#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১৬
#শামছুন্নাহার
‘প্রাণ দিতে চাই,মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষণ দিতে চাই
তোমাকে, ও……তোমাকে
স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
দুটি নয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও…….তোমাকে
জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকে
রোজ দুইফোঁটা যেন আরও ভালো লাগে
গানে,অভিসারে, চাই শুধু বারেবারে…..’
শেষ বিকেলের আলো মেখে পৃথিবী যেন ক্লান্ত,অবসন্ন।পৃথিবীর রং এখন ধূসর। সূর্য যেন কিছুটা ম্লান। একসময় গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে হারিয়ে যাবে সূর্যটা।
বিকেলবেলা ছাদের দোলনাতে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে মিহি। সামনে শুধু ওয়াসিফের মুখশ্রী ভাসছে। সেদিন ওয়াসিফ মিহিকে অনেক বুঝিয়েছিল। মিহিও নিজের ভাবনার সাথে মিলিয়ে দেখল ওয়াসিফ যা বলেছে তাই সত্য। ওয়াসিফের একটাই কথা-‘সেই সময়ের জন্য বাঁচো যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না,বাঁচো ভবিষ্যৎ এর জন্য।’
দেখতে দেখতে কতটা দিন কেটে গেল। মিহি ওয়াসিফকে নিয়ে একটু হলেও ভাবে,তাকে ফিল করে।তার করা কাজগুলো মিহির মন্দ লাগে না। ছেলেটা চটপটে,অস্থির টাইপের কিন্তু খুব ভালো। ওয়াসিফ যে মিহিকে ভালোবাসে মিহি সেটা বুজে। তবুও ওয়াসিফকে সে কখনওই বুজতে দেয়না। ওয়াসিফের দেওয়া মেসেজগুলোর রিপ্লাই করে না। এখনও সে তাকে ইগনোর করছে এটাই বোঝায় ওয়াসিফকে। মিহি ঈশাকেও বলেনি তার ভাইয়ের প্রতি আস্তে আস্তে একটা টান সৃষ্টি হচ্ছে যে। বললে ঈশা তৎক্ষণাৎ ওয়াসিফকে জানিয়ে দিবে আর ওয়াসিফ এটা নিয়ে আরও বাড়াবাড়ি করবে তাই।
ঈশার এইচএসসি এর ফাইনাল পরিক্ষা আর মাত্র চারদিন। এরমধ্যে ভাইয়ার চলে যাওয়াটা খুবই মন খারাপের বিষয়। আগামীকাল মৃদুল চলে যাবে ঢাকায়। ওয়াসিফদের বাসায়। সেখান থেকে পরেরদিন চলে যাবে তার গন্তব্যে। পরশুদিন সকাল দশটায় মৃদুলের ফ্লাইট।
খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় মৃদুল। তার বুকে মাথা রেখে সুয়ে আছে মিলি। আজকের রাতটাই তাদের একসাথে কাটানোর শেষ রাত। এরপর আর কবে না কবে মৃদুলের আগমন ঘটে। মৃদুলও তার প্রশস্ত বুকে এক হাত দিয়ে মিলিকে ঝাপটে ধরে সুয়ে আছে। এরমধ্যে একটা নতুন খবর আছে। মিলি প্রেগন্যান্ট। সবে দেড় একমাস হল সে যে প্রেগন্যান্ট ধরা পড়েছে। এই খবর শুনে শশুড়বাড়িতে মিলির আদর যেন উপচে পড়ছে।
পরেরদিন মিলিদের পুরো পরিবারসহ মৃদুলের ফুফু,খালা সবাই এসেছে তাকে বিদায় দিতে। শুধু ফরিনা খালা ছাড়া। ফরিনা খালা আসেনি কারন মৃদুল তাদের বাসায় উঠবে বলে তিনি আর এতদূরে আসেননি। এই একই দিনে মিলির ফুফু-ফুফা,মামা-মামি,খালা-খালুসহ সবাইকে একসাথে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। এটাকে নাকি গ্রামের ভাষায় ‘মানা ভাঙ্গা’ বলে। বাড়িতে মেহমানের হট্টগোল। মৃদুল খেয়েদেয়ে রেডি হয়ে গেল। সবার খাওয়া-দাওয়া পর্ব এখনও শেষ হয়নি। মৃদুল মিলিকে জরিয়ে ধরতেই মিলি শব্দ করে কেঁদে দিল।
–“বোকা মেয়ে কাঁদছে কেন?আমি তো বছর ঘুরেই আবার আসবো।”(মৃদুল)
–‘——–
–“শেষ বিদায়টা কি হাসি দিয়ে বিদায় দেওয়া যায়না?”
——-
–“একটু হাসো।এক্ষণি বের হব।”
মৃদুল মিলির থুতনিতে ধরে তার মুখটা উপরে তুলে গাল বেয়ে পড়া নোনাজলটুকু মুছে দিল। মৃদুল ফের বলে __ –“একটু হাসো, আমাদের অতিথি পাখিটার খেয়াল রেখো। আমি রোজ কল করবো কেমন?”
মিলি কান্নটুকু গিলে জোরপূর্বক মুচকিহেসে শুধালো –“হু।”
বিদায় নিয়ে মৃদুল চলে গেল ঢাকার উদ্দেশ্যে। মিহিরা তাদের পরিবার সবাই চলে এল তাদের বাড়িতে। মৃদুল চলে গেছে, একটু মন খারাপ তো লাগবেই। সেজন্য মিলির মা নীলুফা বেগম তার মেয়ে মিলিকে সাথে করে নিয়ে আসেন। সপ্তাহখানেক এখানেই থাকবে সে।তারপরের দিন ওয়াসিফ মৃদুলকে এয়ারপোর্ট অব্দি দিয়ে এসেছে। বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীর হেলিয়ে দিল বিছানায়।
ঈশার পরিক্ষা শুরু হয়েছে আজ থেকে। বারোটা সাবজেক্ট পুরো একমাস ধরে পরিক্ষা। একটা পরিক্ষার পর দুয়েকদিন বন্ধ তাই এরকম। ফরিদা বেগম গেলেন ঈশার সাথে তার পরিক্ষাকেন্দ্রে। এত বড় মেয়ে হলেও পরিক্ষার প্রথমদিন মেয়েকে একা ছাড়েননি তিনি।কেন্দ্রে গিয়ে ঈশাকে তার সিট বেঞ্চে বসিয়ে তারপর বাড়ি ফিরে এলেন। পরিক্ষা শেষে ঈশা যখন বাড়ি ফিরল শুনা গেল তার পরিক্ষা ভালোই হয়েছে,বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
এপ্রিল মাস। গরমের আভাস।
মাসের মধ্যবর্তী দিনেই ঈশার পরিক্ষা চলাকালীন সময়ের একদিন শুক্রবার দেখে মৃদুলের পরিবারের সবার দাওয়াত ছিল মিলির বাপের বাড়িতে। ফরিনা বেগমসহ তার দুই বোন,মৃদুলের ফুফু-ফুফা সবাই এসেছে। মৃদুলের ছোট খালা ফিরুজা বেগমসহ তার স্বামী আসলেও ফরিনা বেগম একাই এসেছেন। ফরিনা বেগমের স্বামী কাজের সূত্রে তার মালিকের সাথে দেশের বাহিরে গেছেন তাই আসতে পারেননি। নীলুফা বেগম তাদেরকে সুন্দর করে সমাধর করে দিলেন। যাওয়ার সময় ফরিনা বেগম মিলিকে সাথে করে নিয়ে গেলেন।
–
মৃদুল বিদেশ গিয়েছে আজকে উনিশ দিন। ফরিনা বেগম ঈশাদের বাসায় দুদিন থাকবে। তারপর এখান থেকে যাবে তার শশুড়বাড়ি। ওয়াসিফের দাদা বাড়ি।ওয়াসিফের দাদার বাড়িও কুমিল্লাতেই। কুমিল্লা চাঁদপুর, পুরাতন চৌধুরী পাড়া জায়গাটার নাম। সেখানে রাতটুকু থেকে তারপরের দিনই ঢাকা ফিরবেন।
মিলিদের বাড়ি থেকে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।এসে সবাই ফ্রেশ হয়। তারপর সন্ধ্যার নাস্তা করে ঈশা পড়তে চলে যায় আর তারা দুই বোন গল্প করছে। মৃদূল ফোন করেছে বলে মিলি তার রুমে চলে আসে। ফরিনা বেগম ছাড়া বাকিরা সবাই মিলিদের বাড়ি থেকেই যার যার বাড়িতে ফিরে গেছে।
গল্পের মধ্যেই মিহাদ কল করায় ফরিদা বেগম কথা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফরিনা বেগম তার বোনকে ইশারা করে বুঝালো তিনি রুমে যাচ্ছেন।
অফিস থেকে এসে ওয়াসিফ মাকে কল করে। ফরিনা বেগম তখন শুয়ে ছিলেন। মোবাইল ছিল বালিশের পাশেই।
–“কবে ফিরতেছো?”(ওয়াসিফ)
–“সকালেই না এলাম। চাঁদপুরে যাবো একটু, কাজ আছে ফিরতে দুতিনদিন লাগবে বুঝলি?”(ফরিনা)
–“আচ্ছা নো প্রবলেম। মিহির মাকে বলছো?”
–“বলছি। আগে বল তুই খাওয়া-দাওয়া করেছিস তো খোকা!”
–“না একটু পরে খাবো। কি বলছো ওনাকে?”
–“জিজ্ঞাস করলাম মিহির বিয়েশাদী এখন ধরবে কিনা..’
–“কি বললো?”
–” মিহি ফাস্ট ইয়ারে পড়ে না এখন? ঈশুর পরিক্ষা শেষ হলেই ওদের ফাইনাল পরিক্ষা নাকি শুরু..তো পরিক্ষা শেষ হলে তারপর দেখা যাবে….’
একটু থেমে ফের বলেন– ইচ্ছে করেই আরও গুরুত্ব দেইনি বুঝলি?তোর আব্বু দেশে ফিরুক,তোর বাবা তো আর বিষয়টা জানে না। আমরা একটু আলোচনা করে নেই বিষয়টা তারপর এগুবে বা যা হবার হবে। ততদিনে মেয়েটা পরিক্ষা শেষ করুক।”
–“ওকে। ঢুবলির এক্সাম আর কয়টা আছে?”
–“চারটা বললো।”
–“ওহ ওকে। পরে কল দিবো। খেয়ে নেই বায়।
–“আচ্ছা নিজের খেয়াল রাখিস বাবা।”
ওয়াসিফ যেন একটু চিন্তামুক্ত হল। মিহি বলেছিলো মিলির বিয়ের পর থেকেই মিহির জন্য বিয়ে আসে। তাই ওয়াসিফ তার মাকে দিয়ে একটু খবর নিয়ে নিল। কিন্তু ওয়াসিফ এটাও জানে মেয়েটা ত্যাড়া। ফাইনাল এক্সাম যেহেতু দেড়ি নেই সে এক্সাম দেওয়ার পরেই বিয়ের জন্য রাজি হবে।
মিহি মেয়েটাকে ওয়াসিফ কাছ থেকে দেখেছে। মিহি কাছে থাকলে ওয়াসিফের নাকি শান্তি লাগে। ধুকপুকানি বেড়ে গেলেও হৃদপিন্ডে শীতলতার বাতাস বয়ে যায়। মিহি বাহিরে শক্ত রাগী হলেও খুব ইমোশনাল একটা মেয়ে।
মিহির কাছে ওয়াসিফ একজন ত্যাড়া মানুষ, ওয়াসিফের কাছে মিহিও তাই। ওয়াসিফের তখন খুব বিরক্ত লাগে যখন ওয়াসিফ মেসেজ করে অথচ মিহি রিপ্লাই দেয় না। কিন্তু তার মায়ের ফোন থেকে যখন মেসেজ যায় সাথে সাথেই রিপ্লাই আসে। ওয়াসিফও কম নয়। মিহি ওয়াসিফের মেসেজের রিপ্লাই দেয়না বলে ওয়াসিফ তার মায়ের ফোন থেকে মেসেজ করে। মিহি আন্টি ভেবে যখন তার মেসেজের রিপ্লাই দেয় ওয়াসিফ তখন ঠোঁট কামড়ে হাসে। মিহি বুঝতে পারেনা তার কারন ওয়াসিফ তার মায়ের মতোই ‘তুইতোকারি’ করে মেসেজ করে। দিনশেষে প্রিয়তমা কেমন আছে তার খোঁজখবর পাওয়াটাও শান্তি। এতকিছু ভেবে ওয়াসিফ মুচকি হাসলো। একটা তপ্ত নিঃশেষ ফেলে গিটার হাতে নিয়ে সুর তোলে….
‘ভালোবেসে…..যদি হাতটা ধর, ছেড়ে দেব যে সবি
কাছে এসে… জড়িয়ে রাখো,ভুলে যাবো পৃথিবী
বুকের মাঝে চিনচিন করে,জানো নাকি এমন করে
এভাবে দূরে থেকো না….
তোমার মাঝে ডুবি বাসি..নিজের থেকে আরও বেশি
ভালোবাসি কেন বুঝোনা….
চলবে…….#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১৭
#শামছুন্নাহার
সময় এমন একটি জিনিস যা কারো নিয়মে চলে না। সে নিজের গতিতে চলতে থাকে তার মতো করে।
ঈশার পরিক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই মিহির ফাস্ট ইয়ারের ফাইনাল পরিক্ষা শুরু। হাজার ব্যস্ততা থাকলেও ঈশা দৈনন্দিন একবার করে হলেও তার মিষ্টি আপুর খোঁজখবর নেয়।
ঈশার পরিক্ষা শেষ হয়েছে আজকে ছয়দিন। এরমধ্যে গত দুদিন হল পাত্রপক্ষ এসে দেখে গেছে। পছন্দও হয়েছে তাদের। পাত্র ওয়াসিফের চেনাজানা সেই ছেলেটা। নাম মাহমুদুল হাসান। সবাই হাসান বলেই ডাকে। ঈশার বিয়ে সামনে আরও পনেরো দিন বাকি।
–
–“তোর জন্য ফোন চালানোই বন্ধ করে দিবো ওয়াসিফ!”
ফরিনা বেগম ওয়াসিফকে চোখ রাঙ্গিয়ে কথাটা বলতেই ওয়াসিফ অবাক হয়ে বলে–“আমি আবার কি করলাম!”
–“প্রত্যেকদিন অফিস থেকে এসেই রাত হলে আমার ফোন নিয়ে তুই তোর রুমে চলে যাস। আমি একটু ফেসবুকে যাইতে পারি?”
মায়ের কথা শুনে ওয়াসিফ হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারলো না। ফিচেল হেসে বললো–” আম্মু তুমি কি প্রেম কর?”
–“মানে?”
–“মিহি তো আমাকে এক্সেপ্টই করে না। তুমি সেজে মেসেজ দিলে রিপ্লাই দেয়। মাঝেমধ্যে তো হঠাৎ করে ভুল করে তুমি বলে ফেললে কত যে প্যাঁচায়! তারপর একের পর এক কল দেওয়া শুরু করে দেয়…উফফ!”
–“তখন আমার কাছে নিয়ে আসিস কেন কথা বলতে পারিস না?”
–“আমি কথা বললে আর কখনও মেসেজের রিপ্লাই দিবে? তোমার মনে হয়!”
–“আরেকদিন সত্যি সত্যিই বলে দিবো যে তুই ওর সাথে আমি হয়ে মেসেজ করিস। এখন মোবাইল দিয়ে এখান থেকে যা,তোর আব্বুকে কল দিবো আমি।”
–“যাচ্ছি ম্যাডাম, তবে তার আগে আপনার আইডিটা আমার ফোনে কানেক্ট করে নেই। (একটু থেমে)… এই যে নিন, আপনি মোশারফ চৌধুরীর সাথে প্রেম করুন আমি গেলাম ফরিনা চৌধুরানী!”
বলেই ওয়াসিফ দৌড় দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।পিছন থেকে ফরিনা বেগম চাপাস্বরে শুধালেন –“তবেরে….
পরক্ষনেই ছেলের কান্ডে হাসলেন তিনি।
–
–“কি করিস মিহি”
–“খাওয়া-দাওয়া করছিস?”
–“কিরে,বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিজি আছিস নাকি!”
তিন তিনটে মেসেজের পর যখন মিহির কোনো রেসপন্স পেল না ওয়াসিফ খুব বিরক্ত হল। মিহি কি তবে চিনে ফেললো আমায়,আম্মু কি বলেই দিল সত্যিটা? ভাবলো ওয়াসিফ। তারপর মেসেঞ্জারে কল করল মিহিকে। একবারের পর আরেকবার কল করতেই মিহি ধরল না বরং কেটে দিল। ভয়েস দিল–“আন্টি আমার কাল এক্সাম আছে,পরে কথা বলি!”
ওয়াসিফ সেই রাতটা ভয়েস শুনেই পাড় করে দিল।
পরেরদিন মিহি পরিক্ষা দিয়ে এসে বিকেলে ফরিনা বেগমকে কল দিল।
–“আপনার মেসেজের রিপ্লাই দিতে পারিনি তাই সরি, কাল কল দিয়েছিলেন তাও ধরতে পারলাম না।”
ফরিনা বেগম বুঝলেন এটা তার ছেলের কারবার। তিনি মুখ টিপে হাসলেন। মিহিকে বুঝতে না দিয়ে বললেন–“হ্যা হ্যা তোর যে এক্সাম ছিল সেটা বুঝতে পেরেছি আমি!”
ফরিনা বেগমের সাথে কথা শেষ করে ফোনটা রাখতেই ঈশা কল করল–” মিষ্টি আপু তোমার এক্সাম শেষ কবে?”
–“কথার শুরুতেই এক্সাম? ভালো আছি কি না তার খোঁজ নেই, বাহ!ভালো।”
–” আরে তা না। আমাদের যা কেনাকাটা তোমাকে নিয়ে করতাম আরকি। ডাক্তার না বললো ভাবী তিনমাস কোনো নড়াচড়া করতে পারবে না,ভাবী তো এই অবস্থায় যেতে পারবে না তাইনা। আম্মুও দিবে না। মিহাদ ভাই, ইলমা আপু আসবে হলুদের আগের দিন।বাকিরা হলুদের দিন। তাই তোমাকে কল দিলাম।”
–“আমার এক্সাম চলতেছে ঈশা!এখন মার্কেট করার সময়? একটা কাজ কর তোমার ফুফাতো বোন আছে না? রিমি না কি যেন নাম, ওকে নিয়ে যাও।”
–“ওর কথা আমার মনেই ছিল না। আচ্ছা তুমি কিন্তু ইলমা আপুদের সমানেই আন্টিকে নিয়ে চলে এসো।”
–” আমার এক্সাম শেষ তোমার হলুদের দিন। ভেবেছিলাম রিলাক্স হয়ে বিয়ের দিন যাবো। কথা দিচ্ছি ঐদিনই ইনশাআল্লাহ যাবো। তবে যেতে যেতে সন্ধ্যা হতে পারে। আম্মু নাহয় আগেই চলে যাবে। ওকে?”
–“ওকে।”
–
সময় চলে যায় সময়ের আপন নিয়মে,স্রোত বয়ে যায় তেমনি জনমে জনমে। কাননে ফোটে নবপুষ্প…..
আজকে ঈশার গায়ে হলুদ। সকালেই তার ফুফু এবং ছোট খালা চলে এসেছেন। ঈশার ফুফা আর ছোট খালু বিয়ের সব দায়ভার নিয়ে কাজ করছেন। বাবা না থাকলে যা হয় আরকি!.. শেষ বিকেলে ওয়াসিফ আর ফরিনা বেগম আসলেন। সন্ধ্যার একটু আগে মেহমানের ভিড় যেন আরও বাড়লো।
–“এ্যাই ঈশু বড় বৌ এর বোনটা আসে নাই?”
ঈশাকে মাঝখানে বসিয়ে গল্প করেছে সবাই। ঈশার এক কাজিন নদী নামের একটা মেয়ে ঈশাকে জিজ্ঞেস করল।
–“তুমি আপুকে চিনো নাকি!”(ঈশা)
–“চিনবো না মৃদুল ভাইয়ের শালী বলে কথা।”
সবাই হাসাহাসি করছে ঈশাকে নিয়ে। একটু আগেই হাসান ফোন করেছিল। এ নিয়ে যেন আরও বেশি মশকরা আর হট্টগোল ।
চারদিকে চোখ বুলিয়ে যখন প্রিয়তমার দেখা মিললো না তখন ওয়াসিফ এসে মাকে জিগ্যেস করে–“আম্মু ইচ্ছে….ইয়ে মানে মিহি আসেনি?”
ফরিনা বেগমের কাটকাট উত্তর –“তুই বুঝি এসবের জন্য আসছিস?”
–“কল দাও।”
ওয়াসিফকে দাঁড়ানো রেখেই ফরিনা বেগম কল করলেন।
–“কিরে কই তুই?”
–“আসছি আন্টি,গাড়িতে আছি।
–“তাড়াতাড়ি আয়।”
আধঘণ্টা পর বিয়ে বাড়িতে মিহির পা পড়লো। তার মা নীলুফা বেগম বিকেল চারটায়ই চলে এসেছিলেন। মিহি পরিক্ষা দিয়ে কুমিল্লা থেকে বাড়ি এসে রেডি হয়ে তবেই এলো।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বাবুর্চিদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখান থেকেই এক কাপ চা ওয়াসিফের ভাগ্যে জুটে। সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেল সে। সামনে হলুদ লেহেঙ্গা পড়া মেয়েটাকে দেখে একমুহুর্তের জন্য থমকালো যেনো। চোখ দুটো মূহুর্তেই বড় হয়ে বেড়িয়ে আসবে এমন। মিহি ভিতরে এসে ওয়াসিফের পাশে বসে থাকা ফরিনা বেগমকে জিগ্যেস করল–“কেমন আছেন আন্টি? ”
–“এতক্ষণে এলি? ভালো। তুই কেমন?”
–“ভালো,আজকে পরিক্ষা শেষ হল মাত্র। ঈশা কোথায় ওকে দেখছি না!”
–“ঈশা ঈশার রুমেই। যা।”
ওয়াসিফ তখনও তাকিয়ে আছে। মিহি বুঝতে পেরেও ব্যাপারটাকে ইগনোর করে ঈশার রুমের দিকে চলে গেল।
মেয়েরা সবাই সাজগোজ করছে। ঈশা হলুদে হলুদ আর লাল কম্বিনেশনের একটা লেহেঙ্গা পরেছে। হলুদের গহনার সাজে রাঙ্গিয়ে তুলেছে নিজেকে। মিহি আসার সময় শুধু লেহেঙ্গা পড়ে এসেছিল। সময়ের জন্য তাড়াহুড়ো করে সাজা হয়নি। সাজতে সে পছন্দও করে না। তবে আজ ঈশা দায়িত্ব নিয়ে মিহিকে একটু সাজিয়ে দিয়েছে। যদিও নরমাল, লিপস্টিক ছাড়া আর কিছুই না।লেহেঙ্গার ওড়না একপাশে,চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পিঠের সাথে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর একমুঠো চুল সামনে রাখা। ঈশা মিহির কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে শুধালো –” আজকে ভাইয়া চোখ সরাতেই পারবেনা দেখো!”বলেই খিলখিলিয়ে হাসলো।
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো অনেকসময় বাকি। ঈশা পাখার নিচে বসে আছে যেন ঘেমে সাজ নষ্ট না হয়ে যায়। মিহি দেখতে গেলো হলুদের স্টেজসহ সব এরেন্জ ঠিক আছে কিনা। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। এদিকটায় লোকজন নেই বললেই চলে। মিহি যাওয়ার পথে ওয়াসিফ মিহিকে হেচঁকা টানে একটা দেয়ালের সাথে হেলিয়ে ধরলো সেই প্রথম দিনের মতোই। পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময়তে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে তাহলে সেটা মিহি। ওয়াসিফের নৈসর্গিক চাহনিতে বিস্ময়বিমূঢ় হলো সে। চোখের পাতা দুপলক ঝাপটালো সে। কিন্তু ওয়াসিফের মুখশ্রীতে রাগ্বীভাব স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর। মিহি কিছু বলার আগেই ওয়াসিফ রাগান্বিত হয়ে শুধালো–“আমি যে তোমাকে ভালোবাসি এটা বুঝো? ইগনোর করতেছো কেন হু? কতবার ইশারা করলাম কোনো পাত্তাই নেই, সমস্যা কি তোমার?”
–“হাত ছাড়ুন।”
–“যদি না ছাড়ি..?”
–“কেউ দেখে ফেলবে ওয়াসিফ, হাত ছাড়ুন। ”
ওয়াসিফ মিহির হাতটা ছেড়ে দিল। মিহির থেকে একহাত দূরে সরে মিহি কন্ঠে শুধালো –“সুন্দর লাগছে।”
মিহি কিছু বললো না। তারও বলতে ইচ্ছে করল ‘মেরুন কালার পান্জাবিতে আপনাকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে ওয়াসিফ ‘। কিন্তু বললো না।
–“কি হল একটা থ্যাংকস তো দিতে পারো নাকি?”।ওয়াসিফের ফের কন্ঠ শুনে মিহি বললো-
–“ওদিকে চলুন। কেউ দেখলে বিষয়টা বাজে ভাবে নিতে পারে।”
–“এখন কেউ এদিকটায় আসবে না। জানো? তোমাকে নিয়ে কত সপ্ন আমার!”
–“আমরা সবকিছু একটু বেশিই আশা করে ফেলি তাই না?”(মিহি)
—“তা জানি না। তবে এটা জানি ভালোবাসার মানুষ পাশে না থাকলে তাকে নিয়ে সপ্ন দেখা দোষের কিছু না।”(ওয়াসিফ)
–“আমাকে ভুলে যান আপনি। এই মায়া হতে পারে একদিন কষ্টে কাটাতে হবে।”(মিহি)
–“কাকে ভুলে যাবো,তোমাকে? এটা কখনওই আমার দ্বারা সম্ভব না। আর কি বুঝাতে চাও তুমি?”(ওয়াসিফ)
–“নিয়তি। নিয়তি যদি আমাদের এক হতে না দেয়?(মিহি)
–“নিয়তির কাছে যদি আমরা খুব অল্প সময়ের জন্যও হেরে যাই,তোমাকে আমি আমার করে পেতে চাই। শুনেছো? এক কথায় শেষ। এটা নিয়ে আর কোনোকিছু শুনতে চাই না।”
–“তবুও ওয়াসিফ আপনি বুঝতে পারতেছেন না।”(মিহি)
–“জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার চেয়ে তোমাকে পাওয়াটা আমার বেশি জরুরী এর মানে বুঝো? মানে তোমাকে আমার পেতেই হবে ইচ্ছেমতি ।”(ওয়াসিফ)
এখন মিহি যা বলে ওয়াসিফ উল্টো তাকে বুঝাবে। তাই মিহি চুপ করে রইল। ওয়াসিফ তপ্ত শাস ছেড়ে বলে–“আশিকের মতো ডায়লগ দিচ্ছিনা আমি। শেষমেশ তুমি আমারই হবে দেখো। আমার ফ্যামিলি তো রাজি আর তোমার ফ্যামিলিকে মেনেছ করা জাস্ট টু মিনিটের ব্যাপার। সময় আসুক বলবো।”
এমন সময় মিহির ফোনে রিংটোন বেজে ওঠে। স্কিনে তাকিয়ে দেখলো ঈশার ফোন। কানে তুলে শুধালো – “বলো ঈশা।”
–“কই তোমরা? আমি জানি দুজন একসাথেই আছো।যেখানেই থাকো তাড়াতাড়ি স্টেজে আসো। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ”
–“আসছি।”
বলেই মিহি হাটা ধরল। ওয়াসিফ তার পিছুপিছু গেল।
হলুদ শেষে সবাই একসাথে নাচগান করেছে। মিলি ভিডিও কলে মৃদুলকে দেখাচ্ছে সব। সব হিন্দি গানের আসর। লাস্ট একটা গান “London thumakada” দিয়ে জোয়ান বুড়োটে সবাই একসাথে নেচেছে। স্মৃতিময় দিনগুলোর মধ্যে ঈশার গায়ে হলুদের আরেকটা দিন স্মৃতিচারণ হয়ে রইল।
চলবে….