তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব ২১+২২+২৩

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২১

” কাঁদে না দুয়া। সব ঠিক হয়ে গেছে তো। এই যে তুমি আমার কাছে। নিরাপদে আছো তো।‌ বলো নিরাপদে আছো না? ”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মেয়েটি। কেমন মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তূর্ণ মুচকি হেসে বললো,

” এই তো। আমার বউটা আমার কাছেই আছে। আর কোনো ভয় নেই। এখানে কোনো বাজে লোকের ছায়া অবধি নেই। শুধু তুমি আর আমি। তাই না? ”

দুয়া অস্ফুট স্বরে বললো, ” হুঁ। ”

” গুড। এবার চুপটি করে আমার বুকে আসো তো। এখানটায় মাথা রেখে শুয়ে পড়ো। এটি হলো তোমার সবচেয়ে ভরসাযোগ্য স্থান। যখনই ভয় পাবে, খুব কষ্ট হবে, কাঁদতে ইচ্ছে করবে- ব্যাস এখানটায় চলে আসবে। আমি কিচ্ছুটি বলবো না মাইরা। শুধু নীরবে আগলে নেবো তোমায়। এখানে একবার মাথা রেখে দেখোই না! সমস্ত দুঃখকষ্ট-ভয় এক লহমায় ফুরুৎ। ”

দু হাত প্রসারিত করে নিজের বক্ষপটে আসার আহ্বান জানালো তূর্ণ! সম্মোহিতের ন্যায় তাকিয়ে রইল দুয়া। আঁখি পল্লব ঝাপটে বুঝি শুধালো সত্যিই আসবো! চোখের ইশারায় হাঁ সূচক জবাব দিলো মানুষটি। আর বিলম্ব করলো না দুয়া। নিজের সমস্ত অস্থিরতা, জড়তা একপাশে রেখে আস্তে করে এগিয়ে গেল। এতটা ধীরগতি বুঝি মানুষটির পছন্দ হলো না। তাই তো সন্নিকটে পৌঁছাতেই হাত ধরে নিজের বুকে মিশিয়ে নিলো তার মাইরা’কে। প্রিয়তমাকে! প্রথমবারের মতো তার হৃদয়ে লুকানো প্রেম ঠাঁই নিয়েছে বক্ষপটে। আদুরে পাখির ন্যায় লেপ্টে বুকের মাঝে। এতদিনের তৃষ্ণার্ত অন্তঃস্থল স্বস্তিতে ছেয়ে গেল। ভালোলাগা, আবেশে সিক্ত হলো তনুমন। পরম শান্তিতে মুদিত হলো নেত্রপল্লব। পেশিবহুল দু’টো হাতে আগলে নিলো নিজের সনে।

দুয়া’র কোমল গাত্র ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হচ্ছে। প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষের এতখানি সান্নিধ্যে! সে পুরুষটি কোনো পরপুরুষ নয় কিন্তু। বরং তার একান্ত একজন। তার অর্ধাঙ্গ। মানুষটির দু’টো হাত তার পৃষ্ঠদেশ আঁকড়ে ধরে। প্রগাঢ় রূপে আঁকড়ে রেখেছে। যেন আলগা করে ধরলেই হারিয়ে যাবে ধোঁয়াশায়। মেয়েটির মুখখানি ঠেকে শক্তপোক্ত বক্ষপটে। নাসিকা গ্ৰন্থিতে এসে প্রবল ভাবে প্রবেশ করছে এক মা’দকীয় সুভাস! তার একান্ত মানুষটির নিজস্ব সুভাস যা কোনো মা*দককতার চেয়ে কম নয়। স্বল্প সময়েই তাকে মা’তাল করে তুলছে‌। হৃদয়ের আঙ্গিনায় ফুটে উঠছে নতুন এক পুষ্প। নাম তার প্রেমপুষ্প। অজান্তেই মেয়েটির অধর কোলে ফুটে উঠলো লজ্জালু আভা। তবে তা গাঢ় হবার পূর্বেই হারিয়ে গেল। নিজের মাথা আবিষ্কার করলো বালিশের বুকে। মুখোমুখি একান্ত আপনজন মানুষটি। তার চোখেমুখে মলিন আভা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর মুখখানি দেখছে আর চেহারার রঙ পরিবর্তন হচ্ছে। একসময় আলতো করে স্পর্শ করলো ওর চোয়াল। সেথায় বৃদ্ধাঙ্গুল বুলাতে বুলাতে ক্ষীণ স্বরে শুধালো,

” এখানটায় চেপে ধরেছিল। খুব লেগেছিল তাই না? ব্যথা অনুভূত হয়েছিল? ”

মেয়েটি উত্তর দিতে ভুলে গেল। মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে রইল মানুষটির পানে। তার চোখেমুখে অনুশোচনা, অজানা এক যাতনা! তা লক্ষ্য করে মেয়েটি না চাইতেও প্রসন্ন হলো। মানুষটির চোখেমুখে ফুটে ওঠা বেদনার ছাপ যেন তাকে স্পষ্ট রূপে বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘ আমি যে কে তোমার! ‘ সহসা দুয়া’র পানে ঝুঁকে গেল তূর্ণ। ওর দু পাশে দুই হাত ঠেকিয়ে মুখ নামিয়ে আনলো সন্নিকটে। আলতো করে অধর স্পর্শ করলো চোয়ালের ডান পার্শ্বে। সেথায় অধরের কিছু ছোঁয়া অঙ্কন করে চোয়ালের বাম পার্শ্বে ছুঁয়ে দিলো। সে যেন তার অধরের পবিত্র ছোঁয়ায় মুছে দিচ্ছে রুমান নামক নোং রা মানুষটির অপবিত্র ছোঁয়া। আবেশে মুদিত হলো দুয়া’র মায়াবী আঁখি পল্লব। নেত্রকোণ গড়িয়ে পড়লো সুখময় দু ফোঁটা অশ্রু। মায়াময়ীর দু চোখের পাতায় অধর ছুঁয়ে দিলো তূর্ণ। অবাধ্য দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো অর্ধাঙ্গিনীর ওষ্ঠাধরে। ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত ওষ্ঠাধর প্রেমিক পুরুষটির হৃদয়ে তুফান সৃষ্টি করলো। প্রিয়তমার একান্ত সান্নিধ্যে পুরুষালি চিত্তে যেন তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে দুয়া’র বাম পাশে শয্যা গ্রহণ করলো সে। ওকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে ললাটে চুমু এঁকে দিলো। মৃদু স্বরে বললো,

” ঘুমিয়ে পড়ো। ”

তমসায় আচ্ছাদিত যামিনী। মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে চন্দ্র। শুনশান বাস্কেটবল কোর্টে গোলাকার বলটির ধুপধাপ আলোড়ন। নীরবতা ভেদ করে মেঝেতে বলটির আঘাতের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। বাস্কেটবল কোর্টের ঠিক মধ্যিখানে একটা কাঠের চেয়ার। তাতে মোটা রশির আলিঙ্গনে আবদ্ধ এক মানব। আহত সে মানবটির নাম রুমান শিকদার। সারা মুখে আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন। হাত-পা বাঁধা মোটা রশি দিয়ে। আঘাতে জর্জরিত দেহটি বারংবার এলিয়ে পড়ছে চেয়ারে। নিভু নিভু চোখখানা নিবদ্ধ সম্মুখে। ধূসর বর্ণের স্লিভলেস গেঞ্জি এবং ট্রাউজার পড়নে মানুষটির। স্বেদজল গড়িয়ে পড়ছে কপোল ছুঁয়ে। লালচে চুলগুলো ঘামে এলোমেলো হয়ে লেপ্টে মাথার তালুতে। মানুষটি জোরে জোরে কোর্টে বল আঘাত করে বাস্কেট করছে আহত রুমানের মুখ বরাবর। বুক-পেট বরাবর। শক্তপোক্ত গোলাকার বলের আঘাতে একটু পরপর কঁকিয়ে উঠছে রুমান। তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তূর্ণ’র। সে তো নোং*রা কীটের দেহে বল বাস্কেট করতে ব্যস্ত। আহত দেহে পুনরায় বলের আঘাত। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো রুমান। তার বাম পার্শ্বে দন্ডায়মান রাজীব এবং নিশাদ তা লক্ষ্য করেও বেশ নির্লিপ্ত। যেন কিছুই হয়নি। অল ওকে। সর্বশেষ রুমানের মুখ বরাবর বল আঘাত করে থামলো আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ। তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকালো আহত মানুষটির পানে‌। রাগে ক্ষো’ভে লোহিত কণিকা টগবগ টগবগ করছে। মুষ্ঠিমেয় হয়ে যাচ্ছে হাত। ধীর কদম ফেলে রুমানের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো তূর্ণ। রুমান তা দেখতে পেয়ে ছটফট করতে লাগলো। কিন্তু মুখ দিয়ে টু শব্দটিও করতে পারলো না। স্কচটেপ দিয়ে মুখ যে বন্ধ।

তূর্ণ এসে দাঁড়ালো রুমান বরাবর। ডান হাতটি বাড়িয়ে দিতেই রাজীব এগিয়ে এলো। ওর হাতে তুলে দিলো লৌহ লম্বাকার লাঠি। ডান হাতে লাঠিটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো তূর্ণ। রাজীব পিছিয়ে পূর্বের জায়গায় চলে গেল। তূর্ণ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রুমানের দিকে। ভীতসন্ত্রস্ত রুমান বারবার আপত্তি জানাচ্ছে। ছলছল করছে আঁখি যুগল। তূর্ণ অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো,

” মাইরা! প্রিয়তমা সে। আমার হৃদয়ে সযতনে লুকায়িত প্রেম। ওর থেকে কয়েকশো গজ দূরে থাকতে আদেশ দিয়েছিলাম। মনে পড়ে? ”

রুমান মাথা নাড়িয়ে কিছু বোঝাতে চাইলো। কিন্তু তার পূর্বেই যন্ত্রণায় কাতরে উঠলো। ওর বাম বাহু বরাবর আঘাত হেনেছে লৌহ লাঠিটি।

” বলেছিলাম কি না? ”

রুমান যন্ত্রণায় তটস্থ হয়ে হাঁ সূচক মাথা নাড়ল। পুনরায় ওর ডান বাহুতে লাঠির আঘাত করলো তূর্ণ। রুমানের বদ্ধ আঁখি চুয়ে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো। তূর্ণ হাতে লাঠিটি ঘুরাতে ঘুরাতে আহত রুমানকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে হাঁটতে লাগলো। গম্ভীর স্বরে করতে লাগলো একের পর এক প্রশ্ন।

” তবে কেন এত স্পর্ধা দেখালি? তোর ভেতরে কি ভয়ডর নেই? কাকে তুই নোং রা বাক্যে জর্জরিত করেছিস? সে মাইরা আমার। আমার হালাল প্রিয়তমা।”

বলতে না বলতেই রুমানের হাত-পা বরাবর একের পর এক আঘাত। আঘাতে আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ দশা। আর সইতে পারছে না রুমান শিকদার। চিৎকার করতে না পারায় অবশ কণ্ঠনালী। প্রিয় বন্ধুর হিং স্র রূপ প্রদর্শন করে রাজীব ও নিশাদ বেশ ভীত। আস্তে করে তারা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। এই বদ্ধ উ’ন্মাদ প্রেমিকের উ’ন্মাদনা দেখে তারা অকালে হার্ট অ্যাটাক করে ম”রতে নারাজ।

এক যুগ পূর্বের কথা। সপরিবারে তখন রাজশাহী থাকতেন সাজ্জাদ সাহেব। ওখানে ওনার ইলেকট্রনিক্সের একটি মাঝারি দোকান ছিল। দোকান থেকে যা আয় হতো তাদের জন্য পারফেক্ট ছিল। বেশ ভালোভাবেই কাটছিল দিনকাল। হঠাৎ একদিন এলো কৃষ্ণকালো লগ্ন। মার্কেটে আগুন লেগে অসংখ্য দোকান পু’ড়ে ছাই হলো‌। উপার্জনের উৎস হারালো অগণিত পরিবার। তাদের মধ্যে সাজ্জাদ সাহেব নিজেও অন্তর্ভুক্ত। আয়ের একমাত্র উৎস চোখের সামনে জ্ব*লেপুড়ে ছারখার। সইতে পারলেন না উনি। চেতনা হারালেন মুহুর্তেই মধ্যেই। চেতনা ফেরার পর শুরু হলো নতুন জীবন, এক নতুন লড়াই। আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত সাজ্জাদ সাহেব তখন দিশেহারা বোধ করছেন। পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করতে গিয়ে বহু টাকা খরচ হলো। ব্যাংক ব্যালেন্স তখন সামান্য। এ অবস্থায় নতুন করে কি থেকে কি করবেন বুঝতেই পারছেন না। সব পাওনাদারের পাওনা এখনো পরিশোধ হয়নি। তারা যখন তখন টাকা ফেরত চাইছে। বাড়ি বয়ে এসে হু”মকি ধামকি দিচ্ছে। বিপদের সে-ই মুহূর্তে সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিলেন ভায়রা ভাই নিজাম সাহেব। নিজাম সাহেব তখন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। স্বনামধন্য উচ্চবিত্তদের কাতারে তার নামটিও রয়েছে। উনি তাহমিদা এবং তার পরিবারের দুরবস্থা জানতে পেরে সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন নিঃস্বার্থভাবে। তবে প্রবল আত্মসম্মানবোধের অধিকারী সাজ্জাদ সাহেব তা মানতে নারাজ। উনি বিনা শ্রমে কারো থেকে এক পয়সা নিতে অনিহা প্রকাশ করলেন। হতে পারেন উনি মধ্যবিত্ত। বিপদে পড়েছেন। তবে আত্মসম্মান বিসর্জন দেননি। ওনার প্রবল আত্মসম্মানবোধ দেখে নিজাম সাহেব গর্বিত হলেন। স্বেচ্ছায় পেশ করলেন এক দুর্দান্ত অফার।

” ঠিক আছে। তোমাকে আমার নিঃস্বার্থ হেল্প নিতে হবে না। তবে বিপদের সময় আমি তো টাকা ধার দিতেই পারি। কি পারি না? নিশ্চয়ই পারি। আমি তোমাকে পরামর্শ দেবো তুমি টাকাটা ধার হিসেবে নাও। পরবর্তীতে নাহয় ফেরত দিলে। ”

নিজাম সাহেবের পরামর্শ পছন্দ হলো সাজ্জাদ সাহেবের। উনি সহধর্মিণীর সঙ্গে আলাপচারিতা করে টাকাগুলো ধার হিসেবে গ্রহণ করলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুধাবন করতে পারলেন রাজশাহীতে ওনার হারানো পজিশন আর ফিরবে না। ওখানে টাকা ব্যয় করা অর্থহীন। বেকার। শেষমেষ নিজাম সাহেব আবারো পরামর্শ দিলেন। ওনার পরামর্শ অনুযায়ী সাজ্জাদ সাহেব সপরিবারে স্বপ্নের শহর ঢাকায় স্থানান্তর হলেন। ঢাকায় শুরু হলো তাদের নতুন এক সূচনা। নিজাম সাহেব এবং তাসলিমা নিজ উদ্যোগে তাদের বাসার কাছাকাছি ওদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সময়ের পরিক্রমায় স্বাভাবিক হলো সবটা। নতুন উদ্যমে জাগ্রত হলেন সাজ্জাদ সাহেব। দুই পরিবারের মধ্যে সখ্যতা, ঘনিষ্ঠতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় হতে লাগলো। একসময় সাজ্জাদ সাহেব ভায়রা ভাইয়ের থেকে ধারকৃত অর্থ পরিশোধ করতে সক্ষম হলেন। নিজস্ব অর্থে অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করলেন। যা কিনা ‘ ছায়াবিথী ‘ হতে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। সে-ই থেকে আজো দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা অম্লান – অটুট!

সাজেদার স্বামী ইন্তেকাল করেছেন প্রায় চৌদ্দ বছর পূর্বে। আদরের ছোট বোনটা তখন বিধবা। স্বামী ভিটা বগুড়ায় পুত্র-কন্যাসহ মানবেতর জীবনযাপন করছে। সাজ্জাদ সাহেব কত করে বললেন বোনকে চলে আসতে। কিন্তু বোন তা শুনলো না। অগত্যা সাজ্জাদ সাহেব হার মেনে নিলেন। তবে প্রতি মাসে মাসে বোনের পরিবারের খরচপাতির জন্য একটা অ্যামাউন্ট পাঠাতেন। যা কিনা সাজেদার জন্য খুবই উপকারী ছিল। সাজ্জাদ সাহেব টেরও পেলেন না তার আদরের ছোট বোনটা কবে এত বড়, আত্মসম্মানের অধিকারী হলো! তবে উনি মনে মনে খুশি হতেন। দিনরাত স্রষ্টার নিকটে বোনের জন্য দোয়া করতেন। ভাগ্নে ভাগ্নীর জন্য দোয়া করতেন। আজ সেই বোনটি কিনা এমন পর হয়ে গেল! রিসিপশন পার্টিতে বড় ভাইকে দেখে এমন আচরণ করলো যেন বাহিরের লোক সে। নামমাত্র পরিচিত হতে এসেছে। এমনকি ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে ভালোমতো তাকালোও না? বোনের চোখে এতটাই অপরাধী সে! যার ক্ষমা হয় না! এসব ভাবতে গিয়ে দুঃখবোধ করলেন সাজ্জাদ সাহেব। নেত্রকোণে জমায়িত হলে অশ্রু কণা। পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই! চিরন্তন সেই নিয়ম রক্ষার্থে উনি কাঁদলেন না। নিজেকে কোনোমতে সামলে শুয়ে পড়লেন। শয্যা গ্রহণ করলেন স্ত্রীর পাশে। তাহমিদা তখনো সজাগ। স্বামীর উপস্থিতি টের পেয়ে মৃদু স্বরে শুধালো,

” তুমি ঠিক আছো তো? ”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি পোষণ করলেন সাজ্জাদ সাহেব। রাতের আঁধারে বিলীন হয়ে গেল তার সমস্ত দুঃখকষ্ট- যাতনা!

দিবাকরের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। কক্ষজুড়ে অস্থির মেয়েটি পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। কখনো নখে দন্ত আ’ক্রমণ করছে। কখনোবা সে বসে পড়ছে টাফটেড বেঞ্চে। মাইরা’র এমন দশা দেখে কিছুটা অবাক হলো তূর্ণ! মেয়েটি এমন করছে কেন?

চলবে.#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২২

” অ্যাই অ্যাই এটা একদমই হয়নি। চিটিং করছো কেন?”

” একদম বাজে বলবি না। আমি মোটেও চিটিং করছি না। ইনফ্যাক্ট আমার মতো বাবুসোনা চিটিংয়ের স্পেলিং ই জানে না। চিটিং কারে কয় তাহা তো বহু দূরের বিষয়।”

এতবড় চাপাবাজি শুনে দুয়া আপাতত কো|মায়! অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা।
.

সান্ধ্যকালীন প্রহর। ছায়াবিথী’র লিভিংরুমে বড় ক্যারামবোর্ড রাখা। ক্যারামের দুইপাশে বসে দুয়া, তৃষা এবং নিশি, নিজাম সাহেব। আনোয়ারা বেগম সোফায় বসে হাসিমুখে ওদের খেলা দেখছেন। চারজন সদস্যের দ্বৈত খেলা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। দুয়া এবং তৃষা এক দলে। নিশি এবং নিজাম সাহেব আরেক দলে। দুয়া’র শিকারি চক্ষু নিবদ্ধ রেড গুটিতে। মেয়েটি রেড গুটি নিশানা করে চাল দিলো। তৃষা উৎফুল্ল নয়নে তাকিয়ে। নিজাম সাহেব এবং নিশির কপালে চিন্তার ভাঁজ। এই বুঝি তারা হেরে গেল! কিন্তু হায়! মুহুর্তের মধ্যেই তৃষার উৎফুল্লতা হারিয়ে গেল। চান্স মিস করে ফেলেছে দুয়া।

” ওহ্ শিট! ”

চোখমুখ কুঁচকে দুঃখপ্রকাশ করলো দুয়া। তখনই কর্ণ কুহরে পৌঁছালো হাস্য ধ্বনি। চারজনেই বামে তাকালো। তূর্ণ মহাশয় দাঁড়িয়ে। বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দুয়াকে তাচ্ছিল্য করে বললো,

” হুহ্! উল্টোপাল্টা ভাবে খেললে ওহ্ শিট শিট তো হবেই‌। ”

দুয়া ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

” তুমি কি আমার খেলার নৈপুণ্যকে আন্ডারস্টেমিমেট করছো? ”

তূর্ণ এসে নিশির পাশে বসলো। বাবাকে সসম্মানে সোফায় তুলে দিয়ে উত্তর দিলো,

” জ্বি হ্যাঁ। সবার দ্বারা সব হয় না। ”

” আচ্ছা? বাবার বদলে যখন বসেই পড়েছো হয়ে যাক এক রাউন্ড? ”

তূর্ণ দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

” ওকে ওকে। আমি আবার পত্নীভক্ত পুরুষ। বউয়ের কথা ফেলতে পারি না। ”

চাপাবাজি শুনে দুয়া ভেংচি কাটলো। আনোয়ারা বেগম মুচকি হেসে বললেন,

” পাঁজি ছেলে। শুধু শুধু বউয়ের পেছনে লাগছিস কেন?”

” নানুমনি! পেছনে লাগলাম কোথায়? আমি তো সামনে। ”

তূর্ণ বেবি ফেস করে নানুমনিকে শুধরে দিলো। তা দেখে দুয়া বিড়বিড় করে বললো,

” ঢং দেখলে বাঁচি না। ”

তূর্ণ তা শুনতে পেয়েও কিছু বললো না। বরং ওর দিকে তাকিয়ে থাকাবস্থায় নিশিকে বললো,

” তো ব্যাহনা! খেলা শুরু করা যাক? ”

” ইয়াহ্। ” হাসিমুখে সম্মতি জানালো নিশি।

শুরু হলো দ্বৈত খেলা। দুয়া, তৃষা ভার্সেস তূর্ণ, নিশি। নতুন করে খেলা শুরু হয়েছে। দুয়া কালো গুটি এবং তূর্ণ সাদা গুটি। দুই পক্ষই নিজেদের সেরাটা দিয়ে খেলছে।

” সাবাশ! চালিয়ে যাও। ”

ছেলে-মেয়েদের উৎসাহ প্রদান করে নিজাম সাহেব উঁচু কণ্ঠে পত্নীকে ডেকে উঠলেন।

” তাসলিমা। ও লিমা! জমজমাট খেলা চলছে। দেখে যাও। ”

তাসলিমা কিচেন থেকে জবাব দিলেন,

” আমি ব্যস্ত। তোমরাই দেখো। ”

” তুমি মিস করে ফেলবে তো। ”

” আমি ব্যস্ত। আসা সম্ভব না। ”

” ঠিক আছে থাকো রান্নাঘরে। কত জমজমাট একটা খেলা মিস করে ফেললে। ”

নিজাম সাহেব পুনরায় খেলায় মনোনিবেশ করলেন। খেলার এক পর্যায়ে দুয়া শনাক্ত করতে পারলো যে তূর্ণ মহাশয় চিটিং করছে। তৎক্ষণাৎ জোর বাক্যে আপত্তি জানালো সে।

” অ্যাই অ্যাই এটা একদমই হয়নি। চিটিং করছো কেন?”

তূর্ণ তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানিয়ে বললো,

” একদম বাজে বলবি না। আমি মোটেও চিটিং করছি না। ইনফ্যাক্ট আমার মতো বাবুসোনা চিটিংয়ের স্পেলিং ই জানে না। চিটিং কারে কয় তাহা তো বহু দূরের বিষয়।”

এতবড় চাপাবাজি শুনে দুয়া আপাতত কো`মায়! অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। তৃষা হাসতে হাসতে বললো,

” ভাইয়া গুটি ফেরত দাও। নইলে কিন্তু এলিমিনেট করা হবে।”

” আমার কাছে কোনো গুটি নেই। ”

দুয়া বললো,

” ভালোয় ভালোয় ফেরত দাও বলছি। নইলে কিন্তু.. ”

” নইলে কি? হাঁ? ভয় দেখাচ্ছিস আমায়? আমি বুঝি তোর মতো পুতলাকে ভয় পাই? ”

” এখানে ভয় পাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে? গুটি ফেরত দাও বলছি। ”

” গুটি নেই। ”

দুয়া’র পানে মৃদু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললো সম্মোহনী বাক্য,

” তবে একবুক ভালোবাসা আছে। লাগবে? হুঁ? ”

ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হেসে শুধালো তূর্ণ। তাতেই কুপোকাত দুয়া। মেয়েটি কাঠিন্যতা ত্যাগ করে কোমলতায় ফিরে এলো। লাজুক আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখখানিতে। আনমনে নত হলো মুখ। সে লালিমা মাখা মুখশ্রীতে বিমোহিত হলো পৌরুষ চিত্ত! মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করতে লাগলো মাইরা’র লাজে রাঙা মুখখানি। দুয়া আস্তে করে চোখ তুলে তাকালো। চোখে চোখ পড়তেই আটকে গেল সম্মোহনী চাহনিতে। একে অপরের নয়ন সাগরে ডুবে গেল দু’জন। মানুষটির অধরকোণে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর হাসির রেখা। ঠিক তখনই ট্রে হাতে হাজির হলেন তাসলিমা। সকলের জন্য সবজি পাকোড়া নিয়ে হাজির হয়েছেন।

” খেলা বন্ধ করো সবাই। সোফায় এসে বসো। পাকোড়া এনেছি। ”

” ওয়াও! পাকোড়া! ”

জিভে পানি চলে এলো নিশি’র। দুইবোন ছুটে গিয়ে সোফায় বসলো। চটাপট দখল করে নিলো পাকোড়া। এসবের ভিড়ে দু’জনার মুগ্ধময় দৃষ্টি বিনিময় ভঙ্গ হলো। তূর্ণ হঠাৎ করেই চোখ টিপে দিলো। তাতে হকচকিয়ে গেল মেয়েটি। বক্র হেসে খেলার আসর ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো তূর্ণ। বসলো সোফায়। সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে দুয়া দৃষ্টি নত করে নিলো। লজ্জা মিশ্রিত হেসে সে-ও উঠে দাঁড়ালো।

দিবাকরের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। কক্ষজুড়ে অস্থির মেয়েটি পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। কখনো নখে দন্ত আ’ক্রমণ করছে। কখনোবা সে বসে পড়ছে টাফটেড বেঞ্চে। কখনো আবার পানি পান করে শুকনা গলা সিক্ত করে নিচ্ছে। এমনই সময় কক্ষে প্রবেশ করলো তূর্ণ। তার মাইরা’র ( প্রিয়তমা ) এমন দশা দেখে কিছুটা অবাক হলো! মেয়েটি এমন করছে কেন? ধীরপায়ে এগিয়ে গেল তূর্ণ। দুয়া তখন টাফটেড বেঞ্চে বসে ধ্যানে মগ্ন। আলতো হাতে ওর কপাল স্পর্শ করলো তূর্ণ। তাপমাত্রা তো স্বাভাবিক। তবে?

” দুয়া! ”

হঠাৎ কর্ণ কুহরে কারোর কণ্ঠস্বর পৌঁছাতেই হকচকিয়ে গেল দুয়া। মুখ তুলে তাকালো। দেখতে পেল তূর্ণ দাঁড়িয়ে। চিন্তিত বদনে শুধালো,

” কি হয়েছে তোর? এমন অস্থির হয়ে আছিস কেন? এনি প্রবলেম? ”

” হুঁ। ” মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মেয়েটি।

” কি হয়েছে? বল আমাকে। ইনশাআল্লাহ্ সব সলভ্ করে দেবো। বল। ”

” পরীক্ষা সলভ্ করবে কি করে? ”

” হোয়াট? ” তূর্ণ ঠিক বুঝতে পারলো না।

দুয়া মলিন মুখে বললো,

” হাঁ। দু সপ্তাহ বাদে পরীক্ষা। ফাইনাল পরীক্ষা। ফাইনাল। চিন্তায় চিন্তায় আমার হাত-পা এমনকি পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসবে। কেঁপে কেঁপে উঠছে অন্তরাত্মা। কি হবে আমার? পাশ না ফেইল? ”

আকস্মিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো তূর্ণ। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এমন আচরণে হতবাক দুয়া! উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিস্মিত কণ্ঠে শুধালো,

” তুমি হাসছো? ”

তূর্ণ হাসতে হাসতে ওর কপালে টোকা দিয়ে বললো,

” গাঁধী। পরীক্ষার ভয়ে কেউ এমন করে? তোকে তো পুরো আদুআপা লাগছে। ”

দুয়া ভ্রু কুঁচকে ফেললো।

” আদুআপা! এটা আবার কি? ”

” হা হা। আদুভাইয়ের ফিমেল ভার্সন। ”

সরু চোখে তাকালো মেয়েটি। পুনরায় টাফটেড বেঞ্চে বসে বললো,

” বাজে বলবে না। আ’ম নট আদুআপা। ”

” ওকে ফাইন। বলবো না। ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে দেখা। আর বলবো না। ”

দুয়া চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

” ফার্স্ট ক্লাস আসবে তো? এবার না প্রিন্সিপলস্ অফ ফিন্যান্স বেশ জটিল। এছাড়া অ্যাকাউন্টিং তো আছেই। আমার বেশ ভয় হচ্ছে। ম্যাথে একটু গড়বড় হলেই তো সব খতম। ”

তূর্ণ ওর দু বাহু স্পর্শ করে উঠে দাঁড় করালো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’জনে। তূর্ণ সহধর্মিণীর চোখে চোখ রেখে বললো,

” নো টেনশন ওয়াইফি। যা হবে ইনশাআল্লাহ্ ভালোই হবে। ভয়কে জয় করে প্রিপারেশন নেয়া শুরু কর। হাতে এখনো দুই সপ্তাহ আছে। ইটস্ এনাফ ফর গুড প্রিপারেশন। আল্লাহ্’র রহমতে নিশ্চয়ই সফলকাম হবি।”

” হবো তো? ”

” ইনশাআল্লাহ্। ”

চিন্তিত বদন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। সত্যিই দুশ্চিন্তা অনেকাংশে লাঘব পেয়েছে। এই মানুষটির প্রতিটি বাক্যে কি জা*দুকরী উপাদান মিশ্রিত থাকে! যা কর্ণগোচর হলেই সমস্ত ভয়-চিন্তা উধাও! দুয়া’র অধর কোণ প্রসারিত হলো। মুগ্ধময় দৃষ্টিতে তাকালো স্বামীর পানে। এতদিন এই মানুষটি চেনাজানা ছিল। কাজিন ছিল। দু’জনের মধ্যে ছিল টম এন্ড জেরি সম্পর্ক। একে অপরের পিছে লাগবে ঠিকই কিন্তু একে অপরের কেয়ার করতেও ভুলবে না। তারা যেন অঘোষিত একে অপরের পরিপূরক ছিল। আজ তাদের সম্পর্কের সমীকরণ বদল হয়েছে। বদলেছে সম্পর্কের নাম। সে-ই সঙ্গে একে অপরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনাও পরিবর্তিত হয়েছে। দুয়া চেনা মানুষটির অচেনা এক রূপ প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করছে। অনুধাবন করতে পারছে তার হৃদয়ের বৃহৎ একটি অংশ কোনো জা*দুকরের দখলে চলে যাচ্ছে। নিজেকে নিত্যনতুন রূপে আবিষ্কার করছে সে। টের পাচ্ছে বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি আজ অন্যের সান্নিধ্যে দ্রুততম গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে। এ কেমন অজানা অনুভূতিতে আবিষ্ট হচ্ছে তনুমন!

প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দোরগোড়ায়। হাতে মাত্র নয়দিন সময়। মন ও মস্তিষ্ক একত্রিত করে পড়াশোনায় মগ্ন দুয়া এবং তৃষা। দু’জনেই নিজেদের সেরাটা দিয়ে পড়াশোনা করছে। প্রত্যাশা ফার্স্ট ক্লাস। তৃষা তো সিজিপিএ থ্রি পাড় করতে পারলেই মহাখুশি। কিন্তু জাহিরাহ্ দুয়া! তার স্বপ্ন খুব ভালো সিজিপিএ অর্জন করে পরিবারকে গর্বিত করা। একটি ভালো রেজাল্ট উপহার দেয়া। তাই তো এত পরিশ্রম।
.

প্রিন্সিপলস্ অফ অ্যাকাউন্টিং এর ম্যাথ করছিল দুয়া। দু’টো অঙ্কে গিয়ে আটকে পড়েছে। দু’টো অঙ্ক ই ইম্পর্ট্যান্ট। বেশ কয়েকবার ফাইনাল পরীক্ষায় এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই এটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন করবে টা কি? অসময়ে এসে ফেঁসে গেল। দুয়া টেস্ট পেপার হাতড়ে অঙ্ক দু’টো খুঁজে বের করলো। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। সে বুঝতেই পারছে না ঠিক কিভাবে অঙ্ক দু’টো সমাধান করবে। দুয়া’র চিন্তিত মুখশ্রী দৃষ্টি এড়ালো না তূর্ণ’র। সে হাতে থাকা সাইন্স ফিকশন বইটি রেখে ওর সন্নিকটে এলো।

” কি হয়েছে? এমন হুতুম পেঁচার মতো মুখ করে আছিস কেন? ”

দুয়া মৃদু স্বরে বললো,

” অঙ্কে প্রবলেম হচ্ছে। সলভ্ করতে পারছি না। ”

” দেখি কোন অঙ্ক। ”

দুয়া মুখ তুলে তাকালো।

” তুমি বুঝবে না তো। এগুলো কমার্সের ম্যাথ। ”

” তাতে কি হয়েছে? গ্রুপে কি এসে যায়। অঙ্ক তো অঙ্ক ই। দেখি কোনটায় প্রবলেম? ”

নিজ উদ্যোগে টেস্ট পেপার হাতে নিলো তূর্ণ। দুয়া দেখিয়ে দিলো কোনটায় সমস্যা। তূর্ণ বেশ ভাব নিয়ে প্রশ্ন দেখতে লাগলো। এমন ভাব যেন এক্ষুনি সমাধান করে দেবে। কিন্তু এ কি হাল! প্রশ্নের গভীরে ঢুকতেই লেকচারার আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ ফুঁস! কিসব ডেবিট ক্রেডিট। অ্যাকাউন্টস্ রিসিভেবল, আনআর্নড্ রেভিনিউ ইত্যাদি ইত্যাদি দেয়া। এসব কি?

” এগুলো কি? এই ডেবিট ক্রেডিট না হয় শুনেছি।‌ কিন্তু বাকিগুলো? এগুলো কি? ”

” অ্যাকাউন্টিং এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। তুমি বুঝবে না। ”

” বললেই হলো নাকি? কমার্সের চেয়ে সায়েন্স কিন্তু কয়েক গুণ বেশি কঠিন। সেই সায়েন্স যখন আমার হাতের মুঠোয় তখন কমার্স বুঝবো না? ”

” না বোঝার সম্ভাবনা বেশি। জানো তো সায়েন্সের স্টুডেন্টরা মনে করে কমার্স একদম পানির মতো সহজ। কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি। শুনেছি। আমার কিছু সহপাঠী ছিল স্কুল লেভেলের। ওরা এখন সায়েন্সের সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছে। এত কঠিন কঠিন ম্যাথ ওরা সলভ্ করে। কিন্তু কমার্সের ম্যাথ বোঝে না। ওরা নাকি ডেবিট ক্রেডিট নাম দু’টো শোনেইনি। বাকিগুলো তো পরের বিষয়। সেখানে কমার্স, আর্টসের স্টুডেন্টরা কিন্তু সায়েন্সের টুকটাক বিষয়াদি জানে। তাহলে কি বোঝা গেল? কোনো গ্রুপ ই সহজ না। সবাই যার যার জায়গায় কঠিন। বুঝলে? ”

তূর্ণ মুচকি হাসলো। বিনা দ্বিধায় নিজের অপারগতা স্বীকার করে বললো,

” থ্যাংকস ম্যাডাম। একটা ভুল ধারণা ভেঙে দিলেন। আসলেই যার যার সাবজেক্ট তার তার কাছে সেরা। কঠিন। ”

” হুম। ” মুচকি হেসে সম্মতি পোষণ করলো দুয়া।

তূর্ণ টেস্ট পেপার রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,

” এসব ডেবিট ক্রেডিট আমার কর্ম নয়। আমি বরং তোকে ইউটিউব থেকে কিছু লেকচার বের করে দিচ্ছি। ওগুলো ভালোমতো দেখ। ইনশাআল্লাহ্ বুঝতে পারবি। এতে না হলে কাল সকাল সকাল কোনো ফ্রেন্ডকে কল করে হেল্প নিস। এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে। এতরাতে কল করা ভালো দেখাবে না। ”

” ঠিক আছে। আমি ইউটিউবে দেখছি। ”

তূর্ণ নিজের মোবাইল এগিয়ে দিলো। দুয়া ইশারায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মোবাইলটি হাতে নিলো। খুঁজতে লাগলো কাঙ্ক্ষিত ভিডিও। তূর্ণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বিছানা ত্যাগ করলো। সেদিকে তাকিয়ে দুয়া তৃপ্তিময় হাসলো। কারো কারো ভাষ্যে আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ সেল্ফ সেন্টারড্ পার্সন। অহংকারী। ঠোঁটকাটা নি’র্লজ্জ পুরুষ। নিজেকে সর্বদা পারফেক্ট দাবী করে। আসলেই কি তাই? উঁহু ভুল তারা। তারা তো আর তূর্ণের প্রকৃত রূপটি সম্পর্কে অবগত নয়। জানে না এই দুষ্টু মানুষটির অন্তরালে লুকায়িত এক সরল প্রাণ। হাসিখুশি, মিশুক আর খুবই ভালো একজন মানুষ সে। যে কিনা একজন ট্রু ফ্রেন্ড। শুধু সুসময় নয় বরং দুঃসময়ের বন্ধুও। আজকাল নিজেকে কেমন ভাগ্যবতী মনে হয়! মুচকি হেসে মোবাইলে মনোযোগ দিলো দুয়া।

চলবে.#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৩

দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসুধা। বাতায়ন হতে পর্দা সরিয়ে দিলো তূর্ণ। মুহুর্তের মধ্যেই উজ্জ্বল কিরণে আলোকিত হলো কক্ষ। ঘুমন্ত ললনার চোখেমুখে আলো পড়তেই বিরক্ত বোধ করলো। বাম কাত হয়ে শুয়ে পড়লো সে। তূর্ণ বাতায়ন হতে মুখ ফিরিয়ে পিছু ঘুরে তাকালো। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো ঘুমন্ত অর্ধাঙ্গীর অবয়ব। মুচকি হেসে তূর্ণ এগিয়ে গেল বিছানার ধারে।

” দুয়া অ্যাই দুয়া! উঠে পড়। সকাল হয়ে গেছে। ”

ঘুমন্ত মানবীর কর্ণ কুহরে ডাক পৌঁছালো কি? বোধহয় না।

” দুয়া ওঠ। অ্যাই মেয়ে আর কত ঘুমাবি? ওঠ। তোর না ক’দিন পর পরীক্ষা? ”

ওপাশ হতে কোনো সাড়া নেই। বিরক্তিতে ‘ চ ‘ সূচক ধ্বনি নির্গত হলো কণ্ঠনালী হতে। তূর্ণ গিয়ে বসলো মেয়েটির শিয়রে। দীঘল কালো কেশে হাত বুলাতে বুলাতে মোলায়েম স্বরে ডাকতে লাগলো,

” দুয়া! ওঠ। পড়তে বসতে হবে না? ”

” উম্! ”

ঘুমন্ত রমণী মাথায় আদুরে স্পর্শ পেয়ে ডান কাত হয়ে শুলো। মুচকি হাসলো তূর্ণ। এ তো পুরো ঘুম পা’গলী! ঘুমালে দিনদুনিয়ার হুঁশ থাকে না।

” দুয়া! পড়তে বসতে হবে। উঠে পড় না পুতুল। ”

মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকে চলেছে তূর্ণ। হঠাৎ ঘটলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কাণ্ড! পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী ঘুমন্ত মেয়েটি সন্নিকটে থাকা মানুষটির কোলে মাথা এলিয়ে দিলো। দু হাতে আলিঙ্গন করলো কটিদেশ। মুখ গুঁজে দিলো উদরে। শিউরে উঠলো তূর্ণ! হৃদয়ে লুকানো ললনার এতখানি ঘনিষ্ঠতা হৃৎপিণ্ডে তুফান সৃষ্টি করলো। জাগ্রত হলো প্রেমপূর্ণ পৌরুষ চিত্ত। একটুখানি ছুঁয়ে দেয়ার, স্বল্প আদরে সিক্ত করার বাসনা তনুমনে ঝঙ্কার সৃষ্টি করছে। মেয়েটি কি পা’গল? স্বেচ্ছায় তার লুকানো অনুরক্তি জাগ্রত করে তুলছে! সে যদি একবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় তবে মেয়েটি পারবে কি তাকে সামলাতে! বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো তূর্ণ। মেয়েটির কেশের ভাঁজে আঙ্গুল গলিয়ে ললাটে অধর স্পর্শ করলো। কর্ণ কুহরে অধর ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

” বিবিজান উঠবেন না? এভাবে আমার কোলে মুখ লুকিয়ে আর কত দিশেহারা করবেন আমায়? এবার তো উঠুন। ”

কর্ণ কুহরে পৌঁছে গেল পুরুষালি কণ্ঠস্বর। মস্তিষ্ক সচল হতে লাগলো। আস্তে ধীরে নেত্রপল্লব মেলে তাকালো মেয়েটি। চোখ মেলেই সর্বপ্রথম দর্শন মিললো হৃদয়ে চুপিসারে ঠাঁই নেয়া মানুষটির। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। হলো কত অব্যক্ত আলাপণ! অতি মিষ্টি হাসি উপহার দিলো মেয়েটি।

” উঠবেন না? ”

ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসলো মানুষটি। তাতে আরো মোহিত হলো দুয়া। বিমুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। অবলোকন করতে লাগলো অধর কোণে লেপ্টে থাকা হাসিটুকু। ধুকপুক ধুকপুক করে চলেছে বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি। সে ধুকপুকানি মানুষটির কর্ণগোচর না হয়ে যায়! ভাবতেই দৃষ্টি নত করে নিলো দুয়া। তূর্ণ মুচকি হেসে বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে দিতে লাগলো চিবুকে। সে ছোঁয়ায় শিহরিত হয়ে মেয়েটি তড়িৎ সরে গেল। মাথা ঠেকলো বালিশে। এতক্ষণে হুঁশ ফিরল তার! সে এতক্ষন কই ছিল তাহলে? একবার তূর্ণ আরেকবার বালিশে তাকালো দুয়া। সবটা বোধগম্য হতেই লালিমায় আচ্ছাদিত হলো মুখশ্রী। লজ্জা কি লজ্জা! ইশ্! তৎক্ষণাৎ বালিশে লজ্জা মাখা মুখখানি লুকিয়ে ফেললো দুয়া। কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালো মানুষটির অট্টহাসি।

স্টাডি টেবিলে পাশাপাশি বসে পড়াশোনায় মগ্ন দুয়া এবং তৃষা। দু’জনেই পড়তে পড়তে একপ্রকার শহীদ হয়ে যাচ্ছে। তখনই ট্রে হাতে কক্ষে প্রবেশ করলেন তাসলিমা। ওদের পড়তে দেখে সন্তুষ্ট হলেন। টেবিলের ওপর ট্রে রাখতেই তাকে লক্ষ্য করলো ওরা দু’জনে। দুয়া মুচকি হাসলো।

” মামণি! কি খবর তোমার? ”

” আমি তো আলহামদুলিল্লাহ্ বেশ আছি। তোদের কি খবর বল? কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। প্রিপারেশন কেমন? ”

দুয়া কিছু বলার আগেই তৃষা উত্তর দিলো,

” একদম ফাটাফাটি আম্মু। ”

” বেশি ফাটাফাটি হলে তো সমস্যা। রুমের দেয়াল খসে পড়বে‌। ”

মায়ের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না তৃষা। তবে দুয়া সশব্দে হেসে উঠলো। তাসলিমা এবার ওদের দু’জনের দিকে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,

” নে দুধটা খেয়ে নে। তারপর মন দিয়ে পড়। ”

দুয়া চোখমুখ কুঁচকে বললো,

” মামণি! আমরা কি ছোট বাচ্চা? পরীক্ষার আগে রোজ রোজ দুখ খাওয়াচ্ছো‌। ইশ্ ভাল্লাগে না। ”

” তা লাগবে কেন? এখন যদি কেএফসি থেকে ফাস্টফুড এনে দিতাম ঠিক খেতি। ”

তৃষা লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

” কেন খাবো না? নিশ্চয়ই খাবো। এত টাকা খরচ করে আনবে, অপচয় করবো কেন? ও আম্মু কেএফসি থেকে অর্ডার দাও না। ”

তৃষার অনুরোধ উপেক্ষা করে তাসলিমা ওদের হাতে দুধের গ্লাস ধরিয়ে দিলেন।

” ওসব বাজে জিনিস বাদ দিয়ে দুখ খা। শরীরে পুষ্টি হবে। ওসব খেলে টাকার টাকা তো যাবেই। সাথে পরীক্ষার হলে গিয়ে ডিসেন্ট্রি হবে। ”

” ইয়াক। ” চোখমুখ কুঁচকে ফেললো তৃষা।

দুয়া দুধের গ্লাসে করুণ চোখে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে তিন ঢোকে পান করে নিলো। তাসলিমা মেয়ের পিঠে চাপড় মে রে বললেন,

” তুই খাচ্ছিস না কেন? খা। ”

” ধুৎ! ভাল্লাগে না। ”

একাকী ফটরফটর করে তৃষাও দুখ পান করলো। তাসলিমা ট্রেতে গ্লাস রেখে ওদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অতঃপর প্রস্থান করলেন কক্ষ হতে। দু’জনে পুনরায় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলো।

ফজরের সালাত আদায় করে দুয়া সে-ই যে বই নিয়ে মগ্ন! দিনদুনিয়ার হুঁশ নেই। ঘন্টাখানেক বাদেই পরীক্ষা। চিন্তায় হাত-পা অবশ প্রায়। সকালের ব্রেকফাস্ট অবধি করেনি। হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে রিভিশন দিয়ে চলেছে। সে মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো স্বামী মহাশয়। হাতে খাবারের ট্রে। গিয়ে বসলো দুয়া’র বিপরীতে। দুয়া তাকে খেয়াল অবধি করেনি। তূর্ণ বিছানায় ট্রে রাখতে রাখতে বললো,

” এই যে ম্যাডাম! ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হতে চলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা হবে। তাই বলে নাওয়াখাওয়া ভুলে যাবেন? ”

চোখ তুলে তাকালো দুয়া। পুনরায় বইয়ে মুখ গুঁজে মৃদু স্বরে বললো,

” খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবারগুলো নিয়ে যাও। ”

” বললেই হলো খিদে নেই? এরপর এক্সাম হল এ অনাহারে অজ্ঞান হয়ে যাবি। সেটা বুঝি ভালো হবে? ”

দুয়া ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

” সত্যি বলছি খেতে ইচ্ছে করছে না। ”

তূর্ণ কড়া কণ্ঠে বললো,

” একদম ঢঙ করবি না বলে রাখলাম। হা কর। নইলে পরীক্ষা ক্যান্সেল। ”

তূর্ণ’র হাতে রুটির টুকরো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হা করলো দুয়া। ওর মুখে সবজি ভর্তি রুটির টুকরো পুরে দিলো তূর্ণ। আরেক টুকরো রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললো,

” ইম্পর্ট্যান্ট টপিকস পড়েছিস তো? কিছু বাদ দিস না। ”

” পড়েছি। একটু ভালো করে দোয়া করো ঠিক আছে? খুব চিন্তা হচ্ছে। ”

তূর্ণ নরম স্বরে বললো,

” চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ্ পরীক্ষা ভালো হবে। ”

দুয়া মুচকি হাসলো। তূর্ণ দ্রুত গতিতে ওকে খাইয়ে দিলো। দুয়া গ্লাস হাতে নিয়ে পানি পান করলো। খাওয়া শেষে তূর্ণ রুমাল দিয়ে মেয়েটির সিক্ত মুখ মুছে দিলো। অতঃপর ট্রে হাতে উঠে দাঁড়ালো।

” তাড়াতাড়ি রিভিশন দিয়ে রেডি হতে শুরু কর। আমি দেখে আসি বি*চ্ছুটা কি করছে। ”

তূর্ণ কক্ষ হতে প্রস্থান করলো। উদ্দেশ্য বোনের অবস্থা দেখে আসা।

ভার্সিটি প্রাঙ্গনে এসে থামলো শুভ্র রঙা গাড়িটি। পেছনের ডোর খুলে বেরিয়ে এলো তৃষা।

” ভাইয়া। আমার প্রিয় ভাইয়া। খাস দিলে দোয়া করো। ঠিক আছে? পরীক্ষা শেষে বেঁচে ফিরলে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ্। ”

কথা শেষ হতেই এক বান্ধবীকে দেখে তার দিকে ছুটলো তৃষা। গাড়িতে পাশাপাশি বসে থাকা তূর্ণ এবং দুয়া তা দেখে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে দুয়া তাকালো ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা অর্ধাঙ্গের পানে।

” আসছি তাহলে? আর হ্যাঁ। আমাদের জন্য খাস দিলে দোয়া করবেন মাস্টার মশাই। ”

তূর্ণ মুচকি হেসে ওর পানে ঝুঁকে এলো। আকস্মিক কাণ্ডে মেয়েটির মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো। সিটের সঙ্গে একদম মিশে গেল কোমল কায়া। অতি সন্নিকটে এসে থামলো তূর্ণ। মিলিত হলো দু জোড়া নয়ন। নয়নে নয়ন মিলিয়ে অর্ধাঙ্গিনীর সিট বেল্ট খুলতে লাগলো মানুষটি। বেশ সময় নিয়ে খুললো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো দুয়া। তার দুষ্টু মন কিসব ভাবছিল! ছিঃ! কিন্তু আহা আহা! তার ভাবনা ঠিক সঠিক হলো। দু ভ্রুয়ের সন্ধিস্থলে অধরের পবিত্র ছোঁয়া অঙ্কন করে দিলো তূর্ণ। আঁখিপল্লব বন্ধ করে সে পবিত্র ছোঁয়াটুকু অনুধাবন করলো দুয়া। চোখ মেলে তাকাতেই নয়ন সন্ধি হলো। মানুষটি ওর বাঁ কপোলে আলতো করে হাত রাখলো। মোলায়েম স্বরে বললো,

” ভালোমতো পরীক্ষা দিয়ো। একদম দুশ্চিন্তা করবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে কোয়েশ্চেনস্ সলভ্ করবে। যেটা ভালো পারবে সেটা আগে দিবে। যেটায় সমস্যা ওটা নিয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করবে না। ঠিক আছে? ”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মেয়েটি। তূর্ণ এমন করে ওকে পরামর্শ দিচ্ছে যেন তার অর্ধাঙ্গী কোন শিশু। বুঝদার নয়। তাই তো এত পরামর্শ! দুয়া এসব ভেবেই মুচকি হেসে দিলো। তখন তূর্ণও মুচকি হেসে দুয়া’র ফোলা ফোলা গাল টিপে দিলো।

” যাও। আল্লাহ্ হা’ফিজ ”

” আল্লাহ্ হা’ফিজ। ”

মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো দুয়া। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো। গাড়িতে থাকা মানুষটিও বিপরীতে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। দুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্রষ্টার নাম স্মরণ করতে করতে ভার্সিটিতে প্রবেশ করলো। কিছুদূর এগিয়ে আরেকবার পিছু ঘুরে তাকালো। চোখের ইশারায় যেতে বললো মানুষটি। দুয়া মুচকি হেসে প্রস্থান করলো। তূর্ণ তপ্ত শ্বাস ফেলে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো পার্কিং লটের দিকে।

প্রথম পরীক্ষা শেষ। ওপর ওয়ালার শুকরিয়া আদায় করতে করতে ফুরফুরে মেজাজে ভার্সিটি প্রাঙ্গনে হাজির হলো তৃষা। আশেপাশে তাকিয়ে বন্ধুদের খোঁজ করে চলেছে। গেল কোথায় সব? পরীক্ষা শেষে গেল কোথায়? তৃষা যখন খোঁজাখুঁজিতে মগ্ন ঠিক তখনই তার সম্মুখে হাজির হলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক ব্যক্তি! তৃষার কণ্ঠনালী হতে বেরিয়ে এলো,

” আপনি! ”

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here