নিবিদ্রিতা কাহন পর্ব -২৭

#নিবিদ্রিতা_কাহন—-২৭
®মেহরুমা নূর

★হলুদের ফাংশন প্রায় শেষের দিকে। বরপক্ষ থেকে লোক এসে হলুদ দেওয়াও প্রায় শেষ। সবাই আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমেই অনুষ্ঠান উপভোগ। হলুদের সাথে সাথে নাচ গানও হচ্ছে ফাটাফাটি। সবাই নাচছে, শুধু বেচারি আদ্রিতা নাচতে পারছেনা পায়ের জন্য। বসে থেকেই হাত নাড়িয়ে যা একটু করতে পারছে। উঠতে চাইলেও নিবিড়ের অগ্নি চোখের চাহুনির সামনে আর উঠার সাহস পাচ্ছে না সে। কিছুক্ষণ গাল ফুলিয়ে ভেংচি কেটে আবার বসে পড়ছে। লোকটার হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তন তাকে কনফিউজ করে দেয়। এই জোয়ার, এই ভাটা। তখনতো কতো ভালো মানুষ লাগছিল। হঠাৎ করে কোন ইঁদুরে কাটলো কে জানে। মুখটা কেমন ডিপজলের কো,পা শামসুর মতো বানিয়ে রেখেছে। যেন কুড়াল নিয়ে এখুনি কো,পা,নো শুরু করে দিবে। কত সুন্দর অনুষ্ঠান। একটু নাচলেও তো পারে।নিজেতো নাচবেনা আবার আমাকেও নাচতে দিবেনা। শুধু দেখতেই হিরো। কাজকর্ম পুরাই মিশা সওদাগর। তাও কতো ভক্ত তার। বরপক্ষের মেয়েগুলো যেন পারলে তার কোলে উঠে পড়ে। মাছির মতো উনার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কি দিনকাল এসে গেল। মেয়েদের রুচি বলতে কিছু নেই। শেষমেশ কিনা এই দৈত্য দানবের উপর ক্রাশ খাচ্ছে।

আদ্রিতার ভীষণ বিরক্ত লাগছে হঠাৎ। এখানে আর থাকতেই ইচ্ছে করছেনা। উঠে যেতে চাইলে তখনই জোভান এসে উপস্থিত হলো সেখানে। তাকে দেখে আদ্রিতার বিরক্তি যেন আরও বেড়ে গেল অকারণেই। জোভান মাত্রাতিরিক্ত হাসি হাসি মুখ করে বলল,
“কি হলো অরি! তুমি নাচছ না কেন! এমন অনুষ্ঠানে তোমাকে চুপচাপ বসে থাকা মানায় না। চলো আমরা একসাথে ডান্স করি।”
আদ্রিতা জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“আসলে ভাইয়া, আমার পায়ে আঘাত পেয়েছি তো। তাই নাচতে পারবোনা। আপনি নাচুন না গিয়ে। ওইযে দেখুন সানভি নাচছে। ওর সাথে নাচুন। সানভি,সানভি..
জোভানকে বলার সুযোগ না দিয়ে সানভিকে ডাকা শুরু করে দিলো আদ্রিতা। সানভি আদ্রিতার কাছে আসতেই আদ্রিতা বলে উঠলো,
” সানভি জোভান ভাইয়া না তোর সাথে নাচতে চাইছে। নিয়ে যা না উনাকে।তোর মতো সুন্দরী মেয়ের সাথে নাচলে উনি খুশি হবেন। দেখ বেচারা নাচার জন্য উতলা হয়ে গেছে। অনেক জোরে নাচ পেয়েছে তার। যেকোনো সময় বেড়িয়ে যাবে।”
সানভি মনে মনে খুশিই হলো। সে হাসিমুখে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। চলুন বিয়াই সাহেব।”
জোভান বেচারা আবারও থতমত খেয়ে গেল। সে কিছু বলারও যেন সুযোগ পেল না। সানভি এক প্রকার টেনেই নিয়ে গেল জোভানকে। বেচারা জোভান বারবার শুধু ধোঁকাই খাচ্ছে। পেতে চায় রসমালাই আর পায় শুধু মাশকালাই।

আদ্রিতা দেখলো বরপক্ষের মেয়েগুলো এখনো নিবিড়কে ঘিরেই আছে। যদিও নিবিড় ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এসবে বেশ একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেনা। কেমন অস্বস্তি তার চেহারায় বিদ্যমান। বোঝা যাচ্ছে সে আত্মীয়তা রক্ষার্থে ভদ্রতার খাতিরে অনিচ্ছুক ভাবে মেয়েগুলোর সাথে কথা বলে তাদের এড়িয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু বেশরম মেয়েগুলো তাও তার গলায় ঝুলে পড়ছে। তবুও আদ্রিতার মেজাজ কেমন রুষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইরিটেশন হচ্ছে তার। অভিমান হচ্ছে অযথাই। আদ্রিতা উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে এক পা হালকা খুড়িয়ে খুড়িয়ে স্টেজের সামনে থেকে সরে গিয়ে বাসার যেতে নিলে হঠাৎ বেখেয়ালিতে ঘাসের মাঝে থাকা একটা পাথরের সাথে পায়ে গুতা লাগলো আদ্রিতার। ক্ষত পায়ে আবারও একটু আঘাত পেয়ে ব্যাথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠলো সে। চোখে পানি চলে এলো ব্যাথায়। পাশের গাছে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের ব্যাথা প্রশমিত করার জন্য। হঠাৎ নিজেকে শূন্যে অনুভব করলো আদ্রিতা। চমকে চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে নিবিড়ের কোলে পেল সে। বিস্মিত হলো কিছুক্ষণের জন্য। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিবিড় আদ্রিতাকে কোলে নিয়ে সোজা হাঁটা শুরু করলো। আদ্রিতা খেয়াল করলো নিবিড়ের মুখমন্ডল কেমন শক্ত করে আছে। উনার আবার কি হলো! আদ্রিতা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ ওদের এভাবে দেখছে কিনা। এদিকটাই লোকজন নেই তেমন। সবাই স্টেজের ওখানে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সে৷ এই অবস্থায় কেউ দেখে ফেললে নানান কথা বলবে। বিশেষ করে গ্রামের লোকজন দেখলে। এই লোকের কি কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই নাকি!

নিবিড় আদ্রিতাকে নিয়ে এসে বাগানের এক বেঞ্চে বসিয়ে দিলো। এটা স্টেজের অপর পাশে। এদিকে লোকজন তেমন নেই। আদ্রিতাকে বসিয়ে দিয়ে তার সামনে নিচে হাঁটু গেঁড়ে বসলো নিবিড়। হাত বাড়িয়ে আদ্রিতার ব্যাথা পাওয়া পা টা সামনে আনলো। পায়ের জুতো খুলতেই ব্যাথায় আবারও হালকা আর্তনাদ করে উঠলো আদ্রিতা। চোখের পানি আবারও গাল বেয়ে পড়লো।গুতা লেগে আদ্রিতার পায়ের আঙুলের মাথা লাল হয়ে গেছে। নিবিড় ক্রুদ্ধ নজরে তাকালো আদ্রিতার পানে। চোয়াল শক্ত করে বলল,
“এখন কাঁদছিস কেন? আমার কথা না শোনারতো পণ করে নিয়েছিস তাইনা!তোকে বলেছিলাম না একা একা কোনদিকে যাবিনা! হাঁটার সময় চোখ খুলে পকেটে রেখেদিস! বলদি একটা! একই জায়গায় বারবার চোট লাগানোর মহৎ গুণ তোর মাঝেই আছে শুধু।”
আদ্রিতার এমনিতেই ব্যাথা লেগেছে। তারউপর নিবিড়ের কথায় যেন তার অভিমান হলো ভীষণ। আদ্রিতা নিবিড়ের হাতের উপর থেকে নিজের পা সরিয়ে নিয়ে অভিমানী সুরে বলল,
“ঠিক আছে, আমার দোষে আমি ব্যাথা পেয়েছি। ভুগবোও আমি। আপনাকে এতো পেরেশান হতে হবে না। আপনার মূল্যবান সময় অযথা খরচ না করার দরকার নেই। আপনারতো অনেক কাজ।মেহমানরা আপনাকে না পেলে নারাজ হয়ে যাবে। যান সেখানে যান। আমারটা আমি দেখে নিবো।”
বলেই আদ্রিতা উঠে যেতে নিলো। অভিমানের বশে ধপ করে ক্ষত পা’টা নিচে রাখতেই আবারও ব্যাথা পেল সে। তবুও মালুম না করে এগুতে নিলেই পেছন থেকে হাতে টান পড়লো। নিবিড় আদ্রিতার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো। আদ্রিতা হুমড়ি খেয়ে পড়লো নিবিড়ের কোলের মাঝে। আদ্রিতা পড়ে যাওয়ার ভয়ে নিবিড়ের কাঁধ চেপে ধরলো। নাক গিয়ে ঠেকলো নিবিড়ের বু্কে।নিঃশ্বাসে পেল সেই পরিচিত মোহময় ঘ্রাণ। নিবিড় হাতের আঙ্গুল দিয়ে আদ্রিতার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে মুখ উপরে তুললো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“সাহস অনেক বেশিই বেড়ে যাচ্ছে তোর আজকাল। আমাকে ওভারটেক করে যাওয়ার সাহস হয় কি করে তোর! আমার জন্য কোনটা জরুরি সেটা এখন তোর মতো বলদির কাছ থেকে জানতে হবে আমার!”
আদ্রিতা কিছু বললো না। অভিমানে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলো।নিবিড়ের কোল থেকে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু নিবিড়ের শক্ত বাঁধনের জোরে তা পারলোনা সে।অগত্যা মুখ অন্য দিকে রেখে নাক টেনে ফোপাঁতে লাগলো আর নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। নিবিড় এবার চোয়াল ছেড়ে আলতো করে আদ্রিতার গালে হাত রেখে তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরালো। নরম সুরে বলল,
“এতো অভিমান কোথায় পাস তুই! ফ্যাক্টরি দিয়েছিস নাকি অভিমানের! নির্ঘাত চায়না মাল দিয়ে তৈরি করেছিস ফ্যাক্টরি। তাইতো কথায় কথায় বিগড়ে যায়।”
আদ্রিতা অভিমানী সুরে বলল,
“আমার কোন অভিমান নেই।আর কেন করবো অভিমান! আপনি ওই মেয়েগুলোর সাথে যা খুশি তাই করুন। দরকার হলে তাদের কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তাতে আমার কি! আমি কেন সেটা নিয়ে জেলাস হতে যাবো!”
নিবিড় বাঁকা হেঁসে বলল,
“কিন্তু আমিতো কোনো মেয়ের কথা বলিইনি।”
থতমত খেয়ে গেল আদ্রিতা। কি বলতে কি বলে ফেললাম। ঠিকই বলেন উনি৷ আমি আসলেই একটা বলদি। নিবিড় আদ্রিতার কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
“পোড়া পোড়া গন্ধ কেনরে! জ্বলে নাকি!”
তনু মনে আবারও আলোড়ন ছড়ালো আদ্রিতার। নিবিড়ের এমন ফিসফিসানির সুরে শিহরিত কম্পনে চোখ মুদে নিলো সে। পায়ের যন্ত্রনার পরিবর্তে এবার হৃদপিণ্ডে যন্ত্রণা শুরু হলো।সেই যন্ত্রণা থেকে বাচতে আদ্রিতা কম্পিত স্বরে বলে উঠলো,
“ছা….ছাড়ুন, কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
নিবিড় আদ্রিতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“সো! আই কেয়ার আ ড্যাম। তুই এখানে বোস আমি আসছি এখুনি। ”
আদ্রিতাকে বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে নিবিড় উঠে গেল। কিছুক্ষণ পরই হাতে একটা দইয়ের বোল নিয়ে ফিরে এলো সে। আদ্রিতার সামনে বসে চামচে দই নিয়ে আদ্রিতার মুখের সামনে ধরে বলল,
“নে মুখ খোল৷খাবারের নামে যে ইয়ার্কি করেছিস তা জানা আছে আমার। আজ ব্যস্ত ছিলাম তাই তোর ফাঁকিবাজি ধরতে পারিনি। এখন এটা খেয়ে নে ফটাফট।”
আদ্রিতা করুন সুরে বলল,
“আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা সত্যিই। আজ আমি একটুও ফাঁকিবাজি করিনি। অনেক খাবার খেয়েছি। পেট ভরে আছে।”
“তোর সত্যি তোর কাছেই রাখ৷ নাহলে রোদে শুকিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়ে ফেল৷ তোর ওই বাসিপচা সত্যি আমাকে দেখাতে আসিসনা খবরদার! এখন কথা না বাড়িয়ে এটা খেয়ে নে৷ নাহলে তোকেই দুই ভাগ করে কে,টে রোদে শুকিয়ে অরিসত্ব বানিয়ে দেবো।”
অসহায় আদ্রিতা জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় মুখ করে দই মুখে নিলো। তার দৈত্য দানব টা তাকে পুরোটুকু খাইয়েই দম নিলো। আদ্রিতার জান শেষ। এই লোকটার টর্চারে একদিন পটল তোলা পাক্কা হয়ে যাবে তার। কোনদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে পরলোকে আবিষ্কার করতে পাওয়া যাবে। তবুও যেন এই অসহ্য লোকটাকে ঘিরেই আদ্রিতার সকল অনুভূতির আয়োজন। এইযে কিছুক্ষণ আগেও যে মন খারাপ টা ছিলো। এখন তা আর নেই। ওর সম্মুখে বসা সুদর্শন পুরুষ টা। তার শুভ্র মুখটাতেই যেন এক সমুদ্র প্রশান্তি। তার চোখের তারায় যখন আদ্রিতা নিজের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি দেখে তখন পৃথিবী রঙিন, তার সুবাস নিঃশ্বাসে দেয় শীতলতা,তার আবহে সব সুন্দর। আবার এই মানবটাই আদ্রিতার সকল বিষন্নতা,অভিমান আর পীড়ারও কারণ। সকল রকম অনূভুতি শুধু যেন তাকে ঘিরেই। আদ্রিতার সকল অনূভুতি গুলো যেন অকপটে বলছে, “হে মানব, আমি একমাত্র তোমার নামেই ঘোষিত । আমাতে আর কোনো কিছু আশ্রয় পায় না।”
__

সবাই মজা করছে। শুধু তাসান বেচারা পারছেনা। অনুষ্ঠান শেষ হতে চলল অথচ সে একটা মাছও তার বরশীতে আটকাতে পারলোনা। তাসানের এমন ঝুলিয়ে রাখা মুখ দেখে ফয়সাল বলে উঠলো,
“কি হয়েছে ভাইয়া! মুখটা এমন চুনোপুঁটির মতো বানিয়ে রেখেছেন কেন?”
তাসান আপসোসের সুরে বলে উঠলো,
“তো কি করবো! আরে দেহসনা চারিদিকে কত বাহারি ফুলের মেলা। অথচ আমার পিরিতের ফুলদানিতো খালিই থেকে গেল। একটা ফুলও পড়লোনা তাতে। তুইই ক ফয়সাল, কি কমতি আছে আমার মাঝে! আমার মতো হট আইটেম কে একবার দেখলেইতো মাইয়াগো তিনবার করে প্রেমে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাওয়া অনিবার্য। রবি বাবা এরইমধ্যে তার নারীসেবার সেঞ্চুরি কমপ্লিট করে ফেলেছে। আর আমি তার এতবড় শীর্ষ হয়েও এখনো পর্যন্ত খাতাই খুলতে পারলাম না। এই দুঃখে আমার হলুদ খেয়ে মরে যেতে মন চাইছে।”
ফয়সাল হেঁসে দিয়ে বলল,
“আরে চিন্তা কোরোনা ভাইয়া। মনোবল রাখো। তোমারও আজকে বোনি হয়েই যাবে দেইখো।”
অপরাহ্ন পাশ থেকে বলে উঠলো,
“বাদ দে পাগলা৷ তোর দ্বারা হবে না। গ্রামের মেয়েদের তোর মতো বাঁদরের চামচিকা হওয়ার শখ নেই।”
“কিহ! এত্তো ইনসালাত! এখনতো ইগোর ব্যাপার হয়ে গেল। এন্ড মাই ইগো ইজ ভেরি ইগোয়েস্টিক। তুই দেখ খালি। আইজ খালি ওয়ার্ম আপ না আসল খেলা হবে খেলা! আজতো তোকে দেখিয়েই ছাড়বো এই তাসান দ্য গ্রেট কি চিজ!”

নিজের মহত্ত্ব প্রমাণ করতে তাসান বদ্ধপরিকর হয়ে মাঠে নেমে পড়লো। আশেপাশে সার্চ লাইট মেরে খুঁজতে লাগলো কাকে টোপে ফেলা যায়। অতঃপর সে পেয়েই গেল কাউকে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে একটা মেয়ে এক মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটা গ্রামের হবে। দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেক সহজসরল আর ভীতু মেয়েটা।কারণ মধ্যবয়স্ক লোকটার সামনে কেমন যেন ভয়ে জমে যাওয়ার মতো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। আর মধ্যবয়স্ক লোকটা যেন নিজের ওজনের চাইতেও চারগুন বেশি দাম্ভিক ভাব করে আছে। যেন গ্রামের জমিদার সাহেব উনি। লোকটা মেয়েটাকে কথায় কথায় ধমক দিচ্ছে। এটা খেওনা,ওটা কোরোনা,ওখানে যেওনা, মাথায় কাপড় টানো।এসব আরও অনেক কিছু বলে মেয়েটাকে শুধু ধমকাচ্ছে।আর মেয়েটা মাথা নত করে ভীত হয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে শুধু। তা দেখে তাসান বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে ফয়সালের উদ্দেশ্যে বলল,
“মাইয়াডারে চিনিস নাকি!”
ফয়সাল ভালো করে লক্ষ করে বলল,
“নাতো ভাইয়া। তবে লোকটাকে চিনি। ফাইজা আপুর বরের ফুফাতো বোন জামাই। মেয়েটা বোধহয় উনার বোন টোন হবে।”
তাসান বাঁকা হেঁসে বলল,
“কাজ হয়ে গেছে ফয়সাল। আজতো বোনি হয়েই গেল ধর। এমন গ্রামের সহজসরল মেয়েইতো আমার চাই। এরা একেবারেই সরল হয়। এদের যা বোঝানো যায় তাই বোঝে। একেবারে কাঁদা মাটি। যেমনে চাইবো তেমনেই হইবো। আমার মতো একটা পরদেশী বাবু পাইলে আর কি লাগে। আমারে পাইয়া খুশিতে গান গাইবো ♬ ইক পারদেশী মেরা দিল লে গায়া, যাতে যাতে মিঠা মিঠা দারদ দে গায়া……। তোরা দাঁড়া আমি তাকে মিঠা দরদ দিয়ে আসি।”
“কিন্তু ভাইয়া, লোকটা যে বদমেজাজি মনে হচ্ছে। সে থাকতে ওই মেয়ের ধারে কাছেও যেতে পারবে না। ”
“আরে এসব কোনো ব্যাপারই না। রবি বাবার শীর্ষ আমি। এসব সি গ্রেট ভিলেনদের কীভাবে বশে আনতে হয় তা ভালো করেই জানা আছে আমার। তোরা খালি দেখ কেমন ক্যালমা দেখাবো যে ওই লোক নিজে মেয়েটাকে আমার কাছে হস্তান্তর করে দিবে। খালি দেখে যা তাসানের কামাল।”
তাসান রবির সামনে গিয়ে বলল,
“জয় রবি বাবার জয়। রবি বাবা তোমার শীর্ষকে আশীর্বাদ দাও। সে যেন এই মিশনে সফল হয়ে ফেরে।”
রবি ঋষি মুনিদের মতো হাত উঁচু করে বলল,
“যাও বৎস যাও। জয়ী হও।”

তাসান যোদ্ধার মতো প্রস্তুত হয়ে তার কাজে নেমে পড়লো। সোজা হেঁটে গিয়ে মেয়েটা আর তার সাথে থাকা লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কেমন যেন অদ্ভুত মুখ করে লোকটার দিকে চোখ গেঁড়ে তাকিয়ে রইলো তাসান। লোকটা তখনও মেয়েটাকে বকাবাধ্য করতে ব্যাস্ত। হঠাৎ তাসানকে সামনে দেখে লোকটা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কি হইছে? এভো হইরা তাহাই আছেন ক্যা?”
তাসান কিছু না বলে সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। যেন লোকটার মাঝে কোনো রকেট সাইন্স আবিস্কার করছে সে। তাসানের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে লোকটা আবারও বলে উঠলো,
“কেডো ভাই আপনি! কি সমস্যা! কিছু কইব্যার চান! ”
তাসান এপর্যায়ে হঠাৎ দুই হাতে লোকটার দুই বাহু চেপে ধরে অবাক ভঙ্গিতে বলল,
“মদনা ভাই!”
লোকটা থতমত খেয়ে বলল,
“কিহ! কেডো মদনা ভাই!”
“কে মানে আপনিই মদনা ভাই। সেই ব্যাঙের মতো চোখ, সেই গন্ডারের মতো নাক, জলহস্তীর মতো পেট, গরুর লেজের মতো চুল, ক্যাঙারুর মতো কান।একদম হুবহু মদনা ভাই৷ আমার মদনা ভাই। ”
তাসান লোকটাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লূত হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“কোথায় চলে গিয়েছিলেন মদনা ভাই! কতো খুঁজেছি আমি আপনাকে। সেই যে আমাবস্যার রাতে বদনা হাতে নিয়ে জঙ্গলে মঙ্গল করতে গেলেন আর ফিরে এলেন না। একবারও কি এই ছোটো ভাইটার কথা মনে পড়লোনা! আপনাকে ছাড়া এই জীবন অনার্থক। যেমন সর্দি বিনা নাক, গন্ধ বিনা পাদ আর চুলকানি বিনা এলার্জি। তেমনই আপনাকে বিনা বেচারা আমি।”
লোকটার পিছনের টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে আঙুলে করে পানি নিয়ে নিজের চোখে দিয়ে অশ্রু বানাল তাসান। ভাবটা এমন যেন সিনেমার মতো ছোট বেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইকে ফিরে পেয়েছে সে। তাসানের এমন আচরণ দেখে লোকটারও যেন মুখমন্ডলের ভাব পরিবর্তন হলো। মায়া হলো বোধহয় তাসানের উপর।গলে যাওয়া গলায় সে নরম সুরে বলল,
“আহারে দেহোসেন কি কষ্ট গেদাডোর। তুমি কাইন্দো না ভাই। আমি তোমার মদনা ভাই না৷ কিন্তু তুমি চালি আমাক তোমার ভাই মনে কইরব্যার পারো। আমি তোমার বড় ভাইয়ের মতোই তো।”
“আপনি কতো ভালো মানুষ ভাইয়া। আজকালকার আপনার মতো ভালো মানুষ পাওয়াই দায়। আমি আপনার ছোট ভাই। এখন থেকে আপনার যা কিছু দরকার হবে আপনি আমাকে বলবেন। ছোট ভাইকে ভরসা করেন। আমি আপনার দেওয়া কাজ নিজের জান দিয়ে হলেও পালন করবো। আপনি কিছু খেয়েছেন? চলুন আমি আপনাকে ভালো করে খেতে দেই।”
“না না তার দরকার হইবো না। আমি খাছি। ”
“তা বললে হয়। আরে আপনি আমার ভাই। আপনাকে তো ভিআইপি ট্রিট দিতে হবে। আসেন আমার সাথে।”
তাসান একপ্রকার লোকটাকে জোর করেই খাবার টেবিলে এনে বসিয়ে দিলো। তার সামনে হরেক রকমের খাবারের মেলা লাগিয়ে দিলো। লোকটাও যেন নিজেকে কোন রাজা মহারাজার মতো ফিল করতে লাগলো। মুখে না না করলেও ঠিকই খাওয়া শুরু করলো। তাসান তখন মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল,
“ভাই উনি কে! উনাকেও খেতে দিবো?”
“ও আমার বুইন,তাসলিমা। ও এহন খাইবো না।আসলে ভালো হইছে তোমাক পাছি। তাসলিমাক নিয়া একটু চিন্তায় ছিলাম। ও এল্লা বোকাসোকা বুইঝল্যা। ভালো মন্দ কিছু বোঝেইনা। এহন এহেনে কত এ্যাজলা পোলাপান ঘুইরত্যাছে। এরমধ্যে ওক একা ছাড়ি কেবো হইরা কওতো!”
“আরে এইটুকু ব্যাপার! আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার এই ছোটো ভাই কবে কাজে আসবে। আপনি নিশ্চিন্তে আরামে খান। আমি আপনার বোনের দেখাশোনা করছি। আমি তার সবকিছু দেখাশোনা করবো একেবারে পরোক্ষভাবে।”
“তুমিতো আমার চিন্তা দূর কইরল্যা ভাই৷”
“আপনি বসে খান। আমি উনাকে সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”

ব্যাস হয়ে গেল। বাঁকা হাসলো তাসান। তার কাজ হয়ে গেছে। সে জানতো। এসব বদমেজাজি লোকেদের মগজ খালি থাকে একেবারে। এজটু ইমোশনাল ফোড়ন দিলেই কাজ হয়ে যায়। তাসান মেয়েটাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে এলো। এবার মেয়েটাকে পটানোর জন্য বলল,
“আমি কিন্তু এসব আপনার জন্যই করেছি। আপনাকে কখন থেকে দেখছিলাম উনার কাছে শুধু বকা খাচ্ছিলেন। আমার খুব খারাপ লাগছিল। আপনার মতো এত সুন্দর একটা মেয়েকে এভাবে ভয়ে ভয়ে থাকতে দেখে আমার কলিজায় গ্যাস্টিক জমে যাচ্ছিল। তাইতো উনার হাত থেকে আপনাকে মুক্ত করলাম। এখন আপনি যা খুশি করতে পারেন।”
তাসলিমা লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“আপনি কতো ভালো। মেলা ধন্যবাদ আপনাক।”
তাসানের মনে লাড্ডু ফুটছে। তার নিশানা একেবারে সঠিক জায়গায় গেঁথেছে। হায়, গ্রামের মেয়েরা কত সরল। এখন তাসান যা বলবে তাই মানবে মেয়েটা। এই ভেবে তাসান বলে উঠলো,
“ধন্যবাদের কি আছে। তোমার সুন্দরী মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারা আমার চৌদ্দ গুষ্টির সৌভাগ্যের ব্যাপার। তোমাকে দেখেই না আমার বুকে আগডুম বাগডুম করছে। মন চাচ্ছে আজই বিয়া বাসর সব সেরে টেরে কালই মা বাবাকে দাদা দাদী বানিয়ে দেই।”
তাসানের কথায় মেয়েটি লাজুকলতা হয়ে একেবারে নুইয়ে পড়া ভঙ্গিতে বলল,
“কি বলেন! এমন হয় নাকি!”
“আরে হয় হয়৷ হোয়েন তাসান ইজ হিয়ার, দেন এভরিথিং ইজ পসিবল। চলো তোমাকে ডেমো দেখাচ্ছি এখুনি।”
তাসান মেয়েটিকে সাথে নিয়ে কাচারি ঘরের দিকে যেতে লাগলো। মনে মনে লুঙ্গি ড্যান্স দিচ্ছে। আজতো খেলা জমবে বেশ। গ্রামের বোকাসোকা মেয়েদের পটানো কত সহজ। তাসান যেতে অপরাহ্ন, ফয়সাল আরও যেসব গ্রামের কাজিন ভাই গুলো দাঁড়িয়ে ছিলো সেগুলোকে চোখের ইশারায় বোঝাল, সে চ্যালেঞ্জ জিতে গেছে। এখন আসল গেম খেলতে যাচ্ছে।

অপরাহ্ন বলে উঠলো,
“সালা কেল্লা ফতে করেই দিলো নাকি। চলতো দেখি সে কি করে।”
অপরাহ্ন আর বাকি ছেলেগুলো তাসানের পিছু নিলো। ওরা দেখলো তাসান মেয়েটিকে নিয়ে কাচারি ঘরে ঢুকলো। ওরাও গিয়ে কাচারি ঘরের দরজার কাছে গিয়ে কান পাতলো ভেতরের অবস্থা জানার জন্য। কিছুক্ষণ পরই ভেতর থেকে তাসানের “আআ….” করে আওয়াজ শোনা গেল।এরপর কেমন গোঙানিরও আওয়াজ এলো। অপরাহ্ন দুষ্টু বলে উঠলো,
“আরেব্বাস হারামি তো সত্যি সত্যিই খেলা শুরু করে দিছে। এই ফয়সাল কান চেপে ধর। এসব শুনিস না৷ তোর বয়স হয়নি।”
“আমি ১৮ হয়ে গেছি ভাই৷ এসব শোনা কেন করারও লাইসেন্স পেয়ে গেছি।”
“ছিঃ ছিঃ কি বলিস এসব। আর তাসানটাও কেমন বেশরম। এমন করে কেউ আওয়াজ করে! সারা গ্রামবাসীকে শোনাতে চায় নাকি! গ্রামের মেয়েরাও এতো ফাস্ট হয়ে গেছে জানা ছিলোনা। প্রথম দেখাতেই সোজা ফাইনাল ধাপে চলে গেছে। মানতেই হবে গ্রাম উন্নত হয়েছে অনেক।”
বাকি ছেলেগুলো হাসতে লাগলো। আর ভেতর থেকে গোঙানির আওয়াজ এসেই চলেছে। হঠাৎ তাসানের কন্ঠ শোনা গেল। সে চিল্লিয়ে বলল,
“অপু,ফয়সাল বাঁচা আমারে।”
এবার ওদের সন্দেহ হলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যা দেখলো তাতে চোখ চড়কগাছ। ভেতরে তাসান হাত-পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায় নিচে মাটিতে পড়ে মোচড়ামুচড়ি করছে। ওরা দ্রুত গিয়ে তাসানের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল,
“কিরে তোর এই অবস্থা কি করে হলো।”
তাসান জানাল, তখন তাসান ভেতরে এসে মেয়েটির কাছে যেতে নিলেই মেয়েটি ওর মেইন পয়েন্ট বরাবর হাঁটু দিয়ে সজোরে এক গুঁতা মেরে দেয়। তাতেই বেচারা আর্তনাদ করে নিচে পড়ে যায়। তারপর মেয়েটা তাসানের হাত-পা আর মুখ বেঁধে দেয়। তাসানের কাছে টাকা-পয়সা ঘড়ি মোবাইল যা যা ছিলো সব ছিনিয়ে নেয়। মেয়েটা তাকে বলে,”তোরা শহরের মদ্দাগুলা কি ভাবিস। গ্রামের মেয়েরা সহজসরল। যা খুশি তাই করতে পারবো তাইনা! এতো সহজেই পটাতে পারবি! সেই দিন বাঘে খাইছে। এসেছিলাম তো অন্যকে লুটতে। কিন্তু তুই নিজেই যখন লুটতে এসেছিস তখন আমি কি করতে পারি।”
এই বলে মেয়েটি ওর সবকিছু লুটে নিয়ে জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে।

ঘটনার আসল বৃত্তান্ত শুনে সবাই একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর সবাই একসাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে সবগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো।বেচারা তাসানের সাথে এতবড় ট্রাজেডি দেখে ওরা কিছুতেই হাসি থামাতে পারছেনা। যাকে নিয়ে বাসর সাজিয়েছিল সেই ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে গেল বেচারাকে।

চলবে……
(অনেকে বলছে নূর আদিত্য কবে আসবে। আমি আগেই বলেছি নূর আদিত্য এই গল্পে থাকবেনা। এই কারণেই বিদেশে থাকার কনসেপ্ট করা হয়েছে। ওরা কখনোই গল্পে আসবেনা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here