সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -৪০+৪১

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৪০

“আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু
তোমার কাছে চেয়ে নিলাম

হৃদয়ের জানালায় চোখ মেলে রাখি
বাতাসের বাঁশিতে কান পেতে থাকি
তাতেই কাছে ডেকে
মনের আঙিনা থেকে
বৃষ্টি তোমাকে তবু ফিরিয়ে দিলাম

আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু
তোমার কাছে চেয়ে নিলাম”

গৌরবর্ণ মুখ। গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি যেন নিখুঁত বিন্যাসে সাজানো। শান্ত স্থির দৃষ্টি। নিকষ কালো আঁধারের ন্যায় মণি দুটো মেঝেতে সীমাবদ্ধ। বাম গালের ঠিক মাঝ বরাবর কাল রঙের লম্বাটে জন্মদাগটা শিল্পীর তুলির আঁচরে আঁকা কারুকার্যের ন্যায় মনোলোভা। চেহারায় গাম্ভীর্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রখর ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে। মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধকৃত অবস্থায় গিটারে টুংটাং আওয়াজের সাথে গলা মিলিয়ে বসার ঘরের সকলের মধ্যমণি হয়ে ওঠল ইমরান।

ইভানা খানিকটা সময় ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আবরারের পাশে গিয়ে চাপা গলায় বলল,
“ছেলেটা আকর্ষণীয় তাই না? ব্যক্তিত্ববোধ মনে হচ্ছে চেহারায় ভাসছে।”
আবরার সরু চোখে তাকাল। নিচু গলায় বলল,
“তুমি আমার কাছে আরেক ছেলের প্রশংসা করছো?”

ইভানা মুখ টিপে হাসি আটকাল। হাস্যজ্বল কণ্ঠে বলল,
“জ্বলছে?”
“খুব।” আবরার অসহায় মুখভঙ্গি করে বলল।
“এটা তো প্রশংসা। ভালবাসা তো একজনের জন্যই তুলে রাখা আছে। তার আট বছরের ভালবাসা আশিতে পৌঁছানোর দাঁয়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি যে।”

আবরার সুখী হাসল।
“আমি মরে গেলেও কাউকে কিন্তু ভালবাসতে পারবে না। কথা দিয়েছো আমায়।”
ইভানা কড়া চোখে তাকাল। শক্ত গলায় বলল,
“আর কোনো কথা নেই আপনার মুখে? শুধু মরা আর মরা। মরে তো আমিও যেতে পারি। আর আমি কথা দিলাম কখন হ্যা?”

“কবুল বলার সময়। কি কি বলেছিলাম ভুলে গেছো?”

ইভানা ছোট ছোটো চোখে তাকাল।
আবরার পুনরায় বলল,
“আমার ব্ল্যাং চেকের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাও নি?”
ইভানা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“মনে থাকলেই কি? আপনি বলবেন আর আমি শুনব সব?”
আবরার মৃদু হেসে বলল,
“উপায় নেই সোনা। চেকে যে অংক লেখা হবে তা দিতে তুমি বাধ্য।”
ইভানা ভেংচি কেটে বলল,
“আমার বয়েই গেছে। কারো আজেবাজে কথায় আমি সায় দিই না।”
আবরার সবার অলক্ষ্যে ইভানার হাত আঁকড়ে ধরে করিডোরে নিয়ে গেল।
ইভানা ছোট ছোট চোখে তাকাল। ভ্রুকুটি করে বলল,
“এখানে কেন নিয়ে এলেন? ওখানে কত লোক। ইমরান ভাইয়া গান গাইছিল। সব রেখে এখানে কি করব আমি?”

আবরার ইভানার বাহু আঁকড়ে রেলিংয়ের সাথে লাগিয়ে দাঁড়াল। ইভানা একবার পেছনে তাকিয়ে শক্ত করে হাত আবরারের আঁকড়ে ধরে বলল,
“আবরার! পড়ে যাব তো।”
আবরার মুচকি হাসল। ঘন গলায় বলল,
“আমি থাকতেই?”
ইভানা মাথা নিচু করে হাসে। লাজে রাঙা হয়ে আসা মুখটা আড়াল করতে লেপ্টে যায় মানুষটার প্রশস্ত বক্ষে। আবরার দায়িত্ববান অর্ধাঙ্গের ন্যায় দু’হাতে ঝাপটে আড়াল করে প্রিয়তমার লজ্জা।

সদ্য বিবাহিত দম্পতি রিফাত নোভা সুখ সুখ আবেশে জর্জরিত। টুকটুকে লাল রঙা তাঁতের শাড়ি জড়িয়ে নববধূবেশে কবুল করেছে প্রিয় মানুষটাকে স্বামী রুপে। সারাজীবনের স্বপ্ন আজ সত্যি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারই দোরগোড়ায়।
জনসম্মুখে বসে থাকা নোভা সবার অগোচরে পাশে বসে থাকা শ্যামপুরুষটির দিকে তাকাল। চাপা স্বভাবের এই পুরুষটি তার। একমাত্র তারই ব্যক্তিগত পুরুষ। সুখে দুখে সবসময়, সব মূহুর্তে পাশে পাবে তাকে। নোভার শরীর ঝিমিয়ে আসে সুখের আবেশে। লোকচক্ষুর তোয়াক্কা না করে মাথা এলিয়ে দেয় প্রিয়তমের কাঁধে।
রিফাত মৃদু হেসে নিচু গলায় বলল,
“সবাই আছে তো!”
নোভা আহ্লাদী হলো। ভেজা গলায় বলল,
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
রিফাত স্থির দৃষ্টি ফেলল সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর মুখশ্রীতে। বউ বউ লাগছে তাকে। লোকচক্ষুর তোয়াক্কা করল না সেও। একহাতে বুকের একপাশে ঠাঁই দিয়ে বলল,
“আমার বউ।”
নোভা পুলকিত হলো। ঝিমিয়ে আসা লজ্জারা আরও খানিকটা আঁকড়ে ধরল তাকে। সাথে অফুরান সুখের আবেশ।

বেশ খানিকটা সময় পর ইমরানের গলা খাকাড়িতে চমকে উঠল রিফাত-নোভা। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখে চোখ পড়তেই হেসে ফেলল রিফাত। ইমরান নামের ছেলেটা ধারালো নজরেই লজ্জা দিতে চাইছে তাকে।রিফাত সত্যি সত্যিই লজ্জা পাচ্ছে এবার। এটা কি বিয়ে নামক বিষয়ের কুফল? নইলে লজ্জা পাবে কেন ঠোঁটকাটা পুরুষ মানুষ?

ইমরান রিফাতের পাশের অল্প একটু জায়গায় আয়েশ করে বসল। চমৎকার গলায় বলল,
“নিজের ট্রফি সামলে রাখুন ভাই। আরেকটু হলেই তো ট্রফি আমার কাঁধে উঠছিল। সামলাতে শিখতে হবে তো। একবার হারিয়ে ফেললে কপাল চাপড়ালেও আর আসবে না। তাই আঁকড়ে ধরুন তাকে শক্ত করে। শুধু ভালবাসা নয় ভালবেসে দায়িত্ব নিতে হবে তাকে ভাল রাখার। সব পরিস্থিতিতেই তার পাশে থাকার। ভালবাসার মানুষটিকে পাশে রেখে তার জন্য লড়াই করুন পুরো পৃথিবীর সাথে। তাকে নীরবে হারিয়ে ফেলা কোনো সমাধান নয়। এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। ভালবাসুন এবং ভালবাসতে বাধ্য করুন তাকে প্রতিনিয়ত, যার ভালবাসায় আপনি বিলীন হয়ে যেতে চান”

রিফাত অপলক তাকিয়ে রইল। দেখতে আকর্ষণীয় ছেলেটা মনের দিক থেকেও এতটা আকর্ষণীয়! ছেলে হয়েই তো প্রেমে পড়তে চাইছে সে। নোভা কে তবে ঠকালো সে! নোভা তো এই মানুষটার ভালবাসা ডিজার্ভ করে। পরক্ষণেই কানে বেজে ওঠল-‘তাকে নীরবে হারিয়ে ফেলা কোনো সমাধান নয়।’ নিজেকে মনে মনে একগাদা গালি দিয়ে নোভার হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”

ইমরান হাসল। শব্দহীন মুচকি হাসি। ওই তো জন্মদাগের নিচটায় খানিকটা দেবে গেল, টোল বলে কি একে?

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে নিকট আত্নীয়দের প্রায় সকলেই চলে যাওয়ার পর ইমরানের ফোন শব্দ করে বেজে উঠল। এতক্ষণের হাস্যজ্বল কণ্ঠের পরিবর্তে থমথমে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“হ্যালো!”
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা কথার পৃষ্ঠে পুনরায় বলল,
“ইয়েস বলছি। কে বলছেন প্লিজ!”

এক লহমায় মুখের রং পরিবর্তন হলো তার। হাস্যজ্বল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মুখটা মূহুর্তেই ছেয়ে গেল চরম কাঠিন্যতায়। গমগমে গলায় বলল,
“আমি আসছি। এক্ষুণি।”

আবরারের ভ্রুকুটি করে থাকা মুখের ওপর বিনা ভণিতায় বলল,
“আমাকে যেতে হবে ভাই।”
আবরার হ্যান্ডসেক করে বলল,
“আবার আসবে।”
ইমরান হাসল। চমৎকার হাসি।
দৃঢ় গলায় বলল,
“মনে হচ্ছে দেখা হবে আবার। খুব তাড়াতাড়ি।”

আবরার ভ্রুকুটি করে তাকাল। ইমরান পাত্তা দিল না সেসবে। কৌতুহল বাড়িয়ে দিতে মসৃণ কণ্ঠে বলল,
” সিক্স সেন্স বলছে আবার দেখা হবে এই হাসিখুশি পরিবারের সাথে। খুব তাড়াতাড়ি।”

কাঙ্ক্ষিত রজনীতে চাঁদের আলোয় আলোকিত কামরায় নীরবতার রেশ কাটিয়ে রিফাত নরম গলায় ডাকল,
“নোভা।”
নোভা ফুলে সজ্জিত বিছানায় কিছুটা গুটিয়ে বসল। অস্ফুটে বলল,
“হুম।”
রিফাত ভেজা গলায় বলল,
“আমি ভয় পাচ্ছি তোকে ছুঁতে।”
নোভা অবাক হলো। ঘোমটা ফেলে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,
“কেন? ভয় কেন হচ্ছে?”
রিফাত শুকনো মুখে ঢোক গিলল। নিচু গলায় বলল,
“তোকে ছুঁলে যদি তোর মোমের মত শরীর গলে যায়? যদি শুভ্র ত্বকে দাগ পরে? যদি ব্যথায় জর্জরিত হোস তুই? যদি নিখুঁত দেহের পরদে পরদে আমার দেওয়া অসহ্য চিহ্ন লেপ্টে যায়? আমি যে তোকে কোনো কলঙ্ক দিতে চাই না।”

নোভা কিয়ৎক্ষণ ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বলল,
“তুমি যে পাগল আছো সেটা কি তুমি জানো রিফাত ভাই? ”

রিফাত হেসে বলল,
“ভাগ্যিস বললি!”

নোভা মুখ বেঁকিয়ে অন্য দিকে তাকাল।
বাইরের ঝরঝরে বাতাসের সাথে ভেসে আসা জোছনার গন্ধে রিফাত আন্দোলিত হয়ে বলল,
“ভিজবি নোভা?”
নোভা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল।
রিফাত পুনরায় বলল,
” জোছনার আলোয় প্রেমের বৃষ্টিতে ভিজবি? সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা থাকবে না, কিন্তু তুই ভিজবি, মাতাল হবি গভীর উন্মাদনায়। সুখ সুখ আবেশে মরে যেতে ইচ্ছে করবে তোর। ভিজবি আমার সাথে?”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৪১

শ্রাবণ মেঘেদের সাথে সূর্যের তুমুল যুদ্ধে বিজয়ী হলো শুভ্র এবং কালচে রঙা অজস্র পুঞ্জীভূত মেঘেদের দল।বিজয়ী বেশে তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নীলিমার এপ্রান্ত ওপ্রান্ত জুড়ে। কখনো হাওয়ার বেগে কখনো বা কচ্ছপের গতিতে। আবার কখনো স্থিরচিত্তে অবস্থান করছে একই ঠিকানায়।

খোলা জানালার একপ্রান্তে হেলান দিয়ে আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে ইভানা। দৃষ্টিতে তার উদাসীনতা স্পষ্ট। জাগতিক কাজকর্ম ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে হাজার মাইল দূরে, দ্রুত বেগে এগিয়ে যাওয়া শ্যাওলা রঙা এক ট্রেনের বগিতে। যেখানে আছে উদাসীনতার সাম্রাজ্য আর মন খারাপের পিত্রালয়।

মৃদুমন্দ বাতাসে গালজুড়ে পড়ে থাকা চুলগুলো থেকে থেকে দুলছে। কাঁপছে একসময় বাতাসেরই দাপটে। ইভানার সেদিকে খেয়াল নেই। দু-হাত বুকে গুঁজে আরেকজনের ভাবনায় মশগুল সে। মশগুল বিরহ কাঁটা হৃদয়ে গেঁথে ক্ষরণ হওয়া রক্তের হিসাব মেলাতে।

আবরার নিজ কক্ষে এসে ইভানার উপর দৃষ্টি ফেলল। মলিন মুখটা দেখে চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল প্রণয়িনীর নিকট প্রান্তরে।

স্বীয় অবস্থানের একহাত দুরত্বে আবরার কে দেখেও ভাবনার ইতি ঘটল না ইভানার। নিজের মতই দৃষ্টি রয়ে গেল ওই দূর অজানায়।
আবরার সন্তর্পণে হাত রাখল ইভানার কাঁধে। নিজের দিকে টেনে এনে সযত্নে কাঁধে মাথা রেখে নরম গলায় বলল,
“থাকতেই কেন পুড়ছো কাঁচাগোল্লা? যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তো আদরে, ভালবাসায় মুড়ে থাকো।”

ইভানা নিশ্চুপ, নিশ্চল। নেই কোনো ভাবাবেগ। কেবল জীবন্ত পুতুলের ন্যায় ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে সে।

আবরার পুনরায় বলল,
“কষ্ট পেও না বউ। মাত্র তো একমাস। তারপর তো তুমি যাবে আমার কাছে। অনেকগুলো দিন শুধু তুমি আর আমি। এখন বিদায়বেলায় এসে সময়টাকে কেন জটিল করে তুলছো? একটু ভালবাসো না আমায়।”

নিস্তব্ধ রাতে যেমন আকাশ কাঁপিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায় ঠিক তেমনি নিশ্চুপ, নিশ্চল এক রমণী স্বামীবিয়োগে শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নার শব্দ আঁটকাতে মুখের ওপর চেপে ধরল একটা হাত। আবরার দিশাহীন হয়ে আষ্টেপৃষ্টে দু’হাতের বাঁধনে বেঁধে নিল। উতলা কণ্ঠে বলল,
“কিচ্ছু হয় নি ইভা। দেখো আমি কোথাও যাই নি। যাব না তোমাকে ছেড়ে। শান্ত হও প্রাণহরা আমার। দেখো আমি তোমার কাছেই আছি। কোত্থাও যাব না আর।”

খানিকক্ষণ পর ইভানা শান্ত হলো। কিন্তু থেকে থেকে হেঁচকি তুলা বন্ধ হলো না। ভেজা গলায় থেমে থেমে বলল,
“আমার কেন এমন মনে হচ্ছে আবরার? কেন মনে হচ্ছে আমি তোমাকে আর দেখতে পাব না। আমি হারিয়ে ফেলছি তোমাকে। কেন এমন হচ্ছে? কেন অকারণ চিন্তায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে? হৃদয় ভারাক্রান্ত হচ্ছে?”

আবরার দু’হাতে ইভানার মুখ তুলে ধরল। কপাল উষ্ণ পরশে সিক্ত করে চোখে চোখ রেখে বলল,
“একমাস ইভানা। তারপরই দেখতে পাবে। ঠিক এভাবে ঝাপটে জড়িয়ে নিজেকে আড়াল করতে পারবে। পারবে নিজের দুঃখগুলোকে এই কঠিন বুকটাতে কবর দিয়ে দিতে।”

ইভানা প্রতিত্তোর করল না। কেবল নীরবে চেয়ে রইল বিশুদ্ধতম পুরুষের শুদ্ধতম চোখের দিকে। অশ্রুসিক্ত অথচ কি স্থির ধারাল চাহনি। ইভানা কেঁপে ওঠে। আরও একবার প্রেমে পড়ে। আরও একবার হৃদয় দিয়ে অনুভব করে।

সময় বদলেছে। বদলেছে জীবনধারা। নতুন সংসার গুছিয়ে নিয়েছে ছোট্ট নোভা। পাশে থেকে সবটা সামলে নিতে সাহস যুগিয়েছে রিফাত। সপ্তাহের অর্ধেকটা সময় কাটে তাদের নতুন সংসারে বাকি অর্ধেকটা কাটে ফাহিমা করিমের ছায়াতলে।
বন্ধু ভাগ্যে প্রসন্ন রিফাত পরিবার পেয়ে ভুলতে বসেছে নিজের অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত। ফাহিমা করিম নিজের স্নেহময় বৃক্ষছায়ায় ঠাঁই দিয়েছে তাকে।

এইতো সেদিন বিয়ে হলো তাদের।অথচ দেখতে দেখতে চলে গেছে দেড়টা মাস। বিয়ের পরের দিন সকালবেলা ফাহিমা করিম রিফাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেছিলেন-‘আর দ্বিধা নেই তো মা ডাকতে?’
রিফাত আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রথমবার ডেকেছিল তাকে ‘মা’ বলে। ঘুচে গিয়েছিল তার আটাশ বছরের অনাথ জীবনের দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্চনা। নতুন করে, নতুন ভাবে চিনতে শুরু করেছে জীবনটাকে। এজন্যই বোধহয় বলে- জীবন সুন্দর।

আবরার চলে যাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে অতিদীর্ঘ একটি মাস। এক যুগ লম্বা সময়ের ন্যায় ঠেলে ঠেলে অতিক্রম করেছে ইভানা। শুধু অপেক্ষা! কখন আসবে সেই ক্ষণ। কখন!
ইতালির উদ্দেশ্যে পা বাড়ানোর আগের দিন ইভানা নিজ পিত্রালয়ে প্রবেশাধিকার পায়। ইয়াসিন মোন্তাজ নিজে এসে নিয়ে যান তাকে। মাকসুদা খানম মেয়েকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যান। বুকে জড়িয়ে রাখেন অনেকটা সময়। ইয়াসিন মোন্তাজ মেয়ের মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন প্রাণ ভরে।
মজার ব্যাপার ঘটে ইভানের বেলায়।
ইভানা চলে যাওয়ার আগে গলা বাড়িয়ে ডাকে তাকে। ইভান যথা নিয়মে বলে,
“দশ মিনিট দাঁড়া। আমি এক্ষুণি আসছি।”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পর মূহুর্তেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। ইভানের দরজার সামনে গিয়ে গলায় আওয়াজ তুলে বলে,
“তোর প্রমোশনের জন্য কংগ্রাচুলেশনস ভাই। পাঁচ থেকে দশ মিনিটে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য।”

ইভান নিজ কার্য সম্পাদন শেষে বোনের দিকে মাথা তুলে মুচকি হেসে বলল,
“আপু! চলে যাবি এখনই?”
ইভানা মৃদুহাসে। কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলে,
“গোছগাছ করতে হবে। আবরার অপেক্ষা করছে যে!”

ছোট্ট ইভান বোনের অবয়বে ছড়িয়ে থাকা খুশির ঝলক দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। দায়িত্ববান একজন বড় ভাইয়ের মত।
ইভানা ইভানের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর আদর গলায় বলল,
“মিথির কি খবর ভাই? মেয়েটাকে অনেক দিন দেখি না। এখনো ফুল ছুঁড়িস ওর বারান্দায়?”

ইভান মাথা নামিয়ে নেয়। বোনের অগোচরে লাজুক হাসে। ইভানা মুচকি হেসে ভাইয়ের চুল এলোমেলো করে দিয়ে পা বাড়ায় শ্বশুরালয়ের দিকে।

চব্বিশ ঘণ্টা আবরারের কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে ইভানার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। আশায় বেঁধে রাখা বুকে ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা দিচ্ছে। একটু অক্সিজেনের অভাবে হাসফাস করছে পতিপরায়ণা রমণী। ফাহিমা করিম নিজেকে শান্ত রেখে ইভানাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

ইভানার ফ্লাইটের আগের দিন থেকে আবরার নিরুদ্দেশ। না কলে পাচ্ছে আর না সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফোন বন্ধ! অথচ সে আগে থেকে জানায় নি এ সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও। ইভানার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। নিশ্চল হয়ে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা।

অবশেষে উপস্থিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। নিজের দেশ ছেড়ে স্বামীর গন্তব্যে পা বাড়ানোর। ইভানা ভারাক্রান্ত মনে তৈরী হয়। মনকে আকাশকুসুম বুঝিয়ে চেষ্টা করে প্রায় ভঙ্গুর হৃদয়টাকে সামলানোর। সফলও হয় সে। নিজের ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে পা ফেলে দরজার বাইরে। তৎক্ষণাৎ হাতে থাকা ফোনটায় টুংটাং আওয়াজে একটা মেসেজ আসে। কৌতুহলী ইভানা কাল বিলম্ব না করে চোখ রাখে মোবাইল স্কিন।
ভেসে আসা গোটা গোটা অক্ষরে লেখা বার্তাটুকু পড়তেই হিমশীতল এক তীক্ষ্ণ ফলা ছুঁয়ে যায় তার হৃদপিণ্ড।

চলবে….

দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here