প্রেমের পরশ পর্ব -০৬

#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ছোয়া উদাস হয়ে বসে আছে তাদের পুকুর পাড়ে। দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে দিচ্ছে তার চুলগুলো। ছোয়া অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে জাহিদের সাথে কথা বলবে। তাই আজ পুকুর পাড়ে জাহিদকে ডেকে পাঠিয়েছে। জাহিদ পুকুর পাড়ে আসতেই ছোয়াকে বলে,
‘কি দরকার তোমার? এভাবে আমাকে ডেকে পাঠালে কেন?’

ছোয়া সরাসরি বলে দেয়,
‘আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা চলছে। কিন্তু বিয়ের আগে আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।’

‘হুম বলো।’

‘বিয়ের পর কি আমি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারব?’

ছোয়ার এমন প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় জাহিদ। অতঃপর বুকে হাত গুজে বলে,
‘আমাদের পরিবারে বউরা সংসার করাকেই প্রাধান্য দেয়। আমি আমার মা-বাবার একমাত্র ছেলে। আমার মা এতদিন একা হাতে পুরো পরিবারটাকে সামলেছে। তাই আমি চাইব যে, বিয়ের পর আমার স্ত্রী আমার মাকে সাহায্য করুক। আমার সংসারের হাল ধরুক। তাই তুমি যদি ভেবে থাকো বিয়ের পর পড়াশোনা করা এলাউ করবো সেটা তোমার ভুল ধারণা।’

ছোয়ার মুখে আধার নেমে আসে। এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে। ঠিক এই কারণেই বিয়ে করতে তার অনীহা কাজ করে। কারণ আমাদের সমাজে বেশিরভাগ পরিবারই এমন। বিয়ের পর তাই অধিকাংশ মেয়ের পড়াশোনার পাট চুকে যায়। ছোয়া জাহিদকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘তাহলে আমাকে বিয়ে করার কথাও আপনি ভুলে যান। আমার বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল আমি যেন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাড়াই। আমি আমার বাবার সেই ইচ্ছাটা অবশ্যই পূরণ করব।’

জাহিদ প্রচণ্ড রেগে যায়। রাগে নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে নেয়। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের অতি আদরে বড় হয়েছে সে। আজ অব্দি তার কোন চাওয়াই অপূর্ণ থাকে নি। ছোয়াকে প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার সময় দেখতো জাহিদ। এভাবেই এক সময় তার প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। নিজের বাবাকে কথাটা জানায় জাহিদ। অতঃপর জাহিদের বাবা ছোয়ার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। ছোয়ার বাবা তখন বিয়েতে মত দিলেও তিনি কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে বলেন ছোয়ার পড়াশোনা শেষ করার জন্য। জসিম সাহেব(জাহিদের বাবা) একজন সজ্জন ব্যক্তি। তার ছোয়ার পড়াশোনাতে কোন অসুবিধা নেই। জাহিদও রাজি ছিল কিছু বছর অপেক্ষা করতে। কিন্তু এখন ছোয়ার বাবার মৃত্যুর পর ছোয়ার মা তার বিয়ে দিতে চাইছে। জাহিদ বা তার পরিবারের কেউই চায়না বিয়ের পর ছোয়া লেখাপড়া করুক। আজ ছোয়ার এভাবে বলা কথাগুলো জাহিদকে রাগিয়ে দেয়। জাহিদ ছোয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে তার হাত ধরে বলে,
‘খুব তেজ না তোমার। এই তেজ আমি বের করব। তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই তোমার হাতে।’

কথাটা বলে ছোয়াকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরে যায় জাহিদ। ছোয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

১১.
আজ সকাল থেকে ছোয়া নিজের ঘরের দরজা বন্ধ কথা বসে আছে। গতকাল জাহিদের বলা কথাগুলো শোনার পর থেকে রাগে ছোয়া নিজেকে সামলাতে পারছে না। এখন সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এই বিয়ে আটকানোর জন্য যা করার দরকার সেটাই সে করবে। তবুও কোন কিছুর বিনিময়ে জাহিদকে বিয়ে করবে না। তাই সে আজ আমরণ অনশন পালন করবে বলে ভেবেছে।

মতিয়া বেগমের কোন ভাবান্তর নেই এসব নিয়ে। তিনি দিব্যি বিয়ের সব আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছেন। দুইদিন বাদেই ছোয়ার বিয়ে হওয়ার কথা। মতিয়া বেগমের বড় ভাই মোজাম্মেল হক তার পুরো পরিবারকে নিয়ে এসেছেন। আগামীকাল আমানদেরও আসার কথা।

মোজাম্মেল হক মতিয়া বেগমকে বলেন,
‘তোর মাইয়া যহন বিয়া করতে চাচ্ছে না তহন এত জোর করছিস ক্যান? মাইয়াডারে পড়তে দে না। দ্যাখ কেমন ঘরের দরজা বন্ধ কইরা রাখছে। খাওন-দাওনও তো করে নাই শুনলাম।’

মতিয়া বেগম পান চিবোতে চিবোতে বলেন,
‘মাইয়া মাইনসের এতো ঢং দেহার সময় আমার নাই। মাইয়া মাইনসের বিয়ে দেওয়া একখান ফরজ কাজ। পড়াহুনা কইরা কোন দেশ উদ্ধার করবো? হেই তো সংসারের হালই টানতে হইবো।’

মোজাম্মেল হক গ্রামের সাধারণ কৃষক। তবুও তার চিন্তাধারা বেশ উন্নত। তাই নিজের বোনের মুখে এমন কথা শুনে তিনি আর চুপ থাকতে না পেরে বললেন,
‘যুগ এহন বদলাই গেছে। এহন মাইয়ারাও পড়াহুনা কইরা অনেক ভালো যায়গায় যায়।’

মতিয়া বেগম তেতে উঠে বললেন,
‘আমাকে এগুলা শেখোনের দরকার নাই। তোমার নিজের মাইয়াই তো পড়াহুনার নাম কইরা একটা বেডার লগে পালাইয়া গেছে। তুমি নিজে লেজকাটা শিয়াল হইছো জন্য কি আমারেও বানাতে চাইছ?’

‘সবাই কিন্তু এক হয়না। আমার মাইয়া পালাইছে জন্য ছোয়াও একই কাম করবে তেমনডা না। মেয়েটা যহন পড়তে চায় তহন,,,,’

‘ভাইয়া তুমি বিয়া খাইতে আইছ, বিয়া খায়া চইলা যাবা। এত কথা কওনের তো দরকার নাই।’

আর কিছু বললেন না মোজাম্মেল হক। নিজের বোনকে খুব ভালো করেই চেনেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই মতিয়া বেগম কাউকে পরোয়া করেন না, নিজে যা ভালো মনে করেন তাই করেন। এতদিন ছোয়ার বাবা বেচে ছিল জন্য কিছু করতে পারেন নি। এখন স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের মতো করে সবকিছু করতে চাইছেন। মাঝখান থেকে ছোয়ার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

১২.
গোটা একটা দিন পেরিয়ে গেছে, ছোয়া এখনো মুখে খাবার তোলে নি। সে যেন পণ করেছে না খেয়ে মরে যাবে তবুও বিয়েটা করবে না সে। মতিয়া বেগম অনেক রাগারাগি করেও তার মুখে খাবারের একটু দানাও তুলতে পারে নি। ছোয়া নিজের জেদে অটল আছে।

আজকে আমানরাও পুরো পরিবার সমেত গ্রামে এসেছে। আমান যখন শুনতে পেল ছোয়া কাল থেকে কিছু না খেয়ে আছে তখন সে আর চুপ থাকতে পারল না। নিজে ভাত বেড়ে নিয়ে ছোয়ার সামনে হাজির হলো। ছোয়াকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
‘শুনলাম তুই নাকি কাল কিছু খাস নি৷ দেখ এসব করে কোন লাভ হবে না। না খেয়েও আমি চার-পাচদিন বেচে থাকে। মাঝখান থেকে তোর বিয়েটাও হয়ে যাবে। তাই বলছি এসব না করে চুপচাপ খেয়ে নে।’

ছোয়ার চোখ জলে টইটম্বুর ছিল। সে বলে,
‘আপনি এখান থেকে চলে যান আমান ভাইয়া। আমি কিচ্ছু খাবো না।’

আমান এবার বেশ রাগী গলায় বলে,
‘এত জেদ দেখাস না তো। আমি এসেছি কিসের জন্য? তোকে এসব অনশন আর করতে হবে না। আমি তোকে প্রমিজ করছি তোর বিয়ে আমি হতে দেবো না।’

‘সত্যি বলছেন তো আমান ভাইয়া?’

‘তোকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে যাব কেন? আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। আমার উপর শুধু একটু বিশ্বাস রাখ। তাহলে দেখবি তোকে আর বিয়েটা করতে হবে না। প্রয়োজনে তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব। আর পালানোর জন্য কিন্তু শরীরে এনার্জির দরকার। এভাবে না খেয়ে থাকলে তো পালাতে পারবি না। তাই খেয়ে নে।’

আমানের কথা শুনে ভরসা খুজে পেল ছোয়া৷ অতঃপর খাওয়া শুরু করল। আমান স্বস্তির শ্বাস নিল। কিন্তু এখন তার মনে অন্য চিন্তা। বড় মুখ করে ছোয়াকে কথা তো দিয়ে ফেলল যে তার বিয়ে হতে দেবে না কিন্তু এই বিয়েটা আটকাবে তো কিভাবে আটকাবে। আমানের এসব ভাবনার মধ্যেই ছোয়া বলে উঠল,
‘ব্যাস হয়ে গেছে আর খেতে পারব না।’

আমান ধমক দিয়ে বলে,
‘কাল থেকে না খেয়ে আছিস আর এটুকু খেয়ে বলছিস আর খাবি না। চুপচাপ খেয়ে নে নাহলে কিন্তু আমি তোকে কোন সাহায্য করব না।’

ছোয়া মাথা চুলকে বলে,
‘আসলে আমি না খেয়ে নেই। কাল সারারাত ঘরের মধ্যে যত বিস্কুট, চানাচুর, মুড়ি আছে সব খেয়ে নিয়েছি। না খেয়ে কি থাকা যায় নাকি। অনশন তো শুধু ভাতের উপর।’

ছোয়ার কথা শুনে আমানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে ঠাট্টা করে বলে,
‘বাহ্ অসাধারণ। এত সুন্দর অনশন পালন করার জন্য তোকে তো নোবেল দেওয়া উচিৎ।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here