#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ০৪
পাখিদের কলকাকলিতে স্নিগ্ধ ভোরের আভাস মিমের কর্নকুহরে প্রবেশ করতে লাগলো। আহা এমন সকাল! উপভোগ না করে, বেকার শুয়ে থাকার মানুষ মিম নয়।
আরেকটি নতুন ভোরের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতঙ্গতা জানিয়ে, মিম চোখদুটো খুলেই নিজেকে সবুজের বুকে আবিষ্কার করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মিম কালকে রাতের কথা মনে করার বৃথা চেষ্টা করলো। শুধু এটাই মনে পড়লো ওর কালকে রাতে বেশ জ্বর হয়েছিলো। এরমধ্যে সবুজ কখন, কি করে আসলো ওর কিছুই মনে পড়ছেনা।
নিজেকে সবুজের বাহুডোর থেকে ছাড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করলো, ওর গায়ে শাড়ী নেই। এদিক সেদিক তাকাতেই শাড়ীটা ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখললো। একটা অজানা বৃতিষ্ণায় ওর হৃদয়ে দাও দাও করে আগুন জ্বলতে লাগলো।
বেশ জোড়েসোড়েই ধাক্কা দিয়ে সবুজকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মুহূর্তেই আচমকা ঘুম ভেঙে যায় সবুজের। হতোবিহ্বল হয়ে মিমের দিকে তাকায় সবুজ।
” তোমার জ্বর কমেছে?  শরীর ভালো লাগছে।”
একহাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে সবুজ মিমের কপালে হাত রাখতে যায়।
মিম ঠাস করে সবুজের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। এরপরের মুহূর্তটা সবুজের কাছে একটা দুঃস্বপ্নের মত মনে হতে লাগলো।
মিম এর এই আচরণ এর কোন কারণ, অনেক ভেবেও যখন বের করতে পাচ্ছিলো না। তখন সবুজ আবিষ্কার করলো ওর বিয়ে করা বউ মিম ওকে সত্যিই চড় মেরেছে। আর ঘটনাটা অবিশ্বাস্য হলেও পুরা বাস্তব।
” মিম, তুমি কি সজ্ঞানে স্বইচ্ছায় এই চড়টা মারলে? তুমি কি এখনো জ্বরের ঘোরে আছো?”
” হ্যা, আমি নিজ ইচ্ছাতেই আপনার গালে চড় বসিয়েছি।
এখন মনে হচ্ছে চড়টা কম হয়ে গেছে। আমার আপনাকে খুন করতে ইচ্ছে করছে।
ছিঃ আমার অসহায় অবস্থায় সুযোগ নিয়ে আপনি আমার সাথে এটা করতেই পারেলেন? লজ্জায় আর ঘৃনায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
” মিম, সকাল সকাল কি আবুলতাবুল বকছো?
কি এমন করেছি? নাহ্ সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না।”
” বুঝতে পারছেন না। নাহ্
চাইছেন না।”
মিম ওর শাড়ী ফ্লোর থেকে তুলে নিজের গায়ে জড়াতে জড়াতে সবুজের দিকে কটাক্ষ করে তাকায়।
সবুজ, এইবার বুঝতে পারে মিম আসলে কি বলতে চাইছে।
” মিম, দেখো তুমি যা ভাবছো,  মোটেও সেরকম কিছু আমাদের মাঝে ঘটেনি।  ট্রাস্ট মি, আমি এরকম কিছু করতে পারিনা।”
মুহূর্তের মাঝেই মিম সবুজের বুকের কাছের শার্ট ধরে ধস্তাধস্তি শুরু করে দেয়।
” একদম মিথ্যে বলবেন না। চোরের মতো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে আপনার লজ্জা করলো না। আসলে সব ছেলেরা এক। তারা শুধু শরীর বুঝে, আর কিচ্ছু না।
আমার চোখের সামনে থেকে যান বলছি। আপনার মুখও আমি দেখতে চাইনা।”
” জাস্ট সেট আপ! মিথ্যে কোন অপবাদ  দিবা না।  তোমার শরীরের উপর আমার বিন্দুপরিমাণ লোভ নেই। যদি থাকতোই তবে জোড় করে হলেও তোমার কাছে যেতাম আর তুমি বাধাও দিতে পারতে না। লিগ্যালি তুমি আমার ওয়াইফ আর সেই অধিকারটা নিশ্চয় আমার ছিলো। শুধু তোমার ভালোবাসাই চেয়েছিলাম অন্য কিছু চাইনি। তবে যখন দায়িত্ব নিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছি তখন তোমাকে সুখি করার দায়িত্বটাও যে আমার। এরপর থেকে তুমি ঠিক যা চাও তেমনটাই হবে।”
আহত হয়ে সবুজ রুম থেকে চলে আসে।
হৃদয় জুড়ে  বিষাদের ছায়া নেমে এলো। শরীর মন জুড়ে কেবল লাগামহীন ঘৃনারা দল পাকাতে লাগলো।
এরপরের বিষয়গুলো বেশ দ্রুতই ঘটে গেলো। মিমকে চূড়ান্তরকমের অবহেলাপূর্ণ নাটকটা বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে গেলো সবুজ। কিন্তু এতোকিছুর পরেও আয়নার দাঁড়াতে সবুজের অস্বস্তি হতে লাগলো। ভেতরে ভেতরে খুব ভেংগে পড়তে লাগলো তবুও আচরণে তার লেশপরিমাণ চিন্হও বজায় রাখলোনা।
—————————–
সেইদিনের পর থেকে মিম খুব ডিস্টার্ব হয়ে থাকলো। ওর কাছে মনে হতে লাগলো, সেদিন হয়তোবা ও বেশীই রিএক্ট করে ফেলছে। এতোকিছু সবুজকে ও না বললেও পারতো। ইনফ্যাক্ট সেদিন সারা রাত জেগে সবুজ ওর সেবা করেছে আর বিনিময়ে পেয়েছে একগাদা অপমান আর অবিশ্বাস। এতো অবহেলা হয়তোবা সবুজ ডিজার্ভ করেনা। ওর অন্ততপক্ষে সবুজকে সরি বলা উচিৎ।   ইশ্ কেন যে তখন সবটা মনে পড়ে গেলোনা।
। ইদানীং খাবার টেবিল ছাড়া ওকে আর দেখাই যায়না। বাসায় থাকলে সারাক্ষণ  ঘুমায়।  কিছু বলতে গিয়েও মিম বারবার ফিরে আসে।  অজানা কোন সংকোচ বোধ ওকে কুড়েকুড়ে খায়।
দক্ষিনের জানালা খোলা, হু হু শব্দে ম বাতাস বইতে লাগলো ঘরের আনাচেকানাচে।  মৃদু মন্দ বাতাস আর বাইরের রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া মনকে
ব্যাকুল করে দিতে লাগলো।
মিমের বুকের ভেতরকার কেমন কেমন করা অনুভূতিটা, বারবার সমস্ত অনুভূতি ঠেলে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলো।
 ইদানীং সবুজকে কেন যানি অতোটাও খারাপ লাগেনা। একটুকুও বেমানান মনে হয়না।
ও ঠিক যা যা চেয়েছিলো তাই হচ্ছে। সবুজ আর ওকে যেচে বিরক্ত করতে আসেনা, প্রয়োজন ছাড়া আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যায়না। তবে এতকিছুর পরেও সবুজের দায়িত্ব কর্তব্যে  কিঞ্চিৎ পরিমাণ  অবহেলার ছাঁপ ও খুঁজে পায়না।
” হেই মিম, হুয়াট’স আপ?”
মিম কিছুটা অবাক হয়েই পিছনে তাকায়।
ঠোট বাকাঁ করা,  হাসি হাসি মুখ করে ছেলেটা ওর দিকেই অপলকভাবেই তাকিয়ে আছে।
মিম কিছুক্ষণ সময় নিয়ে অস্ফুট স্বরে মিনমিনিয়ে বলে উঠলো,
” মেঘ!”
” তাহলে চিনতে পারলি? আমিতো ভেবেছিলাম চিনবিই না।”
” কবে দেশে ফিরলে? আর  ছোট ফুপি, ফুফা কেমন আছে?”
” সবাই ভালো আছে। এইতো আজকেই ফিরলাম। কেন ভাইয়া তোকে কিছু বলেনি।
তবে দেশে ফিরে এইরকম একটা সারপ্রাইজ পাবো স্বপ্নেও ভাবিনি।  ”
” কি রকম? ”
” এই যে, তোর আর সবুজ ভাইয়ার বিয়ে। আচ্ছা তোকে কি এখন থেকে ভাবী ডাকতে হবে। ”
মেঘের মুখে ভাবী ডাক শুনে মিম খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। ওর কেন জানি এই ডাকটা শুনতে একটুকুও মন্দ লাগছে  না বরং বেশ লাগছে।
মেঘের চরম বিরক্ত লাগছে মিমের খিলখিল করে হাসা দেখে। এমনিতেও মিমের বিয়ের খবর শুনে ও কিঞ্চিৎ আহত হয়েছে।
ওর এখন একা থাকাটা খুবই জরুরী।
মেঘ দরজার দিকে পা বাড়ায়।
সামনেই সবুজকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়।
মিম খিলখিল    করে  হাসতে হাসতে,  সামনে না তাকিয়েই আবার বলে উঠে,
” আরে কোথায় যাচ্ছো? বসে যাও..। কতদিনপর এলে বলোতো ?”
সবুজ আড়চোখে মিমের দিকে তাকায় মিমের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ঠিকরে পড়ছে। একটা সুক্ষ্ম চিনচিনে নাম না জানা অভিমান, ওর সর্বাঙ্গে নদীর স্রোতের মতো বয়ে যেতে লাগলো। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো সবুজ। মিম চমকে সবুজের দিকে তাকায়।
 ঈষৎ  লালচেঁ চোখের  অন্তর্ভেদি দৃষ্টি, মিমের বুকের কাঁপন ধরিয়ে যায়।
দুজনের এই চোখাচোখি অবস্থা দেখে মেঘ ওখানে আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে সোজা চলে আসে।
” আজকে আসতে এতো লেট হলো যে?”
 কেন তুমি কি প্রতিদিন আমার খোজ রাখো?  আমি কখন বাসায় থাকি না থাকি?
মুখে এনেও কথাটা বললোনা সবুজ।
” মেঘকে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে গিয়েছিলাম?”
” আচ্ছা ফ্রেস হয়ে আসুন, ডিনারের টাইম হয়ে আসছে।”
” ইচ্ছে নেই। খেয়ে আসছি। তুমি খেয়ে নাও।”
” আপনি না আসলে মেঘ ভাইয়া কি মনে করবে?”
সবুজ মেঘের কথা শুনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিমের দিকে তাকায়।
” ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন?
আসুন.. ”
মিম সবুজের হাত ধরে টানতে লাগলো।
” আচ্ছা তুমি কি  মেঘের সাথে খাওয়ার জন্যই  আমার হাত ধরে  টানছো?”
মিম হাতটা ছেড়ে দেয়।
” কেন, আমি আপনার হাত ধরতে পারিনা?”
” কথা ঘুরিও না। যা জিজ্ঞাস করছি সেটাই বলো?”
” আমি যা জিজ্ঞাস করছি তার উত্তর আগে দিন।”
” আহা! আগেতো কুয়েশ্চেন আমি করেছি?”
” কুয়েশ্চেনতো কুয়েশ্চেন ই হয় আগে পরের তাতে কি যায় আসে। উত্তর দিলেই হয়।”
” নাহ, ভুতের মুখে রাম নাম শুনলে যেমন বোধ হয় আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হচ্ছে।।
আমি খেয়ে আসছি। তুমি মেঘকে খেতে দাও।  প্লিজ তুমি তোমার রুমে যাও। এখানে আর কষ্ট করে আসতে হবেনা।”
সবুজের কথা শুনে মিম নিভলো ।  একেবারে জ্বলে উঠা অগ্নিশিখার মতো নিভলো। সবুজ ওকে ইগ্নোর করছেনাতো? ব্যাপারটা মাথায় আনতেই ও ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেল।
চলবে..
 
             
		