#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
শরীরে হাত রাখা যাচ্ছে না প্রচন্ড তাপমাত্রায়। থার্মোমিটারে শরীরের তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি ছাড়িয়ে ১০৪ এ থেমেছে। ঘন্টা দুয়েক না যেতেই আবারও তীব্র জ্বরে বেঘোরে পড়ে আছেন তরীর মা। কাঁপুনির সাথে দাঁতে দাঁত ঠকঠক শব্দে বারি খাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কেমন কষ্ট হচ্ছে। যেন ভীষণ কষ্ট করে এক একটা শ্বাস নিচ্ছেন। বাবার ডাক পেতেই ছুটে এলো তরী। অস্বাভাবিক জ্বরে শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে বারবার। এবারে তরী ঠিক তেমনটাই করল, যেমনটা অরু করেছিল। কাঁথা, কম্বলেও যখন কম্পন কমছিলনা, তখন মাকে ঝাপটে ধরে রইলো দু-হাতে। রাত অনেক হয়েছে। এদিকে মায়ের অবস্থা বেগতিক দেখে তরী বলল,
-“বাবা, মাকে হাসপাতালে নিয়ে চল।”
তরীর বাবার এই মুহুর্তে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেলো। মেয়ের কথায় সংবিৎ ফিরতেই স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সাথে তরীও যাচ্ছে। মাঝে তরী মিঠুকে জাগিয়ে তার রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। অরুর খেয়াল রাখতে বলে গিয়েছে৷ মিঠুর মনটাও কেমন ছোট্ট হয়ে আছে। একটু আগেই চোখের পাতায় ঘুমেরা ভীড় জমিয়েছে। এখন দুশ্চিন্তায় সেই ঘুমের রেশ বহু বহু মাইল দূরে গিয়ে ঠেকেছে।
গাড়ির জন্য কিছুক্ষণ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। অতঃপর হাসপাতালে এসে উপস্থিত হলো তারা। মাকে ভর্তি করানো হলো।
বাবা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। শক্ত-সামর্থ্য চেহারার মাঝে কী যেন এক করুণ ছাপ দেখা দিল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। তরী বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়ের অসুস্থতায় এই মানুষটা এমন ভেঙে পড়েছে। যখন জানবে সে তাদের অজান্তে, অমতে বিয়ে করে নিয়েছে, তখন কতটা চুরমার হয়ে যাবেন! ভেবেই তরীর শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। ঠান্ডা হয়ে এলো হাত পা।
দুরুদুরু বুক নিয়ে মায়ের শরীর ছুঁয়ে দেখল। জ্বর এখনো মনে হচ্ছে আগের মতোই আছে। শ্বাস টেনে টেনে নিচ্ছেন। পায়ের দিকে কম্বল টেনে দিতে গিয়ে আরেকবার শিউরে উঠলো তরী। মায়ের পায়ের দিকটা একেবারে বরফ শীতল। অথচ উপরের অংশটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
কোনভাবে বাবা-মেয়ে মিলে রাতটা চেয়ারে হেলান দিয়ে কাটিয়ে দিল। ফজরের আজান পড়তেই মসজিদে চলে গেলেন বাবা। সেখান থেকে এসেই তরীকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। বাসায় ছোটো ছোটো দুজন কি করছে একা একা, কেজানে?
তরী বাবাকে রেখে বাসায় চলে এলো। অবাক হলো সে। কলিংবেল চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে মজে থাকা মিঠু জেগে আছে! যাকে ঠেলেও সকালে ঘুম থেকে তোলা যায়না, তার চোখজোড়া চাতক পাখির মতো কিছু জানতে চাইছে। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো মিঠু,
-“মা কেমন আছে, আপু? জ্বর কমেছে?”
মিঠুর অস্থিরতা কমাতে খানিকটা মিথ্যের আশ্রয় নিলো তরী। বলল,
-“এখন জ্বর কম আছে।”
-“আমি একবার গিয়ে দেখে আসি?”
মিঠুর চোখেমুখে ভাসছে ব্যাকুলতা। অস্থিরতায় একজায়গায় স্থির নেই ছেলেটা। ছটফট করছে। তরী বলল,
-“যাবি, এখন নয় পরে। অরু ঘুমাচ্ছে?”
মিঠু হাঁপিয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-“রাতে জেগে গিয়ে তোমাদের কাউকে না দেখে খুব কাঁদছিল। একটু আগেই ঘুমিয়েছে।”
তরী বলল,
-“তুই একটু ঘুমিয়ে নে। আমি নাশতা বানিয়ে নিচ্ছি। একসাথে মাকে দেখতে যাবো।”
চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে অনিদ্রায়। তবুও মিঠু বলল,
-“এখন ঘুম আসবেনা।”
তরী জোর করে পাঠিয়ে দিল মিঠুকে। ছেড়ে দেওয়া শরীরটা কেমন শক্ত হশে উঠলো। কোমরে ওড়না বেঁধে কাজে লেগে পড়লো তরী। কাজকর্ম শেষ দিয়ে অরুকে ঘুম থেকে জাগালো। নাশতা করার সময় ছোট্ট অরুর চোখ দুটো পিটপিট করে এদিক-ওদিক ঘুরছে। আজ বাবা বা মা কাউকেই দেখছেনা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তরীর দিকে। ঘুম ভাঙা কন্ঠের রেশ এখনো কাটেনি। ভাঙা ভাঙা গলায় শুধালো,
-“মা আর বাবা কোথায়?”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“মায়ের অসুখ করেছে তো। তাই বাবা মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে।”
অবুঝ অরু প্রশ্ন করলো,
-“মায়ের অসুখ করেছে কেন?”
-“সেটা তো আল্লাহ জানেন, অরু। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, আমরা মায়ের কাছে যাব।”
অরু আর দ্বিরুক্তি করলোনা। তরীর হাতে খেয়ে নিলো ঝটপট। তরী তাকিয়ে দেখলো মিঠুর খাওয়া শেষ। একটু খানি খেয়েই উঠে গিয়েছে। সে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি। সবকিছু গুছিয়ে ছোটো ভাই-বোন দুটোকে নিয়ে তরী হাসপাতালে চলে গেল। এর মাঝে মাহমুদের এত এত কল, মেসেজ সব উপেক্ষা করলো। তরী আর ফোনের দিকে মন দেওয়ার সময় পেলোনা।
★★★
মায়ের যাবতীয় টেষ্ট করানোর পর রিপোর্ট এলো। সবটা স্বাভাবিক। কোন ধরনের প্রবলেম দেখা দেয়নি। তবে ভর্তি রইলেন তরীর মা। এবারেও স্ত্রীর পাশে রইলেন তরীর বাবা। ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিলেন বাসায়। জ্বরের প্রকোপ কমতির নাম নেই বরং থেকে থেকে বাড়ছে। করোনা টেস্ট করা হলো। তেমন কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। রাতে তরীর বাবাকে ডাক্তার ডেকে জানালেন,
-“আপনারা রোগী অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান।”
অস্থির হয়ে পড়লেন তরীর বাবা। দিনের বেলা আত্মীয়-স্বজন রা অনেকেই দেখে গেলেও রাতে থাকার মতো কেউ নেই। সবাই সন্তান, ব্যস্ততা এসব অজুহাতে কেটে পড়েছেন। রাতারাতি ভাইকে ফোন করে পরামর্শ নিলেন হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারে। তিয়াসের বাবা বললেন,
-“তুই এখন ডাক্তার যেখানে নিতে বলে, নিয়ে যা। আমি সকালে পৌঁছে যাবো। এখন তো অনেক রাত হয়েছে।”
তরীর বাবা মেয়েকেও আর ঝামেলায় ফেলেন নি। রাতারাতি স্ত্রীকে নিয়ে এম্বুলেন্স এ উঠলেন। যতবার গাড়ির ডাকটা কানে বেজে ওঠে ততবারই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।
★★★
অরু কখনো মাকে ছাড়া থাকেনা। রাতে তার সাথে ঘুমায় ঠিকই, কিন্তু তার মনে একটা ভরসা থাকে মা বাসায় আছেন। অরুকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে ফোন হাতে নিলো তরী। মায়ের খোঁজ নিতে হবে। সারাদিনের ব্যস্ততায় তার মাত্রই চোখ পড়লো মাহমুদের নম্বর। ফোন, মেসেজের ভীড়। তাকে একটু পরেই ফোন দেবে। আগে মায়ের খবর নেওয়া দরকার। বাবাকে ফোন করলো তরী। এম্বুলেন্স এর ডাক শোনা যাচ্ছে। বুকের ভেতর ভয়েরা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তরী কাঁপা-কাঁপা গলায় বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো,
-“মায়ের এখন কী অবস্থা, বাবা?”
তরীর বাবা নিস্তেজ হয়ে এলেও, সন্তানের কাছে ভেঙে পড়লেন না। তিনি ভেঙে পড়লে যে মেয়েটাও ভেঙে পড়বে। সন্তানগুলো কার কাছে ভরসা খুঁজবে?
নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলেন,
-“তোর মাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।”
আৎকে উঠলো তরী। মায়ের বড় কোন ক্ষতি হলো বুঝি! তড়িৎ প্রশ্ন করলো,
-“মায়ের অবস্থা কি খুব খা*রা*প?”
-“চিন্তার কিছু নেই। এই হাসপাতালে দেখছি চিকিৎসা ভালোনা। তাই অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেয়েকে মিথ্যে বলে শান্তনা দিলেন। একা বাসায় দুশ্চিন্তা করে নিজে না আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে!
বাবার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি তরীর। তবুও বাবাকে বোঝালো সে বিশ্বাস করেছে। অরু ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠছে। আস্তে করে তার বুকের উপর হাত রাখলো তরী। আবারও মাহমুদের কল। সময় না নিয়ে রিসিভ করলো। ফোন কানে তুলতেই মাহমুদের ব্যাকুলতা টের পেলো,
-“তরী, কোথায় তুমি? সব ঠিক আছে? তোমাকে গতরাত থেকে কল, মেসেজ কোথাও পাচ্ছিনা!”
মাহমুদের ধুপধাপ পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভীষণ অস্থিরতায় পায়চারি করছে মানুষটা। তরী ফুঁপিয়ে উঠলো। মাহমুদ আরও অস্থির হয়ে উঠলো,
-“এই তরী, কাঁদছো কেন? বলোনা আমায়, সব ঠিক আছে? তুমি ঠিক আছো?”
তরীর হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। রোধ হয়ে আসা গলায় বলল,
-“মা, মা ভালো নেই। এখন অন্য হাসপাতালে শিফট করেছে।”
মাহমুদ চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
-“আন্টির এখনো জ্বর কমেনি?”
-“তরী হেঁচকি তুলে জবাব দিলো,
-“নাহ্।”
মাহমুদ কোমল হল।
-“তরী, আগে কান্না থামাও। আন্টির কিচ্ছু হবেনা। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। তুমি কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
মাহমুদ কল কেটে দিলেও তরী ঘুমালোনা। ঘুম আসলোনা চোখে।
★★★
মাহমুদের চিন্তা অন্য জায়গায়। আগামীকালই শুক্রবার। তরীর কথা অনুযায়ী কালই তিয়াসের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা। অথচ তার এখনো তিয়াসের সাথে কথা বলা হয়নি। তরী কাছ থেকে নম্বরও নেওয়া হয়নি। তরীর মায়ের শরীর স্বাভাবিক হলে হয়তো বিয়েটা কালই হয়ে যেতে পারে। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলো সে। রাতে তারও ঘুম হলোনা। সকালে মাকে তরীর মায়ের অসুস্থতার কথা জানানোর সময় রামি শুনলো। আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“আমাদের দেখতে যাওয়া উচিত। আমাদের সাথে তো কোন ঝগড়াঝাটি হয়নি। আর হলেও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”
মাহমুদ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল হাসপাতালে তরীর মাকে দেখতে যাবে। এখন মাকেও সঙ্গে নিল। রামি এসে যোগ দিল তাদের সাথে। সেও যাবে। মাহমুদ না করলোনা। তরীকে ফোন করে হাসপাতালের নাম জেনে নিল।
তরীর বাবা চেয়ারে বসে আছেন। একটু পরই আবার কতগুলো টেস্ট করাতে নিয়ে যাওয়া হবে তরীর মাকে। সেখানে মাহমুদ আর তার মা, ভাইকে দেখে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি ওদের এখানে আশা করেননি। ভেবেছেন ভাই সকালে আসবে বলেছে, সেই এসেছে। তবে উনাদের দেখে কোনরূপ রূঢ় ব্যবহার করলেন না। চুপচাপ রইলেন। একঘন্টা সময় পর তিয়াসের বাবা এলেন। মাহমুদের মা বাসায় গেলেন না। তিনি হাসপাতালে থেকে তরীকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন রেস্ট নেওয়ার জন্য। এতেও তরীর বাবা হ্যাঁ, না কিছুই বলেন নি। তিয়াসের বাবা আবার আধাঘন্টা না পেরোতেই কাজ আছে বলে চলে গেলেন। মাহমুদ ঘোরাফেরায় রইলো। ডাক্তারের সাথে কী কী যেন বলছে। এই মুহূর্তে একজন বড়ছেলের ভীষণ অভাববোধ করলেন তরীর বাবা। রিপোর্ট আসলো। তরীর বাবাকে ডাকা হলো ডাক্তারের চেম্বারে। উনার চোখমুখ মলিন। আতঙ্কিত চেহারা দেখে মাহমুদ তরীর বাবার সামনে সাহস করেই বলে ফেললো,
-“আমিও যাবো আপনার সাথে, চলুন আঙ্কেল।”
তরীর বাবা একবার গম্ভীর হয়ে বললেন,
-“তার দরকার নেই।”
মাহমুদ বারণ শুনলোনা। তরীর বাবার সাথে ঢুকে পড়লো। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন,
-“রিপোর্ট খুব একটা ভালো নয়। রোগীর অবস্থা সিরিয়াস।”
#চলবে……..
(আপনারা বলছেন দুদিন পরপর বলে আমি তিনদিন পর দিচ্ছি। আজ দিয়েছি। আগামীকাল, আগামী পরশু এই দুদিন দেবোনা। তার পরেরদিন দেবো। তাহলে তিনদিন কিভাবে হচ্ছে?)#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
-“আপনারা আরও আগে কী করেছেন? এমন সিরিয়াস মোমেন্ট এ এসে হসপিটালে ভর্তি করলেন?”
কৃত্রিম শীতলতা নিস্তব্ধ কক্ষ জুড়ে বিরাজমান। তরীর বাবার হাত-পা আরও ঠান্ডা হয়ে এলো। শক্ত থাকার চেষ্টা করেও তিনি বাইরের খোলস ছেড়ে ভঙ্গুর রূপে ফিরে আসছেন। ধুকধুক করছে বুকের ভেতর। প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে প্রশ্ন করলেন,
-“আমার স্ত্রীর কী হয়েছে?”
মাহমুদ শান্ত হয়ে বসলো। মনযোগ দিলো সামনে বসে থাকে মাঝবয়সী ডাক্তারের দিকে। উনার চোখমুখ গম্ভীর। নাকের ডগায় ঝুলে থাকা চশমা উপর দিকে ঠেলে দিয়ে রিপোর্টটা শব্দ করে রাখলেন। বললেন,
-“ফুসফুস ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে উনার। সেজন্যই শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে।”
অতঃপর প্রশ্ন করলেন,
-“আপনারা কি কোন উপসর্গ খেয়াল করেন নি?”
তরীর বাবার হাত-পা কেমন অসাড় হয়ে এলো। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছেন। হাঁক ছেড়ে ওঠা গলার স্বর একেবারে ক্ষীণ হয়ে এলো।
-“ওর তো তেমন কোন অসুস্থতা ছিলনা। মাঝে মাঝে জ্বর-টর, কাশি হতো আর বমি হতো। ডাক্তার দেখানোর পর জ্বরের ঔষধ আর বমির জন্য গ্যাসের সমস্যা বলে ঔষধ দিয়েছেন। সেগুলোই চলেছে।”
ডাক্তার বললেন,
-“অনেক সময় কোন উপসর্গ দেখা যায় না। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।”
মাহমুদ তরীর বাবার দিকে তাকালো। নম্রতা বজায় রেখে ভরসার গলায় বলল,
-“আপনি এত চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। নিজেকে ঠিক রাখুন।”
অতঃপর ডাক্তারের মুখোমুখি হলো। প্রশ্ন করলো,
-“আপনারা চিকিৎসা শুরু করুন।”
ডাক্তারকে গম্ভীর দেখালো। তিনি বললেন,
-“আপনাদের আমি হসপিটাল সাজেস্ট করছি। সেখানে নিয়ে যান। এখানে এই রোগের ভালো চিকিৎসা হবেনা।”
ডাক্তারের সাজেস্ট করা হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থায় নামলো মাহমুদ। এম্বুলেন্স দেখছে সে। তরীর বাবাকে রেখে গেল সবার কাছে।
এম্বুলেন্স ঠিক করে মাহমুদ ভেতরে আসছে এমন সময় তরী এসে পড়লো হাসপাতালে। বাসায় বেশিক্ষণ দেরি করেনি। দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার এসেছে। সাথে মিঠু আর অরু। মাহমুদকে ছোটাছুটি করতে দেখে তরী জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি এমন ছোটাছুটি করছেন কেন?”
দ্রুত হাঁটার তাল বজায় রেখে মাহমুদ বলল,
-“আন্টিকে নিয়ে অন্য হাসোতাল যেতে হবে।”
তরীর মুখটা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে এলো। অরুর চোখমুখও শুকিয়ে আছে। এ দুদিন তার ঠিকমতো যত্ন নেওয়া হয়নি। তরী বিচলিত হলো। উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“এখন আবার হসপিটাল কেন পরিবর্তন করতে হবে? রিপোর্টে কী এসেছে?”
মাহমুদ এক্ষুনি তরীকে কোন শক দিতে চাচ্ছে না। সত্যটা এড়িয়ে বলল,
-“এখানেও তেমন কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। তাই অন্য হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। আরেকবার টেস্ট করিয়ে নিলে ভালো হবে।”
তরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। দু-তিন দিনে সে বড্ড ক্লান্ত। দুর্ভাগ্য তাদের না আছে খালা আর না আছে ফুফু। যে দুঃসময়ে তাদের পাশে থাকবে। মামা-মামি, চাচা-চাচিরা দেখতে আসছেন আর ব্যস্ততা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। দুর্বল হাতে অরুর হাত ধরে এগিয়ে গেল। মাহমুদ লম্বা কদমে তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে। মিঠুও তালে তালে দ্রুত এগিয়েছে।
তরীর বাবা ভাইকে ফোন করে স্ত্রীর রিপোর্টের ব্যাপার খুলে বললেন। তিয়াসের বাবা বললেন,
-“তুই টাকা নিয়ে চিন্তা করিস না। ভালোভাবে চিকিৎসা করা। আমরা আছি।”
তরীর বাবা “আমরা আছি” তেও ভরসা খুঁজে পেলেন না। উনার এখন মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন। সন্তানদের আগলে রাখার মানুষ প্রয়োজন, টাকার নয়। উনার সামর্থ্য আছে স্ত্রীকে চিকিৎসা করানোর। প্রয়োজন পড়লে জমি বিক্রি করবেন। যেসবের অভাববোধ করছেন, সেসব পাচ্ছে না। আপন মানুষগুলোই এখন দূরে সরে আছে।
তিয়াস গতরাতে একবার ফোন করে খবর নিয়েছিল। হয়তো বাবা-মায়ের কাছে শুনেছে।
সবটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ছেলে-মেয়েদের সামলাবে কে? বড় মেয়েটাও নরম মনের। ছেলেটা যতই ঘাড়ত্যাড়া হোক, দিন শেষে মায়ের আঁচল না ধরলে তার শান্তি হয়না। আর অরু? তার কথা তো ভাবতেই পারছেন না।
নিজেকে শক্ত করে এগিয়ে গেলেন। হাজারো মানুষের বুক কাঁপানো শব্দ তুলে এম্বুলেন্স এগিয়ে যাচ্ছে। মাহমুদ তরীর বাবার সাথে যাচ্ছে। তরী সাথে যেতে পারছেনা অরুর জন্য। সে কার কাছে থাকবে? মাহমুদের মায়ের কাছেও থাকবেনা। ঘর সামলানোর জন্যেও একজন নারী প্রয়োজন। মায়ের কাছেও একজন থাকা লাগে। পর হয়েও মাহমুদের মা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়লেন। সঙ্গে তিনিও গেলেন।
দিন দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ভর্তির পরপরই সব দেখেশুনে অক্সিজেন দেওয়া হলো তরীর মাকে। তিনি ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছেন। অক্সিজেন মাস্ক টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছেন। ওলট-পালট করায় শরীরের কাপড় সরে যাচ্ছে। মাহমুদের মা বারবার ঠিক করছেন। উনি চোখদুটোকে বিশ্রাম দিতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। মাহমুদ মাকে বলল,
-“তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও মা। আমরা আছি।”
তরীর বাবা নম্র হলেন। তিনি বললেন,
-“আপনারা দুজনেই ক্লান্ত, আমাদের জন্য অনেক করেছেন। আমি আছি এখানে, আপনারা বাসায় গিয়ে রেস্ট করুন।”
আয়েশা সুলতানা ক্লান্ত হলেও নাকচ করলেন তরীর বাবার কথা। তিনি বললেন,
-“আমাদের বি*প*দ হলে কি আপনি এগিয়ে আসতেন না? আমি আছি। মাহমুদ বরং বাসায় গিয়ে গোসল সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আয়।”
একে অপরের ঠে*লা*ঠে*লি*র মাঝে আর কারো বাসায় যাওয়া হলোনা। তবে আয়েশা সুলতানা একটু চোখদুটোকে বিশ্রাম দিলেন।
মাহমুদের ফোনে কলেজ থেকে কল এল। সে কলেজ থেকে কোন ছুটি নেয়নি। তরীর মাকে নিয়ে গতকাল রাতে এখানে এসেছে। সে জানিয়ে দিল আজ আর যেতে পারবেনা।
বাসা থেকে এই হাসপাতালের দূরত্ব অনেক। তবুও তরী অরুকে নিয়ে মাকে দেখতে আসবে। রামি ওদের বাসাতেই ছিল গতকাল। মিঠু রামি দুজনের কাছে অরুকে কয়েকঘন্টার জন্য রেখে তরী ছুটলো হাসপাতালে। অর্ধেক পথ এসে সে রাস্তা ভুল করলো। ফোন করলো বাবাকে। তিনি এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এলেন। মাকে মুখে পানি দেওয়া কড়াভাবে নিষিদ্ধ। তিনি ছটফট করছেন পানির জন্য। কেউই ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞায় পানি দিচ্ছেনা। তরীকে দেখতে পেয়েই মা কথা বললেন। ঠোঁট দুটো ভারী হয়ে এসেছে। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেন মাস্ক সরানোর চেষ্টা করে অস্পষ্ট ভাবে কথা বলছেন। চোখের কোল ঘেঁষে পানি গড়িয়ে কান স্পর্শ করলো। তরীকে বলল,
-“আমাকে কেউ পানি দিচ্ছে না, মা। তুই আমাকে পানি দে। আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে।”
বারবার জিহবা দ্বারা শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে চলেছেন তিনি। তরী মায়ের কষ্ট নিতে পারলোনা। ইচ্ছে করলো পৃথিবীর সকল পানি এনে মায়ের তৃষ্ণা মেটাতে। সে ডাক্তারের আড়ালে বোতলের মুখ খুলে একটু পানি নিলো মায়ের মুখে দেবে বলে। তখনই ডাক্তারের আগমন। তিনি তরীকে ধমকে উঠলেন।
-“রোগী মা*রা গেলে দায়ভার আপনাদের। কতবার না করেছি পানি দেবেন না!”
তরী আর এগোলো না। ওভাবে খোলা অবস্থাতেই পানির বোতল রেখে দিল। তার মনে মাকে হারানোর ভয় ঢুকলো। ডাক্তার হার্টবিট চেইক করছেন। খুবই দুর্বলভাবে চলছে সব। তিনি চলে যেতেই মা আবারও কষ্ট করে বললেন,
-“আমাকে একটু পানি দে, তরী। আমি জীবনে আর কিছু চাইবোনা তোর কাছে। একটু পানি দে না মা!”
তরীর গাল, গলা ভিজে আছে। চোখদুটো জলে টইটম্বুর। ইচ্ছে করছে মাকে বোতলের সবটুকু পানি খাইয়ে দিতে। আবার মাকে হারানোর ভয়ে পিছিয়ে গেল। বাসায় মায়ের ফোন আছে। মিঠু ফোন দিয়ে জানালো অরু কাঁদছে। তরী বিদায় নিলো স্বার্থপরের মতো।
সন্ধ্যার পরই তরীর মায়ের অস্বাভাবিক ছটফট, চোখ বড়ো বড়ো করে তাকানো দেখে আয়েশা সুলতানা দৌঁড়ে বাইরে গেলেন। মাহমুদকে বললেন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসতে।
ডাক্তার আসলেন। তরীর মায়ের নিস্তেজ শরীর পড়ে রইলো। চোখ দুটো খুলে রেখেছেন।
★★★
রাতে তরী হুট করেই দেখলো সবাই এসে তাদের বাসায় ভীড় জমিয়েছে। চাচা-চাচি, মামা-মামি, আত্মীয়-স্বজন সবাই আসছে। কারো কারো চোখে দুঃখের, কারো চোখে লোক দেখানো পানি। তরী মিঠু কেউই বুঝলোনা সবাই এখানে কেন আসছে! কেন কাঁদছে?
তরী অবাক হয়ে মামিকে জিজ্ঞেস করলো,
-“সবাই এখন বাসায় কেন, মামি?”
মামি তরীকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
-“তোর মা আর নেই, তরী।”
তরীর পায়ের তলার মাটি স্বরে গেল। মামিকে ছাড়িয়ে অবাক হয়ে বলল,
-“এসব অলক্ষুণে কথা কেন বলছেন মামি? আমার মাকে আমি দেখে এসেছি। মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন।”
মিঠু মেয়েদের মতো চিৎকার করে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। অরু কিছু না বুঝেই কাঁদছে। তরীর কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। দুপুরে জ্যান্ত মাকে দেখে এলো। অরুকে কোলে নিয়ে মিঠুকে ধরলো,
-“এই মিঠু ওঠ। এমন কাঁদছিস কেন? মায়ের কিচ্ছু হয়নি।”
সবাই তরীকে বোঝাতে ব্যস্ত তার মা আর বেঁচে নেই। তরী কারো কথা শুনতে নারাজ। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে এম্বুলেন্স এর ডাক। এবার তরীর কলিজা কেঁপে উঠলো। অরুকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়েই শরীরের ভর ছেড়ে দিল। তার পূর্ণজ্ঞান আছে। কে কী বলছে, সব শুনছে। শুধু নড়তে পারছেনা, কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। মা এমন স্বার্থপরের মতো উড়াল দিলো? এত দ্রুত?
তিয়াসের মা এসে তরীকে ধরে উঠানেন। মামি পানি এগিয়ে ধরলো মুখের সামনে।
তরীর মনে পড়লো মা কতটা কাতর গলায় একটু পানি চেয়েছিল তার কাছে। সে নিষ্ঠুরের মতো পালিয়ে এসেছে। পানি দেয়নি মাকে। এই পানিও যে তার গলা দিয়ে নামবেনা।
#চলবে……