‘এতবড় ধেমরী মাইয়া, নিজের বাপের মান-সম্মান তো খাইছেই এহন আমগোডাও খাইতে আইছে। হুদাই তো বিয়া ভাঙে নাই। মাইয়ার দোষেই ভাঙছে। মাইনসে ভুল কিছু কয় না।’
দাদীর কথা শুনে ফুলের মুখ রাগে, অপমানে লাল হয়ে উঠলো। প্রতিবাদ করে বললো,
‘আমার বিয়ে আমি ভাঙিনি দাদী। যৌতুকের জন্য ভেঙেছে।’
ফুলের চাচী সোহলী বেগম তেতে উঠলেন,
‘দেখছেন মা দেখছেন। একটা কথা মাটিতে পরতে দেয় না। এর আগেই থাবা দিয়া ধইরা ফেলে। বিয়া ভাঙার সময় মনে নাই। এহন চটাং চটাং কথা কয়।’
সুফিয়া বিবি পান চিবোতে চিবোতে মুখ বাঁকিয়ে ব্যঙ্গ করে বললো,
‘এক্কেবারে বাপের ঢকপদ পাইছে। মায় আছিলো আমগো বাড়ির কামের ছেমরির মাইয়া। কামের ছেড়ির মাইয়া কেমন হইতে পারে? তা আমগো জানা আছে৷ আমার পোলাডারে ফুসলাইয়া বাড়িত থিকা ভাগাইছে। ওর বাপে কামের বেডির মাইয়া নিয়া ভাইগা আমগো নাক কাটছে। এহন মাইয়ারে ঘাড়ে তুইল্লা দিছে।’
মায়ের অপমান শুনে ফুলের ভীষণ রাগ হলো। নাকের পাটা ফুলে উঠলো। হাত মুঠ করে রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারলো না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘দেখো দাদী, এবার কিন্তু বেশি বেশি বলছো তুমি। আমার মা কে নিয়ে একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।আমি কিন্তু সহ্য করবো না।’
‘উহ, আইছে নবাবজাদি! কার লগে চেত দেহাছ তুই? যা সত্যি তাই কইছি।তোর নানী আছিলো এই বাড়ির কামের বেডি। তোর মা কামের বেডির মাইয়া।’
‘তো কি হয়েছে? মানুষের বাসায় ঝি এর কাজ করলে কি তারা মানুষ না?’
পানের পিক খাটের কোণায় ফেলে সুফিয়া বিবি বললেন,
‘মানুষ, অমানুষের হিসাব আমি তোর থিকা নিমু না।’
সেহেলী বেগম মনে মনে শাশুড়ীর ওপর সন্তুষ্ট হলেন। আজ ফুলকে জায়গামতো ধরেছে। প্রতিদিন কোন না কোন উছিলায় ফুলকে কথা শুনানোর ধান্দা খুঁজেন। আজ তার বদলে শাশুড়ী বলায় খুশিতে মন আটখানা। সুর টেনে বললো,
‘উচিত কথার ভাত নাই আম্মা। এগুলারে আর কি কইবেন কন? দেখতে হইবো না মায় কোনহান থিকা উইঠা আইছে। জাত-পাত দেখতে হইবো তো। আবার আমগো লগে টক্কর দিতে আহে। মা কিছু শিখাইছি নাকি?’
ফুলের ইচ্ছে করছে কড়া গলায় চাচীকে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু তা করলো না। নিজের রাগ সংবরণ করে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে ইচ্ছে করে দরজার কপাট ঠাস করে বারি দিতে ভুললো না।
‘দেখছেন আম্মা, দেখছেন। কি বেয়াদ্দব মাইয়া। মুখে মুখে তর্ক করে। কিছু কইলে এমনে তেজ দেহায়।’
‘দেখলামই তো। মা শিক্ষা দিছে নাকি যে আদবকায়দা শিখবো? আসুক আজ আনোয়ার বাড়িত। কোন মুখপুড়িরে ঘরে তুলছে আমি দেহামু।’
‘কিচ্ছু কইবো না। আপনে দেইখেন। তার লাইয়ে তো মাথায় উঠতাছে। বাস্তির(ভাতিজী) লিগা অন্তর পুইরা যায়। কিছু কইলে বিশ্বাস করে না। আর আমার ছোড পোলাডা ফুল কইতেই অজ্ঞান। আমার কথাও হুনে না।হারাদিনে আমার নামও এতোবার লয় না যতবার এই ছেমরির নাম লয়।’
‘চিন্তা করিস না বড় বউ। এই মাইয়ারে বাড়িত থোন বাইর না করলে আমার নামও সুফিয়া বিবি না।’
‘আমার ইচ্ছা করে সংসার ছাইড়া বনবাসে যাই।এই মাইয়ার লিগা বাড়িত থাকোন যাইবো না।’
সোহেলি বেগম রাগে ফুঁসতে লাগলো৷ পারলে এখুনি ফুলের চুলের মুঠি টেনে ধরে কয়েকটা ঘূর্ণি মারে। সুফিয়া বিবি চুনের কৌটা থেকে আঙুলে চুন তুলে দাঁতের আগায় বাজিয়ে চিন্তা করতে লাগলো এই মেয়েকে কি করে ছেলের কাছে কালারিং করানো যায়।
পুকুর ঘাটে চুপ করে বসে আছে ফুল। মাঝে মাঝে টলটলে পানিতে ঢিল ছুঁড়ে মারছে। সে চাইলে চাচী, দাদীর সাথে তুমুলঝগড়া করতে পারে। কিন্তু তার মা বারবার বলে দিয়েছে এই পরিবারের কারো সাথে কোন প্রকার ঝামেলা করা যাবে না।তাই বেশিরভাগ সময় চুপ করে থাকে। তবে সুযোগ পেলে কথা শুনিয়ে দেয়, ছাড় দেয় না।
‘কিরে একলা বইয়া কি করোস?’
‘কিছু না রে ময়না।’
‘আজকেও কি তোর চাচী, দাদী কথা হুনাইছে?’
‘কোনদিন বাকি রাখে বল?’
‘কিছু কস না?’
‘সুযোগ পেলে ছাড়ি না।’
‘মহিলা দুইডা আসলেই বজ্জাত।’
ময়না ফুলের সমবয়সী। পাশের বাসার কুদ্দুস চাচার মেয়ে। ফুলের একমাত্র বান্ধবী। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব।
‘তোর বাড়ির কথা মনে পরে না ফুল।’
‘হুম পরে।’
‘যাইতে মন চায় না?’
‘চাইবো না কেন?’
‘তাইলে এই বাড়ি পইরা রইছোত কেন?’
ফুল হাঁটুতে মুখ রেখে নিষ্পলক দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে ছিলো। ময়নার কথা শুনে চোখ তুলে তাকায়। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখ নামিয়ে বলে,
‘আমি খুব বাজে পরিস্থিতি শিকার সই।চাইলেও এখান থেকে যেতে পারবো না।’
আবার হাঁটুতে মুখ গুঁজে রাখে ফুল।ময়না কথা বাড়ায় না। ফুলের দৃষ্টি অনুসরণ করে দূরে তাকিয়ে থাকে।
আনোয়ার সর্দারের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। পুবপাড়ার একটা জরুরি কাজে গিয়েছিলো। চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে সারাদিন ছোটাছুটির মধ্যে থাকতে হয়। ঘরে ঢুকে গলা ছেড়ে ফুলকে ডাকে।
‘ফুল মা, ও ফুল! কই রে? এদিকে আয়। চাইরডা খাওন দে। বেশিক্ষণ বইতে পারমু না। বড় বিল পাড়ে যাইতে হইবো৷’
‘আইয়াই ঐ হতচ্ছাড়িরে ডাকাডাকি শুরু করলেন? আমরা বাকি মানুষ কি মইরা গেছি? বুঝি না ঐ ছেমরি কি জাদু করছে আপনেগো বাপ-বেটারে। বাড়িত ঢুইকাই তার নাম জপতে শুরু করেন।’
‘এইডা তুমি বুঝবা না সোহেলি। বাড়িত আইয়া ফুলরে না দেখলে আমার দিলডা শান্তি লাগে না।’
সোহেলী বেগম দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন।রাগে তার শরীর ফাটছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘হো বাপ-বেটার এহন শুধু মাথায় তুইল্লা নাচা বাকি আছে। আর কিছু বাকি রাখেন নাই।’
আনোয়ার সর্দার স্ত্রীর কথায় হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বুক ফুলিয়ে বললো,
‘আনোয়ার সর্দারের ভাতিজী ফুল। মন চাইলে মাথায়, কাঁধে, কোলে যেমনে মন চায় তেমনি উঠায় নাচমু। তোমার সমস্যা কি? এহন কও ফুল কই?
‘কই আবার থাকবো? পুকুর ঘাটে বইসা রইছে বোধহয়। আমার কি আর কাম-কাজ নেই। মাইনসের খবর নিয়া বইয়া থাকমু।’
‘তাইলে ওরে ডাইকা লাভ নাই। চালু কইরা কয়ডা ভাত দাও। খাইয়া দেরী করোন যাইবো না।’
‘কলপাড় থিকা হাত-পা ধুইয়া আহেন। আমি ভাত বাড়তেছি।’
সাড়ে নয়টার দিকে বাইক থামলো চেয়ারম্যান বাড়ির ভেতরের উঠানে৷ চাবি পকেটে ঢুকিয়ে ভেতরে আসতে নিয়ে ছোট ইটের সাথে উস্টা খেয়ে পরতে পরতে খুঁটি ধরে বাচলো। রেগে ইটের মধ্যে একটা লাথি মেরে সরিয়ে চেচিয়ে উঠলো,
‘কোন হালায় ইটটারে হেনে রাখছেরে? একটুর লিগা পইরা মাথায় ফাটলো না।’
মেজাজ খারাপ করে ভেতরে ঢুকলো। উনি হচ্ছেন আনোয়ার সর্দারের ছোট ছেলে শুভ সর্দার। নাম শুভ হলেও কাজকর্ম তার অশুভ মার্কা। মেট্রিক ফেল করে পড়াশোনা লাটে উঠিয়েছে। সারাদিন-রাত তাকে বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকান, বটগাছের নিচে, বাজারে আনাচে-কানাচে আড্ডা মারতে দেখা যায়। ভীষণ বেপরোয়া, লাজলজ্জাহীন, বেশরম, বিগড়ে যাওয়া ছেলে। তার এমন হওয়ার পিছনে একটা কারণ আছে। সেটা আমরা পরে জানবো।
চেয়ারম্যানের ছেলে বলে কেউ কিছু বলতেও পারে না। বাপের থেকে জোরজবরদস্তি, হুমকি-ধমকি দিয়ে একটা উড়জাহাজ কিনেছে।আনোয়ার সর্দার ছেলেকে কিছুতেই বাইক কিনে দিবে না।কিন্তু ছেলের হুমকি-ধমকিতে টিকতে না পেরে বাধ্য হয়েছে।সারাদিন সেই উড়োজাহাজ চালিয়ে উড়ে বেড়ায়।
ভেতরে ঢুকে শুভ গলা ফাটিয়ে চেচিয়ে উঠলো,
‘কইতরির মা!’
ফুল ধুপধাপ পায়ে এসে আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,
‘একদম কইতরির মা বলবা না শুভ ভাই।’
ভয় পাওয়ার ভান করে দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বললো,
‘ও মা গো ডরাইছি! হুটহাট কই থিকা আহোছ? খিদা লাগছে ভাত দে।’
‘সারাদিন টই টই করে ঘুরে রাতের বেলা এসে বলবে ভাত দে। তখন সামান্য দেরীটুকু সহ্য হবে না।’
‘জানোস যহন এতো কথা কস কেন?’
‘জামা-কাপড় পাল্টিয়ে আসেন। এই অবস্থায় আমি খাবার দিবো না।’
‘ঐ তোরে না কইছি আমার সামনে শুদ্ধ ভাষায় কথা কবি না। আইছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বউ।
ফুল দাঁত কটমট করে তাকিয়ে খাবার ঘরে চলে গেলো। শুভ মুচকি হেসে নিজের কামরার পথ ধরলো।
সকাল সকাল এলাকার গণ্যমাণ্য মানুষের সাথে আলোচনায় বসেছেন আনোয়ার সর্দার। বিষয়বস্তু হলো গ্রামের রাস্তা-ঘাটের উন্নতি। ফুলের আজ অনেক কাজ। চাচী, কাজের মহিলার সাথে হাতে হাতে অনেক কাজ করতে হবে। বসার ঘরে চা,বিস্কুট পাঠিয়ে এখন রুটি বেলতে বসেছে। ততক্ষণাৎ উপর কামরা থেকে শুভ গলা ফাটিয়ে চেচিয়ে বললো,
‘কইতরির মা, আমার নেভি ব্লু কালার আন্ডারওয়্যারটা দেখছোসনিরে?’
শুভ এমনভাবে জিজ্ঞেস করেছে মনে হচ্ছে তার ঐ গুরুত্বপূর্ণ বস্তুটা ফুল পরে বসে আছে। শুভর কথাগুলো কানে প্রবেশ করতেই ফুল সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফেললো। বাড়ি ভর্তি মানুষ। এর মধ্যে ছেলেটা করলো কি?
#চলবে
#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_01
#Writer_NOVA
গল্পটা আঞ্চলিক ভাষায় লিখবো। কোন শব্দ বুঝতে অসুবিধা হলে কমেন্ট করে জানিয়েন আমি বুঝিয়ে দিবো।