সে আমার মানসিক শান্তি পর্ব -৩৮+৩৯

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৩৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে আব্রাহাম। মূলত আয়াতের সাথে একান্ত সময় কাটানোর জন্যই সে ছাদে এসেছে। কিন্তু আয়াতকে বুঝিয়েছে, সে আয়াতের ওপরে রাগ করে, আয়াতের থেকে দূরে সরে এসেছে। আব্রাহাম জানতো সে ছাদে আসলে, আয়াত-ও তার সাথে আসবে। আব্রাহামের ভাবনার মাঝেই আয়াত এসে, আব্রাহামকে জড়িয়ে ধরলো। আব্রাহাম আনমনেই হেসে উঠলো। আয়াতকে আর ছাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করল না। মেয়েটার পাগলামিতেই তো সে অভ্যস্ত। যার একটু ভালোবাসা তাকে, এক সমুদ্র সমান মানসিক শান্তি দেয়।

–আর কত রাগ করে থাকবে? একটু তো গলে যাও। তোমাক পুলিশে দেওয়া উচিৎ। বউ কত সুন্দর করে সেজেছে। তাকে দু’টো ভালো ভালো কথা বলবে। তার প্রশংসা করবে। তোমার প্রশংসা শুনে, সে লজ্জা লাল হয়ে যাবে। কেমন জামাই তুমি? বউকে লজ্জা পাবার মতো কথা বলতে পারো না।

–যার লজ্জা আছে। তাকে লজ্জা দেওয়া যায়। যার লজ্জা নেই। তাকে কিভাবে লজ্জা দিব? একটু চিন্তিত হবার ভান ধরে কথা গুলো বলল আব্রাহাম। আয়াত রাগান্বিত হয়ে আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে এভাবে অপমান করল আব্রাহাম। রাগ করে ঘুরে চলে যাচ্ছিল আয়াত। তখনই হাতে টান অনুভব করল আয়াত। পেছনে ঘুরে দেখলো আব্রাহাম তার হাত ধরে আছে। আয়াত রাগ দেখিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে, আব্রাহাম আয়াতকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। আয়াত রাগে গজগজ করতে লাগলো। তা দেখে আব্রাহাম হাসতে হাসতে বলল।

–এতটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে গেলে? আমি যে তোমাকে কত সহ্য করি? রজনী ভাবির কাছে যাবার আগে, একটা বার আমার থেকে অনুমতি নিয়েছিলে? আমার ভেতরে কি হচ্ছিল। কখনো ভেবে দেখেছো? আমার যন্ত্রনাটা যদি একটু অনুভব করতে পারতে, তাহলে আমাকে আঘাত করার আগে, শতবার ভাবতে আয়াত। আব্রাহামের কথায় আয়াতের মুখটা মলিন হয়ে আসলো। আয়াতকে মন খারাপ করতে দেখে, নিজের বুকে টেনে দিল আব্রাহাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল।

–আর কখনো এমন করো না আয়াত। আমি সহ্য করতে পারি না। পুরো পৃথিবীর মানুষ আমার পাশে থেকে দূর চলে যাক। তাতে আমার কোনো আক্ষেপ থাকবে না। তুমি একটু দূরে গেলে, আমার ভেতরটা হাহাকার ভরে উঠে। আমি নিঃস্ব হয়ে যাই। আর কখনো এমন করবে না। কথা দাও। আয়াত আব্রাহামের হাতে হাত রেখে কথা দিল। সে আর কখনো এমন করবে না।

–অনেক রাত হয়েছে, তুমি খাবে না?

–আর একটু থাকি।

–আগে খেয়ে আসো। তারপরে আবার আসবো। আয়াতের কথা শুনে, আব্রাহাম একটু ভেবে বলল।

–আমি যেতে পারি। তবে আমাকে খাইয়ে দিতে হবে।

–আচ্ছা সমস্যা নেই। এক প্লেটে বসে দু’জন খাব। আয়াতের কথা শুনে, আব্রাহাম হাসলো। আয়াতের হাত ধরে নিচে চলে আসলো। আয়াত ভাত মেখে নিজেও খাচ্ছে, আব্রাহামকে-ও খাইয়ে দিচ্ছে। আব্রাহাম খাচ্ছে আর ফোনের মধ্যে চোখ দিয়ে আছে। এতে প্রচন্ড বিরক্ত হলো আয়াত। খাবারের প্লেটটা টেবিলে রেখে খপ করে হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। আয়াতকে রেগে যেতে দেখে, আব্রাহাম হাসলো। আব্রাহামকে হাসতে দেখে আয়াত শাসিয়ে বলল।

–সারাদিন পরে বাসায় এসেছো। কোথায় আমার সাথে ভালোমন্দ কথা বলবে। তা-না করে, ফোনের মধ্যে মাথা দিয়ে আছো। ভাত খাবার কি দরকার? মোবাইল খেয়ে থাকলেই তো পারো। শুধু শুধু আমাকে কষ্ট করে খাইয়ে দিতে হয় না। আমি ওর জন্য কি করছি। আর ও আমাকে মূল্যই দিচ্ছে না। কাল থেকে আমি আগে আগে খেয়ে বসে থাকবো।

–রাগ করছো কেনো? খাবার সময় কথা বলতে হয় না। তাই চুপ করে ছিলাম। রুমে গিয়ে তোমার সাথে অনেক গল্প করবো।

–খাবার সময় কথা বলতে হয় না। মোবাইল ঘাটতে হয় তাই না। আব্রাহাম চুপ হয়ে গেল। আয়াত আর কোনো কথা বলল না। দু’জন মিলে খেয়ে রুমে চলে গেল।

–আমার সাথে একটা জায়গায় যাবে আয়াত? আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত আব্রাহামের দিকে তাকালো। গম্ভীর মুখ করে বলল।

–এত রাত করে কোথায় যাব?

–তোমার বোনের কাছে। আমাকে সত্যি কথা বলছে না। তুমি যদি একটু সত্যি কথা বের করে নিয়ে আসতে পারো। আয়াত অবাক হয়ে বলল।

–আরোহী আপু তোমার কাছে!

–হ্যাঁ এতদিন তো আমার কাছেই ছিল। এখনো রেখে দিয়েছি। অনেক কিছু জানার আছে।

–তুমি আরোহী আপুর সাথে একসাথে ছিলে?

–না আলাদা ছিলাম। তোমার বোন এক রুমে ছিল। আমি আরেক রুমে ছিলাম। আমাকে তোমার এত বাজে ছেলে মনে হয়। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত হাসিমাখা মুখ করে বলল।

–তুমি পৃথিবীর সেরা স্বামী। আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তোমাকে কিভাবে বাজে বলবো বলো। আয়াতের কথায় হাসলো আব্রাহাম। আব্রাহামকে এত হাসতে দেখে, আয়াত ভ্রু কুঁচকে বলল।

–এই ব্যাপার কি? আজকে তুমি এত ঘনঘন হাসছো কেনো? কারনে অকারণে হাসা একদম ভালো লক্ষণ না। মানুষ যখন নতুন নতুন প্রেমে পড়ে, তখন অকারণে হাসে। তুমি আবার কারো প্রেমে ট্রেমে পড়ো নাই তো?

–হ্যাঁ পড়েছি। অনেক আগেই একজন আমাকে শেষ করে দিয়েছে। একটা মেয়ে দুই পাশে বিনুনি করা, পড়নে স্কুলের ড্রেস। গরমে মেয়েটার সমস্ত মুখশ্রী ঘেমে একাকার। বিরক্তি মাখা মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। যখন আমি নতুন নতুন ডক্টর হই। তখন সে আমার কাছে এসেছিল। তাকে দেখার পরে, আমার আর কাউকে ভালো লাগেনি। শুনেছি হাত ধরলে, নাকি মানুষ ছেড়ে চলে যায়। তাই তো আমি তার মনে ধরেছি। এখন সে আমার বউ। কথা গুলো বলেই চমৎকার একটা হাসি উপহার দিল আব্রাহাম। আয়াত মুগ্ধ হয়ে মানুষটার কথা গুলো শুনছিল। কতগুলো বছর আগের কথা, মানুষটা সমস্ত কিছু মুখস্থ করে রেখেছে। একটা শব্দ ও ভুলে নাই। আয়াতের ভাবনার মাঝেই আব্রাহাম বলল।

–তোমার শরীরটা ভালো নয়। আজ যাব না। দু’দিন পরে আরোহী আপুর কাছে যাব। আমার শরীরটাও আজকে ভালো ঠেকছে না। কালকে সকালে উঠতে হবে। তোমার জন্য রাতে ডিউটি ক্যানসেল করে দিয়েছি। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াতের চোখে মুখে খুশির ঝলক দেখা দিল।

রাত গভীর হবার আগেই পুরো বস্তি নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ মহিলার সামনে বসে আছে আগন্তুক। বৃদ্ধের চোখে মুখে ধরা দিয়েছে ভয়ের ছাপ। আগন্তুকের দু-চোখ অসম্ভব ভাবে লাল হয়ে আছে। দু-চোখে লেগেছে প্রতিশোধের নেশা। নিজের কর্মে ব্যর্থ হবার দরুনে, সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। বৃদ্ধ কিছু বলতে যাবে। তার আগে আগন্তুক বৃদ্ধের গাল চেপে ধরলো।

–একটা কাজ দিয়েছিলাম। ঠিক মতো কতে পারলে না? তোমাকে কাজ দিয়ে, আমি উল্টো বিপদে পড়ে গেলাম। তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে আমার কোনো কাজ নেই। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমি বিপদে পড়ে যাব।

–আমাকে মেরো না। আমি কাউকে কিছু বলবো না। পেটের জন্য তোমার কাজ করতে রাজি হয়েছি। পেট না থাকলে এত কষ্ট করতাম। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। মেয়েটাকে আমার কাছে রাখার। আমি পাশের এলাকায় গিয়েছিলাম। তখনই কেউ এসে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গিয়েছে। আমাকে মেরো না। আমি এখানে থেকে চলে যাব।

–জীবনে অনেক পাপ কাজ করেছি। কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার মতো পাপ কাজ আমি করবো না। তুমি টাকার জন্য আমার শর্তে রাজি হয়েছো। অন্য কেউ এসে যদি বলে, আমার থেকে বেশি টাকা দিবে। তাহলে তুমি আমাকে খু*ন করতেও রাজি হয়ে যাবে। তোমার মতো বেইমানদের আমি বাঁচিয়ে রাখি না। এই বৃদ্ধকে এমন ভাবে মারবি। দেখে যেনো মনে হয়। একাই মরে গিয়েছে। বলেই আগন্তুক রুম ত্যাগ করল। বৃদ্ধ হাজার আকুতি মিনতি করেও শেষ রক্ষা পেল না। কথায় আছে না লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। কথাটা বেশ করে উপলব্ধি করতে পারলো বৃদ্ধ।

সময় স্রোতের ন্যায় কখন যে পেড়িয়ে যায়। তা বুঝে ওঠা মুসকিল। এর মাঝে কেটে গিয়েছে ক’টাদিন। আরোহী হাত-পা অবস্থায় বসে আছে। তার সামনেই বসে আছে আয়াত। বোনের করুন অবস্থা দেখে, এতটুকু মায়া হলো না আয়াতের। যে বোনের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে, দু’বার ভাবে নাই। সেই বোন তাকে ঠকাতে এক মুহুর্ত সময় নিল না। এমন বোনের দরকার নেই আয়াতের। আরোহী অসহায় দৃষ্টিতে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত কাঠিন্য কণ্ঠে বলল।

–তোমার স্বামীর কি টাকার এতই অভাব পড়লো। যে নিজের বউকে পর পুরুষের কাছে পাঠাতে, এক সেকেন্ড সময় নিল না। বউকে দিয়ে বুঝি এসব করিয়ে খায়। তাই তো বলি, পালিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ের এত টাকা-পয়সা বিলাসিতার জীবন আসে কোথায় থেকে? আয়াতের কথা শুনে, আরোহী চিৎকার দিয়ে উঠলো।

–এত মেজাজ দেখাও কাকে? তোমার মেজাজের কামাই আমি খাই না। তুমি এতদিন আমার মনে ছিলে, তাই তোমার কষ্ট আমার হৃদয় ছুঁতে পেরেছে। তোমার অসহায়ত্ব আমাকে কাঁদিয়েছে। তুমি সেদিনই আমার মন থেকে বেড়িয়ে গিয়েছো। যেদিন আব্রাহাম আর আমাকে আলাদা করে দিয়েছো। বড় বোন হয়ে ছোট বোনের স্বামীর সাথে, একই বাসায় থাকতে লজ্জা করল না তোমার।

–আয়াত চুপ কর। এসব কথা আমি শুনতে পারছি না। আমার ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ আব্রাহামকে বল আমাকে ছেড়ে দিতে।

–কোথায় তোমার স্বামী? তাকে বলো সে যেনো এসে, তোমাকে নিয়ে যায়। তোমার স্বামীর তো অনেক ক্ষমতা। আমার মতো করে, তোমাকে সাজিয়ে আমার স্বামীর কাছে থাকতে পাঠালো। আর তোমাকে উদ্ধার করে নিতে যেতে পারলো না। কেমন স্বামী তোমার? আমার স্বামীকে দেখেছো। ঠিক খুঁজে নিয়ে এসেছে। আমার স্বামীর ভালোবাসার মানুষ হতে হলে, ভাগ্য লাগে। সেই ভাগ্যটা তোমার নেই। এই বুদ্ধি নিয়ে আসছিলে, আমার স্বামীর বউ হতে? তোমার স্বামী তোমাকে অন্য পুরুষের কাছে পাঠাতে দু’বার ভাবে না। কিন্তু আমার স্বামী যদি দেখে, আমি অন্য ছেলের সাথে কথা বলছি। তাহলে চোখ দিয়েই আমাকে শেষ ফেলে। বাকি কথা না বলি। হেয়ালি না করে, এবার আসল কথায় আসি। তুমি সত্যি কথা গুলো ভালোই ভালোই বলবে, নাকি আব্রাহামকে বলবো। বোন আদর বাড়িয়ে দিতে?

–খুব স্বামীর অহংকার দেখাচ্ছিস তাই না। তোর স্বামী যদি না থাকে, তাহলে কিসের অহংকার দেখাবি। নিজের বোন বলে, তোকে এতদিন ছাড় দিয়েছি৷ আজকে তুই যা করলি, এর পরে আর কোনো ছাড় তুই পাবি না। আমাকে আটকে রেখে, তোদের কোনো লাভই হবে না। আমাকে যদি মেরেও ফেলিস। তোদের ক্ষতি হবেই। উনি তোদের কাউকে ভালো থাকতে দিবে না। একটু একটু করে সবাইকে শেষ করে ফেলবে। আগে বাবাকে আর আব্রাহামকে মারবে। তারপরে তোদের সবাইকে রাস্তা থেকে সরাবে। এখন খুঁজে বের করে নে। কে তোদের সবার ক্ষতি করতে চায়। তোরা তো ভাবিস আমি আর আহনাফ তোদের ক্ষতি চাই। কিন্তু আমরা ছাড়া-ও যে তোদের ক্ষতি আরো একজন চায়। সেটা কি তোরা জানিস?

আরোহীর কথা শুনে থমকে গেল আয়াত। তবে দমে গেল না। কঠিন কণ্ঠে বলল।

–একটা কথা কি জানো আপু? চোরের দশ দিন আর সাধুর একদিন। চোর চুরি করতে করতে একদিন না একদিন ধরা পড়বেই। যেদিন ধরা পড়বে। সেদিন আর রক্ষে নেই।

–চোর যদি কাছের কেউ। আপন কেউ। তাহলে কি করে ধরবি। তোর আপনজনই তোর ক্ষতি চায়। যা বাসায় গিয়ে তাকে খুঁজে বের কর।আরোহীর কথা শুনে আয়াত ভাবনায় পড়ে গেল। তার কাছের কেউ, তার আপনজন! তার ক্ষতি চায়। কে সে?

চলবে…..#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৩৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

নিস্তব্ধতার রেশ ঘিরে ধরেছে চারিদিকে, থম রয়েছে রজনী। পুরো শহর নিদ্রা দেশে তলিয়ে গিয়েছে। ঘুমোয়নি শুধু আয়াতের আঁখি জোড়া। ঘড়ির কাঁটায় রাত দু’টো বাজতে যায়। মানুষটা এখনো বাসায় ফিরলো না। সে বলেছিল? আর রাত করে বাসায় ফিরবে না। তবে কেনো সে তার কথা রাখলো না। বড্ড অভিমান হচ্ছে আয়াতের, সাথে ঘিরে ধরেছে একরাশ ভয়। আয়াতের ভাবনার মাঝেই আয়াত উপলব্ধি করতে পারলো। রুমের মধ্যে কেউ প্রবেশ করেছে। দ্রুত নিজের আঁখি জোড়া বন্ধ করে নিল। আজকে তার জীবন চলে যাবে। তবু্ও তার সাথে কথা বলবে না। বড্ড অবহেলা করছে মানুষটা। তাকে এতটুকু সময় দেয় না। মানছি সে পেশায় একজন ডক্টর। কিন্তু তার যে একটা বউ আছে। সে কথা কি তার মনে আছে। আমাকে এতটুকু সময় দেওয়া যায় না। সে যদি তার কাজ নিয়ে ভালো থাকতে পারে। আমি কেনো তার থেকে, সময়ের আশা করে কষ্ট পাব। পাওয়ার আশা ছেড়ে দিলাম আজ থেকে। সে তার মতো আমি আমার মতো। আঁখি জোড়া বন্ধ কথা গুলো মনে মনে আওড়াচ্ছিলো আয়াত৷ আব্রাহাম রুমে এসে, ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসলো। আলতো করে আয়াতের শরীর স্পর্শ করে ডাকলো। আয়াত জেগে থেকে-ও কথা বলল না। মনটা কেনো জানি ভিষণ খারাপ। আয়াতের থেকে, কোনো রেসপন্স না পেয়ে আস্তে করে আয়াতের পাশে শুয়ে, আয়াতকে জড়িয়ে ধরলো। আব্রাহামের শীতল হাত আয়াতকে স্পর্শ করতেই আয়াত আব্রাহামের হাত সরিয়ে দিল। আব্রাহাম বুঝতে পারলো আয়াত জেগে রয়েছে। মেয়েটার বড্ড অভিমান হয়েছে। আয়াত তো শান্ত থাকার মতো মেয়ে নয়। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলল।

–ঘুমোওনি? না ঘুমোলে চলো যাই? খেয়ে আসি। পরিবেশ একজন নিস্তব্ধ। সিলিং ফ্যানের শব্দ ছাড়া কোনো কিছুর আওয়াজ আসছে না। এভাবেই অতিবাহিত হয় যায় কিছু সময়। আয়াতের থেকে কোনো সারা শব্দ আসলো না। আব্রাহাম বুঝলো আয়াত ঘুমিয়ে গিয়েছে। আব্রাহাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আয়াতকে নিজের টেনে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে-ও নিদ্রা দেশে তলিয়ে গেল।

পরের দিন সকাল বেলা আয়াত রান্না ঘরে রান্না করছে। আব্রাহাম এসে আয়াতের পাশে দাঁড়ালো। আয়াত আব্রাহামকে দেখেও না দেখার ভান ধরে নিজের কাজে মনযোগ দিল। আব্রাহাম রাগান্বিত হয়ে বলল।

–তুমি রান্না ঘরে এসেছো কেনো? আন্টি এসে রান্না করে দিয়ে যাবে। তুমি রান্না করতে পারো না। যদি কোনো অঘটন ঘটে যেতো? আয়াত আব্রাহামের কথায় পাত্তা না দিয়ে, শুকনো মুখ করে গ্যাসের চুলা অফ করে দিয়ে, রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো। আব্রাহাম ফ্যালফ্যাল করে আয়াতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা বড্ড অভিমানী। খুব সহজে অভিমান করে না। একবার অভিমান করলে, আর রক্ষে নেই। আব্রাহাম আয়াতের পিছু পিছু গেল। হাজার রকমের কথা বলেও কাজ হলো না। আয়াতের মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারে নাই। হতাশ হয়ে বেড়িয়ে গেল। আয়াত আব্রাহামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে ফেলল।

আহনাফের পাশে বসে আছে আবরার। হঠাৎ করেই দরজার কাছে থেকে শব্দ আসলো। আবরার তাকিয়ে দেখলো তার বাবা এসেছে। বাবাকে দেখে এতটুকুও ভরকালো না আবরার। সত্যিটা ইতিমধ্যে জেনেছে সে। আবরারের বাবা এসে ছেলের পাশে বসলো। আহনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল।

–এখন কেমন আছিস বাবা? তোকে আর আড়ালে থাকতে হবে না। অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা। আব্রাহাম আমার বাসায় থেকে বের হয়ে গিয়েছে। তুই এখন নিশ্চিন্তে চৌধুরী বাড়িতে যেতে পারবি।

–আহনাফ ভাইয়ের সাথে তোমার যোগাযোগ ঠিকই ছিল। তাহলে শুধু শুধু এতদিন আব্রাহামকে কষ্ট দিলে কেনো আব্বু? ছেলেকে ছদ্মবেশে বস্তিতে লুকিয়ে রাখতে, তোমার বুক কাঁপলো না। নিজের ছেলেকে লুকিয়ে রেখে, একটা এতিম বাচ্চাকে কষ্ট দিতে তোমার বিবেকে বাঁধা দিল না। আবরারের কথা শুনে, থমকালো আহনাফ। হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল।

–কাকে তুই এতিম বাচ্চা বলছিস?

–আহনাফ তুমি এখন অসুস্থ। সময় হলে, সবকিছু জানতে পারবে। আরোহী কোথায়? বাবার কথায় মুখ চুপসে গেল আহনাফের। এখন সে বাবাকে কি জবাব দিবে?

–আরোহী আপু আব্রাহামের কাছে, আহনাফ ভাই আরোহী আপুকে আয়াত সাজিয়ে, আব্রাহামকে মারতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আরোহী আপু আব্রাহামের হাতে ধরা পড়ে যায়। আব্রাহাম কেমন মানুষ? সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। আবরারের কথা শুনে সফিউল চৌধুরী বলল।

–অনেক হয়েছে প্রতিশোধের খেলা। এবার থেমে যা আহনাফ। আব্রাহামের কোনো ক্ষতি করিস না৷ যাকে কোলে পিঠে করে, মানুষ করেছি। তাকে কিভাবে খু*ন* করবো। আমরা যেটা চেয়ে ছিলাম। আমাদের আশা পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আমাদের আর কিছু চাই না। আব্রাহামকে আব্রাহামের মতো ভালো থাকতে দে। আমরা সবাই মিলে সুন্দর করে জীবন সাজিয়ে নিতে পারি না। বাবার কথায় ফুঁসে উঠলো আহনাফ। কিন্তু বাহিরে তা প্রকাশ করল না। একবার সুস্থ হয়ে নিক। তারপরে সব হিসাবনিকাশ করা হবে।

–আব্বু তুমি বললে, আব্রাহাম আরোহীকে ছেড়ে দিবে। তুমি একটু আব্রাহামকে বলো, সে যেনো আরোহীকে ছেড়ে দেয়।

–তুই আমার সাথে বাসায় চল। বাসায় গিয়ে একটা ব্যবস্থা হবে। সবাই মিলে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিয়ে দিল।

আরোহীর সামনে বসে আছে আব্রাহাম। নিরাবতাময় পরিবেশ। আব্রাহামের একটি গর্জন প্রতিটি মানুষকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। আব্রাহামের ভয়ংকর চেহারার দিকে একবার তাকিয়ে, চোখ নামিয়ে নিল আরোহী। হৃদস্পন্দনের ক্রিয়া দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। আব্রাহাম রাগান্বিত হয়ে বলল৷

–শেষ বারের মতো বলছি? সত্যিটা বলবে, নাকি এখানেই পুঁতে ফেলবো। আব্রাহামের কথায় ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো আরোহী। আঁখি জোড়া বন্ধ করে, একটা শ্বাস নিল। তারপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল।

–বলতে পারি একটা শর্ত আছে?

–কি শর্ত?

–সত্যিটা বলার পরে, আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। আরোহীর কথায় আব্রাহাম অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলো। আব্রাহামকে হাসতে দেখে দৃঢ় হলো আরোহী ভয়। দু-চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো।

–তোমার আর আয়াতের বিয়ের জন্য যে, সবাইকে রাজি করিয়েছিল। সে সবকিছু করেছে। এখন এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। কে রাজি করিয়েছে। তুমি তাকে ভালোভাবে না চিনলেও। খুব যে অচেনা তা নয়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে এখানে থেকে যেতে দাও। আরোহীর কথা শুনে, অবাক হলো আব্রাহাম। উনি কিভাবে এতকিছু করতে পারলো। উনাকে দেখে মনে হয় না। উনি এসব কাজ করতে পারবে। এতে উনার কি লাভ। আব্রাহামের ভাবনার মাঝেই আবরার আর সফিউল চৌধুরী আব্রাহামের রুমে প্রবেশ করে। আব্রাহাম আবরারকে তার সিক্রেট রুমের কথা বলেছিল। আবরার যে এভাবে চলে আসবে। সে ভাবতে পারে নাই। আবরার কিছু বলতে আসবে। তার আগেই আব্রাহাম উঠে চলে গেল। আব্রাহামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দু’জনেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আব্রাহাম হাসতে হাসতে বলতে লাগলো। আপনার ছেলে আর ছেলের বউকে আমার শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই চৌধুরী সাহেব। খুব তাড়াতাড়ি ছেলের আসল রূপ দেখতে পারবেন। এতদিন ছায়া হয়ে মাথার ওপরে ছিলাম। তাই বুঝতে পারেন নাই। ছেলেকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। এবার সবকিছু উপলব্ধি করতে পারবেন। খুব তাড়াতাড়ি চৌধুরী বাড়ির সবাই ধংস হতে চলেছেন। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ফুরফুরে মেজাজে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল। আজকে বড্ড নিজের কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে। এতদিন সবার কথা ভেবেছে সে। প্রতিদানে মানুষের অবহেলা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেয়েছে। এবার থেকে সবাই বুঝতে পারবে। কথায় কথায় অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, মানুষের বাজে ব্যবহার, কথার আঘাত মানুষকে কিভাবে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। চারদিকে শীতল হওয়া বইছে। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। একটু পরেই আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি নামবে। আব্রাহাম এখনো বাড়ি ফিরে নাই। আয়াতের বড্ড চিন্তা হচ্ছে, মানুষটা এখনো বাসায় আসলো না। ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে, বাসায় আসবে কি করে? একবার ফোন দিতে চাইলো। কিন্তু অভিমানের পাল্লা গুলো ভারি হয়ে উঠলো। সে তার কথা ভাবছে না। তাকে একটা বার ফোন দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। সে কেনো মানুষটার জন্য অস্থির হচ্ছে, অশান্ত মনকে বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে পারলো না। মুঠোফোনটি হাতে তুলে নিল। হসপিটালে ফোন দিয়ে জেনে, নিবে আব্রাহাম এখনো হসপিটালে আছে নাকি। আয়াতের ভাবনার মাঝে আব্রাহাম হন্তদন্ত হয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করল। আয়াত আড়চোখে মানুষটাকে পরখ করে নিল। আব্রাহাম হাতে করে, অনেক গুলো ব্যাগ নিয়ে এসেছে। ব্যাগ গুলো রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল। আয়াত সেদিকে তাকিয়ে, একটা সুপ্ত শ্বাস ছাড়লো। রুমের জানালা খোলা থাকায় বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে, জানালার পর্দা গুলো উড়ছে। অতিরিক্ত হওয়ার কারনে জানালা বারবার বাড়ি খাচ্ছে। বাড়ি পাড়ার অদ্ভুত আওয়াজে বিরক্ত হলো আয়াত। উঠে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে যেই জানালা দু’টো এক করতে যাবে। তখনই এক জোড়া শীতল হাত আয়াতকে আবদ্ধ করে ফেলল। হাত জোড়া কার বুঝতে বেগ পেতে হলো না আয়াতের। রাগান্বিত হয়ে আব্রাহামের দিকে তাকালো। আব্রাহাম আয়াতের দৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে আয়াতের গালে গভীর ভাবে অধর ছুঁইয়ে দিল। আব্রাহামের হঠাৎ স্পর্শ আয়াতের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। আব্রাহাম আয়াতের কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বলল।

–বউ আমার বড্ড অভিমানী। বউয়ের অভিমান ভাঙানোর কত প্রচেষ্টা করলাম। আমার সব প্রচেষ্টা বৃথা চলে গেল। প্রকৃতি আমার দুঃখ বুঝছে। প্রকৃতি আমাকে জানান দিচ্ছে, আব্রাহাম বউয়ের অভিমান ভাঙানোর সময় চলে এসেছে। এটাই মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগটা হাত ছাড়া করিস না। এই সুযোগটা একবার চলে গেলে, বারবার ফিরে আসবে না। আমিও ভেবে দেখলাম। স্বামী হিসেবে প্রকৃতির কথা শোনা আমার উচিৎ। তুমি চাইলে বেশী অভিমান করতে পারো। আমি বেশি আদর দিয়ে, সব অভিমান উড়িয়ে দিব। আব্রাহামের কথায় আয়াতের কান গরম হয়ে আসলো। অভিমানরা পালিয়ে, ঘিরে ধরেছে লজ্জার রেশ। আব্রাহামের থেকে ছাড়া পাবার জন্য উসখুস করছে। কিন্তু আব্রাহাম শক্ত করে আয়াতকে ধরে রেখেছে। আয়াতকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ললাটে অধর ছোঁয়াল। আয়াত নেত্রপল্লব জোড়া বন্ধ করে নিল। মানুষটার চোখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই। হৃদস্পন্দনের ক্রিয়া দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। আব্রাহাম তা বেশ করে অনুভব করতে পারছে। আব্রাহাম হুট করে আয়াতের চুলগুলো খুলে দিল৷ মুহুর্তের মধ্যেই হাওয়া এসে, আয়াতের গুলো এলোমেলো করে দিল। আব্রাহাম এক হাতে জানালা লাগিয়ে দিল। আচমকা আয়াতকে কোলে তুলে নিল। আয়াত তড়িঘড়ি করে, আব্রাহামের দিকে তাকালো। মানুষটার দৃষ্টি তার দিকে স্থীর। কেউ তার দিকে তাকিয়ে থাকলে, আয়াতের বড্ড অস্বস্তি হয়। আয়াত নিঃশব্দে দৃষ্টি নত করে নিল। আব্রাহাম আয়াতকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল। সে-ও আয়াতের পাশে উঠে বসলো।

–আয়াত চোখ বন্ধ করো। আব্রাহামের কথা শুনে আয়াত আব্রাহামের দিকে দৃষ্টিপাত করল। না চাইতেও উত্তর দিল।

–কেনো? মানুষটার কণ্ঠে কেমন জানি ঠেকলো আয়াতের কাছে। আব্রাহাম আয়াতের আরো একটু কাছে এসে বলল।

–তুমি যদি তাকিয়ে তাকিয়ে আমার আদর করা দেখতে পারো। তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত লজ্জা লতা গাছের মতো মিইয়ে গেল। আব্রাহাম কথা গুলো বলেই আয়াতের অধরে নিজের অধর ডুবিয়ে দিল। আয়াত তড়িৎ গতিতে নেত্রপল্লব জোড়া বন্ধ করে নিল। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। শরীরের শক্তি গুলো জোট বেঁধে পালিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আব্রাহাম আয়াতের থেকে সরে আসলো। আয়াত লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছে। আব্রাহামের চোখের দিকে তাকানোর সাহস টুকু পাচ্ছে না সে। মানুষটার ওপরের সমস্ত রাগ অভিমান নিমিষেই হওয়া হয়ে গিয়েছে। আব্রাহাম আয়াতের হাতের ভাজে নিজের হাত রাখলো। তারপরে আয়াতের গলদেশ মুখ ডুবিয়ে দিল। অতঃপর একটি রাত সাক্ষী হলো তাদের মধুচন্দ্রিমার।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here