প্রেম পিয়াসী পর্ব -১৫+১৬+১৭

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব___________১৫.

ইলহাম দৌড়ে বের হলো নিজের রুম থেকে। রাদ কোথায় গেলো? সিঁড়ি ধরে দ্রুত পায়ে ছুটে এলে আকস্মিক সামনে এসে দাঁড়ায় অন্তু। অন্তু সম্মুখে এসে দাঁড়াতে ইলহাম পায়ের বেগ কমাতে বাধ্য হয় এক প্রকার।

—-“কি ব্যাপার? এতো হন্যেহয়ে কোথায় ছুটছিলে? নিশ্চয়ই আমার কাছে?”

অন্তুর গা পো/ড়ানো কথায় রো/ষপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ইলহাম। অন্তু গা জ্ব/লা/নো হাসি দেয়। যা দেখে রা/গটা আরও দিগুণ হয়ে ওঠে ইলহামের। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর সাথে তর্কে গিয়ে সময় ন/ষ্ট করার মতো সময় নেই হাতে। তাকে রাদের কাছে যেতে হবে। কথাটা ভেবেও যেন আর সময় ন/ষ্ট করলো না। পূর্বের ন্যায় ফের ছুটলো। বাড়ির বাইরে এসে দেখলো রাদ তড়িঘড়ি গাড়ির দরজা খুলছে। হয়তো কোথাও যাচ্ছে। ইলহাম না দাঁড়িয়ে আবারও ছুটলো। বার কয়েক পিছু ডাকলো বটে। কিন্তু, তাকে আটকাতে পারলো না। রাদ গাড়ি ঘুরিয়ে চলল অজানা গন্তব্যে। ইলহাম নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে কেবল তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। এতো রা/গ? সামান্য কফি দিতে দেরী হওয়ায়!

—-“কি সমস্যা হ্যাঁ? তোমার সাহস দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! তুমি আমায় ইগনোর করছো? এই অন্তুকে?”

আকস্মিক হাতে হেঁচকা টান অনুভব হওয়ায় চমকে উঠলো ইলহাম। হাতে টান খেয়ে অন্তুর সাথে লেপ্টে যেতে যেতে গেলো না! তার পূর্বেই নিজেকে সামলে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো অন্তুকে। অন্তুর কথার জবাব দিতে এক মুহুর্তও বিলম্ব না করে বলে উঠলো তৎক্ষণাৎ,

—-“তোমার মতো দশটা অন্তুকেও গোনায় ধরেনা এই ইলহাম! আসছে বড় নিজেকে “আমি” বলে প্রমান করতে!”

—-“ইলহাম!! তুমি কিন্তু আমায় অপমান করছো।”

—-“আচ্ছা, তাই নাকি? তা সেই বোধ টুকু কোনোদিন ছিলো তোমার?”

—-“ইলহাম!”(মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে)

ইলহাম যেনো কোনো ভাবেই পাত্তা দিলো না অন্তুকে। যার দরুন বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে জ্ব/লতে লাগলো অন্তুর। ক্ষেপা দৃষ্টিতে এমন ভাবে তাকালো যেন, চোখের অ/গ্নি/কু/ণ্ড দিয়ে জ্বা/লিয়ে ছা/রখার করে দিবে তাকে। ইলহাম অবশ্য এসব দেখেও দেখলোনা। তার মন খারাপ হয়ে গেলো রাদের এমন করে চলে যাওয়াতে। ভীষণ খারাপ লাগছে মনেমনে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, সে হঠাৎ রাদের প্রতি এতোটা দুর্বল হলো কবে থেকে? মনে হচ্ছে কত জনম জনম ধরে তারা একসাথে থেকে আসছে। কিন্তু সেসব কি আদৌও কখনোও সম্ভব? গত তিনমাস যাবত তারা চিনে একে অপরকে।

ইলহাম আর দাঁড়িয়ে রইলো না এখানে। অন্তুকে কোনো ধরনের পাত্তা না দিয়ে মন খারাপ করেই চলে গেলো নিজের ঘরে। অপেক্ষা করতে লাগলো,রাদের ফেরার।

রাদ ফিরলো ঠিক রাত আড়াইটা নাগাদ। সেটাও স্বাভাবিক ভাবে নয়। ম/দ খেয়ে একদম নাজেহাল অবস্থায়। তাকে সঙ্গে করে দিয়ে গেলো দুটো ছেলে। ইলহাম অসহায় মুখে দেখছিলো রাদকে। সামান্য রাগ নিয়ে বের হয়ে একি দশা করে ফিরলো?

রাদকে তার রুমে নিয়ে যেতে চাইলে ইলহাম বলে তার নিজের রুমেই রাখলো। মাঝরাতে বাড়ির একটা মশা-মাছিও জেগে নেই। তাই বাসার লোক রাদের এই সব কান্ড জানতো পারেনি ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইলহাম। কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পেলে লজ্জায় মাথা কাটা যেতো রাদের মায়ের। মানুষটা কত ভালো, একদম নরম। কারোর সাথে কোনো দন্দ নেই,কোলাহল নেই। নিজেও যেমন শান্ত, তার পরিবেশটাও ওমনই শান্ত। আর কোথায় তার ছেলে এমন উগ্র মেজাজের। পাজি লোক! কখনও ভালো হবেনা।

রান্নাঘরে গিয়ে চুপিচুপি লেবুর জল নিয়ে এলো ইলহাম। এতো রাতে যদি কোনো ভাবে মাতলামো শুরু করে তবেই হলো!

—-“এখানে বসুন চুপটি করে। আমি একটা ভেজা তোয়ালে নিয়ে আসি।”

—-“সু-ই-ট হার্টটট!”

ইলহাম রাদকে বিছানায় বসালো। লেবুর জলটা ছোট্ট টি-টেবিলটার উপর রাখতে রাখতে বললো কথাটা। যখনই উঠতে যাবে তখনই এলোমেলো শব্দ জুড়লো রাদ। ইলহামের হাতটা টেনে ধরলো। ইলহাম যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো। রাদের ঘেমে-নেয়ে একাকার মুখখানার পানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অতঃপর ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাসের ইতি টেনে বলল,

—-“বলুন, শুনছি।”

—-“ভা-লোবাসিইইইই!”

গাঢ় কন্ঠে আওড়ালো রাদ। ইলহামকের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে শাসনি সুরে বলল,

—-“ভালোবাসেন না ছাই! তখন তো দিব্যি রা/গ দেখিয়ে, কফিটা ছুঁড়ে ফেলে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। আপনারা পুরুষ মানুষরা রা/গ দেখানো ছাড়া আর কি পারেন বলুন?”

রাদ ভুবন ভুলানো হাসে। ইলহামের হাতটা ধরে আরেকটু কাছে টেনে এলোমেলো শব্দে বলে,

—-“ নিঃ-স্বা-র্থ ভাবে ভালোবাসতে পারি! ভালোবেসে আঁ-ক-ড়ে ধ-র-তে পারি!”

—-“হয়েছে হয়েছে! ঢং আপনি খুব পারেন জানি আমি। এবার হাতটা ছেড়ে উপকৃত করুন আমায়। আমি ভেজা টাওয়ালটা এনে আপনার শরীর মুছিয়ে দেই।”

—-“আহহ্ ড্যা-ম! আ-ই নি-ড আ শাওয়ার!”

—-“রাত ক’টা বাজে জানেন? আসছে ‘আই নিড আ শাওয়ার'(ব্যঙ্গ করে)। চুপ করে বসুন এখানে। আমি ভেজা তোয়ালে নিয়ে আসছি।”

—-“তু-মি কো-থা-ও যাবেনা। আ-মা-র কা-ছে থা-ক-বে।”

ইলহাম সরু চোখে তাকালো। কোমরে হাত চেপের বকার সুরে বলল,

—-“নেশা করেছেন গলা ডুবিয়ে! তবুও দেখুন আমায় এক মুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতে পারছেন না!”

—-“তো-মার চেয়ে বড় নে-শা আর হয় না-কি?”

টেনে টেনে কথাটা বলে মাতাল হাসলো রাদ। ইলহাম কপাল কুঁচকে তাকালো। প্রতিত্তোরে আর কিছুই বলল না। রাদের থেকে হাত ছাড়িয়ে আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একটা তোয়ালে দরকার। ভেতরে থাকবে কিনা জানা নেই। তবুও তল্লাশি করলো। মনের সংশয় ফললো যেন। ভেতরে তেমন কিছুই পেলো না। এখন এই রাতবিরেতে কাউকে ডেকেও তুলতে পারবেনা। তবে এখন উপায় কি? রাদের কথাটা মনে পড়লো হঠাৎ,’আই নিড আ শাওয়ার’। এখন একমাত্র পথ শাওয়ার নেওয়া। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ইলহাম হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল রাদের সামনে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

—-“চলুন, শাওয়ার নিবেন।”

রাদ মাথা নীচু করে ঝিমোচ্ছিলো। ইলহামের কথায় মুখ উঁচিয়ে তাকালো। মাতাল হেসে মুখ খানা গোল করে ফ্লায়িং কিস দিয়ে বলল,

—-“উম্মাহ্, দ্যা-টস মা-ই গার্ল! আ-মি জা-ন-তা-ম তু-মি আ-মা-র কথা একদম ফে-ল-বে না।”

ইলহাম সরু চোখে তাকিয়েই ছিলো। মনে মনে বলল,

(আহা,কত কনফিডেন্স নিজের ওপর। সে তো কোনো তোয়ালে পেলাম না বলে, শাওয়ার নিতে বললাম। ডে/ভিল একটা)

রাদকে ধরে ধরে নিয়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে দরজাটা ভেজিয়ে রেখে বলল,

—-“কোনো অসুবিধা হলে তবেই ডাকবেন। আমি আপনার জামা-কাপড় নিয়ে আসি।”

এই বলে ইলহাম চলে গেলো রাদের রুমে। লাগেজ থেকে এখনও জামাকাপড় বের করেনি লাটসাহেব। অন্তুর মামা ঘুমোচ্ছেন নাক ডেকে। ভীষণ বিশ্রী শব্দ। সত্যিই তো, এমন বিদঘুটে অবস্থায় মানুষ কি করে ঘুমাবে? ইলহাম আর দাঁড়িয়ে থেকে সময় ন/ষ্ট করলো না। লাগেজ থেকে রাদের জামা-কাপড় বের করতে করতে এখখানা তোয়ালেও পেয়ে গেলো। তাই নিয়েই আবার ফিরে এলো নিজের রুমে। ওয়াশরুমের দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে গলা উঁচিয়ে বলল,

—-“এগুলো নিয়ে রাখুন ভেতরে।”

এই বলে ভেজানো দরজা ঠেলে হাতটা ভেতরে বাড়িয়ে দিলো ইলহাম। কিন্তু ততক্ষণে রাদ তার প্রাণ ধরিয়া মারিলো টান। অর্থাৎ, ইলহাম হাত বাড়িয়ে দিতেই ভেতর থেকে রাদ তার হাত ধরে হেঁচকা টানে ভেতরে নিয়ে গেলো। এমনকি ঘটনা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে, ইলহামের হাতে ধরে রাখা জামা-কাপড় সব যে যেভাবে পারলো ছিটকে পড়লো।

রাদ ইলহামকে ভেতরে নিয়েই সোজা শাওয়ারের নীচে দাঁড় করিয়ে ঠেসে ধরলো দেওয়ালে। তার চোখমুখ একরকম র/ক্তমুখো হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, রা/গে এক্ষনি ব্লা/স্ট করবে রাদ। উপর থেকে বিরামহীন ঝর্ণায় ভিজেপুরে একাকার ইলহাম। তার চোখ, নাক, মুখ, ঠোঁট চুয়ে পানি পড়ছে। আকস্মিক ঘটনায় কয়েক লহমা নিস্তব্ধতায় কেটে গেলো। ইলহামের ধ্যান ভাঙলো তখন, যখন বিরামহীন ঝর্ণার নীচে নিঃশ্বাস নেওয়া ক/ষ্ট সাধ্য হয়ে উঠলো। রাদ হয়তো আন্দাজ করলো ইলহামের অবস্থা। তাই যতটা সম্ভব হলো এগিয়ে এলো ওর কাছে। মুখের উপর রাদের উষ্ণ নিঃশ্বাসের ভারী মেলা আঁচড়ে পড়তেই চোখ তুলে তাকালো ইলহাম। রাদ দেখতে হাজার নারীর স্বপ্নের পুরুষ এককথায়। এতো মোহনীয় রূপ কোনো পুরুষ নিয়ে জন্মাতে পারে জানা ছিলো না ইলহামের। তবে সেই রূপ ইলহাম কোনোদিন একবারের জন্যও দেখেনি দৃষ্টি মেলে। সব সময়ই কেবল দুরছাই করে এসেছে তাকে। তবে এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে ইলহাম চোখ ফেরাতে পারছেনা। চোখ আঁটকে গেছে তার ভুবন মোহিনি সুন্দর মুখশ্রীতে।

—-“আ-জ আমি তো-মা-য় কিছু বলতে চাই সুই-ট-হার্ট।”

রাদের নেশা এখনও কাটেনি। ইলহাম ভেবেছিলো, হয়তো কেটে গেছে। সন্ধ্যার কথাগুলো পূণরায় মনে পড়তে আবারও রে/গে গেছে সে। যার দরুন, তার চোখ মুখ এমন লাল মনে হচ্ছে। কিন্তু না.. এমন কিছুই নয়।

—-“আ..আপনি না সবসময় এমন বাড়াবাড়ি করেন! ছাড়ুন আমায়। দেখুন, কেমন করে ভিজে গেলাম! এই রাতবিরেতে ভেজাটা কি খুব সুস্বাস্থ্যকর হবে বলুন? মোটেই হবেনা। উল্টে জ্বর এসে পড়বে। আর তা কেবল আমার একার নয়। আপনারও।”

ইলহামের প্রতিটা কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো রাদ। মুচকি হেসে ঠান্ডা বরফ হাত জোড়া হঠাৎ ঠেসে ধরলো ইলহামের গালে। ইলহাম কেঁপে উঠলো রাদের শীতল ছোঁয়ায়। ঠান্ডায় একপ্রকার জমে যাওয়ার দশা হয়েছে তার। এর মাঝে রাদের উদ্ভট কান্ড!

—-“শশ.. চুপ-টি করে শোনো আমা-য়! নয়-তো মু-খ বন্ধ করার টিপস এপ্লাই করবো!”

রাদ কি ইঙ্গিত করতে চাইলো, ঢের বুঝেছে ইলহাম। তাই সময় থাকতেই শুধরে গেলো। একদম কোনোরূপ কথা না বলে ইনোসেন্ট মেয়ের মতো চুপটি করে রইলো। রাদ ওর কান্ড দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। অতঃপর বলল,

—-“আজ থেকে একটা কথা মনে রাখবে, আমাদের সম্পর্কটা আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো নয়। আমাদের সম্পর্কে কোনো অশালীন কিংবা অপবিত্রতার ছোঁয়া নেই। আমাদের সম্পর্কটা পবিত্র। আমাদের এই সুতোয় গাঁথা সম্পর্কটা অন্য সব সম্পর্ক থেকে একদম ভিন্ন। তাই এরপর থেকে যদি কেউ কখনও তোমায় আমাদের এই সম্পর্কের ব্যাপারে কোনরূপ কটুক্তি করে তবে তুমি তাকে এই কথাগুলোই জানিয়ে দিবে। কেমন?”

ইলহামের চোখ জোড়া ছানাবড়া। রাদের কথায় সে স্পষ্ট বুঝতে পারে তখন নীচে যা যা হয়েছিলো রাদ সবটাই জানে। কেবল জানেই না, সে নিজ চোখে দেখেও এসেছে।

—-“আ্ আমি কারোর কথায় কিছু মনে করিনি!”

—-“আমি করেছি! আমার এই এখানটায় (বক্ষপিঞ্জর নির্দেশ করে) লেগেছে। উনাদের প্রত্যেকটা কথা আমার এখানটায় বি/ধ্বং/স করেছে, সুইটহার্ট। ওরা জানেনা, আমি তোমায় ঠিক কতোখানি ভালোবাসি। ওরা বুঝবেনা। কিন্তু, তুমি তো বুঝবে! বুঝোতো তুমি? তাহলে, তুমি কেন চুপ থাকবে? আ-মি মেনে নিতে পারিনা কেউ যদি তোমায় এইটুকুও ক’টু’ক্তি করে! সেখানে ওরা তো…”

ইলহামের কথা পৃষ্ঠে তড়িঘড়ি বলে ওঠে রাদ। তার কন্ঠে চাপা আ/ক্রো/শ! হয়তো মুখে প্রকাশ করছেনা। নিজেকে শান্ত রেখে বলে যাচ্ছে কথাগুলো। অথচ ভেতরটায় কি “র ক্ত ক্ষ র ণ” তা বোঝার সাধ্য কারোর নেই। স্বয়ং ইলহামেরও নয়। বলতে বলতে থেমে গেলো রাদ। ইলহাম শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। রাদ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে শাওয়ারটা বন্ধ করে দিলো। শাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইলহাম বড় বড় দম ফেললো। একবার মুখ উঁচিয়ে রাদের পানে তাকালো। মনেমনে কিছু অগোছালো বাক্য জুড়তে চেষ্টা করছে সে। তবে, তাকে বার বার ব্যর্থ হতে হচ্ছে কন্ঠনালির কাছে। তাকে বারবার আঁটকে দিচ্ছে তার গলার স্বর। কথাগুলো কেমন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। শব্দ জুড়তে গেলে উল্টে ঘেঁটে ফেলছে সব।

#চলবে♥#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
পর্ব________১৬.

—-“হা-তে কি-ছু লাগাওনি কেন?”

ইলহামের ঠান্ডা হাতটা নিজের হাতের ভাজে জড়িয়ে নিলো রাদ। অনুরাগী স্বরে বলে উঠলো কথাটা। ইলহাম রাদের তপ্ত ছোঁয়ায় খানিক ঘোরে তলিয়ে যায়। বলে,

—-“এমনি সেরে যাবে।”

ইলহামের ভাবলেশহীন গলায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় রাদ। বলল,

—-“পু ড়ে গেছে তো!”

—-“ও কিছু না। সামান্য গরম সেক লেগেছে।”

রাদ সহসা খানিকটা ঝুঁকে ইলহামের হাতের উপর গাঢ় একটা চু মু খেলো। ইলহাম কেঁপে উঠে ব্যস্তসমস্ত চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। রাদ ঝুঁকে থেকেই প্রগাঢ় দৃষ্টিতে অবলোকন করলো লজ্জায় আড়ষ্ট হওয়া তার প্রিয়দর্শিনীকে। ভয়ানক আবেদনময়ী লাগছে তাকে। ভেতরটা অস্থিরতায় দুমড়েমুচড়ে যেতে আবারও কেঁপে উঠলো ইলহাম। তবে এবারেও রাদের অদ্ভুত কর্মকাণ্ডেরই ফল। আকস্মিক তার তপ্ত ওষ্ঠদ্বয় আলতো আকারে স্পর্শ করলো ইলহামের কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়ে। ইলহাম ওড়নার পাড় খানা খামচে ধরলো হাতের ভাঁজে। রাদ হাত বাড়িয়ে কোমর ছুঁয়ে দিলো প্রিয়দর্শিনীর। প্রিয়দর্শিনী পূণরায় কেঁপে উঠল। রাদ তাকে নিজের কাছে টেনে আনলে ইলহাম তার শার্ট আঁকড়ে ধরে। প্রায় অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো।

রাদ ফ্রেশ হয়ে একটা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট আর একটা টি-শার্ট পড়ে বের হলো। ইলহাম তার ঘর থেকে এগুলোই নিয়ে এসেছিলো। মাথাটা এখনও ভনভন করে ঘুরছে। নিহার শাশুড়ী এবং রাজিয়া বেগমের কথাগুলোয় নিজের রা/গকে কোনো ভাবে ধরে রাখতে পারেনি সে। যার দরুণ তখন সব রা/গ ইলহামকে দেখিয়ে হনহন করে চলে গিয়েছিলো। অতঃপর সোজা ম দ খেতে। রাদ সর্বদাই একটু-আধটু ম দ খেতো। তবে আজ যে পরিমান পেটপুরে খেয়েছে, তা মনে পড়েনা গত কয়েক মাসে খাওয়া পড়েছে কি না?

ইলহাম লেবুর জলটা এগিয়ে দিলো তার নিকট। বলল,

—-“এটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন!”

—-“ক্ষিদে পেয়েছে!”

বাচ্চা সুলভ কন্ঠে বলল রাদ। ইলহাম ঘড়ির দিকে তাকালো। ৩টা বেজে ১০মিনিট। লেবুর জলটা রাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

—-“দশ মিনিট অপেক্ষা করুন। কিছু একটা বানিয়ে নিয়ে আসি।”

ইলহামের কথা মতো রাদ দশ মিনিট অপেক্ষা করলো। ইলহাম দশ মিনিটের মাথায় প্লেটে করে একটা পিৎজা নিয়ে হাজির হলো। পিৎজা থেকে শাঁই শাঁই ধোঁয়া উড়ছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে এক্ষনি নামানো হয়েছে চুলা থেকে। রাদ পিৎজাটা দেখে হা সূচক দৃষ্টি মেলে তাকালো ইলহামের পানে। তার ভাবখানা এমন যেন, বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা। সহসা দাঁড়িয়ে গেলো রাদ। ইলহাম পিৎজার প্লেট টা বেডের উপর রাখতেই রাদের অবাক – বিস্ময় কন্ঠখানা শ্রবণ গোচর হলো,

—-“এ্ এটা তুমি বানিয়েছো?”

ইলহামের রিয়াকশন একদমই শান্ত। বলল,

—-“হুম। কেন?”(ভ্রু নাচিয়ে)

—-“এটা পাউরুটি কেটে যে পিৎজা রেসিপি সেটাই তো!”

ইলহাম এবার একটু অবাকই হলো যেন। কপালের মাঝে বিস্ময়ের শতকুটি তীক্ষ্ণ ভাজ ফেলে বলল,

—-“হ্যাঁ, সেটাই। কেন বলুন তো? আর আপনি এতো অবাক-ই বা কেন হচ্ছেন?”

রাদের বক্ষপিঞ্জরে এক অদ্ভুত শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। ভেতরটা শীতল হয়ে যেতে রাদ ইলহামের হাত টেনে কাছে নিয়ে আসে। একপ্রকার আকুতি ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

—-“ত্ তোমার মনে আছে এই রেসিপির কথা?”

ইলহাম এবার অবাকের শীর্ষে এসে ঠেকে। কপাল কুঁচকে বলে,

—-“মানে?”

রাদ মুখে হাত চেপে শূন্যে দৃষ্টি ভাসায়। পরক্ষণেই আবার বলে,

—-“সুইটহার্ট? ত্ তোমার কি সবটা ম্ মনে পড়ে গেছে?”

ইলহামের এবার বেশ বেগ পেতে হয় রাদের কথাটা বুঝতে। সে হা করে তাকিয়ে থাকে। তার চোখমুখ ফুলেফেঁপে উঠছে বিস্ময়ে। হলো কি লোকটার? হঠাৎ কি বলে যাচ্ছে এসব?

—-“আপনি কি মনে করার কথা বলছেন? আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছিনা!”

—-“এ্ এই যে! এই রেসিপিটা তোমাকে কে শিখিয়েছিলো? ম্ মনে আছে তোমার?”

উত্তেজনায় রাদের কন্ঠ কাঁপে। কাঁপে তার হাত ও মুখ। ইলহাম একবার তাকায় বেডের উপর স্থান পাওয়া পিৎজাটার দিকে। কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে ভাবার চেষ্টা করে। তাকে এই রেসিপি কে শিখিয়েছিলো? ধ্যাৎ.. কে আর শেখাবে? সে তো ছোট থেকেই পটু এসব রান্না-বান্নায়।

—-“কে শেখাবে? আমি নিজেই তো পারতাম এসব। আরও অনেক রেসিপি পারি। আপনি তো জানেন, বাসায় আমি ছিলাম এজ আ কাজের বুয়া। মামী এবং তিন্নির একেকদিন একেকটা আবদার ছিলো। আজ এই খাবো তো কাল ঐ খাবো। তাদের আবদার মেটাতে মেটাতে আমি সব রান্নাতেই পারদর্শী হয়ে গেলাম।”

রাদ হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নাহ; সে অযথা স্বপ্ন দেখে ফেলছে তার প্রিয়দর্শিনীকে নিয়ে। এতো সহজে কি ওর সবটা মনে পড়বে? হয়তো না! সম্ভবনা নিতান্তই শূন্য। বলেছিলেন ডক্টর ওয়াহিদ আলম।

—-“কিন্তু আপনি কার কথা বলতে চাচ্ছিলেন, মানে আমাকে কে শেখাবে এসব?”

—-“ন্ না! ক্ কিছুনা।”

ইলহাম ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটতে বসেনা। সে পিৎজাটা চার ভাগ করে কেটে রাদকে পুরোটাই খেতে দেয়। সত্যি বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে তার। কেমন করে খেয়ে চলেছে। একে একে পুরোটাই শেষ করলো রাদ। খাওয়া শেষে এখন যেন শরীর ভে ঙে আসলো। আর স্বস্তি নিয়ে বসতে পারলোনা। কিছু না বলেই বিছানায় লেপ্টে পড়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো।

____________________________________________

সমস্ত ক্লান্তি কাটিয়ে রাদ ঘুম থেকে উঠলো দুপুর ঠিক ২টায়। ইলহাম রাতে অনন্যার ঘরে চলে গিয়েছিলো ঘুমানোর জন্য। নয়তো ভোরের দিকে কেউ তাদের একসাথে দেখলে আবারও হাজারটা কথা শুনতে হবে। আজ অনন্যার বিয়ের শপিং করা হবে। আত্মিয় স্বজন বেশিরভাগ এসে হাজির হয়েছে। সবাইকে সঙ্গে করেই শপিং এর উদ্দেশ্যে বের হলো ঠিক ৪টা নাগাদ। অনন্যা সারাক্ষণ ইলহামের সঙ্গে থাকছে। ইলহামের সাথে তার একটা জোড়ালো বন্ডিং দেখা যাচ্ছে। যা দৃষ্টি কটু হয়ে উঠেছে রাজিয়া বেগমের। তবে, ‘মেয়ে আর কয়দিন থাকবে’ এই ভেবে কিছু বলছেন না।

শপিং করতে করতে হাঁপিয়ে ম র ছে সবাই। ইলহাম রাদের হুকুমে দু’টো শাড়ি নিলো। আর এক’টা লেহেঙ্গা। জুয়েলারি তেমন পছন্দ হচ্ছে না বলে নিলো না। বাকি সবকিছু একদম নিখুঁত আকারে পরখ করে কিনে দিচ্ছে অনন্যাকে। অনন্যা হাসি মুখে সবই নিয়ে নিচ্ছে। সে উপরে উপরে হাসলেও ভেতরটা যে কেমন করে পু/ড়ে যাচ্ছে, সেসব যে সে ছাড়া কেউ জানেনা।

শপিংমলে হঠাৎ প্রণয়ের সাথে দেখা ইলহাম এবং অনন্যার। প্রণয়কে দেখতেই অনন্যা এক রকম বাঁধন হারা তৃষ্ণার্ত পাখির মতো ছুটে গেলো। ইলহাম অবাক নয়নে সবটাই নিরক্ষন করলো। অনন্যা করুন কন্ঠে বলতে লাগলো,

—-“আমাকে নিতে এসেছেন, প্রণয় ভাই!”

প্রণয় হঠাৎ অনন্যাকে দেখবে ভাবতে পারেনি। আকস্মিক অনন্যাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন এক তৃপ্তি এসে ছুঁয়ে গেলো মনকে। তবে আকস্মিক অনন্যার কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই নিজেকে কেমন পৃথিবীর সবচেয়ে নি কৃ ষ্ট এক পা পী বলে মনে হলো!

—-“ক্ কি হলো? কথা বলছেন না কেন?”

অনন্যার ডাকে ঘোর কাটে প্রণয়ের। নিজেকে স্থীর করার দায়ে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। অতঃপর বলে,

—-“ তুমি হঠাৎ এখানে? কার সাথে এসেছো?”

—-“সবার সাথে। বিয়ের শপিং এ!”

বিয়ের শপিং এ কথাটা শুনতেই ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠল প্রণয়ের। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বলল,

—-“ওহ। অন্তুও এসেছে? আর রাদ..”

অনন্যা ভাবলেশহীন গলায় বলল,

—-“সবাই!”

—-“কোথায় ওরা? দেখছিনা যে! আর বিয়ের শপিং এ এসে বিয়ের কনে একা একা কেন ঘুরছে?”

প্রণয় কথাটা শেষ করতে তার সামনে এসে দাঁড়ালো ইলহাম। ইলহামকে দেখতে প্রণয় মৃদু হেসে চা’পা দেয় নিজের ভেতরের আ ক্ষে প, আ র্ত না দ গুলো। বলল,

—-“আস্সালামু আলাইকুম, ভাবী।”

ইলহাম মৃদু হেসে সালামের জবাব দেয়। বলে,

—-“ভাইয়া হঠাৎ শপিং এ? কারোর জন্য গিফট নেওয়া হচ্ছে নাকি?”

ইলহাম এই কথাটা একটা ফাঁদ হিসেবে ব্যাবহার করে। সে দেখতে চায় এই কথার পিঠে কে আগে রিয়াক্ট করে অনন্যা নাকি প্রণয়!

তার ভাবনাই মিলে যায়। প্রণয়ের আগেই কেমন ম রা কন্ঠে বলে ওঠে অনন্যা,

—-“গার্লফ্রেন্ডের জন্য গিফ্ট নিচ্ছেন, প্রণয় ভাই?”

অনন্যার কথাটা হেসে উড়িয়ে দেয় প্রণয়। ইলহাম যা বোঝার বুঝে নেয়। একটু মৃদু হেসে বলে,

—-“তাহলে কার জন্য?”

—-“তেমন কিছুনা ভাবী। মায়ের কিছু দরকারী জিনিসপত্র নিতে এসেছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, রাদ কোথায়? এখানে যখন আছে একটু সাক্ষাৎ করে যাই।

—-“নিশ্চয়ই। আসুন আমার সাথে।”

________________

—-“কি ভাই? এভাবে হুট করে একদম লাপাত্তা! তারপর আর কোনো খবরই নেই?”

প্রণয়ের প্রশ্নে মলিন হাসলো রাদ। কফির মগটা হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইলহামের পানে। দুই বন্ধুকে মিলিয়ে দিয়ে সে অনন্যাকে নিয়ে পূণরায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো কেনাকাটায়। জুয়েলারির দোকানো দাঁড়িয়ে অনন্যার পছন্দের সব ডিজাইন গুলো খতিয়ে দেখছে।

—-“নিয়তি! নিয়তি আমার থেকে আরও একবার সবটা কেঁ/ড়ে নিলো রে। তাই.. নিজেকে নিয়ে বেঁ’চে থাকার ব্রত করেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, উপরওয়ালা সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওকে আবারও আমার কাছে উপহার হিসেবে পাঠালেন, তখন পূণরায় একা থাকার ব্রত উপেক্ষা করে ফিরে এলাম। আরও একবার ওকে সঙ্গে করে হোক বেঁ’চে থাকার বা ম/রে যাওয়ার আক্ষেপে ফিরে এলাম।”

প্রণয় অবোধ দৃষ্টিতে তাকালো রাদের পানে। গুণীদের মতো কপাল ভাজ করলো রাদের অগোছালো, আগাগোড়া বিহীন কথা গুলো নিজের মাঝে আয়ত্ত করার খাতিরে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারলোনা। কপাল কুঁচকে রেখেই ভাবপ্রবণ হয়ে বলল,

—-“মানে?”

রাদ হঠাৎ ঘোর থেকে বেরোলো প্রণয়ের কন্ঠ পেয়ে। তড়িঘড়ি ইলহামের থেকে দৃষ্টি লুকিয়ে তাকালো প্রণয়ের পানে। ওমনি প্রদর্শন হলো, প্রয়ণের অবোধ, অর্থাৎ কিছু বুঝতে না পারা মুখটা।

রাদ পূর্বের ন্যায় হাসলো। কফির কাপ টা উঠিয়ে আনলো ঠোঁটের আগায়। কেন যেন, চুমুক দিতে যেয়েও পারলোনা। উনিশ-বিশ ভাবতে ভাবতে একপ্রকার অসহায় কন্ঠে বলল,

—-“ইলহাম সবটা ভুলে গেছে!”

কথাটা শুনতেই মাথার উপর থেকে শা শা করে কিছু উড়ে গেলো প্রণয়ের। তার দৃষ্টি সহসা নি’থর হয়ে উঠলো। গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে আসতে ঢোক গিললো। শুঁকনো স্বরে বলল,

—-“মানে! কি বলছিস এসব?”

—-“ইয়েস, দ্যাট’স ট্রু।”

প্রণয় বুকের ভেতর একপ্রকার জ্বালা অনুভব করলো। অদ্ভুত চাহনিতে রাদকে একবার পরখ করে নিলো। মনে মনে প্রশ্ন জাগলো, “তবে,কি করে বেঁচে আছে ছেলেটা?”। জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠলো না যেন। প্রণয়ের র//ক্ত//ক্ষ/র/ণ হলো অনন্যার কথা ভেবে! সেও কি কোনোদিন মেনে পারবে তাদের এই বিচ্ছেদ? রাদ তো তবুও ভাগ্যবান। অন্তত ভালোবাসার মানুষ টা তো সঙ্গে আছে। হোক সবটা ভুলে! আছে তো? সে তো তার চেয়েও বড় হত’ভা’গা।

—-“ত্ তুই কখনো ভাবিকে কিছু মনে করানোর চেষ্টা করিস নি?”

—-“চাইলেও সম্ভব ছিলোনা। ডক্টরের কড়া নিষেধ ছিলো। ওর ব্রেনে কোনো রকম চাপ পড়লে শর্ট টাইম মেমোরি লস এর প্রবলেম লং টাইমে পরিণত হতে সময় লাগবেনা! তাই..”

—-“আচ্ছা ভাই, ভাবির কি কিচ্ছু মনে নেই? সেই তিনবছর পূর্বে তোদের বিয়ে, সংসার! কিচ্ছুনা?”

রাদের বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। একই সাথে চোখের কোন গুলো কেমন চিকচিক করে উঠলো চোরাবালির ন্যায়। মুখে বলল,

—-“না! কিচ্ছু মনে নেই। একদম কিচ্ছু না।”

—-“ড্যাম ইয়ার! ডক্টর কি বলে?”

—-“ওকে ওর স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু, আমার ভ/য় ছিলো ওর মামীকে নিয়ে। আর যা নিয়ে ভ/য় হচ্ছিলো, আখেরে সেটাই ফললো। উনি আমাকে না জানিয়ে ইলহামের অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছিলেন। তাই ইলহামকে জোর করেই নিয়ে আসি আমার কাছে। জানিস, ও এখনও পুরোটা স্বাভাবিক নয় আমার সাথে। তবে কোথাও একটা টান ও ঠিকই অনুভব করে আমার প্রতি। আর যে টানে জোর করে হলেও ও থেকে গেছে আমার সাথে।”

প্রণয় মুখখানা সরু করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বলল,

—-“তবে, ভাবির এখন কোন কথাগুলো মনে আছে? ছোট বেলার কথা?”

—-“নট সো! আমি এখনও নিশ্চিত নই ওর ঠিক কোন কথাগুলো মনে আছে। আমাদের বিয়ের আগে যেমন করে নিজের জীবন পার করতো, এই মুহুর্তে ও সেটাই করছিলো। তার মানে, হয়তো ওর চার বছর আগের কথা মনে আছে। এন্ড মিশমিশের মৃ/ত্যু/র কথাও মনে আছে ওর। তবে, ওর মায়ের মৃ/ত্যু/র কথা মনে নেই। যখন আমাদের বিয়ে হয়েছিলো, তখন ওর মিশমিশের মৃ/ত্যু/র কথা মনে ছিলোনা। কিন্তু, আন্টির মৃ/ত্যু ওর স্পষ্ট মনে ছিলো। অর্থাৎ ঐ সময়টায় ওর তার কয়েক বছর পূর্বের কথা মনে ছিলোনা। প্রত্যেক বার এমন করেই কাটে। প্রতিটা ধাপে ধাপে, স্তরে স্তরে! মাঝখান থেকে দেখ, আমি কেমন নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম!”

—-“তোর জীবনে এতকিছু ঘটে গেলো, অথচ তুই একবারও মুখ ফুটে জানাতে পারলিনা আমায়? এই নাকি বলিস আমি তোর কাছের বন্ধু!”

রাদ পূর্বের ন্যায় একাধারে দীর্ঘশ্বাস গুলো বিসর্জন দিতে থাকে। কয়েক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে এক সময় বলে,

—“জীবনের প্রতি আমার অগাধ বিতৃষ্ণা জমে গিয়েছিলো। তাই কাজের অজুহাতে গত একটা বছর ওর থেকে দূর, মায়ের থেকে দূর! সবার থেকে একটা দূরত্ব করে চলে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ডে। কাজের প্রচন্ড প্রেশারে আর মেন্টাল স্ট্রেসে পড়ে তো দেশে ফেরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অতঃপর যখন সেই তিন বছর আগের কথা গুলো থেকে থেকে আমার মেন্টাল স্ট্রেস বাড়িয়ে দিতে থাকলো, তখন আর পারলাম না নিজেকে ধরে রাখতে। উন্মাদের মতো চলে এলাম আমার দেড় বছরের ফেলে রাখা ছোট্ট সংসারটা পূণরায় সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার আক্ষেপে। কিন্তু, সময়ের কাছে আমি আবারও অসহায় হয়ে গেলাম। এক বিশাল সময় চাইলো ধরণী। ইলহামের আরও একবার সবটা মনে পড়ার সময়।”

—-“একটাবারও কি এর কিছু.. এই আংশিক কিছুও বলা যেতোনা ভাবিকে?”

—-“হয়তো যেতো! কিন্তু আমি চাইনা, আমার কারনে বেচারি আরও নতুন করে কিছু সহ্য করুক। অলরেডি, ছোট বেলা থেকে অনেক কিছু সহ্য করতে করতে বড় হয়েছে। আর কত সহ্য করবে বল?”

—-“আর তুই?”

—-“ওর ক’ষ্টগুলোর কাছে আমার ক’ষ্ট গুলো নিতান্তই তুচ্ছ রে। আমি চাই, উপরওয়ালা স ইচ্ছেতে আমার প্রাণ ভোমরাকে ফিরিয়ে দিক আমায়। আমি জোর করে কিছু পেতে চাইনা।”

—-“চিন্তা করিস না ভাই। আজ থেকে আমি আছি তোর পাশে। আমি তোকে বলছি, ভাবির খুব শীঘ্রই মনে পড়বে সবটা। তোর প্রাণ ভোমরা খুব জলদি ফিরে আসবে তোর কাছে। শুধু একটু ভরসা রাখ।”

রাদ হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে মলিন হাসলো। ফের পাশ থেকে তাকালো ইলহামের স্নিগ্ধ কোমল মুখাখানার প্রতি। কতটা মায়া জুড়ে আছে ঐ মুখে। ঠিক যেমন তিন বছর পূর্বে দেখেছিলো।

#চলবে#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_________১৭.

—-“সে কি গো, একটাও পছন্দ হচ্ছে না?”

ইলহাম মন খারাপ করে বলল। অনন্যা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকালো ইলহামের পানে। তার চেয়েও আরও দিগুণ মন খারাপ নিয়ে বলল,

—-“ভাবি, চলো না বাসায় ফিরে যাই। আমার একদমই ভালো লাগছেনা কিছু। উল্টে, শরীর খারাপ লাগছে ভীষণ।”

কথাটা উড়ে এসে প্রণয়ের কানের পর্দা ভেদ করতে থমকে যায় সে। পাশ ফিরে তড়িঘড়ি তাকায় অনন্যার ক্লান্ত মুখপানে। কি হয়েছে ওর? হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছে কেন?
____________________________________________

কাল অনন্যার মেহেন্দির অনুষ্ঠান করার কথা ভাবছেন সকলে। বিয়ের বাকি আছে দু’দিন। মেহেন্দি,হলুদ অতঃপর বিয়ে। রাজিয়া বেগমের একটাই মাত্র মেয়ে। তার বিয়েতে কোনো কমতি রাখবেন না তিনি। আর তাছাড়া, রাদকেও তো দেখাতে হবে, ওর কারীকারী টাকা পয়সা হলেও ও আগের মতোই আছে। অসহায় এবং গরীব। আর সে? আগেও বড়লোক ছিলো এখনও তাই-ই আছে।

রাদের করজোড় অনুরোধে আসতে বাধ্য হলো প্রণয়। নতুবা, অন্তুর একশটা অনুরোধকেও গায়ে মাখতো না সে। তাকে আসতে দেখে অনন্যা কয়েক মুহুর্ত ধ্যান জ্ঞান খুইয়ে একমনা হয়ে কেবল দেখে যাচ্ছিলো প্রণয়কে। তবে সেই সাধেও বাঁধা হলো তার বিয়ে। মানুষটাকে দু’মিনিট মন ভরে দেখার যে উপায় নেই।

বাড়ি ভর্তি মেহমানরা গমগম করছে। অনন্যা এসবের মাঝে সাফোকেশনে ভুগছে। অবশ্য সবার মুল কৌতুহলই হলো সে। যার দরুন দ’ম ফেলারও সুযোগ হয়ে উঠছে না। অতঃপর যখন একটু আলাদা হতে পারলো তখন যেন পালিয়ে এলো ছাঁদে। গোটা বাড়ি মরিচ বাতিতে সেজে উঠেছে। বিভিন্ন কালারের লাইটিং এ ঝলমল করছে এক প্রকার। যেই দেখছে তার মাঝেই এক অদ্ভুত আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। কিন্তু এ-সব কিছু থেকে অনন্যা পালাতে চাইছে। এই খুশিতে সে খুশি হতে পারছেনা একদমই। বরং উল্টে দ’মব/ন্ধ হয়ে ম’/রা/’র উপক্রম হচ্ছে। কি হতো? যদি তার বিয়েটা প্রণয়ের সাথেই হতো? হয়তো ভুল করেই সই! তাতে কি ধ্ব/স নামতো দুনিয়ায়? না তো; তবে কেন হলো না তার এই ছোট্ট স্বপ্ন পূরণ। কেন ঐ ঝলমল তাঁরাদের মতো তার আক্ষেপটা দূরেই অস্পষ্ট হয়ে থেকে গেলো? কেন? কার কাছে আছে এর উত্তর! কে দিবে তাকে জবাব?

—-“অনু?”

পেছন থেকে একটা অস্পষ্ট গলা পেলো অনন্যা। কিন্তু ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হলো না একদম। আগন্তুক উৎসুক হয়ে আবারও বলল,

—-“ছাঁদে কি করছো তুমি? নীচে সবাই তোমাকে খুঁজছে তো!”

অনন্যা বুঝতে পারে এটা প্রণয়। একরাশ অভিমান বক্ষপিঞ্জরে ঝেকে বসতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো ভেতরটা। আহাজারি করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো! কেঁদে কেঁদে গোটা দুনিয়াকে জানাতে ইচ্ছে হলো, ঐ একটা মানুষকে আমার করে দাও!

—-“অনু?”

একটু জোরেশোরেই ডেকে উঠলো প্রণয়। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে অনন্যার হাত ধরে নিজের দিকে ঘোরালো সে। অমনি একফালি চাঁদের আলোয় দৃশ্যমান হলো অনন্যার কান্না ভেজা অক্ষিপট। যা দেখতেই বিচলিত হয়ে পড়লো প্রণয়। অনন্যার হাত ছেড়ে এক পা এগিয়ে দুগালে হাত রাখলো। বিচলিত কন্ঠেই আওড়ালো,

—-“কাঁদছো কেন?”

অনন্যা অদ্ভুত এক দৃষ্টি মেলে তাকায় প্রণয়ের পানে। তাকিয়ে থেকেই আনমনে জবাব দেয়,

—-“নিয়তি কেন এতো নি/ষ্ঠু/র প্রণয় ভাই? এই একটা মানুষকেই তো চেয়েছিলাম। কেন পেলাম না?”

—-“ধুর পাগলি! ভালোবাসায় জয়লাভ করার চেয়ে ত্যাগে বেশি সুখ। তুমি এখনও অনেক ছোট। বড় হও। এসব কথা তখন বোঝাতে হবেনা।”

—-“তাহলে কি আমি নিজের জীবন উৎসর্গ করে আমার ভালোবাসাকে ত্যাগ করতে পারি প্রণয় ভাই?”

প্রণয়ের বুকটা ধরাক করে উঠলো। সহসা ভীত হয়ে নিজের অধিকার গুটিয়ে হাত জোড়া নামিয়ে নিলো অনন্যার গাল থেকে। মেয়েটা বারবার একই কথা কেন বলে? ও কি বুঝতে পারেনা এই কথায় তার কতোটা কষ্ট হয়?

—-“বলেন না প্রণয় ভাই? আমি কি নিজের জীবনটা উৎসর্গ করতে পারিনা?”

—-“না পারোনা।”

—-“কেন পারিনা?”

—-“পারোনা কারন, তোমার এই ছোট্ট জীবনটার সাথে কেবল তোমার একার নয়, আরও অনেক গুলো জীবন জড়িয়ে আছে, অনু। তার মধ্যে আমি একজন। যে তোমার এই টুকু ক/ষ্টও দেখতে পারেনা সচক্ষে। তোমার কিছু হলে আমি কি করে থাকবো? আমি কি করে বাঁচবো…”

—-“না, প্রণয় ভাই! আপনি জানেন না! আপনি জানেন না ঐ বাড়িতে আমি রোজ নিয়ম করে ঠিক কতবার ম’/র’/বো! রোজ! কিন্তু সে ম’/রা আপনারা কেউ দেখবেন না। বুঝবেন না!”

—-“স্বামীর ভালোবাসায় কেউ ম’/রে না, অনু!”

অনন্যা তাচ্ছিল্য করে হাসলো। সহসা উল্টো ঘুরে দূর আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আনমনে বলল,

—-“উনি স্বামী নয়, প্রণয় ভাই। উনি একজন তথাকথিত ধ’/র্ষ’/ক! যিনি বিয়ের আগেই আমার সাথে..”

অনন্যা পুরো কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার পূর্বেই হাতের ফোনটা বেজে উঠলো। অনন্যা থেমে গেলো। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা কানে তুলে পেছন মুড়ে তাকালো। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে লাউডে দিলো কলটা। ওমনি ওপাশ থেকে ভেসে এলো আলভি অর্থাৎ অনন্যার হবু স্বামীর কন্ঠটি,

—-“সরি সরি জান। ওরা শুধু ডিস্টার্ব করে। সবগুলোকে একদম ঝেটিয়ে বিদায় করেছি। এবার একদম ফ্রী। তা কোথায় যেন ছিলাম আমরা? হ্যাঁ, তোমার, কোমরে! সত্যি বলতে কি জানো? তোমার পাতলা সুন্দর কোমর টা দেখলেই আমার হার্টবিট কেন যেন খুব ফাস্ট হয়ে যায়। আর তোমার বুব…”

আলভির কথাগুলো সম্পূর্ণ শোনা ধৈর্য্য কুলাল না প্রণয়ের। রা’/গে বিক্ষি’/প্ত হয়ে অনন্যার হাত থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মা/র/লো দূরে। তৎক্ষনাৎ ফোনটা তৃ-খন্ডে বিভক্ত হলো। ফোন ভাঙার শব্দে কিছুটা কেঁপে উঠলো অনন্যা। অবাক হওয়ার চেষ্টা করে প্রণয়ের দিকে তাকালে তার মুখ দেখার আর সৌভাগ্য হলোনা। হনহন করে চলে গেলো সে। রা/গে মাথা অকেজো লাগছে প্রণয়ের। কি করে সহ্য করে এসব মেয়েটা?

_

রাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুমে ঢুকলো। ল্যাপটপে তুলে রাখা ডকুমেন্টস গুলো এখনি পাঠাতে হবে জুয়েল চৌধুরীকে। বিশাল ইন্ডাস্ট্রিসের মালিক তিনি। যার সাথেই আপাতত রাদের কোম্পানি বিষয়ক ডিল হচ্ছে। খুব শীঘ্রই একটা বড় প্রজেক্ট পেতে যাচ্ছে সে। মোটা অংকের টাকা। টাকার খেলা তো বরাবরই ছিলো। এবার যেন আকাশ ছুঁবে পালা।

ল্যাপটপটা ওপেন করে তড়িঘড়ি ফাইল ঘেঁটে ডকুমেন্টস গুলো ওপেন করলো। ডকুমেন্ট গুলো ভীষণ ইম্পরট্যান্ট। একটু হেরফের হলেই বিরাট সমস্যা এসে যাবে। তাই খুব ভেবে চিন্তে, ভালো করে পরখ করে দেখে নিলো পুরোটা। অতঃপর, আর দেরী না করে পাঠিয়ে দিলো জুয়েল চৌধুরীর মেইল বক্সে। ক্ষনকালেই বুকের উপর থেকে ভারী কোনো বস্তুর বিসর্জন হলো যেন। এবার সে নিশ্চিন্ত।

—-“আসবো?”

ল্যাপটপটা বন্ধ করলো রাদ। ঠিক তখনই দরজার পাশ থেকে ভেসে আসে অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির পরিচিত গলা। অর্থাৎ ইলহাম। রাদ ঘাড় কাত করে একবার আপাদমস্তক দেখে ইলহামকে। মেরুন রঙের একটা চুরিদার পড়ে আছে ইলহাম। লম্বা কেশ গুলো ঝুলছে হাঁটুর কাছে। অর্থাৎ বিনা বাঁধায় তারা স্বাধীনতা উপভোগ করছে। মাঝখান থেকে সিঁথি চলে গেছে। ডান পাশের চুলগুলোতে বরাবর দুটো ক্লিপ এঁটে আছে। কপালে একটা কালো টিপ। একহাত স্থান পেয়েছে দরজার কপাটে। অন্যহাত বাঁ পাশের চুলগুলোতে। যা বারবার ঠেসে দিচ্ছে কানের পাশে। ব্যস, এটুকুতেই তার মায়াবী মুখখানা অপরূপ লাগছে।

—-“সূর্য কোন দিক থেকে উঠলো বলুন তো?”

রাদ রসিয়ে রসিয়ে বলে উঠলো। ইলহাম দরজার কপাট থেকে হাত সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ওড়নার পাড় ধরে আঙ্গুল পেঁচাতে পেঁচাতে খানিক বিরক্ত ভঙ্গিতে আওড়ালো,

—-“দরকার আছে বলেই এসেছি।”

রাদ ল্যাপটপ তুলে আলমারি তে রাখতে রাখতে হাসলো ইলহামের কথা শুনে। আলমারির দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে অতঃপর এগিয়ে গেলো তার পানে। কিছু না বলে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। ইলহাম বাধ্য মেয়ের মতো তার সাথে পায়ে পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। রাদ তাকে বসিয়ে দিলো বিছানার উপর। অতঃপর, বরাবরের ন্যায় হাঁটু মুড়ে বসলো তার সামনে। ঠোঁটের কোনে এঁটে দিলো কোমল স্নিগ্ধ হাসি। কোমলত্ব স্বরে বলল,

—-“বলো, কি দরকার আছে?”

বলতে বলতে ইলহামের হাত দুটো হাতের ভাঁজে আগলে নিলো রাদ। ইলহাম অস্বস্তিতে কাঁদা কাঁদা হচ্ছে। সামান্য সন্দেহের বসে কিছু বলাটা বোধহয় ঠিক হবেনা। কিন্তু, ওদিকে যদি সত্যিই এমন কিছু ঘটে থাকে? কিংবা আজ না বললে যদি সত্যিই দেরী হয়ে যায়? তখন তো সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা! হয়তো, তার মাধ্যমেই বাঁচবে তিনটি প্রাণ?

—-“কি ভাবছো, সুইটহার্ট! এই আবার কি চাচী বা আপুর শাশুড়ী তোমাকে কিছু বলেছে?(খানিক রেগে) ওদের তো আজ আমি…”

—-“ন..না না! আ্ আমায় কেউ কিছু বলেনি। আমি নিজেই বলতে এসেছি। মানে, আ্ আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই?”

রাদ রাগ চেপে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো ইলহামের পানে। বলল,

—-“হ্যাঁ, বলো? কি হয়েছে?”

—-“আসলে.. আব.. আসলে আমি নিজেও জানিনা ঠিক কি হয়েছে! তবে, আমার যেটুকু ঠিক বলে মনে হচ্ছে আমি আপনাকে শুধু সেটুকুই বলতে চাই।”

রাদের উদ্বেগ বাড়ে। কপালের মাঝে খানিক সরু রেখার ভাজ পড়তে থাকে। জানতে চায়,

—-“বলতে এসেছো? কি কথা?”

—-“হু, আ্ আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় অনন্যা এই বিয়েতে খুশি?”

রাদ ফট করে কপাল কুঁচকে নেয়।

—-“খুশি বলতে?”

—-“ও কি নিজ থেকে এই বিয়েতে রাজি হয়েছে?”

—-“ অবভিয়াসলি! ও রাজি না থাকলে কি এই সম্মন্ধ এতোদূর আসতো? কাল ওর মেহেন্দি, পরশু হলুদ এবং তার পরের দিন বিয়ে।”

—-“না না! আপনি বুঝতে পারছেন না আমার কথা!”

ইলহাম অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। কথাটা বলতেই রাদ তার হাত জোড়া আরেকটু শক্ত করে ধরে নিজের হাতের মুঠোয়। উদগ্রীব কন্ঠে শুধায়,

—-“কি হয়েছে সুইটহার্ট? আমাকে সবটা খুলে বলো?”

—-“আ্ আমার মনে হয় অনন্যা কাউকে ভালোবাসে। আর সেই মানুষটার থেকে হঠাৎ এমন বিচ্ছেদ ও কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। আপনি ওকে ভালো করে দেখেছেন? ওর এই বিয়েতে ঠিক যতটা খুশি হওয়ার কথা তার এক ভাগও খুশি নেই ওর মাঝে। আমার মনে হয়…”

—-“হোয়াট!”

রাদ যেন চমকালো। অবাক হওয়া কন্ঠে মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলল। ইলহাম অসহায় মুখ করে মাথা নাড়ে। রাদ অবোধ স্বরে শুধালো,

—-“ইজ ইট ট্রু?”

ইলহাম উপর নীচ করে তুমুল গতিতে মাথা নাড়ে। রাদ অস্থিরতা দমাতে না পেরে দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়ায় ইলহামও। রাদের উত্তরের আশায় এক অস্থিরতা দলা পাকাচ্ছে তার ভেতরেও। রাদ ভাবপ্রবণ কন্ঠে আওড়ালো হঠাৎ,

—-“তাহলে, ওর বিয়ে কেন অন্যকারোর সঙ্গে হচ্ছে? চাচী কি জানেনা?”

ইলহাম অস্থিরতা দমাতে না পেরে সেই প্রথম দিন ছাঁদের ঘটনা থেকে শুরু করে শপিং মলের ঘটনা সবটা উগরে দিলো। খানিক অস্বস্তি হচ্ছে বটে। তবে, যখনই অনন্যার স্নিগ্ধ মুখখানা চোখে ভাসে তখন আর ইলহাম চুপ থাকতে পারেনা।

—-“কিন্তু ছেলেটা কে?”

রাদ সবটা শুনে যখন ছেলে কে জানতে চাইলো। তখন ইলহাম যেন অদৃশ্য এক আত্মবিশ্বাস পেলো। নির্দ্বিধায় বলে উঠলো,

—-“প্রণয় ভাই!”

“প্রণয় ভাই” নামটা মস্তিষ্কে দুবার প্রতিধ্বনি হতে বড়সড় একটা হোঁচট খেলো রাদ। না চাইতেও চোখ মুখ বিস্ময়ে ভরে গেলো। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলে উঠলো,

—-“হোয়াট!! প্রণয়? আমার ফ্রেন্ড প্রণয়।”

ইলহাম পূর্বের ন্যায় আত্মবিশ্বাসের সহিত মাথা নাড়ে। অর্থাৎ, হ্যাঁ। রাদকে আর কিছুই বলতে হয়না। সে যা বোঝার বুঝে যায় সবটা।

____________________________________________

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here