১৪
রিপ হাতজোড়া তুলে নীরাকে ধরলো। কোমল গলায় জানতে চাইলো
কি হয়েছে নীরা? তুমি কাঁদছো কেন?
আপনি বলুন আপনি যাবেন না।
এ কি করে হয়? আমি না গেলে কি করে হবে?
আমি বেশিকিছু চাইনি।
রিপের শার্টটা ওর চোখের জলে ভিজে উঠলো। বুকের চামড়ায় চোখের জল টের পেতেই রিপ কেঁপে উঠলো। বলল
তুমি শান্ত হও আর বলো কি হয়েছে?
নীরা না না করে উঠলো। রিপ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
নীরা বুঝার চেষ্টা করো। তুমি বাচ্চা নও।
মুনা আর তালহা বেগম রান্নাঘরের কাজ সেড়ে রেডি হয়ে এসে দেখলেন নীরা রেডি হয়নি। তার চোখমুখ অস্বাভাবিক। নাক মুখ আর চোখের কোণা ঈষৎ লালচে। রিপ তাদের বেশি পরখ করতে না দিয়ে বলল
আমি ওকে রেডি হতে বলছি। তোমরা সব গুছিয়ে নাও। গাড়ি এসেছে।
মুনা সন্দেহভাজন চোখে তাকিয়ে চলে গেল। রিপ শাড়ি নিয়ে নীরার সামনে গিয়ে বলল
এই নাও। শাড়ি পড়ে নাও নীরা।
নীরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।
রিপ কোমলস্বরে বলল,
তোমার কি হয়েছে আমাকে বলবে না?
নীরা ওর দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো। বলল
আমার যা বলার আমি তা বলে দিয়েছি। যাবেন নাকি যাবেন না তা আপনার সিদ্ধান্ত।
কি হয়েছে তোমার?
খানিকটা উঁচুস্বরে বলল রিপ।
নীরা ওর দিকে চেয়ে কোনে জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো । রিপ কপালে আঙুল স্লাইড করে বলল
আমাকে না বললে আমি কি করে বুঝবো নীরা? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? মা কিছু বলেছে?
নীরা পুনরপি চোখ মুছলো। ভেঙে আসা গলায় বলল
আমি যাব না বলেছি যখন যাব না। কেউ কিছু বলেনি।
আরেহ কেন যাবেনা সেটা তো বলো।
রিপের ধমকে কেঁপে উঠলো নীরা। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চাইলো রিপের দিকে। রিপ রক্তলাল চোখে বলল
তুমি না যাও। আমি যাব। তাতে যা প্রমাণ হওয়ার হোক।
নীরা উদভ্রান্তের মতো শুধু চেয়ে রইলো। কোনো শব্দ করলো না।
রিপ রেডি হয়ে মা আর মুনাকে গিয়ে বলল নীরা যাচ্ছে না আমাদের সাথে । তারা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলল
কেন যাবে না? একা একা কি করে থাকবে বাড়িতে? কি হয়েছে ওর?
রিক বলল
যাবে না কেন? ওর জন্যও তে আয়োজন হচ্ছে ওই বাড়িতে। ও নতুন বউ না গেলে কি করে হবে?
যাবে না যখন বলেছে তখন জোরাজোরি করে লাভ নেই। তোমরা চলো।
তুই যাচ্ছিস না?
তোমরা যাও। আমি পরে যাচ্ছি।
রিক সবাইকে নিয়ে চলে গেল। রিপ পুনরায় ঘরে এল। নীরা হাত পা গুটিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে ঘর অন্ধকার করে। রিপ জানালা মেলে দিয়ে বিছানায় বসলো। নীরা মুখ তুলে তাকে দেখলো। ফুঁপিয়ে উঠে বলল
আপনি এখানে বসে আছেন কেন? চলে যান। শুধু শুধু বৃথা প্রমাণ চেষ্টা করছেন আপনি আমাকে যেন কত ভালোবাসেন।
এভাবে একা একটা মানুষকে রেখে চলে যাওয়া যায়?
আপনার দ্বারা সবই সম্ভব। আপনাকে আমি আটকে তো রাখিনি।
শেষবারের মতো বলছি। শাড়ি পড়ে নাও নীরা। তুমি না গেলে ইশু কষ্ট পাবে।
নীরার বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠলো ঠিক একারণে। তার চাওয়া পাওয়ার কোনো মূল্য নেই?
নীরার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরুলো না আর। ইশার ফোন এল স্বয়ং তার ফোনে। সে ফোন তোলামাত্রই ইশা ওপাশ থেকে বললো
নীরু বড়দা ফোনে বললো তুই নাকি আসতে চাইছিস না? কেন? এরকম কেন করছিস? প্লিজ চলে আয়। আমি অপেক্ষায় আছি। রিপদার সাথে চলে আয়। কেমন? এই নীরু। কথা বল।
রিপ নীরার দিকে চেয়ে আছে।
নীরা শক্ত গলায় বলল
আমি যাচ্ছি না। কেন যাচ্ছি না সেসব তোকে বলতো আমি বাধ্য নয়। আমাকে যেতে বলবি না। সবসময় সবকিছু তোদের মর্জিমতো হবে না। আমারও ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে।
রিপ ছুটে এসে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে কেটে দিয়ে গর্জে বলল
পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি? কি শুরু করেছ? ওকে এসব কথা কেন বলছো? আমি কখনো ওর সাথে এভাবে কথা বলেছি? বলতে দেখেছ? ওকে এভাবে কষ্ট দিয়ে আমি কখনো কথা বলিনি নীরা।
আমাকে তো প্রায়ই কষ্ট দিয়ে কথা বলেন। আমাকে তো বলাই যায়। আমি পরের মেয়ে। যা ইচ্ছে খুশি করা যায়।
রিপ অধৈর্য গলায় বলল
ব্যস। অনেক হয়েছে। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তুমি এখন যা করলে তোমার আর যাওয়ার কোনো প্রয়োজনই দেখছি না আমি। থাকো তুমি এখানে।
নীরা কাঁদলো। রিপ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নীরা পিছু পিছু গেল। বলল
আপনি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন?
রিপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে।
এখনো সময় আছে। রেডি হয়ে নাও।
আপনার কাছেও সময় আছে আপনি আর পা বাড়াবেন না। আমি আপনার কাছে কি এমন চেয়েছি? আপনি আমাকে কোনোদিনই বুঝলেন না।
রিপ চলে গেল।
নীরা আর বাঁধা দিল না। রিপ সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেল। নীরা একছুটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। চোখ মুছতে মুছতে দেখলো রিপের যাওয়া। একবারও পিছু ফিরে তাকায়নি। কি অদ্ভুত! সে কার মুখ চেয়ে এই বাড়িতে পড়ে আছে? একবার যদি বলতো আমি যাচ্ছি না নীরা তাহলে সে সত্যি সত্যি যেত চৌধুরী বাড়িতে। একবারও ওকথা মুখ ফুটে বললো না লোকটা!
______________
নীরাকে না দেখে মন খারাপ হলো ইশার। পরী রিকের গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা ফেলে রেখেছে। এ কয়েকদিনে পরীর স্বাস্থ্য উন্নত হয়েছে। দেখতে আরও গুলুমুল লাগছে। রিকের কোল থেকে ঝাঁপ দিয়ে রিপের কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। রিপ তার পিঠে আলতো চাপড় দিতে দিতে ইশাকে বলল
আমি তাড়াতাড়ি চলে যাব। ও সেখানে একা। ভয় পাবে।
ওর আবার কি হলো? তুমি ওকে বকাঝকা করোনি তো?
আমি শুধু শুধু ওকে বকাঝকা করব বলে মনে হয় তোর?
না সেটা বলছিনা। মনে হচ্ছে আমার উপরও রেগে আছে।
রিপ কথা ঘুুরিয়ে বলল
কেক কখন কাটবি? আমি কেক কাটার পরপরই চলে যাব।
রাতের খাবার?
না না অতক্ষণ থাকতে পারব না ইশু। ওকে একা রেখে এসেছি।
পরীর কেক কাটার পরপর ইশা রিপ আর নীরার জন্য খাবার প্যাক করে দিল। রিপকে বলল
তোমরা দু’জন একসাথে খেয়ে নেবে। ওকে আবার বকাঝকা করো না। হয়ত কোনো কারণে মন খারাপ।
রিপ পরীকে আদর করে বলল
আসি আম্মা। আবার দেখা হবে।
পরী গলা কাত করে বলল
আবাল?
হুমম। আবার।
রিপ তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে এল। বাড়ি ফিরতেই দেখলো সারা বাড়ির কোণায় কোণায় অন্ধকার। নির্জন, সুনসান নীরবতা। সে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কয়েকবার ডাকলো
নীরা!
জবাব আসবে না জেনেও সে নীরাকে ডেকে ডেকে ঘরের দিকে ছুটলো। ঘরে যেতেই দেখতে পেল ঘর খালি। কেউ কোথাও নেই।
চলবে…