#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী
সানাউল রাশেদিন ড্রয়িংরুমে বসে পেপারে চোখ বুলাচ্ছেন। তার পাশে বসে আছে শফিউল রাশেদিন। দুইদিন ছুটি নিয়ে তিনি পরিবারের কাছে এসেছেন। আফরোজা নাজনীন এবং তাহমিনা আক্তার পিঠা তৈরী করছেন। তাহমিদ আর সিক্তা পিঠা খাওয়ার বায়না ধরেছে। তাই তারা দুই জা মিলে পাটিসাপটা বানাচ্ছেন। বেশ
কয়েকটা পিঠা বানানো হলে আফরোজা নাজনীন হাফপ্লেটে করে নিয়ে আসেন ড্রয়িংরুমে। নিচ থেকেই জোরে ডাক দিলেন তাহমিদ আর সিক্তাকে। ডাক শুনে ওরা নিচে এসে দেখল সামনের টেবিলে কয়েকটা পিঠা।
দুই ভাই-বোন পিঠা হাতে নিয়ে বাবা-চাচ্চুকেও নিতে বলে। সানাউল রাশেদিন হেসে একটা পিঠা হাতে নিলেন, তার দেখাদেখি শফিউল রাশেদিনও একটা পিঠা নিলেন। তার বরাবরই তাহমিনার হাতের বানানো পিঠা খুব পছন্দের।
আফরোজা নাজনীন তার শ্বাশুড়িকে ধরে এনে সোফায় বসালেন। আজকাল তিনি খুব একটা হাঁটতে পারেননা। শ্বাশুড়িকে বসিয়ে রেখে তিনি রান্নাঘর থেকে আরেকটা প্লেটে করে দুইটা পিঠা এনে আয়েশা সালেহার হাতে দিলেন।
” কি করছ বউমা! আমার ডায়াবেটিস আর তুমি আমাকে দুইটা পিঠা দিলে! আমি শুধু অর্ধেক পিঠা খাব। ”
” আম্মা, এই দুইটা পিঠাই আপনাকে খেতে হবে। আমি কোন বারণ শুনবনা। সারা মাস কোন প্রকার মিষ্টি না খেয়ে শুধু একদিন দুইটা পিঠা খেলে ডায়বেটিস বাড়বেনা। কোন কথা না বলে খেয়ে নিন। ” আফরোজা নাজনীনের ধমকে আর কিছু বলার সাহস পাননা বৃদ্ধা। কিন্তু তার চোখের কোনে ঠিকই পানি জমেছে। তার তিনটা ছেলের বউই এক একটা রত্ন। তবে এই বড় বউটা একটু বেশিই ভালো। তাকে কখনো মা বৈ শ্বাশুড়ির চোখে দেখেনি। অতি আবেগে ভেসে তিনি কামড় বসালেন পিঠায়।
” ভাবি, কুহু কোথায় ভর্তি হচ্ছে? ওর ভর্তির বিষয় কে দেখছে? ” ইতোমধ্যে একটা পিঠা সাবাড় করে আরেকটা হাতে নিয়ে শফিউল রাশেদিন জিজ্ঞেস করলেন আফরোজা নাজনীনকে।
কুহুর নাম শোনা মাত্রই তাহমিদের বুকের ভিতর ঢোল বাজতে শুরু করেছে। ঢোলের প্রতিটি আওয়াজে কুহুর নাম লিখা।
পিঠা হাতে নিয়েই মনযোগী হয় তাদের কথা শুনতে।
” এখানের একটা সরকারি গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছে কুহু। শাহনাজের দেবর সাজ্জাদ ঐ কলেজেই আছে। সে-ই সব ব্যবস্থা করেছে। আনান ওর ফর্ম পূরণ করেছে। সে-ই কলেজের চয়েস দিয়েছিল। কয়েকটা চয়েস দিয়েছিল, তারমধ্যে এই কলেজে চান্স পেয়েছে। ছেলেটা এই কয়েকদিন খুব ছুটোছুটি করেছে । ”
” ও কবে আসছে ঢাকায়? আর থাকবে কোথায়? ” আবারও প্রশ্ন করলেন শফিউল রাশেদিন।
” সাজ্জাদ হোস্টেলে সিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
ক্লাস শুরু হলেই কুহু চলে আসবে। আগামী সাত-আট দিনের মধ্যেই ক্লাস শুরু হবে। আনানকে বললেই ও কুহুকে নিয়ে আসবে। ”
” আফরোজা, কুহুকে শুধু ওর পোশাক আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে বলো। ওর বেডিং এখান থেকেই কিনে দিও। আর ও যেন হোস্টেলের খাবার না খায়। সপ্তাহে দুইদিন খাবার দিয়ে আসবে। সাজ্জাদকে বলে হোস্টেলের ফ্রিজে খাবার রাখার ব্যবস্থা করে নিও। কুহু হোস্টেলের খাবার খেতে পারবেনা। ” সানাউল রাশেদিন তাদের কথার মাঝেই কথা বললেন।
” ভাবি, কুহুর বেডিং, অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার জন্য আমিও তোমার সাথে যাব। আমরা ওর সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ওকে হোস্টেলে উঠিয়ে দিয়ে আসব। কি কি কিনতে হবে আমি তার লিষ্ট করে রাখব। ” তাহমিনা আক্তার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন।
এদিকে বারবার আনানের কথা শুনে তাহমিদের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। এত মানুষ থাকতে আনানকেই কেন কুহুর দ্বায়িত্ব দেয়া হল! হাতে থাকা পিঠা রেখে দিল তাহমিদ। আর পিঠা খাওয়া হলোনা ওর।
ড্রয়িংরুমে সবার কথপোকথন চলতে থাকে। কেউ লক্ষ্য করলনা রা’গে তাহমিদের শরীর কাঁপছে।
নয়দিন পর। আজ কুহু ঢাকা আসবে। আনান গতকাল ফুলতলা গেছে। আজ সকালেই ওরা রওনা দিয়েছে। আফরোজা নাজনীন রান্না সেরে নিয়েছেন অনেক আগেই। রান্না শেষ করে তিনি আর তাহমিনা শপিংয়ে গেছেন কুহুর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে।
তাহমিদ ড্রয়িংরুমে বই নিয়ে বসেছে। ওর আর দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে। বাসায় শুধু ও আর দিদুন। মা, বড়মা নেই সিক্তাও কলেজে গেছে। গতকাল থেকে ওর ক্লাস শুরু হয়েছে। তাই আপাতত সে বাড়ি পাহারার কাজে রয়েছে।
কিন্তু তাহমিদের হাতে শুধু নামমাত্র বইটা রয়েছে। ওর মন পরে রয়েছে কুহুর কাছে। সেই সাথে মাথায় চিন্তা চেপে বসেছে, আনান আছে কুহুর সাথে। কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছেনা।
বিকেলে কুহু আর আনান এসে পৌঁছায় কলেজের হোস্টেলের সামনে। সেখানে আগে থেকেই আফরোজা নাজনীন, শাহনাজ সুলতানা আর তাহমিনা আক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। তারা দুপুরের দিকে কুহুর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে হোস্টেল সুপারভাইজারের নিকট রেখেছেন। সাজ্জাদ আগেই সুপারভাইজারকে বলে রেখেছিলেন। তাই কোন সমস্যা হয়নি। এরপর তারা বাসায় এসে খাবার খেয়ে কুহুর জন্য খাবার সাজিয়ে নিয়ে আসেন।
কুহু গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে আসে ফুপুদের কাছে। আছড়ে পরে আফরোজা নাজনীনের বুকে।
” এখানে আমিও আছি কুহুসোনা। আমার দিকে তো একটু তাকা। ” তাহমিনা আক্তার মিটিমিটি হেসে বললেন।
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন আপনি? দিদুন কেমন আছে? আর আংকেল ভালো আছে তো? ”
” একবারেই এত প্রশ্ন করলে আমি কোনটার উত্তর আগে দিব! আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছে। ” কুহুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু আঁকেন তাহমিনা আক্তার।
তার খুব ইচ্ছে ছিল এই শান্ত, বোকাসোকা মেয়েটাকে ছেলের বউ করার। আজ তার ছেলের ত্যাড়ামির জন্য সব এলোমেলো হয়ে গেছে। তিনি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
কিছুক্ষণ তাহমিনা আক্তারের সাথে কথা বলে কুহু ছোট ফুপুর কাছে আসে। ছোট ফুপুও কুহুকে আদরে বুকে জরিয়ে নেয়৷
এরপর তারা একসাথে হোস্টেলের ভেতর প্রবেশ করেন। কুহুকে ওর রুমে পৌঁছে দিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে দেন। সব কাজ শেষ হলে আফরোজা নাজনীন কুহুকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলেন। কুহু ফ্রেশ হয়ে আসলে আফরোজা নাজনীন কুহুকে খাইয়ে দেন।
তারপর খানিকক্ষণ কুহুর সাথে কাটিয়ে তারা ফিরে আসেন যে যার গন্তব্যে।
আসার আগে তারা কুহুকে প্রয়োজনীয় সকল নির্দেশ দেন। কি করনীয়, কি করনীয় নয় তার সকল কিছু বুঝিয়ে দেন। কুহুও বাধ্য মেয়ের মত তাদের সকল কথা মেনে নেয়।
তাহমিদ পড়ার টেবিলে বসে আছে ঠিকই কিন্তু ওর মন পরে আছে কুহুর কাছে। কিভাবে কুহুকে দেখবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। হোস্টেল থেকে কুহু কখন বের হবে, কখন কলেজে থাকবে সেটা কিভাবে জানবে
পরদিন সকালে নাস্তা করে তাহমিদ বেরিয়ে পরে। মা, বড়মা অনেকবার জানতে চাইলেও কিছুই বলেনা।
কুহুর কলেজের সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কুহুর দেখা নেই। দুপুর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে তাহমিদ অবশেষে বাসায় ফিরে।
কিন্তু বেচারা তো আর জানেনা কুহু আজ কলেজেই আসেনি।
তাহমিদের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। পড়াশোনায় ব্যস্ত তাহমিদের বুকের ভিতর কুহু নামক মেয়েটির একছত্র আধিপত্য থাকলেও গত ছয় মাসে তার হৃদয়ের অধিশ্বরীকে একবারও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। একবার সেই হৃদয়ের অধিশ্বরীকে দেখতে থেকে থেকেই ওর মন আঁকুপাঁকু করে। কিন্তু সে নিরুপায়। একই শহরে থেকেও আজ ভীতুকন্যার সাথে তার হাজার মাইলের দূরত্ব।
সেদিনের সেই দুর্ব্যবহার না করলে আজ কুহু তার কাছেই থাকত, খুব কাছে।
তাহমিদ বই রেখে চেয়ার ছাড়ে। আজ তার কিছুই ভালো লাগছেনা। বারবার কুহুকে মনে পরছে। কুহুকে দেখার তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করছে কুহু নামক সঞ্জীবনী বিনা। এ এমন এক সঞ্জীবনী যার ছোঁয়ায় নিমেষেই তাহমিদের বুকে সৃষ্টি করতে পারে আস্ত সরোবর।
তাহমিদ ছাদে আসে। সেই হাসনাহেনা গাছের কাছে এসে ছুঁয়ে দেয় গাছের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা। একসময় সটান হয়ে শুয়ে পরে গাছের পাশেই। ছোট গাছের শাখা-প্রশাখার ফাঁক গলে তাকিয়ে থাকে সূদুর মহাশূন্যে। অন্তরীক্ষের নীলচে তারার আলো ঠিকরে পড়ছে ধরনীর বুকে। সেই আলোর কিয়দাংশ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে এক উদাস প্রেমিকের শরীর। যে তার প্রেমিকার দর্শন পাবার আশায় চাতকের ন্যায় প্রতিক্ষায় চেয়ে রয়েছে। এই প্রতিক্ষার অন্ত কবে তা জানা নেই এই প্রেমিক পুরুষের।
সুদূর পানে চেয়ে থাকতে থাকতে কখন যে দুই চোখের পাতা এক হয়েছে তা জানা নেই তাহমিদের।
ভোরের উজ্জ্বল আলো চোখে পরতেই পিটপিট করে তাকায়। কোথায় আছে তা ঠাওর করতে একটু সময় লাগে। উঠে বসতেই ব্যাথার অস্তিত্ব টের পায় শরীরে। ছাদের মেঝেতে শোয়ার ফল। হাফ হাতা টি শার্ট শরীরে থাকায় কনুই থেকে পুরো হাতে লালচে দাগ। চুলকাচ্ছেও প্রচুর। এমনকি মুখেও চুলকাচ্ছে। বুঝতে পারে সারারাত মশাদের ভালোই ভোজন হয়েছে।
#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী
আজ ক্লাস শেষে বাসায় ফিরতে বিকেল হয়ে গেছে। তাহমিদ নিজেদের গাড়ি করে বাসায় ফিরছে। কুহুর কলেজের সামনে এসে গাড়ির গতি স্লো করতে বলে ড্রাইভারকে। কুহু এখানে ভর্তি হওয়ার পর ওর ড্রাইভারকে গাড়ি স্লো করতে বলা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ছয়মাস পেরিয়ে গেছে এতে কোন কাজ হয়নি। ও কুহুর দেখা পায়নি। তবে আজ বোধহয় ভাগ্য সহায় হয়েছে। কলেজের সামনে এসে গাড়ি স্লো করলে তাহমিদ আশেপাশে তাকায় কুহুকে দেখার আশায়। ঠিক তখনই চোখ যায় কলেজের ঠিক সামনে রাস্তার ওপাশে একটা ফুচকার দোকানে কুহু দাঁড়িয়ে আছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে আনান কিছু বলছে। আনানের মুখ ভর্তি বলে দিচ্ছে ওরা বেশ ভালোই সময় কাটাচ্ছে। এভাবে কুহুকে দেখবে কল্পনাই করতে পারেনি তাহমিদ। সেই চিরচেনা মুখ, সেই কফি কালার গোল ফ্রেমের চশমা, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট, মাঝারি উচ্চতার শ্যামবর্নের মেয়েটিকে আজ বেশ আকর্ষনীয় লাগছে। বরাবরের মত আজ চুলে বেনী করা নেই। তার বদলে ওড়না মাথায় হিজাবের ন্যায় পেঁচিয়ে রাখা। ফুল স্লিভ সাদা সালোয়ার-কামিজে দেখতে বেশ লাগছে। আগের থেকে বোধহয় স্বাস্থ্য একটু বেড়েছে। ড্রাইভারকে একপাশে গাড়ি সাইড করতে বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কুহুর দিকে। যেন বহুকালের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে আজ। আদৌ কি এই তৃষ্ণা কভু মেটানো যায় !
” ভাইয়া, আমি ফুচকা খাবনা। তুমি বরং আইসক্রিম অথবা চকলেট কিনে দাও। আমার ফুচকা খেতে ভালো লাগেনা। ” কুহু আবদার করে আনানের কাছে।
” দূর মাইয়া, মেয়েরা ফুচকা পছন্দ করেনা এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস! কই আমি আরও ভাবলাম কতদিন ফুচকা খাইনা, এই সুযোগে তোর সাথে খাওয়া হবে। আর তুই কিনা বলছিস ফুচকা খাবিনা। এই দিনও আমার দেখতে হচ্ছে। একটা গার্লফ্রেন্ড থাকলে তোকে এত সাধাসাধি করতামনা বুঝলি। গার্লফ্রেন্ডের কোলে মাথা রেখে ইচ্ছেমত খেতাম। তুই আসলেই একটা গা’ধী। ” আনান আফসোস করছে ফুচকা খেতে না পারায়। ও পারলে কুহুকে চি’বি’য়ে খা’য়।
কুহু আনানের মুখভঙ্গি দেখে হেসে দেয়।
” আচ্ছা আমি শুধু এক প্লেট খাব। টক-ঝাল কম দিয়ে। তুমি যত ইচ্ছে খাও। ” কুহুর কথা শুনে আনানকে আর পায় কে। ও পাঁচ প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে কুহুকে নিয়ে পাশের বেঞ্চে বসে। কুহু পার্স থেকে ফোন বের করে গেইম খেলতে থাকে। আনান অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে ফুচকার।
তাহমিদ কুহুকে দেখে খুশি হয়েছে ঠিকই কিন্তু আনানের সাথে এত হাসাহাসি সহ্য করতে পারছেনা। অন্য ছেলের সামনে এত হাসতে হবে কেন? হোকনা সে ফুপাতো ভাই। তাহমিদ দেখল আনান এক প্লেট ফুচকা কুহুর হাতে ধরিয়ে দিল। এই বিষয়টা ঠিক হজম হচ্ছেনা তাহমিদের। রাস্তার ধারে বসে খাওয়া ও পছন্দ করেনা। বড়মার নিষেধ আছে রাস্তার ধারে কিছু খাওয়া। এই মেয়েকেও নিশ্চয়ই নিষেধ করেছে বড়মা। কিন্তু এ মানছেনা বড়মার কথা। কিছু একটা ভেবে গাড়ি থেকে নামে তাহমিদ। ড্রাইভারকে বলে বাসায় যেতে। ওর কথামত ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
তাহমিদ ফুটপাতের ওপর দিয়ে একমনে ফোন টিপতে টিপতে হাঁটছে। যেন ওর কোনদিকে খেয়াল নেই। আনানের সামনে এসে হঠাৎই ওর হাত থেকে ফোনটা ছুটে যায়। অস্থির চিত্তে ফোন তুলে উঠে দাঁড়াতেই চোখ যায় আনানের দিকে৷ আনানও কারো ফোন পরে যাওয়া দেখে চমকে তাকিয়েছিল। তাহমিদকে দেখে আনান হৈহৈ করে উঠে।
” তাহমিদ ভাই, কেমন আছো? কতদিন পর তোমার সাথে দেখা! ”
” এই তো আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? তা এখানে কি করছিস? ” তাহমিদ এমন ভাব করে বলে যেন আচমকাই আনানের সাথে ওর দেখা হয়েছে। কথা ফাঁকে আড়চোখে তাকায় কুহুর দিকে। কুহু তাহমিদকে দেখেই মাথা নিচু করে রেখেছে।
” আমিও ভালো আছি ভাই। আমি এসেছিলাম কুহুকে নিতে। ওর কলেজ সাতদিনের ছুটি। তাই আমাদের বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। ও গ্রামে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ওর কোচিং আছে। তাই এই কয়দিন আমাদের বাসা থেকেই কোচিং করবে। ”
” বড়মা তোকে কখনও রাস্তার ধারে বসে কিছু খেতে নিষেধ করেনি? আর সে কোন কোচিং এ পড়ে? সেখানকার টিচার কারা? ” আনানের হাতের প্লেটের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলে তাহমিদ।
ব্যাস এতেই কুহুর যা হওয়ার হয়েছে। ঠাস করে প্লেট রেখে দিয়েছে। ওর ভেতর ভয় ঢুকে গেছে। ফুপুতো ওকেও নিষেধ করেছিল!
” আজকেই প্রথমবার এবং আজকেই শেষ। আসলে আমার ফুচকা খুব পছন্দের তাই কুহুকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু ওর ফুচকা পছন্দ নয় তবুও আমার মন রক্ষার্থে রাজি হয়েছে। ” মুখ ভার করে জবাব দেয় আনান। আর সেই সাথে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেয় কুহুর কোচিং। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার দক্ষিণ দিকের একটা বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় কোচিং। আর সেই সাথে টিচারদের নামও জানিয়ে দেয়।
” দেখতো ঐটার জুতার তলা ছিঁড়েছে নাকি। এতক্ষণ নিচে তাকিয়ে কি দেখছে। ” কুহুর দিকে না তাকিয়েই বলে তাহমিদ।
আনান তাহমিদের কথা শুনে ঝুঁকে কুহুর জুতার দিকে তাকায়। কুহু মাথা নাড়িয়ে জানায় ওর জুতা ঠিক আছে।
” ভাই, ওর জুতা একদম ফিট আছে। ” দাঁত কেলিয়ে বলে আনান।
” ঐটা এমনভাবে সবসময় মাথা নিচু করে থাকে কেন! দেখিস ঘাড় থেকে মাথা খুলে পরে যেন না যায়। তখন নিচু করার জন্য মাথাই আর থাকবেনা। ”
তাহমিদ যা জানার জেনে গেছে। ওয়ালেট থেকে পাঁচশ টাকার নোট বের করে আনানের কাছে দেয়।
” টাকাটা রাখ। যত ইচ্ছে তত ফুচকা খা। আমি আসছি। তুই সময় করে বাসায় আসিস। ”
আনান টাকা পেয়ে ভিষণ খুশি।
” তুমিও তো কতদিন আমাদের বাসায় আসোনা। একদিন বাসায় এসোনা ভাই। ”
” কবে যাব? ” তাহমিদের সরকারি এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকে আনান। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
” কি ভাই, তোমার যখন খুশি তখন আসবে। এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে! ”
” আসছি। সাবধানে যাস। আর যাওয়ার সময় কয়েকটা পেইন কিলার নিয়ে যাস। ঐটার ঘাড় ব্যথা করবে আমি নিশ্চিত। ”
” জিও ভাই। একেই বলে ডক্টর। পড়া শেষ না হতেই মানুষকে দেখে বলে দিচ্ছ, তার কি সমস্যা হতে পারে! কোন গ্রুপের পেইন কিলার কিনব ভাই? ”
” ফার্মেসীতে যেয়ে কোন ভালো কোম্পানির ঔষধ দেখে কিনে নিস। ” বলেই হাঁটা শুরু করে দিয়েছে তাহমিদ।
এদিকে কুহু হতভম্বের ন্যায় চেয়ে আছে সামনের দিকে। ঐ লোকটা কি বলে গেল! আর সেইবা কেন আমাকে ‘ঐটা ‘ বলে সম্মোধন করল! আমি কি ‘ঐটা ‘!
আনান টাকা পেয়ে পারলে আনন্দে নাচে। গপাগপ একের পর এক ফুচকা খেতে থাকে। কুহুর আর খাওয়া হয়না। ওর মাথায় তাহমিদের বলা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।
খাওয়া শেষ করে আনান সিএনজি ডেকে কুহুকে নিয়ে উঠে বসে। সিএনজি ছেড়ে দিতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে তাহমিদ। ওর ঠোঁটে মুচকি হাসি। কতদিন পর সে দেখল তার ভীতুকন্যাকে।
আজ যেন ওর সমস্ত তনু-মন শান্তির পরশে ছেয়ে গেছে।
আনান কুহুর জন্য আইসক্রিম, চকলেট কিনেছে। কিন্তু কুহু আঁইগুই করছে নিবেনা বলে। আসলে তাহমিদের টাকায় কেনা কোন কিছু ও খেতে চাচ্ছেনা। কিন্তু আনানকে বলার সাহস পাচ্ছেনা। এদিকে আনানও জোড়াজুড়ি করছে। বাধ্য হয়ে কুহু সেগুলো হাতে নেয়৷
তাহমিদ সোজা চলে আসে কুহুর কোচিং-এ। সেখানে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে শিক্ষকদের সাথে পরিচিত হয়। সেখানকার দুইজন শিক্ষক পরিচিত হওয়ায় সুবিধা হয় তাহমিদের। কুহুকে নিজেদের আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়ে ওর প্রতি খেয়াল রাখতে বলে তাদের। এরপর বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
পরদিন কুহু সিনএজি থেকে নেমে কোচিং-এ ঢুকতেই পাশের দোকান থেকে বের হয় তাহমিদ। কুহুকে নামতে দেখেই ও দোকানে ঢুকেছিল।
আজ কোচিং-এ এসে কুহু সকল স্যারের আচরণ দেখে অবাক হয়ে যায়। যদিও স্যারেরা যথেষ্ট আন্তরিক, কিন্তু আজ তারা একটু বেশিই আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন! স্যারেদের রাতারাতি এরূপ পরিবর্তন কুহুকে চিন্তায় ফেলে দেয়। অন্য দিনের চাইতে বেশি করে বুঝাচ্ছে, কুহুর দিকে নজর দিচ্ছে বেশি বেশি। অবশ্য এতে কুহুর লাভই হয়েছে। বেশ ভালো বুঝতে পারছে পড়াগুলো।
দুই ঘন্টা পর কুহু কোচিং থেকে বের হয়ে সিএনজির খোঁজ করছে। ঠিক তখনই ওর সামনে এক বয়স্ক চাচা সিএনজি নিয়ে দাঁড়ায়।
কুহু ভাড়া মিটিয়ে উঠে বসে সিএনজিতে।
কুহু জানলওনা হঠাৎ করেই সিএনজি ওর সামনে এসে কেন দাঁড়াল।
সিএনজি ছেড়ে দিলে তাহমিদ পাশের দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। কিছুক্ষণ গমনরত সিএনজির দিকে তাকিয়ে থেকে একটা রিক্সা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দেয়।
শাহনাজ সুলতানার মেয়ে আরোশির জন্মদিন চারদিন পর। ও জেদ ধরেছে এবার ঘটা করে জন্মদিন পালন করতে হবে। একটামাত্র মেয়ের জেদকে প্রশ্রয় দিয়ে বাবা আকরাম হোসেন বড় করে জন্মদিন পালন করতে রাজি হয়। সে অনুযায়ী লিষ্ট করেছেন শাহনাজ সুলতানা। গ্রামে ফোন করে কায়েস-শিউলিকে দাওয়াত করেছেন। নাজমা পারভিনকে ফোন করে পরিবারসহ দাওয়াত করেছেন। আর আফরোজা নাজনীনের পরিবারকে দাওয়াত করতে যাবেন আকরাম হোসেন।
শ্বশুর বাড়ির সকল আত্মীয় স্বজনদের নিজে দাওয়াত করেছেন শাহনাজ সুলতানা। তারা সবাই আসবে বলেছে।
আকরাম হোসেন ছেলেকে সাথে নিয়ে আফরোজা নাজনীনের ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। তিনি এ বাসার সবাইকে দাওয়াত করেছেন। তার ইচ্ছা জন্মদিনের আগেরদিন সবাই যাবে। কিন্তু আফরোজা নাজনীন এতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, অনুষ্ঠানের দিন সকাল সকাল সবাই সেখানে হাজির হবেন।
আয়েশা সালেহার সাথে কথা বলছেন আকরাম হোসেন। তাকেও যাওয়ার জন্য রাজি করিয়েছেন।
আনান অপেক্ষা করছে তাহমিদের জন্য। তাহমিদ আসলে আনান ওকে জড়িয়ে ধরে।
” ভাই, কেমন আছো? আমি তোমার জন্য বসে আছি। ফোন করেছি কিন্তু সুইচড অফ পেলাম। ”
” আমি ভালো আছি। এবার বল তুই কেমন আছিস? আর আমার জন্য অপেক্ষা করার কারন! ইদানীং কি ভিআইপি হিসাবে পরিচিতি পেয়েছি? ”
” ভাই, তুমি সব সময়ই আমার কাছে ভিআইপি। এবার শোন আগামী মঙ্গলবার আরোশির জন্মদিন। এই বাসার সবাইকে আব্বু দাওয়াত করেছে। কিন্তু আমি তোমাকে স্পেশালি দাওয়াত করছি। খালামনিরা সকালে যাবে। তুমি কখন যাবে?”
ঐ বাসায় যাওয়ার কথা শুনে তাহমিদের রক্ত সঞ্চালন বেড়ে গেছে। খুব কাছে থেকে দেখতে পারবে কুহুকে! ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাবে কিন্তু বাসার কাউকে বুঝতে না দিয়ে বলে,
” আমার মঙ্গলবার ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাশ আছে যেতে পারব কিনা তা এখনই বলতে পারছিনা। ”
” তোমার কোন না আমি শুনবনা ভাই। তুমি না আসলে আমি তোমার কাছে মেডিকেলে চলে যাব। দেখব তুমি না এসে থাক কেমন করে। ” আনান জোড়াজুড়ি করছে তাহমিদকে।
” আনান ভাই, যতই ক্লাস থাকুক তাহমিদ তোদের বাসায় যাবে। আমি দিদুন তোকে কথা দিলাম। ”
তাহমিদও হাঁফ ছাড়ে বেশিক্ষণ অভিনয় করতে হলোনা ভেবে। তবে নাছোড়বান্দা আনান তাহমিদকে দিয়ে কথা নিয়েই ছাড়ে বিকেল চারটার মধ্যে সেখানে যেতে হবে।
মঙ্গলবার বিকেল চারটার সময়ই তাহমিদ পৌঁছে আনানদের বাসায়। জন্মদিনের আয়োজন করা হয়েছে আনানদের বাগানে। সকল আত্মীয়-স্বজনরা জড়ো হয়েছে বাগানে। একপাশে জমকালো স্টেজ সাজানো হয়েছে। তাহমিদের মা, বড়মা, শাহনাজ খালামনিসহ অনেকেই অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। তাহমিদের ক্ষুধার্ত চোখদুটো খুঁজে চলেছে তার হৃদয়েশ্বরীকে।
” ভাই, এসেছ! এসো আমার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করাই। ” আনান এসে তাহমিদকে নিয়ে যেতে চায় তার বন্ধুদের কাছে৷
” রিল্যাক্স আনান, আগে বার্থডে গার্লের সাথে দেখা করে আসি। আরোশির কাছে যাই চল। ”
” চলো ভাই। ”
আনান তাহমিদকে নিয়ে আরোশির কাছে আসে। আরোশি ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল৷ সেখানে সুপ্তি, সিক্তাও আছে। নাজমা পারভিনের মেয়ে তনয়াও আছে। তাহমিদকে দেখে সবাই চিল্লাতে থাকে। তনয়া দৌড়ে এসে দাঁড়ায় তাহমিদের সামনে। সে এবার এইচএসসি দিবে আনানের সাথে।
” তাহমিদ ভাইয়া, কেমন আছো? এতক্ষণে তোমার আসার সময় হল! জানো তোমার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি। ” আল্লাদি গলায় বলে তনয়া।
চারপাশে এত মেয়ে দেখে তাহমিদ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। একটু এগিয়ে যেয়ে আরোশির হাতে একটা র্যাপিংয়ে মোড়ানো প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। ওকে উইশ করে পুনরায় এসে দাঁড়ায় তনয়ার কাছে।
” আমি ক্লাস শেষে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর এখানে আসছি। খুব চাপের মধ্যে থাকতে হয় বুঝলি। ” তাহমিদ ওদের সাথে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর চোখ কুহুকে খুঁজছে৷
” সিক্তা, দিদুন কোথায় জানিস? ”
” দিদুন ভেতরে রুমে আছে, ভাইয়া। ”
” আচ্ছা, তোরা আড্ডা দে। আনান চল যাই। ” তাহমিদ আনানকে নিয়ে বেরিয়ে আসে।
হাঁটতে গিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে যায় তাহমিদ। এ কাকে দেখছে সে! ভীতুকন্যা এ কোন রূপে তার সামনে হাজির হয়েছে! হালকা কলাপাতা রংয়ের শাড়ীতে ওকে চমৎকার লাগছে দেখতে। কানে পাথরের ঝুমকা, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি আর সাজ বলতে শুধু চোখে কাজল। ব্যাস এটুকুতেই ওকে মোহনীয় লাগছে। কুহু হাতে একটা জুসের গ্লাস নিয়ে আরোশিদের কাছে যাচ্ছিল। সামনে দাঁড়ানো তাহমিদকে দেখে আপনাআপনি মাথা নুইয়ে পরে। তাহমিদ দুই ধাপ এগিয়ে এসে কুহুর হাত থেকে জুসের গ্লাস নিয়ে তাতে চুমুক দেয়। কিন্তু ওর চোখ তখনো কুহুর দিকেই চেয়ে আছে।
” আনান, তোর কাছে পেইন কিলার আছে। থাকলে এটাকে দিস। তাছাড়া সন্ধ্যায় চোখ তুলে আরোশির কেক কাটা দেখার সৌভাগ্য তার হবেনা। ”
আনান চোখ গোল করে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। ভাই কুহুকে দেখলে এমন এলোমেলো কথা কেন বলে ভেবে পায়না।
আনাকে কিছু বলতে না দিয়ে তাহমিদ সামনে এগিয়ে যায়।
তাহমিদ চলে গেলে কুহু জোরে শ্বাস ছাড়ে৷
তারপর প্রায় ছুটে আসে আরোশিদের কাছে।
” কুহু তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? থেকে থেকে কোথায় হারাস বলতো?” সুপ্তি জিজ্ঞেস করে কুহুকে।
” আপু, আমি ফুপুদের সাথে ছিলাম। তাদের টুকটাক সাহায্য করছিলাম। ”
” তাদের সাহায্য করার জন্য অনেকেই আছে। তোর না গেলেও চলবে। দেখতো শাড়ীর ভাঁজ এলোমেলো হয়ে গেছে। আয় ঠিক করে দিই। ” ধ’ম’কে উঠে সুপ্তি।
” আপু, আমার শাড়ী পরতে ভালো লাগছেনা। আমি চেঞ্জ করব এখনই। ”
” আমরাও তো শাড়ী পরেই আছি। কই আমাদের এতে মোটেও অসুবিধা হচ্ছেনা। যত অসুবিধা সব তোর। তুই শাড়ীই পরে থাকবি। বেশি কথা না বলে আনন্দ কর। ” আবারও সুপ্তির ধ’ম’ক খেয়ে চুপ হয়ে যায় কুহু।
তাহমিদ আনানের বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত।
আনানের মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কুহু আর তাহমিদের বিষয়। ভাই আর কারো সাথে এমন করে কথা বলেনা শুধু কুহুর সাথে ছাড়া। কুহু একটু ভীতু বলেই কি ভাই ওকে রা’গা’তে চায়!
” আনান, মেয়েরা সবাই শাড়ী পরেছে কেন রে? আজ কি তোর বিয়ে? আমি এতদিন জানতাম বিয়েতে শাড়ী পরে কিন্তু এই প্রথম জন্মদিনে কাউকে শাড়ী পরতে দেখলাম। বিষয়টা একটু অদ্ভুত না! ”
” ভাই, মেয়েদের মনের খবর যেখানে স্বয়ং ঈশ্বরই দিতে পারেনি সেখানে আমরা কোন ছাড়! ওদের যেমন ষোলকলা তেমনই বত্রিশ শখ। বাদ দাও ওদের কথা। ” আনানের কথার ধরনে হেসে উঠে সবাই।
” কিন্তু আমাকে একটা কথা বল, ভাই। তুমি কুহুর পেছনে এমন করে লাগছ কেন? ও তো এক্কেরে নিউট্রাল মাইয়া। ”
” আগেই গুরুজন হবার শখ জেগেছে! কিন্তু আমার এত তারাতারি তোকে গুরুজন করার শখ নেই । জুনিয়র থাক কিছুদিন তারপর গুরুজন হবি বুঝলি? ” নির্বিকার মুখে জবাব দেয় তাহমিদ।
আনান তাহমিদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনা।
কুহু দিদুনকে ধরে নিয়ে বাগানে আসে। দিদুনের মুখ থেকে আজ হাসি কিছুতেই ফুরোচ্ছেনা। তিনি সবাইকে একসাথে দেখে শুধু হাসছেন। আড্ডার ফাঁকে তাহমিদের চোখ যায় দিদুনের দিকে। আড্ডা ছেড়ে আসে দিদুনের কাছে।
” দিদুন, তুমি এখন বাইরে আসলে কেন! পায়ের ব্যথা একটু কমেছে? ” তাহমিদ কথা বললেও ওর চোখ কুহুর দিকে।
” সবাই এখানে আছে আমি একা ভেতরে কেমন করে থাকি বল। তুই কিছু খেয়েছিস? দুপুরেতো মনে হয় কিছুই খাসনি। বড় বউমা জানে তুই এসেছিস? ”
” জুস খেয়েছি দিদুন। এখন তেমন ক্ষুধা নেই। বড়মার সাথে এখনো দেখা হয়নি। ”
” কুহু যাতো মনা, ওর জন্য কিছু খাবার নিয়ে আয়। আমিই আজকে খাইয়ে দিই ওকে। তাহমিদ, তুই এই চেয়ারে আমার পাশে বস। কুহু তারাতারি যা। ”
” আচ্ছা দিদুন। ”
কিছুক্ষণ পর কুহু একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসে। তাহমিদের ভিষণ লজ্জা লাগছে এভাবে খেতে হবে বলে। কিন্তু দিদুন যখন বলছেন তখন না খেয়ে উপায় নেই।
কুহু খাবার আনলে দিদুন ওকে তার পাশের চেয়ারে বসতে বলেন। কুহু তার কথা অমান্য না করে চেয়ারে বসে। বরাবরের মতো মাথা নিচু করে বসে সে ।
” দিদুন, মানুষের বোধহয় আজকাল লজ্জা বেশিই হয়েছে। আমার সামনে লজ্জার সিজন চলছে মনে হচ্ছে। এত লজ্জা সবাই কোথায় রাখে! ”
দিদুন তার নাতির কথার মানে বুঝতে পারেননা।
” কি আবোলতাবোল বলছিস এসব। লজ্জার আবার সিজন হয় নাকি! ”
” হয় দিদুন, খুব হয়। কিন্তু তুমি এসবের কিছুই বুঝবেনা। দিদুন, তোমার পাশেরজন কিছু খেয়েছে? আচ্ছা, সে কি বোবা নাকি কানে শোনেনা! ”
কুহু চোখ বড় বড় করে তাহমিদের দিকে তাকায়। কিন্তু ও তাহমিদের দিকে তাকাতেই দেখল তাহমিদ আগে থেকেই ওর দিকে কেমন একটা চোখে চেয়ে রয়েছে।
” দাদুভাই, এসব কি বলছিস তুই? কুহু কথাও বলতে পারে আবার কানেও শোনে। এভাবে মেয়েটার পেছনে লাগিসনা। ”
” ওকে, ঐটার পেছনে লাগবনা। এবার ঐটাকে এক লোকমা খাইয়ে দাও। তাছাড়া আমার খাবারে নজর দিলে শেষে দেখা যাবে আমার পেট খারাপ হবে। এখনই ওকে এক লোকমা খাইয়ে দাও। ” তাহমিদের জোড়াজুড়িতে কুহুকে এক লোকমা খাইয়ে দেন দিদুন।
পরের লোকমা তাহমিদের মুখে দিতেই দিদুনের আঙুল চেটেপুটে খায় তাহমিদ। ও এটাই চেয়েছিল। দিদুনের আঙুলে কুহুর ঠোঁটের পরশ লেগে আছে সেই পরশ এভাবে নিজের ঠোঁটে মেখে নেয় তাহমিদ।
চলবে….
(