প্রেমের মরা জলে ডুবে পর্ব -০৩

#প্রেমের_মরা_জলে_ডুবে

#তানিয়া

পব:৩

শুভ্র, পুরো নাম সফেদ হক শুভ্র। লেখাপড়া পুরোপুরি শেষ হয়েছে বছর দুয়েক হলো।লেখাপড়ার ভালো রেজাল্টে বাইরের দেশ থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত।বাবা মায়ের এক ছেলে তবে ছোট একটা বোন আছে। নাম শুভা।বাবার নিজের ব্যবসা আছে।কিন্তু শুভ্রর কাছে ব্যবসার চেয়ে নিজের পায়ে দাড়ানোটা যুক্তিসঙ্গত লাগে।তাছাড়া ব্যবসার চেয়ে শিক্ষকতার পেশাটাকে সে অনেক সম্মান করে তাই বর্তমানে সে একজন ইংরেজি প্রফেসর হিসেবে একটা সরকারি কলেজে নিয়োজিত আছে। তবে কলেজটা গ্রাম ভিত্তিক হওয়ায় যাতায়াতে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই শুভ্র খুব তাড়াতাড়ি নিজ শহরে ট্রান্সফার হওয়ার আবেদন জানাচ্ছে। মা বাবার অনেক আদরের ছেলে শুভ্র। ধবধবে ফর্সা হওয়ায় জন্মের পর তার নাম শুভ্র রাখা হয় তবে ছোট থাকতে যতটা আদুরে ছিল প্রাপ্ত বয়সে এসে সেই আদুরে ভাবটা যেন বহু গুণ বেড়েছে।শুভ্রর ভালো গুণ হচ্ছে তার ব্যক্তিত্ব। পুরুষ হিসেবে সে যতটা সুদর্শন তারচেয়ে বেশি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন সুপুরুষ।মেয়েদের সাথে খুব একটা মেলামেশা হয় না।যদিও মেয়েরা তার সাথে আলাপ জমাতে ইচ্ছুক তবে সেটাতে খুব একটা গা করে না। তুরফা হচ্ছে তার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে।সেই হিসেবে ছোট থেকে তাদের বাসায় যাওয়া আসা করতে করতে তুরফার সাথে একটা ভালো বন্ডিং গড়ে উঠে আর তখনি তুরফার প্রতি প্রেম জাগে।তবে এটা কখনো সরাসরি তুরফাকে না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে।তাছাড়া শান্তা আর নিপার বন্ধুত্বকে জিইয়ে রাখতে তারা ছেলেমেয়েদের বিয়ের মাধ্যমে সেটা আরো শক্ত করার চিন্তা করে।সেই মোতাবেক বিয়ের অনুষ্ঠান করা হলেও বিয়ের দিন সবটা এলোমেলো হয়ে যায়।

অন্যদিকে তিমির,পুরোই শুভ্রর উল্টো।তিমিরের মা ইয়াসমিন মারা যান যখন তিমিরের বয়স আড়াই বছর। তিমির তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে।গায়ের রং ডিপ কালোর চেয়ে কিছুটা উন্নত তবে উজ্জ্বল শ্যামলাও বলা যায় না।পড়াশোনা সবে মেট্রিক পাশ করে কলেজে পদার্পণ।তবে লেখাপড়া আর বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পাকা।লেখাপড়ায় যতটা না ভালো তারচেয়ে ভালো দুনিয়ার সব অপদার্থ কাজ কামে।প্রচুর কথা বলে,প্রচুর মজা করে সেই সাথে সব বাচ্চামো অভ্যাস তো আছেই।কালো হওয়ার কারণেই হয়তো সুন্দর মানুষের প্রতি তার আলাদা একটা টান কাজ করে আর সেই জন্যই সবসময় সুন্দর মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করতো আর স্বপ্ন পোষণ করতো জীবনে একজন সুন্দর পুরুষের।তবে নিজের গায়ের রং নিয়ে চিন্তা না করলেও মাঝেমধ্যে ভয় পেতো যদি সুন্দর পুরুষ তাকে পছন্দ না করে কিন্তু কাকতালীয় ভাবে সুদর্শন শুভ্র এখন তার হাসবেন্ড কিন্তু শুভ্র কি আধো তাকে বউ হিসেবে মানবে?

তুরফার মা শান্তা বেগম প্রথম পক্ষ আর সেই ঘরেই একমেয়ে তুরফা।দেখতে সুন্দর, শিক্ষিতা আর অনেক স্মার্ট। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করছে খুব তাড়াতাড়ি ইন্টার্নি করে পড়াশোনার ইতি টানবে।হাতে আরো কিছু সময় আছে পড়াশোনার শেষ করার।এরমধ্যেই মা তার বিয়ের কাজ চালায় কিন্তু সে এতে মারাত্মকভাবে নারাজ ছিল।কেননা নিজের এক ইয়ার সিনিয়র এক ছেলের সাথে তার প্রেম কিন্তু ঐ ছেলের অবস্থা তার পরিবারের চেয়ে কম বলে সেটা মা শান্তাকে জানাতে পারে নি কারণ সে জানে তার মা শান্তা কখনো এ সম্পর্ক মানবে না।তাছাড়া তিনি আগে থেকে তুরফাকে সতর্ক করেছিলেন যে শুভ্রর সাথে তার বিয়ে হবে।তাই যেন অন্যদিকে তিরিং বিরিং না করে কিন্তু মন তো সেটা শুনবে না।সে তিরিং বিরিং করে প্রেমে পড়লো তাও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের। শান্তা বেগম, বান্ধবী নিপাকে অনেকটা সমীচীন করে কারণ নিপার অবস্থা অনেক উঁচু। তাই বান্ধবীর ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিজেকেও তাদের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়লো যখন বিয়েটা নিজের মেয়ের না হয়ে সতীনের মেয়ের হলো।তার সব স্বপ্ন যেন কাঁদায় গড়াগড়ি করা শুরু হয়েছে যখন শুনলো তিমিরের সাথে শুভ্রর বিয়ে হয়েছে।কবির সাহেব যখন আড়াই বছরের তিমিরকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে তখন শান্তা বেগম মেয়েকে খাওয়াচ্ছিলেন।স্বামীর সাথে একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখে তিনি প্রশ্ন করেন আর সেই প্রশ্নে যখন জানতে পারলেন তাকে না জানিয়ে তিনি বিয়ে করেছেন আর সেই সংসারের মেয়ে তিমির তখনি রাগে তিনি ফেটে পড়লেন। গায়ের সব শক্তি দিয়ে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠেছিলেন আর সেই চিৎকারে তিমির দ্রুত বাবার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে।কবির সাহেব জানান তিমিরের মা মারা গেছে তার দেখাশোনার কেউ নেই তাই তাকে এ বাসায় রাখবে।এটা নিয়ে দুজনের মধ্যে একমাসেরও বেশি সময় ঝড় চলে।একসময় শান্তা বেগম বুঝতে পারে কবির এ মেয়েকে এ বাড়িতেই রাখবে তাই উপায় না পেয়ে সে তিমিরকে সহ্য করেন। কিন্তু চক্ষুশুল সতীনের মেয়েকে তিনি কখনো প্রাপ্য অধিকার দেননি।বরাবরের মতোই তার সাথে জঘন্য আচরণ করেছে। যখন তিমিরকে এ বাড়িতে আনা হয় তখন তুরফা প্রাইমারি পর্যায়ে। তুরফাও তিমিরকে তেমন একটা পছন্দ করতো না।যতই হোক কোথাকার কে এসে তার বাবার ভাগ বসাচ্ছে এটা সে নিতে পারছে না তার ওপর কুচকুচে কালো মেয়ে হওয়াতে তুরফা তাকে খুব একটা পছন্দ করতোনা।সবমিলিয়ে তিমিরের বাল্য শৈশব তেমন একটা সুখের ছিলো না।অনেক অবহেলা কষ্ট নিয়ে সে বড় হয় কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে তার মধ্যে দুনিয়ার সব ইবলিশপনা কাজ ভর করে আর তাই সৎ মা যতই মারধর আর বকাঝকা করতো ততই সে তার পেছনে লাগতো।এতে সব তার গা সওয়া হয়ে গেছে কেননা সে দোষ করলেও মার খেতো না করলেও অন্য অজুহাতে মার দিত।তাই দোষ করাটা তার দৈনন্দিন কাজে পরিণত হলো।শান্তার বান্ধবী হিসেবে নিপাও যেন একি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।দুজনের স্বভাব আচরণ একি ধাঁচের।তাই তো তাদের সম্পর্ক এত গাড়।কবির সাহেব আর জিন্নাহ সাহেব দুজনি বৈবাহিক অবস্থার দিক থেকে খুব একটা সুখী নন, জিন্নাহ সাহেব বউয়ের কথার ধার না ধরলেও কবির সাহেব ঠিকই শান্তাকে ভয় করে চলে।আসলে কবির সাহেব শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ তাই ঝগড়া দ্বন্দ্বে তিনি পছন্দ করেন না।শান্তা তাকে সবকিছুতে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে।তাই ব্যাবসার কাজে যখন তিনি কুষ্টিয়া যান সেখানেই দেখা পায় ইয়াসমিনের।ইয়াসমিন মেয়ে হিসেবে অসম্ভব ভালো আর খুবই মিশুক স্বভাবের।তবে ইয়াসমিনও কালো হলেও অনেক শ্রীময়ী আর সেই রং আর শ্রী পেয়েছে তিমির।তবে মায়ের মতো খোলামেলা, হাসিখুশি স্বভাবের গুণগুলো ধারণ করতে পারলেও মায়ের মতো লজ্জা আর সংযত স্বভাব সে নিতে পারে নি আর তাই তো শান্তা বেগম তাকে উঠতে বসতে মায়ের নাম নিয়ে বকা দেয়।এতে তার খারাপ লাগে কারণ সে যতটুকু মা কে পেয়েছে তাতে অল্প অল্প মনে পড়ে মা তার মতো নয়।এমনকি বাবা থেকেও মায়ের যত গল্প শুনেছে তাতেও সে তার এসব দুষ্টমির কোনো গল্প পায় নি।সব মিলে এ গল্পের শুভ্র তিমির যেন একি মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। সৃষ্টির মধ্যেই যেন বৈপরীত্যে তাদের মধ্যে অবস্থান করছে।

সকাল আটটায় ঘুম ভাঙলো শুভ্রর।আজকে ফজরের নামাজটা পড়তে পারেনি।গতকাল এত বেশি শারীরিক ও মানসিক চাপে ছিল যে শেষ পর্যন্ত ঘুমি ভাঙে নি।বিছানা ছেড়ে এসে গোসলে ঢুকলো।গোসল শেষ করে এসো নামাজে দাঁড়ালো। নিপা এরমধ্যে একবার উঁকি দিয়ে গেছে যে ছেলে উঠলো কিনা,গতকাল জেগে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই টের পায় নি ছেলের আগমন।যখন চোখ খুললো তখনি হন্তদন্ত হয়ে ছেলের রুমে গেলো দেখলো তার আদরের ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে।ঘুমের মধ্যেও ছেলের চেহারায় স্পষ্ট বিষাদ ভেসে ওঠলো।তিনি চোখ মুছে দরজা লাগিয়ে চলে গেলেন।ছেলেকে তিনি বড় ভালোবাসেন।

শুভ্র তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে চলে আসলো সেই সাথে এলো শুভা আর তিমির।তিমির এসেই সোজা শুভ্রর পাশের চেয়ারে বসে গেলো আর সেটা দেখেই নিপা চিৎকার দিয়ে উঠলো।

“এই মেয়ে, এত চেয়ার খালি থাকতে তুমি ওদিকে বসলে কেনো,সরো বলছি? ”

তিমির কিছু বলতে গেলো কিন্তু আড়চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে নিরবে সরে গেলো কারণ শুভ্র নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছে। এ মুহুর্তে শুভ্রর সামনে কথা বলতে তার ভয় করছে।

শুভ্র খাবার খেয়ে নিজের রুমে গেলো নিজের বাকি জিনিসগুলো নিতে।তিমির শুভ্রর আগেই টেবিল ছেড়ে উপরে চলে গেলো কারণ শুভ্রর পরে গেলে নিপা হাজারটা প্রশ্ন করবে।শুভ্র রুমে যেতেই তিমির দরজার কাছে চলে গেলো।সে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কি বলবে বা কোথা হতে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা।চোখ বন্ধ করে মনে মনে সবটা গুছিয়ে নিয়ে বড় নিঃশ্বাস ফেলে মুখ খুললো,

“শুভ্র ভাইয়া আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ”

শুভ্র তিমিরের উপস্থিতি টের পেলেও সেদিকে না তাকিয়ে নিজের কাজ করছিলো।শুভ্র এমনিতেই স্বল্পভাষী ছেলে তার ওপর এমন পরিস্থিতিতে যে তিমিরের সাথে কোনো কথা বলা বা শুনবে না ভালো করেই জানে।তাই ভণিতা না করে তিমির আবারও বললো,

“শুভ্র ভাইয়া দেখুন আসলে কালকে যা হয়েছে তার জন্য আমার একার কোনো দোষ নেই। আসলে আপনাকে আমার কিছু কথা বলার আছে,আসলে কালল”

তিমির দ্রুত গতিতে কথা বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু বারবার কথা গুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কথা পুরোপুরি শেষ করার আগেই শুভ্র পাশ কেটে চলে গেলো।তিমির শুভ্রর যাওয়ার দিকে চেয়ে রয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেললো।এ স্বল্পভাষী লোকটাকে যে কীভাবে সব কথা খুলে বলবে, কীভাবে বলবে তুরফা আপু নিজেই তাকে এ বিয়ে করতে জোর করেছে কারণ সে শুভ্রকে নয় অন্য কাউকে পছন্দ করে কীভাবে তিমির এসব কথা বলবে শুভ্রকে!তার আগে তুরফা আপুর সাথে কথা বলতে হবে কেনই তিনি আমাকে সবার সামনে প্রতারক হিসেবে প্রমাণ করেছে?
,
,
,
চলবে…….

২.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here