“সে তোমার মত সুন্দরী ছিল না। চোখে পড়ার মত রূপ তার ছিল না। তবে আমার চোখে সে সবচেয়ে সুন্দরী রমনী ছিল।”
স্বামীর মুখ থেকে অন্য নারীর সৌন্দর্যের বর্ণনা কোন নারীই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু মালিহা অবলিলায় শুনে যাচ্ছে। যেন এতে অবাক হওয়ার ছিটে ফোটাও প্রয়োজন নেই। আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ছিল বলতে? এখন কোথায় তিনি?”
জাওয়াদের মুখ বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে। পুরোনো অতীত, শুকিয়ে যাওয়া ক্ষ’ত যেন পুনরায় তা’জা হয়ে উঠছে। মলিন কন্ঠে জবাবে বলল, “সে আরও বছর তিনেক আগে রোড এক্সিডেন্টে আল্লাহর মেহমান হয়ে চলে গিয়েছে। নশ্বর দুনিয়ায় একা আমাকে ফেলে পারি জমিয়েছে পরপারে।
মালিহার খুব আফসোস হলো। দুঃখও হলো স্বামী নামক পুরুষটার প্রেয়সীর চির বিচ্ছেদে। মেয়েটা কতটা ভাগ্যবতী হলে এমন একজন মানুষ পাই। অথচ এমন স্বর্গীয় সুখ তার নিয়তিতে লেখা ছিল না। মালিহার হঠাৎই মনে হলে সে কেন এমন ভাগ্যবতী হলো না? স্বামীর ভালোবাসা সেও প্রাপ্য তবুও কেন তার ঝুলিতে ঠাই হলো না? মনের প্রশ্নের আর উত্তর পাওয়া হলো না। না কেউ জানতে পারলো রমনীর হৃদয়ের প্রশ্নের আন্দোলন। মালিহা পুনারায় আগ্রহভরা কন্ঠে জানতে চাইলো, “তারপর কি হয়েছিল?”
“তারপর আর কি ভাবঘুরে যুবক হয়ে লোকমুখে পরিচিতি পেলাম। তোমার কি ধারণা আমি আসলেই ভাবঘুরে? জীবনের প্রতি কোন মায়া নেই? টান নেই?”
“ঠিক ভাবঘুরে বলা চলে না। তবে চুপচাপ স্বভাবের। গম্ভীর, সল্পভাষী একজন মানুষ।”
“ছোট থেকেই আমি ইন্ট্রোভার্ট। চুপচাপ স্বভাবের। আচ্ছা, আজ এসব কথা থাক। তোমার কথা বলো? কেমন আছো?”
মালিহার বিষণ্ণমন হঠাৎ পুলকিত হয়ে উঠলো। খুশিতে অশ্রু গড়িয়ে কখন যে চিবুক স্পর্শ করেছে খেয়ালই করেনি।
জাওয়াদের চোখে আটকালো মালিহার অশ্রুসিক্ত নেত্রযুগল। ব্যস্ত কন্ঠে সুধালো, “কি হয়েছে ইবনাত? কাঁদছো কেন? আমার কথায় হার্ট হয়ে থাকলে আমি খুবই দুঃখিত।”
দ্রুত হস্তে গড়িয়ে পড়া অশ্রু ওড়নার আচল দিয়ে মুছে নেয়। মুখে হাসির রেখা টেনে জবাবে বলল, “কই না তো। আপনার কথায় খারাপ লাগবে কেন? আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? আসলে হয়েছে কি! বিয়ের ছমাস পেড়িয়ে যাওয়ার পরে আজ হঠাৎ আমার খোঁজ জানতে চাইলেন তাই একটু আবেগী হয়ে পড়েছিলাম।”
“আছি ভালো। তবে ইবনাত তুমি কি জানো? বড্ড ধৈর্যশীল মেয়ে তুমি! বিয়ের পর থেকে স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েও কি অবলিলায় না সংসার করে যাচ্ছো। মায়ের প্রিয় পুত্র বধুও হয়ে দেখিতেছো। তোমার কি মনে হয় না? তোমার কাছে আমি বড্ড ঋনী?”
“ধৈর্যশীল কতটুকু তা জানা নেই। তবে সবকিছুতেই আল্লাহর ওপর ভরসা করতে জানি। তাই হয়তো বিচলিত ভাবটা কম। নিয়তিকে সাদরে গ্রহন করে আপনার বাড়িতে পড়ে রয়েছি। আর রইলো কথা প্রিয় পুত্রবধু হওয়া। নিজের দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন করার চেষ্টা করি এতেই আপনার মা বেজায় খুশি। আমি মনে করি সবকিছুর আগে দায়িত্ব। দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পারলে মন তুষ্ট হয়।”
“বাহ্! তুমি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলো।”
“মোটেও না। হয়তো প্রথমবার আমার সাথে মুখোমুখি আপনার আলাপ তাই আমার অগোছালো কথায় গোছানো মনে হচ্ছে। তা কদিন থাকা হচ্ছে?
“আছি কাল সকাল পর্যন্ত। সকালে বেড়িয়ে পড়বো।”
“ওহ্।”
মালিহার ছোট্ট প্রতিত্তোর জাওয়াদের পছন্দ হয়নি। সে বেশি কিছু আশা করেছিল। হতাশ সে।
”আমি তাহলে উঠি?”
“কেন? কাজ আছে?”
“না। এমনিতেই।”
“ইবনাত! ছমাসে যে অবহেলা পেয়েছো বাকি জীবন দিয়ে তা মোচন করার সুযোগ দিবে এই অধম কে?”
“বেশ।”
সম্মতি পেয়ে মুচকি হেসে জাওয়াদ তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে প্রথমবারের মত আলিঙ্গন করেছিল। প্রিয়মতের বুকে মুখ গুজে মালিহাও সুখ খুজেঁ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যেন কতই না মধুর সে দৃশ্য।
_____________________________
এলার্মের বিকট বিশ্রী শব্দে সুন্দর সপ্নটার ইতি ঘটলো ঘুমন্ত রমনীর। পাশ ফিরতেই পুরুষালি দেহ চোখে পড়লো। বিকট আওয়াজে চিল্লিয়ে উঠলো সে।
“সমস্যা কি? এভাবে ষাঁ’ড়ের মত রাত দুপুরে এভাবে চিল্লাছো কেন?”
“চিল্লাবো না তো কি করবো? আপনি কে? এই বিছানায় কি করে এলেন?”
“তুমি কি গাধা? আমার বাড়ি আমার বিছানা আমি আসবো না?”
“কিন্তু কে আপনি?”
দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার স্বামী। চিনেছো?”
মালিহা হতভম্বের ন্যায় বসে আছে। মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। সে যে বিবাহিত এবং শশুর বাড়িতে এ কথা সে বেমালুম ভুলে বসে আছে।
“ওহ্। সরি! আমি কখন আসলেন? ঘুমের ঘোরে ঠিক পাইনি কিছুই।”
“বারোটার দিকে এসেছি। আম্মা জানেন। তা হঠাৎ এলার্ম বাজলো কেন?”
“সাহরীর সময় বেশি নেই। এখন উঠে ভাত রান্না করতে হবে তাই এলার্ম দেওেয়া। আচ্ছা আপনি ঘুমান। আমি যায়।”
“ওহ্। তা বাড়ির অন্য মেয়েগুলো কোথায়? তারা থাকতে তোমার কেন?”
“যে মেয়ের স্বামী অদৃশ্য ত্যাগ করেছে, শশুর বাড়িতে তার ঠাই হয়েছে এটাই অনেক।”
মালিহা আর বসে না। দ্রুতগতিতে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। পিছনে রেখে যায় দ্বিধান্বিত মুখশ্রীর এক যুবককে।
মাস ছয়েক আগেই স্বামী নামক অপরিচিত পুরুষটার হাত ধরে বহু আড়ম্বরের সাথে শশুর বাড়িতে তার আগমন ঘঠে মালিহা ইবনাত নামক সুন্দর রমনীর। বাসর রাতেই স্বামী নামক পুরুষটার তিক্ত বাক্যের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। সে নাকি মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে। পছন্দ নয় তাকে। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাই কোন স্ত্রীর অধিকার সে পাবে না।
যুবক কত অবলিলায় না বলেছিল কথাগুলো। অথচ যাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল তার যেন একেকটা শব্দ তরবারির আঘাতের মত যন্ত্রণার লাগছিল। মুহূর্তেই ফুটন্ত গোলাপের ন্যায় মেয়েটি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। নরম স্বভাবের মালিহা ক্রমেই পাথর মানবীতে রুপ নিচ্ছিল।
মালিহা কিচেনে চলে গিয়েছে রান্না করতে। জাওয়াদও আর ঘুমালো না। কি যেন ভেবে সেও ফ্রেশ হয়ে গুটিগুটি কদমে কিচেনে হাজির হলো।
রান্নায় ব্যস্ত মালিহা। পিছন ফিরতেই জাওয়াদকে দেখে এক দফা চমকে ওঠে সে। তবে কিছু বলে না। র্নিলিপ্ত ভঙ্গিতে রান্না চালিয়ে যাচ্ছে। যেন জাওয়াদ নামক কোন মানুষের এখানে কোন অস্তিত্ব নেই।
“আমি সাহায্য করবো?”
সাহায্যের বার্তা যেন অবাক না হয়ে পারলো না মালিহা। অবাক কন্ঠেই বলল, আপনি? ঠিক শুনছি তো?”
“হ্যাঁ আমিই। বলো কি কি করতে হবে?”
“না লাগবে না। আমি একাই ঠিক আছি। আপনি কিছু খাবেন?”
“না। তোমাকে সাহায্য করি। কি করতে হবে বলো। না শুনবো না। বলে দিলাম।”
জাওয়াদের জেদি আবদারে মালিহা তাকে রাতে রান্না করা খাবার গরম করতে দিল। সে অন্য চুলায় দুধ জ্বাল করছে।
জাওয়াদের নেত্রযুগলে র্ঘমাক্ত ক্লান্ত ঘুমঘুম মুখশ্রী ভেসে আসলো। সাদা আলোই সে মুখখানা কতই না মোহনীয় লাগছে। আগে কেন এই সুন্দর মুখশ্রীর মেয়েটিকে সে খেয়াল করেনি? কেন মরিচিকার পেছনে হাত পা ধুয়ে পড়েছিল? জবাবে কোন বার্তা আসে না। আসে শুধুই দীর্ঘশ্বাস!
সাহরীতে স্ত্রীর কাজে সাহায্য করছে স্বামী। কতই না উত্তম দৃশ্য।
শিরিন বেগম এসেছিলেন রান্নার তদারকি করতে। এসে এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হবে কখনও কি ভেবেছিলেন?
শাশুড়ির উপস্থিতে মালিহা অপরাধি মুখ করে এক কোনায় জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে। পাছে না মহিলা রাগ করেন।
মালিহার ভাবনা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন, “একি জাওয়াদ। কখন উঠলে বাবা?’
“একটু আগেই আম্মা। ভাবলাম ইবনাতকে একটু সাহায্য করি। একা একাই সবটা করছে।”
“বেশ তো। তোমার আব্বাও করতো একসময়।আচ্ছা, আমি তাহলে গেলাম। সময় হলে আসবো। আর বউমা? গাধাটাকে দিয়ে ভালো করে খাটিয়ে নাও। বুঝুক ঘরের কাজেও কষ্ট আছে।”
মালিহার যেন অবাক হওয়ার রাত। পরপর এত সুন্দর দৃশ্য তার মনকে পুনরায় আশা বাধতে বাধ্য করছে। সে কি পারেনা রমজানের এই পবিত্র মাসের ওসিলায় সুখি হতে? ভাবনার অতল সাগরে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিল। তখনই জাওয়াদের উদগ্রীব কন্ঠস্বর। বলল,
“কোন ভাবনায় আছো হ্যাঁ? দুধ যে পুড়ে যাচ্ছে সে খেয়াল রেখেছো? দেখি সরো।”
ইনশাআল্লাহ, চলবে….
#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(০১)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি( লেখনীতে)