#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_১৯
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
দুই রাস্তার মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়ানো প্রিয়া। দুই পাশেই গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে। দোটানায় আটকে আছে সে। বাড়ি ফিরবে নাকি আজ অন্যকোথাও যাবে। তার মন আজ ভীষণ বিধ্বস্ত। নিজেই জানে না তার প্রধান কারণ। হৃদগহীনের প্রতিটি কোণে সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তার। মন কানন তার ভষ্ম হয়ে যাচ্ছে। দগ্ধ হওয়া মন শেষে সিদ্ধান্ত নেয় আজ প্রীতিদের বাড়ি যাবে। যদি তার ভঙ্গুর হৃদয়ের কিছুটা কষ্ট লাগব হয়।
প্রীতিদের বাড়ি যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের মতই। মারিয়াকে সে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সে বাড়ি ফিরবে না।
প্রীতি প্রিয়াকে দেখে খুশিতে আত্মহারা। মোহনাও খুশি বোনঝিকে দেখে। অনেকদিন পর প্রিয়া খালার বাড়ি গেছে। মোটামুটি বাড়িতেই সবাই খুশি তাকে দেখে। মোহনা প্রিয়ার জন্য তড়িঘড়ি দেশী মুরগী আর পুকুরের তাজা মাছ ফ্রিজ থেকে নামালেন। মেয়েটা কতদিন পর আসলো তার বাড়ি। ভালো মন্দ না খাওয়ালেই তার মন অশান্তিতে ভরে থাকবে।
প্রিয়া খালার এরকম আতিথেয়তা দেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। তার জন্য এত কিছু করার কি দরকার ছিল?
মোহনা মারিয়াকে কল দিলো,
আপা তোরাও আয়। দুলাভাইও কতদিন হয়ছে আসে না। তোরা শহরে গিয়ে আমাদের ভুলেই গেলি। প্রিয়া তো মাঝে মাঝে আসে খালার বাড়ি। অন্তত ভাবে তার একটা খালা আছে। কিন্তু তুই কত হারা!মি নিজের বোনরে মনে নাই তোর।
মারিয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলো বোনের কথা শুনে। সে কি করে যাবে। তার তো সে সময় নাই। আনোয়ারের স্কুল বন্ধ হয় না। ছেলে মেয়েদের স্কুল/কলেজ প্রাইভেট টিউশন করতে করতে সময় চলে যায় তার। যেতে তো তারও মন চায়। কিন্তু যাওয়া হয় না আজকাল। বোনকে সান্ত্বনা স্বরূপ বলল,
দেখ তুই তো সব জানোস, আমি কিভাবে যাই বল? তোর দুলাভাই তো স্কুল থেকে ছুটি পায় না। তাই আর যাওয়া হয় না। তুই আয় সবাইকে নিয়ে।
মোহনা আর কথা বাড়ায় না। আইচ্ছা, আপা এখন রাখি। প্রিয়ার জন্য রান্না বসায়ছি। সেগুলো দেখি। মোহনা কল কেটে দেয়।
ভারাক্রান্ত মনে মোহনা নিজ ভাবনায় ডুবে গেলো। তার স্বামী আগে প্রবাসী ছিলো। ভালই ছিলো তাদের অবস্থা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে তার স্বামী হাসিব আজ বাড়িতে। ক্ষেত-খামার করেই চলে যায় তাদের জীবন। তাই কোথাও একটা যায় না। বাড়িতে তার গরু, হাঁস-মুরগি, পুকুরে মাছ চাষ আর ক্ষেত খামারি করেই দিন চলে। তার আপার অবস্থা তার থেকে অনেক ভালো। তার দুলাভাইয়ের পরিবার অনেক আগে থেকে বিত্তশালী। এত বিত্তবান হয়েও তার দুলাভাই একদম মাটির মানুষ। তাই মা-বাপবিহীন হয়েও সে আজ পরিবার ছাড়া হয় নাই। তার আপা তার ছায়া। সব সময় তাদের দেখা-শোনা করে আসছে। আলগোছে দুই চোখের জল মুছে নেয় মোহনা। “আলহামদুলিল্লাহ” এখন ভালো আছে সে।
খেতে বসে প্রিয়া যারপরনাই অবাক। তার খালা এত কম সময়ে এত রান্না কখন করলো। প্রীতিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রিয়াকে ঢুসে ঢুসে যেনো খাওয়ানো হয়। প্রীতির সাথে আছে তার বোন পিয়না। সেও বসে আছে প্রিয়ার অ্যাপায়ন করার জন্য। খাবার খেতে বসলে হাসিব আসে। প্রিয়াকে দেখে এক প্রাণখোলা হাসি উপহার দেয়। মেয়েটাকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। প্রিয়া তার আঙ্কেলকে দেখে সালাম দেন। কিছুক্ষণ বাক্য বিনিময় শেষে হাসিবও খেতে বসে।
টুকটাক কথা শেষে সবার খাবার খাওয়া শুরু হয়। তাদের সাথে মোহনাও যোগ দেয়।
_______________
শোভা পুরো শপিংমল ঘুরেও মনের মত জামা খুঁজে পেলো না। সে মনে মনে ভীষণ হতাশ। তার ভাইয়ের জন্মদিন অথচ সে আনকমন কিছু খুঁজেই পেলো না।
নিজের জামা রেখে শেষে তার ভাইদের জন্য নিলো। এটা তার দেওয়া প্রথম উপহার হবে তার ভাইদের জন্য।
বাসায় এসে বেশ অবাক হলো শোভা। এখনো অনেক কাজ বাকি। নাজমা তো কাজের জন্য ফুরসতই পাচ্ছে না। তার ছেলের জন্মদিন বলেই অনেক কেই নিমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে তাদের পুরো বিল্ডিং এর সবাইকে। কিছু তার ছেলের মেয়ের বন্ধু-বান্ধবও থাকবে।
শোভা প্রিয়াকে ডাকতে তাদের বাসায় যায়। কিন্তু প্রিয়াকে না দেখে চরমভাবে হতাশ হয়। এই মেয়ের আজকেই বেড়ানোর দরকার ছিলো। সে কল করে প্রিয়াকে। কিন্তু মেয়েটা তার কল উঠানোর নামই নাই। সে মনে মনে ভীষণ ক্ষেপলো প্রিয়ার উপর।
বাসায় ফিরে আসে নিকষ কালো মুখ নিয়ে। মাসুদ মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করে। শোভা ভারাক্রান্ত মনে ছোট্ট করে বলে,
প্রিয়া নাই।
“কোথায় গেছে?”
“খালার বাড়ি গেছে ঘুরতে।”
মাসুদ আর কথা বাড়াই না। তার অনেক কাজ বাকি আছে। সৌরভ এখনো ফিরে নাই। ছেলেটাকে বলা হয় নাই আজকে তার জন্য এত বড় আয়োজন করেছে। শোভা বলতে দেয় নাই। সে ভাইকে সারপ্রাইজ দিবে। তার জন্যই সৌরভকে অনুষ্ঠান সম্পর্কে গোপন রাখা হয়েছে। ছেলেটা আসলে ভীষণ খুশি হবে।
_____________
বিকেলে খোলা মাঠে প্রীতি, পিয়নার সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে প্রিয়া। সাথে তার মোবাইল নামক যন্ত্র নিয়ে আসেনি। অত প্রয়োজনীয় কল আসার নেই তার। তাই এত তাড়াও নেই এই যন্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরার। নির্বিঘ্নে সে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে আপনমনে। দুপুরের বিষন্ন মন কিছুটা হলেও এখন ভালো আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে।
সেই বিকেলে বেরিয়েছে তারা। এখন গোধূলি লগ্ন। সন্ধ্যে হওয়ার আগে বাড়ি ফিরতে বলেছে তাদের।
বাসায় এসে এক ঝটকা খায় প্রিয়া। মোবাইল নামক যন্ত্রকে সে সাইলেন্ট করে গিয়েছিলো। কিন্তু মোহনার কাছে শুনলো তাকে সেই তখন থেকেই মারিয়া কল করছে। প্রিয়া নিজেও ভেবে পায় না তাকে এত কল কেনো দিলো? মোবাইল স্ক্রিনে নজর বুলাতে তার চক্ষু ছানাবড়া। পুরো ৮১টি মিসডকল জ্বল জ্বল করছে তার মোবাইল স্ক্রিনে।
মারিয়া, শোভা, নাজমা, মাসুদ, তারপর আরো অপরিচিত দুইটা নাম্বারও। প্রিয়া ভেবে পায় না কি এমন দরকার তাকে। তার ভাবনার দুয়ার বন্ধ করেই মারিয়াকে কল দিলো।
মারিয়া কল রিসিভ করে আর কিছু না বলে প্রথমেই আদেশ করলো বাসায় ফিরে আসতে।
প্রিয়া আসবে না বলে কল রেখে দিলো। মারিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না।
তার কিয়ৎক্ষন পরেই শোভা কল দিলো।
প্রিয়া কল রিসিভ করতে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় কিছু গা*লি দিলো। জলদি বাসায় ফিরতে বললো। প্রিয়া ভেবে পায় না তাকে সবাই বাসায় যেতে বলছে কেনো? সে শোভাকে জিজ্ঞেস করলো,
আপু বাসায় কেনো আসতে হবে? কোনো সমস্যা হয়েছে?
শোভা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো এই মেয়ে এরকম ছেদি কেনো? তার ভাইয়ের কপালে সত্যিই অনেক দুঃখ আছে। এই মেয়েকে মানানো এত সোজা নয়। অবশেষে সে বলল,
আজকে আমার ভাইয়ের বার্থডে। তাই তোকে বলছি আসতে। জলদি আয় বাসায়।
“তোমার ভাইয়ের বার্থডে আমি গিয়ে কি করব? তোমরা তো আছোই।”
শোভার ভীষণ রাগ হলো প্রিয়ার উপর। কোথায় সে এসে তার ভাইকে উইশ করবে তা ‘না সেখানে এই মেয়েই থাকবে না। শোভা অনেককিছু বলতে গিয়েও আর বলল না। চুপচাপ কল কেটে দিলো।
সন্ধ্যা ৭টার মাঝে সৌরভ বাসায় এসে পৌছায়। বাসায় প্রবেশ করতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। এত জমকালো আয়োজন তার বাসায়। জিজ্ঞেস করার আগেই তার গায়ে ফুল বর্ষণ হলো। শোভাসহ বাসার অনেক পিচ্চি মেয়েরাও যোগদান করেছে সেখানে। সবার হাতে ফুল আর পার্টি স্প্রে। সে প্রবেশ করতেই তার গায়ে স্প্রে করলো। সৌরভ একটু এগিয়ে যেতেই তার পিছনে থাকা আরেকটা অবয়ব দেখে সবাই বিমূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। শোভা একটা চিৎকার দিলো ভাইয়া বলে।
নাজমা তো হু হু করে কেঁদে উঠল।
পুরো বিল্ডিং এর মানুষ জমায়েত হয়েছে তাদের বাসায়। সবাইকে অ্যাপায়ন শেষে যে যার বাসায় ফিরে যায়। ড্রয়িং রুমের অবস্থা নাজেহাল। নাজমা অবশ্যই অনেকবার বলেছে ছাদে আয়োজন করতে। কিন্তু শোভা কট্টর ভাবে নিষেধ করেছে। কারণ তার ভাইয়ের বাগানের কোনো ক্ষতি হোক সে চাই না।
_______________
ঘড়ির কাটায় রাত ৯টা।
এত আয়োজন আর কোলাহলের মাঝেও সৌরভের চক্ষুদ্বয় কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে খুঁজে বেড়ালো। কিন্তু হাজার খুঁজেও সেই ব্যক্তির নাগাল সে পেলো না। মনে মনে হতাশ হলো। শোভা ভাইয়ের মনোভাব বুঝতে পারলো। তাই সৌরভ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তার কানের কাছে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল,
ভাইয়া যাকে খুঁজচ্ছো সেই মহান ব্যক্তি বাসায় নেই। খালার বাড়ি গেছে। আমি অনেক অনুরোধ করেও তাকে আনতে পারিনি। তার জন্য ভীষণ দুঃখিত।
সৌরভ বোনের এরকম অকপটে বলা বাক্যেই মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেলো। কিন্তু মুখে কপট রাগ দেখিয়ে বোনকে বললো,
আমি আবার কাকে খুঁজতে গেলাম। ফালতু বকবক করিস না’ তো?
শোভা মিট মিট করে হেসে উঠল। ঠিক আছে। তুমি যখন কাউকে খুঁজচ্ছো না আমিও এত কষ্ট করে বলার কি দরকার? থাকো তোমরা তোমাদের মত।
বোনের জ্বালায় সৌরভ ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। কিন্তু দু’চোখ তার হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গত পাঁচটা দিন তাকে দেখেনি। বুকের বাঁ-পাশে ভীষণ কষ্ট হয়েছে তার জন্য। আচমকা তার চোখ পড়লো বাড়ির সদর দরজায়। নিজের অজান্তে তার অধরযুগল প্রসারিত হলো। আপন মনে বিড়বিড় করলো,
“মহারানীর পদার্পণ হোক। অবশেষে আপনার দেখা পেলাম। বড্ড জ্বালিয়েছেন আমাকে। এবার আপনাকে জ্বালানোর পালা।”
চলবে,,,,,,,,,,,,
সৌরভ কি করতে পারে প্রিয়ার সাথে? আমি ভীষণ চিন্তিত?
“ব্যাই দ্যা ওয়ে বলেন তো কে এসেছে সৌরভের সাথে?”#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_২০ (ধামাকা পর্ব)
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
“এই যে ‘মহারানী ভিক্টোরিয়া’ পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছাদে আসবেন। আর ‘হ্যাঁ’ অযুহাত দিবেন তো আমি নিজেই আপনার বাসায় আসবো। তখন নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ হবে না।”
এমন একটা মেসেজ দেখে থমকালো প্রিয়া। সে মাত্রই শুয়েছে। রাতের খাবার প্রীতিদের বাড়িতেই খেয়ে এসেছে। তাই বাসায় এসে আর খাওয়া লাগেনি। মারিয়া আসার পর থেকেই প্রিয়াকে অনেক বকাবকি করেছে। তার নাকি ন্যূনতম বিবেকবোধও নাই। নাজমা, শোভা কতবার অনুরোধ করেছে তাকে আসতে। কিন্তু সে আসেনি এটাই তার অপ*রাধ।
প্রিয়া ভেবে পায় না ঐ সৌরবিদ্যুৎ এর বার্থডে হলে তাকে কেনো আসতে হবে? সৌরবিদ্যুত তার কিছু হয় না’কি? তাকে কেনো আসতে হবে? কিন্তু তার বাবা তাকে রাতে গিয়ে নিয়ে এসেছে। নয়তো তার আসার কিঞ্চিত ইচ্ছেও ছিল না। বাবা যাওয়ায় সে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে।
এখন তো তার মেজাজ আরও চটে গেছে সৌরবিদ্যুত এর ধমকানো মেসেজ দেখে। কিয়ৎক্ষন পায়চারী করে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো। তারপর মনঃস্থির করলো যাবে। তবে যাবার আগে ছোট্ট একটা কা*টার নিল নিজের সেফটির জন্য।
ছাদের বেঞ্চিতে বসে আছে সৌরভ। কারো ত্রস্ত পায়ে ছাদে এগিয়ে আসার শব্দ পেলো। মনে মনে বক্র হাসলো।
“আসুন প্রিয়ারানী আপনার অপেক্ষায় আছি।”
প্রিয়া নিশব্দে লম্বা এক দম ছাড়লো। তারপর ধীরে ধীরে সৌরভের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভীতিগ্রস্ত অন্তঃকরণ কিন্তু মুখে তার কাঠিন্যতা বজায় রেখে দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠল,
কেনো ডেকেছেন?
সৌরভ চমকালো না। আগের মতই নিশ্চুপ সে। নিশব্দে মিট মিট করে হাসছে। সে আগেই প্রস্তুত ছিলো প্রিয়ার এমন আচরণের জন্য। কিয়ৎক্ষন পরে সে মুখ খুললো। রসিকতার স্বরে বলে উঠল,
সালাম দোয়া কি জানো না না’কি ভুলে গেছো? একজন টীচারকে কীভাবে সম্মান দিতে হয় সে বোধটুকুও তোমার মধ্যে নাই দেখছি। How rude!
“আপনি নিশ্চয়ই সালাম দোয়া শিখানোর জন্য আমাকে ডাকেন নি। কেনো ডেকেছেন সেটা বলুন?”
সৌরভ ভেবে পায় না এইটুকুন মেয়ের এত জেদ কিসের? কোথায় এসে পাশে বসবে, খিল খিল করে হাসবে। আমাকে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করবে কেমন আছি তা ‘না, উকিলের মত জেরা শুরু করে দিয়েছে? সৌরভ ঠোঁট উল্টালো প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে। দৈবাৎ বলে উঠল,
“আমি তোমার কি হয়?”
সৌরভের এহেন প্রশ্নে প্রিয়া চমকে উঠল। থতমত খেয়ে গেলো সে। কি বলবে প্রতিত্তোরে তার জবাব খুঁজে বেড়ালো। সে আধো বুঝতে পারলোনা সৌরভ তার কি হয়? আমতা আমতা করে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
“মা,,নে?”
“আমি তোমার টীচার হয় ভুলে গেছো? সেজন্য আর একবার মনে করিয়ে দিলাম।”
প্রিয়া পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছে। সে তো অন্যকিছু ভেবে বসেছিল। অন্ত:করণে ঢিপঢিপ শব্দে এখনো প্রকম্পিত হচ্ছে তার বক্ষস্থল। হাত-পা অসাড় হওয়ার উপক্রম তাও নিজেকে সক্রিয় রেখেছে। পরবর্তী উত্তর কি দিবে সে নিজেই জানে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সৌরভ পরমূহুর্তে বলে উঠে,
“আমার জন্মদিনে সম্মানীয় টীচার হিসেবে তোমার থেকে উপহার পাওয়ার যোগ্য আমি। তো’ আমার উপহার কোথায়?
প্রিয়া কা*টার রাখা হাতের মুঠো শক্ত করে। এই সৌরবিদ্যুত তার কাছে উপহার চাইছে। সে তো যাই নি বার্থডেতে। তাহলে উপহার কেনো দিবে? সে নিশ্চুপ ভাবতে থাকে কি করবে এখন।
আচমকা সৌরভের দৃষ্টি গোচর হয় প্রিয়ার মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে। ত্বরিত সে বলে উঠে,
“তোমার হাতে কি? আমার জন্য উপহার নিয়ে আসছো। ওহহ, সামান্য উপহার বলে দিচ্ছো না। তাই না? কিন্তু আমার কোনো সমস্যা নেই। দাও তো কি নিয়ে আসছো?
প্রিয়া বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো সৌরভের দিকে। সে তো নিজের সেফটির জন্য কাটার নিয়ে আসছে। এটা সৌরবিদ্যুতকে দিবে কিভাবে? আতংকিত হয়ে ধরা গলায় বলল,
আস,,লে আমি কাটার নিয়ে এসেছিলাম। বাকিটা বলার আগেই সৌরভ ছোঁ মেরে তার হাত থেকে কাটার নিয়ে নেয়।
কাটার উলটে পালটে দেখে মিট মিট করে হেসে উঠল। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি স্বরে বলল,
“বাহ্! প্রিয়া’ তুমি তো দেখছি সত্যিই জিনিয়াস। জানো আমার কাটারটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভালোই করেছে এটা দিয়ে। তোমার কাটার উপহার হিসেবে পেয়ে আমি বেশ প্রসন্ন হয়েছি। অসংখ্য ধন্যবাদ।”
প্রিয়া যারপরনাই বিস্মিত সৌরভের কথা শুনে। তার মুখে কোন রা’ নেই। সে শুধু সৌরভের পরিবর্তনটা দেখছে। মাত্র পাঁচ দিনে একটা ছেলে এত দ্রুত কিভাবে পরিবর্তন হতে পারে। অবিশ্বাস্য!
সৌরভ কাটার পেয়ে খুশিতে বাকহারা। মিট মিট করে হেসে চলেছে। আকস্মিক প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“যাও বাসায় চলে যাও। অনেক রাত হয়ে গেছে।”
প্রিয়া হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। তার তো মাথা ভন ভন করে ঘুরছে এই সৌরবিদ্যুতকে দেখে। কিন্তু তারপরও নিশ্চুপে গট গট করে ছাদ থেকে নেমে আসে।
সৌরভ হাতের কাটার উঁচিয়ে ধরলো নিজের মুখের সামনে। আলতো করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা ছুঁয়ে নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের গভীর চুম্বন বসিয়ে দিলো তাতে। আর মানসপটে বার বার উচ্চারিত হলো।
“আমার প্রিয়র দেয়া প্রথম উপহার।”
______________________
বিবশ হয়ে বেশ অনেকক্ষণ বসেছিল প্রিয়া। বিছানায় বসে হাত দিয়ে অনবরত কাপড় খুঁটে যাচ্ছে সে। তার মস্তিষ্ক পুরো ফাঁকা হয়ে আছে সৌরভের আচরণে। অবশ্যই সেই দিন চাক্ষুষ দেখা দিঘির পাড়ের দৃশ্যপট তার অন্তঃকরণে উদিত হলো। নিজমনে বিড় বিড় করল,
নির্লজ্জ, বেহায়া, কাপুরষ আপনি। আপনি আমার জন্য এক ঘৃন্য পুরুষ।
বক্ষস্থলে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে সে ঘুমের অতলে ডুবে যায়।
প্রভাতের মৃদু বায়ুর আলতো ছোঁয়ায় প্রিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ পিটপিট করে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে ভোর ৫ঃ৪৫। তড়িঘড়ি উঠে তার সেই অতি পছন্দের কাজটা করার জন্য।
ছাদে এসে সতেজ এক নিশ্বাস নেয় প্রিয়া। সৌরভ আসার আগেই সে বাগানে পানি দিবে। এই কাজটা তার কাছে ভীষণ ভালো লাগে। তাই তো সৌরভ উঠার আগে ছুটে এসেছে সে। পানি দেয়ার জন্য সে ছুটে আগে পাইপ আনতে। পানির পাইপ ধরে আলতো হাতে গাছে পানি দেয়। কয়েকটা গাছে পানি দিয়ে মাত্র দাঁড়িয়েছে। আচমকা এক গম্ভীর গলার স্বর শুনে সে থমকায়। ত্রস্ত নয়নে তাকায় সে আগুন্তকের দিকে। সৌরভকে দেখে সে আৎকে উঠে।
সামনে থাকা আগুন্তক প্রিয়াকে দেখে মিষ্টি করে একটা হাসি উপহার দেয়। কোমল স্বরে বলে উঠে,
“হ্যাই কিউটিপাই”। ভোর সকালে বুঝি তুমি গাছে পানি দাও।
প্রিয়া বিস্ময়বাহ দৃষ্টিতে সৌরভকে দেখছে। এই ছেলের কি একরাতের মধ্যে মতিভ্রম হলো না’কি? কালকেও তাকে কত কি জ্ঞান দিলো? তার কাটার নিয়ে গেলো? শাস্তিস্বরূপ বাগানে কাজ করতে বললো। আর এখন ডং করে তাকে জিজ্ঞেস করছে পানি দাও ভোর সকালে? যত্রসব ডং! প্রিয়া সামনে থাকা আগুন্তকের কথায় পাত্তাই দিলো না। সে নিজমনে কাজ করছিলো।
এই যে কিউটিপাই তুমি কি বোবা! কথা বলছো না কেনো?
প্রিয়া রক্তিমচোখে তাকালো তার দিকে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
আপনার মাথায় ব্যামো আছে? নাকি ইচ্ছে করে ডং করছেন?
গৌরব মাথা চুলকালো। তার মাথায় ব্যামো কোত্থেকে আসলো? কিন্তু পরক্ষণে একটা ব্যাপার মাথায় আসার পর বুঝলো। আচ্ছা, এই কাহিনী! সেও পুনরায় মিষ্টি করে হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
তুমি কিন্তু অনেক কিউট! তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।
“ওরে মোর খোদা! আপনি তো দেখছি গিরগিটিকেও হার মানাবেন। ক্ষণে ক্ষণে এত পরিবর্তন আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না। কালকে রাতে দেখলাম আপনার একরূপ আর এখন দেখছি আরেকরূপ। তা ঢাকা গিয়ে কি আপনি গা*জা সেবন করে এসেছেন।
গৌরব মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছে প্রিয়ার কথায়। সেও প্রিয়ার কথায় সায় দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, খেয়েছি তো।”
অহহ, এজন্যই তো আপনাকে গা*জাখোরের মত লাগতেছে। কাল রাতেও আমি সন্দেহ করেছি যখন আমার কাটার উপহার হিসেবে নিয়েছেন।
গৌরব বিস্মিত নয়নে তাকালো। মনে মনে সে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। তারপর আবার পুনরায় প্রিয়াকে প্রশ্ন করলো,
আমাকে আর কিসের মত লাগে?
প্রিয়া এবার সন্দেহ করলো। এই সৌরবিদ্যুত হঠাৎ এত ভালো হয়ে গেলো কেনো? এত মিষ্টি মিষ্টি করে তার সাথে কথা বলছে। ব্যাপার টা অতি সন্দেহজনক। সে আর কিছু বলতে চাইলো না। কিন্তু গৌরব বলে উঠল,
তবে তুমি কিন্তু অনেক সুইট।
প্রিয়া বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো তার দিকে। বক্র হাসি দিয়ে বলল,
ভূতের মুখে রাম রাম,
জোকারের মুখে আমার সুনাম।
গৌরব প্রিয়ার ছড়া শুনে হো হো করে হেসে দিলো। মেয়েটা বেশ মজা করে কথা বলে। তার খুব ভালো লাগলো প্রিয়ার কথা আর হাসি। গৌরব আবারো বললো,
তুমি সত্যিই অসাধারণ!
প্রিয়া আর দাঁড়ালো না। এই সৌরবিদ্যুত এর মাথার সবগুলো তার ছিঁড়ে গেছে। তাই তো আবোল তাবোল বকছে আজকে। গট গট পায়ে নেমে পড়লো ছাদ থেকে।
গৌরব এখনো হাসছে। তার ভাইকে বেশ জব্দ করা যাবে এবার।
প্রিয়া বিরক্তিকর মুখ নিয়ে নিচে নামলো। যখন সে তিন তলার করিডোরের মাঝ বরাবর এসে হাজির আচমকাই সৌরভ দরজা খুলে বের হলো।
প্রিয়া ভূত দেখার মত চমকে উঠলো সৌরভকে দেখে। সৌরবিদ্যুৎ যদি এতক্ষণ বাসায় থাকে তাহলে ছাদে সে কার সাথে কথা বলেছে এতক্ষণ। ঐটা ভূত ছিলো না ‘তো? ব্যস প্রিয়া আর কিছু ভাবতে পারলো না। এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে মেঝেতে ঢলে পড়লো?
সৌরভ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়! এটা কি হলো?
চলবে,,,,,,,,,,,,,,
“ব্যাই দ্যা ওয়ে প্রিয়া কেনো সৌরভকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলো?”