তিক্ত বুকের বাঁ-পাশ পর্ব -১৬

#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_১৬(অপ্রাপ্তি)

নিঝুম রাতে শহরের অলিগলিতে প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ানোর সখ তো প্রতিটা মানুষেরই হয়। তোহাও তার ব্যাতিক্রম নয়। বরং সে কল্পনায় বহুবার আঁকড়ে ধরে প্রিয় সেই মানুষটার বাহু। একটু বেশীই জোরেশোরে আঁকড়ে ধরে, যদি হারিয়ে যায়! সেই ভয়েই বোধহয়। জানালা ভেদ করে ঠাণ্ডা বাতাস হু হু করে রূমে প্রবেশ করছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রন করা রুমের ভেতরের পরিবেশ ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তবুও ভালো লাগছে তোহার। খোলা জানালা থেকে আসা ফুরফুরে বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

রাতের দার্জিলিং এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে বেরিয়ে পড়ে তোহা। নম্রমিতা আর রাফিদ তাদের মতো করে ব্যাস্ত। তাই এই মূহুর্তে তাদেরকে বিরক্ত না করে, কাউকে না জানিয়েই বেরিয়ে পড়ে তোহা। জাকজমকপূর্ন হোটেলের চারপাশটা ঘুরছে সে। আশেপাশে ঠান্ডার ফলে মানুষজন কম। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে হোটেলের পিছনের দিকে নির্জন রাস্তায় চলে আসে তার জানা নেই। এদিকটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলেও বাকি জায়গার তুলনায় বেশ নিরিবিলি আর আবছায়া। বেশ কিছুটা দূরত্বে দূরত্বে হলদেটে আলো জ্বলছে। জায়গাটা দেখে বাগানের মতো মনে হলেও আদতে তা না। ছোটো বড়ো বেশ কিছু গাছ গাছালি রয়েছে। শীতের ফলে জ্যাকেটটা আরো খানিকটা গায়ের সাথে জড়িয়ে নিয়ে তোহা পা বাড়ায় সামনের দিকে।

বেশ খানিকটা দূরে দুইজনকে বসে থাকতে দেখে ভরসা পায় তোহা। ভয় কেটে যায় খানিকটা। শীতের ফলে দুজনেই জ্যাকেট পরে বসে আছে গুটিশুটি হয়ে। একজন মেয়ে আর একজনকে দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা। খানিকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ায় মেয়েটার মুখও বোঝা যাচ্ছেনা ঠিকভাবে। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ায় দুজনে। খানিকটা দূরত্ব আর অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ায় ঘটনা ঠিক বুঝতে পারছেনা তোহা। তবে দুজনে কিছু সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে তা তাদের ভাব ভঙ্গিমায় স্পষ্ট।

*****************************
ঠকঠক করে দরজার শব্দে বুক কেঁপে ওঠে নম্রমিতার। সে জানে আগত ব্যাক্তিটা কে হতে পারে। তবুও কেমন কেনো এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির দোলাচল দেহ মন জুড়ে। লক করা না থাকায় দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে রাফিদ। কোনদিকে না তাকিয়েই আগে লক করে দরজা। অতঃপর ফিরে তাকায় সামনের দিকে। বুক ধুকপুক করছিল তার। নব্য এক অনুভূতিতে শিরশিরিয়ে উঠছে শিরদাঁড়া। কালো শাড়ি, লাল পাড়, চুলগুলো খোপা করে বাঁধা। উল্টো দিকে মুখ করে দাড়ানোর ফলে উন্মুক্ত পিঠ দৃশ্যমান রাফিদের চোখের সামনে। কালো পোশাকের মাঝে ফর্সা ত্বক যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। নেশা লেগে যাচ্ছে রাফিদের। অদৃশ্য কোনো এক টানে সে এগিয়ে যাচ্ছে নম্রমিতার দিকে।

রুমের আনাচে কানাচে লাগানো সুগন্ধি মোমবাতির আলোয় একে একে চিরকুটগুলো খুলে পড়া শুরু করে নম্রমিতা। প্রতিটা বেলুন হতে ঝোলানো ফিতের সাথে লাগানো চিরকুটগুলো খুলে একে একে পড়ছে সে। এরপর জমা করছে হাতের মাঝে।

“শুন্য হাতে এসেছি দ্বারে, করুণা করে হলেও দাওগো পিরিতি এ খরখরা মরুভূমিতে।”

“ওগো বিনাশীনি, কাঁপেনা তোমার ওষ্ঠ! যখন ঘুমে মাতাল তাকে আলিঙ্গনে চুমে নাও!”

প্রতিটা চিরকুট যেনো অনুভূতির রঙে ঠাসা। লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছে নম্রমিতা। শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি তুঙ্গে তুলে দিতেই বোধহয় আগমন ঘটে রাফিদের। উন্মুক্ত পিঠে অগণিত অধরের স্পর্শ এঁকে নাক ঘষে রাফিদ। কেঁপে ওঠে নম্রমিতা। অতঃপর দুইহাতের বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ করে পবিত্র নিখাদ ভালোবাসার পরশে ডুবিয়ে রাখে প্রিয়তমাকে।

“অলকানন্দা, কী নেশায় জড়ালে! মাধুরী মিশায়ে ডাকিছো তুমি নব্য ছন্দ তালে। এসে তো দেখো, তব তরে সাজানো রয়েছে মোর ফুলের গালিচা।”

**************************

কাছাকাছি যেতেই বিস্ময়ে হতবাক তোহা। নিজের চোখকে কোনমতে বিশ্বাস হচ্ছেনা তার। মন বলছে সে স্বপ্ন দেখছে। রনক, তার চোখের সামনে রনক! এতোগুলো দিন পর চোখের সামনে রনককে দেখে রীতিমত হাত পা কাঁপছে তার। মুখ থেকে কোনো শব্দ উচ্চারণ করাও দায় হয়ে পড়েছে। অনুভূতির আন্দোলনে বিবশ মনের অবশ ভাবকে দূরে ঠেলে দৌড়ে গিয়ে রনকের গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ে তোহা। শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দুইহাতে আঁকড়ে ধরে তাকে। আকস্মিক আক্রমনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় রনক। ব্যালেন্স দিতে গিয়ে আঁকড়ে ধরে তোহার কোমর।

অনবরত কেঁদে চলেছে তোহা। দুইহাতে শার্টের কলার খামচে ধরে নিরলস ভঙ্গিতে কেঁদে চলেছে সে। রনক তার সাথে থাকা মেয়েটাকে যাওয়ার জন্য ইশারা করতেই, মনে একরাশ বিস্ময় নিয়েই সেখান থেকে বিদায় নেয় সে। কিছু সময় অতিবাহিত হয় নীরবে। তোহার নাক টেনে টেনে কান্না আর রনকের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষন পর কান্না থেমে আসে তোহার। নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায়। রনককে ছেড়ে নীচে নামার জন্য উদ্যত হলে কোমরে রাখা হাত আলগা করে দেয় রনক। এতক্ষন সে রনকের গলা ধরে ঝুলছিলো, ভাবতেই লজ্জায় নুইয়ে যায় তোহা। রনক সন্ধিহান চোখে তাকায় তোহার দিকে। আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে ভালো করে। আগের চেয়ে অনেকটা শুকিয়ে গেছে তোহা। চোখের নিচের কালশিটে ভাবটাও বড্ডো বেমানান লাগছে হলদে আলোর মাঝে। চোখে মুখে নেই সেই আগের প্রফুল্লতা। তবে কি খারাপ কিছু ঘটেছে তোহার সাথে! রুহেল কী কোনোভাবে তোহাকে শুধুমাত্র ইউজ করেছে! সে কী ভালোবাসে না আদৌ!

“কেমন আছো?”

লজ্জার ঝুলি দূরে সরিয়ে নতজানু শিরে প্রশ্ন করে তোহা। রনক চমকায় আরও একবার। আছো! তোহা তাকে তুমি করে ডাকছে!

“স্যারকে তুমি করে ডাকছো! এ আমুল পরিবর্তন কিসের জন্য শুনি!”

“তুমি করেই ডাকবো, কোনো সমস্যা?”

“অবশ্যই সমস্যা। একশ বার সমস্যা। স্টুডেন্ট স্যারকে তুমি করে বললে কেমন যেনো দেখায় না?”

রাগে গর্জে ওঠে তোহা। একহাতে শার্টের কলার ধরে জোর গলায় জবাব দেয়,

“মানিনা আমি তোমাকে স্যার। বুঝেছ! আমি তোমাকে স্যার মানতে পারবো না।”

“তোহা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এবার!”

“আচ্ছা সরি। মেয়েটা কে ছিলো? ওয়াইফ!”

তোহার মলিন কণ্ঠ শুনে ভেতরে ভেতরে চমকালেও তা প্রকাশ করেনা রনক। ভাবভঙ্গি আগের মতোই গম্ভীর রেখে বলে,

“ভীষণ আপন কেউ। খুবই কাছের আমার সেই মানুষটা।”

কান্না পায় তোহার। এতগুলো মাসের অপেক্ষা বৃথা মনে হয়। কার জন্য অপেক্ষা করেছে সে! যার মনে অন্য কারোর ঠাঁই, তার জন্য! কাকে ভেবে নিত্যনতুন স্বপ্ন সাজিয়েছে সে! যার স্বপ্নের রানী অন্য কেউ! বিষাদের সেই বিস্বাদ হওয়া দিনগুলো যার নামে গুছিয়েছিল তার মনে যে অন্য কারোর বসবাস। সাজানো তার স্বপ্নের সংসার এক লহমায় ভেঙে যেনো চুরমার হয়ে গেলো। একটু একটু করে জমানো অনুভূতিগুলো তাসের ঘরের মতো একটা টোকায় ছন্নছাড়া হয়ে গেলো। কষ্ট হচ্ছে তার। বাজে রকম কষ্ট। এতোটা কষ্ট সে আজ অবদি কখনও পায়নি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড়ো হওয়াটা বড্ডো ভুল হয়েছে তার। বাবা মা আর ভাইয়ের ছত্রতলে আদরে বড়ো হওয়াটা আজ সচেয়ে বেশি দোষের লাগছে তার কাছে। সেও যদি আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ের মতো কষ্টে বড়ো হতো, তবে বোধহয় ভালো হতো! অন্তত কষ্ট সয়ে নেওয়া তো শিখতো! শিখতো হাজারো অপ্রাপ্তি নিয়েও বেঁচে থাকতে হয়। বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পছন্দের মানুষকে ভুলে যাওয়া শিখতো। কষ্টগুলো গিলে ফেলে সম্মুখে হাসিমাখা মুখে থাকার সুন্দর এক অভ্যাস তার হতো। কেনো হলোনা এতকিছু! কেনো তাকে এতো মাথায় করে রেখেছিল এতদিন সবাই! কেনো কষ্ট জিনিসটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়নি সে! কেনো কেনো কেনো! আজ যে সে সহ্য করতে পারছেনা একদম। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে ভিতরটা। এই দুনিয়াটাকে বড্ডো বেশিই নিষ্ঠুর লাগছে তার। নিঃশ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে! নিষ্ঠুর এই দুনিয়ার মাঝে তার মতো নগণ্য মানুষ মারা গেলে কী খুব ক্ষতি হবে? খুব কী ক্ষতি হবে যদি সে এখনই মারা যায়! আচ্ছা বাবা, মা, ভাইয়া কী খুব বেশীই কষ্ট পাবেন! আর রনক, তার কী আদৌ কিছু যায় আসবে? নাহ আসবে না। সে তো কখনো ভালোবাসেনি তাকে। শুধু করুণা করেছে। আচ্ছা সে বেঁচে থাকলে কি সহ্য করতে পারবে চোখের সামনে প্রিয় মানুষের হাতের ভাঁজে অন্য কারোর ভাঁজ! পারবে সহ্য করতে প্রিয় মানুষটা অন্য কারোর দৃষ্টির মোহে মাতোয়ারা! তাদের দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটিময় প্রেম সহ্য করতে পারবে তো সে! নাহ পারবে না। তার চেয়ে বরং এখনই তার কিছু একটা হয়ে যাক। এতো এতো অপ্রাপ্তির মাঝে কিভাবে বাঁচবে সে! রনকের তো কোনো দোষ নেই। ভালো তো সে একাই বেসেছিলো। তাই কষ্টটাও তার একারই প্রাপ্য।

#চলবে!

অনেকে অভিযোগ করেছেন, এতো ছোট করে কেনো পর্ব দিয়! আপনারা যে গল্পটা দুইমিনিটে পড়ে শেষ করেন, সেটা লিখতে কিন্তু দুইঘন্টারও বেশি সময় লাগে। বাকি লেখিকাদের কথা জানিনা, তবে আমার পড়শোনার মাঝে এই সময়টা বের করতেও অনেক কষ্ট করতে হয়। আবার গল্প না লিখেও শান্তি পাইনা। তাই আমার অনুরোধ, যাদের কাছে গল্পটা অনেক ছোট ছোট মনে হচ্ছে, তারা একটু অপেক্ষা করুন। শেষ হলে নাহয় একসাথে পড়বেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here