সেদিন বসন্ত ছিল ২ পর্ব – ১০+১১+১২

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ১০

অদূর ভবিষ্যতের এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির ভয়ে জর্জরিত এক মা বিগত কিছু সময় যাবৎ মুখ চেপে নিজের ক্রন্দনগতি আঁটকে রেখেছে। বুক ঠেলে আসা হাহাকারগুলো গলা টিপে হত্যা করছে। কিন্তু ভয়গুলো! পারছে না সেগুলো পিষে ফেলতে। তারই ফলস্বরূপ ভয়ে জীর্ণশীর্ণ হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে।

ইমরান কিছু সময় যাবৎ ইভানার নীরব আত্মাহুতি দেখল। সময় নিয়ে তার চাপা আহাজারি পর্যবেক্ষণ করে নিজের ফোন বের করে টপাটপ কয়েকটা নাম্বার তুলে ডায়াল করল এক দায়িত্বশীল পুরুষের ফোনে।

কিয়ৎপরিমাণ সময় পর ভরাট গলায় উচ্চারিত হলো-
“হ্যালো; ইমরান, সব ঠিক আছে?”

ইমরান ভণিতা না করে রোবোটিক স্টাইলে বলল,
“আরাবী কোথায়?”

ফোনের অপর প্রান্তে থাকা রিফাত এবার নড়েচড়ে বসল। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,
“আরাবী কেন হঠাৎ? ইভানা কোথায়? সে ঠিক আছে তো?”

ইমরান আড়চোখে একবার ইভানা কে দেখে নিচু গলায় বলল,
“ঠিক নেই সে; একদম ঠিক নেই। আরাবীর বিপদের আশঙ্কায় সে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তবে সে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে।”

রিফাত বুঝতে পারল না ইমরানের বলা কথাগুলো। চেষ্টা করেও ব্যাহত হয়ে বলল,
“কি হয়েছে ইমরান? সব ঠিক আছে তো? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আরাবী সুস্থ, স্বাভাবিক আছে। ওর কিসের বিপদ?”

ইমরান একে একে প্রতিটি ঘটনা, চিরকুটে লেখা হুমকি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ননা করল। রিফাত সবটা শুনে শিউরে উঠলেও স্বাভাবিক গলায় বলল,
“ইভানা আছে আশেপাশে?”

ইমরান ফোন হাতে ইভানার কাছে গিয়ে লাউড স্পিকার চালু করতেই রিফাত দায়িত্বশীল পিতার ন্যায় অনড় গলায় বলল,
“আরাবীর কিছু হবে না ইভানা। আমি আমার জান দিয়ে আমার ভাইয়ের শেষ সম্বল আগলে রাখব। প্রয়োজনে নিজের সব কাজ ছেড়ে ছুঁড়ে চব্বিশ ঘন্টা আরাবীর পাহারা দেব। ওর ত্রিসীমানায় আমি শত্রুর ছায়াও মাড়াতে দেব না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আবরারের এক্সিডেন্টের সময় আমি ওর কাছে ছিলাম না। পারি নি ওকে রক্ষা করতে। কিন্তু আরাবী.. আমি আরাবীর কাছে আছি ইভানা। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও সাধ্যি নেই আমার আরাবীর ক্ষতি করে। প্রয়োজনে তুফান উঠিয়ে দেব, ধ্বংস লীলায় মাতবো, তবুও আবরারের শেষ স্মৃতির কোনো ক্ষতি আমি হতে দেব না। কোনো আঁচ আসতে দেব না। কথা দিচ্ছি।”

ইভানা কষ্ট ভুলে মুচকি হাসল। এটাও যে আবরারেরই ভালো মানুষির ফল। তার ভালবাসার প্রতিদান। কে বলে সে নেই? এই তো আছে সে! আছে তাদের চারপাশেই। প্রতিনিয়ত সাথ দিয়ে চলছে তাকে, তাদের।

নিজের কক্ষে সুসজ্জিত বিছানায় মৃত্তিকা কে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে এহসান খানিকটা অবাক হলো। অবাক হওয়ার চেয়ে মেজাজ খারাপটা বেশি হলো তার। এটা তো তার রাজত্ব। এখানে এই মেয়ের কি!

পাশেই টেবিলে রাখা পানির গ্লাসে চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ তুলল সে। কিন্তু মৃত্তিকার ওঠা তো দূর, কোনো নড়নচড়নও লক্ষ করা গেল না।
এহসান এবার বিরক্তও হলো। বিরবির করে বলল,
“মরার মত ঘুমাচ্ছে কেন, আশ্চর্য!”

মৃত্তিকা এহসানের অগোচরে মুখ টিপে হাসল। উঠবে কি সে! সে তো ঘুমায়ই নি! বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল মন ভরে। প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসে তিন দিন যাবত একা একা দিন রাত্রি যাপন করছে সে। এহসান অফিসিয়াল ফটোগ্রাফির কাজে বাইরে ছিল দিন চারেক। তার তিন দিনই মৃত্তিকা এসেছে এ বাড়ি।

বেলকনিতে আকাশে মত্ত থাকা অবস্থায় যখনই হালকা নজর গেইটের পানে পড়েছে তখনই শিউরে ওঠেছে মেয়েটা। সিলভার রঙের চকচকে নিখুঁত বিন্যাসে সজ্জিত গেইট ঠেলে তারই আপন মানুষটা ভেতরে পা রেখেছে যে! তৎক্ষণাৎ এক ছুটে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছে, ভান ধরেছে ঘুমের।

মৃত্তিকার ওঠার কোনো ভাবগতিক না দেখে ওয়াশরুমে ছুটে এহসান। মিনিট দশেক সেখানে কাটিয়ে এসেও মৃত্তিকার অবস্থান যথা স্থানেই আবিষ্কার করল। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সে। যেন আজন্মকাল ধরে ঘুমোয় নি। এই ঘুমই প্রথম এবং শেষ ঘুম।

ভেজা তোয়ালে মেলে দিতে গিয়েও দিল না। ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে ফিরে এলো বেলকনি থেকে। বিছানায় বসে আলতো করে ছড়িয়ে দিল মৃত্তিকার মুখের ওপর। এবার থাক ঘুমিয়ে!

মৃত্তিকা এবার মুখ লুকিয়ে আয়েস করে হাসল। শব্দহীন খিলখিল হাসি। যা কেবল শুনতে পেল অন্তরাত্মারা, অনুভূতিরা।

ব্যর্থ এহসান এবার কপাল চাপড়ে ঠাস করে শুয়ে পড়ল মৃত্তিকার সমান্তরালে। অজান্তেই কেঁপে উঠল মেয়েটি। এই তো সেদিন, এমনই মধুময় ছিল সময়গুলো। অথচ তা অশালীন, অনৈতিক, অবৈধ। বুক ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চায়, হাহাকার করে। কিন্তু কাঁদে না সে। পাথরের ন্যায় পড়ে রয়। তবুও যেন শুনতে পায় সেই পাষন্ড পুরুষ। মাথা উঁচিয়ে পাশে শায়িত রমনীর পানে তাকায়। হাত বাড়িয়ে তোয়ালে সরিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ঘুমন্ত মুখের আড়ালে জাগ্রত মাটিকে। মেয়েটা যে তখনো কৃত্রিম ঘুমে মগ্ন। এহসান ওঠে বসে। হাত টেনে উঠিয়ে বসায় মৃত্তিকাকেও।

মৃত্তিকা দু’হাতে চোখ কচলে ঘুমঘুম ভান করে। নিভু নিভু আঁখি জোড়া মেলে বলে,
“কি হয়েছে? তুলছো কেন এভাবে? তুমি এলেই বা কখন?”
এহসান নিখুঁত অভিনয়ে বেশ চমকিত হয়। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে। খাঁজ কাটা সুসজ্জিত চিবুকে হাত বুলিয়ে বলে,
“কোনটার উত্তর আগে দেব?”

মৃত্তিকা চোখ সরিয়ে নেয়। ছেলেটা যে মায়াময়, সর্বনাশা চোখ তার। এহসান পুনরায় হাসে। সে জানে মৃত্তিকার দুর্বলতা। এই হাসিতেই তো কাত সে! নইলে কি তার মত কড়া মেজাজী, বদমাশ মেয়েকে হাত করতে পারে এহসানের মত বাউন্ডুলে যুবক!

মৃত্তিকা বেশ কড়া গলায় বলল,
“কোনটারই প্রয়োজন নেই। আমি ঘুমাব। তুমি যাও এখন, বিরক্ত করো না।”

এহসান গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল। তার ঘর, তার বিছানা; কোথাকার কোন মেয়ে এসে বলে, যাও!

মৃত্তিকা পুনরায় শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতেই এহসান হাত টেনে থামিয়ে কিঞ্চিৎ রাগান্বিত গলায় বলল,
“তুমি আমার বাড়িতে কি করছো? বেরিয়ে যাও এক্ষুণি। নিজের জায়গায় গিয়ে ঘুমাও। এটা তোমার উপযুক্ত জায়গা নয়।”

মৃত্তিকা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“আমার ঘর, আমার সংসার। তুমি কে হে আমাকে চলে যেতে বলার। যাও রাস্তা মাপো।”

এহসান চোখ বড় বড় করে তাকাল। এ তো সেই কয়েক বছর আগের মাটি। সেই তেজ, সেই ঝাঁঝ! অতীতে ফিরল কি করে সে!

“বন্ধু তুই লোকাল বাস
বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস
ঘাড় ধইরা নামাস।”

মৃত্তিকার মুখে গুনগুন করে উপরোক্ত লাইনগুলো শুনে এহসান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সরু গলায় বলল,
“লোকাল বাস? সেটা কি?”

মৃত্তিকা ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“তুমি! ঠিক লোকাল বাসের মতোই। আদর করে ডেকে এনে ঘাড় ধরে নামাচ্ছো।”

এহসানের কুঞ্চিত ভ্রু যুগল আরও খানিকটা কুঞ্চিত হলো। সরু গলায় বলল,
“আমি আদর করে ডেকে এনেছি? ঘাড়ই বা ধরলাম কখন?”

মৃত্তিকা উদাসীন হলো কয়েক মূহুর্তের জন্য। পরক্ষণেই নিজের ভেতরে থাকা ইভানার সত্ত্বা জাগ্রত হলো। বোল পাল্টে গেল চেহারার। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“সেটা চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবো; তাহলেই বুঝবে। এখন আবার এটা বলো না যেন, চিৎ হয়ে শুতে জানো না। আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে।”

এহসান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। মৃত্তিকা তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে পুনরায় গুনগুন করে বলল,
“বন্ধু তুই লোকাল বাস…
বন্ধু তুই লোকাল বাস
আদর কইরা ঘরে তুলস
ঘাড় ধইরা নামাস… ”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ১১

ল্যাভেন্ডার রঙা তুলির আঁচর কারো দেয়ালে থাকতে পারে! থাকতে পারে, সেখানে ক্যাটক্যাটে লাল রঙা পর্দা! সিঙ্গেল সোফায় থাকা কুশনটায়ও ল্যাভেন্ডার রঙের সুতোর কারুকার্য। মৃত্তিকা নাক সিটকাল একজন রুচিশীল মানুষের এমন অদ্ভুতুড়ে রুচি দেখে। বিশেষত লাল রঙা পর্দাটাই নজর কাড়ল অত্যাধিক।

কামরাটা আহনাফ সরকারের। সভ্য, মার্জিত মানুষটার কক্ষ হবে মার্জিত বর্ণের; এমনটাই ভেবেছিল মৃত্তিকা। কিন্তু স্বচক্ষে রুমের এমন বেহাল দশা থেকে মনে মনে তার রুচিকে খানিকটা ভর্ৎসনাও জানালো।

সরকার বাড়িতে প্রায় সপ্তাহ খানেক কাটালেও এই কক্ষে এই প্রথম পদচারণা তার। প্রবেশাধিকার পেতেই নজরে তার বহুব্রীহি রঙের পশরা লেগেছে। এদিক ওদিক তাকাতেই নজরে এলো কিছু ফটো ফ্রেম। রঙ বেরঙের ফ্রেমে সাজিয়ে কিছু ছবি দেয়ালে সেঁটে দেওয়া আছে। সেসবের দিকে আগ্রহ নেই তার। তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিল তৎক্ষণাৎ।

নিঝুম নিস্তব্ধ কক্ষে কোনো জনমানবের উপস্থিতি টের না পেয়ে হাতের ধরে রাখা সাদা রঙা কফিমগ বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে রাখতে গিয়ে নজর আটকালো সোনালী বর্ণ ফ্রেমে। কাঙ্খিত মুখটা অক্ষি পল্লবের দুরত্ব বাড়িয়ে দিল বহুগুণ।

দুজন সুখী মানুষ মুখে একরাশ হাসি লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে। নজর তাদের দু’জনের দিকেই সীমাবদ্ধ। যেন চোখে চোখে করছে দুনিয়াবি হাজারো আলাপন। মানুষ দু’জন আবরার এবং আহনাফ।

মৃত্তিকা নিচু হয়ে কফি মগটা রেখে ওভাবেই হাতে তুলে নিল ছবিটা। বুঝতে চেষ্টা করল দু’জনের মধ্যকার কেমিস্ট্রি। আদৌ কোনো শত্রুতা আছে এদের মধ্যে? থাকতে পারে? এত স্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে দেখা মানুষটাকে খুন করতে পারে কি সরকার বাড়ির বড় ছেলে! মৃত্তিকার মাথা ঘুরে ওঠে; ঘুরতে থাকে ভনভন করে। যন্ত্রণা হয় প্রখর থেকে আরও প্রখর। মাথায় হাত চেপে ধরে টেবিলে ছবিটা রাখতে চায়। কিন্তু ফসকে যায় হাত থেকে। নিচে পড়ে কাচ ভাঙা ঝনঝন শব্দ হওয়ার আগেই এক শক্তপোক্ত পুরুষালী হাত আগলে নেয় প্রিয় ফটোফ্রেম। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে চাপা আর্তনাদ।

মৃত্তিকা অপরাধীর ন্যায় তাকায়। অতঃপর মাথা নিচু করে ফেলল। আহনাফ মৃত্তিকার অপরাধে মরমর চেহারা দেখে মুচকি হাসে। কণ্ঠে হাসি রেখেই বলল,
“মৃত্তি, তুমি এসময়? কিছু দরকার?”

মৃত্তিকা হাত উঁচিয়ে মগ দেখিয়ে আমতাআমতা বলল,
“কফি দিতে এসেছিলাম স্যার। ছবিটা দেখতে পেয়ে…..”

আহনাফ মৃদু হেসে ছবিটির দিকে তাকাল। আলতো করে ছুঁয়ে নরম গলায় বলল,
“আবরারের ছবি দেখে হাতে নিয়েছিলে?”

মৃত্তিকা মাথা উপর নিচ করে সত্যিটা স্বীকার করে নিল।
আহনাফ মৃদু হেসে বলল,
“আরও অনেক ছবি আছে আমাদের ফ্যামিলি অ্যালবামে। মায়ের কাছে গিয়ে বলো অ্যালবাম দেখতে চাও। আবরারের ছবি দেখতে চাইলে কিন্তু দেখাবে না।”

মৃত্তিকা চোখ মেলে আহনাফের মুখোমুখি তাকাল। সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
“কেন? কেন দেখাবে না স্যার?”

“আছে কিছু কারণ।” আহনাফের হেয়ালিপনা উত্তর।

মৃত্তিকা অসন্তোষ হলো। সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“আবরার স্যার আপনার ক্লোজ ছিল স্যার?”

আহনাফ উত্তর দিল না মৃত্তিকার প্রশ্নের। কথা ঘুরিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে এত স্যার স্যার বলছো কেন মৃত্তি? মিস আফরোজ কে তো দিব্যি আপু আপু বলে ডাকো।”

মৃত্তিকা মুচকি হেসে বলল,
“সে আমার আপুই হয়।”

আহনাফ জেদি বাচ্চার মত বলল,
“তাহলে আমি তো আরও দলিল করা ভাই হই। আমার একমাত্র এবং একমাত্র বেপরোয়া ভাইয়ের বউ তুমি। ভাই তো আমি বটেই।”

মৃত্তিকা আহনাফের কণ্ঠে এমন জেদি বাচ্চার ন্যায় কথা শুনে কিছু সময় অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অতঃপর ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল সে; সঙ্গে তাল মেলালো আহনাফও।

“আবরারের আবিষ্কৃত ফর্মুলা অনুযায়ী কাজ করার সময় এসে গেছে।”
ইমরানের দীপ্ত কণ্ঠে এহেন বাক্য শুনে ইভানা স্থির দৃষ্টি ফেলল তার উপর। কিঞ্চিৎ সময় পর বলল,
“আর কোনো ক্লু পাওয়া গেছে?”
ইমরান মাথা নেড়ে বলল,
“অপরাধী খুব ধূর্ত প্রকৃতির। অভিনব পন্থায় সে নিজেকে আড়ালে রাখছে। সে যে খুব কাছের কেউ সেটা বুঝতে পারছি; অথচ জানতে পারছি না সে কে! কতটা ধূর্ত হলে ল্যাবে এসে চিরকুট রেখে যেতে পারে, সেটাও কাউকে টের পেতে না দিয়েই।”

ইভানা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এটাই আজকাল একমাত্র সঙ্গী তার। নিয়ম করে তিনবেলা মেডিসিনের ন্যায় দীর্ঘশ্বাস জমা হয় বক্ষস্থলে।

ইমরান পুনরায় বলল,
“আজ কৌশলে সবাই কে জানাবে, আবরারের তৈরি ফর্মুলার হদিস তুমি পেয়েছো এবং তদনুযায়ী কাজ করতে শুরু করবে। যদিও সে হয়তো এটা জেনেই বসে আছে।”

ইভানা মাথা নেড়ে সায় জানালো। অতঃপর বলল,
“এতে কি কাজ হবে বলে মনে হয়?”

“হতেই হবে।” ইমরানের অনবদ্য উত্তর। যেন সে ভবিষ্যত জেনে বসে আছে।

ল্যাবরেটরিতে হুমকিস্বরূপ চিরকুট পাওয়ার পর ইভানা এবং ইমরান দরজার সম্মুখে থাকা সিসি ক্যামেরা হতে প্রাপ্ত ফুটেজে সূচ খুঁজা চেষ্টা চালায়। কিন্তু ফলাফল আশানুরূপ পায় নি। তবে এটা নিশ্চিত হয়েছে যে খুনি তাদের গবেষণাগারেরই একজন। অযাচিত কোনো মনুষ্যের প্রবেশাধিকার সেদিন ঘটে নি সেখানে। বড্ড আফসোস হয় ল্যাবের ভেতরে কোনো সিসি ক্যামেরার উপস্থিতি না থাকায়।

অতঃপর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, আগামীকাল প্রত্যুষে ইভানা নিজের কাছে থাকা আবরারের সৃষ্টি অমূল্য সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে এবং ঘোষণা দেবে তার স্বপ্ন কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।

আহনাফের কক্ষ থেকে আকাশসম কৌতূহল নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা ফেলে মৃত্তিকা। শ্বাশুড়ি শেলী সরকার রান্না করতে ব্যস্ত থাকায় তার কাছে যায় নি প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে।

প্রশ্নের সমুদ্রে ডুবে থাকা মৃত্তিকা বেঘোরে নিজের ঘরের বিছানায় বসতেই এহসান চেঁচিয়ে উঠল। মৃত্তিকা চমকে উঠে দাঁড়াল তৎক্ষণাৎ। হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে দেখল এহসানের হাত ঝাঁকিয়ে করা মৃদু আর্তনাদ।
মৃত্তিকা অপরাধী গলায় বলল,
“কি হয়েছে?”
এহসান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“একটা গরু এসে হাতের উপর পড়েছে।”

মৃত্তিকা হেসে ফেলল এহেন বাক্য শুনে। হাসতে হাসতেই বলল,
“ভাগ্যিস হাতি আসে নি।”

এহসান সরু চোখে তাকাল। মৃত্তিকা শব্দ করে হেসে উঠল তার দৃষ্টি দেখে। ঘোর লাগা নয়নে মুক্তোঝরা হাসি অবলোকন করল একজোড়া আঁখি। বিছানা থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল,
“একটু ছুঁই?”

মৃত্তিকা পিছিয়ে এলো। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল হাজারো বারণ।

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ১২

পারিবারিক অ্যালবামে জায়গা পাওয়া মানুষটা পরিবারেরই একটা অংশ। এটা সদ্য জন্মানো বাচ্চাকেও বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সজ্ঞানে থাকা প্রতিটি মানুষই এটা বুঝার ক্ষমতা রাখে।

শেলী সরকারের তত্বাবধানে তুলে রাখা ফ্যামিলি অ্যালবামে থাকা ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মৃত্তিকা। অসংখ্য ছবির মাঝে আবরারের ছবিও হাতেগোনা নয়। তবে এগুলো যে বেশ পুরনো তা স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। হতে পারে তা চার থেকে পাঁচ বছর আগের। যে সময়টাতে মৃত্তিকা বিভোর ছিল আবরারে। সকাল সন্ধ্যা বিমুগ্ধ হয়ে ডুবে থাকত তারই ভাবনায়। চৈতন্যচিত্তেও ছিল সে।
মৃত্তিকা মুচকি হাসল। সময় কত দ্রুত যায়। কত সহজে পরিবর্তন হয় পরিস্থিতি। শুধু ভেতরটা বয়ে বেড়ায় লম্বা এক শ্বাস, কিছু আফসোসের সুর।

সদা হাস্যজ্বল আবরারের লেপ্টে থাকা হাসিমুখের বেশ কিছু ছবির সন্ধান পাওয়া গেল সরকার বাড়ির অ্যালবামে। আহনাফের সাথে তো বটেই; কিছু ছবি শেলী সরকারের সান্নিধ্যেও। শুধু বাকি রয়েছে এহসান।

এহসান সরকারের সঙ্গে কোনো আলেখ্যর সন্ধান না পেয়ে মৃত্তিকা শ্বাশুড়ির কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মা, আপনার ছোট ছেলের সঙ্গে কেন আবরার স্যারের ছবি নেই?”

“এহসান আবরার কে পছন্দ করতো না।” শেলী সরকারের কাটকাট উত্তর।

মৃত্তিকা অবাক হলো। এমনও মানুষ হয়! আবরারের মত মানুষ কে অপছন্দ করা যায়! পরক্ষণেই ভাবল- হ্যা যায়। নইলে কি পারতো কেউ তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে!

আবরারের আবিষ্কৃত ফর্মুলা অনুযায়ী কাজ এগিয়ে যেতে ইভানা বেশ হিমশিম খাচ্ছে। যোগ্যতা এবং সাহস দু’দিক থেকেই পিছিয়ে সে। অভিজ্ঞতাও খুবই নগন্য। লেখাপড়া চলাকালীন সময় এত দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার স্বপ্ন সে কস্মিনকালেও দেখেনি। দেখেনি কারো স্বপ্ন পূরণের স্বপ্নও। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে জীবন তার খেই হারিয়ে ফেলল। না খেই হারায় নি। বরং পেয়েছিল নীড়ের ঠিকানা। সত্যিকারের নীড়। একজন মেয়ের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল। যদিও তা বিধাতা কেড়ে নিয়েছেন অতিদ্রুত। তবুও রয়ে গেছে সেই নীড়। হয়তো ঘরটা তার শূন্য ;কিন্তু কোথাও এখনো তার কণ্ঠের সেই সুর বাজে। বাজে তার ভালবাসার নিখাঁদ কিছু শব্দবাণ।

প্রায় হাঁপিয়ে ওঠা ইভানার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল ৩৫ বছর বয়সী গৌতম বিশ্বাস। সাহায্যের হাত তার বরাবরই বেশ লম্বা। নইলে কেন সে সেই শুরু থেকে ইভানার প্রতিটি কাজে তাকে সাহায্য করে চলেছে!

ভিন দেশে, নতুন প্রফেশনে সদ্য পা ফেলা ইভানা যখন দিকবিদিকশুন্য এক নারী; তখন থেকেই গৌতম বিশ্বাস তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঝপথে থেমে যাওয়া রিসার্চ নিজ দায়িত্বে সম্পূর্ণ করেছে। ইভানাও ভরসা করে কতশত কাজ আধফেলা করে ক্লাসে চলে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। গৌতম বিশ্বাস তা ঠিকঠাক মতোই সম্পূর্ণ করেছে। হয়তো এটাও আবরারের ভালো মানুষির ফল।

একটু একটু করে এগোনো কাজের ফাঁকে হঠাৎ ইমরান এগিয়ে এসে ইভানা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনার ফোন কোথায়?”

ইভানা পূর্ণ মনোযোগ কাজের দিকে রাখতে চেষ্টা করেই বলল,
“আমার?”

“হুম। রিফাত ভাই কল দিয়েছে। আরাবী আপনাকে চাইছে। কাঁদছে বোধহয় সে। আউট অফ কন্ট্রোল হওয়াই বাধ্য হয়ে আপনাকে জানাতে চাইছে। অথচ আপনার কোনো খোঁজ খবর নেই। ফোন কোথায় রাখেন আপনি?” ঝাঁঝ ঢালা গলা ইমরানের।

ইভানা আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। এ কেমন মেজাজ তার! এ যেন নতুন কণ্ঠ, নতুন সুর। আগের ইমরানের তো এমন ঝাঁঝাল মেজাজ নেই।

ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইমরান পুনরায় বলল,
“কি হলো? কিছু বলেছি আমি?”

ইভানা দ্রুত হাতের গ্লাভস খুলে বলল,
“দিন তাড়াতাড়ি।”

অতঃপর ফোন টেনে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল বাইরের দিকে।

ইমরান গৌতম বিশ্বাসের দিকে মুচকি হেসে তাকাল। তার অবাক দৃষ্টি দেখে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে রেখেই বলল,
“কিছু বলবেন নাকি মিস্টার বিশ্বাস?”

গৌতম বিশ্বাস কৌতুহলী গলায় বলল,
“আপনারা কি পূর্ব পরিচিত?”

“সেরকম কি মনে হচ্ছে?” চোখে প্রশ্ন রেখে কৌতুকে গলায় বলল সে।

গৌতম বিশ্বাস কিছু বললেন না। তবে চোখে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি তার।

ইমরান সিরিয়াস মুখ করে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“সে আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল।”

কিঞ্চিৎ সময় চুপ থেকে পুনরায় সিরিয়াস ভঙ্গিতে
বলল,
“আগের জন্মে।”

অতঃপর হেসে উঠল দুজনেই; শব্দ করে। সেই শব্দে ছাপিয়ে গেল আশেপাশের কয়েক গজ জায়গা। একসময় তা মিলিয়েও গেল শূন্যে।

বাহিরমুখো ইভানা যখন পুনরায় ল্যাবরেটরিতে পা ফেলল, তখন তার চেহারায় শোভা পাচ্ছিল একরাশ দুশ্চিন্তা। আরাবীর হাতের মুঠোয় পাওয়া গেছে আরও একটি হুমকি বার্তা।

“আবরারের একমাত্র এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী। মিস করো বাবা কে! যাবে নাকি তার কাছে!”

দূর্ভাগ্যবশত কাগজখানা হাতে পড়ে নোভার। তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে সে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। তার কর্কট কণ্ঠে ছোট্ট আরাবী কান্না জুড়ে দেয়। যা থামানোর সাধ্যি হয় নি কারো। ফলস্বরূপ ডাক পড়ে ইভানার। কন্যার কান্না থামানোর দায় পড়ে নিজ মাতার কাঁধেই।

দিন কতক পরের ঘটনা।
বদ্ধ স্নানাগারে নিজেকে পাক সাফে ব্যস্ত ইভানার হঠাৎ খেয়ালে আসে তার বন্ধ কক্ষে কারো প্রবেশাধিকারের শব্দ। তৎক্ষণাৎ কান উঁচিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে চেষ্টা করে। অতঃপর কানে আসে জিনিসপত্র উল্টেপাল্টে ফেলে দেয়ার শব্দ। ইভানা সচকিত হয়। হাতের কাছে রাখা ফোনটা থেকে কলদেয় পরিচিত নম্বরে। যা ডায়ালে থাকে সবসময়। ইমরান! হ্যা, ইমরান। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা একমাত্র আপন কেউ একজন।

দু’বার রিং হওয়ার পরই নিভু নিভু গলায় বলল,
“বলুন। নতুন কিছু পেলেন?”

ইভানা নিচু গলায় বলল,
“আমার ফ্ল্যাটে কেউ এসেছে ইমরান। বোধহয় কিছু খুঁজছে। হতে পারে আমাকেও।”

ইমরানের ঘুম ঘুম চোখ তৎক্ষণাৎ ঘুমশূন্য হলো। এক নিমিষে পালিয়ে গেল যেন। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে নামতে নামতে শুধালো,
“আপনি, আপনি কোথায়? ঠিক আছেন?”

“আমি ওয়াশরুমে। এখন পর্যন্ত ঠিক আছি। কিছু করুন প্লিজ।” ইভানার আকুতি ভরা কণ্ঠস্বর।

ইমরান বেরিয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ। দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো হন্তদন্ত হয়ে। পেছনে ঝটকা খাওয়া দরজার পাল্লা খুলে রইল হাট করে।

কেবল অস্থির চিত্তে বলল,
“আপনি বের হবেন না ইভানা। আমি আসছি।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here