একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব -৩+৪

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৩
#Saji_Afroz

আজ মানতাশা ও এজাজের প্রেমের সম্পর্কের এক বছর পূর্ণ হলো। তাই এজাজ তাকে দেখা করতে বলেছে। যদিও মানতাশার দেখা করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সারপ্রাইজের কথা শুনে না করতে পারলো না সে। এজাজের সাথে দেখা করার জন্যে রেস্টুরেন্টে আসে মানতাশা। এখানেই প্রায় বসে তারা।
আজও মানতাশার আগে এজাজের আগমন ঘটে। তাকে ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করানো মানতাশার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।
সে দেরীতে আসবে জেনেও সঠিক সময়ে চলে আসে এজাজ। যদি কোনোদিন দ্রুত চলে আসে? কবে বেচারিকে একা সময় কাটাতে হবে এই ভেবে এজাজ দেরী করে না।

মানতাশার অপেক্ষা করতে করতে তার দেখা পেল এজাজ।
সাদা রঙের টপস, নীল জিন্স পরে চোখে কালো সানগ্লাস লাগিয়েছে সে।
দেখতে তাকে নায়িকার চেয়ে কোনো অংশে কম ভালো লাগছে না!
চোখের চশমাটা খুলে এজাজের পাশে বসতে বসতে মানতাশা বলল, কতক্ষণ হলো এসেছ?

এক ঘন্টা হয়ে গেলেও এজাজ জবাব দিলো, খুব বেশি সময় হচ্ছে না।
-ওহ!

তারা খাবার অর্ডার করে। খাওয়ার মাঝেই মানতাশা বলল, কী সারপ্রাইজ এর কথা বলছিলে তুমি?
-মা কে তোমার কথা বলেছি। তারা তোমার ছবি দেখে অনেক বেশি পছন্দ করেছে। যেতে চায় তোমার বাসায়।

এজাজ খেয়াল করলো, কথাটি শুনে মানতাশা খুশি হলো না। বরং তার চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে জবাবে সে বলল, কিন্তু তুমি এখনো কোনো জব পাওনি। তোমার কথা বাসায় কীভাবে বলব আমি?

তার কথা শুনে হেসে ফেলে এজাজ। মানতাশা বলল, কী হলো?
-আমি কী বোকা? এতটুক বোধ শক্তি আমার আছে। মা কে এটা বলে থামিয়েছি আমি।
-ভালোই করলে।
-কিন্তু মা তোমার সাথে দেখা করার লোভ থামাননি।
-মানে?
-পাশের শপিংমলেই আছেন মা। তোমাকে দেখতে চান তিনি।

একথা শুনতেই প্রায় লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মানতাশা। সে বলল-
কীসব বলছ? এভাবে হুটহাট! নাহ এটা পসিবল না এখন।
-তোমার পরিবারের কেউ তো জানছে না।
-তবুও…
-মা একটা উপহারও এনেছেন তোমার জন্য। ছেলের হবু বউ কে দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন।

উপহারের কথা শুনতেই শান্ত হলো মানতাশা। আবারও বসতে বসতে বলল, তাই?
-হু। আসতে বলি?

একটু ভেবে সে বলল, বলো।

এজাজ মা কে ফোন করে আসতে বলল। আর এদিকে মানতাশা ছটফট করতে থাকে সেই উপহারের জন্য। তার যে আজরার সেই নেকলেসটি চোখে ভাসছে!
.
.
.
অফিসে যাওয়ার জন্যে বেরুচ্ছে ইনতিসার। তার পথ আটকালেন ইলারা জামান। ইনতিসার বলল, কিছু বলবে?

তিনি ইনতিসারের ফোন চায়। ইনতিসার বলল, তোমার ফোনে ব্যালেন্স নেই?
-থাকলেও তোরটা চাইতে পারি না? না কি পারসোনাল কিছু আছে?
-কি যে বলো না মা!

এই বলে মা এর দিকে ফোন এগিয়ে দেয় ইনতিসার। তিনি কী যেন টাইপ করে ছেলের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন। ইনতিসার প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন, হবু বউ এর ফোন নাম্বার দিলাম। লজ্জায় চাইতে পারছিস না বুঝেছি তো।

ইনতিসার লাজুক হাসি দেয়।
ইলারা জামান বললেন, ফোন দিস মেয়েটা কে। আমি তো বলি একদিন বের হও তোরা। ঘুরে আয় কোথাও থেকে।
-সপ্তাহ খানেক পরেই তো বিয়ে। এখন থাক না!
-বিয়ের আগে ও পরে একটা আলাদা ব্যাপার স্যাপার আছে না?
-তুমিও না মা!
-কী?
-এইজন্যই বাবা বলে, তুমি অনেক রোমান্টিক।

মা এর সাথে খানিকক্ষণ দুষ্টুমি করে গাড়িতে গিয়ে বসে ইনতিসার। স্ক্রিনে থাকা আজরার ফোন নাম্বারের দিকে তাকায় সে। ভালোই হলো মা নাম্বারটা দিয়েছে। জীবনসঙ্গিনী যে হবে তাকে নিয়েই ভাবা উচিত। কথা বলে সময় পার করা উচিত। নতুবা নাবীহার চিন্তা মাথা থেকে ফেলতে পারবে না সে!
এই ভেবে আজরার নাম্বারে ডায়াল করলো ইনতিসার। কিন্তু বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরেও ফোন রিসিভ করে না সে।
এখনো ঘুমিয়ে আছে না কী মেয়েটা?
.
.
.
এজাজের মা ও বোন কে দেখে ‘হ্যালো’ বলে জড়িয়ে ধরলো মানতাশা।
এজাজের মা আসমা আক্তার ভেবেছিলেন, মানতাশা তাকে সালাম জানাবে। তবে এতেও তিনি অখুশি হলেন না। বরং তিনিও বুকে টেনে নিলেন মানতাশা কে।
তবে এজাজের ছোটো বোন এলিজার বিষয়টির সাথে সাথে তার পোশাকও পছন্দ হলো না। তবুও তা বুঝতে না দিয়ে মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করলো সে।
তারা বসে কিছুক্ষণ গল্প করলো। এরপর আসমা আক্তার একটি লাল রঙের ছোটো বাক্স তার ব্যাগ থেকে বের করলেন।
বাক্স দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে চেইন অথবা রিং রয়েছে। তাতেই এক দফা মন খারাপ হয়ে যায় মানতাশার। তিনি যখন বাক্সটি খুললেন, মন খারাপের সাথে সাথে চরম বিরক্তও হলো সে। কারণ সেখানে একটি ছোট্ট স্বর্ণের চেইন দেখা যাচ্ছে। আদৌ সোনার কী না মানতাশা বুঝতে পারছে না।
তিনি চেইনটি মানতাশার গলায় পরিয়ে দেন। কিন্তু মানতাশা ভাবলেশহীন ভাবে বসে থাকে। তাকে ধন্যবাদ অবধি জানালো না সে।
তাই তিনি নিজেই জানতে চাইলেন, পছন্দ হয়েছে তোমার?

না চাইতেও হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো মানতাশা। তিনি আবারও তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তাড়াতাড়ি আমার ছেলেটা জব পেয়ে নিক। তোমাকে নিয়ে আসব কাছে।
.
.
.
রেস্টুরেন্টে থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরছে মানতাশা। পথিমধ্যে তার দেখা হয়ে যায় নাবীহার সাথে। নাবীহা কে দেখে ডাক দেয় সে। নাবীহা তার ডাকে সাড়া দিয়ে বলল, কোথা থেকে আসছিস?
-এজাজের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তুই?
-ইন্টারভিউ আছে। দিতে যাচ্ছি। সকালে নাস্তা করিনি। তাই ভাবলাম ঝাল কিছু কিনে নিই, পথে খাব।
-পথে কেন? আয় বসি কোথাও। আমি খাওয়াব তোকে।
-আমি কিনে ফেলেছি। তাছাড়া এত সময় নেই!

মানতাশার গলার দিকে তাকিয়ে নাবীহা বলল-
নতুন চেইন কিনলি কবে?
-কিনিনি। এজাজ তার মা কে এনে আজ সারপ্রাইজ দিলো আমায়। উনিই দিয়েছেন এটা। আর বলেছেন এজাজ জব পেলে বাসায় প্রস্তাব পাঠাবেন।

নাবীহা খুশি হয়ে বলল-
কত ভাগ্যবতী রে তুই!

বিরক্তির সুর নিয়ে মানতাশা বলল-
ভাগ্যবতী না কি ছাই! আমার গলায় এই চিকন চেইনটা মানিয়েছে? গতকাল আজরা কী সুন্দর একটা নেকলেস পেল। আর আমি কি না এই চিকনা চেইন।
-যার সামর্থ্য যেমন। তাছাড়া ভালোবাসার মানুষের দেওয়া উপহার নিয়ে আমাদের খুশি থাকা উচিত। এই দেখ, আমাকে সাজিরের মা কী দিয়েছেন?

এই বলে আঙুল দেখিয়ে নাবীহা বলল, এই আংটি টা। সুন্দর না?

ব্যাঙ্গসুরে মানতাশা বলল, ইনতিসার কে বাদ দিয়ে কেন যে এই প্রস্তাবে রাজি হলি তুই! সব সুখ তো এখন আজরা ভোগ করবে।

মুচকি হেসে দুষ্টুমির ছলে নাবীহা বলল-
তোর যেন আমার জন্য দুঃখ হচ্ছে?
-হচ্ছেই তো।
-তবে আজরার জন্য খুশি না তুই? সেও আমাদের বান্ধবী।

ও কিছু বলার আগেই সাদাত এসে হাজির হয়।

সাদাত…
নাবীহার এলাকার বড়ো ভাই। অনেকদিন যাবত তাকে বিরক্ত করছে।
নাবীহার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে পাগলপ্রায় সে। নাবীহা কে দেখেই সে ছুটে আসে। তাকে দেখে বিরক্তির আভা ছেয়ে যায় নাবীহার চোখেমুখে। সে মানতাশা কে তাড়া দিয়ে বলল, চল এখান থেকে।

সাদাত তাদের পথ আঁটকে বলল, বিয়ে আমি হতে দেব ভাবলে কীভাবে? এই এলাকা থেকে তো তুমি বউ সাজে অন্য ঘরে যেতে পারবে না।

মানতাশা রাগে কটমট করতে করতে বলল, এলাকা তোর বাপের না কি?

এতে সাদাতও রেগে গিয়ে জবাব দেয়-
বাপ নিয়ে কথা বললি কেন? মুরুব্বিদের টানলি কেন তুই? সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানিস না?

-তুমি জানো না মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়?

ইনতিসার কে দেখে মানতাশা ও নাবীহা দু’জনেই চমকায়।
সাদাত তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কে?

জবাবে ইনতিসার বলল, আমি যেই হই। তোমাকে বছরের বছর জেল হাজতে রাখার ক্ষমতা আমি রাখি।

ইনতিসারের পোশাক-আশাক ও কথা বলার ধরণ দেখেই বখাটে সাদাত ঘাবড়ে যায়।
সে মিনমিনে স্বরে বলল, বাইরের এলাকায় এসে মাতব্বরি করছ?

শান্ত ভাবেই ইনতিসার বলল, পুলিশে ফোন দিয়েই তবে জিজ্ঞাসা করি এই এলাকায় এসব চলে কি না?

সাদাত আমতাআমতা করে বলল, ওসবের প্রয়োজন নেই। আমি শুধু আমার মনের কথাটা নাবীহা কে জানাতে এসেছি৷ ও রাজি না হলে থাক। সমস্যা নাই। গেলাম আমি!

এই বলে দ্রুত প্রস্থান নেয় সাদাত। নাবীহা ধন্যবাদ জানায় ইনতিসার কে। মানতাশা কিছু বলতে চাইলে তার হাত চেপে ধরে নাবীহা। তাকে তাড়া দিয়ে বলল, আয় তো আমার সাথে।

কারণ নাবীহা জানে, এখুনি এখানে মানতাশা কিছু বলে পরিস্থিতি গড়বড় করে ফেলবে।

ইনতিসার তাদের উদ্দেশ্যে বলল, একটু শুনুন?

বাধ্য হয়ে থামতে হয় নাবীহা কে। সে পেছনে ফিরতেই ইনতিসার বলল, বাসায় পৌঁছে দেব আপনাদের?
-তার দরকার নেই!

এই বলে সে মানতাশার হাত ধরে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো। মানতাশা বলল, আরেহ দুলাভাই কে আমাদের পরিচয়টা অন্তত দিতাম?
-সময় হলে দেব। চল এখন!

ইনতিসারের ফোন বেজে উঠলো। দেখলো, আজরার ফোন এসেছে।
নাবীহা কে দেখে এক মুহুর্তের জন্য আজরার কথা ভুলেই গিয়েছিল সে।
মাথাটা ঝেড়ে ফোন রিসিভ করে ইনতিসার। ওপাশ থেকে সালাম জানিয়ে আজরা তার পরিচয় জানতে চায়। ইনতিসার পরিচয় দিতেই সে বলল, দুঃখিত! আসলে ফোন যে কখন সাইলেন্ট হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি! কেমন আছেন আপনি?
-ভালো। আপনি?
-আমিও ভালো। হঠাৎ ফোন?
-ভেবেছিলাম আজ বেরুবো আপনাকে নিয়ে। যদি আপনার অসুবিধা না থাকতো আরকি। কিন্তু আপনি ফোন রিসিভ না করাতে একটা কাজ দিয়ে ফেলেছি। ওটাতে মাস্ট থাকা লাগবে আমার।

কথাটি শুনে আজরার নিজের উপরে রাগ হয়। কেন যে ফোনটা হাতের কাছে ছিল না! সে বলল, সমস্যা নেই। অন্য একদিন হবে।
-বোঝার জন্য ধন্যবাদ।

এই বলে তাড়া দিয়ে বিদায় জানিয়ে ফোন রাখে ইনতিসার। সাথে সাথেই মানতাশার ফোন আসে।

নাবীহা ইন্টারভিউ এর উদ্দেশ্যে গেলে বাড়ির দিকে রওনা হয় মানতাশা। গাড়িতে বসেই সে ফোন দেয় আজরা কে। আজরা রিসিভ করতেই সে বলল-
আজ কী হলো জানিস?
-কী?
-ওই যে সাদাত? সে নাবীহা কে ডিস্টার্ব করতে আসে।
-তারপর!
-সেখানে নায়কের মতো এন্ট্রি নেয় ইনতিসার।

অনেকটা অবাক হয়ে আজরা বলল-
ইনতিসার?
-জি।
-ও কীভাবে গেল?
-মনের টানে! আর যাই বলিস, আমি তার চোখে নাবীহার জন্য যা দেখেছি না!
-কী দেখেছিস?
-ভালোবাসা রে।

কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে আজরা বলল-
ফাজলামো কম কর।
-শুধু কী তাই! নাবীহা কে সে দাঁড়াতেও বলেছিল। কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু নাবীহার ইন্টারভিউ নিয়ে তাড়া ছিল বলে দাড়ায়নি। তাছাড়া পৌঁছেও দিতে চেয়েছিল ইনতিসার। তুই বল? কেয়ার না থাকলে এমন করে?
-কেমন?
-প্রথমে সাদাত থেকে বাঁচানো এরপর বাড়িতে পৌঁছে দিতে চাওয়া…

আরও কিছু বলতে চাইছিল মানতাশা। কিন্তু আজরা মা আসার অজুহাত দেখিয়ে ফোনের লাইন কেটে দেয়।
এসব শুনে আজরার মনের কোণে মেঘ জমতে শুরু করে। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় সে। একটু আগেই তো ইনতিসারের সাথে তার কথা হয়েছে। সে তার সাথেই বেরুতে চেয়েছে। নাবীহার জায়গায় অন্য মেয়ে থাকলে নিশ্চয় এমনি করতো ইনতিসার।
এই ভেবে নিজেকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত আজরা।

এদিকে কাজের বাহানায় বেরুনোর প্লান বাতিল করলো ইনতিসার। এমনটা কেন করলো নিজেরই ধারণা নেই তার। শুধু জানে, এই মুহুর্তে তার ভালো লাগছে কিছুই!

রিকশায় বসে শরীরে হাওয়া লাগিয়ে আপনমনে হেসে চলেছে মানতাশা।
এতবড়ো ঘরে আজরার বিয়ে হচ্ছে এটা যেন মানতেই পারছে না সে। এমন কারো যোগ্য তো সে। আজরা নয়। তবে কেন আজরা ওই বাড়ির বউ হবে!
তার কপালে যখন এমন কিছু লেখা নেই, আজরার কপালের লেখাও মুছে ফেলতে চায় সে।
.
চলবে#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৪
#Saji_Afroz

বাসায় এসে আবারও আজরা কে ফোন দেয় মানতাশা। আজরা না চাইতেও ফোন রিসিভ করলো। মানতাশা বলল, তখন আমার কথা শেষ হয়নি তো।
-তুই যে কীসব বলিস না মানতাশা! ইনতিসারের মনে এমন কিছু নেই। জানিস? আজ সে আমায় ফোন করেছে। বাইরে যাওয়ার কথা বলেছে।
-ওহ! কবে বেরুচ্ছিস?
-হ্যাঁ?
-বললাম কবে বের হচ্ছিস?

আমতাআমতা করে আজরা বলল-
ওর আবার কাজ পড়ে গেছে।
-সবই বাহানা।
-মোটেও এমনটা না! আমিই ফোন রিসিভ করিনি। তাই কাজের শিডিউল দিয়ে ফেলেছে।
-আমি তোকে এখন ইনতিসারের কথা বলতে ফোন করিনি।
-তবে?
-নাবীহার মনের অবস্থা জানাতে করেছি।
-ওর মনের অবস্থা তুই বুঝেছিস কীভাবে?
-তোর টা কী বুঝছি না? এই যে তুই এখন ইনতিসার কে নিয়ে ভাবছিস।
-আর নাবীহা?
-সেও ইনতিসার কে নিয়ে ভাবছে।

এইবার চিন্তার ভাজ পড়ে আজরার কপালে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, খুলে বল তো সব?
-আমি শিওর, আজ ইনতিসার কে সরাসরি দেখে ওর বড্ড আফসোস হচ্ছে। কথার মাধ্যমে সেটা তো কিঞ্চিৎ প্রকাশও করে ফেলেছে।
-কিন্তু ও তো সাজির কে পছন্দ করে।
-তখন ইনতিসার কে দেখেনি তাইনা! দেখার পর ওর চোখেমুখে যে আফসোস টা আমি দেখেছি না! তোর সাথে বিয়ে ঠিক না হলে নিশ্চয় ও ইনতিসারের কে হ্যাঁ বলে দিতো।
-এমনটা মনে হয়েছে তোর?
-হু। আমার মনে হয় এই ব্যাপারে তুই বরং ইনতিসারের সাথে কথা বল।
-কী বলব?
-যে ও সত্যি তোকে পছন্দ করে কী না নাবীহা কে। বিয়ের আগেই সবটা পরিষ্কার হয়ে নে।

এই বলে বিদায় জানিয়ে ফোন রাখে মানতাশা। সে জানে, আজরা সহজ সরল একটা মেয়ে। এসব কথা নিমিষেই বিশ্বাস করে ফেলেছে। আর এখন সে যদি ইনতিসারের সাথে এসব নিয়ে কথা বলে, নিশ্চয় বিষয়টা পছন্দ করবে না ইনতিসার। হতে পারে নাবীহা তার বান্ধবী জেনে নিজ থেকে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে সে!
নিজের বুদ্ধির প্রশংসা নিজেই করলো মানতাশা। আজরা ও ইনতিসারের বিয়েটা ভেঙে গেছে, এটা শোনার অপেক্ষায় আছে সে।
.
.
মন খারাপের মাঝেই সারাটা দিন পার হয় আজরার। কানে সারাক্ষণ মানতাশার বলা কথাগুলো বাজছে। মনটা বড্ড অশান্ত হয়ে আছে।
মানতাশার কথামতো ইনতিসার কে ফোন করতে চাইলেও করলো না আজরা।
সে সিদ্ধান্ত নিলো, নাবীহার বাসায় যাবে। তাকে সবটা বলবে। নাবীহা কী চায় সেটা জানবে। সত্যিই যদি ইনতিসার কে নাবীহার পছন্দ হয়, তবে সে এই বিয়েটা করবে না।

এই ভেবে নাবীহার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় আজরা।

যা গরম পড়ছে! এই বিকেলেও গরমের উত্তাপ রয়েছে দেখে বিরক্ত হয় আজরা। খেটে-খাওয়া মানুষ যে কীভাবে এই গরমে কষ্ট করে! এসব ভেবে উদাসীন হয়ে উঠলো আজরা। নেহাতই সে নরম মনের মানুষ। তাই তো মানতাশার বলা কথাগুলো এতটা ভাবাচ্ছে তাকে!
.
.
আলমারি গোছাচ্ছেন আসমা আক্তার। তার পছন্দের গোলাপি রঙের কাতান শাড়িটা হাতে নিতেই মানতাশার কথা মনে হলো। এই শাড়িটা তাকে বেশ মানাবে। এই বাড়িতে আসলে তাকে শাড়িটি দেবেন।
মনে মনে এসব ভাবলেন তিনি।
ঠিক তখনি এলিজা আসে মা এর রুমে। মা এর হাতে শাড়িটি দেখে বলল, তোমার এই শাড়িটা অনেক সুন্দর।
-তাই না? কত বছর আগের শাড়ি কিন্তু ডিজাইন দেখেছিস? তখনই অনেক দাম দিয়ে নিয়ে দিয়েছিলেন তোর বাবা এইটা।
-আমার কলেজে প্রোগ্রাম আছে। ভাবছি এটা পরব।

আসমা আক্তার একটু থেমে বললেন, অন্য একটা পরিস। এটা না।

এলিজা ভ্রু কুচকে বলল-
কেন?
-কারণ এটা আমি মানতাশা কে দেব ঠিক করেছি।
-বউ হয়ে আসেনি এখনো। এখন থেকেই এত আদর!
-হ্যাঁ। আমার বউ মার জন্যে সব ঠিক করে রাখছি। ক’টা দিনের ব্যাপার আর!
-কিন্তু তোমার বউ মা যে এই পুরাতন শাড়ি পেয়ে খুশি হবে তুমি জানো?
-তাকে কী আমি পুরাতন শাড়িই শুধু দেব না কি? এটা আমার স্মৃতি হিসেবে দেব। ওকে বেশ মানাবে এটি।

এলিজা কে নিশ্চুপ দেখে আসমা আক্তার বললেন-
রাগ করলি?
-নাহ। ভাবছি।
-কী?
-মানতাশা আপু যথেষ্ট সুন্দর এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু উনাকে আমার কেমন যেন ভালো লাগেনি।
-কেন? আমার তো বেশ লেগেছে।
-পোশাক দেখেছ তার?
-জানতো না আমরা যাব। বিয়ের পর ওসব ঠিক হয়ে যাবে।
-আচরণও কেমন যেন! তুমি চেইন পরিয়ে দিলে অথচ মুখে হাসি ছিল না তার। মনে হয়েছে আরও বড়ো কিছু আশা করেছিল!
-ধুর! হুট করে সব ঘটে গিয়েছে। তাই হয়তো নার্ভাস ছিল।
-কী জানি! আমার যা মনে হয়েছে বললাম।
.
আড়াল থেকে এসব শুনে এজাজ। এলিজার কথা একেবারেও ফেলে দেওয়া যায় না। আসলেই মানতাশার মুখে হাসি সে দেখেনি। বরং দেখেছে তার বিরক্তি ভাব! নার্ভাস আর বিরক্ত দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। মানতাশা নার্ভাস হওয়ার মেয়ে নয়।
এজাজ ভাবতো, পরিবারের সাথে সাক্ষাত করালে মানতাশা খুশি হবে। প্রত্যেক সম্পর্কে একটা মেয়ের তো এটাই চাওয়া থাকে! সেই জায়গায় এজাজের মা তাকে সাদরে গ্রহণ করে চেইনও পরিয়ে এসেছে। তবুও কেন মানতাশা খুশি হতে পারলো না!

এজাজ নিজের রুমে ফিরে আসে। ফোন দেয় মানতাশা কে। সে রিসিভ করলে এজাজ বলল, সারাদিন আর কোনো খবর নিলে না?
-কী খবর নেব?
-আজ মা আর এলিজা দেখা করলো তোমার সাথে। তাদের সাথে পরিচিত হয়ে কেমন লাগলো জানাবে না?
-জানতে চেয়েছ তুমি?

কথা না বাড়িয়ে এজাজ বলল, আচ্ছা বলো এখন।
-ভালোই। আচ্ছা শোনো, চেইনটা কী গোল্ড এর না কী গোল্ড প্লেটের?
-তোমার কী মনে হয়? মা তার পুত্রবধূর জন্য সিটি গোল্ড এর চেইন যত্ন করে রেখেছেন?
-সিটি গোল্ড কই বললাম! চকচক করছে দেখেই গোল্ড প্লেট বলেছি।
-গোল্ড এর সেটা।
-ও আচ্ছা।
-পছন্দ হয়েছে তোমার?
-চেইন তো চেইনই! পছন্দ হওয়ার আর কী আছে। হার হলে নাহয় ডিজাইন দেখে বলতাম।
-সেসবও হবে। বিয়ে টা তো ঠিক হতে দাও। তারপর দেখো কী কী হয়। আমার বউ কে আমি সেভাবে আনব না?

কী হবে! ছাই! আজরার ওই নেকলেসের মতো নেকলেস দিতে এজাজের সারাজীবন লেগে যাবে।
মনে মনে এসব ভেবে হতাশ হতে লাগলো মানতাশা।
.
.
.
নাবীহার বাসায় আসতেই চমকায় আজরা।
ড্রয়িংরুমটা সাজানো। ঘরের সবাই বেশ পরিপাটি হয়ে রয়েছে। সাথে রয়েছে সাজিরের পরিবার। এখানে কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে।
নায়লা খাতুন তাকে দেখে এক গাল হেসে বললেন, আরে আজরা যে!

তাকে সালাম জানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আজরা। আজরা কে উপস্থিত কম বেশি সকলেই চেনে। অনেকদিন বন্ধুত্ব কী না তার নাবীহার সাথে!
নায়লা খাতুন বললেন, তুমি আসবে নাবীহা তো বলেনি।
-আমি আসলে বলে আসিনি। আমি কী অসময়ে চলে আসলাম?

নাবীহা তার ছোটো বোন নাফিসা কে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আজরা কে দেখে অবাক হয়ে বলল সে, আজরা তুই!
-আমি আসলে এমনেই এসেছিলাম।
-বেশ করেছিস। আজ নাফিসার জন্মদিন।
-ও আচ্ছা! আমি তো জানতামই না। শুভ জন্মদিন নাফিসা।

নাফিসা তাকে ধন্যবাদ জানালে আজরা বলল, আমি জানলে কখনোই খালি হাতে আসতাম না। তবে তোমার উপহার অবশ্যই পাবে তুমি।

নাবীহা বলল, কী যে বলিস না! আমাদেরও কোনো প্লান ছিল না। হঠাৎ ফুফু কেক নিয়ে চলে আসে। তারাই হুট করে সব আয়োজন করলো। নাহয় আমিও কী তোদের বাদ দিয়ে কোনো আয়োজন করি?

সাজির এসে বলল, বান্ধবীর সাথে কথা পরে। আগে আমার হবু শ্যালিকার কেক কাটা হোক?

মিষ্টি করে হেসে নাবীহা বলল, নিশ্চয়।

সবাই মিলে কেক কাটার পর্ব শেষ করলো। সাজির ও নাবীহা একইসাথে কেক খাইয়ে দেয় নাফিসা কে। এরপর তারা একে অপরকে কেক খাইয়ে দিলো।
তাদের একত্রে বেশ মানিয়েছে।
তাছাড়া দুই পরিবারের মিল মহব্বত দেখে বেশ ভালো লাগলো আজরার।

খানিকবাদে নাবীহা আজরা কে তার রুমে নিয়ে যেতে চায়। সাজির ইশারায় তাকে যেতে বারণ করে। নাবীহা বলল, এখন তোমার সময় শেষ। আমার বান্ধবী এসেছে না!

এই বলে আজরা কে নিয়ে রুমে চলে আসে সে। নাবীহা বলল, বল আর কী অবস্থা তোর? শপিং শুরু করলি তো?

এসব দেখে আজরা তার সিদ্ধান্ত বদলায়। সাজিরের সাথে হাসিখুশিতে আছে নাবীহা। মানতাশা না বুঝেই কথাগুলো বলেছে। মানতাশার কথার উপরে ভিত্তি করে নাবীহা বা ইনতিসার কে কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবে না।
নাবীহা সাজির কে নিয়ে ভালো আছে। ইনতিসারও তার সাথে পথ চলতে চায়। তবে আর পুরাতন কথা নিয়ে ভেবে কী হবে?

মাথা থেকে সবটা ঝেড়ে আজরা বলল, খুব তাড়াতাড়ি শুরু করব। তোর খবর বল?
-সাজির তো বিয়ে করতেই চায়। কিন্তু আমি চাইছি যেহেতু সে নতুন জব পেয়েছে একটু সময় নিক। এরমধ্যে আমিও জব খুঁজে নিই।
দু’জনে নিজের পা এ দাঁড়াই। এরপর চুটিয়ে সংসার করব।

কত সুন্দর পরিকল্পনাও করে রেখেছে নাবীহা। অথচ সে কী না নাবীহার কাছে বিব্রতকর প্রশ্ন করতে এসেছিল! ভাবতেই নিজের উপরে রাগ হলো আজরার।
.
.
.
সন্ধ্যায় টেবিলে বসে নাস্তা করছে মানতাশা। তার গলার দিকে চোখ যেতেই মরিয়ম বেগম বললেন, এই চেইন কই পেলি তুই?

মা এর কথা শুনে চমকে উঠলো সে। ভুলবশত চেইনটা খুলে রাখা হয়নি।
সে আমতাআমতা করে বলল, গোল্ড প্লেটের এটা। কিনেছি আজ। সুন্দর না?

মরিয়ম বেগম নুডলস খেতে খেতে বললেন, আমি ভাবলাম কেউ দিয়েছে। এমন কেউ থাকলে বলতে পারিস। তোর বাবার সাথে কথা বলব। বিয়ের বয়স তো হলোই।

এজাজের কথা বললে নিঃসন্দেহে তার পরিবার মেনে নেবে, এতে শতভাগ নিশ্চিত মানতাশা। কারণ তার ভালো সিদ্ধান্ত কে সবসময় গুরুত্ব দেয় পরিবার।
এজাজ শিক্ষিত ছেলে। এটা শুনেই যে তারা গুরুত্ব দেবেন জানে সে। চাকরির জন্য সময়ও দেবেন। কিন্তু সে এখনই এজাজের সম্পর্কে কিছু বলতে চায় না। কারণ মানতাশার ইদানীং মনে হচ্ছে, এজাজ নয় বরং ইনতিসারের মতো কেউ তার যোগ্য। এমন কারো জন্যে অপেক্ষা করতে ক্ষতি কী!
.
.
.
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো আজরা। সিদ্ধান্ত নিলো, বিয়েটা করবে সে। অতীত নিয়ে পড়ে থাকা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। ইনতিসারের সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চায় সে। এটা অস্বীকার করা যায় না, এখন থেকেই ইনতিসারের প্রতি আলাদা টান অনুভব করছে সে। তার সাথেই সংসার জীবনে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক আজরা।
এই ভেবে চোখ জোড়া বন্ধ করলো সে। ঘুম পাচ্ছে তার ভীষণ। শান্তির ঘুম….
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here