মেঘমেদুর মন পর্ব -০৯+১০ ও শেষ

#মেঘমেদুর_মন [৯]
প্রভা আফরিন

আজ রিমঝিমকে হসপিটালে ভর্তি করার কথা। কিন্তু রিমঝিম জেদ ধরেছে আজ বাড়িতেই থাকবে। একদমই নাছোড়বান্দা। কাল সকালে এডমিট হবে হসপিটালে। এরপর অপারেশন হবে। আলমগীর সাহেব অসুস্থ মেয়েটার ওপর রাগ করতে পারছেন না। আবার আবদার শুনতেও চাইছেন না। যত দ্রুত চিকিৎসা সম্ভব ততই দ্রুত করতে চান। মনে হচ্ছে এক একটা মিনিটও বিপদজনক। যদি অসুখটা বেড়ে যায়! যদি মেয়েটার আরো কষ্ট হয়! পঞ্চাশ বছর বয়সী আলমগীর সাহেব নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন অতি আদরের জিনিস কেন জানি উনার কপালে বেশিদিন থাকে না। অল্পবয়সে মাকে হারালেন, বিয়ের কিছুদিন পর ভালোবাসার স্ত্রীও পরপারে পাড়ি দিলেন। এ জগতে রইল শুধু একমাত্র কন্যা। হৃদয়ের মণিকোঠায় যার স্থান। সেই সন্তানের জীবনেও শেষে এমন বিপদ নেমে এলো! অসহায় পিতা করুণ নিনাদ করেন মনে মনে,
“হে আল্লাহ! আমার ভালোবাসার মানুষগুলো কেন সর্বদা কষ্ট ভোগ করে? আপনি দয়ালু, করুণাময়। বান্দার জন্য যা মঙ্গলজনক তাই ফয়সালা করেন। আমার সন্তানের জন্য যা মঙ্গলজনক আপনি তাই করুন। হে পরম দয়াময়।”

রিমঝিম দুপুরের পর দুর্বল পায়ে বাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো। ওকে সাহায্য করল তাহমিনা। ঘরে প্রবেশ করে রিমঝিম আগের মতো চনমনে স্বরে বলল,
“বাবা! খালা! তোমরা কী শুরু করেছ বলোতো? এই দেখো আমি দিব্যি ভালো আছি। হেসে-খেলে বেড়াচ্ছি। ছোটো একটা অপারেশন হবে এরপর আবার সব ঠিকঠাক। অথচ তোমরা সব মুমূর্ষু রোগীর মতো মুখ করে আছো! বাড়িতে রয়ে গেলাম একটু শান্তি পাব বলে এখন দেখি বাড়িটাকেই হসপিটালের মতো অসুস্থ রোগীভরা বানিয়ে রেখেছ! এমন করলে খেলব না।”

মেয়ের উচ্ছ্বল কণ্ঠস্বরে আলমগীর সাহেবের চোখে জল জমে। আর্দ্র হয় পিতৃহৃদয়। আসলেই তো, এভাবে মুষড়ে পড়ে উনারা মেয়েটাকে মনে মনে আরো ভয় দেখাচ্ছে। ওর মনের জোর কমিয়ে দিচ্ছে। এটা তো অনুচিত কার্য৷ তিনিও অভয় দিতে বললেন,
“কে রোগী? কোথায় রোগী? আমরা সবাই সুস্থ। তুইও সুস্থ। ছোট্টো একটা অপারেশন হবে। ঘুম থেকে উঠে দেখবি সব আবার আগের মতো। এসবে ভয় পেলে চলে?”

“তাই তো। এই খালা, তুমি একটু বাইরে যাও তো। বাবার সঙ্গে আমার গোপন বৈঠক আছে। ইটস্ কনফিডেনশিয়াল।”

তাহমিনা মেয়েকে বসিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে যেতে যেতে বললেন,
“আমার যেন আগ্রহ গলে পড়ছে তোদের গোপন বৈঠকে সামিল হওয়ার! বাপ-মেয়েতে খিচুড়ি পাকাও, হুহ!”

তাহমিনা পর্দার আড়াল হলেন। রিমঝিম ঠোঁটের হাসিটা ধরে রেখেই বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে। আলমগীর সাহেব উঠে এসে মেয়ের পাশে বসে একটা হাত ধরলেন। রিমঝিম বলল,
“একটা সত্যি কথা বলো তো বাবা।”

“কোন সত্যি জানতে চায় আমার প্রিন্সেস?”

“তুমি খালাকে বিয়ে কেন করলে না? খালা আমাদের জন্য যা করেছে তার কোনো মূল্য হয় না। নিঃস্বার্থভাবে আমাদের ভালোবেসেছে। আমার মায়ের অভাব পূরণ করেছে। তাহলে তুমি কেন খালাকে বিয়ে করলে না?”

আলমগীর সাহেব মৌন হয়ে গেলেন। রিমঝিম উত্তর জানতে উদগ্রীব। আলমগীর সাহেব কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,
“তুই বড়ো হয়েছিস। এখন সব বুঝিস। সত্যিটাই বলছি। আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন আমার মা মা’রা যায়। আমার মুখের দিকে চেয়ে, আমার অযত্ন যেন না হয় তাই বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন। বিয়ের প্রথম প্রথম সবই ঠিক ছিল। নতুন মা আমাকে ভালোও বাসতেন। কিন্তু বছর ঘুরতেই যখন মায়ের কোলে বাচ্চা এলো তখন থেকেই আমি ধীরে ধীরে ঘরের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ হয়ে উঠি। বাবা সারাদিন কাজ করে রাতে বাড়ি ফিরতেন। সংসারের খুঁটিনাটি কী লাগে তদারকি করতেন। আমার কখনোই তেমন সখ্যতা ছিল না উনার সাথে। তাই আমার নিত্য প্রয়োজন জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কথাবার্তা। অথচ আমার নিত্য প্রয়োজনীয় আরেকটা চাহিদা ছিল মমতা। সেদিকে কারো বিশেষ নজর ছিল না। নতুন মা আমাকে ভালোবাসতেন না ব্যাপারটা এমন নয়, বাসতেন। তবে পেটের সন্তানের কাছে সেই ভালোবাসার পার্থক্য প্রকট। তাদের জন্য একহালি ভালোবাসা থাকলে আমার জন্য চার ভাগের এক ভাগ বরাদ্দ। অবশ্য এখানে উনার দোষ নেই। এটা প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম। নিজের সন্তান কোলে নিয়ে পরের সন্তানের যত্ন কোনো নারীই একশত ভাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না। সেখানে আমি ছিলাম নতুন মায়ের বিবাহসূত্রে পাওয়া দায়িত্ব। ভালোবাসার সন্তান ও দায়িত্বের সন্তানে পার্থক্য আছে। অন্য ভাইবোনরা মায়ের সঙ্গে যেভাবে খোলামেলা কথা বলতে পারত আমি তা পারতাম না। অদৃশ্য দেয়াল ছিল মাঝে। কথা বলতাম বুঝেশুনে যেন আমার অসংলগ্ন আচরণে তিনি রাগ না করেন। চোখের সামনে অন্য ভাইবোনকে সীমাহীন ভালোবাসা পেতে দেখতাম যখন, আমার নিজেকে খুবই তুচ্ছ মনে হতো। কষ্ট হতো, রাগ লাগত। কারণ আমি সেই সমান ভালোবাসা পাই না। একটা শূন্যতা চিরকাল আমার বুকের গহীনে জমে আছে। কেন বলছি এসব কথা? কারণ, তাহমিনা নিঃসন্দেহে চমৎকার একজন নারী। জীবনসঙ্গিনী হিসেবেও সেরাই হতো। হয়তো মা হিসেবেও। বিয়ে করলে কিন্তু ওর সাথে আমার একটা দারুণ সংসার হয়ে যেতো। দুদিন বাদে বাচ্চাকাচ্চা হতো। আমিও স্ত্রী-সন্তানকে খুব ভালোবাসতাম। তোকেও বাসতাম। কিন্তু মায়ের ভালোবাসায় পার্থক্য দেখা দিতো। গর্ভের সন্তান, যা একজন নারীর হৃদয়ে প্রকৃত মাতৃত্বের টান সৃষ্টি করে। এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। পরের গর্ভের সন্তান সেই সমান উপলব্ধি কোনোদিন আনতে পারবে না। এটাতে আমি দোষের কিছুও দেখি না। শুধু বিয়ে করেছে বলে, সংসার করতে হবে বলে অন্যের সন্তান লালন করার দায় একটা মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়াও বোধহয় ঠিক নয়। মেয়েটা আসলেই মন থেকে প্রস্তুত কিনা মা হতে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। একটা নারী যেভাবে সন্তানকে নয়মাস গর্ভে আগলে মা হওয়ার প্রস্তুতি নেয়, একই সন্তানের জন্য অন্য নারী সেই প্রস্তুতি বা উপলব্ধি কোনোটাই পায় না। তাই তো আমাদের কাছে আমাদের নিজের মা সেরা, পরের মা নয়। তুই যখন চোখের সামনে এই ভালোবাসার পার্থক্য উপলব্ধি করতি তখন গুমরে কাঁদতি। বাবার ওপর অভিমান হতো। শৈশব-কৈশোরে এসব বিষয় সন্তানদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে আমি নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করেছি। তাই একই পরিস্থিতি আমার প্রিন্সেসের জীবনে আসুক চাইনি। চাইনি সেও শৈশবে একই ট্রমার মধ্যে দিয়ে বড়ো হোক যেখানে তারই পরিবারে দুজন সন্তানকে দু-রকম ভালোবাসা হচ্ছে। বরং সে জানুক জগতে বাবা একমাত্র তাকেই সীমাহীন ভালোবাসে। বাসে না?”

রিমঝিম ফুঁপিয়ে কেঁদে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। শুধুমাত্র তার মুখের দিকে চেয়ে এতগুলো বছর বাবা আত্মত্যাগ করল! সুখের সংসারের হাতছানি থাকা সত্ত্বেও মেয়েকে নিয়ে পড়ে রইলেন। এই ভালোবাসা যেকোনো মুনি-ঋষির সারাজীবনের তপস্যার চেয়ে কম নয়, বরং তারচেয়েও দামী। কারণ ধ্যানীরা জগত সংসারের আড়ালে গিয়ে তপস্যা করেন। সেখানে তাদের জ্বালাতন করার, প্রলুব্ধ করার কেউ থাকে না। আর বাবা এই ঝামেলাময়, প্রলুব্ধ সমাজে থেকেই মেয়ের জন্য তপস্যা করে গেছেন। রিমঝিমের মনে হলো এইসব ভালোবাসার কাছে শরীরের রোগ অতি তুচ্ছ। পৃথিবীতে সে কিছু সেরা মানুষ পেয়েছে। স্বামী, বাবা, খালার জীবনের ভালোবাসার একমাত্র নাম রিমঝিম। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়! আর কী চাই ওর!

বাবার বুক থেকে মাথা তুলে রিমঝিম চোখ মোছে। ঠোঁট উলটে বলে,
“আচ্ছা এখন তো আমি আর শৈশব-কৈশোরের অবুঝ মেয়েটা নই। আমি জানি তোমরা আমায় কত ভালোবাসো। এখন বিয়ে করতে তো অসুবিধা নেই।”

আলমগীর সাহেব অবাক চোখে চাইলেন। মুহূর্তকাল সময় লাগল মেয়ের কথাটা বুঝতে। রিমঝিম সঙ্গে যোগ করল,
“তাছাড়া এখন খালার বয়স ফোর্টি হয়ে গেছে। বাচ্চা-কাচ্চার চান্স কম। হলেও আমার আপত্তি নেই। কোলেপিঠে মানুষ করব। বিয়েটা করে নাও না। খালা কিন্তু মায়ের মতোই সুন্দরী।”

আলমগীর সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী বলবেন যেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তাহমিনা হঠাৎ তেড়েমেড়ে ছুটে এলেন। উনার চোখে জল। রিমঝিমের দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টি হেনে বললেন,
“মুখে লাগাম না দিলে কপালে দুঃখ আছে বলে দিলাম। অসুখ হয়েছে বলে ছেড়ে দেব না। অসভ্য মেয়ে!”

রিমঝিম খালার হাত টেনে ধরে নিজের অপর পাশে বসিয়ে দিল। জড়িয়ে ধরে বলল,
“সে আমায় তুমি অসভ্য বলে থামাতে পারবে না। আমি না বুঝে কিছুই বলছি না। একবার সত্যি করে ভাবো তো, আজ যদি আমার ক্যান্সার শুরুতে ধরা পড়ার আগেই ছড়িয়ে পড়ত! ডাক্তার তো বলেছেই শরীরে একবার ক্যান্সার কোষ পাওয়া গেলে সেড়ে ওঠার বছর পাঁচেক পর আবারো ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। মানে বাকি জীবনটা ঝুঁকিতে। তখন আমার অবস্থা যদি আরো খারাপ হয়, কিংবা আর নাই বাঁচি! আচ্ছা… আচ্ছা… ম’রার কথা বলছি না। কিন্তু আমার তো বিয়ে হয়েছে। নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে যাব। তোমরা দুই মধ্যবয়সী মানুষ বাকিটা জীবন কেমন করে কাটাবে? কে হবে তোমাদের আপনজন? কেউ তো বেঁচে নেই। আমার বাবা-খালার শেষ জীবনটা চরম একাকিত্বে কাটবে এটা আমি বেঁচে থাকতে মেনে নেব? এতদিন আমার কথা ভেবে অনেক তো আত্মত্যাগ করলে। এবার একটু আত্মকেন্দ্রিক হও না। দুজন দুজনের বাকি জীবনের কেয়ারটেকার হও। ইটস্ মাই অর্ডার। তোমাদের দুটোর গতি না করে আমি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকব না। এন্ড দ্যাটস্ ফাইনাল।”

রিমঝিম নিজের জেদে অটল রইল। প্রথমে আলমগীর সাহেব ও তাহমিনা ওকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলেন, এরপর শাসন করলেন। কোনোটাতেই কাজ হলো না। মেয়ে তাদের চেয়েও বেশি জেদি। এদিকে একজন চল্লিশোর্ধ্ব নারী এবং পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ তাদের আদরের সন্তানের জন্য জীবনের চরম বিব্রতকর মুহূর্তে এসে পৌঁছেছেন। এই বয়সে বিয়ে! যে শব্দটা কিনা জীবন থেকে একপ্রকার বাতিলের খাতায় চলে গেছিল। কল্লোলকে দেখা গেল বউয়ের দল ভারী করতে। সে শ্বশুরকে বলল,
“দেখুন বাবা, পুরুষদের বয়স পঞ্চাশ খুব একটা বুড়ো নয়। তেরো বছরের টিনেজ থেকে আশি বছরের বুড়ো সবাই বিয়ে করছে। সেখানে আপনারা স্টিল ইয়াং। আত্মীয়স্বজনের ঝামেলাও নেই। চক্ষুলজ্জাকে প্রাধান্য না দিয়ে জীবনটাকে প্রায়োরিটি দিন। রিমঝিম ভুল কিছু বলছে না।”

আলমগীর সাহেব কপাল চাপড়ান বসে বসে। যেমন মেয়ে তার তেমন জামাই জুটেছে। দুটোই ঠোঁটকাটা। জীবনের চরম বিপদের মুহূর্তেও তারা স্বভাবছাড়া হবে না। অতএব মেয়ের অপারেশনের কথা মাথায় রেখেই দুজনকে সমঝোতায় আসতে হলো। পরদিন সন্ধ্যায় কাজি ডেকে বাবা ও খালার বিয়ে দিল রিমঝিম। তার খুশি যেন ধরে না। নিজে অভিভাবক হয়ে বাবার বিয়ে দেওয়ার মতো দায়িত্ব নিয়ে যেন আহ্লাদে আটখানা রিমঝিম। পারলে ধুমধাম করে আয়োজন করে। কিন্তু বাবার চোখ রাঙানিতে সেসব করা গেল না। খালাকে অনেক জোর করেও রঙিন শাড়ি পরানো গেল না। কিছু বললেই তিনি ছ্যাঁত করে ওঠেন। রিমঝিম তখন অভিমানী স্বরে বলে,
“নট ফেয়ার। কবুল বলার আগেই সৎ মা হয়ে যাচ্ছো!”

এই কথা শুনে তাহমিনা দাঁত কিড়মিড় করেন। রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেলার জোগাড়। বিয়ে পড়ানোর পর খালার কাছ ঘেঁষে বসে রিমঝিম মিনমিন করে করল,
“সব সময় তো খালা বলেই ডেকেছি। খালা ডাকটাই আমার প্রিয়। কিন্তু আজকে একটু মা বলতে ইচ্ছে করছে। জ্ঞানত কখনো ডাকিনি তো, তাই।”

তাহমিনা রিমঝিমকে জাপটে ধরে কেঁদে উঠলেন। এই কান্নার অন্তর্নিহিত কারণ কেউ বুঝল কিনা কে জানে! যে সংসারটাকে এতদিন তিনি মৃ’ত বোনের সংসার হিসেবে নিজের হাতে সামলেছেন, নিঃস্বার্থভাবে, হৃদয় উজার করে দিয়েছেন সবাইকে, আজ সেই সংসারটা উনার নিজের হলো! যে মেয়েকে আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ ভেবে এসেছেন, আজ সেই মেয়ে নিজের হলো! সকল গ্লানি, শোক, তাপ, না পাওয়ার আক্ষেপ যেন চোখের জল হয়ে ঝরতে লাগল। রিমঝিম তাহমিনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুজে দেয়। কম্পিত স্বরে ফিসফিস করে ডাকে,
“মা…মা… তুমি আমার মা!”

তাহমিনা হাপুস নয়নে কেঁদে বলেন, “আমার ময়না, আমার কলিজার টুকরা, আমার সন্তান। আমি তোকে গর্ভে ধারণ করিনি। হৃদয়ে ধারণ করেছি। তুই আমার হৃদয় প্রসূত একমাত্র সন্তান।”

রিমঝিমের আজ খুশির দিন। সমস্ত শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসছে মেয়েটা। কল্লোল মুগ্ধ হয়ে ওকেই দেখে চলেছে। জেদি, অবাধ্য রূপের ভেতর তার একটা সরল, নিষ্কলুষ মন আছে। সে সবাইকে ভালো রাখতে জানে। সবার জন্য চিন্তা করতে জানে। স্বামীর নিষ্কম্পিত দৃষ্টি চোখে পড়েছে রিমঝিমের। এই মানুষটা যখন তার দিকে এভাবে তাকায় কোত্থেকে যে একরাশ লজ্জার আবির্ভাব হয় কে জানে! ও গুটিসুটি হয়ে গা ঘেষে বসে। শরীরে চিনচিনে যন্ত্রণার রেশ, দুর্বলতা। কিছুই পাত্তা পায় না খুশির কাছে। কল্লোলের কোকড়া চুল এলোমেলো করে দিয়ে ও বলে,
“এই যে চশমাকান্ত, এভাবে দেখবে না। আমার লজ্জা লাগে।”

কল্লোল স্মিত হাসে। বলে,
“লজ্জা ভাঙাতেই বেশি বেশি দেখা উচিত।”

রিমঝিম মুখ নামিয়ে রাখে। বিয়ের আগে যাকে ছিটেফোঁটা লজ্জাও পায়নি এখন তার সামনে এলে কত না অনুভূতি প্লাবিত হয় মনে! কল্লোল চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“তুমি ঠিক আছো?”

রিমঝিম পুনরায় হেসে ওঠে,
“একদম। জগতে খুব কম মানুষই বাবা-মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে খেতে পারে। তারমধ্যে আরো কম মানুষ সেই বিয়েটা মন থেকে ইনজয় করতে পারে। আমি পেরেছি। দেখেছো কত ভাগ্যবতী আমি!”

“হুম আর এই ভাগ্যবতী মেয়েটাকে পেয়ে আমিও ভাগ্যবান হয়ে গেছি।”

“সৌভাগ্য তোমারও! শ্বশুরের বিয়ে খেলে। নাতি নাতনিদের কাছে জমিয়ে গল্প করতে…”

রিমঝিমের জবানে আচমকা শব্দশূন্যতা তৈরি হলো। ঠোঁটের হাসি সরে ঠাঁই নিল নিকষতা। নাতি নাতনি তো আসবে না ওদের জীবনে। কল্লোল ওর মুখখানি আজলায় তুলে নেয়। বলে,
“সবার তো গতি করে দিলে। শুধু আমার গতিই করলে না। এটা কী ঠিক হলো?”

রিমঝিমের বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া শুরু হয়৷ ভীত হয় চিত্ত। ভবিষ্যতে কখনো কী কল্লোলের নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হবে না! সে চাইবে না বাবা হতে! তখন কী সে আবার বিয়ে করবে! ছেড়ে দেবে রিমঝিমের হাত! কতশত উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা উঁকি দেয় মস্তিষ্কে। ঢোক গিলে বলে,
“বলো, কী চাও?”

কল্লোল ওকে নিবিড় বন্ধনে বেঁধে ফেলল,
“তোমাকে চাই। ভোরের সতেজতায় তোমাকে চাই, সন্ধ্যার ম্লানতায় তোমাকে চাই। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ঘোলা চোখে তোমাকেই দেখতে চাই। চায়ের আড্ডায় টা হিসেবে তোমাকে চাই। ঘুমের আবেশে নির্ভরতা হিসেবে তোমার কোল চাই। আমার সমস্ত অস্তিত্বে শুধু তোমাকেই চাই, রিমঝিম। দুজন মানুষ চাইলেই ভালোভাবে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। আর তুমি ভয় পাচ্ছো আমি বাবা হওয়ার আক্ষেপে অন্য কারো সঙ্গে জড়াবো? দেখো, আমার বুকটা কেমন ঝিমঝিম করছে। এই বুকে তুমি থাকবে না ভাবতেও আমার দম আটকে যায়। সেখানে অন্য কাউকে ঠাঁই দেওয়ার কথা চিন্তা করা আমার কাছে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের সমান।”

রিমঝিম হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে,
“আমি ভীষণ হিংসুটে, ভীষণ স্বার্থপর। তোমার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারব না। ম’রে গেলেও না। কক্ষনো ছেড়ে যেয়ো না আমায়। জীবনের অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত তোমার সান্নিধ্য চাই।”

পরদিন রিমঝিমকে হসপিটালে এডমিট করা হলো। সমস্ত ফর্মালিটি শেষ করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় কল্লোল ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব, ভীষণ একা। সুস্থ হয়ে আমার বুকে ফিরে এসো রিমঝিম। আমি অপেক্ষায় আছি। তোমায় নিয়ে একটা চমৎকার ভবিষ্যত পাড়ি দেওয়ার জন্য।”

চলবে…#মেঘমেদুর_মন [১০]
প্রভা আফরিন

মেঘঘন সন্ধ্যা। বজ্রধ্বনিতে কেঁপে ওঠে শহরের বুকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অট্টালিকা। বাতাসে প্রলয়ের সুর বাজে। পাখপাখালিরা নীড়ে ফেরে দুরুদুরু বুকে। গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়ার, উড়ে যাওয়ার বাসনায় মিছিল তুলেছে। রিমঝিম জানালার কার্নিশে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ঘর জুড়ে এখন আঁধারের আধিপত্য। মন জুড়েও তাই। প্রতিক্ষার প্রখরতায় মুখে তার নির্জীবতার ছোঁয়া৷ রতনের মা দরজায় কড়া নাড়লেন। বললেন,
“আন্ধারে বইয়া রইছো ক্যান, বউ? বাতি ধরাও।”

রিমঝিম মুখ না ফিরিয়েই বলল,
“ভালো লাগছে না, চাচি৷ অন্ধকারেই থাকি।”

রতনের মা মুখ চেপে হেসে বললেন,
“কী যে করো তুমি! হুদাই জামাইরে রাগাইয়া দেও এরপরে নিজেও মনমরা হইয়া থাকো। বুঝি না তোমাগো হিসাব।”

রতনের মা চলে গেলেন। রিমঝিমের চোখে বিক্ষিপ্ত আকারে ভাসে গতকালের ঘটনা। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে দুজনে ঘোরাঘুরি, শপিং কিংবা ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করে একে অপরের সঙ্গটা চমৎকার করতে চেষ্টা করে ওরা। সেই সুবাদেই গতকাল সকালে ওরা প্রথমে রিমঝিমের বাবার বাড়িতে গেছিল। দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুরতে বের হয়। মেট্রোরেলে চড়া হয়নি বলে সিদ্ধান্ত নেয় উত্তরা দিয়াবাড়ি যাবে। সেখান থেকে ঘুরে এসে রেস্টুরেন্টে ডিনারে যায় রাত নয়টায়। তখনই দেখা হয় কল্লোলের এক অফিস কলিগের সাথে। কলিগ তার বউ-বাচ্চা নিয়ে ডিনারে এসেছে। অল্প সাক্ষাতে আলাপটা বেশ জমে উঠেছিল তাদের। কল্লোল ওদের দুই বছরের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ভীষণ আদর করেছে। চকলেট কিনে দিয়েছে। কলিগের বউ হাসি মজায় একসময় বলেই ফেলেছিল,

“বিয়ের তো কয়েক বছর পেরোলো। এবার বেবি নিয়ে নিন। বেশি বয়সে বাচ্চা পালতে এনার্জি থাকে না। জেনারেশন গ্যাপে পড়ে সন্তানের সঙ্গে ডিস্টেন্স বেড়ে যায়। সময়মতো হলে বাচ্চারা বড়ো হয়ে এক সময় বন্ধু হয়ে যায়।”

রিমঝিমের মুখটা তখন বাতাসের সংস্পর্শে এসে প্রদীপশিখা যেমন নিভু নিভু করে তেমনই হয়ে গেছিল। কল্লোল সেই প্রকম্পিত, ভীতু শিখাটি আগলে ধরে দৃঢ় স্বরে জবাব দিয়েছিল,
“আমরা একে অপরকে আগলে রেখে বৃদ্ধ হতে চাই। আমরাই আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।”

“তবুও বাচ্চা হলো উত্তরাধিকার। সম্পর্কের সেতু। বন্ধন দৃঢ় করে।”

পালটা জবাব এসেছিল বন্ধুপত্নীর থেকে। অন্যের ব্যক্তি জীবন, পছন্দ, রুচি নিয়ে মন্তব্য না করার শিষ্টাচার অনেক সভ্য মানুষেরও নেই। কল্লোল তাতে পরাস্ত হলো না। সন্তর্পণে বিরক্তি চেপে মধুর হেসে বলেছিল,
“তাহলে বলতে হবে সেই সম্পর্কের শেকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি। তাই সন্তানকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে সম্পর্কটা ধরে রাখা শুধু। সন্তান বন্ধন দৃঢ় করতে নয়, বরং দৃঢ় বন্ধনের উপহার হিসেবে জন্মানো উচিত। যদি তা না হয়ে শুধু সামাজিকতা রক্ষায় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায় থাকে তবে সেই দাম্পত্য দুজনের কাছে বোঝা হয়ে যায়। বাচ্চার মুখের দিকে চেয়ে একটা বোঝা বয়ে যেতে হয় সারাজীবন। সন্তান সৃষ্টিকর্তার অশেষ নেয়ামত। জীবনের অমূল্য সম্পদও। এতে কোনো সন্দেহ নেই। জীবনচক্রের নিয়মেই তারা জন্ম নেয়। পরিবারের মায়া, মমতার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। বংশ পরম্পরা প্রবাহিত হয়। তাই বলে বাচ্চাই সম্পর্কের সব নয়। আল্লাহর নেয়ামত জীবনে নানানভাবে আসতে পারে। আমার কাছে স্ত্রী রূপে এক নেয়ামত এসেছে। তাকে জীবন দিয়ে আগলে রাখাই এই স্বামীর সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য।”

উত্তরে বন্ধুপত্নীর মুখ কালো হলেও রিমঝিমের মুখশ্রীতে তখন স্বামী ভাগ্য নিয়ে গৌরবের সুখ ধরা দেয়। ফেরার পথে বন্ধুপত্নী রিমঝিমকে একান্তে বলেছিল,
“ভাবি কি ফিগার নিয়ে কনশাস নাকি? ভালো মেইনটেইন করছেন নিজেকে। ভাইয়া তো দেখি একদম দিওয়ানা আপনার ওপর। কিন্তু যত নীতিকথাই বলুক না কেন, দিনশেষে সংসারে বাচ্চাটাই সব। কতশত সুখের সংসার ভেঙে গেল বাচ্চার জন্য! নাকি আপনাদের অন্য কোনো সমস্যা?”

বাচ্চার অধ্যায়টা রিমঝিমের মনে এক দগদগে ঘা। যা কখনো পূরণ হবে না, আক্ষেপও যাবে না। কেউ যখন তা নিয়ে কথা বলে ঘায়ের ক্ষতটা যেন পুনরায় তাজা হয়ে ওঠে। বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ও মিষ্টি হেসে বলেছিল,
“ফিগার কনশাস নই, আমরা লাভ এন্ড রিলেশনশিপ কনশাস।”

বাড়ি ফিরে রিমঝিমের মনে অদ্ভুত এক বিষন্নতা বিরাজ করছিল। ঘুমানোর আগে কল্লোলের আদুরে আহ্বানেও সাড়া দেয়নি। অবশ্য ঘুমটাও হয়নি। সারা রাত জেগে ভাবছিল সে হয়তো স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভেবে স্বামীকে বাবা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত করছে। কল্লোল ওকে ভালোবাসে, মায়া করে বলেই আক্ষেপটা লুকিয়ে রাখছে। সবারই জীবনে ভালোভাবে থাকার অধিকার আছে। কল্লোলকে ও কেন বেঁধে রেখেছে? সে-ই তো রিমঝিমকে শিখিয়েছে ভালোবাসা জুলুম নয়, বেঁধে রাখা নয়, বরং ভালোবাসা পিঠে দুটি পাখা সৃষ্টি করে, উড়তে শেখায়। তবে কেন রিমঝিম স্বামীকে আবদ্ধ করে রাখবে? কেন তার অপূর্ণ জীবনে একজন সবল, সক্ষম মানুষকে ধরে রেখে কষ্ট দেবে? চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে কলিগের বাচ্চাকে আদর করা স্বামীর মুখখানি। কতই না চোখজুড়ানো ছিল সেই দৃশ্য!

চার বছর আগের সেই মেজর অপারেশনের পর রিমঝিমের আর কোনো শারীরিক সমস্যা না হলেও অতিরিক্ত চিন্তার রোগটা ধরা দিয়েছে। সকালে কল্লোলের অফিসে পরে যাওয়ার জন্য সাদা শার্টটা প্রেস করে দিতে দিতে ও বলল,
“শোনো, আমি তোমায় অনুমতি দিলাম। তুমি আরেকটা বিয়ে করো।”

কল্লোল নিরবে কিছুক্ষণ চেয়েছিল ওর মুখপানে। এরপর ছোটো করে জবাব দেয়,
“আচ্ছা।”

আচ্ছা! জবাবে রিমঝিমের হাত থমকে গেছিল। দেহ বিবশ হয়ে যায়। ও ভেবেছিল কল্লোল আপত্তি তুলবে। অন্তত ওকে সান্ত্বনা দিতে হলেও। কিন্তু কল্লোল তার কিছুই করল না! তবে কী সেও মনে মনে এমনটাই চায়? গতকালের কথাটা পুনরায় কানে বাজে রিমঝিমের। সম্পর্কের আসল দৃঢ়তা বুঝি বাচ্চাই! ওর স্থবিরতায় সাদা শার্টটা তখন প্রায় জ্বলে যাওয়ার পথে। পোড়া গন্ধ নাকে লাগতেই কল্লোল ছুটে এসে দেখে শার্টে পোড়া দাগ লেগে গেছে। কঠিন একটা ধমক দিয়ে বলে,
“দিলে শার্টটা নষ্ট করে! মনোযোগ কই থাকে তোমার?”

সম্বিত ফিরে পেয়ে রিমঝিম লজ্জিত। তারচেয়েও আহত স্বামীর ধমকে। কল্লোল পারল ওর ওপর আওয়াজ তুলতে! চার বছরেই ক্লান্ত হয়ে গেল এই সংসারে! বহু কষ্টে চোখের জল সামলে বলল,
“তুমি নাশতা করে নাও। আমি আরেকটা শার্ট প্রেস করে দিচ্ছি…”

কল্লোল ততক্ষণে আলমারি থেকে আরেকটা শার্ট বের করে পরতে শুরু করেছে। না খেয়েই বেরিয়ে গেছে অফিসের উদ্দেশ্যে। এরপর সারাদিন রিমঝিমেরও খাওয়া হয়নি। অন্যদিন কল্লোল অফিসের ফাঁকে একবার কল বা ম্যাসেজ হলেও পাঠায়। আজ সেটাও করেনি। রিমঝিমের অভিমান ততক্ষণে পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়েছে।

কল্লোল বাড়ি ফিরল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামার পর। দরজা খুলে দিয়ে তার কাকভেজা রূপ দেখে রিমঝিম মুহূর্তেই ভুলে গেল সকল অভিমান। কঠিন গলায় বলে উঠল,
“দেরি করেই তো এসেছো, বৃষ্টিটা দেখে আসা গেল না? জানে অসুখ করবে তবুও সেই কাজটাই করবে!”

রিমঝিম তোয়ালে এনে কল্লোলের মাথা মুছে দেয়। একটা তোয়ালে! হ্যাঁ, একটা শুকনো তোয়ালের আবদার ও বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যা থেকেই তো শুরু হয়েছিল তাদের পথচলা। রিমঝিম দ্রুত ভেজা কাপড় বদলে নিতে তাগাদা দেয়। কল্লোল একটা কথাও বলেনি। হাবভাব একদম শান্ত। শুকনো কাপড় পরিধান করে এসে সে খেতে বসল। রিমঝিম পাশে বসে খাবার এগিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল,

“দেরি হলো কেন আসতে?”

“কাজ ছিল।”

“কী কাজ?”

“ঘটকের সঙ্গে দেখা করেছি। কিছু ভালো পাত্রীর সন্ধান দিয়েছেন। ঠিক করেছি আগামীকাল একজনকে দেখতে যাব। আম্মা-আব্বাকেও আসতে বলে দিয়েছি। শুভ কাজে তাদের পাশে রাখা প্রয়োজন।”

স্টিলের ডাল বেড়ে দেওয়ার চামচটা রিমঝিমের হাত থেকে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলল ফ্লোরে। কল্লোল তাতে সামান্যতম বিচলিত হলো না। নিজমনে খেয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখল অভিমানী স্ত্রী চোখের জল মুছতে মুছতে ব্যাগ গোছাচ্ছে। কল্লোল পকেটে হাত গুজে কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে,

“ব্যাগ গোছাচ্ছো যে?”

“বাবার কাছে চলে যাচ্ছি আমি। এখানে তুমি নতুন বউকে নিয়ে থেকো। আমি জ্বালাতন করতে আসব না।”

কল্লোল ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল,
“রাতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তারওপর বাইরে ঝড়-বৃষ্টি। আজকের রাতটা থেকেই যাও বরং।”

রিমঝিম কান্না ভুলে মর্মাহত চোখে চেয়ে থাকে। কল্লোল পারল এমন করে বলতে? একবারও প্রতিবাদ করল না! আটকাতে চাইল না! এতটাই অদরকারী রিমঝিম তার জীবনে! ও তখনই বেরিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু বাইরে আসলেই প্রবল ঝড় উঠেছে। গাড়ি মিলবে না। একটা রাত দাঁতে দাঁত চিপে আদর, মায়া, ভালোবাসায় গড়া সংসারে থাকার সিদ্ধান্ত নিল ও। ঘরে ফিরে রিমঝিম থম ধরে রইল। কল্লোল পাশে বসতেই বলল,

“তুমি পাত্রী দেখতে যাবে আম্মা জানে?”

“জানে।”

“রাজি হলো?”

“হ্যাঁ, হলোই তো। তুমি অনুমতি দিয়েছো এখানে কারো তো নিষেধ নেই। আমি তোমার কথা ফেলেছি কখনো?”

রিমঝিম বলহীন হয়ে গেল। শাশুড়ি মায়ের নয়নের মণি তার বউমা। সাবিনা ধার্মিক নারী। সর্বাবস্থায় মানেন এই জগত পূন্য সঞ্চয়ের স্থান। ইহলৌকিক হতাশায় না ডুবে পরলোকের জন্য আমল সঞ্চয় করা উচিত। তিনি রিমঝিমকে সর্বদা সাহস দিতেন। মাঝে মাঝেই বলতেন একটা অনাথ শিশু দত্তক নিতে। সেই তিনিই পারলেন ছেলের পুনরায় বিবাহের মত দিতে! বুক কাঁপল না! তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল ঠোঁটে। রিমঝিমের কথা রাখতেই কিনা বিয়ে!

কল্লোল রিমঝিমের চুল নিয়ে খেলছে। একপর্যায়ে ওর সারামুখে আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল,
“চলেই যখন যাচ্ছো তখন আজকের রাতটা স্পেশাল করে দিয়ে যাও।”

রিমঝিম বুঝল কথার অর্থ। রাগে, ক্ষোভে, হিংসায়, যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ অন্তরে এই কথাটা যেন আরো ঘি ঢেলে দিল। ভাবনাতীত হয়ে ও সম্মতি দিল কল্লোলের প্রস্তাবে। মনের সকল বেদনাকে ঠোঁটে ধারণ করে স্বামীর ওপর আগ্রাসী হলো। ঠোঁটের দখল নিল নির্মমভাবে। একপর্যায়ে গলাতেও বসায় চুমুর রুক্ষতা। গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয় কল্লোলের ঠোঁটে, গলায়, বুকে। বুকে দাঁত বসানো অবস্থাতেই রিমঝিম ফুঁপিয়ে ওঠে। কল্লোল তখন ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে,
“জোর শেষ?”

রিমঝিম ওর বুকে লুটিয়ে পড়ে কাঁদে। কল্লোল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“নতুন বিয়ে করলে কী কী হবে জানো তো? তোমাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরি নতুন বউকেও সেভাবেই ধরব। তোমাকে যতভাবে, যতস্থানে চুমু খাই, তাকেও খাব। তোমাকে বিছানায় যেভাবে…”

“কক্ষনো না, কক্ষনো না। তুমি আমার। শুধু আমার।”

রিমঝিম ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। এই মানুষটার বুকে সে ছাড়া অন্যকেউ মাথা রাখবে ভাবলেও পৃথিবী দুলে ওঠে। কল্লোল কৌতুকের সুরে বলল,
“কক্ষনো না মানে? বিয়ে করব অথচ স্পর্শ করব না? তাহলে আমি বাবা হবো কী করে? তুমি তো আমার বাবা হতে না পারার আক্ষেপে ম’রে যাচ্ছো।”

রিমঝিম জবাব দিতে পারল না। কান্নার দমকে তার কণ্ঠরোধ হয়েছে। অস্তিত্ব সংকটাপন্ন মন নেতিবাচক ভাবনাকে আকর্ষণ করতে পছন্দ করে। রিমঝিমের বেলায় তার ব্যতিক্রম হলো না। বিয়ে করলে বাকি সম্পর্ক তো অবধারিত ও অধিকারসুলভ। কল্লোল একবার প্রতিবাদও তো করল না। অর্থাৎ তার সম্মতি সুস্পষ্ট। রিমঝিম উঠে গেল স্বামীর বুক থেকে। হাঁটুতে মুখ গুজে বসে রইল খাটের কোণায়।

কল্লোল উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ঠোঁট, বুক, গলা পর্যবেক্ষণ করে আফসোসের সাথে বলে,
“দাগ করে দিলে! এখন পাত্রী দেখতে যাই কেমন করে? পাত্রী তো দেখেই বুঝে ফেলবে তার হবু সতীনের সঙ্গে আমার দাম্পত্য কতটা মধুর। বিয়ের পর আমার ঠোঁটে চুমু খেতে চাইবে তখন?”

রিমঝিম মুখ না তুলেই ক্ষিপ্ত স্বরে জবাব দিল,
“দুদিন পরে যাও পাত্রী দেখতে। কাল সকালেই দাগ দূর হওয়ার মলম কিনে আনবে। সকাল বিকাল মাখবে তাহলেই মিলিয়ে যাবে। এরপর দেখবে পাত্রী বিয়ের আগেই চুমু খেতে রাজি হয়ে গেছে।”

“ওহহ আচ্ছা! আমার ঠোঁট বুঝি এতটাই লোভনীয়? আগে তো বলোনি।”

জেদে রিমঝিম বিছানায় হাত-পা ছুঁড়ে হেঁচকি তুলে কাঁদে। কল্লোল ঠোঁট টিপে হাসি লুকিয়ে বিছানায় আসে পুনরায়। শক্ত হাতে রিমঝিমের ঘাড় চেপে ধরে নিজের কাছে টানে। দুহাতের সবল বন্ধনে বন্দি করে ওর কানে কামড় বসায়। শৃঙ্গারের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করে বলল,
“পাত্রী দেখতে আগামীকালই যাব আমি। তার আগে কামড়ের শোধ তুলতে দাও সোনা।”
__________________

একটি আবেগঘন রাতে দুটি মনে ভালোবাসার জোয়ার উঠেছিল। দুজন দুজনায় ডুবে সকল ইহজাগতিক দুঃখের কথা বিস্মরণ হয়েছিল। শরীর, মন, ইন্দ্রিয় নতুন করে উপলব্ধি করেছিল তারা একে অপরের জীবনে ঠিক কতটা জুড়ে আছে। অপর মানুষটাকে ছাড়া কতটা অসম্পূর্ণ তাদের সত্ত্বা। দুটি মনে জমে থাকা সমস্ত মেঘ ভালোবাসার জল হয়ে ঝরে গেছিল। ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়, ধারণ করে স্নিগ্ধ মেঘমেদুর রূপ, তেমনই স্নিগ্ধ, তুষ্ট, মেঘমেদুর হয়েছিল যুগলের মন।

রাতের সমাপ্তিতে গতকালের সকল আলোচনার, উৎকণ্ঠার সমাপ্তি ঘটবে এমনই ছিল রিমঝিমের ভাবনা। কিন্তু তেমনটা হলো না। কল্লোল সকালেই ঘোষণা দিল আজ সে পাত্রী দেখতে যাবে। রিমঝিমকেও ছেড়ে আসবে তার বাপের বাড়িতে। ভেজা চুল তখনও শুকায়নি অনুরাগিনীর। গায়ে তখনও রাতের লাজুক আবীর মাখা। এমন মিষ্টি মুহূর্তে স্বামীর মুখ নিসৃত বাক্য ওর কাছে বিষবাক্য মনে হলো। আবারও শঙ্কাগ্রস্ত উৎকণ্ঠা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। চোখে ভিড়ল স্বচ্ছ জলের ফোয়ারা। তবে কী রাতের সেসব মুহূর্ত শুধুই উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ ছিল! কল্লোল আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বলে চলেছে,

“শুধু হিংস্র বাঘিনীর দাঁত ও নখের আঁচড়গুলো নিয়ে ঝামেলায় পড়লাম। বুকেরগুলো শার্টে ঢেকে যাবে, গলারটাও নাহয় টাই পরে সামলে দিতে পারব৷ কিন্তু ঠোঁটেরটা! উম…পাত্রীকে ম্যানেজ করতে হবে এলার্জি বলে। আগের বউয়ের সাথে সখ্যতা আছে সেটা প্রকাশ করা যাবে না ভুলেও। বোঝাতে হবে বউয়ের সাথে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। তাই না রিমঝিম?”

রিমঝিমের মুখটা তখন দেখার মতো। ফুলকো লুচিও বোধহয় এতটা ফোলে না। রিমঝিম হাতের কাছে চিরুনি পেয়ে সেটাই ছুড়ে মেরে অসহ্য স্বরে বলল,
“আজকে, এই মুহূর্ত থেকে তেমনটাই হবে।”

রিমঝিম চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কল্লোল তা খেয়াল করে ঠোঁট উলটে বলল,
“এখনই চলে যাবে?”

“তো কী তোমায় বরবেশে সাজিয়ে দিয়ে যাব? বলো তো বাসরটাও সাজিয়ে দিয়ে যাই?”

“সে আমিই পারব। তোমায় কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু আজ তো আম্মা-আব্বা আসবে। আম্মাকে দর্শন না দিয়েই চলে যাবে? বউমা তুমি। আপ্যায়ন করা কর্তব্য।”

কল্লোলের হেয়ালিতে রিমঝিমের সর্বাঙ্গ জেদে কাঁপছে। তবুও ঠিক করল শাশুড়ি আসা পর্যন্ত থাকবে। ও দেখতে চায় শাশুড়ি আম্মা ও তার আদরের সুপুত্র কীভাবে তার সামনে দিয়ে পাত্রী দেখতে যায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। আম্মার দেখা নেই। রতনের মা সব শুনে হায় হায় করে কেঁদে ওঠেন। হতে পারেন তিনি কাজের লোক কিন্তু এ বাড়িতে একজন সদস্যের মতোই থেকেছেন। রিমঝিমকে অসম্ভব স্নেহ করেন। কল্লোল বউকে তাড়িয়ে দিচ্ছে শুনে তিনি কাজ ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। এক পুত্রের জননী রতনের মাকে তার স্বামী ছেড়ে দিয়ে অন্য নারীর হাত ধরে চলে গেছেন। পুত্র সন্তান দিয়েও স্বামীকে ধরে রাখতে পারেননি। আর এদিকে সন্তানের জন্য রিমঝিমকে ছাড়বে কল্লোল! কি বিচিত্র মানুষের চাহিদা, বিচিত্র জীবনযাত্রা। রতনের মা গা’লি দেন কল্লোলকে। রিমঝিমকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,

“কাইন্দো না বউ। পুরুষের জাতটাই খারাপ। একলা থাকলে বউ চাই, বউ পাইলে বাচ্চা চাই, বউ-বাচ্চা দুইডাই পাইলে তহন অন্যকিছু চাই। হেগো চাহিদার শেষ নাই। মাইয়াগো জীবন শেষ হয় হেগো চাহিদার যোগান দিতে দিতে।”

কল্লোল বেশ ফুরফুরে মেজাজেই সারাবাড়ি বিচরণ করছে। একের পর এক হুকুম করে যাচ্ছে কাজের। রিমঝিম থম ধরে দূরে সরে আছে। কল্লোল উঁকি দিয়ে বলল,
“চাচি, এককাপ চা দেবেন?”

রতনের মা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
“নিজে বানাইয়া খাও বাপ। আজকেরতন তোমার কাম আমি করমু না। ফুলের মতো বউ যে খেদাইতে পারে হের মতো পিশাচের কাম আমি করি না।”

অবস্থা বেগতিক বুঝে কল্লোল সরে গেল। তৈরি হয়ে এসে রিমঝিমকে বলল,
“আম্মা-আব্বা এসেছেন। কিন্তু সরাসরি তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। আমাদের ফাইনাল ফয়সালা সেখানেই হবে। তুমি প্রস্তুত হও। আমরা এখন সেখানেই যাচ্ছি।”

রিমঝিম ভেজা চোখে কল্লোলের সঙ্গে রওনা হলো মিরপুরের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে রতনের মাকেও নিল। বাড়িতে পৌঁছে একদম হকচকিয়ে গেল। সম্পূর্ণ বাড়িটা উজ্জ্বল আলোতে সাজানো। চেনা মুখের ছড়াছড়ি চারপাশে। দম্পতি পদার্পণ করতেই সকলে একযোগে উল্লাসধ্বনি করে ওঠে। আতশবাজি ফুটে সন্ধ্যার আকাশে আলোর ফোয়ারা ছোটে। রিমঝিম স্তব্ধ বনে যায়। কল্লোল ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলল,
“শুভ বিবাহবার্ষিকী, আমার রাণী। পাঁচটা বছর আমাকে সামলে রাখার জন্য আপনার প্রতি চির কৃতজ্ঞতা। আজকের এই শুভ দিনে আপনার সঙ্গে ভালোবাসার সুবর্ণজয়ন্তী পাড়ি দেওয়ার সৌভাগ্য প্রার্থনা করি।”

রিমঝিমের ধাতস্থ হতে সময় লাগল। এরপর ঝরনাধারার মতো আছড়ে পড়ল স্বামীর বুকে। এলোপাথাড়ি কিল, ঘু’সি মে’রে নাস্তানাবুদ কণ্ঠে বলে,
“বাজে লোক, তুমি আমার সঙ্গে এমন করতে পারলে?”

“পারলাম। আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার চিন্তা করেছিলে। তাই ছোট্টো করে একটু শাস্তি দিলাম। এখন শাস্তি শেষ হয়েছে।”

“পাঁচ বছর হয়ে গেল!”

“মাত্র পাঁচ বছর। আল্লাহ তায়ালা বাঁচিয়ে রাখলে পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকীও আমরা এভাবেই পালন করব, ইনশাআল্লাহ।”

ফুলের বর্ষণ মাথায় নিয়ে ওরা বাড়ির ভেতরে ঢুকল। তাহমিনা সদর দরজায় দুজনের অপেক্ষা করছিলেন। উনাকে দেখে রিমঝিম চোখ পাকিয়ে বলল,
“এই বাবার বউ, তুমিও ষড়যন্ত্রের পেছনে আছো তাই না?”

তাহমিনা এক গাল হেসে বললেন,
“পাগল মেয়েকে সামলাতে হলে একটু ষড়যন্ত্র করতেই হয়।”

“কাজটা মোটেও ঠিক করোনি। সবাই সেজেগুজে এসেছে। আর আমি বিরহে কাতর হয়ে ফকিন্নির বেশে চলে এসেছি। ইশ! কী লজ্জা!”

রিমঝিমকে লজ্জা পেতে হলো না। তার জন্য শাড়ি-গহনা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। রিমঝিমকে দিয়ে গতমাসে তাহমিনা সেসব পছন্দ করিয়ে রেখেছিলেন। কিনেছেন তা জানাননি। দুদিনের মানসিক চাপে রিমঝিমেরও আজকের দিনটার কথা মনে ছিল না। সুযোগ পেয়ে কল্লোলও সময়টার সদ্ব্যবহার করেছে।
লাল টুকটুকে শাড়িতে গোলাপের মতো রাজকীয় সাজ নিয়ে অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল রিমঝিম। কেক কাটল স্বামীর হাত ধরে। ডিনারের সময় সাবিনা ছেলের ঠোঁট দেখে ভ্রু কুচকে বললেন,
“তোর ঠোঁটে কী হয়েছে?”

রিমঝিম খুকখুক করে কেশে উঠল। যে ঠোঁটকাটা লোক, না জানি বলেই বসে। কল্লোল অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“পোকায় কামড়েছে। ওষুধ লাগিয়েছি, চিন্তা নেই।”

“এ আবার কেমন পোকা! এমন পোকার কামড় তো জন্মে দেখিনি।”

কল্লোল রিমঝিমের দিকে হেলে ফিসফিস করে বলল,
“এ হলো বউপোকা।” রিমঝিম নিজের কাণ্ডের কথা স্মরণ করে লজ্জায় মুখ নত করে রইল।

রতনের মা খাবার পরিবেশন করছিলেন। কল্লোলের কাছে আসতেই ও তেরছা চোখে চেয়ে বলল,
“তারপর চাচি, কাজ ছেড়ে দেবেন? মায়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দেব আপনাকে? কী যেন বলছিলেন পুরুষের জাত-ফাত খারাপ?”

রতনের মা ফোকলা হেসে বললেন,
“আমি কী জানতাম তুমি এইরকম কিছু করবা! এহন কথা শুধরাই লইতাছি। পুরুষের জাত খারাপ না। কিছু পুরুষ আসলে জাতছাড়া। আর কিছু পুরুষ তোমার মতো জাতের গর্ব।”

সমস্ত আয়োজনের সমাপ্তিতে বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। রিমঝিম শাড়ি-গয়না বদলে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তাদের ঘুমানোর ঘরটা প্রস্তুত করে দেয়। একমাত্র ননদ বর্ষা আজ অনুপস্থিত। গতবছর বিয়ে করে সে জাপান চলে গেছে। সেখানেই পড়াশোনা করছে। ভিডিও কলে শুভেচ্ছা জানিয়েছে ভাবিকে। শাশুড়ির ঘর থেকে ফেরার পথে রিমঝিমের পা থেমে গেল সুন্দর একটা দৃশ্য দেখে। আলমগীর সাহেবকে নিজের হাতে ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছেন তাহমিনা। পানি খেয়ে আলমগীর সাহেব মুখ মুছলেন স্ত্রীর আঁচলে। বিপরীতে তাহমিনা এমন ভাব করলেন যেন তিনি মহা বিরক্ত। অথচ তাদের দেখতে কি সুখী, পরিপূর্ণ মানুষ মনে হচ্ছে। একে অপরের ওষুধ খাওয়ার খেয়াল রাখা, পাকা চুল বেছে দেওয়া কিংবা অবসরে একসঙ্গে চায়ের কাপ হাতে গল্পগুজব করার মিষ্টি মিষ্টি মুহূর্তগুলো এখন এ বাড়ির নিত্য পরিচিত দৃশ্য। রিমঝিমের ঠোঁটে মিষ্টি হাসি উঁকি দেয়। জীবনে দুটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ও ভীষণ গর্ব করে। প্রথমটি হলো কল্লোলকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করা, দ্বিতীয়টি বাবা ও খালাকে বিয়ে দেওয়া।

রিমঝিম নিজের শোবার ঘরে ঢুকে দেখল কল্লোল থম ধরে বসে আছে। চশমা ঝুলে আছে নাকের ওপর। মাথাভরা কোকড়া চুল এলোমেলো। রিমঝিম এগিয়ে গিয়ে ওর চশমাটা নিয়ে নিজের আঁচলে কাচ মুছে দিল। এরপর আবার পরিয়ে দিল চোখে। বলল,
“স্বামী মহাশয়ের মুড অফ কেন?”

“কারণ এমন স্পেশাল দিনের শেষে মুডি বউয়ের স্বামীর দিকে খেয়াল নেই।”

রিমঝিম হাসল। পাশে বসে চওড়া কাঁধে মাথা হেলিয়ে বলল,
“আমার খেয়াল তোমাতেই শুরু এবং তোমাতেই শেষ, প্রিয়তম।”

“তাহলে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো কোন সাহসে?”

রিমঝিম মিনমিন সুরে বলল,
“তোমার ধারণা আমি মন থেকে বলি? মাঝে মাঝে খুব কষ্ট, তখন বলে ফেলি। যাচাই করে দেখি আমার মানুষটা আসলেই আমার আছে নাকি ফসকে গেছে।”

“যাচাই করে কী বুঝলে?”

রিমঝিম গলা জড়িয়ে ধরে, চোখে চোখ রেখে বলল,
“বুঝলাম, মন ও মনের মালিক দুটোই আমার। শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি এর দখল ছাড়ব না। কক্ষনো না।”

প্রিয়তমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু আঁকল কল্লোল। পরম যত্নে বুকে আগলে বলল,
“তুমিই আমার পূর্ণতা। তুমি না থাকলেই বরং আমি অপূর্ণ হয়ে যাব। তোমার রাগ, জেদ, অভিমান, অভিযোগ সব সহ্য করতে পারব কিন্তু দূরত্ব! উহু, এতটা সহ্যক্ষমতা আমার নেই।”

রিমঝিমের চোখে জল চলে আসে। সৃষ্টিকর্তা তাকে একদিকে অপূর্ণ করে বাকি সব দিকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। রিমঝিম আবেশে মিশে থাকে উষ্ণ বুকের ওমের সাথে। পাঁচ বছরে এই বুকের উষ্ণতম মমতায় সামান্যতম কমতি পায়নি ও। বরং সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে। পরিণত হয়েছে তীব্রতম আসক্তিতে৷ কল্লোল ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে ফিসফিস করে,

“রিমঝিম, তোমার সান্নিধ্যে আমার সমস্ত সত্ত্বা ঝিমঝিম করে।”

(অতঃপর সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here