এক সমুদ্র প্রেম পর্ব -৪৮ | নুসরাত সুলতানা সেজৌতি

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৪৮)

ধূসর ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে। না কিছু বলছে,না কিছু বোঝাচ্ছে। হয়না,বরফের মত কিছু শীতল দৃষ্টি, যা দেখলে হাত বা বিবশ হয়ে আসে! পিউয়ের বুক ধড়ফড় করছে। তানহা কখন উঠে গেল পাশ থেকে? উনিই বা এসে বসলেন কখন? কোন পর্যায়ের বেয়াক্কেল হলে একটা মানুষ কিচ্ছু টের পায়না! বাকী সব ঠিক ছিল,কিন্তু বাসর,আর বাচ্চা গাচ্চা? এসব কথাবার্তা শুনলে তার মান ইজ্জ্বত, ছি! ছি! পিউ প্রার্থনা করল ভূমন্ডল দুভাগ হয়ে যাক। যা দেখছে মিথ্যে হোক সব। এমন ক্ষু*রের মত চাউনী থেকে রেহাই পাক সে। দ্বিখ*ন্ডিত মাটির ভেতর টুপ করে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা আসুক। এই যে ধূসর ভাই এইভাবে তাকিয়ে আছেন, এতে তো আরো গুলিয়ে ফেলছে সব। তার সব রা*গ গিয়ে নির্দোষ তানহার ওপর বর্তাল। হতচ্ছাড়ি মেয়েটা যাওয়ার সময়, বলবে না?
ধূসর আচমকা উঠে দাঁড়াল। লোহার চেহারটা হাল্কা নড়ে উঠল তাতে। পিউয়ের চোয়াল ঝুলে পরে। আরো একবার বক্ষপট ধ্বক করে ওঠে ওকে নিজের দিকে এগোতে দেখে। সে যত্র পিছিয়ে যেতে চাইল। পায়ের কাছে, থ্রি পিসের লম্বা, ছড়ানো ওড়নাটায় জুতো বেধে আবার ধপ করে বসে পরল। ধূসর ওকে আড়াল করে ওর দিক ফিরেই দাঁড়াল। চোখদুটোতে জ্বলজ্বলে দুষ্টুমি। অথচ চিবুকটা অভ*ঙ্গুর। ভাবখানা এমন,ভীষণ চটেছে সে। পিউ ঢোক গি*লল। ধূসর ভাই তো ওকে ভালোবাসেন। তাহলে এসব কথাবার্তার জন্য চ*ড় -টড় খাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু, বেহায়াপনার জন্যে একটা খেতেই পারে। যার হাত ধরে দু কদম হাঁটা হলো না,একে অন্যের দিকে সেকেন্ড খানেকের বেশি চেয়ে থাকা হলো না,হয়নি ভালোবাসার কথা বলা, সেই কবে একটা চুমু খেয়েছিলেন পিঠে,তার সাথে বাসর অবধি ভাবা! পিউ কুণ্ঠায় ম*রে যাচ্ছে। ধূসর এমন ভাবে দাঁড়াল যেন ফাঁক-ফোঁকড় থেকেও তার পালানো বন্ধ। অসহায় বনে বসে থাকে সে। অপেক্ষা করে ক*ঠিন কণ্ঠের, ক*ঠোর কিছু শোনার। এক্ষুনি হয়ত ধম*কাবে,রে*গেমেগে বলবে, ‘ তোর কি লজ্জা নেই পিউ? এত বেহায়া তুই!’

পিউয়ের আঁদোল সংকীর্ণ। নীচু অক্ষিপট তাক করল বিনম্র গতিতে। ধূসর পাঞ্জাবি গলিয়ে সাদা প্যান্টে হাত ভরল। ঘাড়টা চলে এলো এক দিকে। পাতলা, শক্ত ওষ্ঠযূগল নেড়ে কিছু শোনাতে যাবে এর মধ্যেই স্টেজ থেকে কা*ন্নার বিগলিত স্বর ভেসে আসে। চকিতে তাকাল ওরা। পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে মিনা বেগম হাউমাউ করে কাঁদ*ছেন। এই দৃশ্যে নিমিষে ঘুরে গেল মনোযোগ। পিউ ভুলে গেল লজ্জা,ধূসর ভুলল সব কিছু। দুজন ত্রস্ত পায়ে ছুটল সেদিকে।

আমজাদ সিকদার পেছনে দুহাত বেঁধে স্ত্রীর দিক চেয়ে আছেন। চোখেমুখে এক আকাশ বির*ক্তি। ভ্রু দুখানা, নেত্রদ্বয়ের নিকট আঁটঘাট বে*ধেছে। চাউনীর আকার ছোট হচ্ছে ক্রমে। এই হঠাৎ কা*ন্নার কোনও মাথা-মুন্ডু খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। আগামী দুই বছর মেয়ে তাদের বাড়িতেই থাকবে। যেদিন যাবে সেদিন কাঁ*দলে একটা কথা ছিল। তাহলে আজকে এই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁ*দার মানে কী? অথচ মিনার দেখাদেখি কান্না*কাটি শুরু করলেন বাকী তিন জন। সুমনা আস্তেধীরে কাঁ*দলেও, জবা আর রুবার গলা বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে। পুষ্প ও থেমে নেই,সে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে। সবতো ঠিকই ছিল,মিনা বেগম আচমকা কেঁ*দে ওঠায়,সে চুপ থাকতে পারল না। কা*ন্না একেবারে উগলে বেরিয়ে এলো।
যারা খেতে বসেছিল,ঝড়ের মত শো শো শব্দের কা*ন্না শুনে ত্রস্ত এপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গিন্নীরা কাঁ*দছেন,আর কর্তারা হা করে দেখছেন। মাথার ওপর দিয়ে সবটা গত হচ্ছে প্রায়।
আফতাব আশেপাশে তাকালেন৷ বেয়াই বাড়ির আশ্চর্যজনক দৃষ্টি গুলো হজম করে মুখটাকে বড় ভাইয়ের দিক এগোলেন। আস্তে করে বললেন,
‘ এভাবে কতক্ষণ কাঁ*দবে ভাইজান? থামাতে হবে তো।’

আমজাদ সিকদার শ্বাস ফেললেন। কানায় কানায় বিদ্বিষ্ট সে। বললেন, ‘ তোমার ভাবির আক্কেল টা দেখলে? এই কান্না*কাটি সেই শুরু করল না? মেয়েত সাথেই যাচ্ছে,তাহলে কাঁদছে কেন?’

‘ ভাইজান,মেয়ে যার,ক*ষ্ট তার। ভাবি হয়ত দু বছর পরের ক*ষ্টটা আজই অনুভব করছেন। মায়ের মন,কে বোঝে?’

তিনি কিছু বললেন না। স্টেজের দিক এগোতে গেলেন,এর আগেই সেখানে উঠল ধূসর। ওকে দেখেই থেমে দাঁড়ালেন আমজাদ। ভাইকে বললেন,
‘ আমার যাওয়ার আর দরকার হবে না। বংশের নেতাজী উঠেছেন স্টেজে। ভাষণ দেবেন এখন। তুমি বরং কান খাড়া করে শোনো। ‘

বলেই হনহন করে চলে গেলেন কোথাও। আফতাব সিকদার কিছুক্ষণ বোকার মত চেয়ে রইলেন সেদিকে। তারপর দুপাশে মাথা নাড়লেন,হাসলেনও।

ধূসর প্রথমেই ইকবালের দিক তাকায়। ছেলেটার দু চোখে অসহায়ত্বের বন্যা। এই যে পুষ্প কাঁ*দছে,সে মলিন দৃষ্টিতে দেখছে। এতক্ষণ সেজেগুজে পরী হয়ে বসে থাকা মেয়ের চোখের কাজল টাও ঠিক নেই এখন। এত কাঁ*দলে তার ক*ষ্ট হয়না বুঝি! ইকবালের ইচ্ছে করল স্বহস্তে পুষ্পটার চোখের জল মুছিয়ে দেবে। এত এত মানুষের ভীড়ে পারল না! চুপচাপ বসে রইল। ধূসর মিনা বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। জবা,সুমনা,রুবায়দা,পুষ্প আর তার একটা জটলা বেধেছে এখানে। পিউটা মিসিং। ও থাকলে সিকদার বাড়ির নারী সদস্য পূর্ন হতো। ধূসর আড়চোখে তাকায়। পিউ বিরস চেহারায় স্টেজের কোনায় দাঁড়িয়ে। ছলছলে দৃষ্টি এদিকেই। ধূসর আবার চক্ষু ফেরাল। মিনা বেগমের কাঁধে হাত রেখে নরম কণ্ঠে ডাকল ‘ বড় মা।’
প্রথম ডাক কানে পৌঁছাল না ওনার। তিনি কাঁ*দছেন। পড়নের কাতান শাড়িটার ভাঁজে মিশিয়ে ফেলেছেন মেয়েকে। ধূসর আবার ডাকল,
‘ বড় মা!’

এবারেও কাজ হলো না৷ একজনও মাথা তুলল না। বাধ্য হয়ে কণ্ঠ উঁচু করল সে। কেমন খ্যাক করে বলল, ‘ কী শুরু করেছ তোমরা?’
ওমনি কা*ন্না থামে, সবাই তড়াক তড়াক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ধূসর পুষ্পর হাত দুটো প্রথমে সরাল মায়ের থেকে। বলল,
‘ তুইও কি বাচ্চা হয়ে গেলি? শ্বশুর বাড়ি যাবি কবে,আর কাঁ*দছিস এখন! ম্যাচিউরড পুষ্পর থেকে এসব আশা করা যায়?’

পুষ্প মাথা নামিয়ে নিলো। ফোঁপাল অল্প। একবার ইকবালের দিক চাইতেই সে সহায়হীন ভাবে ইশারা করল। নিরবে বোঝাল ‘ কেঁদোনা মাই লাভ!’

মিনা আঁচলে মুখ চাপলেন। গুনগুন শব্দ হলো। বাকীরা চোখ মুছছে। ধূসর বলল
‘ কোথায় তোমরা মা -মেয়েকে সামলাবে,তা না নিজেরাও তাল মেলাচ্ছো?’

কেউ উত্তর দিলোনা। ধূসর মিনার দুবাহু ধরে নিজের দিক ফিরিয়ে শুধাল,
‘ এসব কী হচ্ছে বড় মা? ‘

তিনি আবার কেঁ*দে উঠলেন৷ ভা*ঙা ভা*ঙা কণ্ঠে বললেন,
‘ আমার খুব ক*ষ্ট হচ্ছে রে বাবা! মেয়েটা আজ হোক কাল, চলে তো যাবে। আমি যেন এখনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেই সময়টা। আমার বুকটা ছিড়ে যাচ্ছে এতে।’

পুষ্পর কা*ন্না থামতে গিয়েও, আবার বাড়ল। মায়ের কথায় গাঢ় হলো অশ্রুজল। মুমতাহিনা এ পর্যায়ে স্টেজে পা রাখলেন। মিনাকে আগলে ধরে বললেন,
‘ মেয়ে চলে যাবে এমন কেন ভাবছেন আপা? ও বুঝি আর আসবে না? কাছেইত দুটো বাড়ি। ওর যখন ইচ্ছে হবে,বা আপনার যখন মন চাইবে ছুট্টে চলে যাবেন।’

মিনা বেগম তাও কাঁদলেন। তবে শব্দ হলো না। ধূসর তার মাথাটা বুকের সাথে চে*পে ধরে বলল,
‘ এত কাঁদার কিছু হয়নি। পুষ্প শ্বশুর বাড়ি গেলে যাক,আমরা কি নেই? তোমার আরেক মেয়ে নেই? ‘

মিনা বেগম কান্নার মধ্যেই, বিড়বিড় করে বললেন,
‘ পিউটাও তো বড় হয়ে পরের ঘরে যাবে রে ধূসর। আমার একটা মেয়েও আমার কাছে থাকবে না।’

ধূসরের ঠোঁটদ্বয় ওমনি এক পাশে উঠে গেল। ভীষণ চতুরের ন্যায় দেখাল হাসিটা। কোনায় দাঁড়ানো পিউয়ের দিকে তাকাল নিষ্প্রভ নেত্রে৷ ভাবল,
‘ তোমার ছোট মেয়েকে সারাজীবন তোমার কাছেই রাখব। সেই ব্যবস্থা করতে ধূসর আছে। ‘

***

বরযাত্রী বাড়ি ফিরেছে। প্রস্থান নিয়েছে দূর -দূরান্ত থেকে আসা সকল অতিথি। পুষ্প আর ইকবালকে একসাথে নিয়ে সিকদার বাড়ি এসেছেন সকলে। যেহেতু কাবিন,বর আজকের রাত মেয়ের বাড়িতেই থাকবে, এক ঘরে। বিষয়টা নিয়ে ইকবাল বুক ফুলিয়ে আছে। তার চেহারা হাসিহাসি বেশ। সে নিশ্চিন্ত থাকলেও,পুষ্প অস্থির ভীষণ। এক বাড়ি লোকের মধ্যে বর নিয়ে একটা ঘরে ও রাত পার করবে কী করে? সকালে উঠে মুখই বা দেখাবে কীভাবে? এ বাবা! লজ্জা করবে না?

পুষ্প সেই চিন্তায় ফ্যাসফ্যাস করেছে সারাপথ। তাদের গাড়ির,সামনের সিটে সাদিফ। তার পাশে ড্রাইভার। রাদিফ আছে পুষ্পর পাশে। তবে ছেলেটা ঘুমে সিটের সঙ্গে লেগে গিয়েছে। পুষ্প ওর মাথাটা নিজের কাধে এনে রাখল। সেই সময় ইকবাল, পুষ্পর হাত মুঠোব*ন্দি করল শ*ক্ত করে। পুষ্পও ছাড়াল না। ইকবাল গুনগুন করে গান ধরল। বেশরমের মতো,
‘আজ ফির তুমসে পেয়্যার আয়া হ্যায়!’
পুষ্প লজ্জায় আই-ঢাই করে ওঠে। গোল গোল চোখে সাদিফের দিক চায়। তার দুকানে হেডফোনের দুটো মাথা গোঁজা দেখে স্বস্তির শ্বাস ফ্যালে।

সাদিফ কাল থেকে বেশ চুপচাপ! তবে গা-গতর, পদযূগল জিরোয়নি। বলতে গেলে এ কদিনের চাইতেও অধিক তৎপর হয়ে সে কাজ করেছে আজকে। ক্যাটারিং এর লোকজন থাকা সত্ত্বেও নিজে আগ বাড়িয়ে খাবার পরিবেশন করেছে।
বিষয়টা দৃষ্টিনন্দিত! বড়রা মুগ্ধও হয়েছেন। কিন্তু ভেতরের গল্পটা অন্য। গতকাল থেকে একজনের মুখোমুখি হওয়া থেকে বাঁচতেই এই আপ্রাণ চেষ্টা তার। সাদিফ জানলায় ঠেস দিয়ে,বাম হাতে থুত্নী ঘষল। চোখের সামনে ভেসে উঠল গত রাতের চিত্রপট। কেমন ঝ*ড়ের গতিতে একটা মেয়ে আ*ছড়ে পরেছিল তার বক্ষঃস্থলে! তারপর তার ধুকপুকানী রেশটা? সারারাত বহাল ছিল। আজ অবধি কোনও নারীই এত কাছে আসেনি। পিউয়ের হাত ছাড়া স্পর্শ করেনি কোথাও। সেখানে,সোজাসুজি বুকে?
সাদিফ চোখ বুজে, খুলল। চশমাটা হাতে নিয়ে পাঞ্জাবির হাতায় ঘষে ঘষে আবার পরল। এরকম হচ্ছে কেন আজকাল? যা চাইছে তা ঘটছে না। যা থেকে দূরে যেতে চায়,চায় এড়িয়ে যাবে তাই হচ্ছে।
কী অর্থ এসবের?

****

মিনা বেগম আগেভাগে মেয়ে গুলোকে গাড়ি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে পাঠিয়েছেন সুমনাকেও। ওনারা মেয়ে জামাই নিয়ে পৌঁছানোর আগেই সবাই যেন ঘরটা সাজিয়ে ফ্যালে। হয়েছেও তাই। একেকজন ফিরে জামাকাপড় ও ছাড়েনি। দেয়ালে,গ্রিলে,খাটের কাঠে সব কিছুতে কাঁচা ফুল লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পরল। বিপাকে পরেছে মৈত্রী। তার লেহেঙ্গা বারবার পায়ে বাঁধছে। সেন্টারে কয়েকবার মুখ থু*বড়ে পরতেও পরতেও পরেনি। তার ঝ*ড়টা গত হয়েছে পিউয়ের ওপর থেকে৷ মেয়েটা পিলারের সাথে যেই বারি খেল! বাংলা সিনেমা হলে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরত নির্ঘাত। এক ঘন্টা পর উঠে, আকাশ বাতাস দেখে বলত,
‘আমি কে? তোমরা কারা? ‘
মৈত্রী ফিক করে হেসে দিলো এসব ভেবে। পিউ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল ‘ কী হয়েছে?’
সে ত্রস্ত দুপাশে মাথা নাড়ে। ঠোঁটের হাসিটা তখনও বহাল। সুমনা বেগম কোমড় থেকে আঁচল ছেড়ে বললেন,
‘ আমার শেষ! তোমাদের কতদূর?’
মারিয়া বিছানা থেকে লাফ দিয়ে মেঝেতে নেমে দাঁড়াল। বিশাল দায়িত্ব সাড়ার ন্যায় শ্বাস টেনে বলল,
‘ হয়ে গিয়েছে। ‘

এরমধ্যে গেটের কাছে একের পর এক গাড়ি থামার শব্দ আসে। সবাই চোখ বড় বড় করে একে -অপরকে দেখল। সমস্বরে চিল্লিয়ে বলল ‘ এসে গেছে।’

হুলস্থূল বাধিয়ে সিড়ি বেয়ে নামল ওরা। শুধু পিউ গেল নিজের ঘরে। ধূসরের সামনে থাকতেও তার লজ্জা করবে এখন। তখনকার কথা যতবার মাথায়, আসে মিশে যাচ্ছে মাটিতে। বারবার জ্বিভ কে*টে ঘাড় নাড়ছে দুদিকে। এরকম পরিস্থিতি জীবনে আর না আসুক আল্লাহ!

____

রাত তখন প্রায় বারোটার কাছাকাছি। সবাই জামাকাপড় পালটে,একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে। নিজেদের মত করে ঝেড়েছে ক্লান্তি। ইকবাল উশখুশ করছে। আপাতত সে বসে আছে বসার ঘরে। সামনে এক ঝাঁক মুরুব্বিদের ভীড়। তাকে ঘিরেই বসেছেন সকলে। গল্প,গুজবে পরিবেশ মাতানো। অথচ ধারে-কাছে তার বউয়ের টিকিটিও নেই। আর কতক্ষণ এভাবে বসিয়ে রাখবে?
ইকবাল আশে-পাশে তাকাল। ধূসর কাজে ব্যস্ত। একইরকম ব্যস্ত সাদিফও। দুজনেই পড়নের মোটা পাঞ্জাবি পালটে পাতলা দেখে টি শার্ট চড়িয়েছে। ইকবালের ঠোঁটদ্বয় উল্টে এলো। অসহায় নেত্রে পুরু শেরওয়ানির দিক তাকাল নিজের। সারা গা,ঘাড় চুরচুর করছে। কখন যে পাল্টাবে এটাকে!

***
সাদিফ কাঁচের প্লেট দিয়ে উচু স্তম্ভ বানিয়েছে। এগুলো সব ক্যাটারিং এর৷ গতকাল গায়ে হলুদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ছাদে। রাখা হয়েছিল তিনতলায়। এখন রেখে আসতে হবে নীচে। কাল সকালে এসেই নিয়ে যাবেন ওনারা। সাদিফ বুকের সঙ্গে প্লেট গুলো লাগিয়ে সিড়িতে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে পা চে*পে নামল। কয়েক ধাপ নেমে এসেও গন্ডগোল লেগেছে। অল্প নড়াচাড়ায় ওপরের প্লেট পরতে ধরল ফ্লোরে। সে ভ*য় পেল বুঝতেই। মারবেল মেঝেতে পরলে একটা প্লেটও আস্ত থাকবে কী না সন্দেহ!
সাদিফের চোখ দুটো যখন ভ*য়ে, বিকট থেকেও বৃদ্ধি পেল,সেই মুহুর্তে একজন এসে আকড়ে ধরল সব। পরতে নেয়া প্লেট আগলে রাখল নিজের সঙ্গে। সাদিফ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কৃতজ্ঞ চোখে চাইল। মারিয়ার মুখটা দেখতেই সেই দৃষ্টি বদলায়। আজ সারাদিনে এই কেবল সামনা-সামনি দুজন। হুরহুর করে, কৃতজ্ঞতা বদলে গেল অস্বস্তিতে। তার চোখেমুখের জেগে ওঠা স্পষ্ট কুন্ঠা,অপ্রতিভ ভাবমূর্তি বুঝে নিল মারিয়া। পরিষ্কার ভাবে দেখতে পেয়েছে সে। শুধু মিহি কণ্ঠে বলল ‘ সাবধানে!’

সাদিফ নীচের দিক চেয়ে মাথা নাড়ে। ছোট করে জানায় ‘ ধন্যবাদ!’
মারিয়া ধ্বসে পরতে নেয়া প্লেট গুলো সাদিফের কাছে আর দিলো না। পরপর গুছিয়ে,নিজের সাথেই নিয়ে চলল। সাদিফ বিস্মিত হলো বটে। সেই সাথে বিষয়টা ভালো ও লেগেছে। হাসলো মৃদূ। পরমুহূর্তে চেহারা তটস্থ করে পিছনে চলল তার।

____
ওপর থেকে মৈত্রী, শান্তা,সুপ্তি, তানহা সবাই দুরন্ত পায়ে নেমে এলো। সঙ্গে কানে এলো তাদের খিলখিলে হাসির শব্দ। পিউ -ধূসরকে নীচে দেখেই সিড়িঘরে দাঁড়িয়ে পরল। টার্ন নিলো উল্টোদিকে। আজকে ওনার মুখোমুখি সে হবেইনা।
বাকী চারজন,একদম, ইকবালের সামনে এসে দাঁড়াল। মৈত্রী হৈ হৈ করে বলল,
‘ চলুন দুলাভাই,আপনার যাওয়ার সময় হয়েছে।’

ইকবাল ঘাবড়ে গেল। ভাবল,বাড়ি থেকে যাওয়ার কথা বলছে। হিটলার শ্বশুর কি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন? আজ না তাদের একসাথে থাকার কথা? ভী*ত কণ্ঠে বলল ‘ কোথায় যাব?’
‘ কোথায় আবার? ঘরে। আসুন,আসুন।’
মারিয়া প্লেট গুলো রেখেই ছুটে এলো। ভীড়ল ওদের সাথে। ইকবালের ঠোঁটে হাসি ফুটেছে ওমনি। যাক! এতক্ষণে তার কথা শুনেছেন ওপর ওয়ালা। কিন্তু ধূসর কোথায়?
ইকবাল চার-পাশ দেখল। ধূসর নেই কোথাও।
সুপ্তি, শান্তা দুইপাশ থেকে তার দুইহাত বগলদাবা করল। এক প্রকার টানতে টানতে নিয়ে চলল সাথে।

ইকবাল স্ফূর্ত মনে এসেছে। ঘর অবধি আসতেই ওরা এক লাফে তাকে ছেড়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। চারজন দুইপাশ আটকে ধরল হাত দিয়ে। নিরবে বেরি বাঁধ বানাল। মারিয়া বলল,
‘ ওপাশে যেতে হলে টাকা লাগবে।’
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ইকবাল। বাসর ঘরে ঢুকতে গেলেও টাকা দিতে হয়? প্রশ্নটা মুখ ফুঁটে করেও ফেলল সে। মৈত্রী অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,
‘ সে কী! বউয়ের কাছে যাবেন,শালীদের সাজানো ঘরে থাকবেন,আর তার দাম দেবেন না?’
ইকবাল শুধাল, ‘ তা কত দাম দিতে হবে?
সবাই একসাথে জানাল, ‘ ত্রিশ হাজার।’

ছেলেটার চোখ কপালে উঠল। বাসর ঘরে ঢুকতে ত্রিশ হাজার? গেটে,হাত ধোঁয়া,সব মিলিয়ে কত টাকা গেল! আবার টাকা? যা ইনকাম করল সব কি এই বিয়েতেই শেষ হবে?

ইকবালের পেছনে পিউকে দেখেই সুপ্তি চেঁচিয়ে বলল,
‘ এই পিউপু তাড়াতাড়ি এসো!’
ইকবাল চকচকে চেহারায় চাইল ওকে দেখে। হাঁপ ছাড়ার মত কণ্ঠে বলল,
‘ পিউপিউ তুমি এসেছো? এই দ্যাখো ওরা আমায় ঢুকতে দিচ্ছেনা। কিছু বলো।’

পিউ দুঃ*খী দুঃ*খী মুখ করে বলল ‘ আ’ম সরি ভাইয়া! আজ আমি আপনার দলে নই,আজ আমি আপনার শালীকাদের দলে।’
বলেই সেও লাফ দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। বাকীরা হৈহৈ করে হিপ হিপ হুররে বলে উঠল। ইকবাল মাথা চুল্কে নিজের চারদিকে দেখল। ইফতি সাথে আসতে চেয়েছিল। পিউকে লাইন মা*রবে, ধূসর চেতে যাবে এসব ভেবে সে কড়া ভাবে মানা করেছে। এখন মনে হচ্ছে আনলেই ভালো হতো। নিজেকে একা একা লাগছে এখানে। এত গুলো শালীদের ভীড়ে,তার হয়ে লড়াই করার কি কেউ নেই?
রাদিফ হল্লাহল্লির আওয়াজে ঘুম ভে*ঙে চোখ কচলে দাঁড়িয়েছে কেবল,ওমনি ইকবাল বলল,
‘ ভাইয়া,যাওতো, একটু ধূসর আর সাদিফকে ডেকে আনো। ‘

ধূসরের নাম শুনেই চুপসে গেল পিউ। হা করে মানা করবে এর আগেই রাদিফ দৌড়ে গেল নীচে। ইকবাল বিজয়ী হেসে বলল,
‘ আমার ভ্রম্মাস্ত্র আসছে দাঁড়াও। এইবার টাকা নিয়ে চালবাজি চলছে না। ‘
মিনিট খানেকের মধ্যেই ধূসর এলো। তার আঙুল রাদিফের মুঠোয়। এতক্ষণ বীরের মত বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পিউ ওমনি গুটিশুটি মেরে পেছনে চলে গেল। ধূসর লক্ষ্য করেছে,শব্দ করেনি।
ইকবালকে জিজ্ঞেস করল, ‘ কী হয়েছে?’

সে উদ্বীগ্ন কণ্ঠে বলল,’ বাসর ঘরে ঢুকতে পারছিনা। এদের দাবী ত্রিশ হাজার টাকা। কিছু একটা কর না ভাই।’

মেয়েরা চোরা চোখে একে -অন্যের দিক তাকায়। ধূসরের সাথে তর্কে তারা জড়াবে না। যা নিতে বলবে তাই নিতে হবে ভেবে, ভেতর ভেতর দুঃ*খ পায়। আসন্ন পরা*জয় মেনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।

ধূসর কপাল কুঁচকে বলল, ‘ এইজন্য ডাকলি?
‘ হ্যাঁ। ‘
ধূসর রাদিফের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো। ইকবালের কাছে গিয়ে খুব আস্তে বলল,
‘ তোর কি মাথাটা গেছে ইকবাল? পুষ্প আমার ছোট বোন,ওর বাসর ঘরের সামনে এসে আমি দর কষাকষি করব? ইজ’ন্ট ইট সো লেইম?’

ইকবাল অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘ কিন্তু আমি তোর বন্ধু! সেই হিসেবে ডেকেছি।’
‘ এ বাড়িতে আগে আমার বোনের বর তুই। তারপর বাকী সব। তাল গাছের মত লম্বা হয়েছিস, বুদ্ধি নেই এক ফোঁটা।’
ধূসর চোটপাট দেখিয়ে চলে গেল।
ইকবাল হতাশ চোখে মৈত্রীদের দিক তাকাতেই হুহা করে হেসে উঠল ওরা। একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাই ফাইভ করল। রাদিফ বলল,
‘ তাহলে কি এখন সাদিফ ভাইকে ডাকব?’
ডাকতে হয়নি,সাদিফ নিজেই হাজির হয়েছে। হাতের কাজটা সেড়ে তবেই এলো। তাকে দেখেই বদলে গেল দুটো মেয়ের অভিব্যক্তি। অথচ সে কোনও দিক না তাকিয়ে সোজাসুজি ইকবালকেই প্রশ্ন করল,
‘ ভাইয়া ডেকেছিলেন?’

ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাদিফকে বলে লাভ হবে না। কারণ সেও পুষ্পর বড়। হয়ত একই কথা শোনাবে ধূসরের মত। তাই বলল,
‘ তোমার কাছে ত্রিশ হাজার ক্যাশ হবে? আমার কাছে নেই এখন।’

সাদিফ বিস্ময় সমেত বলল, ‘ এত টাকা দিয়ে এখন কী করবেন?’

‘ এই যে বা*ঘিনীর দল গেট ধরেছে ভাই। টাকা না দিলে বউয়ের কাছে প্রবেশ নিষেধ। ভেতরে আমার বউটা না জানি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে!’

তার শেষ কথায় আবার হেসে ফেলল ওরা। সাদিফ ভ্রু গুঁটিয়ে বলল,
‘ গেটে একবার টাকা নেয়া হলো না? আবার কীসের টাকা?’
কথাটার জবাব এলো সময় নিয়ে। পিউ খরগোশের মত মাথা বের করে বলল,
‘ ভাইয়া এটা আমাদের শালীগত অধিকার। আপনি….’

সাদিফ মাঝপথে থামিয়ে বলল, ‘ তাই বলে এত টাকা? ভাইয়াকে একা পেয়ে ডাকাতি হচ্ছে?’
মৈত্রী মুগ্ধ চোখে সাদিফের দিক চেয়ে আছে। সাদিফ কথা বলছে,তার মনে হচ্ছে কবিতা শুনছে যেন। পিউ গুঁতো দিয়ে বলল, ‘ এই আপু তুমি কিছু বলো?’
মেয়েটা নড়েচড়ে ওঠে। তটস্থ কণ্ঠে বলে, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ। ‘

তারপর সাদিফের দিক ফিরে খেই হারায় আবার। বোকা বোকা স্বরে শুধায় ‘ কী বলব আমি? ‘
মারিয়ার হাসি পেলো। ঠোঁট টিপে হেসে মাথা নামিয়ে নিলো সে। সাদিফ চশমা ঠেলে আরেকদিক তাকায়। পিউ চ সূচক শব্দ করে বলল ‘ এই তুমি সরোতো!’

তারপর মৈত্রীকে টেনে সরিয়ে দিলো পেছনে। নিজে সামনে এসে দাঁড়াল। ওড়নাটা কোমড়ে গুজে বলল, ‘ ত্রিশ হাজারের নিচে এক টাকাও আমরা নেব না। বুঝেছেন?’
তার ঝগড়ু*টে ভাবমূর্তি দেখে সাদিফ থমকায়। বিমোহিত নয়নে চায়। কোমড়ে গোজা ওড়নার প্রান্তের দিক দেখে আবার মুখের দিকে তাকায়। ছোট পিউটাকে কেমন গিন্নী গিন্নী লাগছে!
সে বুকের সাথে হাত গুজল, কণ্ঠ নরম,তবে যুক্তি দিয়ে বলল,
‘ না বুঝিনি। গেটে অত টাকা নিয়েছিস,মানে এখন কমাতে হবে। নাহলে বরকে নিয়ে যাই,আমার রুমে থাকবে। তোরা তোদের সাজানো রুমে নিয়ে বসে থাকিস। ‘

মারিয়া মিনমিন করে বলল, ‘ এটা কেমন কথা? আর আপনিই বা আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন কেন? আপনি না মেয়েপক্ষ?’

‘ আপাতত
আমি ভাইয়ার পক্ষে। এন্ড ন্যায়ের পক্ষে। এত গুলো টাকাতো দেয়া যাবে না মিস ম্যালেরিয়া। ‘

মারিয়ার কথা থেমে গেল। টানা কয়েক ঘন্টা পর সাদিফের সম্বোধনে দুলে উঠল হৃদয়। শান্তা,সুপ্তি, তানহা নিরব দর্শক। মৈত্রী, মারিয়া কেউই কিছু বলছেনা। দুজনেই তালা ঝুলিয়েছে মুখে। পিউ একা আর কত দূর কী করবে? তাই হার মানল শেষে। দুহাত তুলে বলল ‘ ওকে,ওকে,কমাচ্ছি। আচ্ছা পঁচিশ হাজার দিলে চলবে।’

সাদিফ বলল, ‘ আরও কম।’
‘ আচ্ছা বিশ হাজার।’
‘ উহু,পনের।’
পিউ চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ এত কম? ‘
‘ হ্যাঁ।’

পিউ অনিচ্ছায় বলল, ‘ আচ্ছা তাই। কিন্তু এক্ষুনি দিতে হবে।’
ইকবাল হৈহৈ করে বলল,’ হ্যাঁ হ্যাঁ এইত দিচ্ছি এখনই।’

পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল সে। একটা চওড়া বান্ডিল থেকে গুনে গুনে পনেরটা এক হাজার টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে দিল। ভাগ্যিস আসার সময় হাতে বাবা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে এখন বিপদে পড়তে হতোনা?
পিউ চোখমুখ অন্ধকার করে বলল,
‘ লস প্রজেক্ট।’
ধরতে গেলেই খপ করে হাতখানা চে*পে ধরল সাদিফ। সবাই অবাক হলেও পিউ হকচকাল খানিক। হাতের দিকে চাইল একবার। সাদিফ মুচকি হাসে। নির্দ্বিধায় বলে,
‘ তোর বিয়ের সময় এই লস পুষিয়ে দেব। প্রমিস করলাম।’

যেমন দ্রুত ধরেছিল,ওমন গতিতেই ছেড়ে দিলো আবার। ইকবালের এদিকে খেয়াল নেই। সে আপ্লুত ভঙিতে ধন্যবাদ জানাল তাকে। অবিলম্বে চলে গেল সাদিফ। পিউ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষন। সাদিফ ভাই এ কথা বললেন কেন? ওর যে ধূসরের সাথে বিয়ে হবে,গেটটা এ বাড়িতে ধরা হবে,সেসবতো এখনই কারো জানার কথা নয়।

অবশেষে ইকবাল ঢুকল ভেতরে। আগেই ছিটকিনি টানল সে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পেছনে তাকাতেই ভড়কে গেল পুষ্পকে দেখে। মেয়েটার পড়নের শাড়ি পরে আছে পাশের চেয়ারে। পড়নে গেঞ্জি কাপড়ের প্লাজো, টি শার্ট। ইকবাল চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকল কিছু সময়। পুষ্প ওকে দেখেই বলল, ‘এসেছো তুমি? আমার তো আরেকটু হলে ঘুমই এসে যেত।’

ইকবাল গলা ঝাড়ল। এগিয়ে এসে বিছানায় বসল। মন খারাপ করে বলল, ‘ শাড়ি,গয়না সব খুলে ফেললে?’

কণ্ঠ করুণ তার। পুষ্প বুঝতে পারল। বলল না কিছু। শুধু কাধের পাশ থেকে গেঞ্জিটা অল্প সরিয়ে দেখাল। ফর্সা, চামড়ায় র‍্যাশের লাল লাল দাগ দেখে ইকবাল আর্ত*নাদ করে বলল , ‘ একী! কী অবস্থা?’

‘ তাহলেই ভাবো,সারা পিঠ ভরে গিয়েছে র‍্যাশে। কাতান কাপড়ের ব্লাউজ ছিল,তার ওপর এত গরম পরছে আজ! আরেকটু সময় এই ভারি পোশাকে থাকলে আমি ম*রেই যেতাম।’

‘এসব বলে না। ভালো করেছ পালটে। আমি বুঝতে পারিনি মাই লাভ৷ সরি! ‘
পুষ্প মুচকি হেসে বলল, ‘ ইটস ওকে। ‘

‘ এলার্জির ওষুধ? ‘
‘ খেয়েছি এসেই। এখন যাও,তুমিও চেঞ্জ করে এসো। ওয়াশরুমে ট্রাউজার,টি শার্ট রেখেই এসছি। ক*ষ্ট হচ্ছেনা? সেন্টারে মোড়া-মুড়ি করছিলে দেখলাম!

‘ বাবা! এত খেয়াল করলে কখন? কেঁ*দেই তো কূল পাচ্ছিলে না।’
পুষ্প ভ্রু গোছাতেই বলল ‘ যাচ্ছি,যাচ্ছি।’

যখন বের হলো পুষ্প কাঁত হয়ে শুয়ে। এক হাত বিছানায় ঠেস দিয়ে টলছিল ঘুমে। ইকবাল হাসল। প্রশান্তির শ্বাস নিলো। আজ থেকে এই মেয়েটা একান্ত তার। এখানে আর কোনও তৃতীয় ব্যক্তি,কোনও পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা আসবে না। ইকবাল হেঁটে এলো বিছানার দিকে। আস্তে করে বসে পুষ্পর মাথায় হাত রাখতেই জেগে গেল সে। বলল,
‘ এসেছো? আমি…’
ইকবাল বলতে দিলো না। ঠোঁটে আঙুল চে*পে থামাল। শুয়ে থাকা পুষ্পকে টেনে নিজের কাছে আনল। মাথাটা বুকের সাথে চে*পে ধরে বলল,
‘ ঘুমাও।’
পুষ্প অবাক হয়েছিল। এখন হাসল। ইকবালের বুকের সাথে আরেকটু মিশে গিয়ে বুজে ফেলল চক্ষুদ্বয়। ইকবাল চুমু খেল তার কালো রেশম কেশরাশিতে। অল্প সময়ের মধ্যে তার অক্ষিপল্লবও বুজে এলো ক্লান্তিতে।

–—
টাকা ভাগাভাগি শেষ। একেকজনের ভাগে তিন হাজার পরেছে কেবল। মৈত্রী, পিউয়ের ঘর থেকে টাকা হাতে বের হতেই সামনে পরল সাদিফ। আকষ্মিক সামনে আসায়,
প্রথম দফায় থমকাল দুজন। পরমুহূর্তে সাদিফ পাশ কা*টাতে গেলেই মৈত্রী ডাকল, ‘ শুনুন!’
সাদিফ ‘চ’ সূচক শব্দ করল। দাঁত চেপে কিছু বিড়বিড় করে ঘুরল হাসিমুখে। ভদ্র কণ্ঠে বলল ‘ জি বলুন।’

মৈত্রী আঙুলে ওড়না প্যাচাতে প্যাচাতে বলল,
‘ আপনি তখন যেভাবে ইকবাল ভাইয়ের বিষয় টা সমাধান করলেন না? আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।’

প্রসঙ্গটা অজুহাত মাত্র। সাদিফের সঙ্গে একটুখানি কথা বলাই মৈত্রীর মূল চাওয়া। অথচ
তার চেহারা জড়ো হয়ে আসে। পাশাপাশি আশ্চর্য হয়। তখন যে সবার সামনে ইচ্ছে করে পিউয়ের হাত টেনে ধরল,যাতে মৈত্রী একটু হলেও বোঝে,মারিয়ার সাথে না চাইতেও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা কমে,কিন্তু এ মেয়েতো বুঝলোইনা কিছু।
উলটে আবার লজ্জাবতী লতার মত লতিয়ে কথা বলছে! এসব দেখলে গা জ্ব*লে তার। সাদিফ ভেতর ভেতর চটেছিল। এখন রা*গটা বাইরে ছিটকে আসে। অনেক হয়েছে,আর নয়! একেবারে সরাসরি প্রশ্ন করে বসল,
‘ আপনি কি আমায় পছন্দ করেন মৈত্রী? ‘
মেয়েটা থতমত খেয়ে তাকাল। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। হা করার আগেই সাদিফ ভনিতাহীন বলে ফেলল,
‘ আপনি যেরকম করেছেন এতে আমার বিরক্ত লাগছে। আগেও বলতে চেয়েছি, খা*রাপ লাগবে বিধায় বলিনি। দেখুন,আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি। তাকেই বিয়ে করব। আপনি প্লিজ এর মধ্যে আসবেন না।’

মৈত্রী হতচকিত কণ্ঠে বলল, ‘ কিন্তু পুষ্প আপুরতো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওকে আবার কী করে…’
‘ আমি পুষ্পকে কোনও কালেই পছন্দ করতাম না। ওটা আমার মায়ের একটা ভুল ধারণা ছিল।’
মৈত্রী আহত স্বরে শুধাল,’ তবে কাকে?’
‘ আছে কেউ একজন। এত উত্তর দেয়া তো আর বাধ্যতামূলক নয়! আপনি এটুকু জেনে রাখুন,আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। ব্যাস!’

বলেই হনহন করে ঢুকে গেল রুমে। মৈত্রীর চোখ ভিজে উঠল। বুকটা চুর*মার হয়ে গেল ক*ষ্টে। আবার? আবার সেই ধা*ক্কা? এক ধা*ক্কা দুইবার করে তাকে দেয়ার কী মানে? কী মজা পাচ্ছে ভাগ্য?

মারিয়া দরজার আড়াল ছেড়ে সরে গেল। তার বুক ধড়ফড় করে লাফাচ্ছে। এতক্ষণের সব কথা কানে গিয়েছে । আড়িপাতা ঠিক নয় জানে। তবুও ইচ্ছে করে মৈত্রীর সাথে সাদিফের কথোপকথন শুনলো। কিন্তু, এটা কী বললেন উনি? ওনার অন্য কাউকে পছন্দ মানে? কাকে?
মারিয়া দাঁত দিয়ে, নীচের ঠোঁট কা*মড়ে ধরল। ডু*ব দিলো গহীন চেতনায়। মাথায় এলো,পিউয়ের হাত চে*পে ধরা,ওর দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকানো সাদিফের সেই মুহুর্ত গুলো। মুহুর্তে সচেতন চাউনীতে মুখ তুলল সে। মাথায় যা আসছে,সেটাই সত্যি নয়ত? তবে যে একটা বিরাট ধা*ক্কা,অপ্রত্যাশিত আ*ঘাত অপেক্ষা করছে মানুষটার জন্যে।

——

বাড়ি নিশ্চুপ হতে, ঘড়িতে প্রায় দুটো গড়িয়েছে। ধূসর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নিজের কক্ষের দরজা ঠেলল। এক পা ভেতরে দিয়েও ফিরিয়ে আনল আবার। কী একটা ভেবে ঘুরে হাঁটা ধরল অন্যদিকে। এসে থামল,ঠিক পিউয়ের ঘরের সামনে। ভেতরে অন্ধকার, দরজা চাপানো। ফ্যানের বাতাসে পর্দা উড়ছে। ও কি ঘুমিয়ে গিয়েছে? বিচ্ছুটাতো এত তাড়াতাড়ি ঘুমোয় না। ধূসর দরজা আস্তে করে খুলল। তার জানামতে
আজকে এই ঘরে পিউ একাই শুয়েছে। বিয়ে শেষে অর্ধেক মেহমান চলে যাওয়ায় মোটামুটি তিন তলা খালি। ওখানেই এঁটে গিয়েছে বাকীরা।
ধূসর সেই অনুযায়ী ভেতরে ঢুকল। গত কালকের মতো অত গুলো মেয়ে থাকলে কখনওই আসতো না।

ভেতরে ঢুকেই সোজা-সুজি বিছানার দিকে চোখ পড়ে। পিউ সজাগ। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে৷ অর্ধেক ভাঁজ করা পা দুটো একটু পর পর শূন্য তুলে নাড়াচ্ছে। বালিশের ওপর দিয়ে চোখের সামনে ফোন ধরে রাখা।
পাশে ঘুমিয়ে সুপ্তি। ধূসর ডানে- বামে না চেয়ে সোজা গিয়ে বিছানার কাছে দাঁড়াল। পিউ টের পায়নি। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে তার ফোনের স্ক্রিন। গুনগুন করে গান গাইছে সাথে। স্বতঃস্ফুর্ত চিত্ত। ধূসর বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়াল। পিউ একটার পর একটা ছবি পালটে দেখছে। গায়ে হলুদ আর বিয়েতে তোলা এসব। এরপর এসে থামল তার আর ধূসরের কাপল পিকটায়। ফটোগ্রাফার ছেলেটাকে কী পরিমান জ্বা*লিয়ে যে ছবিটা নিজের ফোনে আজই নিয়েছে! ধূসর নীচের ঠোঁট ওপরের ঠোঁট দিয়ে চেপে, কপালে ভাঁজ নিয়ে চেয়ে রইল। পিউ ছবিটা টেনে বড় করল প্রথমে। প্রতিটা কোনা কানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তার কাধ ধরে রাখা ধূসরের হাতটা দেখে লাজুক লাজুক হাসল। তারপর নিজেকে বাদ দিয়ে জুম করল ওকে। একেবারে তার নিরেট,হাস্যহীন মুখটা পুরো স্ক্রিনে আনল। বালিশে হাত রেখে মাথায় ঠেস দিয়ে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। হাসল মিটিমিটি। ধূসরের গভীর চোখদুটো আরো ছোট হয়ে এলো আকারে। পিউ সেই মুহুর্তে চমকে দিলো তাকে। চট করে ফোনটা কাছে এনে চুমু খেল। একটা নয়,দুটো নয়,পুরো ছয়-সাতটা চুমুতে মুখটা ভরিয়ে ফেলল ওর। ধূসরের চোখ প্রকট হলো,বিহ্বলতার দমকে খুকখুক করে কেশে উঠল। শব্দ পেয়ে চকিতে মাথা তুলল পিউ। ফটাফট ঘুরে চাইল পেছনে। অন্ধকারে একটা মানুষের অবয়ব দ্রুত পায়ে ঘর ছাড়ছে। হাঁটার ধরন,আর শরীরের গঠন দেখে পিউয়ের বুঝতে বাকী নেই এটা কে! তার মাথা চক্কর কা*টে। ধূসর ভাই! সব দেখে ফেলেছেন?
পিউ তড়াক করে উঠে বসল। আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। লজ্জায় বলী হয়ে, মুখ ঢেকে ফেলল দুহাতে। ইয়া আল্লাহ! আজকে এসব কী ঘটছে তার সাথে!

_____

পরদিন,
ইকবাল-পুষ্পর বিয়েতে যা যা গিফট পেয়েছে সব নিয়ে বসল সবাই। ছোটদের হাতে দায়িত্ব বর্তেছে এর। পিউ,শান্তা,সুপ্তি,মারিয়া,তানহা এমনকি পুষ্প নিজেও বসেছে গিফটের স্কচটেপ খোলার কাজে। চেয়ার নিয়ে ঘুরে বসেছেন বাকীরা। ইকবাল নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছে ধূসরের সাথে। সাদিফ তখনও ঘুমে। মৈত্রী নীচে নামেনি এখনও। মেয়েটার মন খা*রাপ। অবশ্য হওয়ারই কথা। মানুষ যেখানে একবার ছ্যাকা খেলেই বাঁকা হয়ে পরে থাকে,সেখানে একই মানুষকে নিয়ে দুই -দুইবার ছ্যাকা খেলো সে। মন ভালো নেই মারিয়ারও। কিন্তু তার ভাবমূর্তি ভিন্ন। মুখ দেখে ভেতরটা আঁচ করার সাধ্য হবে না কারো। এই যে, সবার সাথে দিব্যি হেসে হেসে কথা বলছে!

ঘড়ি,প্রেসার কুকার,ডিনারসেট,অর্নামেন্স,শাড়ি,আরও, অনেক রকম দামী দামী জিনিস উপহার হিসেবে পাওয়া গেল। বাকীরা নগদ অর্থ প্রদান করেছেন। সব মিলিয়ে যখন উপহারের প্যাকেট খোলার সময় শেষ হলো ধূসর- ইকবাল ঢুকল তখন। সাদিফ ও নেমে এলো নীচে। সুমনা ওদের দেখেই বললেন,
‘ বিয়েতে কত উপহার পেয়েছো ইকবাল! তোমাদের হবু মেয়র সাহেব একটা মিনি ফ্রিজ গিফট করেছেন জানো?’
ইকবাল একটু অবাক হলো এমন ভঙিতে তাকায়। পিউ মাথা নামিয়ে ছিল। চোরা চোখে একবার ধূসরের দিক তাকায়,সেই সময় সেও ফিরল এদিকে। চটপট মেয়েটা দৃষ্টি নত করল ফের। ধূসর আর দাঁড়ালো না। রওনা করল কামড়ায়। ইকবাল পিছনে গেল। একটু পর পুষ্পও গেল সেদিকে। পিউ দোনামনা করল খুব। যেতে ইচ্ছে করছে,কিন্তু, কাল থেকে যা একেকটা কাণ্ড ঘটিয়েছে সে,ধূসর ভাইয়ের সামনে যেতেই তো লজ্জা করছে খুব!

__

দুটো প্লেনের টিকিট বের করে পুষ্প আর ইকবালের সামনে রাখল ধূসর। বলল,
‘ এটা তোদের গিফট,আমার তরফ থেকে।’
দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ইকবাল টিকিট হাতে ধরে বলল,’ কক্সবাজার ট্রিপ? ‘

পুষ্প বলল, ‘ এসব কী দরকার ছিল ভাইয়া!’
‘ কেন? দিতে পারিনা?’

ইকবাল একটু নড়েচড়ে বসে বলল, ‘ তা পারিস। একটা কেন, একশটা গিফট দিবি তুই। কিন্তু বন্ধু, আমিত ওখানে একা যাব না।’

‘ একা কোথায়,পুষ্প আছে।’
‘ ওতো থাকছে। কিন্তু আমি তোকে ছাড়া যাব না। গেলে তোকে নিয়েই যাব।’
ধূসর আপত্তি জানাল,
‘ সেটা সম্ভব? তুই থাকবি না,আমিও না। পার্লামেন্ট?
ইকবাল ততটাই নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল ‘ সোহেল কে বলব। তিন চার দিনেরই তো ব্যাপার। ‘
পুষ্পও তাল মেলায়, ‘ হ্যাঁ ভাইয়া আপনিও চলুন, প্লিজ প্লিজ!’

‘ আরে আমি গিয়ে করব? তোরা এঞ্জয় কর। তোদের মধ্যে আমার একার গিয়ে কী কাজ?’
ইকবাল ভ্রু কুঁচকায়, ‘ একা? কে বলল একা? আরে,তুই যাবি, সাথে পিউকে নেব না?’

ধূসর আশ্চর্য বনে বলল, ‘ তোর কি মাথা গেছে ইকবাল? পিউ কী করে যাবে? কী করতে যাবে?’
‘ কেন? আমরা হানিমুনে গেলে,পিউ তোর সাথে প্রি হানিমুনে যাবে।’
পুষ্প লজা পেল। অপ্রস্তুত ভঙিতে চোখ নামাল। শত হলেও বড় ভাই!
ধূসরের অবস্থাও তাই। গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল,
‘ যা তা একটা বললেই হলো? এটা আদৌ হয়?’
‘ আলবাত হয়! তোরা আমাদের সাথে যাবি। কিন্তু ঘর আলাদা আলাদা নিয়ে থাকবি। সামনে পিউয়ের জন্মদিন,ভেবে দ্যাখ।’

ইকবালের স্বর দৃঢ়।
পুষ্পও মিনমিন করে বলল, ‘ গেলে কিন্তু খুব ভালো হোতো ভাইয়া। আপনাদের ছাড়া আমাদের ওখানে মন ও টিকবে না।’
ধূসর শ*ক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ না। এটা হয়না। তাছাড়া পিউকে বাড়ি থেকে এখন ছাড়বেই বা কেন?’
ইকবাল বলল, ‘ কেন ছাড়বেনা? তোর বড় মা,আই মিন আমার শ্বাশুড়ি আম্মা,তোর যেই মস্ত বড় ফ্যান,তুই চাইলে উনি আরো একটা মেয়ে বানিয়ে এনে দেবেন। ‘

ধূসর তাও আপত্তি করল ‘ না,দরকার নেই।’
ইকবাল পুষ্পর দিক একবার চেয়ে ধূসরের দিক এগিয়ে বসল। কানের পাশে মুখ এনে বলল, ‘ কেন ভায়া,কন্ট্রোল নেই?’
ধূসর চোখ গরম করে তাকায়। ইকবাল দাঁত কেলিয়ে,ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বলে, ‘ তাহলে সমস্যা কোথায়?’

পুষ্প শুনতে পায়নি। সে বলল,’ ভাইয়া আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিন। পিউকে সাথে নেয়ার দায়িত্ব আমার।’
ধূসর একটু ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’ যা খুশি কর। আমি এর মধ্যে নেই।’

তারপর উঠে চলে গেল। ইকবাল দুষ্টু হেসে বলল,
‘ ব্যাটা মনে মনে চাইছে পিউ যাক,কিন্তু বলবেনা। ভাব কমে যাবে না তাহলে? ‘
পুষ্প মুচকি হাসল,বলল, ‘ ভাইয়া এরকমই।’

___

একটা ছোট্ট ট্রলি ব্যাগ সাথে নিয়ে সাদিফের দরজায় এসে দাঁড়াল মৈত্রী। ভেতরে ঢুকবে, কী ঢুকবে না দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল। যদি রে*গে যায়! দাঁড়িয়ে থাকল ওইভাবে। সাদিফ সেই সময় বের হতে নেয়। সদ্য গোসল সেড়েছে সে। মাথার চুলে তোয়ালে চালাতে চালাতে দরজা দিয়ে বের হলো। ওমনি মুখোমুখি হলো দুজন। সাদিফ থমকাল খানিক,অসময়ে মৈত্রীকে দেখে। এদিকে মৈত্রী খেই হারিয়েছে ফের। সাদিফের ছোট ছোট, পরিপাটি করে কা*টা চুল থেকে পানি পরছে। স্যান্ডো গেঞ্জির, বুকের কাছটা ভেজা। কী দারূন দেখতে লাগছে তাকে! ইশ,এই মানুষটা ওর হলে মন্দ হতোনা। পরমুহূর্তে মাথা নামিয়ে নিলো সে৷ সাদিফ শুধাল,
‘ আপনি? ‘
মৈত্রী তাকায়। ঢোক গি*লে ঠোঁট নেড়ে বলে ‘ হ্যাঁ, চলে যাচ্ছিলাম তো,তাই।’

সাদিফের চোখ পড়ল তার লাগেজের দিকে। বলল,
‘ ও,আজই যাচ্ছেন? এসেছেন যখন দুটোদিন থাকতেন না হয়। ‘

মৈত্রী সরাসরি তার চোখের দিক চেয়ে বলল,
‘ যে টানে ছুটে এসেছিলাম,সেই টান ফিকে হয়ে গেছে। তাই আর থাকার ইচ্ছে নেই। ‘
সাদিফ এতক্ষণ হেসে হেসে কথা বলছিল। চাইছিল সহজ হতে। শত হলেও অতিথি। কিন্তু মাত্র বলা কথাটায় হাসি নিভে গেল তার। ডানে -বামে এলোমেলো পাতা ফেলল। মৈত্রী তার মুখবিবরের জড়তা টুকু দেখে যায়। তারপর ছোট করে বলে, ‘সরি!’
সাদিফ প্রশ্ন সমেত তাকাল। জানতে চাওয়ার আগেই সে জবাব দেয়,
‘ এই কদিন আপনাকে এত জ্বা*লানোর জন্যে সরি। কাল বললেন না আমার জন্য আপনি বিরক্ত হয়েছেন?সেটার জন্যেও সরি। সরি,আপনার মনের কথা না জেনেই আপনাকে ভালোবেসেছি বলে । ‘

সাদিফের খা*রাপ লাগল খুব। সহানুভূতি জানানোর মত যুঁতসই জবাব জানা নেই তার। মৈত্রী আবার বলল,
‘ আমি আপনাকে কোনও দিন ভুলব না মিস্টার সাদিফ। আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারেন,তাই বলে আমার ভালোবাসা বদলাবে না। আসি,ক্ষমা করবেন সব কিছুর জন্য।’

তারপর লাগেজটা টেনেটুনে নীচে নেমে গেল মৈত্রী। সাদিফ বিরস চোখে চেয়ে রইল। মেয়েটা পিউয়ের থেকে অল্প একটু বড় হবে। অথচ কত বড় আর,ভারী কথা বলে গেল! মনটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। কিন্তু সেতো নিরুপায়, হৃদয় একটাই, কতজন কেই বা দেওয়া যায়?
____

বিয়ের দুদিন পার হতেই বাড়ি পুরোপুরি ফাঁকা হলো। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার তাগিদে রাশিদ মজুমদার ও পরিবার নিয়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। বর্ষা আর তার বর সেন্টার থেকেই বিদায় পর্ব সেড়েছিল। থাকার ইচ্ছে থাকলেও, সৈকতের ছুটি নেই।
মারিয়া আর সাদিফের ছুটিও আজকেই সমাপ্ত । সে আজই ফিরে যেতে চাইল। সবাই একে একে যাচ্ছে,তানহাও নেই। ও থেকে কী করবে? কিন্তু জবা আর রুবায়দা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছেন। ওনাদের এক কথা, কাল সাদিফের সাথে একসঙ্গে যেও৷
মারিয়া তখন নিরূপায় হয়ে চুপ রইল। কী করে বোঝাবে,ওতো এটাই চাইছেনা। সাদিফের সঙ্গটাই আস্তে আস্তে ছাড়তে হবে এবার।

এ বাড়িতে
ইকবালের তিনদিন থাকার পরিকল্পনা ছিল। তারপর সে নিজ গৃহে ফিরে যাবে। যদিও মনে মনে এখানে থাকার,বা বউটাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার অমোঘ ইচ্ছে তার। এখন অবধি যে বাসরটাই ঠিকঠাক হলো না। কিন্তু হিটলার শ্বশুর সেই ইচ্ছে পূরণ হতে দিলে তো!

রাতের বেলা সবাই খেতে বসেছে। আমজাদ সিকদার ও উপস্থিত। আজমল ফিরে যাবেন কাল। ঈদের ছুটি ব্যাতীত আর আসা হবে না। তাই সকলে একসঙ্গে খেতে বসল। কালকেই তো পরিবারের সবাই আবার যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরবে। আজকে উৎসব উৎসব পরিবেশ টা বজায় রাখার জন্য গৃহিণীরা অনেক রকম পদ রেঁধে টেবিল ভরিয়েছেন। চার ভাই,তাদের ছেলেমেয়ে,ইকবাল, মারিয়া খাচ্ছে। বেড়ে দিচ্ছেন মিনা,জবা আর রুবায়দা। কারো মুখে তেমন কথা নেই। আমজাদ উপস্থিত থাকলে হয় ও না। একটা শান্ত,নিরিবিলি পরিবেশের রেশ কাটিয়ে হঠাৎই ইকবালের কণ্ঠ শোনা গেল। মিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ আন্টি,একটা কথা বলতাম!’
সবাই ওর দিক তাকায়। মিনা বললেন, ‘ হ্যাঁ বাবা বলো, কিছু লাগবে?’

‘ না না কিছু লাগবে না। আসলে,আসলে আমি পুষ্পকে নিয়ে একটু বেড়াতে যেতাম। কক্সবাজারে,যদি অনুমতি থাকে আপনাদের। ‘

মিনা স্বামীর দিক তাকালেন। সাদিফ ভ্রু উঁচিয়ে ফিসফিসে স্বরে শুধাল, ‘ হানিমুন?’
ইকবাল হাসল,মাথা নেড়ে বোঝাল হ্যাঁ।
আমজাদ খেতে খেতে ভারী স্বরে বললেন, ‘ তুমি এখন ওর স্বামী। ওর আরেকজন অভিবাবক। নিয়ে যেতে চাইলে নেবে,এভাবে অনুমতি চাওয়ার কী আছে?’

প্রতিটি কথাই ভালো,কিন্তু শোনাল বেশ কর্কশ। ইকবাল মনে মনে অনেক কিছু বিড়বিড় করল। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘ তাহলে কি আমরা কাল যেতে পারি?’
মিনা বললেন, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ‘
ইকবাল হাসল। পুষ্প মধ্যিখানে আবদার করল,
‘ আম্মু আমি পিউকে নিয়ে যাই?’
পিউ ওমনি মাথা তুলল খাওয়া থেকে। না,সে কী করে যাবে? ওরা দুজন হানিমুনে যাচ্ছে, তার এইচ এস সি পরীক্ষা। সব থেকে বড় কথা তার প্রাণ ভোমরাটাই তো এখানে থাকবে। পিউ চোখের কোনা দিয়ে ধূসরকে দেখার চেষ্টা করল। এত মানুষের গাল গুলো পেরিয়ে সরাসরি ওই অবধি পৌঁছাতে না পারলেও ধূসরের কান,চুল, ভ্রুয়ের আশপাশ দেখা যায়।
তারপর জ্বিভের ডগায় হরেক যুক্তি সাজিয়ে , যেই মাত্র আপত্তি করতে যাবে,এর আগেই মিনা বললেন,
‘ ও গিয়ে কী করবে? ওরতো দুমাস পর পরীক্ষা।’
‘ সেট দুমাস পর,এটাতো তিন চারদিনের ব্যাপার আম্মু।’

আমজাদ বললেন, ‘ আহা,তোমরা দুজন যাবে যাওনা। ও ছোট মানুষ ওকে নিয়ে কী করবে?’

কথার মধ্যে রাদিফ বায়না ছুড়ল, ‘ আমিও যাব আপু।’
রিক্ত তাকে অনুসরন করল, ‘ আমিও দাব।’

ইকবাল বলল, ‘ আমরা সবাই যাব। সাদিফ ভাই চলো,তুমিও চলো।’
‘ না ভাইয়া,এইত তিনদিনের ছুটি কা*টালাম। এখন আবার ছুটি নেয়া একেবারেই অসম্ভব। ‘
ইকবাল মনে মনে শান্তি পেলো। মুখে ভীষণ আফসোস ফুটিয়ে বলল,
‘ আহা,কী একটা অবস্থা! সবাই গেলে কত ভালো হোতো!’
পুষ্প সবাইকে থামিয়ে বাবার উত্তরে বলল,
‘ পিউ কিন্তু অতটাও ছোট না আব্বু। আর আমি আর পিউ একে -অন্যকে কবে থেকে বলে রেখেছিলাম,আমরা একসাথে সমুদ্র দেখব,একসাথে সমুদ্রে নামব। আমি যেমন কক্সে প্রথম যাব এবার,পিউ ও তো যায়নি কখনও। ঢাকার বাইরে আমরা কেউ কখনওই তেমন ঘুরিনি। আজ আমি আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়াব,আর পিউ মন খা*রাপ করবে?একটা মাত্র ছোট বোন,ক*ষ্ট হবে না আমার?’

পিউ চিন্তায় পড়ে গেল। বোনের দিক চেয়ে পল্লব ঝাপ্টাল কয়েকবার। এত ভালোবাসা? আর এইরকম কথা পুষ্পকে কবে দিয়েছিল সে? মিনা রে*গে কিছু বলতে গিয়েও গি*লে ফেললেন। জামাই এর সামনে তো মেয়েকে বকাঝকা করা যায়না। কোমল গলায় বললেন,
‘ তুই নিজে ঘুরবি, না কি ওকে সামলাবি? ও কেমন জানিস না? এত্ত চঞ্চল! কোথাও এক দন্ড বসে? শেষে সমুদ্রে ভেসে না যায়৷ ওকে দেখতে আলাদা লোক লাগে। কে দেখবে শুনি?’

পুষ্প উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘ আমি দেখব,ইকবাল দেখবে। আমরাও যদি না পারি বড় ভাইয়াতো যাবেন। উনি দেখবেন।’

সবার হতচেতন চক্ষুযূগল ধূসরের দিক ঘুরে গেল নিমিষে। সাদিফের খাওয়া থামল সেখানেই। ভীষণ চুপচাপ, নিরব হয়ে খাচ্ছে ধূসর। যেন কিছুই কানে যাচ্ছেনা। রুবায়দা বিস্মিত স্বরে শুধালেন,
‘ তুইও ওদের সাথে যাচ্ছিস?’
সে না তাকিয়েই জবাব দিলো, ‘ হু।’
পিউয়ের ভাত আটকাল গলায়। ধুসর ভাই যাবেন? আয় হায়! এ বাবা,তাহলে ও বাড়িতে থাকবে কী করে? দুনিয়া উল্টিয়ে হলেও ওকে যেতে হবে। পিউ খুব ক*ষ্টে মুখের ভাত টুকু গি*লে, ধড়ফড়ে কণ্ঠে বলল,
‘ আম্মু আমি যাইনা একটু? এই কদিনের সহ ওই কদিনের পড়াও সব একবারে পড়ে পুষিয়ে দেব। প্রমিস! এ-প্লাস পাব পরীক্ষায়,প্রমিস। আর একদম একা একা সমুদ্রে নামবনা এটাও প্রমিস।’

পুষ্প, ইকবাল মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ঠোঁট চেপে হাসল। আমজাদ সিকদার সজাগ লোঁচনে স্ত্রীকে দেখছেন। ধূসরের নাম শুনেছে না? এইবার মহিলা ‘হ্যাঁ’ বললেন বলে। মিনা স্বামীর তাকানো দেখেই বুঝলেন মুখ খোলা বিপদ। আমতা- আমতা করে বললেন,
‘ আচ্ছা তোর বাবা বললে যাস।’
আমজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সাদিফ তটস্থ ভঙিতে তাকিয়ে।
পিউ পাহাড়সম আশা, আগ্রহ নিয়ে বাবার দিক চাইল। আমজাদ আর কী করবেন? সংক্ষেপে বললেন, ‘ যেও।’
পিউ খুশিতে উড়ে যেতে পারলনা। তবে ইয়েএএ বলে লাফ দিলো। আর লাফের দমকে তরকারির বাটিটা ছল্কে পরল মেঝেতে। সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে দেখে গেল তা। মিনা মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
‘ ইয়া আল্লাহ! কে সামলাবে এই ধাঁড়ি মেয়েকে? পারবিতো ধূসর? বুঝে নিস রে বাপ!’

ধূসর উত্তর দিলো না। শুধু ঘাড় কাঁত করে একবার শীতল চোখে পিউকে দেখল। সে চোরের মত, মুখ কাচুমাচু করে চেয়ারে বসেছে আবার। ধূসর আবার প্লেটের দিক চায়। তার ঠোঁটের পাশে উদয় হয়,তকতকে,শোধিত, একপেশে, পাতলা হাসির। যেই হাসির প্রতিটি কোনায় রহস্য। পিউয়ের সাথে ঘটতে যাওয়া কিছু চমৎকৃত ঘটনার আগাম আহ্বান।

চলবে
পুরো পাঁচ হাজার সাতশ প্লাস শব্দ। বানান ভুল হতে পারে। রিটেনের ঝামেলা পুহিয়ে একটা পর্ব দিলাম। ভাইবার জন্য দোয়া করবেন সবাই, রুটিন দিলো আজ। হ্যাপি রিডিং! 😘

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here