নিবিদ্রিতা কাহন পর্ব -২৬

#নিবিদ্রিতা_কাহন—-২৬
®মেহরুমা নূর

★বাসায় ফিরতেই আদ্রিতার পায়ের অবস্থা দেখে পুরো বাড়িতে তুলকালাম বেঁধে গেল। সবার পরান গলায় এসে ঝুলে পড়ার দশা। নিবিড় আদ্রিতাকে কোলে করে নিয়ে বাসায় এসেছে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় লোকজন তেমন ছিলোনা তাই আর সমস্যা হয়নি। এমনিতেও ওই অবস্থায় আদ্রিতা হেঁটে আসতে পারতোনা। বাসায় এসে আদ্রিতাকে লিভিং রুমের সোফায় বসিয়ে দিয়েই সাথে সাথে একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে নিবিড় সোজা নিজের রুমে চলে গেল। তখনই শুরু হয়ে গেল সবার হায় হুতাশ। কি হয়েছে, কীভাবে হয়েছে প্রশ্নে প্রশ্নে আদ্রিতাকে ঘিরে ফেললো। বেচারি আদ্রিতা কি বলবে সেটা মনে মনে পাকানোর সময়ও দিচ্ছে না। ওদিকে চারিদিক থেকে সবাই হা-হুতাশ করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে। আরমান,আহনাফ দুজন নাতনীর চিন্তায় অস্থির। আবিরতো পারলে এখনই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেই সোজা উঠিয়ে নিয়ে আসে। ফোন কানে নিয়ে অস্থির হয়ে পায়চারী করছে আর ডাক্তারকে ফোন লাগাচ্ছে। বড়দের চিন্তা একরকম আর ইয়াং গুলার চিন্তার লেভেলতো আরও ইউনিক। তানহা বলল,
“এই অরি, পা কাটলো কি করে? কোথায় গিয়েছিলি তুই?”
সানভি বলল,
“এটা কি করলি তুই! কাল হলুদের অনুষ্ঠানে আমরা দুজন মিলে যে ডান্সের প্ল্যান করেছিলাম তার কি হবে? জানিস ডান্স পারফরম্যান্সের জন্য আমেরিকা থেকে আনা মেকাপ বক্সটা কাল উদ্বোধন করবো। এখন সেটার কি হবে!”
তানহা বলে উঠলো,
“হ্যাঁ তাইতো, বেচারি সানভি এই নিয়ে দশ বার মেকাপ লাগানোর প্রাক্টিস করে ফেলেছে। নাচের আর কি! ওটা না শিখলেও চলবে। তবে মেকাপের প্রাক্টিস মাস্ট জরুরি। তোর অন্তত সানভির মেকাপের জন্যতো নিজেকে ঠিক রাখা উচিত ছিলো।”
তাসান এগিয়ে এসে বলল,
“আরে তোরা বোঝোস না ক্যান৷ অরি মনে হয় ওই ♬ কাটা লাগা উইমা উইমা উইমা উহ….. এই গানে ডান্সের প্রাকটিস করতেছিল। আর ফিল নেওয়ার জন্য সত্যি সত্যিই কাটা বিঁধিয়ে নিয়েছে। তাইনারে অরি!”
আদ্রিতা বেচারি তিন ফুট লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে নিলো। আপাতত সে কোনো কিছু ভাবনা চিন্তার মাঝে নেই। তার খেয়ালে শুধু বারবার হানা দিচ্ছে তখনকার সেই মুহুর্ত। যা মনে আসতেই আদ্রিতা হৃৎস্পন্দন ধাবিত হচ্ছে অশান্ত গতিতে।
___

পরদিন সকাল সকালই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল ফাইজার গায়ে হলুদের। বাড়ির সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। প্যান্ডেলের লোক এসে স্টেজ সাজাচ্ছে। ফুল আর রঙবেরঙের ফেইরি লাইটে চারিদিকে রঙিন সাজে সজ্জিত করছে। মেহমান আর আশেপাশের লোকজনের সমাগমে বাড়ি মেতে উঠেছে। বিশালকারের চার পাঁচটা লাউডস্পিকার মিউজিক সিস্টেমও আনা হয়েছে। বলতে গেলে এলাহি এক আনন্দঘন পরিবেশ।তানহা আর সানভি আদ্রিতার সাথে বাহিরের চেয়ারে বসে সব আয়োজন দেখছিলো।রাতে ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে গেছে। পায়ের ব্যাথা অনেকটাই কমে গেছে আদ্রিতার। তবে পুরোপুরি ঠিক একটু সময় লাগবে।ওদের কথার মাঝে তখনই ভেতর থেকে তাসান আর অপরাহ্ন ফয়সালের সাথে বাইরে এলো। তাদের দেখেই মেয়েগুলো হঠাৎ হাসতে শুরু করে দিলো। কারণ ওরা সবগুলো লুঙ্গি পড়েছে। আর তাসানকে দেখে মনে হচ্ছে তার লুঙ্গি যেকোনো সময় তাকে ধোঁকা দিতে পারে। বেচারা একবার এদিক ধরছে তো আরেকবার ওদিক ধরছে। তাসান লুঙ্গির প্যারা সামলাতে সামলাতে বলল,
“আরে ইয়ার,এই লুঙ্গি ক্যামনে পড়ে মাইনষে। আমার তো ল্যাংটা ল্যাংটা ফিল হইতাছে। ফিরোজ ভাইয়ার দাদীর সবগুলোরে লুঙ্গি পড়ানোর শখ জাগলো কিজন্য কে জানে! কেমন খালি খালি লাগতাছে।”
“আরে এইডাই তো সুবিধা লুঙ্গির। হাওয়া বাতাস আদান-প্রদান হয় আরামে। আরে আমগো যেমন অক্সিজেন, ফ্রেশ বাতাসের প্রয়োজন হয়। তেমনি তোর বংশের বাতিরও তো হাওয়া বাতাস প্রয়োজন। সারাদিন বেচারাকে বদ্ধ খাচায় আটকে রাখিস। একটু হাওয়া বাতাস না দিলে বাঁচবে কীভাবে!”
ওদের দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মেয়েগুলো। তাসানরা ওদের কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“কিরে এমন আবুলের মতো হাসার কি হলো!জীবনক কখনো হ্যান্ডসাম ছেলেমানুষ দেখিসনি নাকি!”
তানহা বলে উঠলো,
“হ্যান্ডসাম তো জানিনা। তবে তোমার মতো জোকারকে প্রথম দেখলাম।”
তাসান লুঙ্গি সামলাতে পারছেনা। সে অসহায় ভাবে অপরাহ্নকে বলল,
“ইয়ার কেমনে সামলায় এই লুঙ্গি! তোর অসুবিধা হচ্ছে না!”
তানহা পাশ থেকে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
“হবে কীভাবে। এটাতো উনার ফেবারিট পোশাক।”
বিড়বিড় করে বললেও অপরাহ্ন ঠিকই শুনতে পেল। বাকা হাসলো সে। মেয়েটা দুষ্টুও আছে দেখছি।সেদিনের ওটা নিয়ে ভালোই মজা নিচ্ছে।

ফিরোজে দাদাীদের অনেকগুলো গরু আছে। বাহিরে বেঁধে রেখেছে। তাসান, আদ্রিতারা সবাই দেখছে সেগুলো। আদ্রিতা তো ফটাফট একগাদা সেলফিও তুলে নিলো গরুর সাথে। গরুর মুখে বাঁশের বানানো, টোনা বাঁধা দেখে তাসান বলে উঠলো,
“ইয়ার এই গরুর মুখে মাস্ক পড়িয়ে রেখেছে কেন?এখনতো করোনা ভাইরাসও নেই। আর এটা আবার কেমন মাস্ক! এমন মাস্ক পড়া আর ল্যাংটা হয়ে টুপি পড়ে ঘোরা একই কথা। বেচারাকে একটা ভালো মাস্কই পড়াতো। আজ গরু বলে বেচারাদের কোনো দামই নেই।”
জ্ঞানের রানী আদ্রিতা বলে উঠলো,
“আরে ভাইয়া এটা মাস্ক না। এটা বোধহয় ওদের ক্রিকেট হেলমেট। ওদের বোধহয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হবে। সিপিএল, কাউ প্রিমিয়ার লিগ।”
তাসান হাতে তালি বাজিয়ে বলে উঠলো,
“বাহ! বোইন বাহ! কেমনে! আই মিন এতো বুদ্ধি নিয়া তুই ঘুমাস কেমনে।”
আদ্রিতা গর্বে গদগদ হয়ে বলল,
“আসলে ভাইয়া রাতে ঘুমানোর আগে বুদ্ধিগুলো আলমারিতে রেখে তারপর ঘুমাই।”
অপরাহ্ন বলে উঠলো,
“আরে ধুরর,হতে পারে এটা ওদের কর্মদোষে পড়ানো হয়েছে। আমার মনে হয় গরুটা তাসানের মতোই বেশরম, ক্যারেক্টারলেস। তাইতো শাস্তিস্বরূপ টোনা পড়িয়ে রেখেছে। নাহলে হয়তো যুবতী গরুগুলোকে বদনাম করে ফেলতো।”

হাসাহাসির রোল পড়ে গেল তখন।
___

বিকালের দিকে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। হলুদের জন্য থিম রাখা হয়েছে,মেয়েরা কলাপাতা রঙের শাড়ি বা লং গোল জামা।আর ছেলেরা কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবি আর গোল্ডেন পাজামা। সানভি সেই সকাল থেকে মেকাপের পোস্ট মর্টাম করতে বসেছে। তাও এখনো যেন তার শেষই হচ্ছেনা। তানহা বেচারি শাড়ি নিয়ে অসহায় হয়ে বসে আছে। তার মোটেও ইচ্ছে নেই শাড়ি পড়ার। শাড়ি পরে হাঁটা তার কাছে খুবই অসম্ভব বিষয়। এই ১৩ হাতের শাড়ি নামক জঞ্জাল বস্তুটা তাকে জোর করে পড়তে বলা হয়েছে। না পড়লে ফাইজা রাগ করবে। তাই না চাইতেও তাকে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তাকে এখন শাড়িটা কে পড়িয়ে দিবে। শাড়ি পড়া তার নিজ সাধ্য কই! অনেকক্ষণ বসে থাকার পর শেষমেশ জুহিকে পেল সে। জুহিকে বলে শাড়ি পড়লো অবশেষে। আর আদ্রিতাতো শাড়ি হাতে নিয়ে গোল্লাছুটের মতো সারা বাড়ি ছুটছে।পায়ের ক্ষত নিয়ে বেচারি ইচ্ছেমতো ছুটতেও পারছেনা।তবুও কখনো তানির পিছনে তো কখনো সানার পিছনে যাচ্ছে । কিন্তু কাজের জন্য কেউই বেচারিকে ভাউ দিচ্ছে না। ছুটতে ছুটতে একসময় ফিরোজের দাদী সামনে পড়লো। দাদাী আদ্রিতাকে দেখে বলল,
“কিলো ছেড়ি,এব্যা গোলে পাগলের মতোন পাকপাইড়ত্যাছু ক্যা? কি হইছে?”
আদ্রিতা ঠোঁট উল্টে বলল,
“দেখোনা দাদী,আমাকে কেউ শাড়িই পড়িয়ে দিচ্ছে না। আমি কীভাবে রেডি হবো?”
“উমাই হেই কথা! আয় আমি তোক কাপড় ফিন্দাইয়া দিত্যাছি। দেহিস কি সুন্দর হইরা কাপড় ফিন্দাইয়া দেই। এহারে পটের বিবি নাইগবোনে।”
আদ্রিতা খুশি হয়ে বলল,
“সত্যিই! ঠিক আছে চলো।”

দাদীর শাড়ী পড়ানো শেষে আদ্রিতা খুশি হয়ে নাচতে নাচতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু তার শাড়ী পড়ানোটা কেমন যেন অন্যরকম হয়েছে।অন্যদের থেকে আলাদা। দাদী ওকে গ্রামীণ বাঙালী স্টাইলে ভেঙে শাড়ী পড়েয়েছে। তবে এভাবে যেন আদ্রিতাকে নিজের কাছে আরও বেশি ভালো লাগছে। বাকিরা কতো স্টাইল করে কুঁচি দিয়ে নায়িকাদের মতো করে শাড়ি পড়েছে। তাদের মাঝে আদ্রিতাকে ইউনিক লাগছে। ভালোই লাগছে নিজের কাছে তার। দাদী তার নিজের পুরানো কাঠের সিন্দুক খুলে সেখান থেকে একটা বক্স বের করে আনলো। তার ভেতর থেকে কিছু গহনা বের করে বলল,
“এইগুনা আমার গয়না। তোর দাদা দিছিল আমাক। এইসব পুরাইনা গয়না আইজকাল কার ছেড়িড়া পইরব্যার চাইনা। কয় পুরানতা পরলি নাকি খ্যাত দেহায়। তুই পড়বি! তোক মেলা মানাইবো।”
“কেন নয় দাদী। আমারতো ভীষণ ভালো লাগছে এগুলো।”
“আয় বু,তোক ফিইন্দা দেই।”
দাদী ধান-তাবিজ নামক পুরানো ডিজাইনের একটা মালা জাতীয় গহনা আদ্রিতাকে পড়িয়ে দিলো। গহনা টা গলার সাথে লেগে রইল আদ্রিতার। মালার সেটের সাথে একই রকম কানের দুল জোড়াও পড়িয়ে দিলো আদ্রিতাকে। হাতে পড়িয়ে দিলো একজোড়া বালা আর কোমড়ে পড়িয়ে বিছা। গহনা পড়া শেষে আদ্রিতা হালকা করে একটু সেজে নিলো। নিবিড়ের সেদিনের বলার পর থেকে আদ্রিতা আর মেকাপ করে না৷ সাধারণ লিপস্টিক আর কাজল পড়ে নিলো। সাজা শেষে দাদী আদ্রিতার মুখটা ধরে বলল,
“উম্মাইলো! কি সুন্দর লাইগতাছে আমার বুবুডোক। তোক দেইহা আজ ভাবীজানের কথা মনে পইড়া গেল। তুই দেখতে এহারে তোর দাদীর মতোই হচু।”
খুশিমনে হাসলো আদ্রিতা। দাদীর গাল টেনে দিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ দাদী।তুমি সত্যিই অনেক কিউট।”
“তুইও মেল কুট।”
খিলখিল করে হেঁসে উঠলো আদ্রিতা। দাদী বেড়িয়ে গেলে আদ্রিতা নিজেকে আবারও ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো আয়নায়৷ কোমড়ের বিছাটা তার অনেক ভালো লাগছে। নিজেকে দেখার মাঝেই হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
“পুতুল তোর পায়ের জন্য অয়েন্টমেন্ট এনে…..
আদ্রিতা পেছনে ফিরে তাকালো। নিবিড় নিজের মতো কথা বলতে বলতেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল। কিন্তু আদ্রিতার উপর পূর্ণ দৃষ্টি পড়তেই কণ্ঠস্বর মাঝপথেই থেমে গেল তার। স্থির নজর আঁটকে গেল আদ্রিতার পানেই। অচলিষ্ণু অস্পন্দ তার মুখয়ব৷ ইন্দ্রজালের বশীভূত যেন তার সর্বত্র। বোধশূন্যর মতো হাতে ধরে রাখা অয়েন্টমেন্ট টা হাত ফসকে পড়ে গেল নিচে। নিবিড়কে এভাবে স্তম্ভিত হয়ে যেতে দেখে আদ্রিতার হৃদপিণ্ডের ধুকধুকানির রোগ আবারও বেড়ে গেল। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে সে নিচে পড়ে থাকা অয়েন্টমেন্ট’টা হাতে তুলে নিয়ে বলল,
“এটা আমার পায়ের জন্য এনেছেন? আচ্ছা আমি লাগিয়ে নিবো।”
আদ্রিতার কথায় নিবিড়ের ঘোর কাটলো বোধহয়। সে হকচকানো ভঙ্গিতে বলল,
“হুম! হ্যাঁ। বিয়ের কিছু কাজে উল্লাপাড়া গিয়েছিলাম। সেখানের ফার্মেসী থেকে এনেছি। এটা লাগিয়ে নিস। বিয়ে বাড়িতে পা লেংড়িয়ে বেড়ালে ফাইজার শশুর বাড়ির লোক ভাববে এবাড়ির মেয়েরা বোধহয় সব অ্যাবনর্মাল। আমি থাকতে আমাদের বংশের এতবড় বদনামতো আর মেনে নিতে পারি না। তাই ফটাফট অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে ঠিক হয়ে যা।”
বলেই ফট করে বেড়িয়ে গেল নিবিড়। আদ্রিতা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে অয়েন্টমেন্ট টা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে পিছনে ফিরতেই থতমত খেয়ে গেল। নিবিড় ভাইয়াতো মাত্রই চলে গেল, আবার কখন এলেন উনি! চোখ পিটপিট করে আদ্রিতা বলল,
“আরও কিছু বলবেন!”
নিবিড় গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। চেয়ারে বোস।”
“কেন?”
“বসতে বললাম তাই।”
আদ্রিতা বসে পড়লো চেয়ারে। নিবিড় আদ্রিতার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। আদ্রিতা বুঝতে পারছেনা নিবিড় কি করতে চাইছে। কিন্তু ধমকের ভয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছেনা। অগত্যা চুপচাপ দেখতে লাগলো। নিবিড় এক হাত বাড়িয়ে আদ্রিতার পা ধরতে নিলে আদ্রিতা হকচকিয়ে উঠে বলল,
“কি করছেন, পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন!আমি নিজেই লাগিয়ে নিবো অয়েন্টমেন্ট।”
নিবিড় ধমকের সুরে বলল,
“চুপ, দুই মিনিট চুপ থাকলে কি তোর চুল পেকে যাবে! চুপ করে বসে থাক। তোর পা রোস্ট করে খেয়ে ফেলসি না।”
নিবিড় এক হাতে আদ্রিতার পা এনে নিজের হাঁটুর উপর রাখলো। আরেক হাত নিজের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে একটা আলতার শিশি বের করে বলল,
“পেত্নী যখন সেজেছিস তখন পুরোপুরি সাজ। নাহলে পেত্নী জাতির অপমান হবে।আর একজন সজ্জন ব্যাক্তি হয়ে কোন জাতিকে আমি অপমানিত হতে দিবোনা।”
বলতে বলতে আদ্রিতার পায়ে আলতা পড়াতে লাগলো নিবিড়। আজ যেন নিবিড়ের গা জ্বালানো কথায়ও আদ্রিতার মন খারাপ হলোনা। কেন যেন মনে হচ্ছে এগুলো তার মনের কথা না। নিবিড়ের অব্যক্ত অনুভূতি হয়তো একটু হলেও আদ্রিতার মন পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। সে অনুভব করতে পারছে তার আবহের সুর।

দু পায়ে সুন্দর করে আলতা পড়িয়ে দিলো নিবিড়। আদ্রিতা নিগুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো শুধু। আলতা লাগানো শেষে আদ্রিতা বলে উঠলো,
“হয়ে গেছে। এখন যাই বাইরে?”
আদ্রিতার প্রশ্নে নিবিড়ের মুখয়বে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দিলো। চোখে মুখে অদ্ভুত এক ভীত যেন দেখা দিচ্ছে। চোখের নজর যেন বলতে চাইছে,”তুই বাহিরে যাসনা মেয়ে। লোকের নজর থেকে তোকে লুকানো দায় হয়ে যায় যে।”
নিবিড়ের নীরবতা দেখে আদ্রিতা আবারও জিজ্ঞেস করলো। নিবিড় আদ্রিতার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিতার কাজল হালকা ছড়ে আছে।নিবিড় বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে আদ্রিতার লেপ্টানো কাজল মুছে দিয়ে নরম সুরে বলল,
“হ্যাঁ যা। তবে ক্ষত পা নিয়ে বেশি লাফালাফি করবিনা খবরদার।বিয়ে বাড়িতে বাহিরের ছেলেপেলে আসবে অনেক। তাই নিজের বাড়ির লোকের সাথেই থাকবি। একা একা কোথাও যাবি না।”
আদ্রিতার হঠাৎ মনে পড়লো ইভার বলা কথাগুলো। তাই সে বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে প্রমিজ করছি আমি একদম একা একা কোনদিকে যাবোনা।”
“হুম ঠিক আছে যা এখন। আমি রেডি হয়ে আসছি।”
“আচ্ছা।”

হলুদ ফাংশনের কার্যক্রম পুরোপুরি ভাবে শুরু হয়ে গেছে। অপরাহ্ন রেডি হয়ে এসে স্টেজের সামনে চেয়ারে বসেছিল। ফয়সাল আর তাসানের সাথে বসে কথা বলছিল। তখনই ফাইজাকে নিয়ে আসা হলো স্টেজে। অপরাহ্ন সেদিকে তাকাতেই তার হৃদপিণ্ড থমকে গেল। ফাইজার সাথে আসা মায়াবী রমনী তানহাকে দেখে তার সকল নিউরন ক্রিয়া বন্ধ করে দিলো। এতটাই বিমূঢ় হলো যে বেচারা তানহাকে দেখতে একসময় চেয়ার উল্টে পড়েই গেল। তা দেখে হাসির রোল পড়ে গেল চারপাশে। তানহাও সেটা দেখে মুখ টিপে হাসলো। ফাইজাকে স্টেজে বসিয়ে দিয়ে চেয়ারে এসে বসলো তানহা৷ হঠাৎ পাশের চেয়ারে এসে তার পাশে বসলো অপরাহ্ন। তানহার কানের কাছে ঝুঁকে বলল,
“এটা ঠিক করছনা শ্যামকন্যা। ডাক্তারকে রুগী বানানোর দায়ে তোমার শাস্তি প্রযোজ্য হয়ে যাচ্ছে। রুগীর ডাক্তার হয়ে তার রোগের প্রতিরোধকও তোমাকেই দিতে হবে কন্যা। নাহলে ডাক্তার পাগল হওয়ার খবর রটে যাবে মহল্লায়।”
চকিত নজরে তাকালো তানহা। নজরে নজর বিঁধল তখন। হৃদ গহ্বরে চলল তুমুল তুফান। যার তোড়ে তানহার টিকে থাকা দায়। চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে যেন। অপরাহ্নের মুগ্ধ অপলক দৃষ্টি। ঠোঁটে মোহনীয় হাসির রেখা। যে হাসির হেতু তার সম্মুখের কন্যাটি। দুজনের দৃষ্টি আদানপ্রদানরত অবস্থায়ই অপরাহ্ন হাত বাড়িয়ে পাশের ডেকোরেশন করা ফুল থেকে একটা হলুদ রঙের জারবেরা ফুল নিয়ে তানহার খোঁপা করা চুলে গুঁজে দিয়ে বলল,
“এখন পরিপূর্ণ লাগছে। এবার পাগল হলেও খেদ নেই। তাতেও সার্থক।”
কথা শেষ করেই হাসিমুখে উঠে গেল অপরাহ্ন। তানহা থমকে বসে রইল। আনমনে হাত চলে গেল তার খোঁপায় লাগানো ফুলে। হঠাৎ কেমন কান্না পেল তার যেন। এই অনুভূতির যন্ত্রণা থেকে সেতো অনেক দূরে থাকতে চায়। তবে কেন আরও মায়াজালে আঁটকে পড়ছে সে।

ফাইজাকে একে একে হলুদ দিচ্ছে সবাই। গান বাজনা চলছে ধুমাধুম। সবাই স্টেজের সামনেই আছে। আদ্রিতা নূরানকে টেনে নিয়ে এসেছে হলুদ দেওয়ার জন্য। বেচারা এসব বিষয়ে একটু ইতস্তত বোধ করে। তাই আদ্রিতা টেনে নিয়ে এসেছে তাকে। নিয়ে আসতে আসতে দুষ্টুমি করে বলছে,
“আরে ভাইয়া আসোনা। আমার এতো হ্যান্ডসাম ভাইয়াকে না দেখলে বরপক্ষের মেয়েরা বুঝবে কীভাবে যে এতো হ্যান্ডসাম একটা বিয়াই আছে তাদের।”
নূরান বলল,
“কি বলিস পাগলী এসব!”
তানি এগিয়ে এসে নূরানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ঠিকিত বলেছে অরি। আমার এতো হ্যান্ডসাম বাবাটা না থাকলে অনুষ্ঠানে চমক কীভাবে আসবে!”
তাসান বলে উঠলো,
“হরে নীড়। আইজকা হলুদ দিতে আসা মেয়েগুলোর সামনে খাবারের বদলে তোরেই প্লেটে সালাদ আর টমেটো সসের সাথে সার্ভ করে দেবো। আমগো খরচও বাইচা যাইবো। তোর রুপ যৌবন কবে কাজে আসবে তাইনা!”
নূরান অসহায় ভঙ্গিতে হাসলো। আদ্রিতার জোড়াজুড়িতে ফাইজাকে একটু হলুদ লাগিয়েই ছাড়া পেল সে ওখান থেকে। তড়িৎ গতিতে পালালো নূরান। পুকুর ঘাটে বসে ফোন বের করলো। আজকের রাতটা কাটাবে সে নীলাম্বরীর সাথে কথা বলে। কিছু প্রণয়ের সূচনা করবে আজ। হবে কিছু নিশিকথা,কিছু মায়াবৃন্দের অনুরক্তি।

আদ্রিতাকে আজ যে দেখছে সেই মুগ্ধ হচ্ছে।তানি আবিরসহ বাড়ির সবাই তার প্রশংসা করছে। সানাও আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার মা টাকে আজ হুরপরী লাগছে। নজর না লাগে কারোর।”
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
“নজরতো লেগে গেছে আন্টি।”
আদ্রিতা পেছনে তাকিয়ে দেখলো জোভান এসেছে। জোভান হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল,
“আসলেই আজ অরিকে অনেক সুন্দর লাগছে। তাই নজরতো লাগাই স্বাভাবিক। এইযে আমিই চোখ ফেরাতে পারছিনা।”
জোভানের কথাটা কেমন যেন পছন্দ হলোনা আদ্রিতার। তবুও সৌজন্যে বজায় রাখতে জোরপূর্বক মুচকি হেসে বলল,
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
জোভানের হাসি মুখটা সহসাই খানিকটা চুপসে গেল। যেন ভাইয়া ডাকটা তার হাসি বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণ। তবুও মেকি হেঁসে বলল,
“আগে কেমন ছিলাম জানিনা। তবে এখন বেস্ট লাগছে।”
সানাকে কেউ ডাক দেওয়ায় সে চলে গেল ওখান থেকে। জোভান যেন আরও সুযোগ পেয়ে আদ্রিতার সাথে আরও ভাব জমাতে চাইলো। তবে কিছু বলার আগেই হঠাৎ সেখানে প্রকট হলো নিবিড়। এসেই বাজখাঁই নজরে তাকালো আদ্রিতার পানে। যেন এখুনি পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মাখিয়ে মড়মড় করে খেয়ে ফেলবে তাকে। এসেই আদ্রিতার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“ফাইজাকে একা রেখে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কোন পূণ্য করতে! যা গিয়ে ওর পাশে বসে থাক। দেখ কিছু লাগে নাকি ওর। এতো মানুষের মাঝে ও একা নিশ্চয় নার্ভাস হচ্ছে।”
আদ্রিতা মাথা দুলিয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”
আদ্রিতা চলে গেল ফাইজার কাছে। নিবিড় তিন্নিকে ডাক দিয়ে বলল,
“মামুনি দেখ তোমার মামা এসেছে। যাও গিয়ে তোমার মাকে বলো তাকে খেতে দিতে। এতো দূর থেকে এসেছে নিশ্চয় টায়ার্ড হয়ে গেছে।”
কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলেই অন্য দিকে চলে গেল নিবিড়।আর তিন্নি মামার কোলে লাফ দিয়ে উঠে গলা ধরে ঝুলে পড়লো। জোভান যেন তব্দা খেয়ে গেল। অগত্যা ভাগ্নির জোরাজুরিতে ভেতরে যেতে বাধ্য হলো সে। এসব কিছু তানি দূর থেকে ঠিকই অবলোকন করলো। চিন্তা হচ্ছে তার৷ কোনো অঘটন না করে ফেলে তার ছেলে।

চলবে……..
(নেট ছিলোনা তাই দেরি হয়েছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here