শুকনো বকুলের মালা গাঁথিব পর্ব -০১

প্রথম স্ত্রীর লা’শ ঘরের সামনে রাখা এখনো দাফন করা হয়নি এর মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে বাড়ির আঙিনায় পা রাখল রশিদ সিকদার।

তার প্রথম স্ত্রী জায়েদা বেগম আজ সকালে মা’রা গেছেন। মাস কয়েক আগে হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়ায় হসপিটাল নিলে ডক্টর জানায় তিনি স্ট্রো’ক করেছিলেন। জ্ঞান ফিরে আসলেও তিনি প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন যাবত অসুস্থ ফিল করায় তাকে হসপিটালাইজড করদ হয়। কিন্তু তিনি আর সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন নি। তার মৃ’ত দেহ নিয়ে আসা হয়েছে। সারা বাড়ি মানুষ গিজগিজ করছে। জায়েদা বেগম ছিলেন বেশ মিশুক স্বভাবের মানুষ। তাই আশপাশে অনেক মানুষের সাথেই তার বেশ ভাব ছিল। আজ জায়েদা বেগমের মৃ’ত্যুর খবর শুনে কেউই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। ছুটে এসেছে একবার দেখার জন্য। কিন্তু রশিদ সাহেবের এমন কাজে সবাই যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। জায়েদা বেগম কোনদিন কারো কাছে তার স্বামীর ব্যাপারে খারাপ মন্তব্য করেন নি বরং সব সময় তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিন্তু রশিদ সাহেব সেই ভালোর এই প্রতিদান দিল।

সবাই রশিদকে নিয়ে সমালোচনায় মত্ত হলো। এ বাড়িতে যে এখনো অনেক কাজ বাকি পরে রয়েছে একটি মৃ’ত ব্যাক্তিকে দাফন কাফন করাতে হবে তা যেন ভুলেই বসল সবাই। এতক্ষণ যাবত দাতে দাত চেপে এতক্ষণ এসব সহ্য করছিলেন রশিদের বড় ভাই রায়হান সাহেব। আর সহ্য করতে না পেরে সামনে এগিয়ে আসলেন। রশিদ মিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন

– এসবের মানে কি রশিদ। আমরা যে একটা সমাজে বাস করি এটা কি তুই ভুলে গেছিস। কীভাবে একটা মেয়েকে আজই এই বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিস। তোর কি জায়েদার জন্য একটুও কষ্ট হচ্ছে না।

– দেখেন ভাইজান যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। জায়েদা চলে গেছে ওর জন্য দুঃখ করে কি হবে। আর এ হচ্ছে ঝর্না। ও আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। ওকে আমি আজকে বিয়ে করিনি। অনেক দিন আগেই করেছি। শুধু ওই মহিলা বেচে ছিল বলে এই বাড়িতে আনতে পারি নি।

রায়হান সাহেব এবার ছোট ভাইয়ের দুই গালে দুটো চ’ড় বসিয়ে দিলেন।

– ভাইজান তুমি আমার গায়ে হাত তুললা। এটা তুমি করতে পারলা।

– এই চড় আরো আগেই দেয়া উচিত ছিল। তুই জায়েদার জীবন এভাবে নষ্ট করছিস
। ছিঃ তোকে ভাই বলতেও তো আমার ঘৃণা লাগতেছে। জায়েদা কত ভালো একটা মেয়ে ছিল। নিজের ভাইয়ের জায়গায় আমাকে বসিয়েছে আর ও যে ওর স্বামীর দ্বারাই এত কষ্টে ছিল একটা বার বুজি নাই। তাইলে এই চড় তোকে আগেই মা’রতাম

– কে বলছে নষ্ট করেছি। ও বেচে থাকতে ওর ভাত কাপড় কোন কিছুতে কষ্ট দিছি আমি। দেই নাই। বিশ্বাস না হলে জিগেস করে ওকে।

– গাধা ও কীভাবে বলবে। কি ড্রামা শুরু করছিস৷ বেরিয়ে যা এই বাসা থেকে।

– কেন বের হবো। বলো আমারে। এ বাড়ি কি তোমার একার। এটা আমার ও বাবার বাড়ি। এইখানে যতটুক তোমার অধিকার ততটুক আমারও। আর কথা বাড়াইও না ভিতরে যেতে দাও।

রায়হান সাহেব এর মাথা এবার চরম লেভেলের খারাপ হয়। যেই ছোট ভাইরে এত আদর কইরা ভালোবাসা দিয়া বড় করছে সে আজ মুখে মুখে তর্ক করে। তাই রা’গের বসে উল্টা পাল্টা থাপড়ানে শুরু করে রশিদকে।

যারা এসেছিল তারা দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফ্রিতে ড্রামা দেখতেছিল কেউ আগাইয়া আসে নাই। রশিদ বড় ভাইয়ের সম্মান এতটুকু রাখছে যে উল্টো বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তোলে নাই।

হঠাৎ নিজের পায়ের কাছে ভারী কিছু পড়ল মনে হলো রায়হান সাহেবের। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার পা জড়িয়ে বসে আছে ভাতিজি নুর।

– কিরে মা তুই নিচে বসে পড়লি কেন?

– চাচ্চু তুমি আর আব্বুকে মে’রো না।

– মা ও যা করেছে তাতে কি ভালো ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য?

– চাচ্চু ভুল তো মানুষই করে। আব্বুও করে ফেলেছে।

– তুমি কীভাবে মানবে

– ধরে নাও এটাই আমার নিয়তি। যে সময় বাবাকে আমার সবচেয়ে বেশি দরকার সেই মুহুর্তে বাবা আমাকে পর করে দিয়ে অন্য কাউকে আপনজন ভেবে সুখে থাকার প্রয়াস চালাচ্ছে। চাচ্চু মা তো তার সাথে আমাকে নিয়ে গেলেও পারত। এই দুনিয়া বড় কঠিন চাচ্চু। আমিও মায়ের সাথে চলে যেতাম তাহলে বাবা হয়ত খুশি হতো।

যে মেয়েটা কয়দিন আগেও ফোন দিয়ে বলত চাচ্চু বাসায় আসলে আইসক্রিম নিয়া আসবা এরা আনবা ওটা আনবা। বাচ্চাদের মতো বায়না করত সেই মেয়ে কয়েক মুহুর্তের মাঝে কেমন বড়দের মত কথা বলা শুরু করেছে। পরিস্থিতি মাঝে মাঝে মানুষকে বদলে দেয়।

রায়হান সাহেব দুহাতে নুরের কাধ ধরে উঠালেন। মাথায় হাত বুলালেন। নুর চাচ্চুর গলা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

মেয়ের এরকম কান্না দেখে রশিদ সাহেবের মন হয়ত একটু গলল৷ এগিয়ে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখতে নিলে মেয়ে তার হাত মাথা থেকে সরিয়ে দিল।

– আমি ভালো আছি বাবা তেমাকে চিন্তা করতে হবে না।

রায়হান সাহেব নুরকে সেখান থেকে নিয়ে ভিতরে আসলেন। এসে ফ্যান ছেড়ে বসিয়ে দিলেন। এক গ্লাস পানি সামনে ধরে বললেন শান্ত হও মা।

নুর কোনো মতেই শান্ত হতে পারছিল না। মাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার বেদনা বাবার এমন নিকৃষ্ট কাজ নুরকে যেন ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। থেমে থেমে হিচকি উঠছে শুধু। চারদিক থেকে মানুষ এসে এর মধ্যে এই রুম ঘিরে ফেলেছে। সবার কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে নুর। নুর কাঁদছে সবাই দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে। মৃ’ত বাড়িতে তো কত মানুষ আসে। যারা আপনজন হারায় তারা বুক ফাটিয়ে কাঁদে। বাহিরের যারা আসে তারা দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেই কান্না দেখে কিন্তু যে আপনজন হারিয়েছে তার বুক যে কতটা পুড়ছে সেটা কেউ বুজতে পারেনা।

বাহিরে প্রচন্ড গরম আর এত মানুষের ভীরে তা ঢ়েন আরো বাড়ছে। সহ্য করতে না পেরে হাসফা’স করছে নুর। স্কিনে র্যাশ বেরিয়ে কেমন লাল হয়ে যাচ্ছিল। রায়হান সাহেব খেয়াল করতেই গলা উচিয়ে তার স্ত্রী খালিদা বেগমকে ডাকলেন। ডাক শুনে সাথে সাথে ছুটে আসলেন খালিদা।

– কি হলো ডাকলেন যে।

– দেখো মেয়েটা কেমন হাসফা’স করতেছে।

নুরের দিকে তাকিয়ে চমকে যায় খালিদা বেগম ও। তারপর বলে ওঠে

– মেয়েটা এই গরম, এত প্রেশার সহ্য করতে পারতেছে না।

– সহ্য করবে কি করে। জায়েদা যে ওকে পুতুলের মতো হাতে করে করে বড় করেছে। কষ্ট কাকে বলে বুজতেই দেয় নি। হয়েছেও পুতুলের মতো। একটু ছুলেই যেন রক্ত বেরিয়ে যাবে। ইয়া আল্লাহ এই মেয়ের উপর রহম করো একটু। ওকে আর কষ্ট দিও না আল্লাহ।

– ও আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। ওকে একটু নিরিবিলি জায়গায় রাখা দরকার। সবাইকে একটু বাহিরে যেতে বলেন।

– আচ্ছা আচ্ছা।

আস্তে আস্তে সবাই রুম ছেড়ে বাহিরে আসে। খালিদা বেগম একটা টাওয়াল ভিজিয়ে তা দিয়ে মুখ হাত পা মুছিয়ে দেয় নুরের। নুর মাকে দেখার জন্য বললে খালিদা নিজে নুরকে ওর মাকে দেখানোর জন্য নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে মায়ের বুকের উপর লুটিয়ে পড়ে নুর। মায়ের কাছে যত অভিযোগ আছে বলতে থাকে। বারবার একটা কথাই উচ্চারণ করে – মা তুমি কেন নিয়ে গেলেনা আমায়।

খালিদা বেগম অনেক কষ্টে নুরকে সেখান থেকে নিয়ে আসেন। রুমে বসিয়ে দিয়ে এক গ্লাস জুস আনেন ওর জন্য। নুর খেতে চায় না তাও জোড় করে মুখে দেন খালিদা বেগম। জুসটা খাওয়ার পর নুরের কেমন যেন ফিল হয়। মনে হচ্ছে চোখ আর খুলে রাখতে পারতেছে না। অনেক কষ্টেও চোখ খুলে রাখতে পারতেছে না। চাচিকে বলে

– বড়মা এটা কি দিলা তুমি আমাকে। মনে হচ্ছে চোখ টেনেও খুলতে পারছি না। আচ্ছা আমিকি মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে মা আমার কথা শুনেছে তাইত তার সাথে নিয়ে যাচ্ছে। জানো বড়মা মা আমাকে অনেক ভালোবাসত আমার সব কথা শুনত তাইত এখনও ফেলতে পরে নি। বড়মা তোমার জুসটা অনেক মজা ছিল। এটা খেয়েছি বলেই মা আমার কথা শুনল।

আর বলতে পারে না নুর। লুটিয়ে পড়ে বেডের উপরে।

#চলবে
#শুকনো_বকুলের_মালা_গাঁথিব
#সূচনা_পর্ব
#নীহারিকা_নুর

[আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছেন সবাই।অনেক দিন পর আবার একটু লিখলাম। কি লিখেছি নিজেও জানিনা। ভালো বা খারাপ যাই হোক কমেন্ট এ জানাবেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here