অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৫.

0
364

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫.

কাশবাহ বাব ওউরিকা হোটেলের কাছাকাছি যখন গাড়ি পৌঁছায় তখন কাছের এক মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসে। চারিদিকে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করেছে। ফাতিহ হোটেল থেকে কিছুটা দূরে একটা গাছের আড়াল করে গাড়ি থামায়। শান্ত স্বরে বলে,

” পৌঁছে গিয়েছি। ”

ল্যায়লা তাকায় একবার ফাতিহর দিকে। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সে। নিজের গায়ে থাকা ফাতিহর জ্যাকেটটা খুলতে থাকে সে। ফাতিহ গাড়ি থেকে নেমে হেটে অপরপাশে গিয়ে ল্যায়লার পাশের দরজা খুলে দেয়। ল্যায়লা চুপচাপ ক্যামেরা নিয়ে নেমে দাঁড়ায়। ফাতিহ ল্যায়লার ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

” যেতে পারবে? ”

ল্যায়লা হাত বাড়িয়ে নিজের ব্যাগ কাধে নিয়ে বলে,

” হ্যাঁ। ”

হোটেলের থেকে দূরে গাড়ি থামানোতে ল্যায়লার কোনো কৌতূহল না দেখে ফাতিহ অবাক হয় না। কোনো কিছুর প্রতি কৌতূহল প্রকাশ করা ল্যায়লার ধাচে নেই তা সে বুঝতে পেরেছে। ঠিক যেমন ধন্যবাদ কিংবা সরি বলাও ল্যায়লার স্বভাবে হয়তো নেই। তাইতো কোনো কিছু না বলেই আপন রাস্তায় হেটে হোটেলের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে সে। ফাতিহ পিছু ডাকে না। সে চুপচাপ রাস্তার পাশে থাকা জলপাই গাছটার আড়াল হতে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না ল্যায়লা ঠিকভাবে হোটেলের ভেতর প্রবেশ করে। ল্যায়লা চোখের আড়াল হতেই ফাতিহ আপন মনে ভাবে, মেয়েটা পৃথিবীতে কতদিনের মুসাফির সেই সময়কাল যদি জানা যেন তবে হয়তো সে কিছুটা নিশ্চিত হতো। এই মেয়ে যে আবার সুইসাইড এটেম্পট করবে তা নিয়ে ফাতিহ নিশ্চিত। কিন্তু তখন কি আবার কেউ তাকে বাঁচাতে যাবে?

আপন মনে কথাগুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফাতিহ। চুপচাপ গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসতেই সে লক্ষ্য করে তার পাশের সিটে একটু আগে যেখানে ল্যায়লা বসে ছিল সেখানে এখন কেবল তার দেওয়া সেই জ্যাকেটটা রাখা। ফাতিহ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

__________

কাশবাহ বাব ওউরিকা হোটেলের সুবিধার মধ্যে রয়েছে সানলাউঞ্জার সহ একটি আউটডোর পুল, একটি আরামদায়ক বার এবং একটি বাগান। এছাড়াও রয়েছে একটি টেরেস, একটি অগ্নিকুণ্ড সহ একটি আরামদায়ক লাউঞ্জ এবং একটি রেস্তোরাঁ। পাশাপাশি পার্কিং এবং বিমানবন্দর শাটলও উপলব্ধ।

ল্যায়লা চেক ইন করে নিজের রুমে প্রবেশ করে। অলস ভঙ্গিতে কাধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রুমে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে সে। তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে রুমের সাথে এটাচড ঝুল টেরেসের দিকে। এই হোটেলের আরেকটা সুবিধা হলো এখান থেকে পাহাড়ের দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু হয়তো এখন শীতকাল হওয়ায় কুয়াশার কারণে অ্যাটলাস চূড়া দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ ল্যায়লার চোখ যায় আয়নার দিকে। সে একহাতে নিজের মাথা থেকে কানটুপিটা খুলে এনে সামনে ধরে। এই কান টুপিটা ওই ফাতিহ নামক লোকটা তাকে পড়িয়ে দিয়েছিলো। আসার সময় জ্যাকেট ফিরিয়ে দিলেও এটা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ল্যায়লার খেয়াল ছিলো না। সে বিরক্ত হয় নিজের প্রতি। সে যত সব ধরনের পিছুটান থেকে মুক্তি পেতে চায়, ততই কোনো না কোনো কিছু আরো তাকে লতাগুল্মের মতো আঁকড়ে ধরে।

এখন এটা কিভাবে ফিরিয়ে দিবে সে? সে ওই লোকের সম্পূর্ণ নাম কিংবা নাম্বার কিছুই জানেনা। যেহেতু সে কিছুই জানে না ওই লোক সম্পর্কে এবং তাদের আর দেখা হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই সেহেতু এটা ফিরিয়ে দেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে। কানটুপিটা বিছানার উপর একপাশে রেখে সে হোটেল ইন্টারকমে কল করে নিজের জন্য খাবার অর্ডার করে নেয়। খিদায় আপাতত তার মাথা ঘুরছে।

__________

” ওহ মাই গড ফাতিহ! ল্যায়লা চলে গেলো আর তুই আমাকে ডাকলিও না? আমি ওকে বিদায়ও জানাতে পারলাম না। ”

বিছানায় আরাম করে গা এলিয়ে দিয়ে বলে,

” হ্যাঁ। ল্যায়লা ম্যাডামকে বিদায় জানাতে না পারায় তো ইসাম শাহমির স্যারের খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। ”

ইসাম নাক ফুলিয়ে বলে,

” ওর সাথে আমাদের ফার্স্ট ইম্প্রেশন ভালো ছিলো না। তাই আমি ভেবে রেখেছিলাম লাস্ট ইম্প্রেশনে নিজের কোনো চমৎকার মেমোরি ওর মাইন্ডে তৈরি করে দিবো। কিন্তু তুই একা ওকে বিদায় জানিয়ে হিরো সেজে গেলি। আর মাঝে আমি জিরো হয়ে গেলাম। ”

ফাতিহ একটা বালিশ কাছে টেনে উবুড় হয়ে শোয়। তার শরীর অনেক ক্লান্ত। দু চোখ বুজে ঘুম আসছে। ঘুমানোর আগে বিড়বিড়য়ে সে বলে,

” জীবন বাঁচানোর ইনামসরূপ যেই মেয়ে কখনো থাপ্পড় তো কখনো ঘুষি মারে সেই মেয়ের থেকে আবার বিদায় আশা করে। কি শখ! ”

ইসাম কোনো প্রতুত্তর না পেয়ে রেগে বেরিয়ে লিভিং রুমে আসে। কিন্তু লিভিং রুমে আসতেই তার রাগ গলে পানি হয়ে যায়। বাতাসে সুস্বাদু কাবাবের গন্ধ পাচ্ছে সে। সেই গন্ধ অনুসরণ করে ইসাম রান্নাঘরে পৌঁছাতেই দেখতে পায় মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা বড় কাবাবের থালা সাজাতে ব্যস্ত। ইসাম পিছন থেকে এগিয়ে গিয়ে একটি কাবাব তুলে মুখে দিয়ে সেই মহিলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,

” ফিরুজে খালা তোমার হাতের কাবাবের টানেই আমার কখনো এই জায়গা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করে না। ”

ফিরুজে খালা হেসে বলে,

” ফাতিহ আব্বাকেও ডেকে নিয়ে আসেন বাবাজান। দুইদিন ধরে পর্বতে ঘুরেছেন কেবল। কিছু হয়তো ঠিক করে খানও নি আপনারা। ”

ইসাম হেসে বলে,

” এই দুদিন সত্যিই ভালো করে কিছু খাওয়া হয়নি আমার। কিন্তু ফাতিহ বাবা ভালোই সুন্দরী রমণীর হাতের উত্তম মধ্যম খেয়েছে৷ ”

শেষের লাইনটা ইসাম বিড়বিড়িয়ে বলে।

__________

ছিছাওয়া নামক শহরটিতে জনগণের সংখ্যা ঢের কম বললেই চলে। মধ্যরাতে তাই আরো জনমানবশূন্য লাগে এখানের চারিদিক। সিটিএম ছিছাওয়ার পাশের এই গলিতেই একটি দোতলা বাড়িতে আপাতত অবস্থান করছে ফাতিহ এবং ইসাম। বাড়িটি মূলত ইসামের দাদার। কিন্তু বর্তমানে কেউ এখানে থাকে না। ইসাম এবং ফাতিহ মাঝেমধ্যে একসাথে অ্যাটলাস পর্বতের উদ্দেশ্যে আসলে এখানে থাকে। বাড়িটা এখনো ফিরুজে খালার তত্ত্বাবধানে থাকায় বসবাসের উপযোগী আছে।

গলির শুরুর মাথায় স্যালুন দে কইফিউর এলিগেন্সের সামনে দিয়ে মেইন রোডে উঠে আসে ফাতিহ। এখানেই তার গাড়ি পার্ক করা। দিনে তার মনমতো চলাফেরা করাটা অসম্ভব প্রায়, তাই রাতেই বের হয়েছে সে। তবুও ভালো করে মাস্ক এবং স্পোর্টস ক্যাপ দিয়ে চেহারা প্রায় সম্পূর্ণটা ঢেকে রেখেছে। বিকালের দিকে গ্রোসারি সুপারশপ থেকে ফিরুজে খালাকে দিয়ে কিছু জিনিস আনিয়েছিলো ফাতিহ। সেগুলো গাড়িতে রেখে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে।

শহরের অপরপাশে ক্যাফে রেস্টুরেন্ট জিজের সামনে এসে গাড়ি থামায় ফাতিহ। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার শেষ মাথায় ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ফাতিহ গাড়ি থেকে নেমে গ্রোসারি ব্যাগটা হাতে নেয়। সাবধানে আরেকবার চারিদিকে তাকিয়ে ব্যাগটা ক্যাফের দরজার সামনে রেখে সে তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

__________

বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ল্যায়লা। আয়নায় স্পষ্ট তার অনুরূপ অবয়ব দেখা যাচ্ছে। যা দেখা যাচ্ছে না তা হলো তার ভেতরকার প্রলয়। আচমকা সামনের আয়নায় ল্যায়লা নিজের পিছনে একজন পুরুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। পুরুষটা এক ধরনের বিভৎসকর হাসি ঠোঁটের কোণে একে ল্যায়লার দিকে তাকিয়ে আছে। ল্যায়লার বুকে অসহ্যকর কাপন ধরে। সে চোখ মুখ খিচে বলে,

” চলে যাও। ”

কিন্তু সেই পুরুষ যায় না। ল্যায়লা আয়নার দিকে তাকিয়েই কাপতে কাপতে বলে উঠে,

” চলে যাও। নাহয় মেরে ফেলবো। ”

পুরুষটা একই ভঙ্গিতে হাসতে থাকে। ল্যায়লা সিংকের পাশের ক্যাবিনেট থেকে একটি ধাতব শো পিস তুলে নেয় হাতে। আয়না বরাবর সেটা ছুঁড়ে মারতেই কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ তুলে আয়না ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

ল্যায়লা অটল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা স্বত্বেও তার সম্পূর্ণ শরীর থরথর করে কাপছে। তার চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছে সে। সে কোনো মতে হাতড়ে বাথটাবের কাছে যায় যা ইতিমধ্যে পানি দ্বারা পূর্ণ। তুমুল আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে সে বাথটাবে সোজা হয়ে বসে পড়ে। বাহিরে রুমের দরজায় নকের শব্দ তার কানে আসছে। কিন্তু সে উঠবে না। কাপা কাপা হাতে সে একহাতের মুঠো থেকে একটি কাচের টুকরো বের করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই সেই কাচের টুকরো দিয়ে নিজের বাম হাতের শিরা কেটে ফেলে। ধীরে ধীরে তার শরীর অসাড় হয়ে আসে। হেলে পানির ভেতর শুয়ে পড়ে সে। পানির ভেতর চোখ মুখ খিচে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে সে শান্ত হয়। বুকের ভেতরের উথাল ঢেউ অবশেষে মুক্তি হয়ে তার কাছে ধরা দিচ্ছে। অ্যাটলাস শৃঙ্গে মুক্তি না পাক, অন্তত এই দেশের মাটিতে তো তার মুক্তি মিলবে। এ-ই বা কম কিসে?

__________

কাশবাহ বাব ওউরিকা হোটেল থেকে কিছুটা দূরে জলপাই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ফাতিহ। দুপুরে ঘুমিয়ে উঠায় রাতে আর ঘুম আসছিলো না তার। তাই আর বাড়িতে ফিরে যায় নি। কিন্তু আপাতত এটা তার অজানা যে সে কি কারণে দুই ঘন্টা দশ মিনিটের পথ পেরিয়ে এখানে এসেছে। প্রথম বারের মতো সে অ্যাটলাস শৃঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রতি অদৃশ্য টান অনুভব করছে। বলা হয়ে থাকে অজানার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি থাকে। ফাতিহও তার ব্যতিক্রম নয়। ল্যায়লা নামক মেয়েটি তার কাছে গ্রন্থাগারের সবথেকে প্রাচীন সংরক্ষিত পুস্তকের ন্যায় মনে হয়েছে। যার সম্পর্কে নিজের অজান্তেই জানার আগ্রহ অনুভব করছে সে।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ির কাছে যেতে নেয় ফাতিহ তখনই তার চোখের সামনে দিয়ে একটি এম্বুল্যান্স স্ব শব্দে হোটেলের দিকে এগিয়ে যায়৷ ফাতিহর পা থেমে যায়। সে মনে মনে চাইছে সে যা অনুমান করছে তা যেন না হয়। কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্ট্রেচারে করে ল্যায়লার দেহ দেখতে পায়। তার রক্তাক্ত এক হাত এবং সম্পূর্ণ ভেজা শরীর দেখে ফাতিহ নিশ্চিত হয় এই মেয়ে কি করেছে।

তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে সে এম্বুলেন্সকে অনুসরণ করে গাড়ি চালাতে থাকে একহাতে। অপর হাতে তাড়াতাড়ি ফোন নিয়ে কোনো একজনকে কল দিয়ে কিছু একটা বলে ফোন রেখে দেয়। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

” এতদিন বিপদ এসে আমার দ্বারে কড়া নাড়তো, এই প্রথম আমি নিজে বিপদের দ্বারে যাচ্ছি কড়া নাড়তে। আল্লাহ রক্ষা করো। ”

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here