সেদিন বসন্ত ছিল ২ পর্ব – ১৬+১৭+১৮

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ১৬

ফর্সা মুখশ্রী লাল বর্ণের ছোপ ছোপ দাগে ছেয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণ, নাসারন্ধ্র, কপাল সব জায়গায় দৃশ্যমান কিছু ক্ষত সগৌরবে মাথা উঁচু করে নিজেদের অবস্থান জাহির করছে। নাকের ফাঁক থেকে এখনো গড়িয়ে পড়ছে আবির রঙা তরল। ঠোঁটের কোণটাও মারাত্মক জখমে জর্জরিত। হাতের কনুই ছুলে সেখান থেকে চামড়া ওঠে গেছে খানিকটা। হয়তো হাঁটুর কাছটাতেও। শুভ্র শাড়িতে লেগে থাকা রক্ত তারই ঈঙ্গিত দিয়ে চলেছে।
এত এত আঘাতের পরও ইভানার রক্তমাখা জখমি ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে মৃদু হাসির রেখা। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনো অনেকটা পথ বাকি থাকলেও একজনের উপর থেকে চিরতরে সন্দেহ দৃষ্টি উঠিয়ে দিয়েছে খোদাতায়ালা।
মেঝেতে গা এলিয়ে বসে থাকা আহনাফ ইভানার আহত মুখশ্রীতে মুচকি হাসির স্পষ্ট ছাপ দেখতে পেল। অপার বিস্ময়ে কম্পিত গলায় বলল,
“আপনি হাসছেন? কিভাবে?”
ইভানার ঠোঁটের কোণের হাসি আরও খানিকটা প্রসারিত হলো। বহুকষ্টে কণ্ঠে জোর এনে শব্দ উচ্চারণ করতে সক্ষম হলো সে। নিভু নিভু আঁখি মেলে মিহি গলায় বলল,
“লক্ষ্য বিন্দু ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার কাছে। আমি হাসব না তো কে হাসবে?”

আহনাফ ভ্রুকুটি করে বলল,
“লক্ষ্য বিন্দু?”

ইভানা মাথা নেড়ে বলল,
“হুম; সমাপ্তি রেখা।”

আহনাফের বোধগম্য হলো না এহেন হেয়ালিপনায় বলা বাক্যবিশেষ। তাকিয়ে রইল সে নির্নিমেষ। ওই রক্তলাল, আহত মুখাবয়বে। পরক্ষণেই মুগ্ধতা ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। আহত বাঘিনীর ন্যায় তেজস্বী রূপ দেখে চক্ষুদ্বয় ঝলসে গেল তার। চোখ নামিয়ে ফেলল সহসাই। এ যে অন্যায়, পাপ।

এলোমেলো পায়ে টলতে টলতে ফার্স্ট এইড বক্স এনে আহনাফের সামনে দিয়ে পুনরায় শরীর এলিয়ে বসে পড়ল ইভানা। ক্লান্ত গলায় বলল,
“আপনার হাতে লেগেছে। ওষুধ লাগিয়ে নিন।”

আহনাফের এতক্ষণে মাথায় এলো ইভানার ইনজুরির কথা। নিজের উপর মারাত্মক রাগ হলো। এতক্ষণ আহত বাঘিনীর মোহনীয় রূপে মুগ্ধ থেকে তার যন্ত্রণাগুলোই আঁচ করতে পারে নি। এজন্যই বোধহয় বিধাতা বিরহে পুড়ার জন্য তার ভাগ্যে এক তরফা ভালবাসা লিখে রেখেছে। এটাই হয়তো তার আর আবরারের পার্থক্য।

লজ্জিত হয়ে নত মুখে বলল,
“আপনার হসপিটালে যাওয়া প্রয়োজন ইভানা। মারাত্মক ভাবে জখম হয়ে গেছে। চলুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

ইভানা তাচ্ছিল্য হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,
“এই জখমে আজকাল কিছু যায় আসে না। ভেতরটা তো সেই কবেই পঁচে গেছে। বাইরেটার ঠুনকো আঘাতে আর কি হওয়ার আছে। আমি ঠিক আছি।”

আহনাফ জেদি ইভানার সাথে এ নিয়ে কথা বাড়াল না। তবে সাহস করে বলল,
“কপালে অনেকটা কেটে গেছে। আমি ড্রেসিং করে দেই, প্লিজ!”

কিয়ৎপরিমাণ সময় ঠায় বসে রইল ইভানা। তাকিয়ে রইল একজন বিধ্বস্ত প্রেমিকের দিকে। অতঃপর নরম গলায় বলল,
“দিন।”

আহনাফের চক্ষুদ্বয় হেসে উঠল তৎক্ষণাৎ। তবে ঠোঁটদ্বয় রইল গম্ভীরতায় মোড়ানো। কিন্তু সে কি জানে মেয়েদের ক্ষমতা সম্পর্কে? চোখের ভাষা বুঝতে পারার ঐশ্বরিক ক্ষমতা! যা হাজার ফুট গর্ত থেকেও ছিড়েখুঁড়ে বের করে আনতে পারে গোপন সত্য।

কপাল, নাক, হাতের বিভিন্ন জায়গার ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে নিচু গলায় বলল,
“পা আর ঠোঁটে আপনি লাগিয়ে নেবেন। আমি আসছি এখন।”

ইভানা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আপনার হাতে লেগেছে।”

আহনাফ মুচকি হাসল। বলল,
“পুরুষ মানুষ ম্যাডাম। এটুকু আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।”

ইভানা মানল না তার সহ্য করার ক্ষমতা। নিজেই ক্ষত পরিষ্কার করতে লাগল। সহসাই বলে উঠল,
“সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ কি আমি, মিস্টার সরকার?”

আহনাফ চমকে উঠল। আকষ্মিকভাবে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“কিসব বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে?”

ইভানা শূন্যে তাকিয়ে মলিন হাসল। অতঃপর বলল,
“ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়। এটা আমায় তীক্ষ্ণ ভাবে সবটা বুঝিয়ে দিয়েছে।”

আহনাফ মাথা নিচু করে ফেলল। কি বলবে সে! কোন মুখে বলবে! অপমানে মাথা নুয়ে এলো তার। ইচ্ছে করছে অদৃশ্য হয়ে যেতে।

ইভানা তার এহেন অবস্থা দেখে নরম গলায় বলল,
“আমার একটা কথা রাখবেন? ধরে নিন অনুরোধ।”

আহনাফ চোখ তুলে চাইল। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইল ইভানার পানে।
ইভানা আকুতিভরা গলায় বলল,
“একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিন। এভাবে তো জীবন চলবে না। সবে তো শুরু। একটা সময় গিয়ে প্রয়োজন হবে একজন সঙ্গীর। একজন আপন মানুষের। যে আপন থেকেও আপনার। যার কাছে আপনি হবেন একটা খোলা ডায়েরি। তখন দেখবেন এই দু’দিনের লজ্জাজনক অধ্যায় আর মাথা নুয়ে থাকতে দেবে না আপনাকে। প্লিজ কথাটা রাখুন। ধরে নিন একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর অনুরোধ।”

আহনাফ জবাব দিল না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ইভানার মুখশ্রীতে।

“ধরুন আবরারের পক্ষ থেকে করা শেষ আবদার।”

শেষোক্ত কথা শুনে আহনাফ নড়েচড়ে বসল। কিঞ্চিৎ সময় পর মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“করব। আই প্রমিস।”

ইভানা মুচকি হাসল। হৃদয়ে দোলা দিল বসন্তের ফুরফুরে হাওয়া। মানুষটার বন্ধু ভাগ্য কেন এত ভালো!

ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে যখন মনে প্রাণে আল্লাহ কে স্মরণ করছিল ; আর একটিবারের জন্য আবরার কে চাইছিল তখনই দুজন পালোয়ানের ন্যায় শরীর দিয়ে করা কড়াঘাতে দরজার লক ভেঙে গুড়িয়ে যায়। দরজা চেপে বসে থাকা ইভানা ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। চেঁচিয়ে ওঠে আল্লাহর নাম করে।
দুজন লোক হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। এনে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় ফ্লোরে। টি-টেবিলের কোণা লেগে কেটে যায় কপালের খানিকটা। ছিঁলে যায় হাত, পা। অতঃপর ফর্মুলার জন্য গালে এসে পড়ে একের পর এক থাপ্পড়। নাক মুখ ফেটে বেরিয়ে আসে লবনাক্ত লাল রঙা তরল। কিন্তু সে অনড় নিজের সিদ্ধান্তে। প্রয়োজনে প্রাণ যাবে ; কিন্তু ফর্মুলা সে দেবে না। জেদ বজায় রেখে সহ্য করে একের পর এক আঘাত।

হাত খোঁপা করে রাখা চুলগুলো যখন পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা হাতে পেঁচিয়ে টেনে ধরে তুলে দাঁড় করায় তাকে। ইভানা ককিয়ে ওঠে। দু’হাত দিয়ে চেষ্টা করে ছাড়াতে। কিন্তু ওই পিচ্চি শরীর কি পারে এদের সাথে!

ব্যথায় জর্জরিত ইভানা যখন শরীর ছেড়ে দিয়ে লুটিয়ে পড়বে মেঝেতে ঠিক তখন সেখানে উপস্থিত হয় আহনাফ। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা আহনাফের পা জোড়া থেমে যায় ইভানার করুণ কণ্ঠে করা আহাজারি শুনে। রক্তে ভেসে যাওয়া মুখশ্রী দেখে। অতঃপর বীর বাঙালির ন্যায় ঝাপিয়ে পড়ে দুজনের উপর। মনের সবটুকু হিংস্রতা দিয়ে আঘাত করে একের পর এক। জান বাঁচাতে পালিয়ে যায় তারা। তারপর থেকেই দুজন বসে ছিল মেঝেতে, নিস্তেজ হয়ে।

ইভানা যখন কিচেনে পানি আনতে গিয়ে প্রথম লোকটিকে দেখে, তখনও মৃত্তিকা লাইনে ছিল। কল কাটে নি সে। কৌতূহলবশত সে শুনতে চেষ্টা করে পরের কথাগুলো। তারপর দরজার সামনে দাঁড়ানো লোকটা। অতঃপর চড়ের শব্দ পাওয়ার সাথে সাথে ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়া। ভয়ে রুহু কেঁপে ওঠে তার। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। দিশাহীন মৃত্তিকার হঠাৎই আহনাফের কথা মাথায় আসে। পেটের সন্তানের কথা ভুলে ছুটতে ছুটতে যায় সে আহনাফের ঘরে। আহনাফ তখন শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাঁটছিল। মৃত্তিকার কাছে ঘটনার বিবরণ শুনতেই তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যায় সে দিকবিদিকশুন্য হয়ে। ভুলে যায় পুলিশ কল করতে বা কাউকে সাথে নিতে। নিজের বিপদের তোয়াক্কা না করেই ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রিয়জনকে বাঁচাতে।

হাতের ক্ষত পরিষ্কার করে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিতেই উঠে দাঁড়াল আহনাফ। ইভানা বসে রইল সেখানেই। পেছন ফিরে চলে গিয়েও পুনরায় পিছু তাকিয়ে বলল,
“আপনি আমার সাথে যাবেন? আমার নয় আবরারের ভাইয়ের বাড়িতে। আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর বাড়িতে। এখানে আপনি নিরাপদ নন।”

ইভানা মুচকি হেসে বলল,
“আয়ু থাকলে আপনার মত কেউ বারবার আসবে আমাকে বাঁচাতে। আল্লাহ ঠিক পাঠিয়ে দেবেন।”

আহনাফ জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে পুনরায় পেছন ফিরে দরজা অবধি গেল।

“আহনাফ!” নরম গলায় ডাকল ইভানা।

আহনাফ থমকে দাঁড়াল। এই প্রথম বার নাম ধরে ডেকেছে ইভানা। না রাগ নিয়ে, আর না জেদ। ভালবেসে ডেকেছে সে!

আহনাফ তাকালে ইভানা লজ্জিত হয়ে নত মুখে বলল,
“সরি!”

আহনাফ মৃদু হেসে বলল,
“হঠাৎ?”

“আপনাকে বিনা কারণে সন্দেহ করার জন্য। অকারণ কথা শুনানোর জন্য। পারলে আমায় মাফ করে দেবেন।”

আহনাফ পুনরায় এসে ইভানার পাশে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে ইভানার সমকক্ষ হয়ে বলল,
“আপনাকে আমি আজীবন এই আগুনে জ্বালিয়ে মারব। করব না মাফ। যে অনলে আমি জ্বলছি, তাতে দগ্ধ হোন আপনিও।”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ১৭

কথায় বলে সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। বয়ে চলে নিজস্ব গতিতে, নিজস্ব ধারায়। যা অভ্যাহত রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। সেই সুত্রেই ইমরানের বাঁধাধরা তিনমাসের দু’মাস কেটে যায় অতিদ্রুত। সময় গড়ালেও রহস্য যেন এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। হাতের নাগালে আসার নাম-ই নিচ্ছে না। অপরাধী চতুরতার সাথে একের পর এক আঘাত হানলেও সে যেন প্রকাণ্ড এক দেয়ালের অন্তরালে। অদৃশ্য শক্তি দ্বারা আবৃত করে রেখেছে আপাদমস্তক।

এদিকে মৃত্তিকার জীবনে এসেছে মধুময় কিছু সময়। অল্পবয়সী তরুণী থেকে ধীরে ধীরে একজন মা হয়ে উঠার গল্প। কুলহীন জীবনে তীরের দিশা পেয়ে মর্তেই স্বর্গসুখ উপভোগ করছে সে। মেদহীন শরীরের ভাজে ভাজে আজ অতিরিক্ত মেদে পূর্ণ, ফোলা ফোলা গাল দর্পণে ভেসে উঠলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে নিজেই। পরক্ষণেই খিলখিল করে হেসে উঠে। স্বহস্তে ছুঁয়ে দেয় ফুলে উঠা পেটে। অনুভব করতে চেষ্টা করে তারই ভেতর বেড়ে উঠা কচি প্রাণ। আজকাল নিয়মিত সুখের চাষ হচ্ছে তার আলয়ে।

পরিচিত মানুষের এত পরিবর্তন চোখ এড়ায় না এহসানের। মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখে তারই পানে। একটা ভুলের মাসুল গুনছে সে বিগত কয়েকমাস ধরে। সেই ভুলের মাসুল হিসেবে ছুঁয়ে দেয়ার অধিকারের সাথে সাথে হারিয়েছে নিষ্পলক চেয়ে দেখার অধিকারও। নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত সে। কিন্তু সেটা মৃত্তিকা কে বোঝাবে কে! মেয়েটা যে আজকাল বড্ড অবুঝ। মা হলে বুঝি এমনই হয়!

পেশায় ছবিয়াল এহসান আজকাল নিজস্ব ক্যামেরায় অন্য ছবি ধারণ করে না। বরং একজন ব্যক্তিগত ছবিয়ালের দায়িত্ব পালন করছে। মৃত্তিকার পেটে হাত রেখে দাঁড়ানো, হাটা, বসা এমনকি চোখ মুখ বুঝে যখন সে আঙুলে তুলে টক খায় সেই ক্লিকটা নিতেও মিস করে না। রেখে দেয় অতি যত্নে। মৃত্তিকা টের পায় ; কিন্তু কিছু বলে না। না ধরা দেয় আর না দূরে সরে যায়। মনে মনে বলে- এখন কেমন লাগে বাছাধন। আমারও লেগেছিল ; আরও দ্বিগুণ যন্ত্রণা। যখন বলেছিলে আমার সন্তানের মায়া ত্যাগ করতে। তাকে দুনিয়ায় আগেই পরপারে পাঠিয়ে দিতে।

শেলী সরকারের পায়ের কাছে বসে আছে মৃত্তিকা। বেশ খানিকটা সময় ধরে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন তিনি। নরম গলায় শুধালেন,
“কিছু বলবে মা?”

মৃত্তিকা আমতা আমতা করল। শেলী সরকার মৃদু হেসে বললেন,
“নির্ভয়ে বলে ফেলো, আমিই তো। ভয় কিসের?”

মৃত্তিকা ঢোক চেপে নিচু গলায় বলল,
“আপনার ছেলে অনেক দিন আগে বলেছিল, তার বাবার জীবন কোনো মেয়ের জন্য নষ্ট হয়েছে! কেন মা? কি এমন হয়েছিল যে আপনার ছেলে মেয়েদের ঘৃণা করতে শুরু করল।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র বাংলাদেশেই প্রতিবছর পনেরো হাজারের বেশি মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এরমধ্যে ৯৮% এর বেশিই নারী এবং বাকি ২% পুরুষ। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ এ রোগে মারা যান।
গোটা বিশ্বে দেখতে গেলে প্রতি আটজনের মধ্যে একজন নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। ২০১৮ সালের গবেষণায় বলা হয়েছে সে বছর প্রায় ৯৬ লাখ মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। যার মধ্যে নারীর সংখ্যাই অধিক।

বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশিয়া মহাদেশেই ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এটা কেবল দারিদ্র্যতার জন্য নয় বরং মানুষের জীবন মানের জন্য। জীবন পরিচালনার ধরনের জন্য। সাধারণত ১৫-৪৪ বছর বয়স পর্যন্ত নারীরা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এর অন্যথাও ঘটতে পারে।

ফ্লোরেন্স শহরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরেন্সের গবেষণাগারে একঝাঁক তরুণ গবেষক দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছেন এই মরণঘাতী রোগের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক আবিষ্কারে। যার সূত্রপাত করে গেছে আবরার ফাইয়াজ। তারই আবিস্কারে ভর করে একের পর এক সিঁড়ি অতিক্রম করছে ইভানাসহ সকল গবেষণাবিদ। ইভানার মূল সহকারী গৌতম বিশ্বাস। পাশে থেকে প্রতিনিয়ত সাহস ও ভরসা দিয়ে চলেছেন। ইভানাও শুভাকাঙ্ক্ষীর ন্যায় সাহায্য নিয়ে চলেছে অবিরত।

আজকাল ইমরান আর ইভানার লেজ ধরে বসে থাকে না। সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করে প্রতিটি মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ। যদি একটা ক্লু ধরে এগোনো যায়। ইরেশ এবং পেট্রিসিয়ার উপর কড়া নজর তার। বলা যায় শকুনি দৃষ্টি।

“আহনাফ এহসানের বাবা ছিল একজন ব্যবসায়ী। তার একজন পার্টনারও ছিল। সেও ছিল বাংলাদেশী । দুজনের ব্যবসা বেশ ধাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ফ্লোরেন্সের মাটিতে। একসময় তার পরিধিও বাড়ে। একে একে ইতালির প্রায় প্রতিটি শহরেই তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে। মূলত সব ক্রেডিট ছিল ওই পার্টনারেরই। অল্পবয়সী ছিল সে । ত্রিশের কাছাকাছি হবে। আর আহনাফের বাবা তখন দুই সন্তানের বাবা। এহসানের বয়সই পনের -ষোলো। তবুও দু’জনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল দেখার মত। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড় করায় নিজেদের ব্যবসা। একদিন হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে লোকটা। হসপিটালে নিতে নিতে মৃত্যুবরণ করে। ঘরে তার তিনবছর আগে বিয়ে করা বউ আর একবছরের বাচ্চা। অসহায় তারা এসে দাঁড়ায় আমাদের দোরগোড়ায়। অসহায় কিন্তু তারা ছিল না। আমাদের যা ছিল ওদেরও সবটাই প্রাপ্য ছিল। কিন্তু আহনাফের বাবা অস্বীকার করে সবটা। ব্যবসায় নাকি তার একার মূলধন ছিল। সে নাকি ছিল শুধুই কর্মচারী। আশ্রয় দেয় নি মেয়েটিকে। আর না কোনো সাহায্য করেছে। অসহায় হয়ে সে ফিরে যায় ছোট্ট সন্তান কে আঁকড়ে ধরে। এরপর বহুবার এসেছিল সে। আশ্রয় নিয়েছিল আইনের। কিন্তু আহনাফের বাবা ততক্ষণে সব কাগজপত্র নিজের মত ঠিকঠাক করে ফেলে। আইনও প্রমাণ না পেয়ে কিছু করতে পারে নি তার। বেঁচে যায় সে। কিন্তু নিয়তি! তা কে খণ্ডাবে। সাধ্য আছে নাকি কারো! তা তো কেবল আল্লাহ প্রদত্ত। মেয়েটি সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরে। এত সম্পদের মালিক হয়েও দিন কাঁটায় ভিখিরির মত। হয়ে পড়ে চালচুলোহীন। এর কিছুদিন পর হঠাৎই একদিন আহনাফের বাবা স্ট্রোক করে। একসাইড প্যারালাইজড হয়ে যায়। হাঁটা চলা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিতে বলে। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন বিছানাই হবে তার একমাত্র জায়গা। সেদিন সে অনুভব করে অসহাত্ব। মনে করতে থাকে নিজের পাপগুলো। প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাচ্চাটা টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। অল্পসময়ের ব্যবধানে স্বামী সন্তান হারিয়ে মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে একসময়ের সুখী,সুন্দর মেয়েটি। হারিয়ে যায় পরিবার, সমাজ, লোকালয় থেকে। আর খুঁজে পাওয়া যায় নি তাকে। এরপর বছর খানেক শয্যাশায়ী থেকে মারা যান আহনাফের বাবাও।”
থেমে যান শেলী সরকার। দম নেন খানিকটা। অতঃপর পুনরায় বললেন,
“এটা নিয়ে বিনা কারণে রাগ এহসানের। মেয়েটাই নাকি ওর বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। এটা কোনো কথা হলো? দোষ ওর বাবার। নিজের পাপে ধ্বংস হয়েছে সে। অতিরিক্ত লোভে বলি হয়েছে। এতে আর কাউকে দোষ দেওয়ার কোনো জো নেই। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে ছাড়ে না। আমি শুধু আল্লাহ কে ডাকছি তার পাপের প্রতিফল যেন আমার সন্তানেরা ভোগ না করে। এটাই এখন একমাত্র চাওয়া। আমার এহসান ভালো পথে ফিরে আসুক। আহনাফের একটা গতি হোক। আর কিছু চাওয়ার নেই খোদার কাছে ; কিচ্ছু না।”

মৃত্তিকা নির্নিমেষ চেয়ে রয়। বিষাক্ত ভরা পরিবেশে থেকেও মানুষটার হৃদয় কলুষিত হয় নি। চোখেমুখে মুগ্ধতা ফুটে ওঠে মৃত্তিকার। শেলী সরকার বোধহয় বুঝতে পারল মৃত্তিকার চোখের ভাষা। মৃদু হেসে তিনি পুনরায় বললেন,
“একটা জাহাজ যখন সমুদ্রে ভাসে তখন কিন্তু সে এত এত পানি দেখে ভয় পেয়ে যায় না। এমনকি একবিন্দু পানিও তার ভেতর ঢুকে না। সে ডুবেও যায় না। বরং তখন ডুবে ; যখন পানি তার ভেতরে প্রবেশ করে। তেমনি, আমাদের চারপাশে এত মিথ্যা, এত বিষ থাকলেও আমরা বিষাক্ত হই না; মারা যাই না। তখন বিষাক্ত হই; মারা যাই তখন, যখন ওই বিষটুকু আমাদের ভেতরে প্রবেশ করে। তাই যেখানে যেভাবে যে পরিবেশেই থাকো না কেন, নিজের ভেতরটা পরিষ্কার রেখো। কলুষিত করো না। তবেই বাঁচতে পারবে; হাসতে পারবে; হাসাতে পারবে।”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ ১৮

ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরেন্সের অথরিটি থেকে শুরু করে গবেষণাগারে কর্মরত প্রতিটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এক সারিতে। চলছে তাদের সওয়াল জওয়াবের কার্যক্রম। প্রশ্নদাতা ইমরান এবং উত্তর দাতা সামনে তটস্থ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা গুটিকতক মানুষ।
গত আটচল্লিশ ঘন্টা যাবত নিখোঁজ ইভানা। না তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে আর না অন্য কোনো সন্ধ্যান। ইমরান দিশেহারা হয়ে নিজের খোলস উন্মোচন করে ফেলে। আবরারের মৃত্যুর পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ ছিল। একমাত্র কারণ তাদের প্রতিষ্ঠানের রেপুটেশন। আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয় একটা জলজ্যান্ত খুনকে। কিন্তু এবার! ইভানার কিছু হয়ে গেলে, কে নেবে দায়িত্ব!

দুদিন আগে প্রায় চার বছর পূর্বের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ইভানা ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে কিছু বলতে বলতে পেট্রিসিয়ার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে ল্যাবে প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সিসিটিভি ফুটেজ এটাই বলছে। কিন্তু তারপর! ভেতরে কি হয়েছে জানা নেই কারো। ঘন্টা তিনেক অকেজো ছিল সিসি ক্যামেরা। তিন ঘন্টা পর ইমরান নিজের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ল্যাবে পা রাখতেই মাথা ঘুরে ওঠে তার। ইরেশ, পেট্রিসিয়া, গৌতম বিশ্বাসসহ আর বেশ কিছু লোক বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। ইমরান আশেপাশে ইভানা কে না পেয়ে তৎক্ষণাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষে খবর পাঠিয়ে নিজে ছুটে ইভানার খোঁজে। তারপর থেকেই চলছে অনুসন্ধান।

নিজের পরিচয় গোপন করে এতদিন ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ইমরান আজ নিজের ফর্মে ফিরেছে। গম্ভীর, থমথমে গলায় একের পর এক বাক্য উচ্চারিত করছে।

পেট্রিসিয়ার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় বলল,
“শেষ বারের মত জানতে চাইছি কি হয়েছিল সেদিন? যেদিন আবরার হারিয়ে গিয়েছিল? কি হয়েছিল সেদিন; যেদিন থেকে ইভানাও মিসিং? আপনি সব জানেন মিস পেট্রিসিয়া। ভালোয় ভালোয় বলে দিন। নইলে পরিণাম আপনার ধারণার চাইতেও বাজে হবে।”

পেট্রিসিয়া হুংকার শুনে কেঁপে কেঁপে উঠল। মাথা নিচু করে বলল,
“আমি কিছু জানি না। বিশ্বাস করুন। আবরার স্যারের সাথে কি হয়েছিল আমি সেটাও জানি না। আর ইভানা ম্যামের সাথে কি হয়েছে সেটাও জানি না। আমরা একসাথে ল্যাবে ঢুকলে কিছুক্ষণ পরই তীব্র ঝাঁঝাল গন্ধে হুঁশ হারিয়ে ফেলি। এই একই রকম ঘটনা সেদিনও হয়েছিল। যেদিন আবরার স্যার উধাও হয়েছিল ল্যাব থেকে। তার কয়েক ঘন্টা পর জানা যায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন।”

ইমরান পুনরায় হুংকার ছেড়ে বলল,
“কে কে ছিল সেদিন ল্যাবে?”

“আমি, গৌতম স্যার আর ইরেশ।” কাঁপা গলায় বলল পেট্রিসিয়া।

ইমরান বাঁকা চোখে তাকিয়ে নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল,
“ইরেশ! শুধু ইরেশ? স্যার নয়?”

পেট্রিসিয়া চমকে উঠল। বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনি… ”

ইমরান বাঁকা হাসল। আগের স্বভাবেই বলল,
“জানাব নাকি অথরিটির কাউকে? এনাউন্স করব?”

পেট্রিসিয়া করুণ চোখে তাকাল। মিনতির সুরে বলল,
“জানাবেন না দয়া করে। আমাদের সম্পর্কের সাথে ম্যামের হারিয়ে যাওয়ার কোনো যোগ নেই ; বিশ্বাস করুন।”

একে একে প্রতিটি মানুষ কে জেরা করা শেষে ক্লান্ত অনুভব করে ইমরান। ফলাফল এখনো শূন্যের ঘরেই আছে। সবটা জেনেও যেন কিচ্ছু ধরতে পারছে না সে। হাতের নাগালে এসেও যেন ধরা দিচ্ছে না। অন্ধকার হাতরাতে হাতরাতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত সে।

খানিক বিশ্রামের জন্য বসতেই গৌতম বিশ্বাস এগিয়ে এলো ইমরানের নিকট। ইমরান ক্লান্ত মুখে উপরে তাকাল। প্রায় বসে যাওয়া গলায় শুধালো,
“কিছু বলবেন?”
গৌতম বিশ্বাস সময় নিল। ধীরে সুস্থে বলল,
“মিসেস ফাইয়াজ কে খুঁজে বের করুন ; যত দ্রুত সম্ভব। উনি ছাড়া আমাদের রিসার্চ অসম্পূর্ণ। আগের বার আবরার সবটা সম্পূর্ণ করতে করতেও হারিয়ে গেল। এবারে মিসেস ফাইয়াজ। কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলার আগেই খুঁজে বের করুন তাকে। উনার কিছু হলে উনার সাথে সাথে ফর্মুলাও হারিয়ে যাবে। তাদের আবিষ্কারও হারিয়ে যাবে। আবরার মিসেস ফাইয়াজ এর কাছে ফর্মুলা গচ্ছিত রেখে গেলেও তিনি তো রেখে যান নি। যদিও সেটা আইন বিরুদ্ধ। তবুও.. প্লিজ কিছু করুন।”

ইমরান চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। অনুরোধ, আকুতিটুকু বিষন্ন ঠেকল তার। সে খুঁজছে না তো কি এত দিন ধরে ধুনো দিচ্ছে? অযথা কনসার্ন দেখানো ঠিক সহ্য হলো না তার। রুঢ় গলায় বলল,
“এতকিছু আপনার ভাবতে হবে না। যেটুকু জানেন বলে বিদায় হন। নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আমি।”
খানিকটা থেমে লম্বা মোটা মতন একজন লোকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“মিস্টার থিয়ানো..”

কেন্দ্রীয় পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিস্টার থিয়ানো। যাকে প্রথম দর্শনে ইমরান পাষবিক, নৃশংস একজন মানুষ হিসেবেই জাজ করেছিল।

মিস্টার থিয়ানো এগিয়ে এসে ইমরানের সাথে জরুরী আলাপনে মত্ত হলে একে একে সন্দেহভাজন লোকগুলো হারিয়ে গেল দৃষ্টি সীমানা থেকে।

ইমরান আড়চোখে তাকিয়ে দেখল একজনের প্রস্থান; চোখের ভাষায় লেপ্টে থাকা চতুরতা। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল তার।

সকলের প্রস্থানের পর আহনাফ এসে দাঁড়াল ইমরানের মুখোমুখি। ইমরান ভ্রুকুটি করে বলল,
“কিছু বলার আছে?”

আহনাফ ভগ্নহৃদয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“ইভানা ফিরবে তো?”

“ইনশাআল্লাহ।” প্রবল আত্নবিশ্বাসী গলায় বলল ইমরান।

আহনাফ চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ব্যথাতুর দৃষ্টি মেলে করুণ গলায় বলল,
“আবরার কে আমি চোখের সামনে হারিয়েছি। কিচ্ছু করতে পারি নি ওর জন্য। চোখের সামনে দৃশ্যমান খুন দেখেও আত্মহত্যা বলে মেনে নিয়েছি। কঠিন সত্য বুকে চেপে কাটিয়েছি কতগুলো বছর। যে সত্যর জন্য ভাইয়ের মত বন্ধুর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে সেই সত্য আজ ইভানার কাছেও পরিষ্কার। চুপিসারে মেনে নিয়েছে সে। কিন্তু আমি আজও দহনে মরছি। মাফ চাওয়া হয় নি যে তার কাছে। একটিবার মাফ চাওয়ার জন্য হলেও তাকে সামনে এনে দিন। শুধু একবার.. ”

ইমরান আহনাফের কাঁধ চাপড়ে সাহস যুগিয়ে একপাশ জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“সন্দেহ সারিতে আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার আহনাফ। বেশি ইমোশন দেখিয়ে কাজ নেই। কিছুটা বাঁচিয়ে রাখুন। সময়ে কাজে দেবে।”

আহনাফ চোখ তুলে ইমরানের চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। প্রবল আত্নবিশ্বাসী দেখাচ্ছে তাকে। চোখে যেন জলন্ত আগ্নেয়গিরি। ভষ্ম করার জন্য ক্রমশ এগিয়ে আসছে তারই দিকে।

দুইদিন আগে। ইভানা প্রেস কনফারেন্স করার সিদ্ধান্ত নেয়। এত বড় আবিষ্কারের কথা চেপে রাখতে চায় নি আর। যদিও তা হিউম্যান বডিতে এপ্লাই করতে এখনো ঢের দেরি। দেরি পুরোপুরি প্রস্তুত করতে ওষুধগুলোও। কিন্তু কিছু কারণবশত প্রেস ডেকে সবটা জানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেদিন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তার পরদিন পেট্রিসিয়ার সাথে ল্যাবে প্রবেশের পর ভ্যাপসা, ঝাঁঝাল একটা গন্ধ এসে নাকে বাড়ি খায়। প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। অন্ধকার হয়ে আসে ধরণী। এরপর আর স্মৃতির পাতায় যোগ হয় নি নতুন কোনো যোজনা।

গভীর ঘুম থেকে চেতনা ফেরার পর নিজেকে অন্ধকার কক্ষে আবিষ্কার করল ইভানা। নরম বিছানায় আয়েশ করে ঘুমিয়ে ছিল সে। উঠতে চাইলে মাথাটা ভারী হয়ে আসে। পুনরায় লুটিয়ে পড়ে বিছানায়। নিকষ কৃষ্ণ আঁধারে নিজের হাতটা পর্যন্ত নজরে পড়ছে না তার। বিছানা হাতড়ে ফোন খুঁজতে চেষ্টা করে। কিন্তু নাগালে পায় না কিছুই। কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার! অন্ধকার যেন গিলে নিয়েছে তাকে!

ঘন্টা কতক ওভাবেই কাটে তার। অন্ধকার হাতড়ে দরজা খুঁজার চেষ্টা করে সে কয়েকবার। কিন্তু সফল হলো না সে। বাধ্য হয়ে পুনরায় বিছানায় বসে আল্লাহ নাম জপতে আরম্ভ করে। অনেকটা সময় পর কানে একটা সুক্ষ্ম আওয়াজ এসে বাড়ি খায়। পরক্ষণেই ঘরজুড়ে হালকা আলোর দেখা মেলে। ইভানা আলোর উৎস পেয়ে বিছানা ছেড়ে নিচে নামে। দু’পা বাড়াতেই সম্পূর্ণ ঘর আলোয় আলোকিত হয়। আকষ্মিক আলোয় ইভানার চোখ বন্ধ হয়ে যায় আপনাআপনি। কিঞ্চিৎ সময় পর সম্মুখে দৃশ্যমান হলো পরিচিত একটি মুখ। ইভানার চক্ষুদ্বয় বড় বড় হয়ে গেল। ঠোঁট দুটো নিজেদের ছেড়ে দিল স্বেচ্ছায়।

নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। এটাও সম্ভব! অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“আপনি.. সব কিছুর পেছনে আপনি?”

সামনের মানুষটা শব্দ করে হাসল। নাহ; এতদিনের সেই সুন্দর, ভাল মানুষটির হাসি নয়। এ যেন এক বদ্ধ উন্মাদের হাসি। ইভানার গা গুলিয়ে উঠল। শরীরের রোমকূপ শিরশির করে উঠল।

ঘেন্নাভরা গলায় বলল,
“আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম। এই ছিল আপনার আসল রূপ! ছিহ! ঘেন্না হচ্ছে আমার নিজের উপর।”

অপর পাশের মানুষটি হো হো করে হেসে উঠল। হাসির শব্দে ইভানা ভয় পেল না। শিউরেও উঠল না আর। মন, মস্তিষ্কে এখন কেবল ঘৃণা আর ঘৃণা।

“ফর্মুলা কোথায়?” ধীর গলায় বলল সে।

ইভানা শক্ত গলায় বলল,
“ফর্মুলা ফর্মুলার জায়গায় আছে। সেই কৈফিয়ত নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দেব না। কোনো খুনি কে তো নয়ই।”

এবার তার হাসির পাল্লা আরও বাড়ল। কপট হাসিতে ফেটে পড়ল সে। চিবুকে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“তুমি খুব সাহসী মেয়ে। আত্মবিশ্বাসীও। নইলে কি এই টুকুনি পুঁচকে মেয়ে স্বামী খুন হয়েছে জেনেও সেখানে মরতে আসতে পারে? ইমপ্রেসিভ! কিন্তু এত সাহস দেখিয়ে লাভ নেই। আমার প্রাপ্য আমায় দিয়ে দাও। নিজে জান নিয়ে ফিরে যাও।”

ইভানা মুচকি হাসল। ক্রমশ তা রূপ নিল অট্টহাসিতে। হাসির দাপটে কথা বলতে ভুলে গেল সে। কিয়ৎক্ষণ পর বলল,
“মরাকে আপনি আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মরার ভয় দেখাচ্ছেন? হাস্যকর!”

লোকটা ভড়কে গেল খানিকটা। আর কিছু বলল না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। বের হতেই ঘরটা পুনরায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। ভাগ্যিস ইভানার অন্ধকার ফোবিয়া নেই। নইলে তো ভয়েই জান যেতো।

লোকটার দেখা মিলল আরও অনেকটা সময় পর। ইভানা জানে না কতক্ষণ সময়। বন্ধ ঘরে মরার মত পড়ে আছে সে। পেটের ক্ষুধা বলছে কেটে গেছে অগুনতি সময়। কিন্তু মনটা এখনো আগের মতই ইস্পাত কঠিন।

লোকটা এবার হাতে একটা পাত্র নিয়ে এসেছে। ধোঁয়া উঠছে সেখান থেকে। ইভানা ভ্রু কুঁচকে তাকালে সে বলল,
“গরম পানি থেরাপির কথা শুনেছো?”

ইভানা ভড়কালো না। চেয়ে রইল নির্নিমেষ। কিঞ্চিৎ সময় পর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। মিটিমিটি হেসে পাত্রের তলানী ছুঁয়ে উল্টে দিল তারই দিকে। ছড়িয়ে গেল পানিটুকু; কিছু বুঝে উঠার আগেই। জ্বলে গেল বুক থেকে বুড়ো আঙুল পর্যন্ত। চেঁচিয়ে উঠল সে; ঘর কাঁপিয়ে।
ইভানা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। পরক্ষণেই ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
“এর চেয়ে বহুত যন্ত্রণা দিয়েছিস আমার আবরার কে। আমাকে আর আমার পুরো পরিবার কে। একজন মায়ের ছটফটানি তুই দেখিস নি। দেখিস নি জায়নামাজে বসে তার হাহাকার। আমার ছোট্ট বাচ্চার আধো আধো বুলিতে বাবা ডাক তুই শুনিস নি। শুনিস নি একজন বোনের ম্যাজিক্যাল ভাই হারানোর যন্ত্রণা। একজন ভাইয়ের ভাই হারানোর যন্ত্রণাও তুই অনুভব করিস নি। সবটা এবার কড়ায় গন্ডায় বুঝবি তুই। আমায় মরার ভয় দেখাবি? প্রয়োজনে মরব আমি। কিন্তু উপরওয়ালা আছে। তোর ধ্বংস সন্নিকটে। প্রস্তুতি নে নিজের শেষ দেখার জন্য।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here