আপদকে কিডন্যাপ করবে।”
নাজ রাগী কণ্ঠে বলল, “এই কী বললেন আপনি? আমি আপদ? আর আপনি নিজে কী? আপনি তো পৃথিবীর সবথেকে বড়ো আপদ।”
“জাস্ট শাট আপ! কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিবে দেখছি। চলো আমার সঙ্গে।”
“কোথায়?”
“খেয়ে নাও, না হলে সারাপথ নিজের এফএম রেডিও বাজাবে কী করে?”
প্রায় আধ ঘন্টা পর খাওয়া-দাওয়া শেষে সকল যাত্রীরা ফিরে এলো, বাস আবারও চলতে শুরু করলো তার গন্তব্যের দিকে। নাজ একটু পর পর আড়চোখে দেখছে সায়েমকে। তখন থেকে ফোনের দিকে তাকিয়ে কী যেন পড়ছে সে। আচ্ছা এই মানুষটার ফোনের চার্জ কী ফুরায় না? কী অদ্ভুত ব্যাপার! কাল রাতে সিগারেট ফুরালো না, আজ আবার চার্জ ফুরাচ্ছে না। সে কি যাদু-টাদু জানে না-কি?
নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “আপনি বেশি কথা বলেন না, না?”
সায়েম জবাব দিলো না। জবাব দেবার কোনো আগ্রহ তার মধ্যে ফুটে উঠলো না। ঠিক আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে।
নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “সেই সকাল থেকে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে যে একটা মানুষ বসে আছে, তার সঙ্গে দুটো কথা বললেও তো পারেন। এই ফোনের জন্যেই পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে!”
সায়েম দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিকভাবে ব্যবহার করলে পৃথিবীরই উপকার হয়।”
“মানে?”
“মানে হলো আমি ফোনে ইবুক পড়ছি। তোমাদের মতো ফেসবুকে টাইমপাস করছি না।”
“এক সেকেন্ড! আপনি কী করে জানলেন আমি ফেসবুকে টাইমপাস করি?”
সায়েম কিছু বলতে যাবে, তখনই পেছন থেকে একজন যাত্রী বলে উঠলো, “ভাই আপনারা একটু আস্তে ঝগড়া করেন না! বাচ্চা ঘুমাইতে পারতেছে না।”
নাজ কড়া গলায় বলল, “ঝগড়া আবার আস্তে করে কীভাবে? আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আপনি বাসে উঠেছেন কেন, দোষটা তো আপনারই!”
বিরক্ত হয়ে নাজ হ্যান্ডব্যাগ থেকে তার ফোনটা বের করলো। ফোন কি সায়েমের একার কাছেই আছে না-কি? হেডফোনটা কানে লাগিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলো।
“ঝড় এলে তুই সাথে থাকলে কি ভয়
তোর ঠিকানায় পাঠালাম এ হৃদয়
প্রেম হলে এক সুরে গান বেজে যায়
সে দেয় জখম, তবু সেই তো ভেজায়।”
চলন্ত বাসে এমনটা একটা গান যেকোনো মুহূর্তকেই বিশেষ করে তোলে। ‘প্রেম’ বিষয়টার ওপরে নাজের বরাবরই প্রচুর আগ্রহ। প্রেমের গান, প্রেমের কবিতা, প্রেমের বই – এসবই তার হৃদয়ের খুব কাছে। আশেপাশে দুজন মানুষকে প্রেমে পড়তে দেখলে সবথেকে বেশি খুশি বোধ হয় নাজই হয়। প্রেম বিষয়টার এত কাছাকাছি থেকেও প্রেমটা কখনো করা হয়নি।
চাইলেই কি আর প্রেম করা যায়, প্রেমে তো পড়তে হয়। নাজ সারাটাজীবন অপেক্ষা করে ছিল কোনো এক বিশেষ মানুষ আসবে তার জীবনে। প্রেমময় করে তুলবে তার জগৎকে, নাজের সমস্তটা জুড়ে থাকবে শুধু তারই বিচরণ। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবার কোথায়? এক রাতের মধ্যেই কেন সব শেষ! নাজ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে, তার পাশে বসে থাকা মানুষটার প্রেমে সে পড়বে না, কখনোই না।
গান শুনতে শুনতেই কেমন অসস্তিতে পড়ে গেল নাজ। তার পেয়েছে বাথরুম। বাস জার্নি এজন্যেই নাজের ভীষণ অপছন্দের। ট্রেনে তো চাইলেই যখন তখন বাথরুমে যাওয়া যায়। বাসে সেই ব্যবস্থা করলে কী ক্ষতি হয়?
নাজ এখন কী করবে? নিজেই ড্রাইভারকে চলন্ত বাস থামাতে বলবে? অসম্ভব? ধুর! কিছুই ভালো লাগছে না। এখানে যদি মা থাকতো তাহলে মায়ের কানে কানে কথা একবার বলে দিলেই নাজ নিশ্চিন্ত! বাকিটা ময়ের দুশ্চিন্তা। কিন্তু এখন সে কাকে বলবে? সায়েমকে? কী সর্বনাশ!
অবশ্য সর্বনাশের কী হলো? বাথরুম কী তার একার পায় না-কি? সকলেরই পায়। তাছাড়া এসব বিষয় তো প্রকৃতির দান। প্রকৃতির দান নিয়ে এত লজ্জার কী আছে?
নাজ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিচু গলায় বলল, “শুনুন! আমি ওয়াশরুমে যাবো।”
“এখানে ওয়াশরুম পাবে কোথায়?”
“এখানে তো ওয়াশরুম পেতেও চাচ্ছি না। আপনি বাসটা থামাতে বলুন।”
সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল “কোথায় থামাবে?”
“কতগুলো রেস্টুরেন্ট আছে, একটার সামনে থামলেই তো হলো।”
“এখন গাড়ি থামাবে না।”
“কেন?”
“একটু আগেই তো থামিয়েছিল, তখন মনে ছিল না তোমার।”
“থামাবে না বললেই হলো? টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছি না? আপনি বলুন তো!”
“পারবো না।”
“প্লিজ!”
“উফ! এত বিরক্ত করো কেন তুমি?”
সায়েম বাসের ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল, “ভাই গাড়িটা একটু থামান তো!”
অভিজ্ঞ ড্রাইভারদের বেশি কিছু বলতে হয় না। অল্পতেই এরা বুঝে যায় কেন থামাতে বলা হয়েছে। বাস থামলো ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে।
সায়েম উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “চলো।”
নাজ উঠতে যাবে, ঠিক তখনই তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তার শাড়ির কুচিগুলো খুলে গেছে। কখন যে খুলেছে সে নিজেও জানে না। এই অবস্থায় সকলের সামনে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “যাবো না।”
“কী? এতক্ষণ তো ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলে।”
“থাক, যেতে হবে না।”
সায়েম অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো নাজের দিকে। তার বিবাহিত বন্ধুরা প্রায়ই বলে, নিয়ে মানেই হলো যন্ত্রণা। এতদিন কথাটাকে নির্ঘাত ঠাট্টা বলে মনে করলেও, বিয়ের চব্বিশ ঘন্টা পার হবার আগে নিজেই টের পেল কথাটার সত্যতা।
(চলবে)#অপেক্ষারা
৩.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
একে তো প্রচন্ড বাথরুমের চাপ তার ওপরে খুলে যাওয়া শাড়ির কুচি। রাগে, বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে নাজের। মায়ের সঙ্গে কতো ঘুরে বেরিয়েছে, কখনো তো এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি তাকে। অথচ আজ এই মানুষটার সঙ্গে বের হওয়ার পর থেকেই যত গন্ডগোল।
সায়েম রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এতক্ষণ বাস থামানোর জন্যে আমাকে পাগল করে দিলে, আর এখন নিজেই নামতে চাইছো না। সমস্যা কী তোমার?”
“আপনি!”
“ওয়াট? আমি?”
নাজ আক্ষেপের সুরে বলল, “হ্যাঁ, আপনি। যখন থেকে আমার জীবনে এসেছেন, তখন থেকে একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে।”
“শোনো আমি তোমার জীবনে যাইনি, তুমি আমার জীবনে এসেছো।”
“ওই একই কথা! আপনি জানেন আমার বান্ধবীরা আমাকে কী বলে ডাকে?”
“আমার কি জানার কথা?”
“আপনারই তো জানার কথা। কারণ আপনার বোন আমার সবথেকে কাছের বান্ধবী। যাইহোক জানেন না যেহেতু আমিই বলছি। বান্ধবীরা আমাকে গুড লাক কুইন বলে ডাকে। সৌভাগ্যের রাণী! বরাবরই আমার ভাগ্য খুব ভালো।”
“এসব কথা আমাকে বলছো কেন?”
“কারণ আপনি আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার জীবনে সৌভাগ্যের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। আপনার জন্যেই এমনটা হলো!”
“কী আবার হয়েছে?”
নাজ রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “কিছু না!”
তারা ঢাকায় এসে পৌঁছালো ছয়টার দিকে। সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে চমৎকার এক লাল আভা। আকাশটায় গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের ছড়াছড়ি। নাজ জানালার বাইরে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। এই মুহূর্ত থেকে শুরু হলো তার দ্বিতীয় জীবন। সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষের সঙ্গে সেই জীবনটা কাটাতে এসেছে এই অচেনা শহরে। একটা সময়ে হয়তো মানুষটা তার কাছে আর অচেনা থাকবে না, শহরটাও হয়ে উঠবে চিরচেনা। কিন্তু সে প্রকৃত অর্থে সুখী হতে পারবে?
যাত্রীরা একে একে নামতে শুরু করেছে। নাজ ঠিকই একই ভঙ্গিতে বসে রইল।
সায়েম মাথার ওপরের সেকশন থেকে একেক করে ব্যাগগুলো নামাতে নামাতে বলল, “নামার ইচ্ছা আছে? না-কি এখানেই থেকে যাবে?”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “আমি নামতে পারবো না।”
সায়েম অবাক হয়ে লক্ষ করলো মেয়েটা কাঁদছে। নিঃশব্দে তার দুচোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। তার চোখে অশ্রু খুবই বেমানান। যে মেয়েটা সারাক্ষণ উৎফুল্লতায় মেতে থাকে, সে এভাবে কাঁদবে কেন?
সায়েম নাজের পাশে বসে শান্ত গলায় বলল, “তুমি কাঁদছো কেন?”
নাজ চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “আমার শাড়ির কুচিগুলো খুলে গেছে।”
সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই ছোট্ট একটা বিষয়ের জন্যে কাঁদতে হয়? সবাই নেমে গেলে ঠিক করে নিও।”
“ঠিক করবো কী করে? আমি তো শাড়িই পড়তে পারি না?”
সায়েম হতাশ গলায় বলল, “ওয়াও!মেয়েমানুষ হয়ে শাড়ি পড়তে পারো না?”
“শুনুন! সব মেয়েমানুষের কাছ থেকে সবকিছু আশা করবেন না।”
“বড়ো বড়ো কথা তো ঠিকই বলতে পারো!”
সায়েম পকেট থেকে ফোনটা বের করে কী যেন করছে।
নাজ বলল, “কী করছেন?”
সায়েম ধমক দিয়ে বলল, “এক সেকেন্ডের জন্যে একটু চুপ করে থাকবে প্লিজ?”
নাজ খেয়াল করলো সায়েম ইউটিউবে শাড়ি পড়ানোর টিউটোরিয়াল দেখছে। কী সাংঘাতিক! সে কি এখন নাজকে শাড়ি পড়িয়ে দেবে? ভয় এবং লজ্জামিশ্রিত এক অনুভূতি ঘিরে ধরলো তাকে। এতক্ষণে বাসের সকলে নেমে গেছে।
ভিডিওটা দেখা শেষ করে সায়েম বলল, “উঠে দাঁড়াও!”
নাজ অস্পষ্ট স্বরে বলল, “কেন?”
“আমি বলেছি তাই।”
নাজ উঠে দাঁড়াতেই সায়েম তার শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নাজের সারা শরীর জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। লজ্জায় বন্ধ হয়ে এল তার দুচোখ। তার উন্মুক্ত কোমর বারবার আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে।
সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “নড়ছো কেন?”
নাজ জবাব দিলো না। পাথরে মতো জমে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সায়েম কুচিগুলো ঠিক করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “গুজে নাও। না-কি সেটাও পারো না?”
নাজ আঁতকে উঠে বলল, “পারবো না কেন?”
কী সুন্দর করে কুচিগুলো করছে সায়েম! নাজ চিরকাল তার মাকে শাড়ি পড়তে দেখেছে, বান্ধবীদের দেখেছে। এতকাল দেখে দেখেও সে যা ছিল পারলো না, তা এই মানুষইটা কয়েক মিনিটের ভিডিও দেখেই শিখে গেল! নাহ্, বলতেই হয়! গুণ আছে লোকটার!
বাসস্টেশন থেকে বাসায় পৌঁছাতে ঘন্টাখানিক লাগলো। ঢাকার চিরচেনা যানজটে সায়েম অতিষ্ট হয়ে গেলেও, নাজ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে চারপাশটা। রাস্তায় কতো মানুষ, কতো ধরনের মানুষ! সকলেরই রয়েছে নিজস্ব ব্যস্ততা, নিজস্ব গন্তব্য। প্রত্যেকটা মানুষের জীবন একে অপরের থেকে কতো আলাদা!
বাসায় ঢুকে রীতিমত অবাক হয়ে গেল নাজ। পুরো বাসাটা ছিমছাম গোছানো। নাজ তো ভেবেই রেখেছিল বাসায় ঢুকে দেখবে ফ্লোরে ভাঙ্গা প্লেট পড়ে আছে, চেয়ারের ওপরে ময়লা কাপড় ঝুলছে। তবে এখন মনে হচ্ছে এর থেকে গোছানো বাসা সে তার জীবনে দেখেনি। মেয়েমানুষ হলেই শাড়ি পড়তে জানতে হবে এমনটা যেমন কোথাও লেখা নেই, ছেলেমানুষ মাত্রই অগোছালো এই ধারণাও সঠিক নয়।
নাজ ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখা। বসার ঘরের দেয়াল জুড়ে ছোটো ছোটো ফ্রেমে অনেকগুলো ছবি। সবাই সায়েমের ছোটবেলার। কোনো ছবিতে প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার জিতেছে, আবার কোনো ছবিতে মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে।
বাসায় ঢুকেই সায়েম রান্নাঘরে ঢুকে কী নিয়ে যেন ব্যস্ত হয়ে গেল। বসার ঘরটা এমন জায়গায়, যেখান থেকে খুব সহজেই দেখা যায় রান্নাঘরটা।
তাই নাজ বসার ঘর থেকেই সায়েমের উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বলল, “এত বড়ো বাসায় আপনি একা থাকেন?”
“হুঁ।”
“আমার তো কয়েক মিনিট একা থাকলেই কেমন দমবন্ধ লাগে। সারাক্ষণ একা একা থাকেন কী করে আপনি?”
সায়েম রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ দুটো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। একটা কাপ নাজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একচুয়ালি আগে আমি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে থাকতাম। বিয়ে ঠিক হবার পর এই বাসাটা নিয়েছি।”
নাজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “এত বড়ো বাসাটা সামলে রাখতে কষ্ট হয়না আপনার?”
“আগে হতো, এখন আর হবে না।”
“কেন?”
“এখন তুমি সামলে রাখবে।”
নাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “শুনুন! আমি কোনো সামলে টামলে রাখতে পারবো না। এসব কাজ আমি কখনো করিনি আর করতে পারবোও না। আর আগেই বলে দিচ্ছি – আমি কিন্তু রান্নাবান্না করতে পারি না। কাজেই আপনি আবার আশা করবেন না আমি লক্ষ্মী বউয়ের তিনবেলা রান্না করবো।”
সায়েম শান্ত গলায় বলল, “ও আচ্ছা! তা আর কী কী পারো না তুমি? এক কাজ করো, যা যা পারো না তার একটা লিস্ট বানিয়ে দাও আমাকে। না! তার থেকে বরং যা পারো তার একটা লিস্ট বানাও। তোমার না পারার লিস্টের থেকে পারার লিস্টটাই নিশ্চয়ই ছোটো হবে, তাই না?”
নাজ আহত গলায় বলল, “ঠাট্টা করছেন আমার সঙ্গে?”
“তোমার সঙ্গে আমার ঠাট্টা করার সম্পর্ক নয়। আমি কি একবারও বলেছি যে লক্ষ্মী বউয়ের মতো তিনবেলা রান্না করতে হবে তোমাকে? যেমন অতিরিক্ত কথা বলো, তেমনই অতিরিক্ত বোঝো!”
নাজ চুপ করে রইলো।
সায়েম আঙুল তাক করে দেখিয়ে বলল, “ওই ঘরটায় আমি থাকবো, আর পাশের ঘরটায় তুমি থাকবে। কারো সঙ্গে রুম শেয়ার করা আমার পক্ষে ইম্পসিবল। আর যত পারো কম বিরক্ত করবে আমাকে।”
দুজনের জন্যে দুটো আলাদা ঘর দেখে মনে মনে ভালোই হকচকিয়ে গেল নাজ।
তবে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “যাক! ভালোই হয়েছে। আমি তো ভেবেছিলাম আপনার সঙ্গে একই ঘরে থাকতে হবে। আমি আবার কারো সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে পারি না। শেয়ার করলে রাতে ঘুমের মধ্যে পাশের মানুষের লাথি মেরে ফেলে দিই। কী একটা অবস্থা, বলুন তো!”
সায়েম কঠিন গলায় বলল, “এই তুমি কথা কম বলতে পারো না? এক দিনই মাথা ধরিয়ে দিয়েছ আমার।”
নাজ উত্তর দিলো না। ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। শোবার ঘর দুটো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে আবারও ফিরে এলো সায়েমের কাছে।
“এই শুনুন!”
“আবার কী হলো?”
“বড়ো ঘরটায় আপনি থাকবেন কেন?”
“কারণ শুরু থেকেই ওটা আমার ঘর।”
“গতকাল আপনি একটা ম্যাজিকাল ওয়ার্ড বলেছিলেন, মনে আছে?”
“কোন ম্যাজিকাল ওয়ার্ড?”
“কবুল! যেই মুহুর্তে এই শব্দটা বলেছেন, সেই মুহূর্ত থেকে আপনার কোনো কিছুই আর আপনার নেই। সবকিছুতে আমার ভাগ বসে গেছে।”
“অন্য সবকিছুতে ভাগ বসলেও ঘর আমি কারো আমার ঘরের কোনো ভাগাভাগি হবে না।”
“এক কাজ করি চলুন, কয়েন টস! যে জিতবে বড়ো ঘরটা তার। আপনার কাছে কয়েন আছে। দাঁড়ান, আমার কাছেই আছে।”
সায়েম কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হ্যান্ডব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করলো নাজ।
“হেড না-কি টেইল?”
সায়েম রাগী কণ্ঠে বলল, “ছেলেমানুষী বন্ধ করো!”
সায়েমের রাগী কণ্ঠকে অগ্রাহ্য করে নাজ বলল, “আমি হেড নিলাম।”
অতঃপর কয়েন টসে হেরে সাধের বড়ো ঘরটা ছেড়েই দিতে হলো সায়েমকে।
(চলবে)