সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -৩০+৩১

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৩০

বাসন্তী রঙা জামদানী শাড়িটা হাতে নিয়ে কিচেনের সামনে পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে ইভানা। ফাহিমা করিম আড়চোখে ইভানার দিকে একবার দেখে পুনরায় নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। কিয়ৎক্ষণ পর ইভানা ইতঃস্তত করে ভেতরে প্রবেশ করল। মিনমিনে গলায় ডাকল,
” মা।”
ফাহিমা করিম হাতের কাজ রেখে ইভানার দিকে দৃষ্টি মেললেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,
“কিছু বলবে?”
ইভানা চোখ নামিয়ে নিচে তাকিয়ে বলল,
“আসলে মা… শাড়িটা পরিয়ে দেবেন প্লিজ।”
ফাহিমা করিম গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আমাকে তোমার ঠিক কি মনে হয়?”
ইভানা থতমত খেয়ে বলল,
“মা আমি…”
ফাহিমা করিম হাত ধুয়ে আঁচলে মুছতে মুছতে বললেন,
“আমি আবরারের মা হলেও ওর একজন ভালো বন্ধুও। আর তুমি মেয়ে আমার কাছে ফরমালিটি দেখাচ্ছো! গাধাটা কি শেখাচ্ছে তোমায় বলো তো? মায়ের সাথে কথা বলতে ফরমালিটি করা শেখাচ্ছে তোমায়? আজ ওর ক্লাস নেব আমি। হচ্ছে আজ ওর। আর তুমি! তুমি আমায় মা না ভাবতে পারো,বান্ধবী তো ভাবতেই পারো। নাকি বুড়ো হয়েছি বলে বান্ধবী ভাবতে পারবে না! বন্ধু হতে কিন্তু বয়স লাগে না।”
ইভানা আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে মা আমি… পরিয়ে দিন না প্লিজ।”

ফাহিমা করিম হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন,
“ঘরে এসো। এখানেই পড়বে নাকি।”
ইভানা মুচকি হেসে পিছু নিল শ্বাশুড়ি নামক মানুষটির। সম্মোহনীর ন্যায় পায়ে পায়ে এগিয়ে প্রবেশ করল নিজের জন্য বরাদ্দ করা কক্ষে। যে কক্ষে একসময় বিচরণ ছিল এ বাড়ির একমাত্র দস্যি ছেলের।

বসন্ত প্রেমের শোভাযাত্রার ক্ষণেও বিরহের অনলে দগ্ধ হচ্ছে নোভা নামক বিদেশী কায়ার মেয়েটি। শুভ্র মুখখানা শুকিয়ে গেছে। বাদামী চুলগুলো উজ্জলতা হারিয়ে মলিনতায় ছেয়ে যাচ্ছে। চোখে সেই চাঞ্চল্যকর ব্যাপারটিও নেই। যেন জীবন্ত এক মেয়ে পুতুল। সাদা জামদানীতে জড়িয়ে চুলে বেলীফুলের গাজরা লাগিয়ে রুম ত্যাগ করল নোভা। আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার কোনো ইচ্ছে না প্রয়োজন কোনোটাই বোধ করছে না সে। অগ্যতা ইভানার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। ভারাক্রান্ত মনে ঘরের ভেতরে নজর ফেলতেই একটা শীতল সমীরণ এসে ছুঁয়ে দিল তাকে। সামনের দৃশ্যটা যে ভীষণ মনোরম। সচরাচর দেখা যায় না এই দৃশ্যপট।

একজন শ্বাশুড়ি নিজ মনে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত তার একমাত্র পুত্রবধূকে। সুন্দরী পুত্রবধূুও ক্ষণে ক্ষণে হেসে লুটিয়ে পড়ছে শ্বাশুড়ির উপর। কিয়ৎক্ষণ পর পুনরায় মনোযোগ দিচ্ছে শাড়িতে।

শাড়ি পড়ানো শেষে ফাহিমা করিম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইভানার গালে হাত রেখে নরম গলায় বললেন,
“আমার ছেলের আটটি বছর নষ্ট হয় নি। তিলে তিলে সঞ্চিত ভালবাসাও বিফলে যায় নি। আট বছরের ধৈর্যের ফল আজ তার ঘরে জ্বলজ্বল করছে।”
ইভানা অবাক হয়ে তাকাল। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“মা! আপনি জানতেন!”
ফাহিমা করিম মুচকি হাসলেন। বললেন,
“আমি ওকে পেটে ধরেছি মা। এই কথাটা জানব না? যদিও ও বলেনি। আবরার চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই ওর হাবভাবে পরিবর্তন লক্ষ করি আমি। প্রথমে ভেবেছিলাম চলে যাবে সেজন্য হয়তো। কিন্তু তারপর বুঝলাম আমি আর নোভা ছাড়াও কিছু নিয়ে, কাউকে নিয়ে ও ভাবছে, চিন্তায় আছে। এরকম চলতে চলতেই ও চলে গেল। তারপর ওর ঘর থেকে আমি তোমার একটা ছবি উদ্ধার করি।”
ইভানা চোখ বড় বড় করে বলল,
“ছবি!”
“হ্যা ছবি। যদিও তোমার অগোচরে তোলা ছবি ছিল বোধহয় । মনে মনে তোমাকে খুঁজেছি অনেক। কিন্তু পাই নি। আবরারকেও কিছু বলি নি। ও কেন আমার থেকে প্রথমবার কোনো কথা লুকিয়েছিল, সেটা তো জানতাম না। তাই মনে মনেই তোমাকে খুঁজতাম। এরপর বহুবছর পর তোমায় পেলাম। আর কালবিলম্ব না করে টুক করে নিয়ে চলে আসলাম।”
ইভানা মৃদুস্বরে বলল,
“আপনাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরি মা?”

“এই বসন্তের অনেক জন্ম আগে
তোমায় প্রথম দেখেছিলেম আমি
সেই বসন্ত এখন অনেক দামী
তোমার কাছে আমার কাছে।”

আবরারের কণ্ঠে গুনগুন করে গাওয়া গানের লাইনগুলো শুনে ইভানা স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“আনকোরা এক প্রেমিকাকে হাত ধরে প্রেম সায়রে সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব পেয়েছেন আপনি মিস্টার ফাইয়াজ।”
ইভানার কথা শুনে আবরার ঠোঁট কামড়ে হাসল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“আমি কি দায়িত্ব পালনে সক্ষম? নাকি ব্যর্থ প্রশিক্ষক?”

ইভানা মোবাইল স্কিনে আবরারের মুচকি হাসি দেখে ঢোক গিলল। মাথা নিচু করে ফেলল তৎক্ষনাৎ।
আবরার পুনরায় বলল,
“তাকাও। এই কাঁচাগোল্লা! তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?”

ইভানা দু’হাতে মুখ ঢেকে লজ্জা সূচক হেসে মাথা নাড়ালো। আবরার হেসে বলল,
“কিন্তু আমি তো লজ্জা পাওয়ার মত কিছু করিনি। এই তুমি কি কল্পনায় কিছু করে ফেলেছো নাকি? কি সাংঘাতিক!”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সেভাবেই বলল,
“আপনি কি আমায় কিছু বললেন? আমি কি আপনার মত নাকি, যে ঝড়ের বেগে এসে সব এলোমেলো করে তুফানের মত চলে যাব।”
আবরার সচকিতে বলল,
“এই বাসন্তী রেগে যাচ্ছো কেন?”
ইভানা গাল ফুলিয়ে বলল,
“রেগে যাই নি। সত্যিটা বলেছি। আপনার কাছে রাগ মনে হলেই তো রাগ হয়ে যাবে না ব্যাপারটা।”
আবরার ইভানার অভিমানে গোল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাস্যজ্বল নয়নে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে কিন্তু লোভ লাগাচ্ছো তুমি। এখন যে তোমার গোল গোল গালে…”
ইভানা চোখ রাঙিয়ে তাকাল।
আবরার হেসে বলল,
“আমি তো টেনে দেওয়ার কথা বলছিলাম। বাচ্চাদের মত গোল গোল গাল!”
ইভানা মাথা নিচু করে হেসে ফেলল।

“আলমারির বাম দিকের ড্রয়ারটা খোলো তো কাঁচাগোল্লা।”

“কেন? কি আছে ড্রয়ারে? আর চাবিই বা কোথায়? ওটা তো আপনার পার্সোনাল প্রোপার্টি। আমায় কেন খুলতে বলছেন?”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“তোমার থেকে ব্যক্তিগত তো কিছু নেই আমার। আর তোমার কাছে ব্যক্তিগত বলে কোনো চ্যাপ্টার আমার থাকা উচিৎও নয়। চাবির গোছার পাঁচ নাম্বার চাবিটা ওই ড্রয়ারের।”
ইভানা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কি আছে ড্রয়ারে?”
“তোমার চোখে আমি প্রেম দেখতে পাচ্ছি ইভানা। লজ্জা দেখতে পাচ্ছি, ভালবাসা দেখতে পাচ্ছি।”
ইভানা চোখ নামিয়ে নিল। কানে ভেসে এলো কোকিলের সেই কুহুতান। ওই তো সুরে সুরে সুর মিলিয়ে ডাকছে তারা।
আবরার মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বলল,
” কাঁচাগোল্লা আমার! এবার যাও।”

ড্রয়ার খুলে একটা রঙিন কাগজে মোড়ানো ডায়েরি পেল ইভানা। একবার বুকে চেপে ধরে পুনরায় সেখানে রেখে সুখীভাব ফুটিয়ে তুলল চোখেমুখে। ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলল এক চিলতে সুখী হাসি।

কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে বিরক্তি মাখা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে নোভা। বিকেল হয়ে গেছে অথচ একটা রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। সচরাচর এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে না সে। কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে বাধ্য হয়ে পিচ ঢালা পথে পা বাড়ালো সে। উদ্দেশ্য পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছা।

ইভানা কে নিয়ে মধ্য দুপুরে নিজ কলেজে এসেছিল সে। বসন্ত বরণে অংশ নিতে। ইভান আসায় ইভানা কিছুক্ষণ থেকেই বাড়ি চলে এসেছে। অগ্যতা নোভা রয়ে গেল বন্ধুদের সাথে।

কিছু সময় হাঁটার পর পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আগ্রহ ভরা দৃষ্টি মেলল নোভা। পরক্ষণেই নজর সরিয়ে নিল। ভেতরে ভেতরে অনূভুতির অনুরণন শুরু হয়েছে যে! কিন্তু পাশের মানুষটিকে দেখেও ভাবাবেগ দেখালো না সে। ভাবলেশহীন ভাবে এগিয়ে চলছে হেলেদুলে।

রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“হেঁটে হেঁটে ফিরছিস কেন? ভাই টাকাপয়সা দেয় না নাকি? বিয়ে হতে না হতেই হাত টান দিল?”
নোভা বুঝতে পারল রিফাত তাকে ক্ষেপাতে চাইছে অথবা চাইছে তার সাথে কথা বলতে। কিন্তু এবারেও কোনো ভাবাবেগ দেখালো না। নিজের মত এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে।

“রিক্সা ডাকি?”
রিফাতের ভরাট গলায় বলা ছোট্ট বাক্যটা শুনে নোভা স্থির দৃষ্টিতে তাকাল।
রিনরিনে গলায় বলল,
“রিক্সা নেই আজ এই রোডে। থাকলেও আমি আপনার সাথে যেতে পারব না।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“কেন? আমার সাথে গেলে তোর জাত যাবে?”
নোভা স্মিত হাসল।
নিচু গলায় বলল,
“আজ দলে দলে প্রেমিক প্রেমিকারা রিক্সায় ঘুরছে রিফাত ভাই। আমি চাই না মানুষ আমাকে নিয়ে ভুল ধারণা করুক। আপনি বরং এখন আসুন। আমি একা একাই চলে যেতে পারব। আপনার কাজ পেলে আমায় পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আপনি পালন করতে ইচ্ছুক নন। দাদাভাইয়ের বলাতে এসেছেন সেটা আমি জানি।”
রিফাত অবাক হয়ে তাকাল। এই কি সেই পিচ্চি!
অথচ সে এসেছিল এক নজর তাকে দেখতে। শুভ্র রজনীগন্ধার মত স্নিগ্ধ মুখটায় একবার নজর বুলিয়ে নিতে।

“একটা মানুষ কে সারাদিন মিস করা! তাকে ফিল করা,তার জন্য বুকের ভেতর প্রতিনিয়ত কি চলে তা তাকে বুঝতে না দেওয়া, ভালবেসেও না বলতে পারার মত বাজে অনূভুতি দুনিয়াতে আর কিছু হতে পারে না নোভা। তুই সেসব বুঝবি না। তুই তো যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পেরেছিস,পারছিস। আমি কি করছি নোভা? কেবল নিজের ভেতর গুমরে গুমরে মরছি।”

চলবে….#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৩১

বকুল তলা। বসন্ত মেলায় মুখরিত চত্বর। দলে দলে শিশু, কিশোর, যুবক যুবতীরা প্রবেশ করছে মেলা চত্বরে। হলুদে সবুজে মুখরিত চত্বরকে মনে হচ্ছে উর্বর শষ্য ক্ষেত্র। সরষের আবাদে ভরে আছে গোটা মাঠ। যেন সরষে ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য্যে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে সকলের। বাসন্তী রঙা শাড়ি পাঞ্জাবিতে জড়ানো মানব মানবীকেই মনে হচ্ছে ফুটন্ত সরষে ফুল। আর সবুজে জড়ানো মানুষগুলো বৃন্তে লেগে থাকা পাতা।

বটতলা চত্বরে পৌঁছে রিফাত রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ভ্রুকুটি করে তাকাল নোভার দিকে। নোভা তখন ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে রিকশায়। রিফাত এগিয়ে এসে নমনীয় গলায় বলল,
“নেমে আয়।”
নোভা নড়াচড়া করল না। হাতের ছোট্ট ব্যাগটা জোর দিয়ে চেপে ধরে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল।
রিফাত এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সামলে বলল,
“নোভা অকারণ জেদ না দেখিয়ে নেমে আয়। নইলে আমি কি করতে পারি তোর জানা। যদি চাস পাবলিককে তখনকার মত ড্রামা দেখাতে তাহলে বসেই থাক।”
নোভা বিরক্তমাখা নেত্রে একবার তাকিয়ে নেমে এলো রিকশা থেকে। রিফাত চোয়ালে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসল।

কিছুক্ষণ আগে কলেজ রোডে হাঁটার সময় রিফাত চেষ্টা করে কথা বলে নোভা কে সহজ করতে। ঠিক আগের মত। কিন্তু নোভা উদাস মনোভাবে স্থির ছিল। অটুট ছিল নিজের ভাবলেশহীন রূপ প্রকাশ্যে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা রিকশার দেখা পেয়ে হাতে চাঁদ পাওয়ার মত মনে হলো নোভার। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই রিফাত রিকশায় চেপে বসে পড়ল। পাশে খানিকটা জায়গা রেখে নোভার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওঠ তাড়াতাড়ি।”
অন্য সময় হলে নোভা ভেতরে ভেতরে লাফিয়ে উঠতো। হয়তো বাইরেও সেটা খানিকটা প্রকাশ পেতো। কিন্তু আজ! আজ পারল না নোভার ছোট্ট মনটা প্রেম সায়রে ভাসতে। সাঁতার না জানা সাঁতারু সে। ডুবে তো সেই কবেই মরেছে। নতুন করে আর যন্ত্রণা সইতে পারার মত শক্তি তার নেই। তাই রিফাতের বলা কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হেঁটে চলে যেতে শুরু করল।
রিফাত কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে লাফিয়ে নেমে এলো। বড় বড় কদম ফেলে মূহুর্তেই নোভার সমকক্ষ হয়ে বলল,
“রিকশায় গেলি না কেন? এখন কি আমার পা ব্যথা না করে শান্তি পাচ্ছিস না?”
নোভা সামনে দৃষ্টি রেখেই বলল,
“আপনি চলে যান। আমাকে নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই।”
রিফাত কোমরে হাত রেখে কিছুক্ষণ ভাবল। লম্বা করে শ্বাস টেনে এগিয়ে গেল নোভার দিকে। চোখ বন্ধ করে সাহস যুগিয়ে আচমকা দু’হাতে জড়িয়ে কোলে তুলে নিল শুভ্র রজনীগন্ধাকে। নোভা সহসা আক্রমণে হকচকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখল নোভা। কিন্তু ব্যথা অনূভুত হতেও বিশ্বাস হলো না তার অবস্থান। অগ্যতা রিফাতের হাতটাকেই একমাত্র অবলম্বন মনে হলো। তাই সজোরে বসিয়ে দিল দুআঙুলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আক্রমণ।
রিফাত সুক্ষ্ম ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“নোভার বাচ্চা! থাপ্পড় কি খাবি? খামচাখামচি করছিস কেন বেয়াদব?”
নোভা হকচকিয়ে গেল পুনরায়। তারমানে এটা তার মনের অদৃশ্য কল্পনা নয়। দৃশ্যমান বাস্তব। হৃদযন্ত্রে তৎক্ষনাৎ ভূমিকম্প অনূভুত হলো তার। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস সব আসতে শুরু করল একযোগে। কিন্তু মনটাকে, মনের কোণে বয়ে চলা অনূভুতিগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে হাত পা ছুঁড়ে বলল,
“নামাও আমাকে রিফাত ভাই। মাঝরাস্তায় কি করছো তুমি এসব?”
রিফাত ভ্রুকুটি করে তাকাল। নিচু গলায় বলল,
“এমনভাবে মাঝরাস্তায় বলছিস যেন বন্ধ ঘরে এসব আমি অনায়াসে করি বা করতে পারি।”
“সেই অধিকারটা আমি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম রিফাত ভাই। কিন্তু তুমি নিলে না। ফেলে দিলে অবজ্ঞায়। অনূভুতিগুলো আজ ধুলোমাখা রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে অযত্নে, অবহেলায়।” হৃদয় উগলে বেরিয়ে আসা কথাগুলো বলা হলো না তার। গিলে ফেলল তৎক্ষনাৎ। বিনিয়ে একরাশ মেঘ এসে ধরা দিল হৃদয়বাগিচায়।

“নামাও আমাকে।” কঠিন গলায় বলল নোভা।
“আমায় মেজাজ দেখিয়ে লাভ নেই মিস নোভালি ফারহানা। মেজাজ আপনার ভাইকে দেখান। তার জন্যই আমি এখানে এসেছি আপনাকে নিতে। নইলে আমার কোনো শখ ছিল না আপনাকে বয়ে বেড়ানোর। নেহাৎই বন্ধুর অনুরোধ। তার বোনকে যেন আগলে রাখা হয়। মোমের পুতুল যেন ধুলোমাখা রাস্তায় পা না মাড়ায়।” বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল রিফাত।
নোভা তাচ্ছিল্য হাসল।
“যার গোটা শরীরটাই কাঁদায় মাখামাখি তাকে ধুলো থেকে আগলাতে এসেছে!”
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমাকে কিছু বললি?”
নোভা মাথা নাড়ালো। নরম গলায় বলল,
“লোকজন খারাপ ভাবছে রিফাত ভাই। নামিয়ে দাও।”
“তাহলে বল রিকশায় যাবি। আর আমি যেখানে নিয়ে যাব বিনা প্রশ্নে সেখানে যাবি।”
নোভা অগ্যতা রাজি হলো। যার ফলস্বরূপ বকুলতলার বসন্ত মেলা।

১৪-০২-২০১৪
“লোকে বলে দিনের আকাশে নাকি চাঁদ দেখা যায় না। তবে আমার কেন মনে হলো পহেলা ফাল্গুনের রৌদ্রজ্বল দিনে আমি পূর্ণিমার চাঁদের দর্শন করলাম।”

১৬-০২-২০১৪
“সাদা নীল রঙের স্কুল ড্রেস, পিঠে গোলাপি রঙের একটা ব্যাগ, গোলাপি রঙের একটা সাইকেল, মাথার দুইপাশে দুটো ঝুঁটি। যথেষ্ট কি এতটুকুই?”

২৫-০২-২০১৪
“ক্লাস নাইন! কেন এত পিচ্চি!”

২৮-০২-২০১৪
“হাসলে কি মুক্তো ঝরে? ঝিকিমিকি করা সাদা মুক্তো!”

০৫-০৩-২০১৪
“পৃথিবী কেন সূর্যের চারদিকে ঘুরে? আর কেনই বা পৃথিবীর জায়গায় আমি আর সূর্যের জায়গায় সে!”

১৩-০৩-১৪
“আগুন ঝরা ফাগুনে কেন আগুনের ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।”

২৫-০৩-২০১৪
“আবরার ফাইয়াজ ইস ফিনিসড।”

পরপর সাত পৃষ্ঠায় গোটানো অক্ষরে লেখা কিছু শব্দ যোগে গঠিত পঙক্তিগুলো পড়ে ইভানা ডায়েরী বন্ধ করে ফেলল। পাশে ফেলে রাখা মোবাইলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখল সময় ছয়টার ঘরে ঘুরছে। পুনরায় ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টানো শুরু করল। কিন্তু বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা খালি পেয়ে লেখা ভর্তি একটা পৃষ্ঠা দৃষ্টি কেঁড়ে নিল। ক্ষুধার্ত বাঘের মত হামলে পড়ল তৎক্ষনাৎ।

২১-০৪-২০১৪
“রাতে কাল বৈশাখীর হানায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে গোটা এলাকা। গাছ থেকে শুরু করে জানালার গ্রীল কিচ্ছুটি বাকি নেই ভাঙার। রাত ভর তান্ডবের পর সকালটা মনে হচ্ছে নিস্তব্ধ শহরের বাকশূন্য রূপ। নিস্তব্ধ হলেও স্নিগ্ধতায় মোড়ানো। চকচকে, তকতকে প্রকৃতি। গাছের পাতাগুলোতেও নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। তেমনই প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে। প্রকৃতির এই পরিবর্তিত রূপ অবলোকন করতে করতেই নজর কাড়ল একজোড়া চপল, ধূর্ত নয়ন। আলেখ্য গঠন করার ক্ষমতা নেই আমার, সেই চঞ্চলতার চঞ্চল হরিণী নেত্র কেবল মননজুড়েই শোভা পাচ্ছে। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো সবুজ ধানের ক্ষেতে হালকা বাতাসে ঢেউ খেলানো রূপ। আচ্ছা, সে কি টের পাচ্ছে আমার মনের ভেতর তড়তড় করে বয়ে চলা প্রেমনদ কে?”

০২-০৮-১৪
“তোমাকে দেখেছি সেই কবে কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমায় দেখি না।”

১৮-০৯-২০১৪
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা।
নাহ! বনলতা সেন নয়,কাঁচাগোল্লা, আমার কাঁচাগোল্লা। দিশা তো তাতেই হারিয়েছি।”

০১-০১-২০১৫
“কবে বড় হবে কাঁচাগোল্লা? কবে ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পড়বে? কবে কিশোরী থেকে রমণী হবে? কবে?”

ডায়েরী বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইভানা। উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকাল। সময় এখনো ছয়টার ঘরেই ঘুরছে। কখন হবে গভীর রাত? কখন আসবে কাঙ্ক্ষিত সময়?

“রিফাত!”
জনকোলাহলকে দাবিয়ে রেখে একটি রিনরিনে আওয়াজ এসে বাড়ি খেলো নোভার কানে। নোভা সঙ্গে সঙ্গে পেছনে তাকাল। সেই সাথে রিফাতও। উৎফুল্ল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অতিপরিচিত রমণীকে দেখে রিফাত কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। আদরে আহ্লাদে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটিও। ভীড় ঠেলে এসে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরল রিফাতের বাহু।
রিফাতও আবেগপ্রবণ হয়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“নোরা! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”
একটা শব্দ দুনিয়া ঘুরিয়ে দিল নোভার। কানের ভেতর বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
“নোরা! নোরা! নোরা!”
নোভা দু’হাতে কান চেপে ধরল। অস্ফুটে গুঙিয়ে ওঠে সামনে তাকাল। একে অপরে মত্ত নোরা-রিফাত কে দেখে পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল সেখান থেকে। একসময় ছুটল উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে।

মেলা চত্বর থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে এক ধারালো থাবায় ঝলসে গেল পেটের বাঁপাশটা। পরোয়া করল না নোভা। একই গতিতে এগিয়ে গেল সামনে। হৃদয়ের জ্বলন এতটাই প্রখর যে শরীরের জ্বলনটা ধারণ করতে পারল না মস্তিষ্ক। অথচ রক্ত গড়িয়ে সাদা শাড়ি আবির রঙা হতে শুরু করেছে সেই কখন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here