#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২১
কানাডার দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত অন্টারিও প্রদেশের রাজধানী শহর টরোন্টো। এটি কানাডার সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক কেন্দ্র। দীর্ঘ ২১ ঘন্টা জার্নি শেষে যখন তাফসির ও শাহিন টরেন্টো এয়ারপোর্টে নামলো তখন সময় বিকাল ৪ টা বেজে ৫ মিনিট। সব প্রসেসিং শেষে তারা এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে এসে দেখলো তাদের আরেক কানাডিয়ান বন্ধু উইলসন তাদের রিসিভ করতে এসেছে। উইলসন এসে তাফসির ও শাহিনকে জড়িয়ে ধরে হাসি মুখে বলে উঠলো—
” হেই ব্রো হোয়াটস আপ? উই মেট আফটার এ লং টাইম।”
তাফসির মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে ইংলিশে জবাব দিলো—
” আমরা ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো? আর এটা মোটেও লং টাইম না। সবে মাত্র এক মাস ”
উইলসন আগের মতোই মুখে লম্বা হাসি টেনে বললো—
” সেটাও বা কম কিসে বলো। ”
” উইলসন আসলে অনেক দুর থেকে জার্নি করে এসেছি তো আমরা। তাই অনেক ক্লান্ত লাগছে। আমরা বাড়িতে যেয়ে কথা বলি প্লিজ? __পাশ থেকে বলে উঠলো শাহিন।
শাহিনের কথায় উইলসন ব্যস্ত হয়ে বললো—
” হ্যাঁ অবশ্যই। দেখেছো অনেকদিন পর তোমাদের দেখে একদমই ভুলে গিয়েছি যে তোমরা কতদূর থেকে জার্নি করে এসেছো। এসো আমার গাড়ি সামনেই রাখা আছে। বাকি কথা পরে হবে। ”
প্রায় ঘন্টাখানিকের পথ অতিক্রম করে অবশেষে তারা তাদের বাড়িতে পৌছালো। তাফসির ও শাহিনকে নিজেদের বাড়িতে পৌছে দিয়ে উইলসন তার নিজের বাড়ি চলে গেলো। এবং জানিয়ে গেলো যে সে রাতে আবার আসবে। ততোক্ষণে যেনো তাফসির ও শাহিন রেস্ট নিয়ে নেয়।
তাফসির এবং শাহিন দুজনের বেডরুমই আলাদা আলাদা। বাড়িটি দু’বছর আগে শাহিন এবং তাফসির মিলে কিনেছিলো। বাড়িটিতে তিনটি বেডরুম ও একটি লিভিংরুম। লিভিংরুমের সাথে কিচেন এডজাস্ট করা। অর্থাৎ লিভিং রুম থেকে কিচেন রুম ভালো ভাবেই দেখা যায়।
তাফসির জ্যাকেটের চেইন খুলতে খুলতে তার ঘরের সাথে লাগানো বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালো। এখানে বাড়িঘর গুলো বেশিরভাগই সব কাঠ বা বোর্ডের তৈরি হয়। ফলস্বরূপ তার বারান্দা ও কাঠের। বেশিরভাগ সময়ই তাফসির এখানে বসে কাজ সম্পন্ন করে। এখান থেকে সামনের লন ও বাড়ির সামনের রাস্তা সব স্পষ্টই দেখা যায়।
তাফসির উপরের মোটা জ্যাকেটটি খুলে বারান্দায় রাখা তার প্রিয় ডিভানে ছুড়ে মারলো। সাথে সাথে ঠান্ডা শীতল বাতাসে শরীরে কাঁপুনি ধরে গেলো। কিন্তু সেদিকে বিশেষ পাত্তা দিলো না সে। ফোনে এখানকার স্থানীয় সিমকার্ড লাগিয়ে ওয়াইফাই কানেক্ট করতে করতে কনটাক্ট লিস্টে থাকা প্রাচুর্যের নাম্বারে গেলো। এখন বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে রাত। সে দেনা মনায় পরে গেলো কল দেবে কি না ভেবে। রাত তো কম হলো না। এতো রাতে কারোরই জেগে থাকার কথা না। মিসেস ফারাহ বারোটা বাজলে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পরেন। এখন ফোন দিলে বিরক্ত করা হবে তাকে। তবে প্রাচুর্য কি এখনো জেগে আছে তার অপেক্ষায়? তাফসির ফোন দেবে না দেবে না করেও রিং বসালো প্রাচুর্যের নাম্বারে। তাফসির ভেবেছিলো প্রাচুর্য হয়তো ধরবে না ফোন কিন্তু প্রথমবার রিং হওয়ার সাথে সাথেই রিসিভ হলো ওপাশ থেকে। তাফসির খানিক অবাক হলেও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফোন কানে ঠেকালো। ওপাশ থেকে কোনো সারা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তাফসির হালকা কাতর স্বরে ডেকে বললো—
” প্রাচুর্য? ”
প্রাচুর্য ছোট্ট কন্ঠে জবাব দিলো—
” হুম ”
” ঘুমাস নি এখনো? ”
” না ”
” কেনো? ”
” এমনি ”
” শরীর খারাপ করবে তো ”
” ঘুম আসছে না ”
প্রাচুর্যের কথায় তাফসির চিন্তিত স্বরে বললো—
” কেনো? কি হয়েছে? ”
” কিছু হয় নি। আপনি ভালো ভাবে পৌঁছিয়েছেন? ”
” হুম। খেয়েছিস রাতে? ”
” হুম। আপনি? ”
তাফসির মৃদু হেসে বললো—
” এখানে এখনো রাত হয় নি ”
” ও হ্যাঁ তাই তো। দুপুরে খেয়েছেন? ”
” খেয়েছি ফ্লাইটে থাকতে। আচ্ছা সবাই কেমন আছে? মা কেমন আছে? ”
” বড় মা খুব কাঁদছিলো তাফসির ভাই। বড় বাবা অনেক কষ্টে সামলিয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন। ”
” মিস করছিস আমাকে? ”
তাফসিরের এমন প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলো প্রাচুর্য। সে কি বলবে এখন। এপাশে প্রাচুর্যের নিরবতা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসঁলো তাফসির। প্রাচুর্যকে আরেকটু জালাতে সে হাসি চেপে আবার টেনে টেনে ডাক দিলো—
” বউউউউ? বল না ”
তাফসিরের দুষ্টুমি এবার বুঝতে পারলো প্রাচুর্য। সে ঝটপট করে উত্তর দিলো—
” তাফসির ভাই আমার ঘুম আসছে অনেক। সকালে কলেজ ও আছে। আমি ঘুমাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ। ”
প্রাচুর্যের এমন করাতে তাফসির এবার একটু শব্দ করেই হাসঁলো। সে বেশ বুঝতে পারলো যে প্রাচুর্য লজ্জা পেয়েছে। তাই আর কিছু বললো না। ফোন নিয়ে এবার সে ঘরে চলে গেলো। অলরেডি ঠান্ডায় তার শরীর মনে হচ্ছে জমে গেছে।
অন্যদিকে প্রাচুর্য ফোন কেটেই উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিলো। এতোক্ষণ তাফসিরের সাথে কথা বলা কালীন তার লজ্জা লাগলেও এখন পুনরায় আবার কষ্ট হচ্ছে তার। একসময় এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পরলো প্রাচুর্য।
.
.
.
তখন বোধহয় সকাল ৭ টা। চোখের উপর রোদের আলো এসে পরতেই প্রাচুর্য ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই দেখলো মিসেস শাহানা জানালার পর্দা সরাচ্ছেন। তিনি জানালার পর্দা সরাতে সারাতেই উচ্চ আওয়াজে প্রাচুর্যকে ডাকতে শুরু করলেন। প্রাচুর্য কন্ঠে একরাশ বিরক্তি এনে বললো—
” আহ মা চেঁচাচ্ছ কেনো? ”
মিসেস শাহানা ঘুরে প্রাচুর্যকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন তার আগেই প্রাচুর্যের মুখ দেখে থেমে গেলেন। ফোলা ফোলা চোখমুখ দেখে আন্দাজ করলেন কিছু একটা। কিন্তু তবুও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এখন কিছু জিজ্ঞেস করলে মেয়েটা উল্টো লজ্জা পাবে। তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন—
” কলেজে যাবি না? ”
মায়ের মুখের হাসি দেখে প্রাচুর্যের বিরক্তি ভাবটা সাথে সাথেই চলে গেলো। সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বললো—
” যাবো মা। ভালো হয়েছে ডেকে দিয়েছো। নাহলে উঠতে পারতাম না আমি। ”
” আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে আয় তাহলে। আমি ততোক্ষণে খবার নিয়ে আসছি। ”
প্রাচুর্য রেডি হয়ে খেয়ে বাইরে আসতেই দেখলো ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। ড্রাইভারকে দেখে প্রাচুর্যের মন আবার খারাপ হয়ে গেলো। কেননা এতোদিন তো তাফসিরই তাকে কলেজে আসা-নেওয়া করতো কিন্তু এখন তো আর সে নেই। খুব মনে পরছে তাকে। প্রাচুর্যকে এতো ভাবনা চিন্তা করতে দেখে ড্রাইভার বলে উঠলো —
” আম্মা কি এতো ভাবতাছেন? তাড়াতাড়ি উইঠা আসেন নাইলে কলেজে আবার দেরি হইয়া যাইবো। ”
ড্রাইভারের কথায় হুশ ফিরলো প্রাচুর্যের। তাই সে আর দেরি না করে উঠে পরলো গাড়িতে। আজ আবার সাপ্তাহিক টেস্ট আছে তার। দেরি করলে ক্লাস মিস যাবে।
.
.
.
.
রাত ন’টায় তাফসিরদের বাড়ি হাজির হলো উইলসন। এসেই তাড়া লাগালো দু’জনকে রেডি হওয়ার জন্য। তাফসির ও শাহিন রেডি হয়ে বাইরে আসতেই দেখলো উইলসন আপেল খেতে খেতে টিভি দেখছে। তাফসির পকেটে ফোন ঢুকাতে ঢুকাতে বললো—
” এতো তাড়াহুড়া করে রেডি হতে বললে যে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাদের? ”
উইলসন আপেলে আরেক কামড় বসিয়ে তা চিবোতে চিবোতে বললো—
” আজকে নাথান ফিলিপস স্কয়ারে যাবো। অনেকদিন যাওয়া হয় না। এক বন্ধুর কাছে শুনলাম কনসার্ট হচ্ছে ওখানে। আমরা ওখানের একটা রেস্টুরেন্টে থেকে একবারে খেয়েই কনসার্টে যাবো। ”
শাহিন চাবি নিতে নিতে বললো—
” কিন্তু কালকে সকালে অফিস আছে উইলসন। এখন কনসার্টে গেলে তো সকালে উঠতেই পারবো না। ”
উইলসন উঠে দাড়িয়ে বাইরে যেতে যেতে বললো—
” সমস্যা নেই। তাড়াতাড়িই চলে আসবো। আর অতো সতো জানি না তোমাদের যেতেই হবে। ”
শাহিন অসহায় দৃষ্টিতে তাফসিরের দিকে তাকালো। তাফসির চোখ দিয়ে ইশারায় আশ্বাস দিয়ে বললো—
” থাক চিন্তা করিস না। ম্যানেজ করে নেবো। আর জানিসই তো ও একটু পাগলাটে ধরনের। এসবে এনজয় করে খুব। আর ও আছে বলেই কিন্তু কানাডার দিন গুলো এতো সুন্দর লাগে। ”
শাহিন উপরনিচ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। তাফসির মৃদু হেসে বললো—
” তাহলে আর কি? যাওয়া যাক!
তারা বাইরে এসে দেখলো উইলসন অলরেডি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। তাফসির ফ্রন্ট সিটে উইলসনের পাশে বসলো এবং ব্যাক সিটে শাহিন বসলো। টরেন্টো শহরের স্ট্রিট লাইট ও সুউচ্চ বিল্ডিং ছাড়িয়ে তারা পৌঁছালো নাথান ফিলিপস স্কয়ারে।
তারা নাথান ফিলিপসের একটি লোকাল রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টটি লোকাল হলে কি হবে এটি এখানকার বেশ জনপ্রিয়। তারা কানাডার জনপ্রিয় ডিস পাউটিন অর্ডার দিলো যেটি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিজ এবং এক রকমের সস দিয়ে হিট করে দেওয়া হয় আর সাথে বিফ বার্গার।
শাহিন খবার চিবোতে চিবোতে বাংলাতে বললো—
” ভাই এরা এসব খায় কেনো ডিনারে? আমার তো রাতে ভাত না খেতে পারলে পেটই ভরে না। বাড়িতে যায়ে আমি রান্না করবো দেখিস। এইসব খেয়ে হবে না আমার। ”
” সম্ভব না ভাই। তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস যে আমরা এরপর কনসার্টে যাবো। বাড়িতে যেতে যেতে রান্না করে খাওয়ার মতো ইচ্ছা থাকবে না। তার থেকে ভালো তুই কিছু খাবার কিনে নিয়ে যাইস যাতে রাতে খিদে লাগলে খেতে পারিস। ”
উইলসন ওদের বাংলা ভাষা বুঝতে পারলো না তাই ওদের দু’জনে দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো—
” হেই কি বলছো তোমরা। আমি বুঝতে পারছি না তোমাদের ভাষা। ”
” তেমন কিছু না উইলসন। আমাদের খাওয়া শেষ। তোমার শেষ হলো?”
” হ্যাঁ শেষ। চলো উঠি। নাহলে কনসার্ট শেষ হয়ে যাবে আবার। ”
তারা তিনজন বিল পরিশোধ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলো। এর মধ্যে তাফসিরের ফোন বেজে উঠলো। তাফসির পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখলো প্রাচুর্যের ফোন। সে একবার সময়ের দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেলো। একটু দুরে গিয়ে ঝটপট ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নম্র কন্ঠে সালাম দিলো প্রাচুর্য। তাফসির সালামের উত্তর দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ভঙ্গিতে বললো—
” কি ব্যাপার? এই সময়ে তো তোর কলেজে থাকার কথা। কলেজে যাস নি? ”
” গিয়েছিলাম। চলে এসেছি। ”
” কেনো কি হয়েছে? ঠিক আছিস তুই? বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো? ”
” এতো অস্থির হবেন না তাফসির ভাই। সবাই ঠিক আছে। আমার এমনি ভালো লাগছিলো না তাই চলে এসেছি। ”
প্রাচুর্যের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তাফসির। সে তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো এ সময় প্রাচুর্যের ফোন পেয়ে। এর মধ্যেই ওপাশ থেকে আবার কথা শোনা গেলো প্রাচুর্যের।
” আপনি কি ব্যস্ত আছেন? বিরক্ত করলাম? ”
প্রাচুর্যের কথায় তাফসির হাসলো। মেয়েটা যে তাকে নিয়ে চিন্তা করে তা তার কথাতেই স্পষ্ট। তাফসির ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বললো—
” ব্যস্ত থাকলে কি রিসিভ করতে পারতাম বল? তোর যখন ইচ্ছা তখন ফোন দিবি। এতো সংকোচ করতে হবে না। ”
তাফসিরকে এমন হাসতে দেখে উইলসন কনুই দিয়ে গুঁতা দিলো শাহিনের বাহুতে। শাহিন ফিরে তাকাতেই উইলসন দুরে দাঁড়িয়ে থাকা তাফসিরের দিকে ইশারা করে বললো—
” ও এতো হেঁসে হেঁসে কার সাথে কথা বলছে শাইন? ”
শাহিন তাফসিরের দিকে তাকালো একবার। পুনরায় উইলসনের দিকে তাকিয়ে বললো—
” ওহ তাফসিরের কথা বলছো? ও তো ওর ওয়াইফের সাথে কথা বলছে। ”
শাহিনের কথায় উইলসন আকাশ থেকে পরলো। মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো—
” কি বলছো? ওয়াইফ? কিন্তু ও তো আনমেরিড। ওয়াইফ কোথা থেকে আসলো? ”
#চলবে
[রিচেইক করি নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন]