মরুর বুকে বৃষ্টি ২ গল্পের লিংক পর্ব -০১ || মেহরুমা নূর

“তোর হবু বউতো ভাইগ্যা গেছেরে আদি।”
কথাটা শোনামাত্র রাগে শক্ত হয়ে থাকা মুখটা আরও র,ক্তিম হয়ে উঠল আদিত্যর। এমনিতেই তার এই বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। শুধুমাত্র দাদাজানের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখানে উপস্থিত হয়েছে সে। মন মেজাজ আগে থেকেই বিগড়ে ছিল তার। তারউপর এখানে বিয়ে বাড়িতে আসার পর থেকে কনে পক্ষের কেমন কানাঘুঁষা খেয়াল করেছে সে। এতে তার মেজাজের ভোল্টেজ আরও হাই হচ্ছিল। আর এখন বিহানের কাছ থেকে এই খবর শুনে ক্রোধে মুখমণ্ডল বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল তার। সে চাইলে এখুনি এই বিয়ে বাড়িটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। গ্যাংস্টার আদিত্যর সেই ক্ষমতা আছে তা সবাই জানে। আদিত্য বিয়ের আসন থেকে ঠাস করে উঠে দাঁড়িয়ে মাথার পাগরিটা মাথা থেকে খুলে ঠাস করে আছাড় মেরে ফেলে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“ডাক উনাদের।”
বিহানের ডাকার দরকার পরল না। মেয়ের বাপসহ তাদের পক্ষের কিছু লোক এসে অপরাধী মুখ করে এসে দাঁড়াল আদিত্যর সামনে। মেয়ের বাপ জলিল মিঞা দুই হাত জোর করে করুন অপরাধী সুরে বলল,
“জানিনা কোন মুখে বলব তোমাকে। আসলে আমার কুলাঙ্গার মেয়েটা কার সাথে যেন পালাইয়া গেছে। আর আমাকে এই ভরা মজলিসে বেইজ্জত করে গেছে। মাফ চাওয়ারও মুখ নাই। তুমি যে শাস্তি দিবে আমাদের মান্য হবে।”
আদিত্য গম্ভীর ভারী গলায় বলল,
“দেখুন, আপনাদের এসব নাটক দেখতে ইন্টারেস্ট নেই আমার। আমি এখানে এসেছি শুধু আমার দাদাজানের কথা রাখতে। দাদাজান মৃত্যুর আগে বলেছিল আমি যেন তার গ্রামের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর ছেলের মেয়েকে বিয়ে করি। সেই কথা রাখতেই আমি এসেছি। কারণ আমার দাদাজানের শেষ ইচ্ছে মানে আমার জন্য পাথরের প্রতিলিপি। আর সেটা আমি পূরণ করেই ছাড়ব।”
জলিল বলল,
” কিন্তু এখন তো আর সম্ভব না।মেয়েটা কোথায় তা আমরা কেউ জানি না।”
“দেখুন, কথা আপনার মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার৷ সেটা যে মেয়েই হোকনা কেন! আপনার আর কোনো মেয়ে নেই? থাকলে তার সাথেই বিয়ে হবে।”
“মেয়েতো আছে।তিন মেয়ে আমার। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ের সাথেই তোমার বিয়ের কথা ছিলো।”
“আর আপনার মেঝ মেয়ে! তিন মেয়ে হলেতো মেঝ মেয়ে থাকার কথা।”
জলিল এবার হতবাক চোখে তাকালো আদিত্যর দিকে। তারপর নিজের বউয়ের সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি হলো তার। তার মুখেও বিস্ময়। জলিল থতমত কন্ঠে বলল,
“আছেতো, কিন্তু… ”
“কিন্তু কি? দেখুন মেয়ে হলেই হলো। বিয়ে আপনার মেয়ের সাথেই হবে। সে যেটাই হোকনা কেন।যান রেডি করুন তাকে।”
“কিন্তু, ওকে কিভাবে বিয়ে করবে? ওতো…. ”
“ওতো কি? দেখুন এমনিতেই মাথা নষ্ট হয়ে আছে। আমার রাগ আর বাড়ায়েন না।”
ওদের মাঝের একজন হঠাৎ বলে উঠল,
“আরে কেমনে বিয়া হইবো! হেই মাইয়াতো পাগল আস্তা।”
লোকটার কথায় খানিক থমকানো চাহুনি দিলো আদিত্য। এমন কিছুর জন্য হয়তো মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা সে। জলিল তখন করুন সুরে বলল,
“জি বাবাজি,আমার আরেক মেয়ে মানুষিক ভাবে অসুস্থ। পাগলী সে। বিয়ে, সংসার এসবের কিছুই সে বোঝে না।”
বিহান আদিত্যর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আরে পাগলীরে কেমনে বিয়ে করবি তুই! বাদ দে। চল ফিরে যাই।”
আদিত্য বিহানের কথার আপাতত উত্তর দিলোনা। জলিলের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনি শুধু বলুন সে বিয়ের জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক কিনা?”
“হ্যাঁ বয়সতো হয়েছে। কিন্তু মানুষিক ভাবে ছোট বাচ্চাদের মতো।”
“দ্যাটস ইনাফ। প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই হলো। দাদাজানের কথা রাখতে আপনার মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়াটা ইম্পর্ট্যান্ট। বাকিসব জরুরি না। এখন যান। নিয়ে আসুন আপনার মেয়েকে। সারাদিন সময় নেই এসবের জন্য।”
“তুমি কি ভেবেচিন্তে বলছ!”
“দেখুন,সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য এক কথা দুবার বলেনা। আমার সময় নষ্ট না করে যা বলছি তাই করেন। নাহলে আমি কি করতে পারি তা জানতে নিশ্চয় বাদ নেই আপনাদের! সো ডু ইট ফাস্ট।”
জলিল মাথা নেড়ে চলে গেল। ওরা যেতেই বিহান আদিত্যর উদ্দেশ্যে হতবাক সুরে বলল,
“তুই কি পাগল হইয়া গেছসগা! জেনেশুনে পাগলীরে বিয়া করবার চাস!”
“দেখ,এমনিতেও বিয়ে আমি সংসার টাইপ কিছু করার জন্য করছিনা। এসব আমার জন্য না। আমি শুধু দাদাজানের কথা রাখতে এই নাটকে সামিল হচ্ছি। ওই মেয়ে কেমন হলো না, হলো দ্যট ইজ নন অফ মাই কনসার্ন।”

আয়নার সামনে নূরকে সাজানো হচ্ছে বঁধুবেশে।অবুঝ,অসম্পূর্ণ বুদ্ধির অধিকারী নূর পরিস্থিতির গম্ভীরতা বোঝে না। সে’তো পুতুল বউয়ের মতো সাজাতে দেখেই খুশিতে বাচ্চাদের মতো প্রফুল্ল হচ্ছে। এতক্ষণ মন খারাপ ছিলো তার। ওকে রুমের মাঝে আঁটকে রেখেছিল তাই। ওতো বাইরে গিয়ে সবাইকে দেখতে চেয়েছিল কিন্তু ওর মা বাবা আঁটকে রাখে ওকে রুমে। অনেক কাঁদে নূর। তাও খোলেনি কেউ। বিরক্ত হয়ে একসময় ওর মা কয়েকটা চড়-থাপ্পড়ও মারে। তারপর আর ভয়ে নূর শব্দ করে কাঁদেনি। যদিও এসব ওর সাথে নিত্যদিনই প্রায় হয়ে থাকে। তবে এখন যখন ওর মা এসে এভাবে সাজিয়ে দিচ্ছে তখন সব ভুলে খুশি হয়ে গেছে নূর। নূর খুশিমনে মাকে সুধায়,
“আমাকে পুতুলের মতো বউ সাজাচ্ছ কেন?”
নূরের মা শাড়ি পড়াতে পড়াতে বলল,
“কারণ তোর বিয়ে হবে আজ তাই।”
অবুঝ নূর আরও খুশি হয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“সত্যিই! আমার বিয়ে হবে! আমারও পুতুল বর হবে! ইয়েএএ.. কত্তো মজা হবে।”
“হ্যাঁ, আজ তোর বিয়ে। আর বিয়ে করে বরের সাথে যেতে হবে তোকে আজ।”
“আমি জানিতো। আমি বর বউ খেলার নিয়ম জানি সব।”

নূরকে রেডি করে বসানোর পর কাজী আর কিছু লোকজন এলো নূরের কাছ থেকে কবুল শুনতে। কাজী সাহেব বলার সাথে সাথে ফটফট করে কবুল বলে দিলো নূর খুশিমনে। এরপর আদিত্যর কাছে এসে তার কাছ থেকেও কবুল শুনল। অতঃপর বিয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল দুটি প্রাণ। যার মধ্যে একজন সব বোঝার ক্ষমতা রাখলেও তার কাছে বিয়েটা কেবলই নামের। আর আরেকজন এই বিয়ে নামক বন্ধনের মহিমা থেকে একেবারেই বেখবর। নাজানি কেমন হবে তাদের অনাগত ভবিষ্যত! বিয়ে পড়ানোর শেষ হতে দেরি, আদিত্যর বিয়ের আসন থেকে উঠতে দেরি হলোনা। উঠে যেতে যেতে বিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“জলদি এখানকার ড্রামা শেষ কর। আই ওয়ান্ট টু গো রাইট নাও।”
“আব্বে হালা,যাবি কইলেই হইলো। শাদী মানাইছ, বউ কি লইয়া যাওন লাগবো না!”
“দেখ বিহান, আমি সত্যিই আর এসব নিতে পারছিনা। যা করার জলদি কর।”
“আচ্ছা, চাপ লইছ না। আমি দেখতাছি।”

আদিত্য গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। বিহান ভেতরে এসে নূরের মা বাবাকে তাড়া বিদায় পর্ব সাড়ার জন্য। নূরের মা বাবাও সেই মোতাবেক নূরের কিছু জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নূরকে সাথে করে গাড়ির দিকে নিয়ে আসতে নিলো। নূর প্রথমে ঠিকঠাক আসলেও গাড়ির কিছুটা দূর থাকতেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা ধরে বলল,
“নেও শেষ। বিয়ে বিয়ে খেলা শেষ। এখন আমি যাই।”
নূরের মা মেয়েকে আঁটকে দিয়ে বলল,
“আরে যাবি মানে!এটা কোনো খেলা না। তোর সত্যি সত্যিই বিয়ে হয়েছে। যেমন তোর বুবুর হয়েছিল। এখন তোকে তোর বরের বাড়িই যেতে হবে। সেখানেই থাকতে হবে।”
নূর হঠাৎ কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল।বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলল,
“যাবো মানে! আমি কেন যাবো! আমি যাবোনা কোথাও। আমি এখানে তোমাদের সাথেই থাকবো।”
“তা বললে হবে না। যেতেতো হবেই।”
নূরের মা বাবা নূরের হাত ধরে গাড়ির দিকে জোর করে নিয়ে যেতে লাগলো। নূর তখন উচ্চস্বরে কান্না শুরু করে দিলো। হাত পা ছোড়াছুড়ি করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,
“না আমি যাবোনা, যাবোনা কোথাও। ছাড়ো আমাকে।”
এসব কান্নাকাটি আদিত্যর কানেও এলো। বিরক্ততে মেজাজ চিড়বিড়িয়ে উঠল তার। সে জোরে জোরে বিহানের নাম ধরে ডাকলো। বিহান ওর কাছে আসতেই সে বলল,
“মেয়েটার মা বাবাকে ডাক।”
বিহান নূরের মা বাবাকে আদিত্যর সামনে আনলে আদিত্য বলল,
“দেখুন এসবের দরকার নেই। আপনাদের মেয়ে আপনাদের সাথেই থাক। চিন্তা নেই, আমি প্রতি মাসে বড় এমাউন্ট পাঠাবো। যা দিয়ে আপনাদের পুরো পরিবারের খরচ চলে যাবে।তাই ওকে আপনাদের কাছেই রেখে দিন। কারণ আমার বাসায় এসব ড্রামা আমার টলারেট হবে না।”
জলিল করুন সুরে বলল,
“কি বলছ বাবাজী এসব! টাকার কোনো কথা না। এক মেয়ে পালিয়ে গিয়ে এমনিতেই আমার বদনাম ছড়িয়ে দিয়েছে। তারউপর আরেক মেয়ে বিয়ের পর বাপের বাড়ি পড়ে থাকলে মানুষের কথার তীরে মরে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবেনা আমার। দেখ তুমি কিন্তু সব জেনেশুনেই আমার মেয়েকে বিয়ে করেছ। এখন এভাবে ফেলে যেতে পারোনা। আর ওর চিন্তা কোরোনা৷ আমি ওকে এখুনি বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসছি৷ কান্নাকাটি করবেনা আর।”
বলেই জলিল তার স্ত্রী আর নূরকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে এসে জলিল তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে রাগী সুরে বলল,
“দেখ তোমার মেয়েরে কিভাবে বুঝাবা জানিনা। তবে জামায় যদি ওরে রেখে যায় তাহলে তোমাদের দুটোকেই বাড়ি থেকে বিদায় করবো আমি।জম্মায়ছো তো সব আপদ। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওকে বসে নিয়ে এসো।”
বলেই ঘরের বাইরে চলে এলো জলিল৷ কিছুক্ষণ পরই ভেতর থেকে নূরের আর্তনাদ শোনা গেল। মারছে তাকে ওর মা। অনেক মারার পর বলল,
“এখন বল,যাবি জামাইর সাথে, নাকি এভাবেই এখানে সারাজীবন মার খাবি? আজ যদি তুই না যাস তাহলে তোকে মেরে ফেলে আমিও বি,ষ খেয়ে মরে যাবো।”
অবুঝ নূর মায়ের হাতের মার খেয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। ভয়ার্ত কন্ঠে সে কোনোরকমে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল,
“যা…..যাবো।”

কিছুক্ষণ পর নূরকে ঠিকঠাক করে আবারও নিয়ে আসা হলো। এবার আর জেদ করলোনা নূর। তাকে নিয়ে এসে আদিত্যর গাড়ির পেছনের সিটে বসালো। বিহান বসলো ড্রাইভাইং সিটে। আদিত্য গিয়ে বসলো বিহানের পাশের সিটে। এরমাঝে একটিবারও নিজের সদ্য বিয়ে করা বউ নামক ব্যাক্তিটির দিকে ভুলেও তাকালোনা আদিত্য। গাড়ি স্টার্ট হয়ে কিছুদূর অগ্রসর হতেই পেছন নূরের কান্নার সুর বাড়ল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা শুরু করল সে। যা শুনে বিরক্তিতে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আদিত্যর।রাগে হঠাৎ গাড়ির কাঁচে সশব্দে চাপড় মারল সে। সেই শব্দে ভয়ে কেঁপে উঠল নূর। মুহুর্তেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চুপ হয়ে গেল সে। আদিত্য বিহানকে গাড়ি থামাতে বলল। তারপর ফোন করে ওদের সাথে আসা অন্য গাড়িটাকেও থামতে বলল। আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে বিহানকে বলল,
“তুই যা, আমি অন্য গাড়িতে আসছি।”
“আরে অন্য গাড়িতে যাবি ক্যালা? এইডাতে কি হইছে?”
“তোকে যা বললাম তুই তাই কর।”
বলেই আদিত্য অন্য গাড়িতে গিয়ে বসলো। বিহান হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় একটা বেজে গেল। আদিত্য আাগের গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে চলে গেল। পরপরই বিহান গাড়ি এনে থামালো। গাড়ি থেকে নেমে নূরের পাশের দরজা খুলে বলল,
“আসেন ভাবি, নামেন৷ আমরা চলে এসেছি। ”
নূর একটু ভীতু চোখ করে তাকালো বিহানের কথায়। আসলে সে বুঝতে পারছেনা লোকটা তাকে ভাবি কেন বলল! তার নামতো নূর। কিন্তু এই মুহুর্তে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা নূর সেটা আর জিজ্ঞেস করার সাহস পেলনা৷ বিহানের কথামত ধীরে ধীরে নেমে এলো সে। গাড়ি থেকে নেমে সামনে তাকাতেই চোখ দুটো বিস্ময়ে পিটপিট করে ফেলল নূর। তার মনে হচ্ছে সে ওই টিভিতে দেখা কোনো রাজার প্রাসাদে চলে এসেছে। অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো সে৷ আর ভাবল,সে এই প্রাসাদে কিভাবে এলো!”
বিহানের ডাকে নূরের ঘোর কাটল। বিহান ভেতরের দিকে যেতে বলল নূরকে। নূর ভীতু মনেই সামনে এগুলো।

আদিত্য বাসায় ঢুকেই জমিলা আন্টিকে জোরে জোরে ডাকল। জমিলা এই বাসার পুরান কাজের মহিলা। আদিত্যর ছোট থেকে এই বাসার দেখাশোনা করে সে৷ অন্যান্য সার্ভেন্টদেরও তিনিই কাজ বুঝিয়ে দেন। আদিত্যর ডাকে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো জমিলা। আসার সাথেই আদিত্য বলে উঠল,
“বিহানের সাথে একটা মেয়ে আসছে৷ মেয়েটা মেন্টালি আনস্টেবল। আজ থেকে এবাড়িতেই থাকবে। ওর সকল দায়িত্ব আপনার। আপনি কিভাবে করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে আমার কানে কোনো আওয়াজ বা আমার সামনে তার উপস্থিতি যেন ডিস্টার্বের কারণ নাহয় সেই বিষয় খেয়াল রাখবেন।আমার কাছে কোনো ঝামেলা যেন না পৌঁছায়। বাকিটা বিহানের কাছে সব জেনে নিয়েন।”
বলেই গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল আদিত্য। তার পরপরই বিহান নূরকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকলো। বাসার ভেতর ঢুকেতো নূর আরও বিস্ময়ে হা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে সত্যিই কোনো রাজবাড়িতে চলে এসেছে। বিহান সামনে এগিয়ে গিয়ে জমিলাকে সব বুঝিয়ে বলল। সব শুনে জমিলা বিস্মিত হয়ে গেল। শেষমেশ কিনা আদিত্য একটা পাগলিকে বিয়ে করল! বিহান নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
“যান ভাবি, ওইযে জমিলা খালার সাথে যান। উনি আপনার সব খেয়াল রাখবেন।”
নূর ভীতু ভীতু চোখে দেখছে শুধু সবকিছু। তারকাছে এখন সবকিছুই কেমন ভীতিকর লাগছে। জমিলা বেগম এগিয়ে এসে নূরকে ধরতে নিলেই নূর ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল। জমিলা নূরকে আস্বস্ত করে বলল,
“ভয় নেই বউমনি, আমি তোমার মায়ের মতোই। একদম ভয় পেওনা। এসো আমি তোমাকে তোমার রুমে নিয়ে যাচ্ছি।”
নূর পুরোপুরি আস্বস্ত না হলেও ভয় খানিকটা কমলো বোধহয়। সে জমিলার সাথে এগুলো সামনে।
___

মাঝখানে দুদিন কেটে গেছে। আদিত্য ওই বিয়ে নামক বিষয়টা হয়তো ভুলেও গেছে। যেন ওটা কোনো মনে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই না তার কাছে। সে তার মতোই নিজের বিজনেস আর তার গ্যাংস্টারের কাজে লেগে আছে।এ পর্যন্ত সে তার বউয়ের চেহারাটাও দেখেনি৷ আর না তার কথাও মনে আছে তার। আদিত্যর আদেশ অনুযায়ী জমিলা খেয়াল রাখে নূর যেন তার সামনে না পড়ে। নূরও এই দুদিনে নিজের ভয়টা হালকা কমাতে পেরেছে। এখানে জমিলা ওর সব দেখাশোনা করে। মাঝে মধ্যে মা বাবার জন্য কান্নাকাটি করলে জমিলা বিহানকে বলে নূরের মা বাবার সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দেই৷ প্রথম প্রথম যতটা ভয় কাজ করতো এখন আর ততটা ভয় লাগেনা তার। সে প্রায় সময়ই জমিলার সাথে সাথেই থাকে।

এবাড়িতে পরিবার বলতে আদিত্য একাই শুধু। আগেপিছে তার কেউই নেই।মা-বাবা এক এক্সিডেন্টে মারা যায় আদিত্য ছোট থাকতেই। আপনজন বলতে ছিলো কেবল দাদা। সে-ও গত মাসখানেক আগে মারা যায়। আর এক বিহান আছে। ছোট বেলা থেকেই আদিত্যর সাথে থাকে ও। ছোট বেলায় রাস্তায় একবার আদিত্যর জান বাচিয়ে ছিলো। যখন জানলো বিহান এতিম,পথশিশু। তখন আদিত্যর দাদা ওকে ওদের বাড়ি নিয়ে আসে। সেদিন থেকে আদিত্যর সাথে আছে ও। নেই বলতে কোনো শব্দ আদিত্যর নেই। শুধু নিজের এই একাকিত্বকেই নেই করতে পারেনা সে। দিনশেষে নিজের মন খুলে মেলে দেওয়ার জন্য কেউ নেই তার পাশে। সারাদিনের ব্যাস্ততা শেষ করে যখন বাড়ি ফেরে তখন তার মনকে প্রশান্তি দেওয়ার মতো কেউ নেই। এমনিতেতো আদিত্যর জীবনে আসার জন্য লাখো মেয়ে ছুটে আসে। কিন্তু আদিত্য জানে, এরা সবাই ওর টাকা স্টাটাসের মোহে আসতে চায়। শুধু আদিত্যের মনের সাথী হতে পারে এমন কেউই নেই। তাইতো আদিত্যর এসবের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেছে। নিজেকে নিজের মতো শক্ত কঠোর বানিয়ে নিয়েছে সে। এসব মোহ মায়া থেকে নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছে।ধীরে ধীরে এক ভয়ানক অগ্নি মানবে পরিণত করে নিয়েছে সে। যার কাছে চাইলেও কেউ আসার সাহস পাবেনা।

সকাল বেলা ঘুমের মাঝেই কারোর রিনিঝিনি হাসির শব্দ কানে বাজে আদিত্যর। চোখ কুঁচকে মেলে তাকায় সে। বালিশ থেকে মাথা উঁচিয়ে কুঁচকান চোখে এদিক ওদিক তাকায় সে হাসির উৎস খুঁজতে। কিন্তু পায়না। হাসিটা যেন জলতরঙ্গের মতো বাজছে তার কানে। আদিত্য বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজার বাইরে এসে এদিক ওদিক চোখ বোলায়। হাসির আওয়াজ ছাঁদ থেকে আসছে বোঝা যায়। আদিত্য পা বাড়ায় ছাঁদের দিকে। ছাঁদে উঠে এসে খানিক সামনে এগুতেই হাসির রহস্য ভেদ হয় তার। দেখতে পায় হাসি ছড়ানো ব্যাক্তিকে। ওইতো সামনেই একটা মেয়ে হাতে প্রজাপতি ধরে রিনিঝিনি সুরে হাসছে। পড়নে প্রিন্টের একটা ফ্রক। মাথার চুলগুলো দুই ঝুঁটি করা কাঁধের উপর। প্রজাপতিটার ডানা ঝাপটানো দেখে হাসছে সে। সাথে হাসছে তার চোখ। যেন চোখে তারা ঝিলমিল করছে। আদিত্য অজান্তেই কখন থমকে তাকিয়ে রইলো নিজেও জানে না। আনমনেই এগিয়ে গেল সে নূরের দিকে। নূরের নজর পাশে যেতেই হঠাৎ আদিত্যকে দেখে ভয়ে আৎকে উঠল সে।ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে হাত দুটো জড়ো করে পেছাতে লাগলো সে। যেন লুকাবার জায়গা খুঁজছে। নাহলে হয়তো আদিত্য ওকে মেরে ফেলবে যেন৷ নূরের এই ভয় পাওয়াটা আদিত্যর ভালো লাগলো না৷ রাগ হলো হঠাৎ তার। রাগটা ঠিক কি কারণে তা জানে না সে। তবে সে রাগে ধমকে উঠে বলল,
“এই মেয়ে কে তুমি? এখানে কি করছ?”
নূর এমনিতেই ভয়ে জমে ছিলো। তারউপর আদিত্যর ধমকে আত্মা উড়ে যাবার জোগাড় তার। তখনই সেখানে জমিলা বেগম ছাঁদের অন্যপাশ থেকে দ্রুত এলো। তাকে দেখেই নূর ঝট করে জমিলার পেছনে লুকিয়ে গেল। পিঠের মাঝে মাথা চেপে ধরলো সে। জমিলা আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
“আসলে আমি গাছে পানি দিতে আইছিলাম। বউমনিও আমার সাথেই আইছিলো। আমি বুঝতে পারি নাই আপনি এখন ছাঁদে আসবেন। তাহলে ওকে নিয়ে আসতাম না।”
আদিত্যর জমিলার কথাতে তেমন ধ্যান নেই। তার ধ্যানতো ওই পেছনে মুখ লুকিয়ে থাকা মেয়েটাতে। জমিলার কথায় বুঝতে পারলো মেয়েটা তারই সেদিনের বিয়ে করা বউ। আর বুঝতে পেরেই তার মাঝে কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি সৃষ্টি হলো। যে অনুভূতির নাম জানে না সে। তবে মেয়েটার এভাবে ওকে ভয় পাওয়াটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না ওর। রাগ হচ্ছে ভীষণ।রাগের মাঝেই জমিলা বলল,
“আমি এখুনি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।”
জমিলা তার কথা শেষ করেই নূরকে নিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল। আদিত্যর রাগ যেন আরও বাড়ল। কেন হচ্ছে এই রাগ তা তার জানা নেই। রাগটা কি মেয়েটার উপর নাকি নিজের উপর তাও জানে না। এক মিনিট! মেয়েটা! ওরতো নাম আছে। কি নাম ওর! আদিত্যতো সেটাও জানে না৷ কেমন অদ্ভুত অস্বস্তি হতে লাগল আদিত্যর। রাগে সামনের টবটাতে লাথি মেরে নিচে নেমে গেল সে।

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (২)
সূচনা পর্ব
®মেহরুমা নূর

()

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here