#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_১২
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
বন্যা ভালো হয়ে যাবেন বললেও তাহসানের জ্বর ভালো হলোনা।টানা দুইদিন জ্বরে ভোগে তারপর ভালো হলো।এই জ্বর তাকে যতোটা না কষ্ট দিয়েছে এর চেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে বন্যা।মেয়েটা সেদিন রাতের পর থেকে ফোন অফ করে রেখেছে,তার উপর সে যে বাসা থেকে বেরোবে তারও উপায় নেই আফিয়া বেগম সারাক্ষণ খেয়াল রাখছেন,সে যে বড়ো হয়ে গেছে এটা তার মা বুঝতেই চায় না।তার মা বলে কথা না সব বাবা মায়ের কাছেই সন্তান সবসময় ছোটই থাকে কিন্তু বন্যার সাথে যোগাযোগ তো করতেই হবে।তাহসান বিরক্তিতে ফ্লোরে থু থু দেয়,মুখ কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা কতো নিষ্ঠুর;জানে জ্বরে পড়ে আছে তারপরও ফোন দিচ্ছে না।ভালোবাসে এটা জানে বলেই কি এতো কষ্ট দিচ্ছে?আসলে খুব বেশী ভালোবাসলে কখনো প্রকাশ করতে নেই।আফিয়া বেগম মুরগীর স্যুপ নিয়ে রুমে আসে।ফ্লোরে পিচ্ছিল কিছুতে তে পা পড়াতে উনার গা ঘিনঘিন করে উঠে;খেয়াল করে দেখে থু থু।থু থু ফালানোর জন্য,ঝুড়ি আছে,বাথরুম আছে,বারান্দা আছে কিন্তু সব উপায় একপাশে রেখে এমন বিশ্রী কাজটা কি করে করলো?উনি উনার ছেলে মেয়েকে এমন অভদ্রতা শেখায়নি।তাহসান মায়ের অভিব্যক্তি দেখেই বুঝে যায় কাহীনি।আফিয়া বেগম তাহসানের বিছানায় বসে বললো,
“ফ্লোর কি থু থু ফালানোর জায়গা?”
তাহসান ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে।আফিয়া বেগমই ফের বললো,
“আগে তো এমন ছিলি না এখন এতো অধঃপতন হয়েছে কেনো?এই অভদ্র বন্যা ফন্যার সাথে ঘুরলে তো এমন অধঃপতন হবেই।”
বন্যার প্রসঙ্গ আসাতে তাহসানের কপালে ভাজ পড়ে।
“এখানে বন্যা আসলো কেনো?”
“ওর সাথে থেকেই তো তোর এই হাল।”
“সবসময় ওকে টানবে না।”
আফিয়া ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বাড়ায় না স্যুপের বাটি সামনে ধরে বললো,
“আচ্ছা।এখন নে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেল।”
স্যুপ দেখে তাহসান অভক্তি সুরে বললো,
“এই স্যুপ ট্যুপ খেতে পারবোনা।এসব রোগীদের খাবার আমাকে কেনো দিচ্ছো?আমি কি রোগী নাকি?”
ছেলের কথা শুনে আফিয়া বেগম অবাক হয়ে বললো,
“তুই কি?রোগী না?খা খা।”
তাহসান মায়ের কথার বিরোধ করে বললো,
“আমি মোটেই রোগী না পুরো ঠিক আছি।এখন বের হবো।”
আফিয়া রাগী চোখে তাকিয়ে কৃত্বিতের সুরে বললো,
“রাত দশটায় আর বের হতে হবে না।এখন ঘুমা।”
বিরক্ত লাগলেও তাহসান স্যুপটা শেষ করে।
রাত বারোটা বাজলেও তাহসানের ঘুম আসে না।ছটফট করে বিছানার এপাশ ওপাশ করে।বন্যার ফোন বন্ধ জেনেও আবারো চেষ্টা করে কিন্তু বরাবরের মতো হতাশ হয়ে বালিশের পাশে মোবাইলটা রেখে দেয়।
বন্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।তাহসান যে তার ফোনকলের অপেক্ষায় আছে সে জানে তারপরও ইচ্ছেকৃতভাবেই ফোন বন্ধ করে রেখেছে।তার মনের মাঝে যে টানাপোড়েন তার সমাধান না হওয়া অবধি সে তাহসানের প্রেমের মিষ্টি আলিঙ্গনে সাড়া দিতে পারছেনা।তার মন বলছে,
‘তাহসানের কাছে তুই সচ্ছ।এতো দ্বিধা কিসের?’
বিবেক বলে’ কিন্তু সমাজের কাছে অসচ্ছ,দোষী।’
‘সমাজ দিয়ে কি হবে?সমাজ তোকে নিয়ে সংসার করবে?তাহসান ঠিক থাকলেই হলো।’
‘আমরা যে এই সমাজেরই অংশ,এখানেই আমাদের বসবাস।পরবর্তীতে তাহসানের কষ্টের কারণ হতে চাই না।’
‘তাহলে এখনি তাহসানকে সব খুলে বল,সব শোনার পরে যদি সে এগিয়ে আসতে চায় তাহলে সমস্যা কি?’
বন্যার বিবেক দোনামোনা করে বললো,’এখনি বলবো?’
‘ হ্যাঁ। ‘
‘রাত তিনটা বাজে।’
মনটা হিসহিস করে হাসে।’ফোন দিয়ে দেখ তোর আশিক এখনো জেগেই আছে।’
বন্যা জোড়ে শ্বাস নেয়।এই দুইদিন এই কথাগুলো মন আর বিবেকের মাঝে রীতিমতো ঝগড়া করছে।বন্যা সিদ্ধান্ত নেয় সে ফোন দেবে।টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফোনটা এনে অন করে।তারপর তাহসানের নাম্বারে ফোন দেয়।
তাহসান তখন বই পড়ছিলো।কোনোভাবেই যখন ঘুম আসছিলো না তখন ভাবলো সময়টাকে কাজে লাগাই।সেই ভেবেই বই পড়া।বালিশের পাশে অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা যখন আচমকা চিৎকার করে উঠে তাহসান চমকে যায়।হাতে নিয়ে বন্যার ফোন দেখে এক আকাশ হাসি সারা মুখজোড়ে ভর করে।রিসিভ করে খানিক রাগী সুরে বললো,
“এই মেয়ে!ফাজলামি পেয়েছো নাকি?এমন করে কেউ উধাও হয়ে যায়?”
বন্যার মন আনন্দে উল্লাস করে বললো’বলেছিলাম না জেগে আছে।’
বন্যা আস্তে করে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।মিহি গলায় বললো,
“আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”
তাহসান মনোযোগী হয়ে বললো,
“বলো।”
বন্যা জোড়ে শ্বাস ফেলে নেয়।চোখ বন্ধ করে নিজের সবচেয়ে খারাপ মূহুর্তটা আরেকজনের কাছে বলতে প্রস্তুত হয়।
“আমার অতীত নিয়ে বলতে চাইছি।”
তাহসান কিছুক্ষণ কোনো কথা বলেনা।তারপর বললো,
“বন্যা!আমি এসব শুনতে চাই না।তোমার অতীত যেমনি হোক আমার সমস্যা নেই।”
বন্যা বললো,
“আমার সমস্যা আছে।আমি সবকিছু বিস্তারিত না বললে আপনার প্রস্তাবে রাজী হতে পারছিনা।”
তাহসান মাথা নেড়ে বললো,
“বলা কি খুব জরুরী?”
“হ্যাঁ।”
তাহসান নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে বললো,
“সরাসরি বলো।ছাদে আসো।”
বন্যা তড়িঘড়ি করে বললো,
“সরাসরি বলতে পারবো না ফোনেই বলবো।”
তাহসান বন্যার অসস্থির কারণ বুঝতে পারে।সে বললো,
“আচ্ছা বলো।”
“আমি তখন মাত্র ফাইভে পরিক্ষা দিয়েছিলাম।এই বাসায়ই থাকতাম।ছোট গুলুমুলু একটা মেয়ে ছিলাম।ওইটুকুন বয়সেই কোমড় ছাপানো লম্বা চুল সবাইকে বিমোহিত করতো।দেখতে এতোটা মিষ্টি ছিলাম যে আমাকে সবাই আদর করতো।আব্বা আম্মাও এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিতো কিন্তু একদিন সকালে আমি সামনের দোকান থেকে চিপস কিনতে গিয়েছিলাম।আব্বার সাথে এক আঙ্কেল চাকরি করতো তো উনি মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতো আমাকে এটা সেটা কিনে দিতো।চিপস কিনে বাসায় আসার পথে উনি আমাকে উনার বাসায় যেতে বলে উনার বাসায় নাকি আব্বা আম্মা গিয়েছে।ছোট ছিলাম এতোকিছু যাচাই না করেই উনার সাথে উনার বাসায় যাই।গিয়ে দেখি উনার বাসায় কেউ নেই।খালি বাসায় আমরা দুজন।আমি আব্বা আম্মাকে খুঁজলে উনি আমার মুখ চেপে ধরে।এতোবড়ো একটা মানুষের সাথে পেরে উঠছিলাম না।চিৎকার করে নিজের কষ্ট উনাকে বলেছিলাম কিন্তু পাষাণ লোকটা আমার মুখ চেপে আমার চিৎকার বন্ধ করতে চেয়েছে,হাত দিয়ে জোড়ে থাপ্পড় দিয়ে ব্যাথা দিয়েছে।প্রচন্ড ব্যাথায় আমি যখন কাতর তখন উনি দেহের খুদা মেটাতে ব্যস্ত।জানেন আমি উনার কাছে থেকে ছাড়া পেতে উনাকে আব্বা পর্যন্ত ডেকেছি কিন্তু উনি আমাকে ছাড়েননি।উনার কর্ম হাসিল করেই আমাকে ছেড়েছে ততক্ষণে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম,ছোট একটা মেয়ে যে কিনা তখনো অপরিণত তার উপরেই এতো বড়ো অত্যাচার করে উনি আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে আমাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায়।তখন সম্ভবত দুপুর আমাকে ওভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে লোকজন আসে।আমার অবস্থা দেখে উনাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না ঘটনা কি।আব্বা আম্মাকে ডেকে এনে আমায় হসপিটালে নিয়ে যায়।টানা সাতদিন হসপিটালে ভর্তি থেকে আমায় বাসায় আনা হয় তখন থেকেই আমি পুরোপুরি বদলে গেছি কারো সাথেই কথা বলিনা,পুরুষ সম্পর্কে আমার ধারনা পাল্টে যায়,সব পুরুষকে খারাপ মনে হয়,কোনো পুরুষকে সহ্য করতে পারিনা।আশেপাশের মানুষ আমাকে দেখতে এসে ইঙ্গিতে এটা সেটা বলে যায় আম্মার গুনগুনিয়ে কান্নাকাটি সবমিলিয়ে আমি তখন থেকেই আজকের বন্যার সৃষ্টি হয়।তাহসান আমার বুকে যে কি পরিমান কষ্ট এটা কাউকে বুঝাতে পারিনা।নিজের কাছেই নিজেকে খারাপ মনে হয়।”
সবগুলো কথা বন্যা কেঁদে কেঁদে বলে,এমনভাবে তাহসান ওকে কান্না করতে আগে দেখেনি,প্রিয় রমনীর কান্নায় বুকটা কেঁপে ওঠে।বন্যার কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে তাহসানের চোখ থেকে পানি পড়ছে সে নিজেই জানেনা।বন্যার অতীত আসলেই খারাপ,শুনতেই তার এতোটা খারাপ লাগছে না জানি বন্যার কেমন লাগে।বন্যা ফিসফিস করে বললো,
“এখনও কি আমাকেই আপনার চাই?”
তাহসান জড়ানো গলায় বললো,
“খুব চাই।”
তাহসানের কন্ঠ শুনে বন্যা বুঝতে পারে তাহসান কাঁদছে।বন্যাও আরো জোড়ে কান্না করে দেয়।
“তাহসান..”
তাহসান নরম কন্ঠে বললো,
“কি?”
বন্যা কান্নারত গলায় বললো,
“আমার খুব কষ্ট হয়।”
“আর কষ্ট হবেনা।”
“এখনো আমাকে ভালোবাসেন।”
তাহসান বললো,
“আগের থেকে বেশী ভালোবাসি।”
বন্যা ডুকরে কেঁদে উঠে।
“আমিও ভালোবাসি।খুব বেশী।”
তাহসান বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে যায়।দরজা খুলতে খুলতে বললো,
“ছাদে যাচ্ছি।দুই মিনিটে আসবে,আমি অপেক্ষায় আছি।”
বন্যা নিঃশব্দে দরজা খুলে ছাদে যায়।তাহসান বন্যাকে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দুজন দুজনকে দেখতে থাকে।হঠাৎ তাহসান ছুটে এসে বন্যাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।বন্যা তখনো কাঁদছে।তাহসান ফিসফিস করে বললো,
“এই!তখন কি বলেছিলে আবার বলো না প্লিজ।”
বন্যা তাহসানের পিঠে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে।বুকে নাক ঘষে কাঁদে।সেদিন এমন ইচ্ছেই হচ্ছিলো আজকে পূরণ হয়ে গেলো।তাহসানের কথা শুনে সে ভিষণ আদুরী গলায় বললো,
“খুব খুব বেশী ভালোবাসি।”
তাহসান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কোথায় রাখি তোমাকে?বুকের ভেতরে নিয়ে যেতে পারলে বোধহয় শান্তি হতো।”
বন্যা তখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।তাহসান বললো,
“এমন জা.নোয়ারের জন্য আমি তোমাকে ভুলে যাবো ভাবলে কি করে?সব কষ্ট আমি ভালোবাসায় মুছে দেবো,আমার উপর বিশ্বাস রাখো।যে ঝড় আসবে আমরা দুজন মিলেই মোকাবিলা করবো।”
তাহসান বন্যাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে ভালোবাসার প্রথম পরশ দেয়।তারপর বন্যাকে ছেড়ে দেখে বন্যা লজ্জা পাচ্ছে।তাহসান হেসে বললো,
“তোমাকে লজ্জা পেতে দেখলে দারুন লাগে।”
বন্যা নিশ্চুপ।তাহসান বললো,
“আর লজ্জা পেও না,বিয়ের আগে আর আদর করবো না না।”
তাহসানের কথা শুনে বন্যা হাসে।তাহসান বন্যার হাত ধরে সেদিন রাতের মতো করে ঘুরায়।তারপর হঠাৎ থেমে চিৎকার করে বললো,
“শোন চাঁদ,আমি আমার ব্যক্তিগত চাঁদ পেয়ে গেছি।”
তারপর বন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভালোবাসি লক্ষীটি।”
বন্যা কান্না ভুলে খিলখিল করে হাসে।তাহসানের মতো গলা ছেড়ে বললো,
“ভালোবাসি আমার রাজকুমার।”
চলবে….#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_১৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
পরেরদিন সকাল বেলা তাহসান ফজরের নামায পড়ে বাহিরে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে।সাতটার দিকে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করতে যায়।তাহসান যে সেই সাত সকালে উঠেছে এটা আফিয়া বেগমের দৃষ্টি এড়ায়নি।ছেলের সামনে নাস্তা দিয়ে পাশে বসে।তাহসান হাসিমুখে খাবার খায়।আফিয়া ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আব্বু;তোকে খুব খুশী লাগছে যে!”
তাহসান আসলে নিজের মনের প্রফুল্লতা লুকাতে পারছেনা।এই যে না চাইতেও মুখটা কেমন হাসিহাসি হয়ে যাচ্ছে এটা তো বন্যার কারণেই।মেয়েটা তার চাঁদ হয়ে গেছে;এর চেয়ে খুশী আর কি হতে পারে!সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“জ্বর ভালো হয়ে গেছে তাই মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।”
আফিয়া হেসে ছেলের মাথায় হাত ভুলায়।
“সবসময় এমন হাসিখুশি থাকবি।তোকে এমন দেখতেই আমার ভালো লাগে।”
তাহসান বাধ্য ছেলের মতো মাথা এলিয়ে বললো,
“আচ্ছা।”
বন্যা আজকে একটু বেশী ঘুমিয়েছে।তার মনে হয়েছে অনেকদিন পরে সে এমন শান্তির ঘুম ঘুমালো।এতোদিন বুকে যে পাথরটা চাপা দিয়ে থাকতো আজকে সেটা নেই,নেই লাগছে।সাড়ে আটটার সময় ফ্রেশ হয়ে বের হয়।রেনু বেগম তখন রান্নায় ব্যস্ত;বন্যা রান্নাঘরে গিয়ে তার আম্মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।রেনু বেগম চমকে যায় পেছন ফিরে বন্যার হাসিমুখটা দেখে মনে শান্তি পায়।হাতের কাজ রেখে বন্যার ববকাট চুল গুছিয়ে দিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার ?”
বন্যা তার মিষ্টি হাসিটা তার আম্মাকে উপহার দিয়ে বললো,
“ভালো আছো আম্মা?”
রেনু বেগম মাথা নেড়ে বললো,
“ভালো।এতো আহ্লাদ করা হচ্ছে কেনো?”
বন্যা রাতের স্মৃতি রোমন্থন করে মুচকি হাসে।মিষ্টি দেখতে রাজকুমারটা যখন একান্ত তার তখন তো তাকেই এসব আহ্লাদ করা মানায়।মায়ের হাত থেকে কাঠি নিয়ে তরকারি নেড়ে বললো,
“এমনি।”
“আচ্ছা।যা টেবিলে নাস্তা দেয়া খেয়ে নে।”
“আব্বা কোথায় আম্মা?”
“কয়টা বাজে খেয়াল আছে?কখনই অফিসে চলে গেছে।আজকাল রাস্তাঘাটে যা জ্যাম,আগে আগে না বের হলে দেরী হওয়ার ভ,য় থাকে।”
বন্যা চুপচাপ নাস্তা সেড়ে ভার্সিটির উদেশ্যে বেরিয়ে যায়।চারতলার বারান্দা থেকে তাহসান মুচকি হাসে।জিন্স আর ঢোলা শার্ট গায়ে বন্যা পিছু ফিরে থাকায় তাহসান হাত নেড়ে বিদায় জানায়।বন্যা প্রতিউত্তরে মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়।এই যান্ত্রিক কোলাহলের শহরে সবাই যখন প্রাত্যহিক ঝঞ্ঝাটময় কাজ কর্মে ব্যস্ত দুজন মানুষ খুব গোপনে তাদের ভালোবাসার দিন উদযাপন করে নেয়।
সারাদিন চাতক পাখির মতো তাহসান অপেক্ষা করে কখন বিকেল হবে।যখন বিকেল হলো তখন মোবাইল হাতে নিয়ে বন্যাকে মেসেজ করে বেরিয়ে পড়ে।এই একদিনেই মনে হচ্ছে বন্যা তাহসানের কলিজা হয়ে গেছে,সারাটাক্ষন একসাথে থাকতে ইচ্ছে করে।আচ্ছা সবারই কি এমন হয়?প্রেমে পড়লেই কি এমন পাগলাটে ইচ্ছে মাথায় ভর করে?
বন্যা তখনো ভার্সিটিতে।আজকে তাদের এক্সট্রা ক্লাস ছিলো বিধায় দেরী।তাছাড়া বন্ধুদের পেয়ে বন্যা আজকে গল্পটা একটু বেশীই করে ফেলেছে।তন্নী সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার!আজকে এতো খুশী কেনো?”
বন্যা মুচকি হাসে।মনের খুশী মুখে কেনো ভেসে উঠে?সে তন্নীর প্রশ্নে কোনো উত্তর দেয় না।তন্নীর চোখ এড়ায়না বন্যার মুচকি হাসি।মেয়েটাকে হাসিখুশি দেখলে তার ভালোই লাগে।সবাই চলে যাবার পরে বন্যা রবীন্দ্র সরোবরে চলে যায়।আজকে প্রথম কোনো ছেলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে তার উপর ছেলেটা তার প্রিয় মানুষ।বন্যার নাকের ডগা ঘেমে উঠে,হাত দিয়ে নাক মুছে নিজেকে শান্ত করে,আসলে তার খুব নার্ভাস লাগছে।
তাহসান চল্লিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছে।অন্যমনস্ক হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে।মেয়েটা কি আসবেনা?তখনি বন্যা আসে;ধীর পায়ে তাহসানের পাশে এসে বসে।তাহসান হাসিমুখে বললো,
“কি ব্যাপার ম্যাডাম?না আসার ফন্দি আটা হচ্ছিলো বুঝি?”
বন্যা হাসে;মাথা নেড়ে না জানায়।
“বন্ধুরা যাচ্ছিলোনা তাই দেরী হলো।কখন এসেছেন?”
তাহসান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“প্রায় চল্লিশ মিনিট হবে।”
বন্যা মাথা নেড়ে বললো,
“খুব বেশী অপেক্ষা করতে হলো।”
তাহসান হাসে।বেঞ্চে থাকা বন্যার হাতটা সযত্নে নিজের দুই হাতর মুঠোয় নিয়ে বললো,
“তুমি আমার চাঁদ;তোমার জন্য মাত্র চল্লিশ মিনিট কেনো দরকার হলে সারাটা জীবন অপেক্ষা করে যাবো।এর বিনিময়ে তুমি শুধু আমার হয়ো।”
তাহসানের এই সামান্য কথায় বন্যা ভিষণ মুগ্ধ হয়।ছেলেটা এতো মিষ্টি করে কথা বলে যে ভালো না লেগে থাকাই যায় না।বন্যা ভাবে আগে তো তাহসানকে কিংবা তার কথাবার্তা সবই বিরক্ত লাগতো কিন্তু এখন একটুও বিরক্ত লাগে না বরং বিরক্তির যায়গায় ভালোলাগা লাজ করে এটাই বুঝি প্রেমের শক্তি।সে তাহসানের দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা গলায় আস্তে করে বললো,
“আমি তো আপনারই।সারা জীবনের জন্য।”
তাহসান বন্যার কথায় হেসে ফেলে।আস্তে করে বললো,
“তুমি লজ্জা পেলে আমার ভিষণ ভালো লাগে।তোমাকে লজ্জাবতী ললনা বলতে ইচ্ছে করে।”
বন্যা।চকিত গলায় বললো,
“আপনি বাচ্চা ছেলেদের মতো ফ্লাট করছেন।”
“তাই নাকি?আমিতো আমার লজ্জাবতীর গুনগান গাইছি।তোমার লজ্জা লাগছে নাকি?দেখি দেখি।”
তাহসান মাথা নিচু করে বন্যার দিকে তাকালে বন্যা অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
“চুপ করেন না প্লিজ।”
তাহসান মুগ্ধ হয়ে বন্যাকে দেখে।এতোদিন শক্ত খোলসে তার সামনে আসলেও আজকে এসেছে কোমল হয়ে।এই যে আড়চোখে তাকে দেখা কিংবা লজ্জা পাওয়া সব কিছুই তাহসান আজকে প্রথম দেখছে।শান্ত গলায় বললো,
“আমার সাথে এমনই থাকবে সবসময়।”
বন্যা কথা বাড়ায় না বরং বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বললো,
“আচ্ছা।”
তাহসান দুষ্টু হেসে বললো,
“আজকে আমাদের ফাস্ট ডেট।”
তাহসানের কথায় বন্যাও হাসে।তাহসান বললো,
“ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে বসতে পারতাম এখানে কেনো আসতে বললে?”
বন্যা লেকের পানির দিকে তাকিয়ে বললো,
“জীবনে কখনো প্রেম করিনি।স্কুল,কলেজ,ভার্সিটিতে যারা প্রেম করে তারা প্রায়ই রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরতে আসে।এই যে আশেপাশে দেখুন কপোত-কপোতী সংখ্যাই বেশী।তাই আমার মনও চাইলো এখানেই আসা ভালো।আপনার ভালো লাগেনি?”
তাহসান আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“ভালো লেগেছে।তুমি পাশে থাকলে সবই ভালো লাগে।”
“আচ্ছা।”
বন্যা তার ববকাট চুলে হাত দেয়,মাথার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে সে হাত দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করছে।ব্যাপারটা তাহসানের চোখে আসে।সে বন্যার ছোট ছোট করে কাঁটা চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে বন্যা বললো,
“একটা সত্যি কথা বলবেন?”
“হুম।”
বন্যা খানিকটা ইতস্তত করে বললো,
” আপনার কি লম্বা চুল পছন্দ।”
তাহসান স্থির চোখে বন্যার দিকে তাকিয়ে থাকে।কি বলবে খুঁজে পায় না।আসলে সত্যি বলতে কি তার লম্বা চুলই পছন্দ কিন্তু বন্যার ছোট চুল তাতে অবশ্য তার কিছু আসে যায় না।সত্যিটা বললে যদি বন্যা কষ্ট পায়!তাহসান চায় না তার বন্যা কষ্ট পাক।তাছাড়া বন্যাকে বোধহয় ছোট চুলেই মানায়,ঠিক পুতুলের মতো লাগে।সে হেসে বললো,
“ছোট চুলই ভালো লাগে। আজকাল তো এমনই চলে।তাই না?”
বন্যা এক দৃষ্টিতে তাহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে।তার চোখের দিকে তাকিয়ে তাহসান বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো?”
বন্যা ঠোঁট উল্টে বললো,
“তেমন কিছু না,আপনার পছন্দ অপছন্দ জানতে চাচ্ছিলাম।”
“আমার পছন্দ জেনে কি করবে?আমার পছন্দ মতো নিজেকে সাজাবে?খবরদার।এমন কাজ ভুলেও করতে যাবেনা,তুমি যেমন তেমনি থাকো,কারো পছন্দ অনুযায়ী নিজেকে সাজাতে যেও না।তুমি যেমন তেমন রূপেই আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।”
বন্যা হেসে বললো,
“আচ্ছা।”
সে লেকের পানির দিকে তাকায়।তারপর কিছুক্ষন দুজনেই চুপ করে থাকে।বন্যা তাহসানের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।বন্যাও তাকিয়ে থাকে।তাহসান ভেবে পায়না একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে এতো ভালো লাগবে কেনো?কেমন মায়াভরা নেশালু আকর্ষণ।সে বন্যার গালে আলতো করে টুকা দিয়ে বললো,
“তুমি খুব সুন্দরী বন্যা।”
বন্যা হেসে বললো,
“পাম দিচ্ছেন নাকি বুঝতে পারছিনা।”
তাহসান গভীর চোখে তাকিয়ে বললো,
“না মন থেকেই বলছি কিন্তু সাবধান আমাকে আর ওসব কথার একটা অক্ষরও বলো না।প্রেমিকার মুখে এমন কথা শুনে আমি নির্ঘাৎ হার্ট অ্যাটাক করবো।ইউ নো!তোমার ব্যাপারে আমার হার্ট খুবই দুর্বল।”
বন্যা বুঝতে না পেরে বললো,
“কোন কথা?”
তাহসান দুষ্টু হেসে বললো,
“সালা!আমি যে তোমার সালা হই এটা আর বলোনা।প্রেমিকার মুখে জান মানায় সালা না।বুঝেছো?”
সন্ধার পরে বন্যা আর তাহসান বাসায় আসে।দুজনে একি রিকশা দিয়ে এসেছে।বন্যা সংকোচ করলেও তাহসান আশ্বাস দিয়েছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে কেউ দেখবেনা কিন্তু তার ধারনা ভূল প্রমানিত করে চারতলার বারান্দা থেকে আফিয়া বেগম ঠিকই দেখে নেয়।কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।তাহসান বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই আফিয়া সামনে এসে দাঁড়ায়।কঠিন গলায় বললো,
“বন্যার সাথে এতো মেলামেশার দরকার নেই।”
তাহসান শান্ত গলায় বললো,
“কেনো?”
আফিয়া চোখের নজর এপাশ ওপাশ করে বললো,
“বন্যা ভালো মেয়ে না।”
“কি করেছে ও?”
আফিয়া ইতস্তত করে ছেলের কাছে এসব বলা উচিত কিনা খানিক ভাবে।বললে যদি ছেলের মঙ্গল হয় তাহলে বলবে।উনি চোখ বন্ধ করে বললো,
“ধর্ষিতা ও।বন্যার সাথে এতো চলাফেরা সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখবে না,তাই তুউ আর ওই মেয়ের কাছেও যাবিনা।”
চলবে…………
সবাই লাইক কমেন্ট করবেন।আপনারা লাইক কমেন্ট করলে আমি খুব দ্রুত লিখতে পারি।