#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮।
‘এত ঝাল কেন দিচ্ছ?’
‘কেন, আপনি ঝাল খেতে পারেন না।’
‘পারি, কিন্তু এতটাও না। তুমি তো একগাদা মরিচ দিয়ে দিয়েছ।’
‘মুরগী মাংস একটু ঝাল ঝাল না হলে হয়?’
‘আচ্ছা, হয়েছে। তুমি এবার সরে এসো। বাকি রান্নাটা আমি শেষ করছি।’
‘না, আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখুন। আমি রান্না করব।’
অর্ণব পৃথাকে জোর করেও রান্নাঘর থেকে বের করতে পারে না। পৃথাই সব রান্না করে। অর্ণব পাশে দাঁড়িয়ে তাকে টুকটাক সাহায্য করে। সেই পুরোনো মুহূর্তগুলো অর্ণবের খুব মনে পড়ে তখন। আগে কীভাবে রান্না করার সময় পৃথাকে জ্বালাত। মেয়েটা রেগে গিয়ে খুনতি হাতে অর্ণবের পিছে ছুটত। হয়তো, আবার পৃথা আগের মতো হবে। আগের স্মৃতি মনে না পড়লেও, নতুন করে হয়তো শুরু হবে সবকিছু। হোক, তাতেও খারাপ কী? পুরোনো ভালোবাসা নতুন করে, নতুন রূপে ফিরবে।
দু’দিন স্বাভাবিক ভাবেই কেটে যায়। এই দু’দিনে অর্ণবের সাথে পৃথার সম্পর্কটাও বেশ জমেছে। সারাক্ষণ দুজনের খুনশুটি যেন চলতেই থাকে। পৃথাও তার এই নতুন জীবনে খুব খুশী। অর্ণবের ব্যবহার তাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। ছেলেটাকে যত দেখে, অবাক হয়। এত কেন যত্ন নেয় সে? সারাক্ষণ পৃথাকে নিয়ে অস্থির থাকে। সেদিন পৃথা একবার বমি করাতেই কী পাগলামীটাই না শুরু করেছিল। এত ভয় কিসের? একবার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে বলে কি তার এত ভয়? হয়তো সে তার প্রথম স্ত্রীকেও এইভাবেই ভালোবাসত। সে তাকে ভুলে যাওয়ায় মনে হয়তো তার খুব কষ্ট জমে আছে। তাই এখন পৃথাকে ও হারাতে সে এত ভয় পায়।
,
আজ বিকেলে পৃথার শরীরটা একটু বেশিই খারাপ করে। অর্ণব সেই সময় বাইরে ছিল। পৃথা প্রথমে এটাতে এত গুরুত্ব না দিলেও পরে শরীর খারাপ আরো বাড়ে তার। কেমন একটা অশান্তি লাগে। সে অস্থির হয়ে এই রুম ঐ রুম পায়চারি করে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না যেন। বিরক্ত হয়ে অর্ণবকে কল দেয়। অর্ণব কল রিসিভ করলে সে বলে,
‘এক্ষুনি বাসায় আসুন, আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে।’
কথার বলার পনেরো মিনিটের মধ্যে অর্ণব ছুটে বাসায় আসে। পৃথা দরজা খুলতেই সে বিচলিত হয়ে বলতে থাকে,
‘কী হয়েছে? আবার বমি পাচ্ছে? পেটে ব্যথা করছে না তো? মাথা ব্যথা করছে নাকি?’
পৃথা মুখ কালো করে বলল,
‘জানি না। বুঝতে পারছি না কিছু। শরীর যেন কেমন করছে, অস্থির অস্থির লাগছে। কোনো ব্যথা নেই, তাও শরীরটা খারাপ লাগছে কেন বুঝতে পারছি না।’
অর্ণবের চোখে মুখের অস্থিরতা রেশ কাটে না। সে কী করে পৃথাকে বলবে, এই সময় এমন একটু আধটু হয়। কিন্তু, ব্যাপারটা তো আর লুকিয়েও রাখা যাচ্ছে না। অর্ণব পৃথার কাছে যায়। দু’হাত গালে স্পর্শ করে বলে,
‘খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করছো না বলে হয়তো শরীর দূর্বল লাগছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আরো খাব? দেখুন, এমনিতেই কত মোটা হয়ে যাচ্ছি। আমার পেটটাও ইদানিং খুব বড়ো হয়ে যাচ্ছে। তাই ভাবছিলাম বেল্ট ইউজ করব। আমাকে একটা বেল্ট এনে দিবেন?’
‘না, একদম না। কোনোকিছু ইউজ করবে না তুমি। হোক পেট বড়ো। পেটে একদম হাত দিবে না।’
পৃথা ঠোঁট গুঁজ করে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলে,
‘পেট বড়ো হলে ভালো লাগবে না তো। আচ্ছা, শুধু কিছু ব্যায়াম করব।’
অর্ণব তাকে বুঝিয়ে উঠতে পারছে না। সে পৃথাকে নিয়ে রুমে যায়। পৃথাকে বিছানায় বসিয়ে সেও পাশে বসে। অসহায় সুরে বলে,
‘একটা কথা রাখবে, পৃথা?’
‘কী, বলুন।’
‘চলো আমরা একটা বাচ্চা নেই।’
পৃথা যেন আকাশ থেকে পড়ল। কোন কথা থেকে সে কোন কথাই চলে গিয়েছে। সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। খানিক বিরক্ত সুরে বলে,
‘এখানে বাচ্চা নেওয়ার কথা আসছে কোথ থেকে?’
অর্ণব জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে। অতঃপর বলে,
‘আমার একটা বাচ্চার খুব শখ। আর তাই আমি লেইট ও করতে চাইছি না। তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, একটা বাচ্চা হলে আমাদেরই লাভ। তুমি তখন সেই বাচ্চার উসিলায় তোমার বাবাকেও বোঝাতে পারবে। তখন দেখবে তোমার বাবাও আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবেন। তাই প্লিজ পৃথা, না করো না।’
‘আশ্চর্য, আমাদের বিয়ের কেবল দুই কী তিন দিন হয়েছে; আর আপনি এখনই বাচ্চা নেওয়ার কথা বলছেন? হুট করে এই চিন্তা কীভাবে আপনার মাথায় এল?’
‘এখানে খারাপের কী আছে? বিয়ের পর তো মানুষ ফ্যামিলি প্ল্যানিং করেই থাকে, তাই না? আমাদেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন একটা বাচ্চা হলেই, আমাদের পরিবার সম্পন্ন হবে। এটা নিয়ে এত বিচলিত হওয়ার কী আছে?’
পৃথা থ মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। অর্ণব তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘আমি বুঝতে পারছি, তোমার কাছে এখন এই ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু, আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলে আমাদেরই লাভ। এখন তুমি যা বলবে তাই হবে।’
পৃথা শক্ত গলায় বলল,
‘আমি তো এখন বাচ্চা নিব না। আমি ভেবেছিলাম, বিয়ের পর আপনার কাছে এসে আমার নিজের মতো একটা জীবন পাব, আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব। ভেবেছিলাম, আপনিও আমার পাশে থাকবেন। তা না, বিয়ের দু’দিনের মাথায় আপনি আমাকে বাচ্চার কথা বলছেন? যেই পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়েটা হয়েছে, সেই পরিস্থিতির সাক্ষেপে আপনি কীভাবে হুট করে বাচ্চা নেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেন? আপনার সাথে আমার ঐরকম ভাবে ঘনিষ্ঠ কোনো সম্পর্কই তৈরি হয়নি। কেবল বন্ধুত্ব হয়েছে, আস্তে ধীরে হয়তো সবকিছু নরমাল হবে। কিন্তু, আপনি এখনই এত তাড়া দিচ্ছেন কেন?’
অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। পৃথাকে বোঝানোর সাধ্য এখন তার নেই। এই মেয়ে যে তার এই সিদ্ধান্ত ভুলেও গ্রহণ সেটা সে আগেই জানতো। এখন কী করবে? কীভাবে প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা সে পৃথাকে বলবে? সে মাথায় হাত রেখে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ে। পৃথা তাকিয়ে থাকে তার দিকে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘এখন এর জন্যও আপনি আমার সাথে রাগ করবেন?’
অর্ণব মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলল,
‘রাগ করলাম কোথায়?’
‘তাহলে এভাবে শুয়ে পড়লেন কেন?’
‘এমনি।’
‘শুতে হবে না, উঠুন। আমাকে নিয়ে ঘুরতে যান। ঘুরতে গেলে মনটা একটু ভালো লাগবে।’
অর্ণব উঠে বসে। পৃথাকে বলে,
‘ঠিক আছে, যাও। তুমি গিয়ে রেডি হও।’
বাইরে গিয়েই পৃথা বায়না করল, সে নাকি ফুচকা খাবে। কিন্তু, এই সময় বাইরের এসব খাবার শরীরের জন্য ভালো হবে না বলে, অর্ণব তাকে বারণ করে। কিন্তু, এই মেয়ে কি আর সহজেই তার বারণ শোনার পাত্রী। সে জেদ ধরে বসে, আজকে ফুচকা না খেয়ে সে আর বাড়িই ফিরবে না। একপর্যায়ে বউয়ের কাছে পরাজিত হয়ে অর্ণব তাকে নিয়ে ফুচকা খেতে যায়। রিক্সা থেকে নেমেই পৃথা ছুটে যায় ফুচকাওয়ালার দোকানে। ঝাল দিয়ে এক প্লেট ফুচকা দিতে বলে। অর্ণব এসে বলে,
‘মামা, একদম কম ঝাল দিবেন না।’
পৃথা বাঁকা চোখে চেয়ে বলে,
‘আমি আমারটাতে বেশি ঝাল দিতে বলেছি, আপনারটা কম ঝাল দিয়েই বানাবে।’
‘না মামা, দুজনেরটাই কম ঝাল দিয়ে বানাবেন। বেশি ঝাল খেলে পেটে অসুখ হবে।’
পৃথা জেদ দেখাতে গিয়ে উল্টো অর্ণবের ধমক খেয়ে চুপ হয়ে যায়। পরে ঝাল ছাড়া ফুচকাটাই চুপচাপ খায় সে।
________________________
বিকেল পাঁচটা,
অর্ণব বাসায় ফেরার রিক্সা ঠিক করছিল। সেই সময় সে খেয়াল করে একটা লোক দূর থেকে তাদের ছবি তুলছে। ব্যাপারটাই অবাক হয় সে। পৃথাকে দাঁড় করিয়ে লোকটার কাছে যেতে নিলেই লোকটা দৌড়ে পালায়। অর্ণব আর তাকে ধরতে পারে না। সে পৃথার কাছে ফিরে এসে বলে,
‘ঐ লোকটা আমাদের ছবি তুলছিল।’
পৃথা কথাটা শুনে ঘাবড়ে যায়। ভীত সুরে বলে,
‘ঐ লোকটা আবার ফরহাদের লোক নয়তো? যদি এখন ফরহাদ আমাকে খুঁজে বের করে ফেলে?’
‘তাতে কী? কারোর বাপেরও সাহস নেই আমার বউয়ের গায়ে হাত দেওয়ার।’
অর্ণবের নিমিষেই রক্তাক্ত হয়ে উঠা চোখগুলো দেখে পৃথা ঢোক গিলে। মনে মনে ভাবে, এই ভেজা বিড়াল রাগলে নিশ্চয়ই সিংহের মতো হুঙ্কার ছাড়ে।
চলবে…#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১ঌ।
ঠাস করে উঠা একটা চড়ের শব্দে চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে ঢোক গিলল কেবল। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা চওড়া শরীরের ব্যক্তিটি কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘খালি একটা ছবি নিয়ে নাচতে নাচতে চলে এলি কেন? দেখতি পারলি না, ওরা কোথায় যায়? কী করে? ওদের ফলো করতে পারলি না, আহাম্মকের বাচ্চা?’
ছেলেটি মিইয়ে যাওয়া সুরে জবাব দেয়,
‘স্যার, ঐ লোকটা আমাকে ধরে ফেলতো, তাই আমি তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি। আর নাহলে তো ধরা পরে যেতাম।’
ফরহাদ প্রচন্ড রেগে যায়। রাগে তার হাতের ছবিটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। প্রচন্ড রাগে হাত জোড়া কাঁপছে তার। কপালের রগ ফুলে আছে। চোখগুলো লাল। সে পৃথার বাবাকে কল দেয়। কল রিসিভ হতেই চেঁচিয়ে বলে,
‘আপনার মেয়ে এবারও ঐ অর্ণবের সাথে পালিয়েছে। আপনারা বাপ মেয়ে মিলে কি আমার সাথে মজা শুরু করেছেন? আগেও একবার এরকম হয়েছে, পরে আপনি অনুরোধ করেছেন, আমি যেন সব ভুলে আপনার মেয়েকে বিয়ে করি। আমিও দয়া দেখিয়ে রাজি হই। কিন্তু, এখন আবারও আপনার মেয়ে একই কাজ করল। ও আবার অর্ণবের সাথেই পালাল। এবার আমি আপনার মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার পর ওকে আর ছাড়ব না। আমাকে এত ঘুরানোর শাস্তি ওকে পেতেই হবে।’
পৃথার বাবা ভয় পেলেন। যে ভয়টা পাচ্ছিলেন অবশেষে সেটাই হলো। ভেবেছিলেন, মেয়ের স্মৃতি নেই, এই সুযোগে বিয়েটা দিয়ে দিবেন। কিন্তু, মেয়ে তার আবার একই কাজ করল। তিক্ত সুরে তিনি বললেন,
‘আমাকে ক্ষমা করো, বাবা। ওকে খালি একবার খুঁজে বের করো তুমি,তারপর দেখো, আমি ওকে কীভাবে তোমার সাথে বিয়ে দেই।’
‘আপনার আর লাগবে না, এবার যা করার আমি একাই করব।’
ফরহাদ কল কেটে দিয়ে তার সহকারীকে বলল,
‘গাড়ি বের করো, আমি এক্ষুনি সেই জায়গাটাই যাব।’
,
সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগেই। চারদিকে এখনো আলোর ছটা রয়ে গেছে। পৃথা খোলা চুলে বারান্দায় দাঁড়ানো। অর্ণব পেছন থেকে এসে বলল,
‘রুমে এসো, পৃথা। তোমার চুলে তেল দিয়ে দেই।’
পৃথা পেছনে চেয়ে অবাক চোখে বলল,
‘আপনি চুলে তেলও দিয়ে দিতে পারেন?’
‘হু।’
‘বাহ, আপনি তো দেখছি বেশ কাজের মানুষ। আপনাকে বিয়ে করে আমার লাভই হয়েছে মনে হচ্ছে। আমার খুব একটা খাটতে হচ্ছে না, সব আপনিই করে ফেলছেন।’
‘জি ম্যাডাম, এত সুন্দরী বউয়ের খেয়াল না রাখলে হয়? আসুন, এখানে এসে বসুন।’
অর্ণব বিছানার উপরে বসল। আর পৃথা তার বরাবর নিচে মেঝেতে বসল। অর্ণব বিলি কেটে কেটে তার মাথায় তেল দিয়ে দেয়। পৃথার বেশ আরাম বোধ হয়। সে চোখ বুঝে সেই আরামটা উপভোগ করে। সেই সময় হুট করেই কেন যেন তার মনে হয়, আগেও একবার কেউ তাকে ঠিক এভাবেই তেল দিয়ে দিয়েছিল, এত যত্ন নিয়ে, আরাম করে। কিন্তু সে কে, সেটা সে মনে করতে পারছে না। পৃথা মস্তিষ্কে খুব চাপ প্রয়োগ করে, ব্যক্তিটাকে মনে করার জন্য, কিন্তু সে পেরে উঠে না। বরাবরের মতো এবারও সে ব্যর্থ। সে বিষাদ মনে অর্ণবের পায়ের উপর মাথা রাখে। অর্ণব বলে,
‘মাথা সোজা করো। এভাবে রাখলে তেল দিতে পারব না তো।’
পৃথা ফুঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। বলে,
‘জানেন অর্ণব, আমার না মাঝে মাঝে কেমন যেন লাগে। মনে হয় একই ঘটনা আমার সাথে বারবার ঘটছে। আমি এই ব্যাপারটা কোনোভাবেই না মেলাতে পারি না। এই যে, আপনি এখন আমাকে তেল দিয়ে দিচ্ছেন, আমার এখন বারবার মনে হচ্ছে, এমন ভাবে আমাকে আগেও কেউ তেল দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, সেটা কে, সেটাই বুঝতে পারছি না। মা’কে খুব ছোট বেলায় হারিয়েছি। মায়ের সাথে খুব একটা স্মৃতি আমার নেই। খালাও কখনো ওভাবে আমাকে তেল দিয়ে দেননি। মাঝে মাঝে রুহা বাসায় এলে তেল দিয়ে দিত। কিন্তু, এভাবে না। এভাবে অন্য কেউ একজন আমাকে তেল দিয়ে দিত, কিন্তু আমার তার কথা কোনোভাবেই মনে পড়ছে না। মাথায় খুব চাপ পড়ছে। ইদানিং এমন খুব বেশি হচ্ছে। কী একটা যেন মনে হতে হতে নিয়েও হচ্ছে না। আমি আসলে আমার প্রবলেমটা কাউকে বোঝাতে পারছি না। নিশ্চয়ই আমার বড়ো কিছু একটা হয়েছে, আমি বুঝতি পারছি। কিন্তু, সেটা কী, ধরতে পারছি না।’
পৃথার খুব অসহায় লাগে। সবকিছু স্বাভাবিক থেকেও যেন কিছু স্বাভাবিক নেই। কেমন যেন করে, কী ভেবে যেন মাঝে মাঝে তার খুব যন্ত্রণা হয়। যদি কাউকে সে খুলে সবটা বোঝাতে পারতো, তাহলে হয়তো কিছুটা শান্তি পেত।
অর্ণব বুঝতে পারে। সে পৃথার সমস্যাটা বুঝতে পারছে, কিন্তু চেয়েও কোনো সমাধান বের করতে পারছে না। খুব ইচ্ছে করছে, পৃথাকে সব সত্যিটা বলে দিতে। কিন্তু, যদি তখন পৃথা আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে? ডাক্তার বলেছেন, ওর জন্য এখন উত্তেজনা একদমই ঠিক না। ওর মস্তিষ্কে বেশি চাপ পড়লে ও আরো বেশি স্মৃতি ভুলে যেতে পারে। এখন যেইটুকু স্মৃতি আছে, সেটাও যদি হারিয়ে যায়, তবে সে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তাই আপাতত সব মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
অর্ণব পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নরম সুরে বলে,
‘এত টেনশন করো না। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের সবার সাথেই মাঝে মাঝে এমন হয়। মনে হয় যেন, “আরে, এই ঘটনাটা তো বোধ হয় আগেও আমার সাথে ঘটেছে।” কিন্তু, আসলে তেমন কিছুই না। আমরা সারাক্ষণ যা নিয়ে ভাবি যদি আমাদের সাথে তেমন কিছুই হয়, তখন আমাদের মস্তিষ্ক তার মতো আরো একটা ইমেজ তৈরি করে। আর তখন আমরা ভাবি, একই ঘটনা আমাদের সাথে আবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আসলে, তা হয় না। মূলত আমাদের মস্তিষ্কে যে ইমেজটা তৈরি হয়, সেটা আমাদের কল্পনা। আর আমরা আমাদের কল্পনাটাকেই বাস্তব বলে ভেবে নেই। ভেবে নেই, অতীতেও এমন কিছু হয়েছে।’
পৃথা অর্ণবের দিকে মুখ করে বসে। চিন্তিত স্বরে বলে,
‘আমার তো আপনাকেও খুব চেনা চেনা লাগে। মনে হয় যেন, আপনি আমার পূর্ব পরিচিত। অথচ আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়, সাজেকে। এটাও কি আমার কল্পনা? আপানাকে আগে না দেখে থাকলে আমার মস্তিষ্ক আপনার ইমেজ তৈরি করল কী করে?’
অর্ণব কী করে বোঝাবে, পৃথার ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা আলাদা। তার তো মুছে যাওয়া স্মৃতিগুলোই আবছা ভাবে মনে পড়ছে। অর্ণব যে তার কল্পনা না, সে তো বাস্তব। তার মস্তিষ্ক অর্ণবের কোনো ইমেজ তৈরি করেনি, বরং চো তার বাস্তব স্মৃতিগুলোই আলতো ভাবে ভাসিয়ে রেখেছে।
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘হয়তো এমন কিছুই। হতে পারে আগে কোনো একদিন আমাদের দেখা হয়েছিল। সেই দেখা থেকেই আমার স্মৃতি তোমার মস্তিষ্কে রয়ে গিয়েছে। তুমি হয়তো সেটা জানোও না। কিন্তু তোমার মেমোরিতে সেই দৃশ্য ঠিকই আটকে আছে।’
পৃথা আর কিছু বলে না। চুপচাপ ঘুরে বসে। অর্ণব আবারও তার চুলে তেল দিতে আরম্ভ করে। তেল দেওয়া শেষ করে, ম্যাসাজ করে দেয়। পৃথার ভীষণ আরাম লাগে। যেন আরামে চোখও লেগে যাচ্ছে তার। ঘুমে বসে বসে ঢুলছে সে।
কিন্তু তার সেই আরাম আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঠকঠক দরজার শব্দে পৃথার ঘুম জানলা দিয়ে পালায়। সে হকচকিয়ে উঠে, অর্ণবের দিকে চেয়ে বলে,
‘কেউ এলো বোধ হয়।’
অর্ণব বলল,
‘হ্যাঁ, চাচা হয়তো। তুমি বসো, আমি গিয়ে দেখছি।’
অর্ণব গিয়ে দরজা খুলে। খুলে দেখে, সত্যি সত্যিই চাচা এসেছেন। অর্ণবকে দেখে তিনি বললেন,
‘তোমাদের সাথে নিচে কিছু লোক দেখা করতে এসেছেন।’
অর্ণব ভ্রুক্ষেপ করে প্রশ্ন করতে যাবে, তার আগেই কয়েকজন লোক চাচাকে সরিয়ে হুরমুড়িয়ে তার বাসার ভেতর ঢুকে পড়ে। অর্ণব তখন সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে বলে,
‘এই কারা আপনারা? বাসার ভেতরে ঢুকছেন কেন?’
চলবে…