একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব -৫+৬

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫
#Saji_Afroz

বিছানাভর্তি আজরার বিয়ের শপিং। পাশেই বসে রয়েছে মানতাশা। তাকে শপিং দেখাতে ব্যস্ত আজরা।

গোলাপি রঙের নেটের শাড়িটা হাতে নিয়ে মানতাশা বলল, এটা ভারী সুন্দর তো।
-তাই না? ও নিজে আমাকে পছন্দ করে নিয়ে দিলো এটা।
-দাম কত?
-একুশ হাজার টাকা।

টাকার পরিমাণ শুনে চোখ জোড়া বড়ো হয়ে গেল মানতাশার। বিয়ের লেহেঙ্গাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, বিয়ের টা কত?
-এক লাখ পনেরো হাজার।

এক লাখ টাকায় বিয়ের কনের পুরো শপিং হতে দেখেছে মানতাশা। শুধু বিয়ের জামাতে এক লাখ পার হলো শুনে কথা বলার ভাষাই যেন হারিয়ে ফেললো সে।

আজরা বলল, আরও দাম দিয়ে নেওয়ার জন্যে জোরাজোরি করছিলেন আমার হবু শাশুড়ী। আমিই না করলাম। একদিনই পরব এটা। এত দাম দিয়ে নেওয়ার কী প্রয়োজন?

তার কথা শুনে মানতাশা বলল, তবুও তো লাখের ঘর পার করলি।
-উনি মানছিলেন না তাই।

এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম শুনে মানতাশা বিস্ময় এর শেষ পর্যায়ে চলে যায়।
ইনতিসার বড়ো ব্যবসায়ী শুনেছে। কিন্তু এত টাকার মালিক এটা সে জানতো না।

মানতাশার জন্য নাস্তা আনতে রুমের বাইরে যায় আজরা।
কিছু একটা ভেবে নাবীহা কে ভিডিও কল দিয়ে বসে মানতাশা। তাকে এসব দেখাতে থাকে সে। নাবীহা এসব দেখে বলল, আজরার হবু শাশুড়ীর চয়েজ দেখছি বেশ ভালো।
-তাই না?
-হু।
-আজরা নিজে আমাকে ফোন করে এসব দেখতে আসতে বলল। তোকে করেনি?

নাবীহা কে ফোন করেনি আজরা। কারণটা সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এতে কিছু মনে করেনি সে। নাবীহা হেসে বলল, আমি ব্যস্ত সে জানে। বললেও যেতে পারি না। তাই বলেনি।
-বললে যেন এসবে নজর দিবি তুই! অথচ এসব তোর হওয়ার কথা ছিল।

মানতাশার এসব কথায় বিরক্ত হয় নাবীহা। তাই সে কথা না বাড়িয়ে কাজের অজুহাত দেখিয়ে ফোনটা রেখে দিলো।

আজরা এসে নুডলস এর বাটিটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, কার সাথে কথা বলছিলি?
-নাবীহা ফোন করেছিল। আমি এখানে আছি, তোর বিয়ের শপিং দেখছি শুনেই ফোনটা কেটে দিলো। মনে হয় বিষয়টা পছন্দ করলো না।
-নাবীহা এমন মেয়েই নয়। তাছাড়া তোকেও তো ডাকিনি আমি। শপিং এর কথা শুনে নিজ থেকেই এসেছিস। সেও জানে শপিং করতে গিয়েছিলাম আমি।
-কী জানি বাপু! ওর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে জেলাস।

মানতাশার কথার পিঠে কোনো কথা না বলে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলো আজরা। মানতাশা নুডলস খেতে খেতে বলল, আমি আরেকটা বিষয় নিয়েও এক্সাইটেড।
-কী?
-ইনতিসার আর নাবীহা মুখোমুখি হলে কী হবে? ইনতিসার নিশ্চয় অনেক বেশি আফসোস করবে। নাবীহা তো অলরেডি করছেই। আমার মনে হয় তুই মাঝখানে দেয়াল হয়ে রইবি।

বিষয়টা গুরুত্ব না দিয়ে হেসে ফেললো আজরা।
সে কথা ঘুরিয়ে বলল, বিয়েতে এজাজ ভাই কে বলি?
-মাথা খারাপ! আমার পরিবার আসবে। দেখে ফেললে?
-এজাজ ভাই কে বলতে পারলে আমারও ভালো লাগতো।
-কোনো প্রয়োজন নেই।

হঠাৎ বিয়ের ব্যাগের দিকে চোখ পড়ে মানতাশার। তা হাতে নিয়ে বলল, ব্যাগটা তো অনেক সুন্দর! পুরাটাই স্টোনের কাজ।
-অনেক ভারীও।
-এটা কত নিয়েছে?
– পঁচিশ হাজার।

মানতাশা ভ্রু কুচকে বলল, শুধু এসবেই মনে হয় পাঁচ-ছয় লাখ খরচ গেছে?
-আরও বেশি।

আচমকা মানতাশা উঠে এসে আজরার কপালে নিজের কপাল ঘষে বলল, ভাগ্যবতী রে! তোর থেকে একটু ভাগ্য নিয়ে নিই আমি।

এই সময় রুমে আসলেন আজিজা বানু। এই দৃশ্য দেখে তিনি প্রায় চ্যাঁচিয়ে বললেন, আরেহ করছ টা কী?

উত্তরে মানতাশা বলল, মারছি না ওকে! জাস্ট কপালে কপাল লাগালাম।
-এমনটা করতে নেই।
-কেন? সত্যি সত্যি ভাগ্য নিয়ে ফেলব না কি?

এই বলে হেসে উঠলো দুই বান্ধবী। তিনি রাগান্বিত হলেও কিছু বললেন না। এই মেয়ের সাথে কথাতে তিনি পারবেন না জানেন। তাই চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তাকে এভাবে রাগান্বিত অবস্থায় দেখে দাঁড় করালেন আজহার শেখ।
তিনি বললেন, রাগান্বিত মনে হচ্ছে?

ঘটনা খুলে বলতেই হেসে ফেললেন আজহার শেখ। আজিজা বানু বললেন, এমন করলে সত্যিই না কি একজনের ভাগ্য অন্য জন নিয়ে যায়।
-এসব কুসংস্কার ছাড়া কিছুই না।
-যাই বলো, মেয়েটা কে একদমই সহ্য হয় না আমার।
-একটু চঞ্চল সে। কিন্তু খারাপ না। ওসব নিয়ে মাথাটা খারাপ করো না তো।

স্বামী তাকে শান্তনা দিলেও শান্ত হলো না তার মন। মানতাশার প্রতি চরম বিরক্ত তিনি। নাবীহা আর আজরার বান্ধবী এই মেয়ে কীভাবে হলো হিসাব মেলাতে পারেন না তিনি।
.
.
.
আগামীকাল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান আজরার। হুট করে ইনতিসার আজ তাকে ডাকলো। কারণ জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলে না সে।
শপিং ছাড়া আর দেখা বা কথা হয়নি ইনতিসারের সাথে তার। আজ এভাবে হুট করে ডেকেছে বলে ভাবনায় পড়ে যায় সে। নানারকম চিন্তা এসে ভর এসে আজরার মনে।
ইনতিসার কী বিয়েটা নিয়ে কিছু বলতে চায়? করতে চায় না সে এই বিয়েটা?
এসব ভেবে ঘাবড়ে যায় আজরা।
তবুও সাহস করে ইনতিসারের দেখা করতে তার দেওয়া ঠিকানায় গেল সে।
.
.
.
রেস্টুরেন্টে আজরার অপেক্ষায় বসে আছে ইনতিসার। অনেক ভেবে সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেটা সবার জন্যই ভালো হবে।
আজরার মতো মেয়েকে সে ঠকাতে পারে না।
তার সম্পর্কে যতটুক সে বুঝেছে, খুবই ভালো একটা মেয়ে আজরা। তার মা তো সারাক্ষণ আজরার গুণাগুণ সম্পর্কে বলতে থাকেন। তাকে পেতে চলে পরিবারের সবাই অনেক খুশি। তবে ইনতিসার নিজেই কেন অখুশি হবে? সেও সব মাথা থেকে ঝেড়ে নতুন এক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চায়। ভালো লাগার মতোই মেয়ে আজরা। তবে কেন যা হওয়ার নয় তা ভেবে নিজের মনকে অশান্ত করতে হবে?
হ্যাঁ, ইনতিসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একটি সুন্দর মন নিয়ে আজরার সাথে নতুন জীবনে প্রবেশ করার জন্য। যে জীবনে থাকবে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা।
আজরা কে সে তার প্রাপ্য ভালোবাসাটা দিতে প্রস্তুত। আর প্রস্তুত নিজের ভালোবাসা আদায় করতে।
এসব ভাবতে ভাবতেই আজরার দেখা পায় ইনতিসার।

ধীরপায়ে সে এগিয়ে এসে কোমল স্বরে বলল, আসসালামু আলাইকুম। খুব বেশি দেরী করে ফেললাম?

ইনতিসার দাঁড়িয়ে বলল, নাহ নাহ! বসুন প্লিজ।

ইনতিসার চেয়ার টেনে দিতেই আজরা বসলো। ইনতিসার তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আসতে অসুবিধে হয়নি তো?
-নাহ।

ইনতিসার খেয়াল করলো, আজরা একেবারেই চুপসে আছে। তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। নাকের উপর মুক্তোর দানার ন্যায় কয়েক ফোটা ঘাম জমেছে। কপালেও জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
ইনতিসার তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নার্ভাস কেন মনে হচ্ছে আপনাকে?

টিস্যু হাতে নিয়ে আলতো করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আজরা জবাব দিলো-
হুট করে ডাকলেন তো আপনি।
-আসলে সব এত হুটহাট হলো! আপনার সাথে আলাদা সময়ই কাটাতে পারলাম না। মা বলেন বিয়ের আগে এভাবে সময় কাটানো টাও না কি স্পেশাল, যা বিয়ের পরে অনুভব করা যাবে না।

একথা শুনে চোখ তুলে ইনতিসারের দিকে তাকালো আজরা।
তার মানে অহেতুক দুঃশ্চিন্তা করছিল সে! ইনতিসার আলাদা সময় কাটানোর জন্য তাকে ডেকেছে। আর সে কী না সারা রাস্তা কীসব ভেবে ভেবে এসেছে!

ইনতিসার বলল, বলুন কী খাবেন?
-কফি।
-জাস্ট?
-জি।
-তা বললে তো চলবে না। ওকে, আমি আপনাকে আমার ফেবারিট খাবারটা খাওয়াই। চলবে?
-জি।

বরাবরই এমন নরম স্বভাবের মেয়ে পছন্দ ইনতিসারের। ভালোই হলো আজ এখানে এসেছে সে। আজরার সাথে সময় কাটিয়ে মনে হচ্ছে, সঠিক সিদ্ধান্ত টায় নিতে চলেছে ইনতিসার।

খাবার আসলে দু’জনে খেতে খেতে গল্প জুড়ে দেয়।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠে আজরার। মানতাশার ফোন এসেছে। যদিও সে এখন কোনো ফোন রিসিভ করে তাদের মুহুর্তটা নষ্ট করতে ইচ্ছুক ছিল না, কিন্তু বান্ধবীর ফোন দেখে রিসিভ না করেও পারলো না সে।
সাথে ইনতিসারও বলল, কার ফোন?
-বান্ধবীর।
– সমস্যা নেই। রিসিভ করুন!

আজরা ফোন রিসিভ করতেই মানতাশা বলল, বাসায় আছিস?
-নাহ। আমি বাইরে আছি।
-কোথায়?
-বারকোড এ আছি।
-এই সময়ে ওখানে কী করিস!

আজরা কিছু বলতে যাবে তখনি মানতাশা বলল, ওহহো! সাথে ইনতিসার আছে না কি?

মৃদু হেসে আজরা বলল, হু!
-দেখা সাক্ষাতও চলে তাহলে?
-আজই প্রথম। হুট করে ডাকলো। তুই কেন ফোন দিয়েছিস বল?
-আমি আর নাবীহা শপিং কমপ্লেক্স এ এসেছিলাম। তোর বিয়েতে পরার জন্য দু’জনে ম্যাচিং করে শপিং করলাম। ভাবলাম তোর বাসায় গিয়ে সেসব দেখাই। এখন তো তুই বাসায় নেই। তবে কোনো সমস্যা নেই। আমরা বারকোডেই আসব। দুলাভাই থেকে একাই খাবি না কি তুই?

মানতাশা একা হলে কোনো সমস্যা হত না। কিন্তু সাথে নাবীহা আছে শুনে চিন্তার ভাজ পড়ে তার কপালে। বিয়ের আগেই ইনতিসারের মুখোমুখি নাবীহা হোক সে চায়নি। এতে করে নাবীহার কোনো সমস্যা না হলেও ইনতিসার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে। এমনটা সে চায় না। ইনতিসারের সামনে মানতাশা কে কী বলবে খুঁজে পায় না সে। মেয়েটারও বিষয়টা বোঝার দরকার ছিল!

আজরা বলল, আমি বেরুবো। তোরা বরং বাসায়ই আয়৷ ওখানে দেখা হবে।

একথা শুনে ইনতিসার বুঝলো, আজরার বান্ধবী এখানে আসতে চায়ছে। তাই সে হেসে বলল, আসতে বলুন। আমার কোনো সমস্যা নেই। বরং ভালোই লাগবে আমার।

ওপাশ থেকে একথা শুনে মানতাশা বলল, ভাইয়া দেখছি বেশ মিশুক! ওকে তাহলে আমরা বেরুচ্ছি। দেখা হচ্ছে।

এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেয় মানতাশা।
আজরার হাসিখুশি মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তা দেখে ইনতিসার ভাবলো, হয়তো হুট করে বান্ধবী আসছে বলে ইনতিসার কিছু মনে করছে ভাবছে। তাই সে বিষয়টা সহজ করতে বলল, আপনার বান্ধবী আছে ভালোই হলো। শ্যালিকার অভাব পূরণ হবে আমার। ক’জন বান্ধবী আছে?
– দু’জন।
-ভালোই হলো দেখা হবে। দু’জনেই সাথে আছে না কি?
-জি।

ভালো হবে না কী অন্যকিছু তা তো একটু পরেই বোঝা যাবে। কেন যে মানতাশার ফোন রিসিভ করতে গিয়েছিল সে!

সাজিরের সাথে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় আজরা ও মানতাশার কথোপকথন শোনেনি নাবীহা।
সে কথা শেষ করে মানতাশার পাশে আসে। মানতাশা তাকে তাড়া দিয়ে বলল, চল যাওয়া যাক।
-আজরা কে জানিয়েছিস আমরা যাচ্ছি?
-হু। তবে ও বাসায় নেই। কাছেই রেস্টুরেন্টে আছে একটা। ওখানে যেতে বলল।
-ওখানে রাতে কী করছে?
-এতসব আমি কী জানি! সময় নষ্ট না করে চল তো।

এই বলে রিকশা ঠিক করতে থাকে মানতাশা। নাবীহা কে নিয়ে সেখানে যাওয়ার পর ইনতিসারের মুখের অবস্থা কী হবে এটা দেখার অপেক্ষায় আছে সে। বরাবরই চেয়েছিল, বিয়ের আগে একটাবার নাবীহা ও ইনতিসারের মুখোমুখি হোক আজরার সামনে। আজ যে এই দিনটি চলে আসবে ভাবতেই পারেনি সে। সুযোগটা হারাতে চায় না মানতাশা। তাই সে অতিদ্রুত রিকশা ঠিক করার কাজে মনোনিবেশ করলো।
.
চলবে#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৬
#Saji_Afroz

এই সময়ে আজরা রেস্টুরেন্টে কী করছে? সাথে ইনতিসার নেই তো? মনের মাঝে ভাবনাটা আসতেই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে নাবীহা। সাথে সাথেই ফোন করে আজরা কে। নাবীহার ফোন পেয়ে রিসিভ করলো আজরা। নাবীহা বলল, তুই কোথায়?
-বারকোডে।
-কার সাথে?
-উনার সাথে।
-ইনতিসার ভাই?
-হু। তোরা কোথায়? কতক্ষণে পৌঁছাবি?
-আমার একটা কাজ পড়ে গেছে রে। পরে দেখা করব। তুই তোর কাজ সেরে বাসায় চলে যাস। এটা বলার জন্যই ফোন দিলাম।

নাবীহার কথা শুনে মনে শান্তি পেল আজরা। নাবীহা কে এখানে আসতে সে নিষেধ করতে পারছিল না। নতুবা তাকে মেসেজ করবে ভেবেছিল। এতে যদি মনে কষ্ট পেত নাবীহা?
কিন্তু এখন তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, নাবীহা জানতোই না সে ইনতিসারের সাথে আছে। জেনে নিজ থেকে আসতে নারাজ। এইজন্যই নাবীহা কে তার এত ভালো লাগে। ওদিকে মানতাশা! বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে এই মেয়ের কে জানে! তার এটা বোঝা উচিত, বিয়ের আগে নাবীহা কে ইনতিসারের সামনে এনে বিব্রতবোধ করার কোনো মানেই হয় না।
মনে মনে নাবীহা কে ধন্যবাদ জানায় আজরা। আর সাথে ইনতিসার কে বলল, আসলে ওদের কাজ পড়ে গেছে। তাই আসতে পারছে না।
-ও আচ্ছা! পরে দেখা হবে তবে।
-আমিও আসি এখন? রাত হয়ে যাচ্ছে।
-চলুন আমি নামিয়ে দিই আপনাকে।
-তার প্রয়োজন নেই!
-খুব আছে।

এই বলে হাসলো ইনতিসার। তার হাসি দেখে হাসলো আজরাও।
.
.
মানতাশা কে থামিয়ে নাবীহা বলল, আমার এখুনি বাসায় যেতে হবে।

মানতাশা ভ্রু কুচকে বলল, আমি রিকশা ঠিক করেছি!
-তবে তুই একাই যা আজরার কাছে। আমার কাজ আছে।
-লাস্ট মুহুর্তে এসে এমন করছিস কেন?
-মানতাশা! তোর মাথা গেছে আসলেই।
-কেন?
-ওরা আলাদা সময় কাটাচ্ছে। এখন আমাদের যাওয়াটা ঠিক হবে? তাছাড়া আমার যাওয়া তো মোটেও উচিত হবে না। এটাও এখন তোকে আমার বোঝাতে হবে?
-আজরা ইনতিসারের সাথে আছে তুই জানলি কীভাবে?
-ফোন দিয়েছিলাম।
-ওহ!
-তুই আমাকে কেন সেটা বললি না?

আমতাআমতা করে মানতাশা বলল, আমি ওত কিছু ভেবেছি না কি! ভাবলাম বিয়ের আগে একবার ভাইয়ার সাথে সবাই পরিচিত হই!

খানিকটা রাগ নিয়েই নাবীহা বলল, বুঝে শুনে কাজ করিস।

রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল, আপনারা কী যাইবেন?

নাবীহা বলল, যাব। কিন্তু উলটা পথে। যাবেন?
-উঠেন আপা তাড়াতাড়ি।

নাবীহা রিকশায় উঠে বসে ডাকলো মানতাশা কে। মানতাশাও উঠে বসে।
মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। আজকে দারুণ একটা ঘটনা ঘটতে পারতো, যেটি নাবীহার জন্য ভেস্তে গেল!
.
.
.
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো নাবীহা। আজ মানতাশার উপরে রাগ হচ্ছে তার। ইদানীং তার আচার-আচরণ ভালো লাগছে না নাবীহার কাছে। মানতাশা নিঃসন্দেহে চঞ্চল একটা মেয়ে। কিন্তু ওর আচরণে কখনো বুদ্ধিহীনতার পরিচয় পায়নি নাবীহা।
নাবীহার মতে সে সাহসী, মনে কিছু লুকিয়ে রাখে না, যখন যা মন চায় করে ফেলে। কিন্তু সে এই ক’টা দিন যা করছে তা কী তার স্বভাবের বশেই করছে নাকি কোনো কারণ রয়েছে?

এটা ভেবেও নিজের উপরে রাগ আরও বেড়ে যায় নাবীহার।
একে অপরের প্রিয় বান্ধবী তারা। অন্য কোনো কারণ কী থাকতে পারে! হয়তো মানতাশা বিষয় টাকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। কারণ তার সাথে তো ঘটেনি কিছু। ঘটেছে এবং ঘটছে আজরা ও নাবীহার সাথে। সে হয়তো সহজ ভাবেই দেখছে বিষয় টাকে।
এমনটা ভেবে মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেললো নাবীহা।
একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। আর বন্ধ হয়ে যাবে এই লুকোচুরিও।
.
.
.
জমকালো ভাবে সাজানো হয়েছে আজরার বাড়ি। সাজাবেই তো! আজ তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। এই বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে হতে চলেছে, আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি তার পরিবার। বরং বড়ো ঘরে বিয়ে হওয়ার আনন্দে ভাবনার চেয়েও বেশি কিছু করা হয়েছে। যদিও ইনতিসারের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো চাহিদা ছিল না, তবুও আজহার শেখ তাদের খুশি রাখার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে।

পার্লার থেকে ফিরে আসে আজরা, নাবীহা, মানতাশা ও আজরার কিছু বোনেরা।
আজরা কে দেখে আজিজা বানুর চোখে পানি চলে এল। তার মেয়েটা কে হলুদ শাড়িতে ঠিক হলুদ পরীর মতোই লাগছে। মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন তিনি। নাবীহা তাকে শান্তনা দিয়ে বললেন, আজকেই বিদায় নিচ্ছে না সে। আজ তো সবাই মজা করব। আপনি কেন ওর মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছেন?
.
আজরার চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। তা দেখে মানতাশা বলল, যাহ বাবা! ওর মেকআপ তো নষ্ট হবে।
.
নিজেকে সামলে নেন আজিজা বানু। আজরা কে বললেন, অনেক সুন্দর লাগছে আমার মা কে।

মানতাশার দিকে চোখ যেতেই ভ্রু কুচকালেন তিনি। মানতাশা ও নাবীহা একই রকমের পোশাক পরলেও দু’জনের সাজে রয়েছে ভিন্নতা। মানতাশা এমনভাবে সেজেছে, দেখে মনে হচ্ছে তারই বিয়ে! আজরার এই বিশেষ দিনে তার কেন এভাবে সাজতে হলো? এই নিয়ে মেজাজ খারাপ করলেন আজিজা বানু। কিন্তু কিছুই প্রকাশ করলেন না। তিনি বললেন, তোরা ডিনারটা সেরে নে। এরপর অনুষ্ঠান শুরু হবে।

টেবিলে এসে সবাই বসলেও নাবীহা বসলো না। এর কারণ জানতে চাইলে সে বলল, আমি আজরা কে আগে খাইয়ে দিই। আলগা নখ লাগিয়েছে সে, নিজ হাতে খেতে পারবে না।

মানতাশা বলল, চামচ দে তবে?
আজরাও বলল, হু আমি চামচ দিয়েই খাব। তুই পাশে বসে খেয়ে নে তো।

আজরার কথা শুনে নাবীহা তার পাশে বসলো। সবাই খাওয়া শুরু করলেও আজরা খেতে পারছে না। শুধু চামচটা নাড়তেই রয়েছে সে। তা দেখে নাবীহা বলল, খাচ্ছিস না যে?
-ইচ্ছে করছে না রে।
-কেন! খাবার অনেক মজা হয়েছে।
-কেন যে আমার গলা দিয়ে নামছে না!
-বুঝতে পেরেছি। এই সময়ে এমন একটু লাগেই। তবে কিছু না খেলে শরীর দূর্বল লাগবে। একটু হলেও ট্রাই কর।
-হু।

আজরার খাবারের প্রতি অনীহা দেখে নাবীহা নিজ হাতে তাকে জোর করে খাইয়ে দিতে শুরু করলো। সাথে বলল-
আমি আগেই বলেছিলাম, খাইয়ে দিই!

এই দৃশ্য দেখে আজিজা বানু বেশ খুশি হলেন। মেয়ের বান্ধবী হিসেবে তার স্বভাবের জন্য নাবীহা কে খুব বেশি পছন্দ করেন তিনি।
.
.
খাওয়া শেষে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আজরা কে মানতাশা জিজ্ঞাসা করলো, ইনতিসার ভাই কী আসবেন না আজ?
-নাহ।
-কেন?
-ওদের ওখান থেকে কেউ আসবে না। আমাদের এখান থেকেও কেউ যাবে না আজ। এমনি কথা হয়েছে।

মানতাশা ভেবেছিল আজ ইনতিসারের বাড়ি যাবে। তারাও এখানে আসবে। নিশ্চয় ইনতিসারের বাড়িতে আসা মেহমানরাও তার মতোই ধনী হবে। কারো না কারো দৃষ্টি আকর্ষণ তো সে করতোই। আর তাই তো এত টাকা খরচ করে এভাবে সেজেছে সে!
এখন ও বাড়ি যাওয়া হবে না শুনে মনটায় খারাপ হয়ে গেল তার।

মানতাশা বলল, এমন কেন হলো? যাওয়া আসাতেই তো মজা। তাছাড়া বর আসলে কত আনন্দ হয়!
-আসলে ওরাই না আসতে চেয়েছে। বিশাল আয়োজন করেছে তারা। নিজেদের মতো সময় কাটাতে চায়। তবে এখান থেকে কেউ যেতে চাইলে যেতে বলেছিল। মা বলল, যাবে না কেউ। যার যার অনুষ্ঠান তারাই করুক। কাল তো সবার দেখা হচ্ছেই।
-আসলেই তাই? না কি ইনতিসারের কোনো ইচ্ছেই নেই? আরেহ বর কাউকে না জানিয়ে বউ এর কাছে এসে সারপ্রাইজ দেয়। ইনতিসারের দেখছি তোর প্রতি কোনো আগ্রহই নেই।
-ওমন কিছু নয়।
-এমন কিছুই। তাই তো পার্টে থাকছে। ধনী ধনী ভাব করছে। ভালোবাসলে এতসব কিছু করতো না।

এই বলে মানতাশা উঠে অন্যদিকে চলে যায়। আজরার ফ্যাকাসে মুখ দেখে তার কাছে আসলো নাবীহা। কী হয়েছে জানতে চাইলে বলল-
ইনতিসার আজ আসবে না শুনে মানতাশা বলছে ওর কাছে না কি আমার কোনো গুরুত্ব নেই। আসলেই কী তাই?

তার কথা শুনে হেসে নাবীহা বলল, সব অনুষ্টানেই কী বরেরা যায়? আর সে হলো বড়ো ব্যবসায়ী। তাদের ওখানে কত মানুষজন আসবেন! তাদের ওয়েট করিয়ে এখানে আসাটা কেমন না!

নাবীহার কথা শুনেও শান্ত হলো না আজরার মন।
নাবীহা তা বুঝতে পেরে বলল-
তুই কবে থেকে মানতাশার কথা কানে নিতে শুরু করলি? তুই তো বলতি মানতাশা কবে কী বলতে হয়, করতে হয় বোঝে না। ওর এসব সিরিয়াসলি নিয়ে লাভ নেই। সেই তুই এখন ওর কথাতেই আজকের দিনে মন খারাপ করছিস?

আজরার ফোন বেজে উঠে। ইনতিসারের ভিডিও কল এসেছে। তা দেখে নাবীহা বলল, দেখলি তো? আসতে না পারলেও তোকে দেখার জন্য ফোন দিচ্ছেন উনি। কথা বল।

এই বলে নাবীহা সরে আসে। আজরা ফোন রিসিভ করতেই তাকে দেখে ইনতিসার বলল, মাশাআল্লাহ!

আজরা খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল, আপনাকেও ভালো দেখাচ্ছে।
-কিন্তু আপনাকে যে এমন ফুলের সাজে প্রকৃতির রানী মনে হচ্ছে। ভাবছি কাল আপনার পাশে আমাকে মানাবে তো!

আজরা কিছু বলার আগে তার থেকে ফোন কেড়ে নেয় মানতাশা। সে বলল, ফোন দিলে হবে? এখানে এসে দেখে যেতে হবে আমার বান্ধবী কে।

মানতাশা কে দেখে চমকে উঠে ইনতিসার। তাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন দেখেছে!
ভাবতেই সেদিন নাবীহার সাথে থাকা মেয়েটির কথা মনে পড়ে। আজ সাজসজ্জার কারণে ভালো করে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে ইনতিসারের। কিন্তু এই মেয়েটিকে সেই মেয়েটির মতোই মনে হচ্ছে।
এমনটি হলে নাবীহার সাথেও কী আজরার কোনো সম্পর্ক আছে!
.
.
আজ গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে সাজির আসবে বলেছে। তাকেও দাওয়াত করা হয়েছে। কিন্তু এতক্ষণেও সে আসছে না কেন!
নাবীহা ফোন করে সাজির কে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করা হয়। কিন্তু ওপাশ থেকে শোনা যায় অন্য একটি কণ্ঠস্বর। যে নিজেকে সাজিরের বন্ধু বলে পরিচয় দেয়। সাজির কোথায় জানতে চাইলে সে এমন একটি সংবাদ শোনায়, যা শুনে পা এর তলা থেকে যেন মাটি সরে যায় নাবীহার।
অস্পষ্ট স্বরে নাবীহা বলল, এটা হতে পারে না! আমার সাজিরের কিছু হতে পারে না!
.

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here