#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_18
#Writer_NOVA
‘কইতরির মা!’
রুটির ডো বানাতে বানাতে ফুল শুভর দিকে এক পলক তাকালো। এই বাড়ির মানুষ চালের রুটি একটু বেশি খায়। তাই প্রায় সময় ফুলকে সকাল, বিকেল রুটি বানাতে বসতে হয়। ঝুমুর চুলোর নিভানো জ্বাল একটা পাটখড়ির সাহায্যে ফুঁ দিয়ে পুনরায় ধরাতে ব্যস্ত।
‘কি বলবে জলদী বলে ফেলো।’
‘কিছু হইছে তোর?’
‘না, আমার আবার কি হইবো?’
‘তোরে কেমন বিষন্ন লাগতাছে।’
‘ধূর, কি বলো না বলো। আমি ঠিক আছি।’
শুভ আশ্বস্ত হতে পারলো না। আসলে ফুলের গতরাতে ঘুম হয়নি। যার দরুন চোখ দুটো ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে। সেটাও চোখ এড়ায়নি শুভর। ফুলের মন খারাপ দেখলে যে শুভর মন খারাপ হয়ে যায় তা কি জানে না ফুল? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে।
ফুলের মুখের হাসির জন্য কি না করেছে? গতবার যখন ঝুমুরের থেকে শুনলো তার মা ফুলের কাচের চুড়ি ভেঙে ফেলেছে। সেটা শুনে দেরী করেনি। ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে গঞ্জে চলে গেছে। বৃষ্টির দিন সারা গঞ্জ বন্ধ। এক বন্ধুর থেকে চুড়িওয়ালির বাড়ির ঠিকানা নিয়ে ছাতা মাথায় ফের সেই বাড়ি গেছে।সেখান থেকে চুড়ি কিনে বাসায় ফিরেছে। বৃষ্টির মধ্যে চুড়িওয়ালী তাকে দেখে ভীষণ অবাক। এমন পাগলামি কেউ করে? নিজের কথা চিন্তা না করে ফুলের মুখের হাসির কথা আগে চিন্তা করেছে। তবুও কি এই মেয়ে বুঝে না? নাকি বোঝার চেষ্টা করে না। সবাই দেখলো দুই মুঠ সামান্য কাচের চুড়ি। এই চুড়ি আনতে যে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে তা কি কেউ দেখেছে?
‘ছোট ভাই, চা দিমু আপনেরে?’
‘চা এক কাপ হইলে ভালোই হয় ঝুমুর আপা। এহন কথা হইলো আমি যেরকম চা খাই তা কি তুমি বানাইতে পারবা?’
‘পারমু না কেন?’
কপাল কুঁচকে কথাটা বলেও বিপাকে পরে গেলো ঝুমুর। যখন খেয়াল হলো কথাটা তাকে নয় ফুলকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। জিভে কামড় দিয়ে চোখ খিচে ফেললো। এরপর ভণিতা ছাড়া সোজাসাপটা উত্তর দিলো।
‘তোমার যার হাতের চা খাইতে মন চায় তারেই কও। আমারে হুনাও ক্যান?’
শুভ তীর্যক দৃষ্টিতে ফুলের দিকে তাকালো। শুভর মনে হলো ফুল কিছু নিয়ে চিন্তিত। তাই অন্য দিকে মন দিচ্ছে না। কিন্তু শুভর ধারণা ভুল করে ফুল ঝুমুরকে বলে উঠলো,
‘ঝুমুর আপা, চুলোয় চায়ের পাতিল বসাও। আমি ডো বানিয়ে চা করে দিচ্ছি।’
পানের বাটা থেকে পান সাজিয়ে শাশুড়ীর দিকে বাড়িয়ে দিলো সোহেলী বেগম। সুফিয়া বিবি পান মুখে পুরে চুনের ডিব্বা থেকে আঙুলের ডগসয় চুন নিয়ে নিলো। এগুলো আসল ঝিনুকের চুন। ছেলেকে দিয়ে বড় বাজার থেকে আনিয়েছেন। সোহলী বেগম নিজের জন্য একটা পান সাজালেন। কম জর্দা, খড়ের সংমিশ্রণে। বেশি জর্দা খেলে তার মাথা ঘুরায়। শাশুড়ী সাথে সাথে তারও পান খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠছে।
‘অভিরে লইয়া কিছু ভাবছোত বড় বউ?’
‘আপনেরা থাকতে আমি ভাবমু কেন?’
‘দেখ তো ছেমরি কি কয়! তুই মা। সবার আগে তোর উচিত ভাবা। আমরা তো আছিই।’
‘আপনে আছেন, শুভর বাপে আছে। আমার কোন চিন্তা নাই। আপনেরা যেইডা ভালো বুঝেন হেইডাই করবেন। আমার না নাই। আমার পোলা সুখে থাকলেই হইলো।’
‘এর লিগা কিছু ভাববি না? আমগো আশায় বইয়া থাকবি?’
‘আপনেরা যতদিন আছেন আমি সব চিন্তা থিকা মুক্ত থাকবার চাই। আমি জানি আপনে, শুভর বাপে আমার অভির কোন খারাপ চাইবেন না।’
বউয়ের কথায় সুফিয়া বিবি উপরে উপরে অসন্তোষ প্রকাশ করলেও ভেতরে ভীষণ খুশি হলেন। এর জন্য তো বড় বউকে তার ভালো লাগে। বউ শাশুড়ীর তোষামোদ করে চলতে পারলে কোন শাশুড়ীর বা খারাপ লাগবে। তাছাড়া বউ, শাশুড়ী দুজনের চিন্তাধারাই এক। সোহেলী প্রথম পানের চিপটি জানালা দিয়ে ফেলে উদাস মনে বললো,
‘অভির লিগা কোন চিন্তা হয় না মা। আমার যত চিন্তা আমার শুভর লিগা। কি যে করবো পোলাডায়! কারো কথা হুনে না।’
শুভর নাম শুনে কোঁৎ করে উঠলো সুফিয়া বিবি। মুখের পান দ্রুত চিবিয়ে জানালা দিয়ে চিপটি ফেললো। দ্রুত পান চিবানোর ফলে ঠোঁটের কোণা বেয়ে পানের রস গড়িয়ে পরেছে। আঁচল দিয়ে তা মুছে রুষ্ট গলায় বললো,
‘ওর কথা ছাড় তো! হইছে একেবারে বেদ্দব। কার মতো হইছে আল্লায় জানে৷ এই বংশের কোন পোলা তো এতো বেদ্দব না।’
শাশুড়ীর কথায় আজ কোন প্রতিবাদ করলো না সোহেলী বেগম। মনটা তার আষাঢ়ের আকাশের মতো ভার। ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। শুভ তো ছোট বেলায় বেয়াদব ছিলো না। ওকে বেয়াদব বানানো হয়েছে। হ্যাঁ, পরিবারের মানুষই বেয়াদব হতে বাধ্য করছে।
দুপুরের পর থেকে অভি ও তার বাবা আনোয়ার সর্দার খোশগল্পে মেতেছেন। কাজের ব্যস্ততায় ছেলেকে কাছে পেয়ে ভালো করে দুটো কথাও বলতে পারেননি। আজ সময় থাকায় তাই হাতছাড়া করেননি। বিকেল যে কখন গড়িয়েছে কেউ বলতে পারবে না। আছরের আজানের আগে আনোয়ার সর্দার গলা ছেড়ে ফুলকে ডাকলো।
‘ফুল ইট্টু এদিকে আহিস তো।’
ফুল তখন ঝুমুরের কামরায় বসে তার সাথে গল্প করছে। ঝুমুরে হাসির কৌতুক শুনে হাসতে হাসতে ঝুমুরের ওপর ঢলে পরছে। হাসির চোটে চাচার ডাক শুনতে পেলো না।
‘আব্বা, আপনি ফুলকে কেন এনেছেন?’
‘যার লিগায় আনি৷ তোর লগে বিয়া দিতে আনি নাই।’
বাপের হঠাৎ কঠিন গলা শুনে ভড়কে উঠলো অভি। মাথা নিচু করে ইতস্তত করে বললো,
‘আমি আগের কাজের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ফুলকে না দেখে তার ব্যাপারে বাজে মন্তব্য করে বিয়েটা ভেঙে আমি ঠিক করিনি।’
‘আমি সব বিষয়ে তোরে ছাড় দিলেও এই বিষয়ে দিমু না। কারণ তুই শুধু বিয়েতে মানা করোস নাই। আমার ইচ্ছায় গলা টিপা মারছোত। আমার ভাইয়ের মাথা নিচু করছোত। আমার ফুল মায়ের চোখ থিকা পানি ঝড়াইছোত। তাই পুনরায় তোর হাতে ফুলরে তুইল্লা দেওয়ার চিন্তা ভাবনা আমি কল্পনাও করি না।’
অভি আৎকে উঠলো,
‘কেনো আব্বা?’
আনোয়ার সর্দার দম টেনে বললেন,
‘কারণ তুই যদি তহন বিয়ায় রাজী হইতি তাইলে বাকি কাহিনি ঘটতো না। ফুলরে এক পোলা পছন্দ করতো। হেই পোলা ভালা না৷ তাই ফুলরে অন্যহানে বিয়া দেওয়ার চিন্তা করলো মনোয়ার। আমার নিয়ত আছিলো তোরে ফুলের লগে বিয়া দিয়া শহরে পাঠায় দিমু। তাইলে সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু তুই আমার মুখের ওপর মানা করলি। তোর ফুলের কথা সারা গ্রামে ছড়ায় গেছিলো। যহন তুই না করলি মনোয়ার আর ওর পরিবারের ওপর দোষ পরলো। সবাই কইলো ফুলের দোষ। এই দোষের থোন বাঁচতে মনোয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ফুলরে যতদ্রুত পারে বিয়া দিয়া দিবো। কিন্তু হেই জায়গায় পরলো বিপত্তি। পোলা পক্ষ বিয়ার দিন যৌতুকের লিগা বিয়া ভাইঙ্গা দিলো। যত ভেজালের গোড়ায় তুই। যার লিগা এতো কাহিনি হইলো তার হাতে ফুলরে কেমনে তুইল্লা দেই?’
আজান হতেই আনোয়ার সর্দার কপাড়ে ওজু করতে চলে গেলো। সব শুনে অভির কিঞ্চিৎ পরিমাণে দুঃখ হলেও তা গা ঝাড়া দিয়ে উড়িয়ে দিলো। এসব সে গায়ে মাখবে না। তার ফুলকপ চাই মানে চাই। যেভাবে হোক তাকে নিজের করেই ছাড়বে।
নিঝুম রাত! চারিদিক থেকে ভেসে আসছে পোকামাকড়, নিশাচর পাখিদের ডাক। স্তব্ধ পরিবেশে পিন পরলেও বোধহয় তার শব্দ শোনা যাবে। আকাশে অর্ধ চাঁদ। তাতে উজ্জ্বল জোস্না। চাঁদের মিষ্টি আলোয় চারিদিক মোহনীয় লাগছে। দক্ষিণের বাতাসে দরজার পর্দা মৃদুমন্দে দুলে উঠছে। সারা বাড়ি ঘুমের দেশে পারি জমিয়েছে। শুধু ঘুম নেই ফুলের চোখে। খাটের তোশক ওলট-পালট করতে গিয়ে দিন বিশ আগের বাবার চিঠি চোখে পরছে। পড়বে পড়বে বলে পড়া হয়ে উঠেনি। খামটা নিয়ে চেয়ারে বসে পরলো। সলতের আগুন কমিয়ে চিঠির খাম ছিড়লো। পড়তে আরম্ভ করলো,
প্রিয় আম্মাজান,
❝কেমন আছিস? আশা করি তুই তোর চাচার অধীনে ভালোই আছিস। আমরা সবাই ভালো আছি। শুধু তোর মা তোর চিন্তায় খাবারের অনীহায় ভুগছে৷ আমার ভয় হয় কোন দিন অসুখে পরে যায়। পাপড়ি, বৃন্ত প্রায় সময় মর্জি করে তোর সাথে দেখা করার। আমারও তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে হয় মা। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। কোন মুখে ঐ বাড়ির সকলের সামনে দাঁড়াই বল? থাক সেসব কথা। যে বিষয়টা জানাতে চিঠি লেখা। আমিন চলে এসেছে।❞
এতটুকু পড়ে চমকে উঠলো ফুল। অতীত এসে আবারো হানা দিলো। যার জন্য নিজের বাসা থেকে দূর, পরিবার থেকে দূর। সে আবার ফিরে এসেছে। ফুল কেঁপে উঠলো। হাত দুটো বৃদ্ধ মানুষের মতো ঠকঠক করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে হাত দিয়ে চিঠিটাও ধরে রাখতে পারবে না। দ্রুত জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নিলো। তাড়াহুড়োয় শ্বাসনালীতে পানি চলে গিয়েছিল। বেশ কয়েকবার কেশে তালু ডলে নিলো। আস্তেধীরে চেয়ারে বসলো। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলো।
❝যে বিষয়টা জানাতে চিঠি লেখা। আমিন চলে এসেছে। সেদিন বাসায় এসেছিলো। তোকে দেখতে না পেয়ে অনেক হুলস্থুল করেছে। হুমকি দিয়েছে এই মাসের মধ্যে তোকে না পেলে খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলবে৷ তার নজর থেকে তোকে আড়াল করে আমরা ভালো করিনি। তুই যেখানে থাকিস সেখান থেকে খুঁজে ওর কাছে নিয়ে যাবে। তুই তো আমিনকে চিনিস। ও এক কথার মানুষ। যেহেতু বলেছে তোকে খুঁজে নিজের কাছে নিবে তার মানে নিবেই। তোকে এতো আড়াল করে রাখার সব চেষ্টা কি ব্যর্থ হয়ে যাবে মা? আরেকটা কথা কি জানিস? তোর বিয়ে যৌতুকের জন্য ভাঙেনি। ভেঙেছে আমিনের ভয়ে। তারা চেয়েছিলো এমন একটা কান্ড ঘটাতে যাতে বিয়ে ভাঙাটা স্বাভাবিক মনে হয়। নয়তো আমিও বলি বিয়ের আগে-পরে কোন কথা হয়নি। বিয়ের দিন হঠাৎ বরপক্ষ দুই লক্ষ টাকা যৌতুক কেন চাইলো?
মা, নিজের খেয়াল রাখিস। একটু সাবধানে থাকিস। আমি জানি তুই ভাইয়ের কাছে নিরাপদ আছিস। তবুও আমার চিন্তা হয়।
ইতি তোর আব্বা
মনোয়ার সর্দার
চিঠি পড়া শেষ করে থ মেরে বসে রইলো ফুল। কি করবে সে এক্ষণ? সব বিপদ কি একসাথেই হানা দিলো। চিন্তিত মনে সারা কামড়া জুড়ে অস্থির পায়চারি শুরু করলো। হঠাৎ খেয়াল হলো দরজাটা আস্তে আস্তে ভিড়ানো হচ্ছে। মানে এতক্ষণ কেউ তাকে দরজার অপরপাশ থেকে লক্ষ্য করছিলো। তীক্ষ্ণ চোখে দরজার নিচের দিকে তাকাতেই চাঁদের আলোতে দেখলে কেউ আড়ালে সরে গেলো।
#চলবে