#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
মধ্যাহ্নের তপ্ত দুপুর বেলায় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে চার বন্ধুর সাথে গল্পে মশগুল প্রিয়া। নীল, শ্রাবণ আর রাঢ়ী বসে আছে প্রিয়ার সম্মুখে। কিন্তু প্রিয়া ডুবে আছে অন্য ভাবনায়। সামনের পুকুরের দিকে তার অপলক দৃষ্টি।
কলেজের মধ্যভাগে বিশাল এক পুকুর। পুকুরের পশ্চিম ভাগে অনার্সভবনে প্রবেশের প্রধান রাস্তা আর তার পাশে রাষ্টবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস বিভাগের ভবন আর মেয়েদের রেষ্টরুম অবস্থিত। দক্ষিণমুখী বিজ্ঞান বিভাগের পিছনের দিকে এই পুকুরের অবস্থান। সেই জানালা দিয়ে পুকুরের স্নিগ্ধ বায়ু প্রবেশ করে অবলীলায়। কলেজ চলাকালীন এই পুকুরে গোসল নি*ষিদ্ধ। প্রতিবছর এই পুকুরে কলেজের সাতার প্রতিযোগিতা হয়। উত্তরে ফেণী কলেজের বিট্রিশ আমলের নির্মিত বিশাল মূল ভবন যেখানে স্নাতক (পাস কোর্সের) ক্লাস হয়। এই ভবন ফেণী কলেজের আসল ঐতিহ্য যা যেকোনো বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়। পূর্ব দিকে কলেজ ক্যান্টিন যা কৃষ্ণচূড়া গাছ দ্বারা আবৃত। বসন্তকাল এলে কৃষ্ণচূড়া গাছ লাল নববধূতে পরিণত হয়। ক্যান্টিনের পাশে কলাভবন আর বোটানি। পুরো কলেজের অবকাঠামো নির্মিত এই পুকুরকে ঘিরে। তাই তো প্রিয়ার এই জায়গা বেশ পছন্দ। কলেজের ক্লাস শেষ হলেই এখানে ছুটে আসে।
প্রিয়া যখন তার ভাবনায় নিমজ্জিত আচমকা কারো ডাকে তার ধ্যানভগ্ন হয়।
কিরে তুই যাবি না আমার সাথে রেলষ্টেশন। প্রিয়া অন্যমনস্ক দেখে পুনরায় এ কথা বলে উঠলো রাঢ়ী।
প্রিয়া চমকালো না। কিন্তু সে ভাবছে অন্যকথা। তার রণচণ্ডী মা যদি জানে কলেজ বাদ দিয়ে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাহলে তার অবস্থা কি হবে ভেবে। কিন্তু প্রাণপ্রিয় বান্ধুবিকে না’ বলতেও পারছে না। আজকে লুবনা আসলে এত সমস্যা হত না। নীল যাবে না তার কোচিং আছে। শ্রাবণও যেতে চাইছে না কিন্তু রাঢ়ীর অনুরোধে পরে রাজী হয়েছে। প্রিয়া না চাইতেও যেতে হবে রাঢ়ীর সাথে। একা একটা মেয়ে অচেনা ছেলের সাথে দেখা করতে যাবে বেশ বেমানান। অগত্য রাজী হলো সে।
রিকশায় চেপে তিনজনেই রেলষ্টেশনের দিকে যাত্রা করলো।
তিনজনকে ঠাসাঠাসি করে রিকশায় বসা অবস্থায় একজনের নজরে পড়লো। সে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে একটা ছেলের সাথে চিপকে আছে। যাচ্ছে কোথায় তার কৌতুহল হলো বেশ। তাই সেও পিছু নিলো তাদের।
তিনজন হাঁপিয়ে গেছে বেশ। দুপুরের রৌদটা বেশ গায়ে লাগছে তাদের। রাঢ়ী বেশ কয়েকবার মোবাইলের ডায়াল নাম্বারে কল করলো। কিছুক্ষণ পরে অপর পাশ থেকে মিষ্টি এক পুরুষালি কন্ঠস্বর কথা বলে উঠল এই তো চলে এসেছি। মাত্র দশমিনিট অপেক্ষা করো জানেমান।
শ্রাবন আর প্রিয়া দু’জনেই এক পাশে কথা বলছিলো। রাঢ়ী তার ফেবুতে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম হওয়া প্রেমিকের সাথে প্রথমবার দেখা করতে এসেছে। এর আগে কথা হলেও দেখা হয়নি। দীর্ঘ একবছর প্রেমের সম্পর্ক হওয়ার পর তাদের দেখা হচ্ছে। রাঢ়ীর প্রেমিক পুরুষের বাড়ী সিলেট শহরে। তাই সেই রেলগাড়ী চেপে সুদূর সিলেট থেকে দেখা করতে এসেছে।
রেলগাড়ী থেমে গেছে। এদিকে হন্য হয়ে রাঢ়ী এদিকে ওদিক খুঁজে চলেছে তার প্রেমিক পুরুষকে। রেলগাড়ীর দরজার অভিমুখে চেয়ে আছে অপলক। আচমকা হালকা পাতলা লিকলিকে এক ছেলেকে দেখে মুখের অভিব্যক্তি তার পরিবর্তন হয়ে গেলো। সে যার জন্য অপেক্ষা করছে সে এই ছেলে?
পাশে শ্রাবণ আর প্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তাদের নজরও পড়েছে সেই ছেলের ওপর। তিন জনেই থ’ হয়ে আছে। একে অপরের মুখ চাওয়া চাউয়ি করছে।
ছেলেটি তিনজনের সামনে এসে বলল আমার নাম টিটু। আপনারা কি আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রিয়া আর শ্রাবণ কিছু বলার আগেই রাঢ়ী সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখমুখ কুঁচকে বলল এই ছেলে তোমার বয়স কত? টিটু ঘাবড়ালো কিন্তু মুখে লাজুক হাসি দিয়ে বললো বয়স দিয়ে কি করবে জানেমান? রাঢ়ী অ*গ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। টিটু আবারও লাজুক হেসে বলল চৌদ্দ বছর। কিন্তু কেনো?
রাঢ়ী কষে একটা থা*প্পড় বসিয়ে দিলো টিটুর গালে। টিটুসহ প্রিয়া আর শ্রাবণও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। টিটু মুখে হাত দিয়ে বললো জানেমান থা*প্পড় কেনো দিছো? আমি কি করছি? টিটুর কথা শুনে রাঢ়ীর কান দিয়ে তপ্ত ধোয়া বেরুচ্ছে। ছিঃ! ভাবতেই তার শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠলো। এই ছেলে তার থেকে কম করে হলেও তিন বছরের ছোট। শেষে সে কিনা তার ভাইয়ের বয়সী একটা ছেলের সাথে প্রেম করতে গেছে। মনে মনে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ছে সে।
রাঢ়ী টিটুর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললো আর একবার জানেমন বললে বাকি গালও লাল করে দেবো বেয়া*দব। নাক চিপলে দুধ বের হবে সেই ছেলে আসছে সিনিয়রের সাথে প্রেম করতে। যেই গাড়ি করে আসলি সেই গাড়িতে আবার উঠ। বাড়ি যা অস*ভ্য বেয়া*দব ছেলে।
টিটু একহাত গালে রেখে বললো কিন্তু নাক চিপলে তো এখন দুধ বের হবে না সর্দি বের হবে জানেমান। টিটুর এ কথা বলতে দেরি কিন্তু রাঢ়ীর টিটুর শার্টের গলার ধরতে দেরি হয় না। শার্টের গলার ধরে তাকে টে*নে হিঁ*চড়ে নিয়ে যায় রেলগাড়ীর দরজার মুখে। তারপর চোখ গরম করে বললো যেভাবে আসছিস ঐভাবে ফিরে যা। টিটু হাটু গেড়ে বসে পড়ে। চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলল আমি তোমাকে ভালোবাসি তো। প্লিজ আমাকে যেতে বলো না।
রাঢ়ী নিরেট গলায় বলল আর একবার ভালোবাসি উচ্চারণ করবি তো তোকে আমি পুলিশে দিবো। ভালোই ভালোই যা বলছি। নয়তো আমার থেকে খারা*প আর কেউ হবে না। রাঢ়ীর এমন রুদ্রমূর্তি দেখে শ্রাবণ, প্রিয়া দু’জনেই হতবাক।
টিটু প্রিয়ার পায়ের উপর ঝাঁ*পিয়ে পড়ে। প্লিজ আমি যাবো না। রাঢ়ী কে বুঝান আপু। প্রিয়া আলতো হাতে টিটুকে তুলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝায় তুমি ছোটো এখনো। প্রেম ভালোবাসার বয়স হয়নি তোমার। তুমি ফিরে যাও ভাই। রাঢ়ীর বয়স আটারো আর তোমার চৌদ্দ। কিছু বুঝতে পেরেছো কি বলতে চাইছি।
দূর থেকে প্রিয়ার সাথে টিটুকে একান্তে কথা বলতে দেখে সৌরভ বেশ অবাক হলো। সে টিটুকে প্রিয়ার বয়ফেন্ড ভেবে নিলো। এই মেয়েকে সে নেহাৎ বাচ্চা মেয়ে ভেবেছিলো। কিন্তু এই মেয়ের স্বভাব চরিত্র পুরাই জ*গন্য। মনে মনে একরাশ ঘৃ*ণা ছুড়লো প্রিয়ার দিকে। পড়ালেখার নাম দিয়ে সে বয়ফেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
_____________
ঘড়ির কাটায় ৩টা তখন।
বাসায় প্রবেশ করতে ঘরের পরিবেশ বেশ থমথমে। মারিয়া অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রিয়ার কাঁধ থেকে ব্যাগের চেইন খুলে তার মোবাইল নিয়ে নিলো। তারপর শাসিয়ে বললো তোর আজ থেকে মোবাইল ব্যবহার করার দরকার নাই। কাল থেকে বাড়ি টু কলেজ আর কলেজ টু বাড়ি। এর বাইরে এক ইঞ্চি কদমও আর কোথাও রাখতে পারবি না।
প্রিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের এহেন আচরণ তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তাই শান্ত গলায় বললো আমি কি করেছি? আমার মোবাইল কিজন্য নিছেন?
মারিয়া এবার চেঁচিয়ে বললো আমি যে একটা চরিত্র-হীন মেয়ে জন্ম দিছি সেটা আজকে যদি সৌরভ না দেখতো তাহলে আমি কোনোদিন জানতেও পারতাম না।
প্রিয়ার রাগ মূহুর্তে দপ দপ করে জ্ব*লে উঠলো। মায়ের দিকে সেও অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো দেখো আম্মু দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বিশ ঘন্টায় তুমি মোবাইল চেক করো তাহলে আমি কি করি তুমি তো ভালোই জানো। ঐ ঘসেটি বেগমের কথা শুনে তুমি আমাকে এভাবে কথা বলতে পারো না।
মারিয়া সপাটে একটা চ*ড় বসিয়ে দিলো প্রিয়ার গালে। মুখে মুখে তর্ক করস। সৌরভ মুখে বলে নাই ভিডিও দিছে আমার ফোনে। আমি নিজে দেখছি সব।
প্রিয়ার রাগে-দুঃখে চোখের কোণে জল জমলো। তার মা তাকে বিশ্বাস করে না ঐ ব*জ্জাতকে করছে।
প্রিয়ার মাথায়ও রাগ চাপলো। উঠে দাঁড়ালো সৌরভের বাসার উদ্দেশ্য।
নাজমা আর মাসুদ তখন রুমে শুয়ে আছে। কলিংবেলের শব্দ শুনে শোভা দরজা খুলে দেয়। শোভা হাসি মুখে বললো কি ব্যাপার আজকে সূর্য কোনদিকে উঠেছে। তুমি তো আমাদের বাসায় আসো না। আজকে কি মনে করে এসেছো?
প্রিয়া কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো আপু তোমার ভাই ঘসেটি বেগম কোথায়?
শোভা বিস্মিত হয়ে বললো ঘসেটি বেগম কে?
তোমার ভাই বাসায় আছে?
শোভা মাথা নাড়ালো হ্যাঁ আছে তো। প্রিয়া আর কিছু না বলে শোভাকে পাশ কাটিয়ে সোজা সৌরভের রুমে ঢুকে পড়লো।
শোভা হতবাক হয়ে চেয়ে আছে প্রিয়া যাওয়ার দিকে। এই মেয়েকে সে চিনে না।
সৌরভ আপনমনে মোবাইল ঘুতা*চ্ছিলো। গায়ে মেকি হাতার গেঞ্জি আর পরনে শুধু ফোর কোয়ার্টার প্যান্ট। আধা শোয়া হয়ে বসে আছে।
প্রিয়া সাত পাঁচ না ভেবে রাগের বশীভূত হয়ে তার ভাবনার অতীত একটা কাজ করে ফেললো। সে গিয়ে সৌরভের বুকের অংশের গেঞ্জির পুরোটা চেপে ধরলো।
আচমকা গেঞ্জি ধরায় সৌরভ হতভম্ব হয়ে যায়। বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো প্রিয়ার দিকে। সেও চক্ষুদ্বয় গোল করে বললো কি সমস্যা তোমার? গায়ে হাত দিছো কোন সাহসে?
প্রিয়া রাগে হিসহিস করতে করতে বললো আমার আম্মু বডিগার্ড রাখছে আপনাকে। বেতন দেয় প্রতিমাসে যার জন্য আপনি আমার পিছু করেন। আমি কি করি না করি তা ভিডিও পাঠান আম্মুকে। তা কত টাকা দেয় আমার আম্মু আপনাকে?
প্রিয়ার এহেন বাক্য শুনে সৌরভের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। সেও প্রিয়ার দুই হাত চেপে ধরে। সৌরভের এত কাছে আসা দেখে সে ধস্তাধস্তি শুরু করে দেয়।
প্রিয়ার আগে হুঁশ ছিলো না সে কি করছে। কিন্তু এখন অস্বস্তিতে মাথা নামিয়ে ফেলে। সৌরব বুঝতে পারে প্রিয়া অস্বস্তি অনুভব করছে। মনে মনে ভাবে এই মেয়ে বাইরে ছেলের সাথে চিপকে থাকে যে তখন অস্বস্তি লাগে না?
প্রিয়া ল*জ্জায় চোখ নামিয়ে রেখেছে। এত কাছে কোনো পুরুষের সে কখনো যায়নি। এই সার্কাস তার একদম কাছে তার নিশ্বাসের শব্দও সে শুনছে। ধস্তা-ধস্তি করেও হাত ছুটাতে পারছে না।
সৌরভ হাত ছেড়ে দিলো। তারপর কপাল কুঁচকে বললো এই কথা আমার রুমে আসার আগে মনে ছিলো না বেয়া*দব। একটা অবিবাহিত ছেলের ঘরে এসে তার কলার ধরা। আমি কি করতে পারি তার আইডিয়াও নাই তোমার?
যা বের হও আমার ঘর থেকে।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,
আপনাদের কাছে সৌরভকে কেমন লাগে? প্রিয়ার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন। আপনাদের আইডিয়া শেয়ার করুন আমার সাথে। ধন্যবাদ।