#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৫
সাফাত বেরিয়ে যাওয়ার সময় মিলি তার নিজের মতো করে মোবাইল চালাচ্ছিল। একবার ফিরেও তাকালো না। মিলির এমন ভাব দেখে সাফাতও আর আদিক্ষেতা করে ডাকলো না। সে কাপড় ব্যাগ নিয়ে নিজের মতো করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মিলি সাফাতের এমন অবজ্ঞা আচরণ দেখে রেগে গেল। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে খাটের মাঝে মোবাইলটা ছুড়ে মারলো। সাফাত তাকে একবারও বললো না! সে ভেবেছিল যাওয়ার শেষ সময়ে মিলির এমন ব্যাবহার পেয়ে সাফাত অনুশোচনায় ভুগে তার কাছে এসে মাফ চাইবে। মিলি যা বলবে সাফাত তা করবে তবুও মিলি যেন ক্ষমা করে দেয় সেটাই বলবে। তারপর মিলি ক্ষমার পরিবর্তে শর্ত দিবে যে এই কাজে যেভাবেই হোক মিলিকে যেন নিয়ে যায়। তারপর সাফাত আমান শেখের কাছে গিয়ে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক জোরাজোরি করে মিলিকে সহ নিয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না! সাফাত উল্টো তার রাগও ভাঙানোর চেষ্টা করলো না? মিলির এখন নিজেকে নিজেরই বোকা মনে হচ্ছে। কেন সকালে রাগের মাথায় ঐসব বলে দিতে গেল! সকালে যদি ঐভাবে এসব না বলতো তাহলে এখন পরিস্থিতিটা এমন হতো না। মিলির এখন কান্না পাচ্ছে। সে এখানে একা কীভাবে থাকবে!
সাফাত বাবা মায়ের রুমে গিয়ে বাবাকে বলে বেরিয়ে পড়লো। নিহিলা ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে ছিল।
সাফাত নিচে গাড়ির পেছনে ব্যাগ ঢোকাতে এসে উপরে চোখ যেতেই দেখলো নিহিলা তাকিয়ে আছে। নিহিলা মূলত সাফাত বেরোবে সেই ভাবনা ভেবেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল। কিসের টানে দাঁড়িয়েছিল সে জানে না কিন্তু তার মনে হলো একটিবার গিয়ে দেখি মানুষটাকে। এই মানুষটা আবার যখন ফিরবে তখন হয়ত নিহিলা বহুদূরে চলে যাবে। আর দেখা হবে না। আজকেই সাফাত ভাইয়ের স্মৃতির সাথে এটাই ওর শেষ দেখা। প্রতিবার সাফাত ভাই যখনোই বাইরে এভাবে ব্যাবসার জন্য যেত ততোবারই নিহিলা মেইন দরজা অব্দি এগিয়ে দিয়ে দৌড়ে রুমে এসে এভাবেই ব্যালকনি দিয়ে বিদায় জানাতো। আজও তার ইচ্ছে হলো কিন্তু সব ইচ্ছে কী আর পূরণ হয়!
সাফাত নিহিলার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। অথচ এখন তার স্ত্রীর এভাবে তাকে বিদায় দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু সে করলো না তা। অথচ সাফাত যাকে অবজ্ঞা করেছে সেইই দাঁড়িয়েছে! সাফাতের অন্যবারের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। প্রতিবার এভাবেই নিহিলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাসি মুখ করে বলতো,
“নিজের খেয়াল রাখবেন সাফাত ভাই। আমার জন্য আসার সময় কিছু নিয়ে আসবেন। খালি হাতে ঢুকতে দিবো না। এতদিন অপেক্ষার ফল হিসেবে নিশ্চই কোনো উপহার আনবেন। খাবার ঠিকমতো খাবেন।”
সাফাত হাসলো। এখন এসব অতীত। মেয়েটা আর এভাবে কোনোদিন বলবে না। কেন নিজের দোষে এমন রত্নকে সে হারিয়ে ফেলল! অথচ এই বিয়ে দিয়েই তার চেয়ে মুক্তি পেতে চেয়েছিল সাফাত তবে বিয়ে করেও কেন শান্তি পাচ্ছে না! কেন মেয়েটার মায়া ভুলতে পারছে না সে! সাফাত নিজের ভাবনা দেখেই তাচ্ছিল্য হাসলো। সে ভাবনা থেকে বেরিয়ে উপরে আবারো তাকাতেই দেখলো নিহিলা নেই। সে রুমের ভেতরে চলে গিয়েছে। সাফাতের খারাপ লাগলো। এই প্রথম মেয়েটি এতো চুপ ছিল। এমনভাবে তো নিহিলাকে মানায় না। মন থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো যেন সাফাতকে বলছে, “এসবকিছুর জন্য তুই নিজেই দায়ী সাফাত। একটা হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েকে কেমন নির্জীব বানিয়ে দিয়েছিস এর ফল উপরওয়ালা তোরে দিবে।” কথাটা ভাবনাতে আসতেই তার নিজেকে নিজে আফসোসে ঘিরে ধরলো। নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে শুরু করলো। এতটা খারাপ কীভাবে হলো সে!
সাফাত গাড়ি ছেড়ে দিতেই নিহিলা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সাফাতের গাড়িটা যতক্ষণ মিলিয়ে যায়নি ততক্ষন তাকিয়ে রইল। আগের বারের কথাটা বারবার মনে পড়ছে। কেন এমন হলো! কেন এমন লাগছে তার!জীবনের একটা পর্যায়ে এসে ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় কারোর উপর অতিরিক্ত আশা রাখা উচিত না। যে মানুষটা যতবেশি আশা রাখে সে মানুষটা ততবেশি কষ্ট পায়। বেশিরভাগ মানুষ সব থেকে বেশি আশাহত হয় তার প্ৰিয় মানুষটার কাছ থেকে কারণ সবাই প্ৰিয় মানুষটার উপরই বেশি আশা রাখে। মনে মনে তারা যা ভেবে রাখে তার বিপরীতটাই পেয়ে থাকে এতে কষ্টও বেশি পায়। প্রিয় মানুষটার উপর আশা রাখা দোষের কিছু না। আশা রাখা স্বাভাবিক কিন্তু অতিরিক্ত আশা রাখা দোষের। যেমনটা নিহিলার বেলায় হয়েছে। সে সাফাতের উপর অতিরিক্ত আশা রেখে ফেলেছিল যার ফলে বিপরীতটাই হয়ে কষ্ট পাচ্ছে।
————–
সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মী চোখে পড়তে নিহিলা চোখমুখ কুঁচকে নিল। বিরক্তিতে ‘চ’-ক্রান্ত শব্দ করে কপাল কুঁচকে তাকাতেই দেখল কেউ একজন জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। নিহিলা রিহি ভেবে বিরক্তিসূচক চেহারা করে ফেলল।
“রিহির বাচ্চা, পর্দা লাগা।”বলেই সে পাশ ফিরে লেপ টেনে আবারো চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
“ঘুম আসবে না জেনেও আবার ঘুমানোর ভান ধরছিস কেন?”
মায়ের কথা শুনে নিহিলা চোখ মুখ কিচে উঠে বসলো। সে এতক্ষন ভেবেছিল, রিহি তার সাথে মজা করছে তাই রেগে কথাটা বলেছিল।
“তাহলে ভাঙালে কেন মা?”
রেহেনা বেগম মেয়ের কথা শুনে মেয়ের কাছে এগিয়ে কপালে হাত ছুঁলো।
“কী হয়েছে মা?”
“সেটা তো তুইই বলতে পারবি। তুই তো এতো বেলা অব্দি কোনোদিন উঠিসনি!”
“এখনো কিসের বেলা?” বলতে বলতেই নিহিলা ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই নিজেও বোকা বনে গেল।
“এতো বেলা অব্দি ঘুমালাম!”
রেহেনা বেগম মেয়ের কাছে এগিয়ে এলেন।
“রাতে ঘুমাসনি তাই না?”
নিহিলা মায়ের কথায় তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে কাপড় নেয়ার জন্য ছুটলো।
“কী যে বলো না মা! রাতে ঘুমাবো না কেন?”
রেহেনা বেগম মেয়েকে আর ঘাটলেন না। তিনি জানেন মেয়ে তার কথা ঘুরাচ্ছে কিন্তু এই কথাটা লম্বা করতে তারও ইচ্ছে হলো না তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তার মাঝে মাঝে খারাপ লাগে, বুকটা খালি খালি লাগে নিহিলার জন্য। তার কী মেয়ে কী হয়ে গিয়েছে সেটা ভেবেই খারাপ লাগাটা কাজ করে। তার মেয়ের দিকে ধ্যান দেওয়া উচিত ছিল। নিজেকে ব্যর্থ মা হিসেবে মনে হচ্ছে। আফসোসবোধে ঘিরে ধরেছে । আগে যদি মেয়ের খবরাখবর নিতো তবে আজ পরিস্থিতিটা এতো বাজে হতো না।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬
সময় চলে যায় নিজস্ব গতিতে। যেটাই হোক না কেন সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। নিজের মতোই বহমান। নিহিলার যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক। দেখতে দেখতে যাওয়ার সময়টাও ঘনিয়ে এসেছে। এইতো আজকের রাতটাই তার শেষ রাত। উহু শেষ রাত বলতে আজকেই সাফাত ভাইয়ের সবকিছুর শেষ। বোধহয় পরেরবার যখন আসবে তখন এই স্মৃতিটা নিয়ে নিজের উপরেই হাসাহাসি করবে নিহিলা। দিনগুলো খুব তাড়াতাড়িই যেন চলে গিয়েছে। সাফাতের অনুপস্থিতিতে নিহিলা যাওয়ার আগের দিনগুলো নিজের বাড়িতে ভালোভাবেই কাটাতে পারলো। কিন্তু আসলেই কী ভালোভাবে কাটিয়েছে! রাত হলেই সব তিক্ত স্মৃতি হানা দেয়। এ কয়দিন ঘুমটাও পরিপূর্ণ হয়নি। যে নিহিলা সকাল হতেই ঘুম থেকে জেগে উঠতো সে নিহিলা এখন বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকে। গোছানো স্বভাবটা যেন হুট্ করে পাল্টে গিয়েছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। রাত হলেই রুমের স্মৃতি থেকে পেরোতে ব্যালকনিতে গেলে আরো বেশি কান্না পায়।
গভীর রাত নেমে এসেছে।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।নিহিলার চোখে আজ ঘুম নেই। এতদিনও ঘুমাতে পেরেছিল তা না কিন্তু আজকেরটা ভিন্ন। এতদিন রাতের শেষভাগে হলেও ঘুমিয়েছিল কিন্তু আজকে রাত পেরিয়ে যেতেও ঘুম যেন চোখে ধরা দিচ্ছে না। চোখের পানি বাঁধ মানছে না। কেন এতো চোখের পানি আসছে সে বুঝছে না। সে তো কিছু মনে করছে না তবে কেন এতো খারাপ লাগছে। নিহিলাও আর চোখের পানি মুছলো না। সে আজ কাঁদবে। খুব করে কাঁদবে। ব্যালকনিতে গিয়ে প্ৰিয় দোলনাতে হেলান দিয়ে বসে আছে। আস্তে আস্তে ভোর হতে শুরু করেছে কিন্তু নিহিলার হেলদোল নেই। চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছে। বোধহয় চোখও ক্লান্ত। নিহিলা হাসলো। আজকেই শেষ। সাফাত ভাইয়ের স্মৃতি এখানে আজকেই শেষবারের মতো মনে করলো। নিহিলা দূরের ঐ হালকা আলোর আকাশটার দিকে দৃষ্টি দিল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কারণে দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসছে তবুও সে ফেরালো না। সে আপনমনেই বিড়বিড়িয়ে উঠলো,
“সাফাত ভাই!কেন করলেন এমন? খুব কী ক্ষতি হয়ে যেত যদি আপনি আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসতেন? একটু মনেও পড়ে না আমাকে?” শেষের কথাটা বলে সে নিজেই নিজের বোকামো দেখে হাসলো, কেন মনে করবে নিহিলাকে ? উনি তো ভালোই আছে হয়ত। ভালো থাকার জন্যই তো নিহিলাকে ছেড়েছে। ভালো তো থাকতেই হবে। পরমুহূর্তে আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো নিহিলা, “আমার সুন্দর জীবনটাতে কেন এতো বিশ্রী একটা অতীত দিয়ে গেলেন সাফাত ভাই! নিজের মানুষ ভেবেছিলাম আপনাকে! আপনার জন্য পরিবারটাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। চাইলেও ঘৃণা আনতে পারছি না। তবুও মনে প্রাণে দোয়া করি, যেটার জন্য আমাকে ছেড়েছেন সেটা যেন পূরণ হয়। আপনি যেন আমার মতো ধোঁকা না খান। একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে এটাই চাই। দোয়া করি আপনি যেন সুখে থাকুন। শুধু মাঝখানে পড়ে আমাদের সুন্দর সম্পর্কটা হারিয়ে যাবে।”
নিহিলা কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেল। তবুও সে থামলো না। এই কান্নায় যেন সাফাত ভাইয়ের জন্য শেষ কান্না হয় সেটাই মনে প্রাণে চাচ্ছে। আজকের পরে থেকে আর কোনো স্মৃতি মনে আনবে না।
“চোখের পানি হয়েই জড়তে থাকুক হৃদয়ের গহীন ব্যথাগুলো। ভালোবাসার মানুষটার জন্য যত গহীন ভালোবাসা আছে সব আজ মুছে যাক। মুছে যাক বেপরোয়া মনের লোকায়িত দীর্ঘশ্বাস।”
নিহিলা আশেপাশে তাকালো। সকালের আলো ফুটে উঠছে। তার সুন্দর সুন্দর গাছগুলোতে ফুলের বাহার পড়েছে যেন। এতদিন যত্ন করে সব গাছই এখন ফুল দিতে শুরু করেছে। নিহিলা দোলনা থেকে উঠে গাছগুলোকে হাত বুলিয়ে দিল।
“তোরাও কী আমি চলে যাবো বলে খুশি? এতদিন তো এতো সুন্দর করে ছিলি না। আমি চলে যাওয়ার সময়ই তোদের এতো সুন্দর হতে হলো? আচ্ছা? আমাকে মনে পড়বে তোদের?” নিহিলা হাসলো। এখন ফুল গাছ থেকেও জবাব আশা করছে সে! এই গাছগুলোকেও মনে পড়বে ভীষণ করে। সে পেছনে ফিরে ব্যালকনির আশেপাশে তাকালো। এই প্ৰিয় জায়গাটাকে বড্ড মনে পড়বে কিন্তু কিছু ভালো সময়ের জন্য এই টুকু ত্যাগ তো দিতেই হবে।
———–
রেহেনা বেগম ক্ষনে ক্ষনে কান্নার সুর তুলছেন। পাশেই নিহিলা মাকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে বসে আছে। রেহেনা বেগমের এমন আচরণ দেখে আমান শেখ ধমকে উঠলো,
“আহঃ রেহেনা!তুই এমন করলে মেয়েটা যাবে কীভাবে?”
“ভাইজান, আমি এই মেয়েটাকে ছাড়া কিছু কল্পনাও করতে পারি না।”
“আহঃ, মা, তুমি এমন করিও না তো। মাত্র কয়েকটা বছরই তো। আমাকে তো সবসময় দেখবে।”
“দেখতে পারবো কিন্তু ছুঁতে তো পারবো না।” রেহেনা বেগমের এমন কথায় নিহিলা মাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো। আসলেই তো ভিডিও কল আর সামনাসামনিতে অনেক পার্থক্য। দেখা আর ছোঁয়া। এই মায়ের ঘ্রানটা সে পাবে না। সবসময় এটা ওটার বায়না ধরা হবে না। মন খারাপ হলে আর মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের আঁচলের ঘ্রানটা নিতে পারবে না। আর কিছুটা সময় পেরোলেই সে চাইলেও আর মাকে ছুঁতে পারবে না এটা ভাবতেই কান্না চলে আসছে কিন্তু নিহিলা যত সম্ভব নিজেকে উপরে শান্ত দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে সে ঠিক নেই। এখন মনে হচ্ছে কেন এতো দূরে এসব করতে গেল! কেন আগ বাড়িয়ে এতো সব করতে গেল! আবার পরবর্তীতে সাফাতের কথা মনে পড়তেই তার মনে হলো সে যা করেছে ভালোই করেছে। অন্তত এই তিক্ত স্মৃতিটা তো ভুলতে পারবে।
রাশিদা বেগম চোখ মুছে নাক টেনে উপদেশের সুরে বললেন,
“সবসময় কল করবি। খাবার ঠিকমতো খাবি মা।”
“হ্যাঁ, মা অবশ্যই করবো।”
রেহেনা বেগম মেয়ের কপালে পরম আদরে চুমু খেলেন। তার ভাবতেও খারাপ লাগছে এই মেয়েটাকে সে আর কিছুসময় পরে ছুঁতে পারবে না।
কিছুসময় পরে ডাক পড়তেই নিহিলা উঠে দাঁড়ালো। সে রিহিকে জড়িয়ে ধরতেই রিহি কানে কানে ফিসফিসিয়ে উঠলো, “পরেরবার অপেক্ষা করার সময় যেন দুজনের জন্য করি। একটা খুশির খবর যেন পাই।”
নিহিলা কান্নার মাঝে হেসে কান মলে দিতেই রিহি হেসে রেহেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।
“আঃ, চাচী!কেন কান্না করছো। তোমার মেয়ে ওখানে কী যে খুশি থাকবে দেখবে দুদিন পরে আমাদের কথা মনেই পড়বে না।”
রিহির কথায় রেহেনা বেগম অভিমানী চোখে নিহিলার দিকে তাকালো,
“সত্যিই কী মনে পড়বে না?”
রেহেনা বেগমের কথা শুনে রিহি নিহি দুজনেই হেসে দিল। তার মা যে কত অবুঝ তা কিছু কিছু কর্মকান্ডে বুঝা যায়।
“আঃ!মা! রিহি তো মজা করে বলছে আর তা তুমি বিশ্বাস করে নিচ্ছ?”
রেহেনা বেগম আবারো মেয়েকে কাছে টেনে নিতেই ডাক ভেসে আসতেই আমান শেখ তাড়া দিল। নিহি আমান শেখের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“নিজের খেয়াল রাখবে মা। যেকোনো পরিস্তিতিতে নিজেকে শক্ত রাখবে, নিজেকে দুর্বল দেখালে মানুষ আরো ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পছন্দ করে। তাই নিজের দুর্বলতা একদম প্রকাশ করবে না। ভালো থেকো মা।”
নিহি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তেই চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমান শেখ পানিটুকু মুছে আদেশের সুরে বলে উঠল, “একদম পানি নয়। এটাতো ভুলেও দেখাবে না।” বলেই তিনি তাড়া দিতেই নিহি আরেকবার রেহেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাঁটা ধরলো।
উপরের মনিটর থেকে শেষ বারের মতো আওয়াজ আসলো বোর্ডিং আওয়ার শেষ, যাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে স্পিকারে বলছে। নিহিলা সবাইকে সালাম দিয়ে হাঁটা ধরলো। যাওয়ার সময় মুখ থেকে কান্নার জন্য আর কোনো কথা বেরোলো না। এতক্ষন উপরে শক্ত দেখালেও এখন আর পারছে না।কান্নারা যেন গলার মাঝে আটকে আসছে। নিহিলা হাঁটতে হাটতেই পেছন ফিরে অস্বচ্ছ কাঁচের দরজা দিয়ে মাকে দেখলো। রেহেনা বেগম ঝাঁপসা চোখে নিহিলাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে। তাকে রিহি জড়িয়ে ধরে আছে। কাঁচ দিয়ে ঝাপসা দৃশ্যটুকু নিজের মনের কুঠুরীর মাঝে আবদ্ধ করে নিল নিহিলা। যতটুকু পরিবারকে দেখা গেল নিহিলা বারবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে রইল। শেষবার তাকাতেই দেখলো আমান শেখ পেছনে ফিরে গিয়েছেন। নিহিলার মনে হলো বড়ো বাবা কাঁদছে কিন্তু তিনি কেন কাঁদবেন! তার কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। এরপর চোখ মুছে পা বাড়ালো নতুন জীবনের সন্ধানে।
#অনুরোধ।)