#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_৩০
#মোহনা_হক
❝প্রেয়সী❞
আজকের লেখা চিঠি অন্য একটা জায়গায় লুকিয়ে যাবো। হয়তো কয়েক বছর পর ও খুঁজে পাবে না। আবার খুব সহজে খুঁজে পাবে। উহুম মোটেও কঠিন ভাষায় বলছি না। আমার সহজ সরল প্রেয়সীর জন্য চিঠিটা সহজ ভাষায় লিখা হয়েছে। তোমাকে যখন আমি ভালোবাসা শুরু করেছি, তখন তুমি নিতান্তই এক বাচ্চা মেয়ে ছিলে। আমার ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা হয়নি তোমার। তোমায় আমি পেয়েছি তোমার অসম্মতিতে। তখন তুমি আমায় ভালোবাসোনি। এটা বলার কারণ আমি তার আগ পর্যন্ত তোমার সাথে আমি আগে কখনো কথা বলিনি। হুট করে ভালোবাসাও সম্ভব নয়। তাই ধরে নিয়েছি তখন তোমার সম্মতি ছিলো না। তোমার সাথে আমার জীবন জড়িয়ে যাওয়ার পর প্রতিমুহূর্তে চেষ্টা করেছি তুমি আমায় মেনে নাও। আমাদের বিয়েতে যেনো তোমার সম্মতি থাকে। শেষ পর্যন্ত তুমি মেনে নিয়েছো। আচ্ছা তোমার মনে আছে তোমাকে বিয়ের আগে একবার অধর ছুঁয়ে দিয়েছিলাম! বড্ড অনুশোচনা হয়েছিলো আমার। তুমি যখন আমায় জড়িয়ে ধরেছিলে আমি তোমার থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছিলাম। ওই যে সেদিন আমার অনুশোচনা হয়েছিলো! হয়তো আয়াজ আর রুয়াতের পথচলা দীর্ঘ হবে না। মাঝপথে থেমে যেতে পারে। জানো আমার শত্রুর অভাব নেই। আবার বন্ধুরও অভাব নেই। তবে দিনশেষে যে কেউ আমায় ভরসা দিবে, আমার সকল বিপদে পাশে থাকবে ওরকম একটা মানুষের অভাব। আমি যদি খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করি তাহলে তুমি কষ্ট পেও না। জানি কষ্ট পাবে, কাঁদবে পাগলামো করবে কিন্তু তুমিই একমাত্র তোমাকে স্ট্রং রাখতে পারবে। এমন মুহুর্ত যদি আসেও তাহলে নিজেকে স্ট্রং রাখবে। আমি যে পেশায় জড়িত সেখানে বন্ধুসুলভ শত্রু রয়েছে। আশাকরি তুমি বুঝেছো। কখনো আমার কথা মনে করে কাঁদবে না শুধু তোমার প্রতিটি মোনাজাতে আমায় রেখো যাতে পরকালে তোমার সাথে আমার দেখা হয়। আমার প্রেয়সী! প্রেয়সী বলে সম্মোধন করছি কেনো জানো? তুমি আমার শখের একজন। আমার ভালোবাসা। ভীষণ ভালোবাসি স্ত্রী। ভীষণ ভালোবাসি তোমায়। আমি চলে যাওয়ার পর আমার বাবা মা কে দেখে রেখো। তোমাকে বড্ড ভরসা করি। শুধু একটাই কথা ❝আয়াজ কে মনে রেখো সব সময়।❞ ভালোবাসি আমার প্রেয়সী।
~আয়াজ ত্বায়ীম চৌধুরী~
তিনমাসের অন্তঃসত্তা রুয়াত। আয়াজ মারা যাবার করেকদিন পর এমন সংবাদ শুনে। মোটেও খুশি হয়নি সে। আয়াজ বেঁচে থাকলে এমন একটা মিষ্টি সংবাদ শুনে কতোই না খুশি হতো। এমপি সাহেবের মুখটা দেখতে তখন কেমন হতো? চৌধুরী বাড়িও আগের মতো নেই। সারাক্ষণ নিরিবিলি হয়ে থাকে। মায়া চৌধুরী তেমন একটা কথা বলেন না কারো সাথে। ছেলের শোকে তিনি প্রায় পা’গ’ল হয়ে গিয়েছেন। পুরো বাড়িটা কে সামলে রেখেছে ইনিমা আর আরহাম। মনের ভিতর অনেক কষ্ট জমা। তাও সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের শক্ত রেখেছে। প্রতি রাতে রুয়াতের ঘর থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। সেগুলো মুখ বুজে সহ্য করে নেয় ইনিমা। এইতো এখন আয়াজের সন্তান তার গর্ভে বেড়ে ওঠছে। নিজের প্রতি খেয়াল রাখবে তা নয় নিজেকে প্রচুর অবহেলা করছে। হান্নান মজুমদার মেয়ের এমন কষ্ট সইতে না পেরে একবার স্ট্রোক করে। মেহরুবাও নিজেকে শক্ত রাখছে। রুয়াতের সামনে ভুলেও কাঁদে না। রুয়াতের এমন সুসংবাদে সবার মুখে শুধু দুঃখ ভেসে ছিলো।
আলমিরা থেকে আয়াজের পাঞ্জাবী বের করে গুছিয়ে রাখছে রুয়াত। এ কয়েক মাসে যে কতো বার আয়াজের পাঞ্জাবী গোছানো হয়েছে তার ঠিক নেই। কালো পাঞ্জাবীর মাঝে একটা চিঠি পায় রুয়াত। সেটাই পড়ছে সে। মনটা বিষিয়ে গেলো আবারও। চারদিক অস্থির লাগা শুরু করলো। আলমিরা থেকে আয়াজের সাদা পাঞ্জাবী, তার একটি হাস্যজ্জ্বল ছবি আর চিঠিটা ড্রায়ারের উপর রাখে। রাত হোক। সে আর আয়াজ নিস্তব্ধ রাতে গল্প করবে একা একা। আচমকা হেসে উঠে রুয়াত।
-‘রুয়াত রুমে আসবো?’
ইনিমার কথা শুনে রুয়াত সেদিকটায় চায়। মাথা নেড়ে বোঝায় বোন কে রুমে আসার জন্য। তার হাতে এক গ্লাস দুধ। রুয়াত মুখটা সরিয়ে নেয় তা দেখে। কঠোর স্বরে ইনিমা বলে-
-‘মুখ সরালে হবে না। খেতে হবে। ডাক্তার কি বলেছে? তোর শরীর দূর্বল তার জন্য শক্তি প্রয়োজন। এমনিও রক্ত নেই শরীরে। তোর বাচ্চাটার কি হবে ভেবেছিস একবারও? এখনো পৃথিবীতে আসেনি, এর আগে কতটা অবহেলা করছিস।’
-‘যার বাচ্চা সে নেই আজ। তার সন্তান কে কিভাবে যত্ন করবো? ওনি থাকলে আজ আমাদের পরিস্থিতি আরও সুন্দর হতো।’
মাথা নিচু করে নেয় ইনিমা। এজন্য রুয়াতের সামনে বেশিরভাগ সময় আসতে চায় না। তার সব কথার মাঝে আয়াজ বিদ্যমান। ইনিমা গ্লাসটা একটি জায়গায় রাখে। কান্নার কারণে মুখ দিয়ে শব্দ আসছে। মাথার ঘোমটা টেনে নেয় বড় করে। চোখের পানি টলমল করছে। কিন্তু এ পানি রুয়াত কে দেখানো যাবে না। দ্রুত স্থান ত্যাগ কতে সে।
নামাযের বিছানায় বসে হাউমাউ করে কাঁদছে রুয়াত। আয়াজের শূন্যতা পুড়িয়ে মারছে তাকে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গিয়েছে। ওয়াশরুম থেকে বমি করে এসেছে রুয়াত। দুপুরে খায়নি অথচ পেট থেকে অনেকখানি খাবার চলে গেলো। সে সকালের দুধের গ্লাস এখনো পড়ে আছে। খায়নি সে। এখন মাথা ঘুরাচ্ছে ভীষণ। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে জায়নামাযে বসে রুয়াত। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সূর্যাস্তের সময় এখন। ড্রয়ারের উপর থেকে রুয়াত আয়াজের পাঞ্জাবী, তার ছবি, আর চিঠিটা নিয়ে ছাদে আসে। ইনিমা খেয়াল করেছে রুয়াতের ছাদে ওঠা। সেও পিছন পিছন আসে।
আয়াজের মৃত্যুর পর রুয়াতের রঙিন জীবন নিমিষেই রঙহীন হয়ে যায়। এখনো পর্যন্ত রুয়াত তার ঝকঝকে কোনো পোষাক পড়েনি। এমনও দিন গিয়েছে স্বামীর জন্য কাঁদতে কাঁদতে মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়েছে। ছাদের একটি পাশে রুয়াত বসে পড়ে। আয়াজের চলে যাওয়ার পর আজ ছাদে উঠেছে। নিজের প্রতি অযত্ন করেছে খুব। এমন জীবদ্দশা থেকে মুক্তি পেতে চায়। প্রথমে যে লোকটা তার বিরক্তির কারণ ছিলো সে এখন লোকটার জন্য অনেক পাগলামো করেছে। যেনো তাকে একবার দেখলে অস্থির হৃদয় শান্ত হবে। চিঠি খুলেছে রুয়াত। প্রতিটি লাইন দু তিনবার করে পড়ছে। লিখাগুলো যেনো আজও জলজ্যান্ত। এর ভিতরে তার প্রেমিক পুরুষ লুকিয়ে আছে। এমন ভাবে চিঠিকে ধরে ধরে পড়ছে। অসংখ্য অশ্রু ঝরছে। সেগুলো তে মন নেই। তার শুষ্ক অধর বুলাচ্ছে লেখাগুলোর উপর। মাঝেমধ্যে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারপাশে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে আয়াজ বসে আছে তার পাশে। পা’গ’লের মতো আয়াজের লিখা চিঠি বুকে জড়িয়ে ধরছে। আবার সেখান থেকে সরিয়ে এনে দেখছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিচ্ছে। খুব মনে পড়ছে আয়াজ কে। কেনো এতো কষ্ট দিচ্ছে নিষ্পাপ মেয়েটা কে। দরজার আড়ালে ইনিমা দাঁড়িয়ে। বোনের এমন দৃশ্য সইতে পারছে না। আজ যদি আয়াজ বেঁচে থাকতো তাহলে সে পৃথিবীর যেখানটায় লুকিয়ে থাকুক না কেনো সেখান থেকে এনে রুয়াতের সামনে দাঁড় করাতো। ইনিমা রুয়াতের পাশে একটু বসলেই রুয়াত বলে ওঠে বিধবা মেয়ের পাশে বসতে নেই। তাদের পাশ দিয়ে হাঁটতে নেই। এসব কথা ইনিমা শুনতে পারে না। দূর থেকে রুয়াত কে দেখছে আর নিঃশব্দে কাঁদছে।
-‘জানেন এমপি সাহেব আপনি চলে যাওয়ার পর আমি একটুও ভালো নেই। আচ্ছা চলে গেলেন ঠিক আছে কেনো আমায় নিয়ে গেলেন না? আমি আর আপনি মা’রা যাবার পর ও একসাথে থাকতে পারতাম। এইযে আমায় গায়ের পোশাক দেখছেন না রঙচটা। আমার জীবনটাও এমন হয়ে গিয়েছে। আর কয়েকটা দিন আমার সাথে থেকে গেলে ভালো হতো। রাতে যখন একা ঘুমাই তখন আপনার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সে রাতগুলো। যেখানে আপনি মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন আমায় পেয়ে। আমি সে দিনগুলো ভুলতে পারছি না। আপনি কি দেখছেন না কিছু? ঠিকই তো একা একা চলে গেলেন আমায় ফেলে রেখে। আপনার প্রেয়সী কে ছাড়া থাকতে পারছেন? আমি কিন্তু মোটেও পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসে আমায়। কতো রাত কেঁদেছি আপনার জন্য। নিশ্চয়ই আপনি আমার এমন অবস্থা দেখে হাসছেন তাইনা! আপনার সন্তান আমার গর্ভে। কেনো যে সে এলো বলুন তো। তার জন্যও এখন স্বইচ্ছায় আপনার কাছে যেতে পারছি না। আমাদের একসাথে অনেকদূর পথ চলা বাকি ছিলো। মাঝপথে হাত ছেড়ে দিলেন? আপনার কষ্ট হয়নি আমাকে যে একা ফেলে রেখে চলে যাওয়াতে। কেনো আমার সাথে এমন হয়েছে? কতো ভালো জীবনযাপন করছিলাম আমরা। আপনি চলে যাবার পর আমার অনেক বার জ্বর হয়েছে কিন্তু আপনার মতো কেউ এতো সুন্দর করে যত্ন নেয়নি। আমায় খাইয়ে দেয়নি। যখন ভালোবাসা বুঝিনি তখন বিরক্ত লেগেছে আপনাকে আর ভালোবাসা বোঝার পরপরই চলে গিয়েছেন। রুয়াত এখনো কাঁদে আপনার জন্য। আমাদের সন্তান কে কি জবাব দিবো আমি? সে তো বলবে মা জাফরির বাবা আছে আমার বাবা নেই কেনো। তখন আমি কি জবাব দিবো আপনার সন্তানের কাছে? চলে যাওয়ার আগেও আমায় কিছু বললেন না হুট করে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছেন। আপনি বেঁচে থাকলে আমার জীবন সুন্দর সহজ হতো। পরকালে আপনার সাথে আমার দেখা হলে আপনাকে ইচ্ছেমতো বকে দিবো। জানি আমাদের শেষ দেখা হয়ে গিয়েছে। আর চাইলেও আমি আমার এমপি সাহেব কে দেখতে পারবো না। এই কয়েক দিন আমি কিভাবে কাটিয়েছি জানেন? আলো, বাতাস, সূর্য আমায় দেখেনি। পুরো একটি মাস ঘরবন্দী হয়েছিলাম। রুয়াত না আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আপনার থেকে বেশি ভালোবাসে। আপনার সাথে আমার জীবনের পথচলার সমাপ্তি হয়ে গিয়েছে। আয়াজ ত্বায়ীম চৌধুরী কে রুয়াত পাগলের মতো ভালোবাসে। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি এমপি সাহেব।’
ছাদের মেঝেতে বসে কাঁদছে রুয়াত। হাঁপিয়ে উঠতে বারবার। আয়াজের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। বাকি জীবন কিভাবে কাটাবে? ইনিমা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে রুয়াত কে। তার ও কিছু বলার ভাষা নেই। আর কি বলেই বা স্বান্তনা দিবে? কান্নারত অবস্থায় রুয়াত ইনিমার উদ্দেশ্যে বলে-
-‘আপু আমি মারা গেলে সাথে সাথে আমাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আয়াজের পাশের কবরটি যেনো আমার হয়। তার কাছে না যাওয়া পর্যন্ত আমার এ হৃদয় শান্ত হবে না।’
#সমাপ্ত
[