কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব -০৩

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩
জাওয়াদ জামী

আরমান নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে পড়ছিল। এমন সময় রুমে প্রবেশ করে ওর ছোট বোন শ্রীজা।

” ভাইয়া, কি এত পড় সব সময়! যেটুকু সময় বাসায় থাক, বইয়ে মুখ গুঁজে থাক। এদিকে তোমার জন্য বাবা অপেক্ষা করছে। সবাই একসাথে কতদিন খাইনা বলতো? ” মুখ ফুলিয়ে বলে শ্রীজা।

” তোরা খেয়ে নে। আমার খেতে দেরি হবে। ”

” ভাইয়া, প্লিজ চলনা। বই রাখ বলছি। ” বলেই শ্রীজা আরমানের হাত থেকে বই কেড়ে নেয়।

” শ্রীজা, আর সাতদিন পর আমার পরীক্ষা। বইটা দে। সাতদিন পর তোর যা যা বায়না আছে, সব আমাকে বলিস। আমি পূরণ করার চেষ্টা করব। ”

” এই ভাইয়া, তুমি না ভার্সিটির টিচার। তোমার আবার কিসের পরীক্ষা? ” বলেই বইয়ের মলাটে নজর দেয় শ্রীজা।

” মাই গড! ভাইয়া, তুমি এবারও বিসিএস দিচ্ছ! কনগ্রেচুলেশন, ভাইয়া। দেখ এবার তুমি ঠিক চান্স পেয়ে যাবে। ”

” আমার আর চান্স পাওয়া এ জন্মে হবেনা। পরীক্ষার দিনেই তোর দাদিমা অসুস্থ হয়ে যায়। আবার সে সময় তার শুধু আমাকেই দেখতে মন চায়। পরীক্ষার টাইমও শেষ, তার শরীরও ফিট। পরক্ষণেই আমাকে দেখে নাক সিটকায়। পরপর দুইবার আমার সাথে এমনটা ঘটল। এই যে আমার পরীক্ষার দিনেই তার অসুস্থ হয়ে যাওয়া, এর মাহাত্ম্য এতদিনেও বুঝলামনা। ”

ভাইয়ের কথা শুনে শ্রীজা মলিন হাসে। দাদিমা ওকে আর শুভ ভাইয়াকে কত ভালোবাসে, কিন্তু বড় ভাইয়াকে এতটা অপছন্দ করে কেন, তা আজও সে ভেবে পায়না।

” দাদিমার কথা বাদ দাও, ভাইয়া। এবারেও তোমার পরীক্ষার দিন দাদিমা যদি অসুস্থ হয়ে পরে, তবে তার কাছে আমি থাকব। তুমি তোমার পরীক্ষা শেষ করবে। বাকিটা আমি দেখব। এবার তো খেতে চল। ”

” তোর কি আমার সাথে খেতে খুব ইচ্ছে করছে? ” আরমানের কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় শ্রীজা।

” তবে যা, দুজনের খাবার এখানে নিয়ে আয়। আজ দুই ভাই-বোন একসাথে খাব। তবুও আমাকে নিচে যেতে বলিসনা। তাদের সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়ায় আমার এ্যালার্জি আছে। ”

” তুমি সব সময় এত ত্যাড়ামো কর কেন, ভাইয়া? আমার একটা কথাও রাখনা। বিয়ের পর বউয়ের সাথেও কি এমন করবে? ”

” আমার বিয়ে বিয়ে করে সবাই এত উতলা হচ্ছিস কেন? আমার বিয়ে করতে এখনও দেরি আছে। ”

” আর কত দেরি, হুম? বয়সতো আর কম হলনা। আমার বুঝি ভাবিকে দেখতে ইচ্ছে করেনা? ভাবির সাথে গল্প করার জন্য কত কথা জমিয়ে রেখেছি। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে। এই ভাইয়া, জানো, আমার ফ্রেন্ড রিশাদ আছেনা? ওর আম্মু তোমার জন্য একটা মেয়ের খোঁজ এনেছে। মেয়েটা নাকি আন্টির বাবার গ্রামের। আন্টির ফোনে তার ছবি আছে। চেহারায় আহামরি কিছু নেই, কিন্তু বড্ড মায়াময়। আর চুলগুলো ইয়া বড়। এক্কেবারে হাঁটু পর্যন্ত। আমার না তাকে খুব পছন্দ হয়েছে। ”

” তুই কিভাবে এতসব জানলি! আজকাল পড়াশোনা বাদ দিয়ে সাংবাদিকতা করে বেড়াস? বিবিসি না সিএনএন কোনটার সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করছিস? ”

” আমি তোমার বোনের ভূমিকা পালন করছি মাত্র। আন্টির কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে তোমাকে দেখাব। আমি নিশ্চিত তাকে তোমারও পছন্দ হবে। ”

” তুই কি আমার সাথে খাবি? না-কি আমি বাইরে যেয়ে খেয়ে আসব? ”

” যাচ্ছি, যাচ্ছি। গোমড়ামুখো একটা। ” বলেই দ্রুত গতিতে রুম ত্যাগ করে শ্রীজা।

কান্তা একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। চুলে যতবারই হাত দিচ্ছে, ততবারই ওর বুক ছ্যাৎ করে উঠছে। ভাবি এতটা পাষাণ কি করে হতে পারল!

” ফুপি, তুমি আর কেঁদনা। তোমার কান্না দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আম্মু খুব পঁচা, তাইনা ফুপি? তোমাকে সব সময় কষ্ট দেয়। ” আরাফ ফুপির পাশে বসে কথাগুলো বলছে।
কান্তার এখন আরাফের কথার জবাব দেয়ার মানসিকতা নেই।

বাড়িতে এতকিছু ঘটে গেছে, তা জাবেদের জানা নেই। সে সকালে স্কুলে যাওয়ার পর শিখা কান্তার সাথে এমন ব’র্ব’র’তা ঘটিয়েছে। জাবেদ ওদের গ্রামের হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক।

কান্তা সেই যে ঘরে ঢুকেছে, আর বের হয়নি। তার রান্নাও হয়নি। শিখা দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর বুঝেছে আজ কান্তা রান্না করবেনা। তাই সে বাধ্য হয়ে রান্নাঘরে যায়। মনে মনে গজগজ করছে। আজ সে কান্তাকে খেতে দিবেনা।

জাবেদ বাড়িতে আসার সাথে সাথে আরাফ লাফিয়ে বাবার কোলে ওঠে। একে একে সকালের সব ঘটনা জানিয়ে দেয় বাবাকে। জাবেদ ছেলের মুখে সব ঘটনা শুনে একটু অবাকই হয়। শিখা কেন অযথাই কান্তার চুল কা’ট’তে গেল!

শিখা গোসল সেরে ঘরে এসে দেখল জাবেদ এসে গেছে। শিখাকে দেখেই মুখ খোলে জাবেদ।

” তুমি না-কি কান্তার চুল কে’টে দিয়েছ? কেন এমনটা করলে? ”

” বাড়িতে আসতে না আসতেই কথাটা তোমার কানে লাগানো শেষ? তোমার মা একটা ডা’ই’নী জন্ম দিয়ে ম’রে’ছে। ডা’ই’নী’টা আমার জীবন জ্বা’লি’য়ে খাচ্ছে, তবুও আমি কিছুই বলিনি, কিন্তু সে হ’ত’চ্ছা’ড়ি এখন আমার ভাইয়ের দিকে নজর দিয়েছে। আমার ভাইকে দেখেই ওর সাথে ঢলাঢলি শুরু করেছে। হাজারবার ওকে নিষেধ করলাম, আমার ভাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করবিনা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সে আমার মুখের ওপর জানিয়ে দিল, কিছুতেই আমার ভাইকে ছাড়বেনা। তখন আমার করনীয় কি তুমি বল? ” শিখা ডাহা মিথ্যা গল্প শোনায় জাবেদকে।

” তাই বলে ওর চুল কে’টে দিবে? ও নিশ্চয়ই খুব কান্নাকাটি করছে? মানছি ও তোমার সাথে বেয়াদবি করেছে, রবিনের দিকে নজর দিয়েছে, কিন্তু তুমি ওর চুল কে’টে ঠিক করনি। ” মিনমিন করে বলে জাবেদ।

” হয়েছে আর বোনের পক্ষ নিয়ে তাবেদারি করতে হবেনা। ন’ষ্টা বোনের জন্য চিন্তা দেখে শরীর জ্ব’লে যায়। ভালোয় ভালোয় ওর বিয়ে দিয়ে, ঘাড়ের ওপর থেকে বোঝা নামাও বলে দিলাম। নইলে দেখবে কোনদিন না’গ’র ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে তোমার মুখে চু’ন’কা’লি মাখাবে। ”

শিখার কথা শুনে জাবেদ রে’গে আ’গু’ন হয়ে গেছে। সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। একটাবারও ভাবলনা কান্তা আর পাঁচটা মেয়ের মত নয়। জাবেদ প্রায় ছুটে আসে কান্তার ঘরে। কান্তা তখনও কাঁদছিল। জাবেদ সোজা ঘরে ঢুকে, কান্তাকে কোন প্রশ্ন না করে ওর গালে সপাটে কয়েকটা থা’প্প’ড় মা’রে। কান্তা ভাইয়ের এমন কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেছে।

সন্ধ্যার পর থেকেই শ্রীজা মেইন গেটে উঁকিঝুঁকি মারছে। কখন ওর বড় ভাইয়া আসবে, আর সে পাত্রীর ছবি তাকে দেখাবে। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে আসছে শ্রীজার।

কলিং বেলের আওয়াজ পেয়েই শ্রীজা দৌড়ে যেয়ে দরজা খুলে। শ্রীজার চোখেমুখে উত্তেজনা আরমানের নজর এড়ায়না।

” কি রে, এভাবে ফু’ট’ছি’স কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে যেকোন সময় ফেটে যাবি। ” আরমান আর কিছুই বলতে পারেনা। শ্রীজা ওর হাত ধরে টেনে সোজা ওপরে যায়। আরমানকে বিছানায় বসিয়ে, নিজের ফোনের গ্যালারিতে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর আরমানের সামনে ফোনের স্ক্রীন মেলে ধরে।

হাঁটু পর্যন্ত কোঁকড়ান চুলের এক কিশোরী কারও সাথে হেসে কথা বলছে। বাম চিবুকে কুচকুচে কালো আঁচিল। পুরুষ্ট ঠোঁট, দুই ভ্রু একে অপরকে আলিঙ্গন করেছে পরম আবেশে। খুবই সাধারণ তার চেহারার গঠন। কিন্তু তবুও কোথায় যেন মায়া মিশে আছে। আরমান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে ছবির দিকে। এরপর চোখ সরিয়ে নেয়।

” ভাইয়া, কেমন লাগল? সুন্দর না? চেহারায় মায়ায় ভরপুর, তাইনা? ” দুই ভ্রু নাড়িয়ে বলে শ্রীজা।

” আমি ফ্রেশ হব নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব? নাকি পাত্রীর ছবি দেখিয়েই আমার পেট ভরানোর ধা’ন্দা করছিস? তুই এত ধা’ন্ধা’বা’জ হয়েছিস কবে থেকে! ”

” আমি তোমার চিন্তায় দিনরাত এক করে বসে থাকি, আর তুমি আমাকে ধা’ন্ধা’বা’জ উপাধি দিচ্ছ! দুনিয়ায় ভালো মানুষের ভাত নেই। তুই তোর ভাইকে ভালোবাসলে কি হবে, তোর ভাই তোকে মোটেও ভালোবাসেনা শ্রীজু। চল নিজের রুমেই চল, সেখানে যেয়ে একা একা দুঃখবিলাস করি। ” ন্যাকা কান্না কেঁদে আরমানের রুম থেকে বেরিয়ে যায় শ্রীজা।
বোনের ঢং দেখে আরমানের ভিষণ হাসি পাচ্ছিল।

রাতে সবার শেষে আরমান ডায়নিং রুমে আসে।
সবাই খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে বসে কিছু একটা আলোচনা করছিল।
আরমান চুপচাপ ডাইনিং টেবিলের কাছে যেয়ে ঢাকনা তুলে দেখল প্লেট আর খাবার রাখা আছে। একটা চেয়ার টেনে বসে প্লেট কাছে এগিয়ে নিয়ে, একটু ভাত আর মাছের ঝোল তুলে নেয়।

খাওয়া শেষ করে চুপচাপ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় আরমান। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা পরিবারের সবাইকে অতিক্রম করতে গেলেই তাকে ডাক দেয় আরমানের বাবা শহিদ আহমেদ।

” আরমান এদিকে এস। এখানে বস। তোমার সাথে কিছু কথা আছে। ”
আরমান কোন কথা না বলে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে। সে শুধুই বসে থাকে কোন কথা বলেনা।
এদিকে শহিদ আহমেদ চাচ্ছে আরমান কিছু একটা বলুক।
কিন্তু বাপের ইচ্ছের মুখে বালি ছিটিয়ে আরমান নিশ্চুপ থাকে।
বাধ্য হয়ে শহিদ আহমেদকে মুখ খুলতে হয়।

” আমরা তোমার জন্য একটা মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। মেয়েটা আমাদের সম্পূর্ণই অচেনা। শ্রীজার ফ্রেন্ডের মা মেয়েটার খোঁজ দিয়েছে। তবে তুমি চাইলে আমরা তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে পারি। তবে তাকে আমাদের সবারই পছন্দ হয়েছে। ”

” সরি, আপনাদের পছন্দের কাউকে আমি বিয়ে করতে পারবনা। আমি বিয়ে করলে আমার পছন্দের কাউকেই করব। ” কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় আরমান। পা বাড়ায় নিজের রুমের দিকে।

আরমানের এরূপ আচরণে সবাই বেশ বিরক্ত হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

” ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে আরমানের বউ করে নিয়ে আসব। তা আর হলোনা। এতিম একটা মেয়ের সংসার হত। ”
আকলিমা খানমের কথা কানে আসা মাত্রই থেমে যায় আরমানের পা।
পুনরায় আসে সবার সামনে।

” মেয়েটার বাড়ি কোথায়? নাম কি? শ্রীজা মেয়েটার বায়োডাটা আমাকে দিস তো। ” আর দাঁড়ায়না আরমান। চলে আসে নিজের রুমে।

কিছুক্ষণ পর শ্রীজা লাফাতে লাফাতে আরমানের রুমে এসে পাত্রীর বায়োডাটা দিয়ে যায়।

দুইদিন পর কাউক কিছু না জানিয়ে কোথাও চলে যায়।
সাতদিন পর সে বাসায় ফিরে। শহিদ আহমেদ অনেকবার জিজ্ঞেস করেও, আরমান কোথায় গিয়েছিল সেই খবর জানতে পারেনা।

আরও দশদিন পর আরমান শহিদ আহমেদকে জানায় তাদের পছন্দের পাত্রীকেই বিয়ে করবে। মেয়ের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বলে।

শহিদ আহমেদ ছেলের সিদ্ধান্ত শুনে খুব খুশি হন। তিনি অতিদ্রুতই মেয়ের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here