আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -৪৬+৪৭

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৪৬]

বিষণ্ণতার বিকেল গুলো কেটে যাচ্ছে চোখের পলকে। আষাঢ়মাসের দিন গুলো শান্তিপূর্ণ থাকলেও শ্রাবণের মেঘ গুলো শূন্যতায় ভরিয়ে দিলো। ক্লান্ত বিকেল, একাকিত্বের রাত, বিষণ্ণ সুন্দর সকাল! শ্রাবণের প্রাত্যহিক দিনগুলো এভাবেই কাটছে নুরার। চোখের নিচের কালো দাগ মেকআপের আস্তরণের মধ্যে লুকানো হয়েছে জনসম্মুখ হতে। হৃদয়ের ক্ষত গুলো আড়ালে রেখে সকলের সঙ্গে হাসিখুশি দিন গুলো বিদায় দিচ্ছে নুরা। তবে রাজকে না দেখার বেদনা তাকে বিষিয়ে তুলছে। প্রতিদিন কলেজে যাবার পর থেকে চোখ দুটো শুধু রাজকে খুঁজে বেড়ায়। অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে না পারার কষ্ট তাকে কুঁকড়ে কুঁকড়ে খায়। ফটিকছড়ি তেই রাজের সঙ্গে দেখা হয়েছে তার। এখন অব্দি রাজের কোনো খোঁজ পেলো না। কলেজেও আসছে না। হায়ার ম্যাথম্যাটিকস ও ফিজিক্স ক্লাস রাজের পরিবর্তে অন্য টিচার করাচ্ছে। রাজের মতো গম্ভীর, রাগী টিচার ক্লাসে না আসায় অন্য সবাই খুশি হলেও নুরা মোটেও না। রাজের না আসার কারণটা তার জানা। তবে কি সত্যি রাজ দেশ ছাড়বে? প্রশ্ন টা মনে আসতেই বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো। চোখ ঘুরিয়ে বারবার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে নুরা। ক্লাসটা শেষ হবার অপেক্ষা করছে শুধু।

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর ঘনিয়ে ক্লাস শেষ হলো। অর্ধবয়স্ক শিক্ষক সাত্তার খান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাস থেকে চলে গেলো। উনি যেতেই আড্ডায় মশগুল হলো শিক্ষার্থীরা। কোলাহলে পূর্ণ হলো ক্লাস। নুরা দ্রুত ক্লাসের বাহিরে এসে দেখলো অলরেডি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন তিনি। বিলম্ব না করে দৌড়ে সিঁড়ির কাছাকাছি এসে ডাক দিলো নুরা। ভদ্রলোক পিছু ফিরে তাকাতেই নুরা সাবলীল ভাবে প্রশ্ন করলো, ‘মুনতাসির রাজ স্যার কলেজে আসে নি আজ?’

সাত্তার খান সুন্দর ভাবে বললো, ‘অনেকদিন ধরেই রাজ কলেজ আসছে না। কেন? কোনো দরকার ছিল?’

অনেক দিন ধরেই কলেজ আসছে না। কথাটা নুরা জানে। ফটিকছড়ি যাবার আগের দিন থেকেই রাজ কলেজ আসে না। কিন্তু ফটিকছড়ি থেকে ফেরার পর থেকে কেন আসছে না? এটাই নুরা জানতে চাইছে। কিন্তু স্যার তো উলটো তাকে প্রশ্ন করে বসলো। প্রত্যুত্তরে সে কি বলবে? কিসের জন্য রাজের খোঁজ করছে? কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে চিন্তা করলো নুরা। হুট করে মাথায় একটা কথা আসতেই বলে ফেললো,

‘আসলে স্যার আমাকে একটা ম্যাথ দিয়ে বলেছিলো পরে দেখাতে। আমি ম্যাথটা কমপ্লিট করেছি। কিন্তু স্যারকে দেখছি না তাই দেখাতে পারছি না। কলেজ আসছে না কেন স্যার? আপনি কিছু জানেন?’

শেষের কথাটা একটু আগ্রহভরে বললো নুরা। রাজের প্রতি তার এমন কৌতুহল দেখে সন্দিহান চোখে তাকালো সাত্তার। কিন্তু সন্দেহাতীত কিছু বললো না নুরাকে। কারণ রোশান মাহমুদের ভাতিজি এবং সোহেন মাহমুদের মেয়ে হিসেবে নুরা তার পরিচিত। তাই এড়িয়ে চললো ব্যাপারটা। স্বাভাবিক ভাবে জানালো, ‘কারণ তো আমি জানি না। কলেজ আসা না আসা যার যার পারসোনাল ব্যাপার। তবে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে যতোটুকু শুনেছি রাজ মনে হয় পিএইসডির জন্য বাহিরে যাবে শীঘ্রই।’

নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসি দিলো একটা। এটাই তাহলে রাজের ফাইনাল ডিসিশন। রাজ সত্যি দেশ ছাড়বে। ক্ষুন্ন হলো মন। আগ্রহাতিশয় চেহারা মলিন করে শুধাল, ‘ওহ আচ্ছা।’

কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই পিছন থেকে অর্ধবয়স্ক শিক্ষক সাত্তার ডেকে উঠলো, ‘তোমাকে কোন ম্যাথটা দিয়েছে রাজ? আমাকে দেখাও সমস্যা নেই।’

গুরুত্ব দিলো না নুরা। না দাঁড়িয়ে হাঁটার মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু তাকিয়ে জবাব দিলো, ‘ভাইকে দেখিয়ে নিবো। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!’

বলেই সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো নুরা। কিছু ভালো লাগছে না তার। অনুভূতি শূন্য হয়ে পরেছে একদম। এতো কষ্ট, যন্ত্রনা কেন শুধু তার কপালেই লিখা ছিল? রাজকে ভালোবাসার মতো এতো বড় অন্যায় কেন সে করলো? কেন রাজকে ভুলার কথা কল্পনাতেও আনতে পারে না? নিজের জন্য বড্ড মায়া হলো নুরার। এতো কষ্ট নিরবে একাই সহ্য করতে লাগলো। বাকি ক্লাস গুলো নিশ্চুপ রইলো। অন্যান্য সময় একাই পুরো ক্লাস মাতিয়ে রাখা মেয়েটা হুট করে চুপচাপ হয়ে গেলো। ব্যাপার টা কিছুতেই সহজ ভাবে নিলো না দীবা ও রিমি। কি এমন কারণ থাকতে পারে যা নুরাকে হঠাৎ পরিবর্তন করে দিল? ক্লাসে থাকায় নুরাকে প্রশ্ন করলো না। স্বাভাবিক ভাবে বাকি ক্লাস গুলো শেষ করে বাড়ি ফিরলো তিনজন।
_____________________

করিডোরের পথ ধরে দুই হাত বুকে গুঁজে হাঁটছে রিমি। দৃষ্টি তার বিশালাকৃতির বারান্দার দরজার খোলা জায়গায়। দরজার ফাঁক দিয়ে বাহিরের খোলামেলা দৃশ্য ভাস্যমান। নীল আকাশটা গুধূলীর আবিরে রঙ্গিন। সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুব দিবে কিয়ৎক্ষণ পর। নুরাকে নিয়ে গভীর চিন্তায় মশগুল রিমি। হুট করে নুরার বিহেভিয়ারের বিশাল পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নুরা কি কোনো ব্যাপারে ডিপ্রেশনে আছে? নয়তো তাকে এমন মনমরা দেখায় কেন? নুরার এই পরিবর্তন দেখে রিমির নিজেরও ভালো লাগছে না। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা ঘুরঘুর করছে মাথায়। যখন পূর্ণ মনোযোগ সহকারে নুরাকে নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত রিমি ; তখুনি আকস্মিক কেউ তার বাহু ধরে টান দিয়ে অন্ধকার একটা রুমে নিয়ে গেলো। হঠাৎ -ই কেউ বাহু ধরে টান দিয়ে অন্ধকার রুমে নেওয়ায় হতভম্ব হয়ে গেলো রিমি। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে নিলেই তার মুখ চেপে ধরে কানের কাছে ফিশফিশ করে বলে উঠলো অভ্র,

‘চুপ! চেঁচাবে না একদম। আমি অভ্র।’

তবুও রিমি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উম্ম উম্ম করে যাচ্ছে। তার এমন অস্বস্তির কারণ বুঝতে পেরে মুখ থেকে হাত সরালো অভ্র। ছাড়া পেতেই জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো রিমি। রাগে চোখমুখ শক্ত করে অভ্রের বাহুতে শরিরের সর্বশক্তি দিয়ে একটা কি/ল বসিয়ে দিলো। ব্যাথা পেলেও টুঁশব্দ করলো না অভ্র। রিমি তার এমন কান্ডের জন্য কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘শ’য়’তা’ন ছেলে। এভাবে কেউ টেনে আনে? ভয় পেয়েছি আমি।’

ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো অভ্র। কোমড়ে দুই হাত রেখে কপাল কুঁচকেই প্রশ্ন করলো, ‘ভয়? তাও আবার তুমি পেয়েছো? সত্যি নাকি রিমি?’

বারান্দায় থাকা কৃতিম লাইট গুলোর আলো রুমে এসে পরেছে। সেই আলোতেই রুমটা আবছায়া আলোকিত। হালকা ঝাপসা আলোতে অভ্রের মায়াবী মুখখানির দিকে তাকালো রিমি। প্রেম প্রেম পেলেও প্রকাশ করলো না। কিছুক্ষণ আগের ঘটনার কারণে রাগান্বিত সে। তাই রোমান্টিক ফিলিংস বাদ দিয়ে কোমড় বেধে ঝগড়ায় নামলো, ‘কেন? আমি কি রোবট যে ডর-ভয় কিছু নেই আমার মাঝে?”

অভ্র এক হাতে মাথার পিছনের চুল গুলো চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘না মানে অল টাইম তোমাকে চেঁচাতে দেখে তুমি যে ভয় পাও সেটা ভুলে গেছি প্রায়।’

কথাটা বলার পরেই সকচকিত হলো অভ্রের মস্তিষ্ক। হকচিকিত চেহারায় রিমির দিকে তাকালো। ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো একটা। ভুল জায়গায়, ভুল সময়ে কথাটা বলে ফেলেছে সে। এখন বাঁচার উপায়?

অভ্রের এমন মন্তব্য শুনে রিমির চোখ দুটো রসগোল্লা সাইজ। রাগ শরিরে রিনরিনিয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত পিষে চোয়াল শক্ত করে তাকালো অভ্রের দিকে। কিছু বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতেই অভ্র ঘটালো আরো একটা অবাক করার ঘটনা। বিস্মিত হলো রিমি। হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে অভ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু।।

বোমা ফোটার আগেই পদক্ষেপ গ্রহন করা উত্তম বলে মনে করে অভ্র। হুট করে যেহেতু এমন একটা কথা বলে ফেলেছে সেহেতু কিছু তো করতে হবে যেন বোম বিস্ফোরিত না হয়। কি করবে, কি করবে না ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দুষ্টু একটা বুদ্ধি আটকালো মাথায়। এর চেয়ে ভালো পদক্ষেপ আর হতেই পারে না। তাই বিলম্ব না করে রিমির দুই গালে নিজের দুই হাত রেখে ঠোঁটে আলতো ভাবে একটা চুমু একে দিলো। রাগ দেখাতে গিয়েও থেমে গেলো রিমি। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে অভ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিমির গাল ধরেই ঠোঁটে আবারো ছোট একটা চুমু দিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বললো অভ্র,

‘বেবি প্লিজ রাগ করো না। তুমি অনেক কিউট কিউট একটা গার্লফ্রেন্ড। সুইটের হাড়ি, পাতিল, ডিব্বা। তোমাকে এখানে এনেছি একটু একা সময় কাটাতে। রেগে গিয়ে সুন্দর মোমেন্ট টা নষ্ট করো না প্লিজ। তুমি না আমার সোনামণি পাখি। প্লিজ অসহায় বয়ফ্রেন্ডটার প্রতি একটু সহায় হউ।’

নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলো না রিমি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে উঠলো। ঠোঁটে হাসি রেখেই অভ্রকে নিজের দুই হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো। অভ্রের বুকে নিজের চিবুক রেখে অভ্রের দিকে তাকালো। মিষ্টি করে একটা হাসি উপহার দিলো রিমি। অভ্র তার কপালে আলতোভাবে আরো একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘লজ্জা পেলে না যে?’

রিমি ঠোঁটে হাসি রেখেই ভাবলেশহীন ভাবে শুধাল, ‘আমি লজ্জা পাই না।’

নিচের ঠোঁট কামড়ে বাঁকা হাসলো অভ্র। রিমির কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বললো, ‘বাহ্! প্লাস পয়েন্ট।’

বুঝতে না পেরে রিমি জানতে চাইল, ‘কিসের প্লাস পয়েন্ট?’

অভ্রের ঠোঁটে এখনো শয়তানি হাসি বিদ্যমান। বললো, ‘অন আওয়ার ওয়েডিং নাইট, কষ্ট করে আর লজ্জা ভাঙ্গাতে হবে না।’

লজ্জা পাই না বলা রিমি এই মুহূর্তে অভ্রের বলা কথাটায় ভীষণ লজ্জা পেলো। নিজের লজ্জা মাখা মুখখানি লুকাতে অভ্রের বক্ষস্থলে নিজের মুখ লুকালো। শব্দ করে হেসে উঠলো অভ্র। রিমিকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। কেটে গেলো অনেকটা সময়। নিরবতা ভেঙ্গে অভ্র তার মনে জমে থাকা প্রশ্নটা করলো।

‘রিমি?’

‘হুম?’

ফটিকছড়িতে থাকার সময় খেয়াল করেছি তুমি কোনো ব্যাপারে অনেক চিন্তিত। একটু আগেও অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলে। কি হয়েছে তোমার? আমাকে বলো প্লিজ।’

হাতের বাধন হালকা করলো রিমি। মাথা তুলে অভ্রের দিকে তাকালো। চোখে চোখ রেখে মলিন কন্ঠে শুধাল, ‘ইদানীং নুরাকে কেমন জানি লাগে। মনে হয় কোনো ব্যাপারে সে অনেক আপসেট। সেদিন রাতে হুট করে এসেই দীবার গালে থাপ্পড় দিয়ে বললো তার প্রিয় জিনিস নাকি সবসময় হারিয়ে যায়। কিন্তু দীবা কি করেছে সে নিজেও জানে না। কি কারণে মারলো তাও না। নুরা দরজা লাগিয়ে একা ছিলো সারারাত। কেঁদেছে অনেক। তারপর থেকেই নুরাকে কেমন জানি হয়ে গেছে। আগের মতো প্রাণোচ্ছল না। হাসাহাসি করে না। আমাদের সাথে তেমন জমিয়ে দুষ্টুমিও করে না। কারণ টা আমাদের এখনো খোলে বলে নি। নুরাকে এমন দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না।’

হতবাক অভ্র। সত্যি নুরাকে আসার পর থেকে অন্যরকম লেগেছে। হঠাৎ এমন কি হবে তার?

‘নুরার কি কোনো রিলেশন আছে?’

‘না!’

‘সত্যি জানো? নাকি লুকিয়েছে তোমাদের থেকে।’

‘আরে না। নুরার রিলেশন নেই। তবে একটা সিরিয়াস ক্রাশ আছে।’

ভ্রুঁ কুঁচকালো অভ্র। সিরিয়াস ক্রাশটাকে জানতে চাইলে রিমি বললো, ‘রাজ স্যার। উনি যেদিন প্রথম আমাদের কলেজে এসেছে সেদিন থেকেই নুরা তার উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে।’

কথা গুলো একটু হাসি হাসি ভাব নিয়ে বললো রিমি। কিন্তু অভ্র চলে গেলো চিন্তার অন্য জগতে। তার মাথায় হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। রাজ দীবাকে পছন্দ করে আগে থেকে সেটা আবরার তাকে বলেছিলো। এই নিয়ে ফটিকছড়ি তে দুজনের মাঝে একটু ঝামেলা হয়েছে। তাহলে কি নুরা কোনো ভাবে জানতে পেরেছে রাজ দীবা কে ভালোবাসে? আর এই কারণেই নুরার পরিবর্তন? কারণটা ধরতে বেশি সময় লাগে নি অভ্রের। নিচের ঠোট কামড়ে রিমির দিকে তাকালো। নিরবে তপ্ত শ্বাস ফেলে রিমির মুখের সামনের চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে আশ্বাস দিয়ে বললো, ‘টেনশন করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

অভ্রের চোখের দিকে তাকালো রিমি। এই মানুষটা তার ভরশা। এই মানুষটার বুকেই তার শান্তির জায়গা। এই মানুষটাকেই সে ভালোবাসে। চিন্তিত মনে একটু প্রশান্তি আনতে অভ্রকে আবারো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মনে মনে এটাই চাইলো নুরাও যেন ঠিক হয়ে যায়। সব ঝামেলা যেন খুব শীঘ্রই মিটে যায়।
____________________

রাত্রীর শুরু কেবল। চারপাশ নিঝুম অন্ধকার। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের আকাশটা পরিষ্কার। সাদা মেঘেদের ভেলা ভাসছে। রাস্তাঘাট নিরব নিস্তর হলেও পুল ক্লাবে মেতে আছে কিছু যুবক। নিজেদের অবসর সময় কাটাতে ফ্রেন্ডদের সাথে নিয়ে রাতের বেলা পুল খেলায় মেতে উঠে সবাই। বিষণ্ণ মনটাকে একটু ভালো করতে বহুদিন পর পুল বেল খেলতে এসেছে রাজ। দীবাকে ভুলে থাকার যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবুও কেন জানি দীবার সেই গোলগাল হাস্যউজ্জ্বল চেহারা তার চোখে ভেসে উঠে। ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাজ। একটু নিচু হয়ে কিউ স্টিক টা সামনে থাকা লাল বলটার দিকে তাক করলো। সরু চোখে খুব সাবধানতার সঙ্গে বলটার দিকে স্টিকটা রাখলো। মনোযোগ যখন বলটার দিকে তখুনি রাজের পকেটে থাকা মোবাইলটা ভোঁভোঁ শব্দ তুলে বেজে উঠলো। তবুও নিশানা সরালো না। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে নিশানা বরাবর ছুড়লো রাজ। বিপরীত পাশে থাকা তার বন্ধু শব্দ করে হেসে উঠলো। রাজকে দূরদান্ত খেলোয়াড় হিসেবে প্রশংসা করতে লাগলো। প্রত্যুত্তরে স্মিতি হাসলো রাজ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। কলটা রিসিভ করে মোবাইল কানে দিয়ে বললো, ‘হ্যালো?’

অপর পাশের ব্যক্তি একদম নিশ্চুপ। কোনো প্রকার বাক্য খরচ করছে না। চুপচাপ থেকে কাটিয়ে দিলো প্রায় অনেকটা সময়। কোনো প্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে রাজ আবারো বললো, ‘কে বলছেন?’

টু টু শব্দ তুলে লাইনটা কেটে গেলো। আশ্চর্য হলো রাজ। এতো রাতে কল দিয়েছে অথচ কোনো কথা না বলেই কেটে দিলো? কিন্তু কেন? প্রশ্নটা মাথায় রেখেই আবারো খেলায় মনোযোগ দিলো। ঘড়ির ধরে প্রায় পনেরো মিনিট পর একই নাম্বার থেকে পূর্ণরায় আবারো কল আসলো। রাজ প্রথমের যতো রিসিভ করে বললো, ‘হ্যালো?’

এবারো অপরপাশের ব্যক্তিটি নিশ্চুপ। তাকে চুপচাপ দেখে অল্প শব্দে হেসে ফেললো রাজ। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলে উঠলো, ‘কল দিয়ে কথা বলছো না কেন নুরা?

নুরার চোখ একদম চড়কগাছে উঠে গেছে। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে নাম্বার টা দেখলো। তারপর আবারো কানে দিয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘চিনলেন কিভাবে?’

রাজ আরো একটা বল কিউ স্টিক দিয়ে ঠেলে গর্তে ফেললো। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘এভাবেই। তা কেমন আছো? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’

নিঃশব্দে তাচ্ছিল্য হাসি দিলো নুরা। মনে মনে বললো ‘আপনাকে ছাড়া আমার দিন গুলো বড্ড অসহায় রাজ। প্লিজ আমার হয়ে আমার কাছে ফিরে আসুন। অসহায় মেয়েটার মনে একটু প্রশান্তির ছোঁয়া নিয়ে আসুন।’ কিন্তু প্রকাশ করলো না। নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো, ‘এইতো ভালোই চলছে। আপনার কি অবস্থা!’

‘যেমন দেখেছিলে তেমনই আছি।’

চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৪৫]

সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে সকালে গভীর ঘুমে বিভোর হলো নুরা। চোখে তার হাজারটা রাজ্যের ঘুম এনে হানা দিলো। কোনো ভাবেই চোখ খুলতে পারছে না। তবুও রিমির ডাকাডাকিতে কোনো রকমে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো নুরা। মাথাটা ব্যাথায় ঝিমঝিম করছে। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে।

‘তোর চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? এই নুরা উঠ না। কি হয়েছে তোর?’

রিমির এই কথা গুলো তার আদিখ্যেতা লাগলো। তাই কপাট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘ঘুম ভাঙ্গিয়ে এই প্রশ্ন গুলো করতে হবে তোর?’

‘এই জন্য ঘুম ভাঙ্গাই নি তো। একটু পরেই আগ্রাবাদ ফিরছি সবাই। তাই তোকে ডাকতে এলাম। কিন্তু তোর চেহারা কেমন জানি দেখাচ্ছে। তুই কি রাতে কেঁদেছিস? কি হয়েছে তোর? আমাদের থেকে কি লুকাচ্ছিস সত্যি করে বল নুরা।’

সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো নুরা। বা হাত দিয়ে কপাল ঘেঁষে শুয়া থেকে উঠে বসলো। রিমির কথার কোনো প্রকার উত্তর না দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে চুপচাপ ব্যাগ থেকে কালো কুর্তি বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। হতভম্ব হয়ে গেলো রিমি। কি হয়েছে নুরার? অন্যান্য দিনের তুলনায় বড্ড উদাসীন লাগছে তাকে। চোখমুখ লাল কেন তার? কেঁদেছে নুরা? কিন্তু কেন? মাথায় হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে রিমির। ঠোঁট কামড়ে বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো। অনেকটা সময় অপেক্ষার পরে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো নুরা। রিমিকে তার দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্মিতি হেসে উঠলো সে। রিমির দিকে ভেজা টাওয়াল ছুড়ে দিয়ে বলে উঠলো, ‘আরে কিছু হয়নি আমার। রাতে মাথা ব্যাথা করেছিলো তাই একটু কেঁদেছি।’

অন্য সময় হলে টাওয়াল ছুড়ে মা’রায় রাগ দেখাতো রিমি। কিন্তু আজ দেখালো না। টাওয়াল টা তুলে চেয়ারে ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘সত্যি বলছিস তো?’

নুরা ড্রেসিংটেবিলের কাছে গিয়ে ক্রিম হাতে নিয়ে জবাব দিলো, ‘একদম।’

মন বিশ্বাস করতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করলো রিমি। সন্দেহপ্রবন চোখে নুরার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। কিছু তো হয়েছে নুরার। দুই দিন যাবত নুরাকে উদাসীন লাগছে। মনে হচ্ছে নুরার প্রাণোচ্ছল হাসি, চঞ্চল স্বভাব হারিয়ে গেছে। কারণ টা জানতে হবে। কিন্তু কিভাবে?

রিমির ভাবনার মাঝেই সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হয়ে গেলো নুরা। চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়ে দিলো যেন চোখের নিচের কালি বুঝা না যায়। ঠোঁটে দিলো ডার্ক মেরুন ম্যাট কালার লিপস্টিক। চুল গুলো উন্মুক্ত, কোমড় ছুঁই ছুঁই। আয়নায় নিজেকে ভালো ভাবে একবার প্রখর করলো নুরা। লম্বা, সৌন্দর্য কোনো দিক দিয়ে তার কমতি নেই। তাহলে কেন রাজের ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা তার মাঝে নেই? রাজ কেন তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো না? দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। ভালোবাসা কখনো সৌন্দর্যের কারণে হয় না। ভালোবাসা হয় ব্যক্তিত্বের কারণে। আর নুরা রাজের সৌন্দর্যে নয়, তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পরেছে। মানুষটার চোখের মায়ায় পরেছে।

রুমের দরজা খোলার শব্দে দুইজন নিজেদের চিন্তার রাজ্য থেকে বেড়িয়ে আসলো। দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই দীবাকে হেলেদুলে ভিতরে আসতে দেখলো। নুরা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে দীবার সৌন্দর্যের তারিফ করলো, ‘তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ!’

দীবা লাজুক লাজুক ভাব নিয়ে বলল, ‘থ্যাংকইউ!’

‘এই ওয়েট ওয়েট! তুই আমার টপস পড়েছিস কেন?’

চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে চেঁচিয়ে উঠলো রিমি। ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচি কাটলো দীবা। ভাব নিয়ে চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললো, ‘কারোর নাম লিখা ছিলো না।’

নুরা ঠোঁটে ঠোঁট টিপে মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো এই সাধারন একটা টপসের কারণে সাংঘাতিক একটা ঝগড়া বাধবে।সেদিন কানের দুল পরায় তাকে চু’ন্নি বলে সম্মোধন করেছিলো দীবা। আজ তাকেও চোর বলার সময় এসেছে। সুযোগ তো আর কেউ ছাড়ে না। নুরাও তাই। সুযোগ পেয়ে ইচ্ছে মতো দীবাকে পঁচানি দিলো, ‘ছিঃ দীবা। তোর জামাইয়ের কি এতোই টাকার অভাব? চুরি না করে আমাকে বলতি। তোকে বস্তা ভরে টপস দিতাম। তবুও কেন চুরি করতে গেলি? জামাইয়ের মানসম্মান সব খেয়ে ফেলছিস দেখছি।’

জামাইয়ের কথা তুলায় শরিরে রাগ রিনরিনিয়ে উঠলো দীবার। চোখমুখ শক্ত করে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘খবরদার জামাই নিয়ে কথা বলবি না।’

দীবার কথা শুনে ক্যাটক্যাটে শব্দ তুলে হেসে উঠলো নুরা ও রিমি। দীবাকে রাগাতে আর পচানি দিতে এক সঙ্গে বলল, ‘আহাঃ কি টান।’ বলেই আবারো উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।

তাদের দুইজনের হাসিটা দীবার কাছে বিদঘুটে লাগলো। রাগে দাঁতে দাঁত খিঁচে বিছানা থেকে বালিশ তুলে দুজনের দিকে ছুড়ে মারলো। তখুনি রুমে আসলো সাবিত আর আবরার। তিনজনকে আবারো ঝগড়া করতে দেখে হতাশ হলো তারা। সাবিত দীবাকে থামাতে দীবার এক হাতের কব্জি ধরে বলে উঠলো , ‘তোরা কি একটু শান্তিতে থাকতে পারিস না? সারাদিন ঝগড়া আর ঝগড়া। তোদের শ্বশুর বাড়ি পাঠালে নির্ঘাত আমাদের সম্মানের কালা ভুনা হয়ে যাবে।’

‘আশ্চর্য ভাই এভাবে বলছো কেন? আমি কিছু করি নি। রিমি আর দীবাই ঝগড়া লেগেছে।’ নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে নুরা বলে উঠলো।

আবরার পকেটে মোবাইল রাখতে রাখতে ঝগড়া লাগার কারণ জানতে চাইলেই রিমি গরগর করে দীবার নামে নালিশ করে বসলো, ‘তোমার ফকিন্নি বউ আমার টপস পরেছে কেন? বউ কে টাকা দিতে পারো না? মাইনষের জিনিস পরে ঘুরে শুধু।’

চোখ-ঠোঁট উলটে রিমির কথার ব্যঙ্গ্য করলো দীবা। হাতের ঘড়িটার দিকে ইশারা করে বললো, ‘তুই এখন কার ঘড়ি পড়ে আছিস? আমর টা। আমি কিছু বলেছি তোকে? বলি নাই। তুই পরেছিস তাই আমিও পরেছি। হিসাব সমান সমান।’

হতাশ হয়ে কপাল চাপড়ালো সাবিত। তিনজন একে অপরের সাথে জিনিসপত্র শেয়ার করবে আর ঝগড়া করবে। তিনজনের এই অসাধারণ বন্ডিং টা সুন্দর। ভাবতেই নিজেই আনমনে হেসে ফেললো সাবিত।

অপরদিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আবরার। তাদের এই অবস্থা দেখে বিস্ময়ের শেষ নেই তার মাঝে। যেখানে আবরারের ব্যবহারিক জিনিসপত্র অন্য কেউ ধরলে সে একদম পছন্দ করে না। সেখানে কিনা এই তিন মেয়ে কানের ঝুমকা থেকে শুরু করে জামাকাপড় পর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করে? ব্যাপারটা উইয়ার্ড লাগলো তার কাছে। তিনজনের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলে উঠলো, ‘তোরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সব কিছুই শেয়ার করিস?’

রিমি সামনের চুল গুলো পিছনে ঠেলে মিষ্টি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, ‘শ্বশুর বাড়ি বাদে সবই শেয়ার করতে পারি। বেরুবে কখন? আমরা রেডি। আসো।’

রিমি কথাটা বলেই দীবার হাত ধরে ফুরফুরে মেজাজে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। এবার আরো বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলো আবরার। এই মাত্র না ঝগড়া লেগেছে? এখন আবার হাত ধরে হেলেদুলে বাহিরে যাচ্ছে? তাকে এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুরা হাসলো। ঠোঁটে হাসি রেখেই আবরারের কাছে এসে আবরারের বাহু জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো, ‘ওরা এমনই। আসো দেরি হয়ে যাবে।’

আবরারের বাহু ধরে বাড়ির নিচে হাসিখুশি মুখে নামলেও নিচে আসার পর নুরার সেই হাস্যউজ্জ্বল মুখটা একদম ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো। অতিরিক্ত উত্তেজনায় কলিজা তার ধুকধুক শব্দ তুলতে লাগলো। হার্টবিট ফাস্ট! নিশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। না চাইতেও বারবার রাজের মলিন চেহারার দিকে চোখের দৃষ্টি পরছে। তবে কি সত্যিই রাজ চলে যাবে?

ফটিকছড়িতে এসেছিলো একটা মাইক্রো কার দিয়ে। কিন্তু আগ্রাবাদ ফেরার প্ল্যান করলো অন্য রকম ভাবে। বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি আনা হলো মোট চারটা। এটা অবশ্য প্ল্যান না। আবরার এক সাথে না গিয়ে দীবাকে নিয়ে পারসোনালি একা যাবার কথা বলেছে। তাই বাকিরাও নিজেদের গাড়ি দিয়ে যাবার চিন্তা করেছে।

সবাই একত্রে নিচে নামতেই প্রথমে আবরার দীবার হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সু-সু শব্দ তুলে গাড়ি মুহূর্তেই সুবিশাল রাজবাড়ি পেড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো। তারপর সাবিতের থেকে বিদায় নিয়ে রাজিব ও রাজ দুইজন গাড়িতে উঠলো। রাজ বসলো ড্রাইভিং সিটে। রাজিবকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সে যাবে ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে নুরা। ব্যথিত চোখে রাজের দিকে তাকিয়ে আছে। মন বলছে শুধু একটা বার, শুধুমাত্র একটা বার রাজ যেন তার দিকে তাকায়। তার মনের কথা গুলো, চোখের দৃষ্টি যেন রাজ বুঝতে পারে। অন্তর কাঁপছে নুরার। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না।

গাড়ি স্টার্ট দিলো রাজ। দুই হাতে স্টোরিয়ারিং ধরে লম্বা একটা দম নিলো। কি মনে হতেই চোখ ঘুরিয়ে বাহিরে তাকালো। গাড়ির জানালার বরাবর নুরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু একটা হাসি দিলো। হাত উঠিয়ে বাই জানালো নুরাকে। প্রত্যুত্তরে নুরাও স্মিতি হেসে হাত নাড়িয়ে বাই জানালো। অতঃপর বিলম্ব না করে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। রাজের গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই মলিন হলো নুরার মুখশ্রী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

অভ্র আগ্রাবাদ আসার পর থেকেই বেশিরভাগ সময় আরিয়ানের সঙ্গে কাটায়। সময়ের সময়সীমাঅনুযায়ী দুইজন প্রায় সমবয়সীর পর্যায়ে পরে। তাই দুজনের বন্ডিং টাও বেশ জমানো। তাই দুইজন এক সঙ্গে বাড়ি ফিরবে। সাবিতের সঙ্গে যাবে রাইমা। নুরাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাইমা নুরার হাত ধরে গাড়ির কাছে এনে বললো, ‘মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার সাথে আয় তুই।’

নুরা কিছু বললো না। বাধ্য মেয়ের মতো রাইমার পাশে বসলো। সাবিতও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। অভ্র আর আরিয়ানের মধ্যে কে গাড়ি চালাবে তা নিয়ে কিছুটা বাধলো। সমাধানে আসার জন্য রক, পেপার ও সিজার খেললো। প্রথম তিনবার ধরার পর অভ্র হারলো। আরিয়ান ফুরফুরে মেজাজে ড্রাইভিং সিটে বসলো। অভ্র রিমিকে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাক দিল। অভ্রের ডাকে হকচকিয়ে গেলো রিমি। নুরাকে নিয়ে শত চিন্তার জগত থেকে বেড়িয়ে এলো সে। রিমিকে অন্যমনস্ক হতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো অভ্র। কারণ জানতে চাইলো, ‘তোমাকে অন্যরকম লাগছে আজ। কি হয়েছে রিমি?’

প্রত্যুত্তর করলো না রিমি। শুধুমাত্র মাথা নাড়িয়ে ”কিছু না” বুঝিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। হতবাক অভ্র। রিমিকে এর আগে কখনো এতো নিশ্চুপ দেখেনি সে। আজ হুট করে কি এমন হলো যে রিমি এতো চুপচাপ? চিন্তিত হলেও প্রকাশ করলো না। চুপচাপ আরিয়ানের পাশের সিটে বসলো। সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে লুকিং মিররে রিমির অন্যমনস্ক মুখখানির দিকে আবারো তাকালো অভ্র। রিমির এই অন্যমনস্কের কারণ না জানা অব্ধি তার মনেও শান্তি নেই। বাড়ি ফিরে জানা যাবে ভেবে শান্ত্বনা দিল নিজেকে।
_____________________

শান্তিনিবাস এতোদিন প্রাণ হারা ছিলো। নিরব নিস্তর বাড়িটিকে আবারো প্রাণোচ্ছল করতে ফিরে এলো তারা। ছেলেমেয়েদের ফিরে আসায় খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো নিশিতা আয়েশা ও রোহানা। এই কয়েকটা দিনই তাদের জন্য মাসের সমান লেগেছে। কোনো রকমে নিজেদের কলিজাদের ছেড়ে থেকেছে। আজ ফিরে আসছে সবাই। তাই খুশি কারোর মাঝে কমতি নেই। সকালেই ঘুম থেকে উঠে নিজেদের হাতে রান্না করলো নানান রকমের সুস্বাদু সব খাবার। সকালের মধ্যেই রান্নাবান্না শেষ করে ঘড়ি দেখছিলো সবাই ফিরবে কখন। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষে দুপুরের আগেই ফিরলো সবাই। আবারো হাস্যউজ্জ্বল হলো শান্তিনিবাস। নিরব নিস্তর পরিবেশ ভেঙ্গে এখন কোলাহলপূর্ণ হলো বাড়ি। সবাইকে আদরের সঙ্গে ড্রয়িংরুমে আনলো তারা।

ড্রয়িংরুমে সকলের উপস্থিত থাকলেও দীবার অনুপস্থিতি ঠিকই টের পেলো রোহানা। এতোদিন বাদে মেয়েকে দেখার জন্য মনটা তার ছটফট করছে। সবার সাথে দীবাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে সাবিতকে প্রশ্ন করে উঠলো, ‘দীবা কোথায় বাবা? তোমরা সবাই এখানে দীবা কোথায়?’

সাবিত রোহানাকে শান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘চিন্তা করবেন না। আবরারের সঙ্গে দীবা আছে। চলে আসবে একটু পর।’

কিছুটা চিন্তা মুক্ত হলো রোহানা। তবুও মেয়ের চিন্তা থেকে বেরুতে পারলো না। যতোক্ষণ না মেয়েকে দুচোখের সামনে দেখবে ততোক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে শান্ত করতে পারবে না।

রাইমা গলা ঝেড়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সবাই তার দিকে তাকাতেই বললো, ‘মহা খুশির খবর নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য।’

আয়েশা বললো, ‘ভণিতা না করে বলে ফেল কি?’

রাইমা মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘দীবা আর আরব ভাইয়ের সম্পর্ক একদম স্বাভাবিক হয়ে গেছে।’

কথাটা শুনে খুশি হলো নিশিতা। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বললো, ‘অবশেষে সব ঠিক হলো। অনেক টেনশনে ছিলাম তাদের জন্য।’

সবার এই আনন্দময় মুহূর্তের প্রতি মোটেও আগ্রহ পেলো না নুরা। চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো। নিষ্প্রভ তার চোখের এই দৃষ্টি। গাড়িত রাজের মৃদু হাসি দেওয়ার চেহারাটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোটা তপ্ত জল পরলো। ধীরে ধীরে চোখ দুটো বন্ধ করলো। ক্লান্তিকর চোখ দুটো একটু স্বস্তি পেতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
____________________

বাড়ির ভিতরে ঢুকে গাড়ি থামালো আবরার। গাড়ি থামাতেই দীবা চটজলদি গাড়ি থেকে নেমে গেলো। পিছনের সিট থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে কাধে দিলো। আবরার গাড়ি থেকে নেমে দীবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘কোন রুমে যাবে এখন?’

ভ্রুঁ কুঁচকে চোখ দুটো ত্যাড়া করে পিছু ফিরে আবরারের দিকে তাকালো দীবা। প্রশ্ন করার মতো আর কিছু পেলো না? কোন রুমে যাবো এটা আবার কেমন প্রশ্ন? মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না, ‘আমার রুমেই। কেন?’

‘এখন থেকে আমার রুমে থাকবে। আমি কমলা দাদীকে বলে দিবো। উনি তোমার জিনিসপত্র আমার রুমে শিফট করে দিবে।’

‘দরকার নেই। আমি আমার রুমেই থাকবো।’

আবরার সব কিছু সহ্য করতে পারে। কিন্তু তার কথার বিরুদ্ধে “না” শব্দটা সে মোটেও সহ্য করতে পারে না। দীবা মুখের উপরে না করায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রাগ ভিতরে ভিতরে সংযত রেখে কাটকাট গলায় বললো, ‘আমি বলেছি মানে এখন থেকে আমার রুমেই থাকবে।’

দীবার এক রোখা প্রত্যুত্তর, ‘আমি থাকবো না মানে না।’

আবারো দীবার থেকে সরাসরি না শব্দটা শুনে ধমকে উঠলো আবরার, ‘দীবা?’

ইষৎ কেঁপে উঠলো দীবা। বিস্মিত চোখে আবরারের দিকে তাকালো। আবরার তাকে ধমক দিয়েছে ভেবে খারাপ লাগলো ভীষণ। চোখে পানির বিন্দু বিন্দু কণা জমে চিকচিক করতে লাগলো। নাক টেনে কাদু কাদু গলায় বললো, ‘আপনি অনেক খারাপ। মাথায় যা আসে তাই বলে ফেলেন। আমাদের সম্পর্কের কথা এখনো কেউ জানে না। হুট করে কিভাবে আমি রুম চেঞ্জ করে ফেলবো? অন্যরা কি ভাববে ভেবেছেন? এইসব কিছুই ভাবেন না আপনি। হুটহাট ডিসিশন নেওয়ার অভ্যাস আপনার।’

ফুঁশ করে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো আবরার। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে দীবার কাছে আসলো। আলতো হাতে দীবার দুই গাল ধরে বললো, ‘হোপ বোকা মেয়ে। এখানে কান্না করার কি আছে? তুমি আমার বউ। এটা পরিবারের সবাই জানে। তাহলে কে কি ভাববে?’

নাক টানলো দীবা। ঠোঁট উল্টে ইনোসেন্ট চেহারায় বললো, ‘সবাই জানে না।’

মৃদু শব্দে হাসলো আবরার। দীবার কপালে গভীর একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘সবাই জানবে তুমি আবরার জুহায়ের’এর বউ। সবাই জানবে।’

বউ শব্দটা শুনে লজ্জা পেলো দীবা। উন্মুক্ত বাগানে দীবার কপালে চুমু খাওয়ায় লজ্জায় গাল লাল হয়ে এলো। তাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো আবরার। দীবার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে নেশালো গলায় বললো, ‘লজ্জা পেলে তোমাকে মারাত্মক লাগে দীবা। ইশ!’

আবরারের বাহুতে দুই হাতে ধা’ক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। চোখ পাকিয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘অসভ্য লোক। সুযোগ পেলেই আজেবাজে কথা বলা শুরু করে। এতো নির্লজ্জ একটা মানুষ আমার কপালে পরলো। ধ্যাৎ!’

বলেই গটগট পায়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো দীবা। পিছন থেকে উচ্চস্বরে আবরারের হাসির শব্দ কানে আসলো শুধু।’

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here