#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_13
#Writer_NOVA
রসুইঘরে ঝিম মেরে বসে আছে ফুল। একটু আগে অভি আসার খবরটা ঝুমুর তার কানে দিয়েছে। এই মুহুর্তে তার কি করা উচিত তা সে জানে না। তবুমনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো অভির মুখোমুখি সে কিছুতেই পরবে না। অভি তার জীবনের কোন অংশে নাই। আসলে কি নেই? মন সায় দিলো না কথাটায়। অভি হলো তার জীবনে কোণ ঠাসা হয়ে অযত্নে পরে থাকা মলিন অধ্যায়। যেখান থেকে তার এলোমেলো দিনের শুরু। পুরো অংশ জুড়ে না থাকলেও সূচনায় তো সেই আছে। যার দরুন শত কাহিনীর জন্ম। যার জন্য দ্বিধাদ্বন্দের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে।
‘কি হইছে তোমার ফুল?’
হঠাৎ কথায় চমকে উঠলো ফুল।নিজেকে সামলে উত্তর দিলো,
‘কিছু না। তুমি রুটি কয়টা বেলে দাও। আমি ততক্ষণে মুরগীর গোস্ত কষিয়ে ফেলি।’
ঝুমুর স্থির দৃষ্টিতে ফুলের মুখপানে তাকিয়ে শ্বাস ফেলে ভীতু স্বরে বললো,
‘জানো আমার না ডর করতাছে?’
‘কেন?’
‘তুমি জানো না?’
ঝুমুরের চোখ, মুখ ঠিকরে অবাকের ছটা। ফুল প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। ঝুমুর চাপা স্বরে ফিসফিস করে বললো,
‘বড় ভাই আর শুভ ভাইয়ের লগে ঝামেলা লাগাইন্না। তারা একে অপরের লগে কথা কওয়া তো দূরে থাক কেউ কারো মুখ দেহে না।’
ফুল ছোট করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘জানি।’
‘হেইবার দুই ভাই যে কি লাগোন লাগছিলো গো। একটুর লিগা খু’নাখু’নি হয় নাই। এরপর তো রাগ কইরা অভি ভাই গেলো গা।’
‘কিসের জন্য লেগেছিল?’
ফুলের প্রশ্নের উত্তর দিতে সবেই মুখ খুলেছিলো ঝুমুর। এর মধ্যে পেছনে থেকে সোহেলী বেগমের ঝাঁঝালো কণ্ঠ শোনা গেলো।
‘হারাক্ষণ গল্প কইরা বেরায়। আমার পোলাডা এত বছর পর আইছে কারো কোন হুশ আছে? একটা কাম দিয়া গেছি কোন সময়। এহনো করে নাই৷ বইয়া বইয়া গল্প করতাছে। রুটিগুলা পর্যন্ত বানায় নাই। ঐ তোরা এতক্ষণ কি করলি?’
‘আমরা কাম করতাছি চাচী। চাচারে কন না কেন রান্ধন ঘরের চাল ফুটা হইয়া গেছে। ফুটা দিয়া বৃষ্টির পানি পইরা চুলার মুখ ভিইজা রইছে। মাটির চুলা ভিজা থাকলে আগুন ধরে? আগুন ধরাইতে কত সময় লাগলো।’
ঝুমুরের কথায় ঢেঢ় অসন্তুষ্ট হলেন সোহেলী বেগম। রাগে ফুলের দিকে তাকিয়ে ঝুমুরকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
‘এহন দেহি তুইও কথা শিইখা গেছোত। এই ছেমরির লগে থাইকা এসব শিখছোত না? ছাইদানি দিয়া যহন পিডে দুইডা দিমু তহন দেখবি কেমন মজা লাগে।’
‘সবকিছু তে আমাকে টানবেন না চাচী।’
ফুলের কথায় স্পষ্ট প্রতিবাদের আভাস। সোহেলী বেগম চোখ কুচকে রাগী কিন্তু বললো,
‘আইছে জমিদারের নাতনী। কি পাকাল দেহো! আমারে হুমকি দেয়।’
‘জমিদারের নাতনি না হলেও চেয়ারম্যানের ভাতিজী আমি। কথাবার্তা সাবধানে বলাই ভালো।’
সোহেলী বেগম তেতে উঠলেন। তার ইচ্ছে করছে পাশের চেলাকাঠ তুলে ফুলের পিঠে দুম করে একটা বসিয়ে দিতে৷ কিন্তু এখন ভেজাল করা মানে রান্না তার করা। তাই নিজের ইচ্ছাকে দমন করে নিলো।
আনোয়ার সর্দার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছেন। আদরের ছেলে ফিরেছে বলে খুশিতে আত্মহারা। ইতিমধ্যে সারা গ্রামে অভি আসার খবরটা ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজেই। বৃষ্টি-বাদল না মেনে ভিজে ভিজে চলে এসেছেন।
‘কই আমার অভি কই?’
‘দাদীর ঘরে ঘুমাইতাছে।’
‘যাও গিয়া ডাকো। কতদিন ধইরা আমার বাজানডারে দেহি না। দেইখা পরাণ জুড়াই।’
‘পোলাডা একটু ঘুমাইছে নুরজাহানের বাপ। এহনই ডাকমু?’
‘তুমি অভির মা কোন কথা কইয়ো না। জলদী গিয়া পোলারে ডাকো। আমার তর সইতাছে না।’
‘আপনি তাইলে ভিজা জামা-কাপড় পাল্ডান। আমি ডাকতাছি।’
সোহেলী বেগম উপরের তলায় চলে গেলেন। আনোয়ার সর্দার খুশিতে ঘনঘন চোখের পাতা নাড়াচ্ছেন। ছেলে আসবে এই কথা সে আগের থেকে জানতেন। মাস খানিক আগেই চিঠি পাঠিয়েছিলো অভি। সেই চিঠিতে আসার কথা বলেছিলো। তবে নির্দিষ্ট কোন তারিখ উল্লেখ করে দেয়নি। হুট করে এসে এভাবে ভড়কে দিবে বলে হয়তো বলেনি। চিঠি পাওয়ার পর থেকে অপেক্ষার প্রহর গুণেছেন আনোয়ার সর্দার। অবশেষে তার অবসান ঘটলো।
মাথার চুল হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে গলা ছেড়ে ডাকলেন আনোয়ার সর্দার।
‘ফুল মা কই রে? আমারে একটা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি দিয়া যাইস।’
ফুলের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারো ডাকলেন।
‘ফুল কই তুই?’
উপরের কামরা থেকে ফুল উচ্চস্বরে জবাব দিলো।
‘আসতেছি চাচা।’
তবে সে এলো না। তার বদলে ঝুমুরকে পাঠালো। তার ভয় করছে যদি অভির সম্মুখে পরে যায়। ছোট সেই ঘটনা নিশ্চয়ই অভির মনে থাকার কথা নয়। কত বছর আগের কথা। তারপরও ফুলের মন খচখচ করছে। অভির চোখে চোখ মিলাতে পারবে না সে।
ছেলেকে দেখেই বুকে টেনে নিলো আনোয়ার সর্দার। অভি প্রথমে মন খারাপ করে থাকলেও একসময় বাবার কাঁধে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো। ছেলের কান্নায় চোখের পাতা ভিজে গেলো বাবার। শেষ পর্যন্ত মান-অভিমানের পাট চুকে গেলো।
‘কই আছিলি তুই বাপ? তোরে কত খুঁজছি। এতবড় শাস্তি দিলি আমগো? আমরা কেউ হয় না তোর। রাগ, গোস্বা করলে কি বাড়ি থিকা যাইতেগা হয়? তোর কলেজে কতবার গেছি। কেউ কইতে পারে না তুই কই আছোত। আমার বুকটা ফাইট্টা যাইতেছিলো।’
‘আমি অন্যায় করেছি আব্বা। আমাকে মাফ করে দিও। তোমাদেরকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতি পদে পদে আমি শাস্তি পেয়েছি। আসলেই কাজটা আমার ঠিক হয়নি৷ আমার কাজের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। আমাকে মাফ করে দিও।’
অভি হাত জোর করে কান্নায় ভেঙে পরলো। আনোয়ার সর্দার ছেলের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
‘তুই আমার সন্তান। তোর লগে কি আমি রাগ কইরা থাকবার পারি? তোরা শুধু আমার কঠিন রূপটা দেহোস। আমার ভালোবাসা দেহোস না?’
অভিকে আবারো জড়িয়ে ধরলেন। অভি শক্ত করে বাবাকে ধরে রাখলো। বহু দিনের অভিমান, অভিযোগ এক নিমিষেই হারিয়ে গেলো অন্য ভুবনে৷ নিজের বোকামির জন্য মনে মনে নিজেকে বেশ ধমকি-ধামকি দিলো অভি৷ কেনো ঝোকের বশে বাড়ি ছেড়েছিলো সে? এই সহজ-সরল মানুষগুলোকে কষ্ট দিলো।
দরজার আড়াল থেকে সবটা দেখে চোখ মুছলো শুভ। পুরোনো দিনগুলো ফিরে এসেছে। নিজের চোখের সামনে বাবা-মায়ের বৈষম্য দেখবে সে। কিছু সময় তার মনে হয় সে বোধহয় পালক সন্তান। যাকে খাওয়ানো, পরানো ছাড়া এই পরিবারের আর কোন দায়িত্ব নেই। কই কোনদিন তো তাকে এভাবে বুকে জড়ায়নি তার বাপ৷ হ্যাঁ, সে একটু বেপরোয়া, জেদি, রাগী, কারো কথা শুনে না। তাই বলে তার কি অধিকার নেই নিজের বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার? তাকে সবসময় সবাই দূরে ঠেলে দেয় কেনো? সে কি এক চিমটি ভালোবাসার দাবি রাখতে পারে না? বড্ড ইচ্ছে হয় প্রশ্নগুলো নিজের পরিবারকে করতে। কিন্তু কোথায় জানি বিবেকে বাঁধা দেয়। তাই চুপচাপ সব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।
চোখের পানি আলগোছে মুছে ভেতরে প্রবেশ করে শুভ। বুকের ভেতরটায় অসহ্য যন্ত্রণা করছে। মাথার ভেতরটায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। শুভকে দেখে অভি এগিয়ে এসে দুই হাত মেলে বললো,
‘কেমন আছিস শুভ?’
শুভ, অভির হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলো। রাগী গলায় অনেকটা চেচিয়ে বললো,
‘একদম ভালোমানুষি দেখাবি না। যাগো লগে ঢং করলে মাথায় তুইল্লা রাখবো তাগো কাছে যা। আমার লগে পিরিত করতে আহিস না। বাড়িতে আইছোত ভালো কতা। আমার থিকা দশ হাত দূরে থাকা তোর লিগা মঙ্গলজনক। গতবার বাঁইচা গেছোত দেইখা ভাবিস না এবারও বাইচা যাবি।’
শুভ দাড়ালো না। প্রায় দৌড়ে স্থান ত্যাগ করলো। আনোয়ার সর্দার রেগে চেচিয়ে উঠলেন,
‘দেখছোত এহনো বেয়াদবই আছে। এডারে আমি মানুষ করতে পারলাম না। অমানুষের জাতটা আমার পোলা কেমনে হইলো?’
অভি তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘থাক বাবা কথা বলো না। এতদিন পর বাড়ি এসে কোন ঝামেলা চাইছি না আমি।’
কামরায় গিয়ে শক্ত করে নিজের চুলগুলো টেনে ধরলো শুভ। চোখ দুটো রাগে, ক্ষোভে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় চোখের পুত্তলী ফেটে রক্ত গড়িয়ে পরবে। টেবিলের ওপর থাকা চিনামাটির ফুলদানিটা হাতে তুলে মেঝেতে সজোড়ে আছাড় মারলো। মনে মনে কল্পনা করলো ফুলদানি নয় যেনো অভিকে আছাড় মেরেছে সে।
‘কি হয়েছে শুভ ভাই?’
কাঠের চেয়ারটা সবেমাত্র হাতে নিয়েছিলো দেয়ালে বারি মেরে ভাঙতে। ফুলের কন্ঠ শুনে থেমে গেলো শুভ। না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো ফুল৷ হঠাৎ ঝুমুর ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে বললো শুভর রুমে যেতে। একটু আগে সে ভাঙাচোরার শব্দ পেয়েছে। শুভকে যদি কেউ থামাতে পারে সেটা একমাত্র ফুল। ফুল পূর্বের ঘটনা কিছুই জানে না। ঘুমে সে এখনো দুলছে। শুভ ফুলের দিকে অগ্নিচক্ষু করে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,
‘তুই এইহানে কি করোস?’
শুভর বাজখাঁই চিৎকারে ফুলের ঘুম এক দৌড়ে পালালো৷ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বললো,
‘কি হয়েছে তোমার?’
‘তোর জানতে হইবো না। যা হেন থিকা।’
‘আশ্চর্য, তুমি এমন ব্যবহার করছো কেন আমার সাথে?’
‘তুই আমার সামনের থিকা না গেলে তোরে আঘাত করতেও আমি দুইবার ভাবমু না। আমার মেজাজ অনেক গরম আছে ফুল৷ ভালো চাইলে নিজের ঘরে যা। আমার সামনে থাকিস না।’
শুভ যে অনেক রেগেছে তা ফুল টের পেলো আরেকবার। খুব বেশি না রাগলে শুভ ফুলের নাম ধরে ডাকে না৷ দমলো না ফুল। শেষ চেষ্টা অব্যহত রাখলো।
‘সমস্যা কি আমাকে বলো! তুমি সবকিছু আমাকে বলো। আজ কি হলো?’
‘আমার কাউরে কিছু কই না। সব আমার মনের মধ্যে দাফন দিয়া রাখি। ফুল আমারে আর রাগাইস না। এট্টু একলা থাকতে দে।’
‘কিন্তু বলবা তো….
পুরো কথা শেষ করার আগে শুভ ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে উঠলো।
‘কইতাছি না আমার সামনের থিকা যাইতে। তুই আমার কথা হুনতাছোত না কেন? কাউরে আমারে নিয়া চিন্তা করতে হইবো না। এতো আদিখ্যেতা ভাল্লাগে না আমার৷ আমি মরি, বাচি কারো কিছু আহে যায় না। তুইও আমারে নিয়া ভাবা বন্ধ কর। কেউ যহন ভাবে না তোরেও দয়া দেহাইয়া ভাবতে হইবো না।’
‘আমি কোন দয়া দেখাচ্ছি না। আমি তো শুধু জানতে চাইলাম। তুমি এমন করছো কেনো?’
‘তোরে যাইতে কইছি আমি। আর কোন কথা শুনমু না। বের হো ঘর থিকা।’
শুভ এগিয়ে এসে ফুলের বাহু শক্ত করে ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেলো৷ ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে মুখের ওপর ঠাস করে দরজা আটকে দিলো। এবার ফুলের চোখ দুটো টলমল করে উঠলো।অভিমানে মন ভারী হয়ে গেলো। শুভর এই আচরণের সাথে পরিচিত নয় সে৷ গাল বেয়ে চোখের পানি পরছে। শেষ পর্যন্ত শুভও তাকে দূরে সরিয়ে দিলো।
#চলবে