#পরিণীতা
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_সাবরিনা_সিদ্দিকা_তাবাচ্ছুম
“আমার সাথে বিহির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। এবং আমি ওকে ছেড়ে দিয়েছি কারণ ওর চরিত্র ঠিক নেই। আমি বিদেশ থাকা কালীন এই সংবাদ পেয়েছিলাম। আমি চাই না আপনাকে এসব লুকিয়ে ঠ’কিয়ে বিয়ে দেওয়া হোক! আপনি বরং চলে যান সেটাই ভালো। এসব খারাপ মেয়ের হাত থেকে বেঁচে থাকবেন”
বড় আম্মু কিছু বলতে যাবে তখনই আদিব দাঁড়িয়ে গেল। আমি বুঝে গেলাম সব শেষ!
আদিব সামনে এসে বলল,
“আপনি বলতে চাইছেন আপনার সাথে বিহির বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলে আমি ওকে ছেড়ে দিবো? বিয়ে ভেঙে দিবো?”
“হ্যাঁ আমি তো কারণ বললামই”
“আচ্ছা”
বলে আদিব বসে পড়লো। তারপর আরাম করে বসে বলল,
“আপনি একটু আমার পাশে এসে বসুন।”
সাদাফ ভাইয়া এসে বসতেই আদিব আবারো বলল,
“আপনার উত্তর একটু পর বলছি। কাজী সাহেব আপনি শুরু করুন।”
“শুরু করবে কেন? বিয়ে ভাঙবেন না?”
“না” বলে কাজীকে তাড়া দিলো। তারপর আমাকে কবুল বলতে বলা হলো তারপর আদিব ও বলল। আমাদের বিয়ে পড়ানো শেষ। এবার আদিব একটু নড়েচড়ে বসে বলল,
“তো এবার আসি আপনার কথায় সাদাফ ভাই। বিহির ওপাশে পর্দা তুলার আগে আপনার কথা ক্লিয়ার করি।”
“ধুর মিয়া। বিয়ে তো করে ফেললেন আর কী ক্লিয়ার করবেন। আপনাকে বাঁচাতে আসলাম আপনি ঠিকই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা’রলেন”
“কীভাবে?”
“ওই যে বললাম বিহির চর…”
“হয়েছে আপনাকে আর বলতে হবে না। বিহির ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট আমি আপনার থেকে নিবো না। আর আপনি বলছিলেন আপনার সাথে বিহির বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেটা আমি জানি এন্ড জেনেই বিয়ে করেছি। আর আপনি ওকে ছেড়েছেন এটাও আমি জানি এবং কারণটাও আমি জানি। আমি সব জেনেশুনে বিহিকে বিয়ে করতে এসেছি। আমার দেশে করা কাজগুলোর খবর ও আমি জানতাম।”
“ম…মানে? কী কাজ?”
“ভয় পাচ্ছেন কেন?”
“ভয় কেন পাবো আজব?”
“বিহির সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে থেকে আমি ওকে পছন্দ করতাম। কিন্তু আমি সরাসরি বিয়ে করার কথা ভেবেছিলাম তাই আমি আগে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছি। কিন্তু তার আগেই আমি জানতে পারি আপনার সাথে বিহির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। তবে আমি আপনাকে লিজার সাথে অনেক আগে থেকেই সম্পর্কে জড়াতে দেখেছি।”
সাদাফ ভাইয়ের মুখ দেখে বোঝায় যাচ্ছে যে সে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। কিন্তু আদিব এসব কী বলছে? বাড়ির সবাই কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে আছে। সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো। এই কথা আগে কেউই শুনে নি। সাদাফ ভাইয়া এ বাড়ির সবচেয়ে ভালো সন্তান হিসেবে পরিচিত ছিল।
“কী হলো সাদাফ সাহেব?”
“কী হবে কিছু না আর আপনি এসব বলছেন কী?”
“কেন সত্যি হজম করতে খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?”
“কী.. কীসের সত্যি?!”
” এই যে দেশে থাকতেই আপনার লিজার সাথে অনেক আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। আর এটা বাড়ির কেউই জানতো না। আপনিও এটা চাপা দিতে বিদেশ পাড়ি জমালেন সাথে লিজা মেহেক।”
আমরা অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম। এরিমধ্যে লিজা এসে হাজির।
“সাদাফ, একটু রুমে আসো তো”
লিজা মনে হয় কিছু শুনতে পায়নি। সাদাফ ঠাঁই বসে রইলো। সে এসে বলল,
“কী হলো সাদাফ এমনভাবে বসে আছো? এসো কাজ আছে!”
“ও এখন যাবে না”(আদিব)
লিজা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন? আর আপনি বলার কে?”
“তুমিও বসো। তোমাদের পর্দা ফাঁস করতেছি।”
“মানে?”
“বসো বুঝতে পারবে। সাদাফ সাহেব যদি বিয়ে ভাঙতে না আসতেন তাহলে আমি এসব কিছুই বলতাম না। আপনি যখন বিয়ে করে এসেছেন তখন আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি। তখনই চেষ্টা শুরু করে দিয়েছি বিহিকে পাওয়ার। আর ততদিনে আমার চাকরি হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু বিহি চাকরি না করে বিয়ে করবে না বলেছিল তাই আমি তখনও প্রস্তাব দিই নি। পরবর্তীতে দিলাম এবং বিয়ে ফাইনাল হলো। আমি অনেকটা আন্দাজ করেছিলাম যে আজকে আপনি এমন কিছু একটাই করবেন। আপনি যে সেদিন ছাদে বিহিকে হুম’কি দিয়েছিলেন সেটাও আমি জানি।”
সাদাফ ভাইয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। বলার মতো কিছু পাচ্ছে না। হাঁসফাঁস করছে। লিজা বলে উঠলো,
“এসব মিথ্যে কথা তো ভালোই বলতে পারেন। আপনার সাথেই ওই বিহি যায়। নিয়ে যান এখান থেকে।”
সাথে সাথে ঠাসসস করে শব্দ শোনা গেল। বড় আম্মু লিজাকে চড় মেরেছে। সাদাফ ভাইয়া কিছু বলতে পারছে না।
“তুমি আর একটা কথাও বলবে না। বিহিকে নিয়ে বলার মতো যোগ্যতা তোমার বা তোমার স্বামীর নেই। বিয়ে শেষ হলেই তোমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে।”
” ভাবী কী বলছো এসব!”(আম্মু)
“আর কেউ কিছু বলবে না; অনুষ্ঠানের অনেক কাজ বাকি। সেগুলো শেষ করতে হবে। বিহির শশুড়বাড়ি যেতে ও অনেক সময় লাগবে তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব শেষ করতে হবে”
বলে বড় আম্মু উপরে চলে গেল। সাদাফ ভাই আর লিজা থ হয়ে আছে। কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারছি না। আমি সাদাফ ভাইয়ের আসল রূপ তো সেদিন ছাদে দেখেছি। নিজ স্বার্থে সব তছনছ করে দিতে এসেছিল। কিন্তু “আল্লাহ্ তায়ালা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না!” নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সাদাফ ভাইয়া আর লিজা রুমে চলে গেলো। সবাই স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় চেষ্টা করছে। হঠাৎ পাশ থেকে আমি কাজিনরা বলে উঠলো,
“ভাইয়া বউয়ের মুখ দেখবেন না? নাকি একেবারে দেখবেন বাড়িতে নিয়ে?”
বলে সবাই হেসে দিলো। আদিব ও হেসে বলল,
“না না! এখন তো দেখতে হবে”
আমার পাশ থেকে আমার এক কাজিন স্নেহা ফিসফিসিয়ে বলল,
“ভাগ্য আছে বলতে হবে তোর” বলে মুখ টিপে হাসলো। বিষয়টা আদিবের ও চোখ এড়ালো না। আমি বুঝতে পারছি সে কী বোঝাতে চেয়েছে। ও ছোটো থেকেই আমাকে পছন্দ করে না তাই সে আমার গঠন বা গায়ের রঙ নিয়ে ঠাট্টা করতো। তার গায়ের রঙ ফর্সা এবং আমি শ্যামলা হওয়ার কারণে। আমি এসব কিছুই বলতাম না। তাই আজ এটা বললো। আদিব পর্দা সরিয়ে এসে আমার লম্বা ঘোমটা দেওয়া দোপাট্টা সরালো। একবার তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। এই হাসিটা ভুবন ভোলানো। ভাবতেই অবাক লাগছে মানুষটা আমার! মানুষটা এতো কিছুর পরও আমার পাশে থাকবে বলে এসেছে। আমি ছোট্ট করে হাসলাম। আদিব আমার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে ওপাশে যাওয়ার আগে স্নেহা দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দরী আমার মানুষটা। সেরাটাও আমার মানুষ। তার গায়ের রঙ ফর্সা না হলেও সবচেয়ে সুন্দর এবং মনটাও সবচেয়ে ফর্সা!”
আমি বুঝলাম সে আমার হয়ে প্রতিত্তোর করেছে। না চাইতেও মুখে হাসি ফুটলো। নিজেকে আসলেই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। আমার হওয়া কোনো অপমান সে হতে দিবে না। উত্তর আমি না দিলেও সে দিবে। সেটা সাদাফ ভাইয়া করুক বা স্নেহা! সবধরণের আনন্দ হইচই শেষে আমার বিদায়ের পালা। বুক ফেটে কান্না আসছে। ছোটো বেলা থেকে বড় হওয়া এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে অজানা ঠিকানায়। যাওয়ার সময় দেখলাম সাদাফ ভাইয়া একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একবার চোখে চোখ পড়েছিল কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আম্মুকে ভেতরে নিয়ে গিয়েছে কারণ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বে কান্নাকাটি করলে। আব্বু আমাকে গাড়ি অব্দি এগিয়ে দিলো। বড় আম্মু কাছে এসে বলল,
“আমার ছেলেটাকে মাফ করে দিস। তুই অনেক সুখী হবি। তোর জন্য অনেক দোয়া থাকলো। এই বড় আম্মুকে মনে রাখিস।” তারপর চোখ মুছে আদিবকে বলল,
” আমাদের অনেক আদরের মেয়ে ও বাবা। তুমি ওকে একটু দেখে রেখো। কষ্ট দিও না”
আদিব তাদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলল। তারপর আমরা গাড়িতে উঠে গেলাম। গাড়ির গ্লাস দিয়ে শেষবার একটু ফিরে তাকালাম বাড়ির দিকে। সবাই একত্রে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে। তাকিয়ে আছে শেষ পথ পর্যন্ত!
অনেক ক্লান্ত আমি! এরিমধ্যে মনে পড়লো আদিব এখন পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলেনি। তিনি তো বললেন তিনি খুশি কিন্তু আমার সাথে কথা না বলার কারণ কী? সকলের আড়ালে কী তবে অপছন্দ করেন আমাকে?!
চলবে….?
(1092 শব্দের)