আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -৩০+৩১+৩২

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩০]

স্বচ্ছ কোমল অম্বর! থোকায় থোকায় সাদা কাদম্বিনী ভেসে বেড়াচ্ছে। শীতল বাতাসে গাছের সবুজ নেত্রপল্লব চারপাশ সু-সু করে শব্দ তুলে রেখেছে। চাঁদের আলোতে পুরো ছাদটা আজ মিটমিট আলোকিত। রোমাঞ্চিত স্তব্ধ অন্তরিক্ষ। কানের কাছে কিছু বুনো মৌমাছির গুনগুনানি আর নাকে কোনো একটা ফুলের সুগন্ধি পাচ্ছে অভ্র। হয়তো ছাদের কার্নিশে মাটির টবে থাকা সাদা ফুলটার, যেটা অন্ধকারের বুক চিরে অদূরে ফুটে রয়েছে। ছাদের কার্নিশে পরে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ডালে কিছু একটা নড়াচড়ার শব্দ পেলো অভ্র। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাকালো অভ্র। ছাদে থাকা লাইটের আলোতে গাছের পাতা গুলো অল্পস্বল্প ভাবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাই অভ্র মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে সেদিকে তাক করলো। কালচে বাদামি রঙের একটা কাঠবিড়ালি নজরে আসলো তার। নিশ্চিত হবার পর সেদিকে আর পাত্তা দিলো না। কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে লাইট সরিয়ে সামনে আনতেই হঠাৎ রিমিকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।তাকে এখানে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো অভ্র। ফ্ল্যাশ অফ করে রিমিকে প্রশ্ন করলো, ‘এখানে কেন?’

রিমি কিছুটা বিরক্তি সহিত উত্তর দিলো, ‘কি আর করবো? আপনাকে ডাকার জন্য তো আমাকেই দেখতে পায় সবাই।’

অভ্র সাবলীল ভাবে জানতে চাইলো, ‘কে ডাকছে আবার?’

রিমি প্রথমের কন্ঠস্বরে বিরক্তি ও রাগ প্রকাশ করলো। এক হাত উঠিয়ে ঘড়ির দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘সময় দেখেছেন? রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে আপনাকে। কেন যে তখন বলতে গেলাম আপনাকে ছাদে আসতে দেখেছি। যদি না বলতাম তাহলে আমাকে এখানে পাঠাতো না। আর না আপনার মুখখানি দর্শন করতে হতো। বিরক্তিকর!’

মন খারাপের সময় একা থাকতে পছন্দ করে অভ্র। তাই নিঃসঙ্গতার সঙ্গি হিসেবে ছাদের নিরিবিলি পরিবেশটাকে কাছে টেনেছে। কিন্তু এইসময় উলটা পালটা প্রলাপ শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে শুধাল, ‘এতোই যখন বিরক্ত লাগে তাহলে সামনে আসো কেন? চলে যাও।’

রিমি ঝ’গ’ড়া চালিয়ে যেতে অভ্রের কথার প্রত্যুত্তর করলো, ‘হ্যালো মিঃ? এটা আমার বাড়ি। আমি কোথায় যাবো সেটা সম্পূর্ণ আমি ডিসাইড করবো। আপনি বলার কে?’

ঝ’গ’ড়া করার মতো ইচ্ছে কিংবা মন কোনোটাই অভ্রের এই মুহূর্তে নেই। তাই নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে বললো, ‘তোমার বলা শেষ হলে যেতে পারো।’

অভ্রের এমন কথা শুনে অপমানবোধ করলো রিমি। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে কাটকাট গলায় বলে ফেললো, ‘এই মেয়ে মানুষের সাথে কিভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয় জানেন না? আপনার বাবা মা আপনাকে শিক্ষা দেয় নাই? ছিঃ উনারা এইটুকু কাজ করতে পারলো না? অন্ততপক্ষে মেয়েদের সম্মান দেবার শিক্ষাটা তো দিতে পারতো।’

এমনিতেই মন খারাপ। নিরিবিলি, নির্জন পরিবেশ দরকার ছিল মন ভালো করার জন্য। সেখানে আবার রিমির অহেতুক প্রলাপ। তার উপর আবার বাবা মা কে নিয়ে কথা! অভ্র প্রকাণ্ড রকমের রেগে গেল। কপালের রগ ফোলে নীল বর্ণ ধারণ করলো। পাশে থাকা ফুল গাছের টবে শরিরের সর্ব শক্তি দিয়ে লাথি দিলো একটা। মাটির টবটা মেঝেতে পরে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। টব ভাঙ্গার শব্দে ভড়কে গিয়ে নাক মুখ কুঁচকে কানে দুই হাত চেপে ধরলো রিমি। হতবাক হয়ে গেলো অভ্রকে এভাবে হঠাৎ রেগে যেতে দেখে। বিস্মিত চোখে তাকালো রিমি। অভ্র ক্রোধান্তিত হয়ে রিমির এক হাত কোমড়ের পিছনে নিয়ে শক্ত করে ধরলো। তার এমন আকস্মিক রাগ দেখে ভয়ার্ত হলো রিমি। ভীতি চোখেমুখে তাকালো অভ্রের দিকে। অভ্র চোয়াল শক্ত করে বললো,

‘এতোদিন কারণ ছাড়া অনেক কথা শুনিয়েছো। আমি টলারেট করেছি। তোমার অহেতুক কাজ কারবার সহ্য করেছি। কিন্তু মম-ড্যাড কে নিয়ে কথা বলে কাজটা ভালো করো নি। তুমি মেয়ে বলে ছেড়ে দিচ্ছি। নাহলে আস্তো রাখতাম না।’

অভ্রের তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি দেখে ভীতিগ্রস্ত হলো রিমি। ভয়ের কারণে শুকনো ঢোক গিললো একটা। অভ্র চোয়াল শক্ত করেই রিমিকে আলতো ভাবে ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে দিলো। কোনো প্রকার টুঁশব্দ না করে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেল। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রিমি। অভ্র শক্ত করে হাত ধরায় ফরশা হাতে পাঁচ আঙ্গুলের লাল দাগ পরে গেছে। ধরে রাখা অংশ জ্বলছে ভীষণ। কিন্তু সেই দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই রিমির। সে অবাক হয়ে অভ্রের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগ হলো নিজের উপর। কারণ ব্যতিত কেন অভ্রের বাবা মা কে নিয়ে কথা বলতে গেলো? লোকটা কি খুব বেশি রাগ করেছে? কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়? ক্ষুন্ন হলো রিমির মন। ব্যথিত চেহারায় মন খারাপ করে নিচে নামতে পা বাড়ালো।
_____________________

ভয়ার্ত রিমি মন। বারংবার ভয়ে শুকনো ঢোক গিলছে। গলা দিয়ে খাবার নামছে না আতঙ্কের কারণে। পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরছে অভ্রের কথা। টানা টানা চোখ দুটো তুলে সামনে বসে থাকা অভ্রের দিকে তাকালো রিমি। অভ্রের মুখ গম্ভীর। অন্যান্য দিনে খাবার খাওয়ার সময় হেসে হেসে কথা বললেও আজ অভ্র একদম নিশ্চুপ। নির্বিকার ভাবে নিজের খাবার খেয়ে যাচ্ছে। অভ্রের এই গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখখানি দেখে ক্ষুণ্ণ হলো রিমির মন। খারাপ লাগছে বেশ। সে তো এমনি এমনি অভ্রের বাবা মায়ের কথা বলেছে। তাই বলে এভাবে রেগে যাবে? এবার রাগ হলো নিজের উপর। কেন তখন বাবা মায়ের শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে গেলো? আহত মনেই অনিচ্ছা থাকার পরেও খাবার চিবুচ্ছে রিমি।

রাতের খাবারের টেবিলে বসে আবরারের অপেক্ষায় আছে দীবা। মনে মনে বিরক্ত হলো অনেক। আশ্চর্য লোক তো। সবাই এখানে এসে পরেছে কিন্তু লোকটা এখনো আসছে না কেন? দীবার এই ভাবনার মাঝেই সেখানে উপস্থিত হলো আবরার। শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে টেবিলের কাছে আসলো। নির্বিকার ভাবে দীবার পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পরলো। মনে মনে প্রচুর খুশি হলেও বাহ্যিক ভাবে দীবা স্বাভাবিক রইলো। তাকালো না আবরারের দিকে। চুপচাপ খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।

টেবিলে রোশান উপস্থিত থাকায় আবরার দীবার পাশে বসেছে। সময় গেলেও রোশানের প্রতি আবরারের রাগ, অভিমান কোনোটাই কমে নি। চেয়ার টেনে বসেই প্রথমে রোশানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। চোখাচোখি হলো বাবা ছেলের। রোশান গম্ভীর মুখে চোখ সরিয়ে খাবার মুখে তুললো। যদিও মনে মনে ছেলের প্রতি সন্তুষ্ট। আবরার রোশানের থেকে চোখ সরিয়ে অভ্রের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘আগামীকাল তুমি ঢাকা যাচ্ছো?’

উপস্থিত থাকা সকলের বিস্মিত হওয়া দৃষ্টি অভ্রের দিকে নিবদ্ধ হলো। হঠাৎ-ই চলে যাবার খবর কারোর ঠিক হজম হচ্ছে। অভ্র নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ।’

আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিশিতা বলে উঠলো, ‘ওমা, কিছুদিন পর রাইমার বিয়ে। আর তুমি এখন চলে যাবে?’

অভ্র প্রত্যুত্তর করলো, ‘অনেক দিন তো হয়েছে এসেছি। ওইদিকে কাজ গুলো জমে আছে। ইদানীং কাজের ভীষণ চাপ। তাছাড়া বনানিতে আমার পারসোনাল কিছু দরকার আছে। বিয়ের সময় নাহয় আসবো।’

আবরার প্লেটে খাবার নিতে নিতে বললো, ‘কাজ সামলানোর জন্য সাত্তার আছে। তোমাকে টেনশন নিতে হবে না। তুমি আমার সাথেই ঢাকা ব্যাক করবে।’

অভ্র বললো, ‘বিয়ের সময় নাহয় আসবো। এখন আমার যাওয়া টা খুব জরুরি।’

তাদের কথার মাঝে নুরা হুট করে বলে উঠলো, ‘অভ্র ভাইয়া! কাজটা কিন্তু ঠিক না। আপনি থাকলে অনেক মজা হবে। প্লিজ এখন যাবেন না। প্লিজ প্লিজ।’

রোশান এতোক্ষণে মুখ খুললো, ‘আর কয়েকটা দিন থেকে যাও অভ্র। আবরার তো বলছে কাজ সামলাতে আরেকজন আছে সেখানে। টেনশন নিও না। থেকে যাও।’

অভ্র ছোট করে উত্তর দিলো, ‘দেখা যাক।’

অভ্রের চেহারা আর না জানিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সন্দেহ হলো আবরারের। হঠাৎ কি এমন হয়েছে যে তাকে না জানিয়ে ঢাকা যাবার প্ল্যান করে নিয়েছে অভ্র? সবসময় মুখে হাসি লেপ্টে থাকা ছেলেটার মুখ এখন গুমরো! কারণ কি? হাতে থাকা ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তারিখ দেখলো আবরার। কিছু একটা মনে পরতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরবে। মনে মনে ভাবলো এই কয়েকদিন অভ্রকে একা রাখা যাবে না।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো রিমি। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো অভ্রের দিকে। তার ছোট একটা কথায় অভ্র এভাবে চলে যাবে বিশ্বাস হচ্ছে না। কষ্ট লাগছে খুব। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাটা চামচ প্লেটে ঘুরাতে লাগলো। ভাবলে লাগলো কিভাবে অভ্রের যাওয়া আটকাবে। কিভাবে স্যরি বলবে।
_____________________

আষাঢ়মাসের কারণে বাহিরের পরিবেশটা আজ শীতল। কিন্তু দীবার মনটা আজ অস্থির। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে আবরারের রুমের সামনে পায়চারি করছে। এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ডাক দিবে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য? রাগ ভাঙ্গাবে কিভাবে? এই ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার। বারবার অস্থির মনে বড়বড় নিশ্বাস নিয়ে প্রশ্বাস ফেলছে। অতঃপর নিজেকে সামলে নিলো। এবার দরজা ধাক্কা দেবার জন্যই মনস্থির করলো। বহু চিন্তার কারণে শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয় জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে হাত উঠাবে এমন সময় পিছন থেকে অভ্র বলে উঠলো, ‘কিছু হয়েছে?’

হকচকিয়ে গেলো দীবা। হতভম্ব হয়ে পিছু ফিরে তাকালো। অভ্র প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। দীবা এক হাতে মাথা চুলকে কিছুটা ইতস্তত করে বললো, ‘না। তেমন কিছু না।’

অভ্র দীবার পিছনে আবরারের রুমের দিকে তাকালো। তারপর দীবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠলো, ‘ভাইয়ের রা:গ কিন্তু অনেক। সাবধানে কথাবার্তা বলবে ভাইয়ের সাথে। কখন কোন কথায় রে:গে যায় বলা মুশকিল। তবে আমার মনে হয় না এখন তোমার সাথে রাগ দেখাবে। নিশ্চিন্তে যেতে পারো।’

কথা বলেই নির্বিকার ভাবে পকেটে দুই হাত গুঁজে রুমে চলে গেলো। অভ্রের কথা শুনে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো দীবা। সাবধানে আর কি কথা বলবে সে? যা বলার আগেই তো বলে দিয়েছে। এখন কি করবে সে?? হৃদয় ভয়ার্ত হলেও মনে অনেক সাহস জুগিয়ে দরজায় কয়েকবার টোকা দিলো।
.

বারবার দরজায় টোকা পরার কারণে মহা বিরক্ত হলো আবরার। অপ্রসন্ন হয়ে দরজা খুললো। চেহারায় তার স্পষ্ট রাগের ছাপ। দরজার বাহিরে দীবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্রোধান্তিত চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো। গম্ভীর চোখে তাকিয়ে রইলো দীবার দিকে।

আবরার দরজা খুলার পর দীবা ঠোঁট টেনে বোকা বোকা টাইপ হাসি দিলো একটা। সকালে যেভাবে রাগিয়ে দিয়েছিলো ; এখন যদি সেই রাগের বশে থাপ্পড় দিয়ে বসে? কিংবা ভাঙ্গচুর করে? মনে সাহস জুগালো দীবা। শুকনো ঢোক গিলে বলল, ‘হ্যালো!’

প্রত্যুত্তর করলো না আবরার। চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো দীবার দিকে। তার এখানে আসার কারণ কি বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো। আবরারকে চুপ থাকতে দেখে দীবা আবারো বলে উঠলো, ‘কতোক্ষণ ধরে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। ভিতরে যেতে বলবেন না? কি অদ্ভুত লোক আপনি।’

‘ভিতরে আসতে হবে না।’ কথাটা বলেই দরজা লাগিয়ে দিতে লাগলো আবরার। তখুনি দরজা লাগাতে বাধা দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠলো দীবা, ‘আশ্চর্য দরজা লাগাচ্ছেন কেন? কতো খারাপ আপনি। সরেন সামনে থেকে।’

একপ্রকার জোর দেখিয়েই দরজা ঠেলে রুমের ভিতরে ঢুকলো দীবা। অবাক হলো আবরার। দরজা না লাগিয়ে পা দিয়ে ঠেলে ভিড়িয়ে দিলো কেবল। নির্বিকার ভাবে নিজের স্টাডি টেবিলের কাছে গেলো। দীবা আবরারের বিছানার উপর দুই পা তুলে বসলো। চোখ ছোট ছোট করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো তাকে। নির্লিপ্ত আবরার নিজের মতো টেবিলে থাকা কিছু বই, কাগজপত্র গুছাচ্ছে। ভুলেও দীবার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। এভাবেই পার হলো অনেকটা সময়। দীবা চোখ ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। আবরার এখনো কোনো প্রকার টুঁশব্দ করছে না। কারণটা তার জানা। তবুও আবরারকে খোঁচা দিয়ে বলে উঠলো, ‘কি ব্যাপার? সারাদিন কোথায় ছিলেন? বাড়ি ফিরলেন রাতে তাও ভাব নিয়ে আছেন। হয়েছে টা কি?’

আবরার একগাদা ফাইল ড্রয়ারে রাখতে রাখতে শুধাল, ‘তোমাকে কেন বলবো?’

মুখ কালো করে ফেললো দীবা। মন খারাপ হলো। এতো রেগে থাকার কি আছে? সে তো নিজে থেকে আবরারের রুমে এসেছে। তবুও লোকটা তাকে পাত্তা দিচ্ছে না? ক্ষুণ্ণ মনে বিছানা থেকে নেমে নিঃশব্দে আবরারের পিছনে এসে দাঁড়ালো। কোনো প্রকার সংকোচ ছাড়া আবরারের বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরালো। ঠোঁট উলটে ক্ষুণ্ণ মনে বললো, ‘স্যরি। তখন রাগের বশে কি থেকে কি বলেছি জানি না। সকালে অনেক মন খারাপ ছিলো। তাই হুট করে রেগে গিয়েছি। এতটুকুই তো রাগ দেখিয়েছি আপনার সাথে। তাই বলে এভাবে ইগনোর করবেন? আমার কিন্তু অনেক খারাপ লাগছে।’

চলমান….#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩১]

‘স্যরি। তখন রাগের বশে কি থেকে কি বলেছি জানি না। সকালে অনেক মন খারাপ ছিলো। তাই হুট করে রেগে গিয়েছি। এতটুকুই তো রাগ দেখিয়েছি আপনার সাথে। তাই বলে এভাবে ইগনোর করবেন? আমার কিন্তু অনেক খারাপ লাগছে।’

মলিন কন্ঠে কথা গুলো বললো দীবা। মন খারাপের কারণে ঠোঁট ভেঙ্গে আসছে তার। এই বুঝি কেঁদে দিবে। নিঃশব্দে মৃদু হাসলো আবরার। দীবার দিকে একটু এগিয়ে নিবিড় হলো। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে আবরারের চোখের দিকে তাকালো দীবা। আবরার বিনা সংকোচে দীবার কোমড়ে দুই হাত রাখলো। ভড়কালো না দীবা। নির্লিপ্ত হয়ে আবরারের দিকেই তাকিয়ে রইলো। দীবার কোমড় শক্ত করে ধরে উপরে উঠিয়ে পাশে থাকা টেবিলে বসালো। দীবার একদম কাছাকাছি এসে মুখের উপর পরে থাকা চুল গুলো কানের পিছনে যত্ন সহকারে গুঁজে দিতে লাগলো। মৃদু গলায় বললো, ‘আমি জানি আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয় নি। হঠাৎ অপরিচিত মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ায় নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। তাই তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করছি আমি। চেষ্টা করছি তোমার মনে আমার জন্য জায়গা করে নিতে। বিশ্বাস করো আমার সবটুকু দিয়ে চাইবো তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো। সারাজীবন আমারই থাকো। কিন্তু তুমি যদি বারবার আমাকে এড়িয়ে চলো তাহলে গড প্রমিস আমি তৃতীয় বারের জন্য বাড়ি ছাড়বো। এই বাড়িমুখো আর কখনোই হবো না।’

এমন কথা শুনে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো দীবা। কপাট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘আমি কি একবারো বলেছি যে আমি সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাই না? আগে আগে একটু বেশি ভাবেন কেন?’

খুশিতে উষ্ঠধয় প্রসারিত হলো আবরারের। দীবার দিকে এগিয়ে একদম ঘনিষ্ঠ হলো। বাঁকা হেসে প্রত্যুত্তর করলো, ‘স্বাভাবিক করতে চাও?’

দীবা মাথা উপর নিচ দুলিয়ে ‘হ্যাঁ চাই’ জানালো। আবরার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি রেখে বলে উঠলো, ‘তাহলে আসো আজ বাসরটা সেরে ফেলি। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রধান ধাপ। আজকের ওয়েদার টা কোল্ড। তোমাকেও মারাক্তক হট লাগছে। বাসর করার জন্য একদম পারফেক্ট।’

চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো দীবার। আবরারের আকস্মিক কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে আবরারের বুকে মৃদু ধা:ক্কা দিয়ে একটু দূরে সরিয়ে দিলো। লজ্জায় সংকোচিত হয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘অসভ্য লোক। এইজন্যই আপনার কাছে আসি না।’

দীবার প্রত্যুত্তর শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আবরার। হাসি তার থামছে না। তার এই হাসিতে মুগ্ধ হলো দীবা। কিন্তু প্রকাশ করলো না। উলটো আবরারের মুখ চেপে ধরলো যেন হাসির শব্দ থামে। চোখ দুটো বড় বড় করে কড়া গলায় বলে উঠলো, ‘চুপ। রাক্ষসের মতো হাসছেন কেন?’

আবরার মুখ থেকে দীবার কোমল হাতটা সরিয়ে দিয়ে ঠোঁটে হাসি রেখেই শুধাল, ‘এইটুকুতেই অসভ্য বলে দিলে? আর যখন পুরোপুরিভাবে রোমান্টিক হয়ে যাবো তখন সামলাবে কি করে?’

‘সরুন তো নির্লজ লোক।’ বলেই লজ্জায় আবরারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। টেবিল থেকে নেমে দৌড়ে চলে যেতে নিলেই আবরার দীবার হাত ধরে আটকে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

দীবা চোখ পাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘রুমে যাচ্ছি ঘুমাতে। আপনাকে আমার বিশ্বাস নেই।’

আবরার দীবার হাত ছাড়লো না। তাকে ইচ্ছে করে রাগাতে সিরিয়াস চোখে মুখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আবারো ইগনোর করছো?’

হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা। কিসের মাঝে কি কিসের কথা বললো এই লোক? সে কোথায় ইগনোর করছে? রাগ হলো কিছুটা। তাই বিরক্ত হয়ে আবরারের হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো, ‘একেই বলে বেডা মানুষ। বললে এক লাইন, বুঝে চার লাইন।’

বিছানার কার্নিশ ঘেঁষে শুয়ে পরলো দীবা। নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেললো আবরার। দরজা লাগিয়ে লাইট অফ করে বিছানায় আসলো। দীবাকে পিছন দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো নিজেও। ঘাড়ে গভীর একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘কাল কলেজ আছে তাই না? ঘুমিয়ে পরো জলদি।’

অন্ধকারেই মুচকি হাসলো দীবা। বিমুখিত হয়ে মৃদু গলায় জানালো, ‘গুড নাইট।’ অতঃপর ঘুমিয়ে গেলো আবরারকে জড়িয়ে ধরে।
.

রজনীর মধ্যভাগ! অন্ধকার নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারপাশ থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কর্কষ ধ্বনি ভেসে আসছে। অম্বরে অর্ধ গোলাকৃতির চাঁদটা তার জ্যোৎস্নায় আলোকিত করেছে ধরনী। ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ কানে স্পষ্ট বাজছে। মাথা তুলে দীবার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকালো আবরার। আনমনে মুগ্ধ হয়ে হেসে দীবার কপালে ছোট করে একটা চুমু দিলো। অতি সাবধানে নিজেকে দীবার থেকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নামলো। নিঃশব্দে রুমের বাহিরে গিয়ে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলো। তারপর-ই পা বাড়ালো অভ্রের রুমের দিকে। দরজার কাছাকাছি এসে নক করার কিছুক্ষণ পরেই দরজা খুললো অভ্র। চেহারা তার মলিন। চুল গুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে কপালে পরে আছে। প্রতিদিনকার হাসিটা আজ অদ্ভুত ভাবে গায়েব। অভ্রের চোখ দেখে আবরার অনায়াসে বুঝে গেলো ছেলেটা এখনো ঘুমায় নি। মন খারাপের কারণে যেকোনো মুহূর্তেই কেঁদে দিতে পারে। আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরবে। অনুমিতি ব্যতিত রুমে প্রবেশ করে বললো, ‘এখনো ঘুমাও নি?’

অভ্র অতিমাত্রায় স্বাভাবিক ভাবে রুমের দরজা লাগিয়ে ছোট করে উত্তর দিলো, ‘না।’

আবরার বিছানায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে ডাকলো অভ্রকে। অভ্র চুপচাপ এগিয়ে এসে আবরারের পাশে বসলো। দুই হাটুতে কনুইয়ের ভর দিয়ে কিছুটা ঝুকে এসে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবরার কিভাবে কথার সূত্রপাত ঘটাবে বুঝতে পারছে না। তবুও শান্ত্বনা দিতে বললো, ‘অভ্র তুমি অনেক বড় হয়েছো। এমন ছেলেমানুষি তোমাকে দিয়ে মানায় না।’

অভ্র প্রত্যুত্তর করলো না। প্রথমের ন্যায় মেঝেতেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আবরার নিস্প্রভ কণ্ঠস্বরে আবারো বললো, ‘আঙ্কেলের হায়াত যতোদিন ছিলো ততোদিন উনি বেঁচে ছিলেন। যদিও হঠাৎ মৃ:ত্যু টা আমাদের এক্সপেকটেশন ছিলো না। কম চেষ্টা তো আর করা হয় নি। কতশত মানুষ ক্যান্সার থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু আঙ্কেল পায় নি। তকদিরে যা ছিলো তাই হয়েছে। আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুক দোয়া করি।’

নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথাটা উপর নিচ দুলালো অভ্র। অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘সব আমার দোষ! আমি আব্বুর ভালো ট্রিটমেন্ট করাতে পারি নি। কেন ওইদিন আমি হস্পিটালে ছিলাম না? আব্বু নিশ্চয় এখনো আমার উপর রেগে আছে। মৃত্যুর সময় আমি উনার পাশে ছিলাম না। কতো খারাপ আমি।’

আবরার অভ্রের কাধে এক হাত রেখে বললো, ‘অভ্র? এতে তোমার কোনো হাত নেই। তুমি আমি সাত্তার সবাই অনেক চেষ্টা করেছি। আঙ্কেলের লাস্ট স্টেপ ছিলো। ওইদিন তো তুমি মেডিসিন আনতেই বাহিরে গিয়েছিলে। নিজেকে দোষারোপ করবে না প্লিজ। আঙ্কেলের জন্য দোয়া করো।’

অভ্র কান্না মিশ্রিত কন্ঠে শুধাল, ‘খুব ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছি। তখন থেকে আব্বু পাশে ছিলেন। আর আজ দুই বছর হলো আব্বু নেই। অথচ দেখো আমি বিন্দাস আছি। সত্যি বলছি ভাই আব্বুকে ছাড়া থাকতে পারছি না আর। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।’

নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবরার। যথাসম্ভব শান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো অভ্র কে।
.

অভ্র ও আবরারের সম্পূর্ণ কথোপকথন রুমের দরজার বাহির থেকে শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো রিমি। প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে সে। বহু ভেবে চিন্তে অভ্রকে সরি বলতে এসেছিলো যেন আগামীকাল চলে না যায়। দরজার বাহির থেকে টোকা দেবার আগেই আবরারের কন্ঠস্বর কানে আসলো। এক এক করে দুজনের কথা গুলো শুনেই চোখ দিয়ে আপনাআপনি কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। বড্ড অপরাধবোধ কাজ করলো মনে। চুপচাপ নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসলো। কেঁদে ফেললো রিমি। কতোটা খারাপ সে? ছাদে তখন এভাবে কথা বলা উচিত হয় নি তার। নিজের অজান্তেই অভ্রকে কষ্ট দিয়েছে সে। নিজের প্রতি রাগ হলো প্রচুর। মারাক্তক রাগের কারণে আবারো কেঁদে উঠলো সে। অভ্রের কষ্টে তার নিজেরও কষ্ট লাগছে। ভীষণ কষ্ট! নিজের অজান্তেই মনের সুপ্ত কোণে অভ্রের জন্য বিশাল জায়গা করে দিয়েছে রিমি। আদৌ জানে না এই নতুন অনুভূতির নামকরণ কি করা হবে।
______________________

ভোরের আলো ফুটতে এখনো বাকি। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলেও ছিমছাম আবছা আলোতে পরিপূর্ণ। রাতের অর্ধ গোলাকৃতির চাঁদটা আকাশে মিলিয়ে গেছে। মুয়াজ্জিনদের ডাকে অনেকে ইতিমধ্যে মসজিদে পারি জমিয়েছে জামায়াতে সালাত আদায় করার জন্য। সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে রিমি। শেষ রাতে একটু চোখ লেগেছে তবুও আজানের ধ্বনিতে উঠে পরলো। চটজলদি নামাজ পরে বিছানায় বসে গড়িমসি খাচ্ছে প্রায়। অভ্র চলে যাবে এই একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। কিভাবে সরি বলবে, কিভাবে তার যাওয়া আটকাবে তাই ভাবছে। বহু চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনার পর অভ্রের রুমে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো। গায়ে ওড়নাটা জড়িয়ে অভ্রের রুমের সামনে আসলো। দরজায় টোকা দিতে গিয়ে খেয়াল করলো দরজাটা হালকা ভিড়ানো। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রিমি। সন্দেহ তার ঠিক-ই হলো। অভ্র খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে যায়। ঘুমায় তো দেরিতে ; তাহলে এতো তাড়াতাড়ি উঠে কিভাবে? নিশ্চয় এলিয়েন। নাহলে কখনোই সম্ভব হতো না। ভাবতে ভাবতে রুমের ভিতরে উঁকি দিলো। খুবই সাবধানতার সাথে উঁকি দেওয়া অবস্থায় চোখ দুটো পুরো রুম জোরে বিচক্ষণ করালো। তখুনি ঘটে গেলো এক আকস্মিক ঘটনা। যার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না রিমি। যখন পূর্ণ মনোযোগ সহকারে রুমের ভিতরটা দেখতে ব্যস্ত ; তখুনি কেউ পিছন থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। হকচকিয়ে গেলো রিমি। প্রকাণ্ড রকমের ভয়ের কারণে ভড়কে গিয়ে বুকে ফু দিলো। কে দিয়েছে ধাক্কা দেখার জন্য পিছু ফিরে তাকাতেই অভ্রকে নজরে আসলো তার। দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে নিরবে রুমে ঢুকে দরজাটা পা দিয়ে ভিড়িয়ে দিলো অভ্র। দরজা লাগিয়ে দেওয়ায় চমকে উঠলো রিমি। হতভম্ব হয়ে কিছু বলে উঠার আগেই অভ্র প্রশ্ন করে বসলো, ‘এখানে কি করছিলে?’

রিমি কিছুটা ইতস্তত করে শুধাল, ‘কাজেই এসেছি।’

পকেটে হাত রেখেই সটান হয়ে দাঁড়ালো অভ্র। ভ্রুঁ জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বললো, ‘আমার রুমের সামনে তোমার কিসের কাজ?’

নতজাত হলো রিমি। দুই হাতে ওড়নার একাংশ টেনে আঙ্গুলে মুচড়াতে লাগলো। মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো বলে উঠলো, ‘আই’ম সরি। ছাদে ওভাবে বলা উচিত হয় নি আমার। প্রথম থেকেই আপনার সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। ভেবেছিলাম তখনো হবে। তাই কি হুট করে বলে ফেললাম। আপনি আমার কথায় কষ্ট পাবেন জানলে কখনোই ওভাবে বলতাম না।’

অভ্র চোখ ছোট ছোট করে রিমির আপাতমস্তষ্ক ভালো ভাবে দেখে নিলো। মনে মনে হাসলো সে এই ভেবে যে রিমি তাকে সরি বলতে এসেছে। যদিও সে রিমির উপর একটুও রেগে নেই। ভাবতেই অভ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে রিমির অগোচরে নিরবে আলতো ভাবে হাসলো। অনেকক্ষণ যাবত অভ্রকে চুপ থাকতে দেখে টানা টানা চোখ দুটো তুলে তাকালো রিমি। অভ্র কি তাহলে তাকে ক্ষমা করে নি? এইসব ভেবে ক্ষুন্ন হলো মন। অভ্রের দিকে এক কদম এগিয়ে এসে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ট্রাস্ট মি অভ্র, আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি। প্লিজ আমার উপর রেগে থাকবেন না। সরি বলছি তো। আর কখনো ঝগড়া করবো না। কিছু তো বলেন। মাফ করেন নি? কান ধরবো তাহলে?’

কথাটা বলেই দুই হাতে কান ধরলো রিমি। আবারো অনুনয় স্বরে বলে উঠলো, ‘সরি বললাম তো। প্লিজ অভ্র আর রেগে থাকবেন না।’

একের পর এক বিস্মিত হচ্ছে অভ্র। প্রথম বিস্মিত হলো রিমিকে এখানে সরি বলতে আসতে দেখে। দ্বিতীয় বিস্মিত হলো তার নাম ধরে সম্মোধন করতে দেখে। তৃতীয় বারের মতো বিস্মিত হলো বাচ্চাদের মতো কান ধরতে দেখে। হাসি পেলেও হাসলো না অভ্র। রিমির অনুরোধের কারণে প্রত্যুত্তরে বললো, ‘ঠিক আছে। কানে ধরতে হবে না।’

রিমির মলিন চেহারায় খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো। উল্লাসিত হয়ে হাসি দিলো একটা। খুশি মনে বলে উঠলো, ‘মাফ করেছেন আমাকে? তার মানে আপনি আর যাচ্ছেন না? ওয়াও! দ্যাট’স গ্রেট।’

রিমির কথা শুনে একটা ভ্রুঁ বাঁকা করলো অভ্র। বললো, ‘যাচ্ছি না মানে? কে বলেছে তোমাকে?’

রিমি বললো, ‘প্লিজ অভ্র ভাই আর কয়েকটা দিন থেকে যান। রাইমা আপুর বিয়েতে অনেক মজা হবে। আপনি থাকলে আরো মজা হবে। প্লিজ থেকে যান। আমার জন্য হলেও থেকে যান।’

অভ্র প্রথমের তুলনায় কন্ঠ কিছুটা ত্যাঁছড়া করে বললো, ‘আমি চলে গেলে তোমার কি?’

বারবার অনুরোধ করার পরেও অভ্রের কাছে এমন প্রশ্ন শুনে ক্ষুব্ধ হলো রিমি। রাগ হলো কিছুটা। অস্থিরতার কারণে রাগ দমাতে না পেরে ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিয়ে উঠলো, ‘আমার কি মানে? আমারই অনেক কিছু। তুমি চলে যাবে কেন? তোমাকে থেকে যেতেই হবে। তুমি চলে গেলে আমি কার সাথে ঝগড়া করবো? কাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবো? যাবে না তুমি। আমার পাশেই থেকে যাবে। কারণ আমার তোমাকে ভালো লাগে। তাই তুমি না থাকলে এই বিয়েতে আমি এঞ্জয় করতে পারবো না। আমি বলেছি মানে তুমি যাচ্ছো না। এটাই ফাইনাল।’

এক টানা এতো গুলো কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলো রিমি। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। রাগের বশে কি থেকে কি বললো জানা নেই তার। তবুও সেদিকে কোনো ভ্রুঁক্ষেপ নেই। অভ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো রিমির দিকে। সব কিছু হজম হলেও রিমির বলা ভালো লাগার কথাটা ঠিক হলো না। কিছুটা নাবুঝের মতো জানতে চাইলো, ‘কি বললে তুমি? কাকে ভালো লাগে?’

রিমি অভ্রের দিকে দু-কদম এগিয়ে একদম কাছাকাছি আসলো। দুজনের দূরত্ব কেবল এক হাত মাত্র। চোখে চোখ রাখলো রিমি। প্রথমের মতোই কন্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে শুধাল, ‘আমার তোমাকে অনেক ভালো লাগে। অন্যসব মেয়েদের মতো এতো লজ্জা টজ্জা আমার নেই। তোমাকে পছন্দ করি তাই ডিরেক্ট বলে দিলাম। এখন তুমি এখানে থাকবে ব্যাস। রাইমার আপুর বিয়ের পর নাহয় ঢাকা ব্যাক করো। আর হ্যাঁ, আমার এক্সাম শেষে বিয়ে করে নিবো দুজন। তারপর কিছুদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে যাবো। হানিমুনের জন্য যাবো সুইজারল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড।’

এতো এতো পরিকল্পনা শুনে এখনো হতভম্ব অভ্র। রিমির কথাবার্তা সব তার তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বিস্মিত হয়ে রিমির কপালে এক হাত রেখে ছুঁয়ে দিয়ে বললো, ‘জ্বর উঠেছে তোমার?’

‘আমি একদম সুস্থ আছি।’

‘যা বলছো সব ভেবে বলছো তো?’

‘একদম!’

রিমির সহজ সরল স্বীকারুক্তি দেখে মৃদু হাসলো অভ্র। প্রথম থেকেই রিমির প্রতি তার একটা সফট কর্নার ছিলো। এখন সেই ছোট অনুভূতি টা আরো প্রগাঢ় হলো। ভালো লাগলো মনে। একটু ভাব নিতে দুই হাতে নিজের এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললো, ‘ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখবো। তুমি এখন যেতে পারো।’

‘ভেবে দেখবো’ কথাটা গায়ে লাগলো রিমির। প্রপোজাল রিজেক্টেড! রাগ হলো প্রচুর। নিজের জেদ বজায় রাখতে রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে উঠলো, ‘কি ভেবে দেখবে? আমি কি তোমাকে ভাবার জন্য বলেছি? আমার তোমাকে ভালো লাগে মানে এখন থেকে আমরা রিলেশনশিপে আছি। এখানে তোমার সম্মতি থাকুক আর না থাকুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’

এইটুকু বলে রিমি অভ্রের একদম কাছে আসলো। এক হাত উঠিয়ে তুড়ি বাজিয়ে ভীতিপ্রদর্শন করে বললো, ‘তুমি আমার মানে সারাজীবন আমারই থাকবে। কথাটা মনে রেখো।’

বলেই অভ্রকে আলতো হাতে ধা:ক্কা দিয়ে সরিয়ে গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে অভ্র। এটা কি মেয়ে? নাকি কোনো প্রশাসক? এভাবে কেউ প্রপোজ করে? মেয়ে মানুষ মানে লজ্জায় লাল নীল হবে। তা না করে এই মেয়ে উল্টো আমাকেই লজ্জায় ফেলে দিলো। সাংঘাতিক একটা মেয়ের প্রেমে পরেছিস তুই অভ্র। সাংঘাতিক!

চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩২]

“ম্যাডাম, ঘুমিয়ে ছিলেন তাই ডাক দেই নি। অভ্রকে নিয়ে বাহিরে যাচ্ছি। গতকালকের মতো আবার টেনশন করে প্রেশার লো করবেন না। সন্ধ্যায় ফিরবো। টেক কেয়ার বউজান।” – এবি।

ঘুম থেকে উঠে বালিশের পাশে আবরারের রেখে যাওয়া চিরকুট টা পড়ে আনমনে মুচকি হাসলো দীবা। আজকের সকালটা সুন্দর। মোহনীয় করে তুলেছে আবরার। অনুপস্থিত থেকেও মুগ্ধতায় ছড়িয়ে দিয়েছে দীবার অবুঝ মন। কিন্তু দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে চোখ দুটো তার চড়কগাছের ন্যায়। প্রতিবার এমন হয়! যেদিন আবরার পাশে থাকে সেদিন-ই ঘুম ভাঙ্গে দেরিতে। এমনটা হয় কেন? ওইদিন রাতেই কেন ভালো ঘুম আসে চোখে? দীবা এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে দ্রুততার সঙে নিজের রুমে ছুটে আসলো। দরজাক ঠেলে ভিতরে ঢুকে প্রথম দফায় হতবাক হয়ে গেলো। রিমি নুরাকে রুমে বসে থাকতে দেখেই সাথে সাথে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ‘ডাইনি দুইটা এখানে কি করছে?’

রিমি বিছানার হেডসাইডে গেলান দিয়ে আপন মনে ইন্ট্র‍্যাগ্রাম চালাচ্ছে। নুরা স্টাডি টেবিলের উপর পা তুলে বসে উপন্যাসের পৃষ্টা ঘাটছে। দুইজনই ইউনিফর্ম পরিহিত। সকালে সময় মতো তৈরি হয়ে দীবার রুমে এসেছিলো দুইজন। প্রতিদিনকার মতো আজও তিনজন একইসঙ্গে নাস্তার টেবিলে যাবে এই ভেবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। রুমে এসে দেখলো দীবা নেই। অনেক খুঁজাখুঁজি ও ভাবাভাবির পর বুঝতে পারলো আবরারের রুমে। তখন থেকেই দুইজন এখানে অপেক্ষায় আছে।

দীবা মৌনতার সঙ্গে রুমের ভিতরে ঢুকলো। নিজের মতো করে কাভার্ড থেকে কাপড় নামাতে লাগলো। ভাব এমন যেন এখানে সে ব্যতিত আর কারোর উপস্থিতি নেই। দীবার এমন ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে রিমি নুরা ভ্রুঁ কুঁচকে একে অপরের দিকে তাকালো। নুরা হাতে থাকা বই বন্ধ করে লম্বা হাই তুলে বলে উঠলো, ‘রিমি রে? আমাদের রুটিন বদলাতে হবে।’

রিমি হেলান দেওয়া অবস্থা পরিবর্তন করে সোজা হয়ে বসলো। কথার তাল মিলিয়ে নিজেও শুধাল, ‘হ, আমরা তো আর মিঙ্গেল না যে সকালে উঠতে দেরি হবে। রাতে তাদের কতো কাজকারবার থাকে।’

রিমির এমন কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো দীবা। অবাক হয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট করে রিমির দিকে তাকালো। নুরাও রিমির কথার প্রত্যুত্তরে বললো, ‘হ ভাই। এখন থেকে রেডি হয়ে সোজা নাস্তার টেবিলে চলে যাবো। মানুষ তো ঘুমিয়ে থাকবে। তাদের জন্য আমাদের দেরি করে লাভ কি?’

দীবা কোমড়ে এক হাত রেখে চোখ পাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য ভাই। যা বলার সরাসরি বল না। এভাবে কথা বলছিস কেন?’

রিমি চেহারায় কাদুকাদু ভাব এনে বললো, ‘নুরা বোইন রে, আমাদের আর ভিতরে বউ রেখে দরজা আটকে ভাইয়ের থেকে টাকা আদায় করা হবে না।’

দীবা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো, ‘কিসের টাকা?’

নুরা ধপাস করে টেবিল থেকে নেমে দাঁড়ালো। দীবার কাছে এসে মাথায় একটা গা:ট্টা মে:রে বললো, ‘বাসর রাতের কথা বলছে গাধা।’

মাথায় গা:ট্টা মা:রায় চোখ পাকিয়ে তাকালো দীবা। রিমি বিছানা থেকে নেমে এসে দীবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভ্রুঁ জোড়া নাচিয়ে নাচিয়ে বললো, ‘আমরা কি ফুফুর ডাক শুনতে পারবো বেইব?’

‘তোদের মন্ডু!’ কথাটা বলেই কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো দীবা। সে যেতেই রিমি নুরা উচ্চস্বরে হাসিতে মেতে উঠলো। দুইজন-ই খুশি হলো এই ভেবে যে আবরার আর দীবার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
___________________________

আষাঢ়মাস শেষ হতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। বাদলা দিনের সুবিশাল আকাশটা ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন। কলেজের পাশে কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে টুইটুম্বুর। সদ্য ফোটা কচি পাতা গুলো তার সবুজ রঙ্গে চট্টগামের পরিবেশ করেছে প্রাকৃতিক রানী। পানিতে ফোটা শাপলা ফুলের মনোরম সৌন্দর্য যেন বর্ষাকালের ঋতুকে শ্রেষ্ঠ ঋতু হিসেবে গণ্য করে। সকাল থেকেই শীতর বাতাসের সঙ্গে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ছিলো। দুপুরের দিকে আকাশটা স্বচ্ছতায় মুখরিত হলো। ক্লাস শেষে বেল পরতেই আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ কোলহলে পরিপূর্ণ হলো। শিক্ষার্থীদের আনাগোনা শুরু হলো চারপাশে। দীবা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রিমি ও নুরার উদ্দেশ্যে বললো, ‘তোরা বাড়ি চলে যা। আমি নোট গুলো রাজ স্যারকে দেখিয়ে আসছি।’

সিঁড়ির থেকে নেমে তিনজন একপাশে দাঁড়ালো। নুরা বললো, ‘ পরে তুই একা যাবি কিভাবে? আমরা নাহয় একটু দাঁড়িয়ে থাকি। তোর কাজ শেষ হলে এক সাথে যাবো।’

রিমিও সম্মতি দিলো নুরার কথায়। কিন্তু দীবা শুনলো না। নোট গুলো দেখাতে দেখাতে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া এখন বৃষ্টির সময় একা রিকশা দিয়ে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে তার। তাই রিমি নুরাকে রাখতে চাইলো না। জোরপূর্বক দুজনকে পাঠিয়ে দিলো বাড়িতে। ওরা যেতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। মনে মনে ভাবলো অন্য কোনো সময় তিনজন মিলে ঘুরবে। অতঃপর সময় নষ্ট না করে রাজের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। দরজার সামনে এসে হাত উঠালো টোকা দিতে। তখুনি রাজ কেবিনের দরজা খুলে বাহিরে আসলো। হঠাৎ বাহিরে আসায় টোকা দরজায় না পরে রাজের গায়ে পরলো। আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। ভড়কে গিয়ে আমতা আমতা করে বললো, ‘আই’ম সরি স্যার। আমি দেখতে পাই নি। সরি। আসলে নক করতে এসেছিলাম তখুনি..! ‘

দীবার কথা সম্পূর্ণ শেষ করতে দিলো না রাজ। তার আগেই রাজ বলে উঠলো, ‘ইট’স ওকে। এখানে তোমার দোষ নেই। আমি হঠাৎ বেরিয়েছিলাম তাই গায়ে লেগেছে।’

দীবা প্রত্যুত্তর করলো না। অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য কিছুটা লজ্জিত হলো দীবা। অপরাধীর মতো তাকিয়ে রইলো কেবল। রাজ মৃদু হেসে দীবাকে স্বাভাবিক করতে বললো, ‘কি বলতে এসেছিলে নাকি?’

শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয়ে জিভ বুলিয়ে ভিজিয়ে নিলো। শুধাল, ‘আসলে স্যার নোট গুলো আপনাকে দেখাতে এসেছি। সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কিনা তাই। যদি একটু হেল্প করতেন।’

‘কিন্তু এখন তো কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। ব্রেক টাইমে আসতে পারতে।’

দীবা মাথা কিছুটা নত করে অন্য দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বললো, ‘আসলে ব্রেক টাইমে আসবো ভেবেছিলাম। কিন্তু তখন অনেক ক্ষিদে পেয়েছে। তাই আর…”

দীবার কথা শুনে আলতোভাবে হাসলো রাজ। যতোবার দীবার সাথে দেখা হচ্ছে ; ততবার দীবার সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারছে। মেয়েটার সব কিছুই মুগ্ধ হওয়ার মতো। এই যে ডিনারের সময়! দীবার খাওয়া দেখে অবাক হয়েছিলো রাজ। মেয়েটা এতো আস্তে আস্তে খায়? মুরগির বাচ্চাও বোধহয় দীবার থেকে বেশি খায়। তাই তো শরিরের এই অবস্থা। ভাবতেই দীবার অগোচরে হাসলো রাজ। অতঃপর কেবিনের দরজা লাগিয়ে বললো, ‘সমস্যা নেই। আসো পাশের রেস্টুরেন্টে যাই। আমার প্রচুর ক্ষিদে পেয়েছে। এক সাথে লাঞ্চ করে নিবো আর তোমার নোট গুলো দেখে নিবো। আসো।’

দীবা কিছুটা ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। যাবে কি যাবে না এই নিয়ে দ্বিধায় পরেছে সে। রাজ আবারো বলল, ‘সমস্যা হলে থাক। লাইব্রেরিতে বসি ওখানেই দেখে নিচ্ছি নোট গুলো।’

দীবা মনে মনে ভাবতে লাগলো। নোট গুলো তো দেখতে অনেক সময় লাগবে। এতোক্ষণ স্যার না খেয়ে থাকবে? ব্যাপার টা তার খারাপ লাগলো। তাই আর দ্বিমত পোষণ করলো না। রাজি হয়ে গেলো যাওয়ার জন্য। উপরে উপরে শান্ত থাকলেও ভিতরে মহা খুশি হলো রাজ। সময়টা অল্প হোক, তবুও একান্তে দীবার পাশাপাশি থাকতে পারবে সে। এতো গুলো বছর অনেক দূরত্ব সহ্য করেছে। এখন আর না। এইসএসসি এক্সামের পরেই দীবাকে তার নিজের করে নিবে। একান্তই নিজের।
_______________________

চট্টগ্রাম মানেই প্রাচুর্যের রানী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য চট্টগাম অতুলনীয়। সেখানে যদি হয় বর্ষাকাল তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। সকাল থেকে দুপুর অব্দি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা ঘটা ভিজে আছে। গাছের পাতা গুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে চকচকে রূপ ধারণ করেছে। ভিজে যাওয়া পিচ ঢালা রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে আবরার ও অভ্র। দুইজনের পরনে সাদা হুডি। মাথায় হুডি তুলে মুখে কালো মাক্স পরেছে যেন কেউ চিনতে না পারে। পড়ন্ত বিকেলের আভাষ চারপাশে। সূর্যমামা মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পরেছে। পরিবেশ শীতল। সারাটা দিন ঘুরাঘুরির পর মনটা হালকা হালকা লাগছে অভ্রের। অবশ্য আবরারের পাশে থাকলে তার মন কখনোই খারাপ থাকে না। আবরারকে বড় ভাই হিসেবে সবসময় ট্রিট করে এসেছে অভ্র। হাঁটতে হাঁটতে দীবাদের কলেজের সামনে সতেরো নাম্বার রোডে এসে পরেছে। আবরার দীবাদের কলেজটা দেখিয়ে দিলো। তারপর হঠাৎ-ই তার পুরনো বন্ধুর কথা মনে পরলো।

‘আসো আজ তোমাকে আমার ছোটবেলার একটা বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।’

অভ্র জানতে চাইলো, ‘নাম কি? বাড়ি যাবেন নাকি তার?’

আবরার প্রত্যুত্তর করলো, ‘পল্লব দাশ। বাড়িতে যাবো না। পল্লবের একটা রেস্টুরেন্ট এখানেই আছে। চলো যাই।’

অভ্রকে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছালো আবরার। একটা ওয়েটারের কাছে নাম বলতেই ওয়েটার তাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টের মালকিনের কাছে নিয়ে যায়। আবরার তার বন্ধু পল্লবকে নিজের পরিচয় দিতেই খুশিতে আমোদিত হয়ে উঠে পল্লব। শৈশবের প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রথমে। পরিচয় করিয়ে দিলো অভ্রের সাথে। খুশিতে বসে তিনজন আলোচনায় মশগুল হলো। আবরার প্রথমেই অনুরোধ করলো তার পরিচয় এখানে না দিতে। তাই করলো পল্লব। আশেপাশের কেউ টেরও পেলো না এখানে এতো বড় নামকরা গায়ক আছে।

দীর্ঘসময় ধরে দুই বন্ধু জমিয়ে আড্ডা দেবার পরে উঠে দাঁড়াল আবরার। পল্লবের কাছ থেকে বিদায় নিলো। অভ্র কে নিয়ে বেড়িয়ে যাবার মুহূর্তেই দূরের একটা টেবিলে নজর গেলো তার। বিস্মিত হলো আবরার। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো একবার। দীবাদের কলেজ তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে। তাহলে মেয়েটা এখানে কি করছে? ছুটির পর দীবা বাড়ি যায় নি রা পরনের ইউনিফর্ম দেখেই বুঝে গেছে আবরার। প্রথমে ভেবেছিলো দীবার কাছে যাবে। কিন্তু তার আগেই দীবার সামনে বসে থাকা লোকটাকে দেখেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। দাঁতে দাঁত লেগে আসলো নিরবে। মারাক্তক লেভেলের রাগের কারণে কপালের রগ ফুলে নীল বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখালো আবরার। চুপচাপ বেড়িয়ে গেলো অভ্রকে নিয়ে। যদিও অভ্র দীবাকে দেখে নি।
______________________

হাত ঘড়িতে সময় দেখলো রাজ। তারপর দীবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার সব গুলো নোট পারফেক্ট হয়েছে। আমি যেগুলো দাগিয়ে দিয়েছি তা আবারো লিখে দেখাবে। আর হ্যাঁ বাড়িতে বেশি বেশি প্র‍্যাক্টিস করবে।’

দীবা প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে বললো, ‘ঠিক আছে।’

‘তাহলে চলো। এবার উঠি।’

বিল পে করে উঠে দাঁড়ালো দুজন। রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য পা বাড়ালো। দীবা রাজের পিছু পিছু হাঁটছে। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে দীবার উদ্দেশ্যে রাজ বলে উঠলো, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে তোমার তাই না? একা যেতে হবে না। বাড়ি পৌঁছে দেই আসো।’

দীবা চটজলদি বারণ করে বললো, ‘না স্যার। আমি একা যেতে পারবো। সমস্যা নেই।’

রাজ আবারো হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি এখন ফ্রি আছি। পৌঁছে দিতে পারবো। আসো?’

দীবা প্রথমের মতোই নাকচ করলো, ‘আমি একাই যেতে পারবো। আমাকে একটা রিকশা ডেকে দেন শুধু।’

রাজ দীবার কথা মতো একটা রিকশা ডেকে দিলো। দীবা সেখানে উঠে বসতেই বিদায় জানালো রাজ। চলতে লাগলো রিকশা। পকেটে দুই হাত গুঁজে রিকশার দিকে তাকিয়ে রইলো রাজ। মৃদু হাসি ফুটে এলো তার ঠোঁটে।
______________________

শান্তিনিবাসের সামনে রিকশা থামতেই দীবা তড়িঘড়ি করে ভাড়া দিয়ে বাড়ির ভিতরে দৌড় লাগালো। আজ সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। হাত ঘড়ির দিকে সময় দেখে তার চোখ চড়কগাছ প্রায়। শুকনো ঢোক গিললো একটা। মনে মনে এই ভেবে স্বস্তি পেলো যে আবরার সন্ধায় বাড়ি ফিরবে। এখনো সন্ধ্যা হয় নি। আবরার আসার আগেই সে ফিরেছে। গেইটের কাছ থেকে দৌড়ে আসার কারণে হাঁপিয়ে উঠেছে দীবা। সদর দরজা দিয়ে চুপিচুপি বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। ড্রয়িংরুমে কাউকে না দেখে মনে মনে খুশি হলো বেশ। চটজলদি পা চালিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। রুমের সামনে গিয়ে দরজা খুলতে ভিতরে ঢুকার সময় থমকালো দীবা। অবাক চোখে আবরারের রুমের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। আবরার পকেটে দুই হাত গুঁজে দরজায় হেলান দিয়ে দীবার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন এভাবে তাকিয়ে থাকার পর চুপচাপ রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আবরারের এমন রিয়েকশন দেখে ভয় পেলো দীবা। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো আবরারের রুমের দিকে।

চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here