প্রেমের পরশ পর্ব -০৫

#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ছোয়া নিজেদের বাড়ির আঙিনায় বসে আছে। ভীষণ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। একটু আগেই শাহাদ হোসেনের জানাজা হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কবরস্থানের উদ্দ্যেশ্যে। হার্ট অ্যাটাক নামক বন্যা আক্রান্ত হয়ে সবাইকে ত্যাগ করে চলে গেলেন তিনি।

বাড়িতে এখন আছে বলতে ছোয়ার মা মতিয়া বেগম, আলিয়া এবং জান্নাতুল খাতুন। এছাড়াও কিছু পাড়া প্রতিবেশী মহিলা ও আত্মীয় স্বজন আছে। সবাই হা হুতাশ করছে ছোয়া এবং তার মায়ের জন্য। কেননা, তাদের পরিবারে ছোয়ার বাবাই একমাত্র উপার্জন ক্ষম ব্যক্তি ছিল। মতিয়া বেগম আহাজারি করে চলেছেন। অন্যদিকে ছোয়া তখনো নিশ্চুপ ছিল। ছোয়াকে এভাবে নিশ্চুপ থাকতে দেখে জান্নাতুল খাতুন এসে তার কাধে হাত রাখে।

ছোয়া এক পলক তার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয়। জান্নাতুল খাতুন ছোয়াকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
‘চুপ করে থেকো না ছোয়া। এতে মন আরো বেশি ভারাক্রান্ত হবে। নিজের কান্নাগুলোকে লুকিয়ে রাখলে বুকে অনেক বেশি কষ্ট জমা হতে থাকবে। তাই তুমি কাদো, কেদে নিজের মনটাকে হালকা করার চেষ্টা করো।’

জান্নাতুল খাতুনের কথা শুনে ছোয়া আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। সে কাদতে শুরু করে দেয়। জান্নাতুল খাতুন ছোয়াকে নিজের বুকে আগলে নেয়।

আমান সহ বাকিরা সবাই শাহাদ হোসেনের দাফন কাজ সম্পন্ন করে ফিরে এসেছে। বাড়িতে এসেই আমান ছোয়াকে কাদতে দেখতে পায়। যা তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে দেখা দেয়। আমানের ইচ্ছা করছিল ছোয়ার কাছে যেতে। তার মাথায় হাত রেখে ছোয়াকে ভরসা দেওয়া যে,
‘কাদিস না তুই। আমি আসি তোর পাশে।’

কিন্তু ইচ্ছা থাকার পরেও সেটা করতে পারল না আমান। কেবল দাড়িয়ে দেখতে লাগল ছোয়াকে।

৯.
ছোয়ার বাবার মৃত্যুর পর তাদের পরিবার কিভাবে চলবে সেই নিয়ে অনেক সংশয় দেখা দেয়। আব্দুল হোসেন ছোয়া এবং তার মায়ের দায়িত্ব নিতে চায়। কিন্তু মতিয়া বেগম অশিক্ষিত হলেও তার আত্মসম্মানবোধও ছিল নিজের স্বামীর মতো প্রখর। তাই তিনি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন,
‘আমাগো নিয়া আপনাগো ভাবতে হইবো না। ছোয়ার বাবার জমানো টাকা দিয়াই চলতে পারবো। তাছাড়া দোকান ঘরডাও আছে, সেটা ভাড়া দিলেই আমাদের চলে যাবে।’

আব্দুল হোসেন তখন বলেন,
‘কিন্তু ছোয়ার পড়াশোনার কি হবে? সেইজন্য তো টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে।’

মতিয়া বেগম বলে দেন,
‘আমার মাইয়ার আর পড়ালেহা করা লাগবো না। মেলা পড়ালেহা করে লইছে। এহন আমি চাই হের বিয়া দিতে। গেরামের চেয়ারম্যানের পোলা জাহিদের সাথে ওর বিয়া দিবো। আমার দায়িত্ব শ্যাষ।’

ছোয়াও উপস্থিত ছিল সেইখানে। নিজের মায়ের কথা শুনে তার বুক কেপে ওঠে। ছোয়া যে তার বাবাকে কথা দিয়েছিল সে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাড়াবে। তার বাবার শেষ ইচ্ছাটা যে তাকে পূরণ করতেই হবে। ছোয়া চাইলো সবার সামনে কিছু বলতে কিন্তু পরে ভাবল এখন কিছু বলে লাভ নেই। তার চেয়ে ভালো হবে পরে নিজের মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবে।

বৈঠকের ইতি ঘটে।রাগে আমানের চোখ লাল হয়ে গেছিল। ছোয়ার বিয়ের কথাটা শোনার পর থেকেই তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। নিজেকে কোনভাবেই সামলাতে পারছিল না আমান। তাই নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাড়ির বাইরে চলে আসে। বাড়ির পাশের বাগানে এসে নিকোটিনের কালো ধোয়া গ্রহণ করতে থাকে। নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় লাগছিল তার। ছোয়ার বিয়ে অন্য কারো সাথে কিছুতেই হতে দেবে না আমান। তাই সে ভাবছিল, কি করে এই বিয়েটা আটকাবে।

৪ দিন পর,
ছোয়া নিজের মায়ের ঘরের বাইরে দাড়িয়ে আছে। মতিয়া বেগম পান চিবোচ্ছিলেন। ছোয়াকে দেখে বলেন,
‘কিছু কি কইবি? আয় ভেতরে আয়।’

ছোয়া গুটি গুটি যায় ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। অতঃপর অনেক সাহস করে নিজের মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আমি বিয়ে করতে চাই না আম্মু। আমি পড়তে চাই, কারণ এটাই আব্বুর ইচ্ছা ছিল। আব্বু চাইত,,,’

ছোয়ার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই মতিয়া বেগম রাগী গলায় বলে ওঠেন,
‘চুপ একদম চুপ। নিজের বাপের কথা কইয়ে তুই আমারে মানাতে পারবি না। আমি যহন ঠিক করছি তোর বিয়া দিমু, তখন দিমু। চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা হয়ে গেছে। আগামী হপ্তাতেই তেনারা আসবেন। আকদ পড়িয়ে তোকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।’

ছোয়া প্রতিবাদী কন্ঠে বলে ওঠে,
‘এমন কেন করছ তুমি আম্মু? আমার আর আব্বুর ইচ্ছার কি কোন দাম নেই তোমার কাছে?’

সহসাই রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ছোয়ার গালে থা’প্পর বসিয়ে দিলেন মতিয়া বেগম। অতঃপর কন্ঠে কিছুটা নমনীয়তা এনে বললেন,
‘তুই বোঝার চেষ্টা করছিস না ক্যান? এইডা একটা গেরাম। এইহানে মাইয়াগো বেশি পড়ালেহা কেউ ভালো চোখে দেহে না। তাছাড়া পড়ালেহা করতে কত টাকা লাগে, তুই আমার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা কর ছোয়া। আমার এহন তুই ছাড়া কেউ নেই৷ তুই আমার দায়িত্ব, তোর বাপ তো তোকে আমার দায়িত্বে রেখে চলে গেল। এহন তোরে যদি আমি একটা ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিতে না পারি তাইলে যে মরেও শান্তি পাবো না।’

ছোয়া বুঝতে পারে তার মায়ের চিন্তাটা ভুল না। কিন্তু ছোয়াও যে তার বাবাকে কথা দিয়েছিল কোন পরিস্থিতিতেই সে পড়াশোনা ছাড়বে না। এখন কি করা উচিৎ ছোয়ার? এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও খুজে পাচ্ছিল না।

১০.
ছোয়া আর কোন উপায় না পেয়ে আব্দুল হোসেনকে কল করে। আব্দুল হোসেন সবেমাত্র নিজের অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন। ছোয়া কল করেছে দেখে বেশ অবাক হলেন তিনি। তাদের আবার নতুন কোন বিপদ হলো কিনা ভাবছে।

তাই ব্যস্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করেই বললেন,
‘হ্যালো ছোয়া! সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?’

ছোয়া কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে,
‘কিছু ঠিক নেই বড় আব্বু। আম্মু আগামী সপ্তাহেই আমার বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাইনা, আমি পড়তে চাই। নিজের পায়ে দাড়িয়ে আব্বুর শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে চাই। জানো আব্বু যেদিন মারা গিয়েছিল সেদিন আমাকে কল করেছিল, আমাকে বলেছিল, আমি যেন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাড়াই। আমি চাই আব্বুকে দেওয়া নিজের কথা রাখতে। তুমি প্লিজ আম্মুকে বোঝাও।’

আব্দুল হোসেন অপারগতা প্রকাশ করে বললেন,
‘আমি কি করতে পারি বল! তোর আম্মুই তো এখন তোর অভিভাবক। তার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তো আমি আর কিছু করতে পারব না। কিন্তু তুই যখন বলছিস, তাহলে আমি একবার তোর আম্মুর সাথে কথা বলে দেখব। দেখি কিছু করতে পারি কিনা।’

ছোয়া কল কে’টে দেয়। এখন বড় আব্বুই তার শেষ ভরসা।


আব্দুল হোসেন ছোয়ার কথামতো মতিয়া বেগমের সাথে কথা বলেন। কিন্তু মতিয়া বেগম একরোখা। তিনি আব্দুল হোসেনের মুখের উপরেই বলে দিলেন, তিনি যা ভেবেছেন তাই করবেন। অগত্যা আব্দুল হোসেনও আর কথা বাড়াতে পারলেন না।

আমান বাড়িতে এসে নিজের বাবাকে মন খারাপ করে সোফায় বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে,
‘কি হয়েছে আব্বু? তোমাকে এমন লাগছে কেন?’

আব্দুল হোসেন হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
‘ছোয়া মেয়েটা ফোন করে আমাকে কত অনুরোধ করে বলল, ও বিয়ে করতে চায়না পড়তে চায়। আমিও ওর কথা ভেবে ওর মাকে কল করে বললাম ওর বিয়ে না দিতে কিন্তু কিছু করতে পারলাম না মেয়েটার জন্য।’

আমান হাতের মুঠো শক্ত করে নিয়ে বলে,
‘ছোট চাচি এই কাজটা একদম ঠিক করছে না। ছোয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বিয়ে দিতে চাইছে। এটা ঠিক নয়। ছোয়া প্রাপ্তবয়স্ক ওর মতামতের একটা দাম আছে। তোমরা যদি ছোয়ার জন্য কিছু করতে না পারো তো কোন ব্যাপার না। আমি আছি ছোয়ার পাশে। আমি ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুতেই এই বিয়েটা হতে দেবো না।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨✨

>>আসসালামু ওয়ালাইকুম। আমি আগামীকাল একটু বাইরে যাব। যার কারণে গল্পটা কাল দিতে পারবো না। আগে থেকেই জানিয়ে রাখলাম। সকলকে গঠনমূলক মন্তব্য করার অনুরোধ রইল। জাযাকাল্লাহ খাইরান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here