#বৈধ_সম্পর্ক
#সিজন_২
#পর্ব_৪
#Saji_Afroz
.
.
.
কেনো যেনো মুনিরার মনে হলো আফরান আজ সত্যি বলবেই।
আফরান শান্ত গলায় তার বান্ধবীর উদ্দেশ্যে বললো-
সি ইজ মাই ওয়াইফ অলসো।
.
মেয়েটির কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগলো। আফরানের ফোনের রিংটোন বাজলে সে ওখান থেকে প্রস্থান করে।
মেয়েটি উৎসুক দৃষ্টিতে সায়নীর দিকে তাকিয়ে বললো-
ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আফরান দুটো বিয়ে কেনো করেছে জানতে পারি?
.
সায়নীর মুখে সবটা শোনার পরে হাসতে হাসতেই মেয়েটি বললো-
এই যুগে দুইটা বউ! মানা যায় এসব! মনে হচ্ছে সিরিয়াল দেখছি।
-জীবনে অনেক কিছুই ঘটে কতোটুকু মানতে পারি আমরা?
আফরান পরোকিয়া করেছে নাকি অন্য কোনো মেয়ের সাথে ঘুরছে ফিরছে! সে যা করেছে তা ভুলেই। মানুষ মাত্রই তো ভুল। তবে ভুল হলেও বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে সে।
-যাই বলো সায়নী দুই বউ শুনতে কেমন কেমন লাগে।
-আমরা আছি আমাদের সমস্যা না হলে মানুষের এতো সমস্যা কিসের!
-তোমাদের দেখে হয়তো আমাদের স্বামীরা বহু বিবাহে উৎসাহ পাবে।
-উৎসাহ! আমি আগেও বলছি এখনো বলছি, আফরান ভুলবশত বিয়েটা করেছে। আমাদের ইসলাম একাধিক বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে সেজন্য নয় আবার দুইটা বউ নিয়ে ফূর্তির জন্যও নয়। আর তখন কি যেনো বলেছিলেন? সিরিয়াল? মানুষের জীবনের সাথে সিরিয়ালের কি কোনো মিল নেই?
.
মেয়েটি চুপ হয়ে গেলে মৃদু হেসে সায়নী বললো-
উস্কানিমূলক কিছুই এখানে হয়নি। দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। এমন অনেক পরিবার আছে যাদের বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির চাপে পড়ে দুইটা বিয়ে করতে হয়। তারা সুখে থাকলেও কিন্তু সমাজের কিছু মানুষের জ্বলে। তাদের যেনো মাথা উঁচু করে সমাজের মানুষরা থাকতেই দিবেনা। এতে এফেক্ট হয় পরবর্তী প্রজন্মের। আমি বলছিনা দুই বিয়েকে প্রাধান্য দেন কিন্তু অবশ্যই বলবো যারা সুখে আছেন তাদের না খোচালেই বেটার।
.
.
.
রাত ১১টা হয়ে গেলো…
নিজের বিছানায় শুয়ে আছে মুনিরা। প্রথমে সায়নীকে ভুল বুঝলেও পরে সায়নী ও আফরানের ব্যাপারে সবটা জেনে ভুল বুঝাবুঝির অবশান ঘটেছিলো মুনিরার। সায়নী সিঙ্গাপুর যাবার আগে তাকে কথা দিয়েছিলো, এসে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। সায়নী তার কথা রাখছে। বিশেষ করে আজকে সে যা করলো অন্য কোনো মেয়ে হলে কি করতো? অবশ্যই না। সায়নীর ভালো মানুষীর জন্যই মুনিরা তার প্রতি ধীরেধীরে দূর্বল হয়ে পড়েছে। নিজের বোনের জায়গা দিয়েছে তাকে। প্রিয় মানুষদের মাঝে একজন করেছে।
আল্লাহ কোনো হিংসা রাখেননি মুনিরার মনে সায়নীর জন্য। শুধু রেখেছেন অফুরন্ত ভালোবাসা।
সবই সে পেয়েছে এই বাড়িতে শুধু আফরানের ভালোবাসা ছাড়া। সত্যি বলতে সায়নীর প্রতি আফরানের ভালোবাসা দেখে আরো বেশি আফরানকে ভালোবেসেছে মুনিরা। এই ছেলে তার ভালোবাসায় এতোটা মগ্ন, যে কিনা অন্য একটি বউ থাকা স্বত্তেও নিজের ভালোবাসার অমর্যাদা হতে দেয়না সে ছেলের মনে মুনিরা একটুখানি জায়গা করতে পারলেও মনেহয় নিজেকে ধন্য মনে করবে।
আর আফরান আজ তার বান্ধবীকে বলেছে মুনিরাও তার স্ত্রী! এতোটুকুই বা কম কিসের!
.
.
আফরানের বুকে মাথা লুকিয়ে শুয়ে আছে সায়নী। হঠাৎ সে বললো-
আচ্ছা আফরান? দুইটা বউ রাখলে সমান অধিকার দিতে হয় এটা তো তোমার অজানা নয় তাইনা?
-মুনিরার কথা বলছো? কিসের অভাবে রেখেছি?
-ভালোবাসার।
.
আফরানকে চুপচাপ দেখে সায়নী বললো-
আমাদের ধর্মেও কিন্তু এর ব্যাখ্যা আছে।
-ধর্ম কতোটুকুই বা মান্য করতে পারি আমরা? তুমি আমি বিয়ে করেছিলাম পালিয়ে।
-একবার ভুল করেছি বলে বারবার করতে হবে? মুনিরাও তোমার স্ত্রী। ধীরেধীরে তাকেও তার অধিকার দিতে চেষ্টা করো।
.
কথাটি বলেই ওপাশ ফিরে সায়নী চোখের পানি ফেলছে বুঝতে কষ্ট হলোনা আফরানের।
পরিস্থিতির চাপে পড়ে মানুষকে কতো কিছুই না করতে হয়! তাই বলে কি ভালোবাসা যায়?
.
.
.
সকাল সকাল বাড়ির আশেপাশে হাটাহাটি করা নুরুল আলমের অভ্যাস। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। তবে আজ দেখা পেলেন তিনি গ্রামের চেয়ারম্যানের।
-আরে নুরুল! কি অবস্থা তোমার?
-জ্বী চেয়ারম্যান সাহেব ভালো। আপনার?
-আছি ভালো। শুনলাম পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে তোমার বিবাহিতা মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছো?
তা সে কি সতীনের ঘরে সংসার করতে পারছেনা?
-বিষয়টা এমন না।
-কেমন? অলক্ষী মেয়ের কোথাও ঠাই হয়না। তাই তো আরেক বিয়ে করতে হচ্ছে এখন। দেখো বাপু যাই করো আমার গ্রামে এসব চলবেনা। বিয়ে দিবে তো বাইরে গিয়ে দাও বিয়ে। এখানে যেনো মুনিরার ছায়াও আমি না দেখি। গ্রামে পা দিলে গ্রামেও অশুভ ভর করবে। বাইরে তার ১০টা হলেও বিয়ে দাও, আমার কোনো সমস্যা নেই।
.
.
বাসায় এসেই নুরুল আলম ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। সেনোয়ারা বেগম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন-
কোথায় যাচ্ছো?
-আফজালের কাছে। যদি মেয়েটাকে শান্তিতে নাই রাখতে পারে দায়িত্ব কেনো নিতে গিয়েছে সে! অন্য কোথাও আমি মেয়ের বিয়ে দিবোনা। ওই বাড়িতেই থাকতে হবে তার। মাথা উঁচু করে থাকবে আর সমস্ত অধিকার দিতে হবে তাকে।
-মাথা ঠান্ডা করো। আমিও যাবো তোমার সাথে।
-তো চলো!
-ঠান্ডা হও আগে। এখন নয়। ধীরেসুস্থে বের হবো।
-তবে আজই যাবো।
-ঠিক আছে।
.
.
.
ক্লাসে মাত্র প্রবেশ করে সিটে গিয়ে বসলো মুনিরা।
তার পাশে থাকা মেয়েটি মুখ টিপে হেসে বললো-
আজ তোর জামাই তোকে দিয়ে গিয়েছে বুঝি? জানালা দিয়ে দেখলাম।
-হু।
-হঠাৎ করে?
-উনার অফিসের সময়ের সাথে আমার ক্লাস টাইম মিলেনা। উনাকে আগেই বেরুতে হয়। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে। আমি বেরুচ্ছিলাম, উনিও অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুচ্ছিলেন। তাই…
-ইশ! এভাবে আর কতোদিন! আমার মনেহয় কি তোর সতীনই তোর জামাইকে তোর সাথে ঘেষতে দেয়না। পেটে পেটে সব শয়তানি তার।
.
দাঁতে দাঁত চেপে মুনিরা জবাব দিলো-
তোমাদের এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আর কে বলেছে সে আমার সতীন? বোন মানি তাকে আমি।
-সে মানেতো?
-না মানলে এই এক বছরই আমি টিকতে পারতাম না।
-তবে তোর জামাই ধরা দিচ্ছেনা কেনো তোর ভালোবাসায়?
-ভালোবাসা এতো ঠুংকো না যে চাইলেই পাওয়া যাবে৷ আর এতো সহজে আমি উনার ভালোবাসা পেলে এটার কদর করতে জানতাম? সায়নী আপুর প্রতি উনার ভালোবাসা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি যদি আমাকেও সহজে ভালোবাসতো হয়তো আমি এতোটা আকৃষ্ট তার প্রতি হতামই না।
-কিসের জোরে থাকবি তুই ভালোবাসা ছাড়া? আর কিসের জোরেই বা এতো বড়বড় কথা বলছিস?
-বৈধ সম্পর্কের জোরে।
.
.
.
আফরান অফিসে, মুনিরা কলেজে।
রান্নার জন্য রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যাবার সময় ফোন বেজে উঠলো সায়নীর। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো মিশিকার ফোন।
-হ্যালো মিশি!
-কি অবস্থা মাই জানু?
-আমি ভালো আছি। তোর আর পাবেলের কি অবস্থা?
-আছে ভালোই।
-তুই দেখি নিয়ম করে আমাকে সপ্তাহে একবার হলেও ফোন দিস। এতোটা ভালোবাসিস তুই আমাকে!
-ধুর ছাই! তোর জন্য পাবেলকে বিয়ে করে আমেরিকা আসতে পেরেছি বলেই তো তোকে ভুলতে পারিনা।
.
হেসে উঠলো সায়নী৷ মিশিকা হেসে জিজ্ঞাসা করলো-
আফরান কোথায়?
-অফিসে।
-আর মুনিরা?
-কলেজে।
-কি করে পারিস বাপু সতীন সহ্য করতে আমি জানিনা।
-আমি তোর সতীন হলে কি তুই আমাকেও সহ্য করতিনা?
-পাগল নাকি! মোটেও করতাম না।
-মুনিরাকে সহ্য না করার কথা আসেনা মিশি। মৃত্যু পথযাত্রি থাকাকালীন তাকে কথা দিয়েছিলাম আমি। সে কিন্তু ডিভোর্স এর জন্য তৈরীও ছিলো তখন। এখন বেঁচে ফিরে তার স্বপ্ন ভঙ্গ করবো এমন মেয়ে আমি নয়।
-কিন্তু আফরান?
-পুরুষ মানুষ সে। নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে।
-তুই ঠিক থাকতে পারবি?
-আল্লাহ কে বলেছি কোনো মাধ্যমের ব্যবস্থা করতে যাতে করে সবটা সহজ হয়ে যায় নাহলে…
-কি?
-বাদ দে। এসব পুরানো কথা।
-হুম। আফজাল আঙ্কেল কোথায়? উনাকে দে কথা বলি।
.
.
.
দুই দিন অফিসে না যাওয়ার ফলে আজ সারাদিন অফিসে কাটাতে হয়েছে আফরানের। এখন রাত ৮টা হয়ে গেলো বাসায় আসতে। ক্লান্ত শরীরে কলিং বেল চাপতেই দেখা পেলো মুনিরার।
-বাসায় আব্বা আম্মা এসেছেন।
-কবে?
-একটু আগেই।
-ওহ!
.
নিজের রুমের দিকে আফরানকে এগুতে দেখে মুনিরাও তার নিজের রুমে এগিয়ে গেলো।
সেনোয়ারা বেগম তাকে দেখে বললেন-
জামাই এসেছে?
-হুম।
-ভালোই হলো। সবার সাথেই খোলামেলাভাবে কথা বলা যাবে।
-কি বলতে চাইছো তুমি?
-তোর প্রাপ্য অধিকার জামাই তোকে দিবে কিনা?
-আমি তো ভালোই আছি আম্মা!
-না তুই ভালো নেই।
.
রুমের মাঝে সায়নীর আগমন ঘটলে দাঁড়িয়ে পড়লেন সেনোয়ারা বেগম। গম্ভীর গলায় তিনি বললেন-
এই মেয়েটাই তো যতো নষ্টের মূল। বড়ই সতীন রাখার ইচ্ছে তাইনা? তা সতীন রাখছো নাকি কাজের মেয়ে?
-আন্টি আপনি যা ভাবছেন তা নয়।
-তা নয়! ওমা! তাহলে কেমন? আমাদের ধর্মেও আছে বউদের সমান অধিকার দেয়ার কথা। তাহলে মুনিরা কেনো সেই অধিকার পাচ্ছেনা? তোমাদের ভুলের শাস্তি ও কেনো পাবে?
.
সায়নী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কি জবাব দিবে সে তার জানা নেই!
এরই মাঝে উপস্থিত হলো আফরান। তাদের সালাম জানিয়ে সে বললো-
এতে সায়নীর কোনো দোষ নেই। দোষ আমার মনের। যে মনে শুধু সায়নীর স্থান।
.
আফরানের উদ্দেশ্যে সায়নী বললো-
আফরান প্লিজ থামো।
-না আমাকে বলতে দাও সায়নী। তাদের মেয়েকে জোর করে কি রাখা হয়েছে?
.
এপর্যায়ে কথা বলে উঠলেন নুরুল আলম-
জোর তোমাকেও করা হয়নি৷ তবুও তুমি বিয়েটা করেছো। এতে দোষ আছে না সায়নীর না মুনিরার। তাই এদের দুজনেরই দায়িত্ব তোমার নিতে হবে।
-কিন্তু…
.
আফরান কে কিছু বলতে না দিয়ে তার পাশে এসে তার দুহাত আঁকড়ে ধরে নুরুল আলম বললেন-
তোমার মনে মুনিরার জন্য কি জায়গা তৈরী করা যায়না বাবা? জানো, আজও আমাকে শুনতে হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে কতো কথা শুনালেন। আমার মেয়েটা অলক্ষী, আরেকটা বিয়ে হলে যেনো গ্রামে আর পা না দেয়। তুমিও জানো সমাজে ডিভোর্সি মেয়ের সম্মান কতোটুক।
.
আফরানকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার হাত ছেড়ে দিলেন নুরুল আলম।
মুনিরার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন-
তোর সুখের জন্য আর কতো মানুষের কাছে ছোট হতে হবে বলতে পারিস তুই? তুই আসলেই একটা অলক্ষী। আজই আমাদের সাথে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি তুই। গ্রামে যেতে না পারি তোকে নিয়ে, সাগরে ডুবে মরতে তো পারবো! তোর মতো অভাগী মেয়ের কপালে বোধহয় মরাই লেখা আছে।
-মুনিরার মতো মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । ও অলক্ষী নয়৷ কোথাও যাবেনা ও। এখানেই থাকবে।
.
কথাটি বলে আফরান হনহন করে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে।
সেনোয়ারা বেগম সায়নীর পাশে এসে বললেন-
কথার খেলাপ করবেনা তুমি আশা করি।
.
.
.
শোয়ার আগে দরজা বন্ধ করার সময় আফরানের দেখা পেয়ে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো মুনিরা।
-এ কি আপনি!
-আজ আমি এখানে ঘুমাবো।
-আম্মাদের দেখানোর জন্য?
.
আফরান ভেতরে প্রবেশ করে বললো-
এখন সেটাই বলতে পারো। তবে আমি চাই তোমাকে তোমার প্রাপ্য অধিকার দিতে। কিন্তু সেটা তো আর একদিনেই সম্ভব নয়। আমি আজ থেকে চেষ্টা করতে চাই। মানে আমাদের সম্পর্ক টাকে একটা সুযোগ দিতে চাই।
-হু।
.
বিছানায় উপরে শুয়ে ওপাশে ফিরে আফরান বললো-
শুয়ে পড়ো।
-কোথায়? না মানে এই রুমে তো কোনো সোফা নেই।
-পাশেই শোও।
.
এই কোন আফরানকে দেখছে মুনিরা! যে কিনা তার সাথে বন্ধুত্বের হাতও বাড়িয়ে দেয়নি সেই কিনা আজ এই সম্পর্ক টা কে এগিয়ে নিতে রাজি হয়েছে!
তার এতোদিনের অপেক্ষা কি শেষ হতে চলেছে?
সমরেশ মজুমদারের একটি কথা মনে পড়লো মুনিরার-
“সব কিছু মনের মত মেলে না, মানিয়ে নিতে হয়। মেনে নিলে ঠিক এক সময় সুখ ফিরে আসে।”
.
(চলবে)
.