অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৪
অন্ধকারের মাঝে ড্রিম লাইটের আলোয় পরিবেশটি নিরিবিলি। হালকা ভাবে ভোরের আলো উঁকি দেওয়া শুরু করেছে! ফজরের আজান স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সাথে খুশির চেঁচামেচি। বেলী ঘুমঘুম চোখে, উঠানের অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে। পাশে টাম্মি জিহ্বা বের করে বসে! তাদের দু’জনকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এবং বের করেছে খুশি। কারনও রয়েছে। ঘুমঘুম চোখ নিয়ে বেলী পানি খেতে গিয়েছিলো। কিন্তু সে দেখেনি টেবিলে নতুন কাঁচের গ্লাসও ছিলো। ব্যাস, না খেয়াল করায় সেটা মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে খন্ড খন্ড হয়ে আছে। আর টাম্মি? সে-তো আরও দু-কদম এগিয়ে। বাড়ির পাশের ফুলগাছটাকে নষ্ট করে ফেলেছে! অবশ্য ইচ্ছে করে করে নি। দৌঁড়িয়ে নামতে গিয়ে গাছে উপর ধড়াম করে পড়েছে।
সেটা আজ নয়। কাল রাত্রের ঘটনা।
খুশি ওজু করে উঠানে উঠতে উঠতে বলল..
— ঘরে প্রবেশ করলে আজকে তোদের একদিন কি আমার।
বিছানার জানালা দিয়ে উঁকি মেড়ে ঘুমঘুম গলায় বাবলু বলল..
— হ্যাপি গুডমর্নিং পাউরুটি আর টুমি । [ বেলির হাতে নজর দিয়ে ] চুড়ি গুলো তুই কি আর খুলবি না?
বেলি চুড়ি নাড়াচাড়া করতে করতে অন্যদিকে হাঁটা ধরলো। সে খুলবে না। ভালোলাগার জিনিস ততক্ষণ সাথে রাখতে হয়, যতক্ষণ মন না ভরে। হু,
মাহফুজের দোকানের টুলে পা দুলিয়ে বসে বেলী । ঠিক নিচে দু’পায়ে ভর দিয়ে বসে রুটি খাচ্ছে টাম্মি। স্বপ্নে নিজের স্ত্রীকে দেখতে পেয়ে খুশিতে গদগদ মাহফুজ। কিভাবে কি ঘটেছে বেশ শান্ত স্বরে খুলে বলছেন বেলীকে। তেমনি বেলী চা খেতে খেতে ভিষণ ইন্টারেস্ট নিয়ে শুনছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এর থেকে ইন্টারেস্টিং আর কিছু হতে পারেই না। অবশ্য বেলীর আবার প্রেমীদের গল্পে ভিষণ টান রয়েছে। বেলি সব শুনে বলল..
— তোমাদের ভালোবাসার কাহিনি তো বললে না?
দোকানের ময়লা ঝাড়া দিতে দিতে মাহফুজের জবাব..
— এ-ই মাত্র কি বললাম?
— মানে কিভাবে দেখা হলো.? প্রেম হলো.? বিয়ে হলো? তোমার গাঁধা ছেলেরা হলো। সিনেমা আকারে বলো না।
মাহফুজ বিষন্নতার চেহারা নিয়ে বেলীর দিক তাকালো! মাঝে মাঝে মেয়েটি এমন কুয়েশ্চন করে যে মাহফুজের রুহ উড়ে যায়। বেলী আবার জিজ্ঞেস করবে তার আগেই পেছন থেকে একটি গম্ভীর ও ভাঁড়ি কন্ঠ শোনা গেলো..
— তার ছেলেরা কিভাবে হলো শুনে কি করবি?
বেলী দ্রুততম গতিতে টুল ছেড়ে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ে উষ্ঠা খেলো। এবং বাঁশ ধরে সাহায্য নিলো! পেছনে ফিরলো। তৃষ্ণা হাতের সিগারেটটি শেষ টান দিয়ে পাশে ফেলে দিলো। মুখের মধ্যে থাকা ধোঁয়া অন্যপাশে উড়িয়ে দিলো । মুখে সিগারেটের গন্ধ থাকাটা তৃষ্ণার নিজের ও পছন্দ না। তাই সে সদা সিগারেট শেষে একটা স্প্রাইট বা অন্যকিছু খেয়ে ফেলে। আজও তাই করলো। প্যান্টের পিছন পকেট থেকে স্প্রাইট বের করে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। বোতলটি অন্যপাশে ফেলে দিয়ে বেলীর দিক মনোযোগ দিলো। বেলী ছোটছোট চোখে দেখে যাচ্ছিল একমনে। এলোমেলো চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে। ঘুমঘুম চেহারার রেশ এখনও কাটেনি।ঠান্ডায় সরু নাকটা হালকা লালচে সাথে কান দু’টো সহ। বিলাই চোখ দু’টো আপাতত বেলীর দিক তাকিয়ে। কালো জ্যাকেটের নিচে সাদা রঙের গেঞ্জি ফুটে আছে। হাতঘড়ি টা কব্জিতে ঝুলে। সাদা জিন্সে পায়ে কালো স্নিকার্স পড়েছে।
টাম্মি ঘেউঘেউ করে উঠলো। টাম্মির ঘেউঘেউ তে বেলী চোখ সরিয়ে নিলো। ইদানীং তৃষ্ণাকে দেখলেই তার কেমন জেনো লাগে। কালকের দিন কাটিয়ে আরো বেশি শরীর শিরশির করতে শুরু করেছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তৃষ্ণার দিক। এ-ই যে চুড়ি গুলো সে কাল থেকে পড়ে। পড়ে থাকার তো কোনো মানে নেই শুধুশুধু। তাও পড়ে আছে।
টাম্মি অর্ধেক খাওয়া রুটি মাটিতে রেখেই তৃষ্ণার পায়ে ঘেষতে লাগলো। তৃষ্ণা পায়ের হাটু উঁচু করে বসলো। টাম্মির মাথায় হাত বুলাতেই টাম্মি চাটতে লাগলো জিহ্বা দিয়ে। টাম্মির কাঁটা যায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল..
— কথা বলছিস না যে.?
বেলি আঁড়চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো..
— নানা তো তার আর নানির অনেক গল্প বলেছে। আগামাথা বুঝি নি। মানে কোনটা আগে ঘটেছে আর কোনটা পড়ে। তাই বলেছি নাটক বা সিনেমার মতো প্রথম থেকে বলতে। যেমন, প্রথম দেখা.. কিভাবে বিয়ে হলো, এগুলো আর কি..
দোকান থেকে আরেকটি রুটি নিয়ে টাম্মির সামনে দিয়ে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। ভ্রু উঁচু করে বলল..
— চাচার গাঁধারা কি করে হলো শুনবি না?
নানা খুকখুক করে হেসে উঠলো। বেলী লজ্জা পেয়ে গেলো। সেতো তেমন ভেবে বলে নি।
— না থাক, শুনবো না। আমি যাচ্ছি। চল টাম্মি।
বেলী কিছুটা যেতেই তৃষ্ণার আওয়াজে থেমে গেলো। সামনে ফিরলো। তৃষ্ণা হালকা হেসে বলল..
— অ্যাটিটিউড দেখাচ্ছিস.?
বেলী মুখ কুঁচকে বলল..
— আমি বললাম বাসায় যাচ্ছি।
— গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়া।
— আমার যেতে.. [ বাকিটুকু আর বলতে পারলো না তৃষ্ণার ভ্রু_উঁচু করা দেখে! ]
বেলী মাথা দুলিয়ে একটু দূরে রাখা গাড়িটার দিক হাঁটা ধরলো! সে ভালোভাবে খেয়াল করলে হয়তো দেখতো তৃষ্ণা মাহফুজ কে চোখ টিপ মারলো।
— হাতে কি হলো?
তৃষ্ণার কথায় হাত ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখতে লাগলো। চুড়ির ঝুনঝুন আয়ায়াজ শুরু হলো। খেয়াল করলো ডান হাতে হালকা কেঁটে গেছে। তখন পড়ে যেতে নিয়ে বাঁশ ধরেছিল, হয়তো ওখানেই।
বেলির চোখের দিক তাকিয়ে থেকেই ধীরেধীরে তার হাতটি আলতো করে ধরলো। বেলি হালকা নড়ে উঠলো। শিরশির করছে যেখানে স্পর্শ লেগেছে। চুড়ি গুলো ধীর একটু উপড়ে তুলে দিলো। হাতের কাঁটা টাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে বারবার স্লাইড করে যাচ্ছে তৃষ্ণা। একমনে তাকিয়ে কাঁটাটার দিক। বেলির ফরসা হাতে লালচে রক্ত হয়ে আছে।
হালকা আওয়াজে বলল,
— ব্যাথা করছে?
বেলি মাথা নাড়ালো..
— না..
বেলীর ওড়নার এক কোণে টান মেরে ছিঁড়ে নিলো। টুকরো টা ভালোভাবে পেঁচিয়ে দিলো হাতে। বেলী কিচ্ছু বলল না। শুধু মনোযোগ দিয়ে দেখে গেলো তৃষ্ণার হাতটি কিভাবে তার হাতে স্পর্শ করছে।
ওড়নার টুকরো টা বেঁধে দিয়ে, নিজের হাত দুটো পকেটে মুড়ে নিলো। বেলীর ঘাড়ের তিলটির দিক তাকিয়ে থেকেই বলল..
— বাসায় গিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে পরিষ্কার করে নিবি। নাহলে ইনফেকশন হবে।
বেলী মাথা দুলালো।
— আপনার জ্বর কমেছে.? ঔষধ নিয়েছিলেন?
— বাড়ি যা।
বেলি মুখ কুচকে বলল..
— আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর না দেওয়া অসভ্যতা।
তৃষ্ণা বাঁকা হেসে আরেকটু এগিয়ে গেলো..
— অসভ্যতা কি তুই তো জানিস ই না।
বেলী দু’কদম পেছনে নিলো। তখনি তৃষ্ণার পেছন থেকে গান বেজে উঠলো..
— আইতে দেখি, যাইতে দেখি, দেখি সারাক্ষণ…
তোমায় না দেখিলে ভাল লাগেনা,
ও ও ও পাড়াতো বোন ….
গানটির সাথে সাথে আবিদও মুখ নাড়াচ্ছে, দুলছে আর বেলিদের দিক এগিয়ে আসছে। আবিদ তৃষ্ণার সামনাসামনি আসতেই আবারও গাইলো..
— আইতে দেখি, যাইতে দেখি.. দেখি সারাক্ষণ..
তোমায় না দেখিলে ভাল লাগে না..
ওহ ওহ পাড়াতো বোন..
তৃষ্ণা ছোট শ্বাস ফেলল..
— গান ওফ কর। [ আবিদ চুপচাপ ওফ করে দিলো ] এখানে কি করছিস?
আবিদ হাই দিতে দিতে বলল..
— এতো সকালে উঠার আমার সখ নেই। চাচিম্মা উঠিয়ে বললেন
” এতো সকালে ছেলেটা কোথায় বেড়িয়েছে দেখ তো। সাথেসাথে থাকবি। এ-র মাথায় কখন কি আসে আল্লাহ মালুম। ”
তৃষ্ণা বেলীর দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। ভাড়ি আওয়াজে বলল..
— বড় হচ্ছিস তুই। এখনো ছোট কি? এতো সকালে ঘুরছিস কেন.? ড্যাংড্যাং করে ঘুরাঘুরি ছাড়া কাজ নেই? বাড়ি যা।
তৃষ্ণা গাড়িতে উঠে গেলো। আবিদ দ্রুত বেলীকে একটু সাইডে আনলো।
— মন খারাপ করো না। আচ্ছা, কাল কি এমন বলেছিলে ভাইকে?
বেলী মন খারাপ করে চোখ পিটপিট করে উঠলো..
-* আমি কি বলবো?
— ও-ই যে রেস্ট নেওয়ার ব্যাপারে?
— তুমি যা বলেছিলে।
— অবুক।
— কি?
— কাল রাত্রে বাড়িতে পৌঁছাতেই ভাইয়া নিজে চাচিম্মা কে বলল ভাত খাইয়ে দিতে। স্বেচ্ছায় ঔষধ ও খেলো। ফ্রেস হয়ে তখনই ঘুমিয়েছে। তুমি হয়তো জানো না, ভাইয়া ভোরের ৪_৫ টার আগে ঘুমোয় না। ছাঁদে বসে নিম্নে পুরো একটি সিগারেটের প্যাকেট ফিনিস করবে। অথচ কাল পুরো,
— হহয়ত মন ভালো ছিলো।
আবিদ রহস্যময় হেসে বলল,
— হ্যাঁ, তা তো বোটেই।
আবিদ গাড়ির দিক চলে যাচ্ছে। বেলী আঁড়চোখে তাকালো গাড়িতে বসে থাকা তৃষ্ণার দিক। গাড়িটি না যাওয়া পর্যন্ত বেলী সেখানেই দাঁড়িয়ে। আবিদ বারবার হাত নাড়াচ্ছে। যতক্ষণ গাড়ি দেখা গিয়েছে আবিদের হাত নাড়ানো ও দেখা যাচ্ছিলো।
স্কুল ফিরে ধপ করে বিছানায় বসলো বেলী । সেই যে সকালে দেখেছিলো, আর দেখতে পায় নি তৃষ্ণাকে। স্কুলের দিক তো সদা থাকে। ঢাকা চলে গেলে তখন আরেক ব্যাপার।
বিকেলে টাম্মি সহ প্রাইভেট যাওয়ার সময় ও ভালোভাবে আশেপাশে তাকিয়েছে পায় নি। ফিরার পথেও খুঁজেছিলো পায় নি। আচ্ছা কেনো খুজছে সে তৃষ্ণাকে? কোনো উত্তর নেই।
সন্ধ্যায় বাড়িতে শিলার আম্মু আর শিলাও হাজির। পিছনের চৌকিতে বাবলু বেলি লুডু খেলছিলো। বিমান মোবাইল গুঁতাচ্ছিলো। শিলা এসে চৌকিতে ধম করে উঠে বসলো। ৪ জন ই লুডু খেলতে বসলো। বিমান আগে উইন হয়ে পগারপার। বাবলু চিটিং করে সেকেন্ড। শিলাও থার্ড হলো। বেলি আঁড়চোখে শিলার দিক তাকিয়ে বলল..
— এ-র আগের বার আমি জিতেছিলাম।
— হ্যাঁ। তুই জিতেছিলি আমরা গর্ভবতী।
বেলী মুখ ভেঁচকিয়ে বিছানা থেকে নামবে তখনি শিলা আনমনে বলল..
— এতো দ্রুত তৃষ্ণা ভাইয়া কেনো চলে গেলো? ১২_১৪ দিনের যায়গায় মাত্র ২ দিন। এখন কাকে দেখবো আমি?
বেলী চোখ পিটপিট করে বলল..
— চলে গেছে?
— ও-ই তো আমি ম্যাসেঞ্জার এ নক দিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করাতে বলল সকালেই বেড়িয়েছে।
বেলী অন্য রুমে গিয়ে মন খারাপ করে ফেলল। সকালে তো বলল ও না একবার, যে চলে যাবে। অবষ্য তাকে কেনো বলবে? চুড়ি গুলো একটা একটা করে খুলে ফেলল। যেভাবে প্যাকেট করা ছিলো সেভাবে ব্যাগে রেখে দিলো। হাতের তালুতে ঘুমিয়ে পড়লো। ফিসফিসিয়ে বলল..
— এইবার আসলে আপনার সাথে কোনো কথা হবে না, দেখা হবে না। আপনি খুব পঁচা, অসভ্য, ইতর।
অথচ, বোকা বেলী বুঝিতেই পারলো না, তার অভিমান কি নিয়ে?
তৃষ্ণা তাকে না বললেই বা কি? সে সেগুলোর তোয়াক্কা না করে অভিমানের ঝুলি নিয়ে বসল।
চলবে….