অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৬.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬.

হসপিটালের কেবিনে ল্যায়লার বেডের পাশে বসে আছে ফাতিহ। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ স্যালাইনের ড্রিপের দিকে। একে তো ল্যায়লা ভীনদেশী তার উপর আবার এটেম্পট টু সুইসাইড কেস। এসব ঝামেলা সামলাতে তার সকাল হয়ে গিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে রক্তপাত বেশি হওয়ার আগেই ল্যায়লাকে হসপিটালে আনা হয়েছে। নাহয় ওর জীবন ঝুঁকিতে পরতো। ইসামকেও কিছুক্ষণ আগে কল করে সে জানিয়ে দিয়েছে এই ঘটনা সম্পর্কে। ইসাম জানিয়েছে সে শীগ্রই আসছে।

জ্ঞান ফিরে আসতেই ল্যায়লা নিজের সামনে সবথেকে অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিকে দেখে বিস্মিত হয়। মুখ ফুটে আধো স্বরে ইংরেজিতে প্রশ্ন করে,

” তুমি? ”

ফাতিহ মেরুদণ্ড সোজা করে বসে মৃদু হেসে বলে উঠে,

” আল্লাহর মর্জি ছিলো বলেই হয়তো আবার আজরাইলের আগে আমি তোমার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ”

ল্যায়লা মাথা চেপে ধরে গতরাতের ঘটনা মনে করে। সাথে সাথে সে চোখ মেলে একবার চারিদিকে তাকায়। সে যে এই মুহুর্তে হসপিটালে আছে তা বুঝতে তার মোটেও অসুবিধা হয় নি। রাতের গায়ের ওই ভেজা রক্তাক্ত জামাও এখন তার গায়ে নেই। তার বদলে রয়েছে হসপিটালের পোশাক। ল্যায়লা ঘাড় কাত করে তার বাম হাতের দিকে তাকায়। হাতের কব্জি সম্পূর্ণ ব্যান্ডেজ কাপড় দ্বারা মোড়ানো। তার মানে সে মরে নি? এই যাত্রায়ও সে বেঁচে গিয়েছে?

মুহুর্তেই ল্যায়লা রাগে উঠে বসার চেষ্টা করে। সাথে সাথে ফাতিহ এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

” ইউ শুড টেক রেস্ট। ”

কথাটা বলেই ফাতিহ ল্যায়লাকে শান্ত করার জন্য তার হাতের বাহুতে হাত রাখে। এতে যেন জ্বলন্ত আগুনে আরো পেট্রোল ঢালার মতো জ্বলে উঠে ল্যায়লা। সে ডান হাত তুলে ফাতিহকে থাপ্পড় মারে। ল্যায়লার ডান হাতে ক্যানেলা লাগানো ছিলো। তাই থাপ্পড় দেওয়ার সময় হাত তুলতে গেলে সুইয়ে টান লেগে রক্ত বের হতে শুরু হয়। থাপ্পড় খাওয়া সত্ত্বেও ফাতিহর মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। সে যেন এমন কিছুর জন্য প্রস্তুতই ছিলো। ল্যায়লা চিৎকার করে উঠে,

” কেন বার বার আমাকে বাঁচাচ্ছো তুমি? যেই আজাব থেকে আমি নিজেকে মুক্তি দিতে চাইছি সেই আজাবের মাঝেই কেন বার বার আমাকে ফিরিয়ে আনছো? ”

ফাতিহ শান্ত স্বরে বলে,

” তুমি শান্ত হও আপাতত। ”

ল্যায়লা তবু্ও থামে না। সে চিৎকার করতে করতে বলে,

” মৃত্যুও কেন আমাকে গ্রহণ করছে না? এটা কোন ধরনের শাস্তি? আমি ধুকে ধুকে মরতে চাই না। আমি চিরমুক্তি চাই। ”

কথাটুকু বলতে বলতে ল্যায়লা তার হাতের ক্যানেলা টেনে খুলতে থাকে। ফাতিহ উপায়ন্তর না পেয়ে একজন নার্সকে কল করে। নার্স এসে ল্যায়লার এমন বেগতিক অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে তাকে ঘুমের ওষুধ দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যায়লার চোখ বুজে আসে। ফাতিহ এক মুহুর্ত ল্যায়লাকে দেখে নিয়ে নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” আপনি এখানেই থাকুন। রুম ছেড়ে বের হবেন না। আমি ডক্টরের সাথে দেখা করে আসছি। ”

কথাটা বলেই ফাতিহ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

__________

ইসামের হাসপাতালে পৌঁছাতে ৩ ঘন্টার মতো সময় লাগে। তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে পৌঁছালেও ভেতরে প্রবেশের সময় খুব সাবধানে মাস্ক পড়ে মাথা নত করে প্রবেশ করে। এমনকি লোক দৃষ্টি এড়াতে সে লিফটের পরিবর্তে সিড়ি বেয়ে ৯ তলায় পৌঁছে যায়। এই ফ্লোরে কেবল সব প্রাইভেট পেশেন্টদের কেবিন। তাই ভীড় নেই বললেই চলে। করিডোরে ৯০৪ নম্বর রুমের দরজার সামনে ফাতিহকে দেখতে পায় সে। ব্যস্ত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ফাতিহকে প্রশ্ন করে,

” ল্যায়লা কোথায়? কেমন আছে? ”

ফাতিহ কেবিনের দিকে ইশারা করে বলে,

” ভিতরে আছে৷ শারীরিক ক্ষত সেরে যাবে আশা করি সময়ের সাথে। কিন্তু ওর মনের ক্ষত সেরে যাওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ”

কথাটা বলতে বলতে ফাতিহ রুমে প্রবেশ করে। ইসামও তার সাথে রুমে প্রবেশ করে। রুমের ভেতরে থাকা একটা তিন সিটের সোফায় ফাতিহ বসে দু হাতে মাথা ঠেকে রাখে। ইসাম তার পাশে বসে প্রশ্ন করে,

” ওর মনের ক্ষত কি জানতে পেরেছিস? ”

” না। কিন্তু আই কান’ট সি হার লাইক দিস। আমি নিজের সামনে একটা মানুষকে এভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখেও চুপ থাকতে পারবো না। ”

ইসাম চুপ থাকে। সে ফাতিহর স্বভাব জানে। ওর ভেতর কি চলছে তাও ধারণা করতে পারছে। ফাতিহ মাথা তুলে ল্যায়লার দিকে তাকায়। তারপর শান্ত স্বরে বলে,

” আই ডোন্ট নো, আমি পারবো নাকি না। কিন্তু আই হ্যাভ টু ডু ইট। ওর মনের ক্ষতের নাম আমার জানা নেই, কিন্তু তার ওষুধ খুঁজে বের করতে করতে হয়তো সেই ক্ষতের নামও জেনে যাবো। ”

ইসাম এক হাতে ফাতিহর পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

” ডোন্ট ওয়ারি। উই ওন’ট লেট হার ডাই। ”

__________

জ্ঞান ফেরার পর থেকে ল্যায়লা আর টু শব্দও করে নি৷ ইসাম অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু তবুও ল্যায়লা কোনো প্রতুত্তর করে নি। ইসাম ব্যর্থ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই ফাতিহ ল্যায়লার সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন ফাতিহ কিছু বলে না তখন ল্যায়লা চোখ তুলে তাকায় ফাতিহর দিকে। ফাতিহ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দৃষ্টিমিলন হতেই ল্যায়লা চোখ ফিরিয়ে নেয়। ফাতিহ ল্যায়লার পাশে চেয়ারে বসতে বসতে বলে উঠে,

” তোমার ব্যাগ এবং ক্যামেরা হোটেল থেকে আনিয়েছি৷ আশা করছি কোনো অসুবিধা হবে না। ”

ল্যায়লা কোনো উত্তর দেয় না। ফাতিহ নিজেই আবার বলে,

” তুমি ফোটোগ্রাফি করো? ”

এবার ল্যায়লা চোখ তুলে তাকায়। হালকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ফাতিহ প্রশ্ন করে,

” মরক্কোতে এসে এই পর্যন্ত একবারও ছবি তুলেছো? ”

ল্যায়লা এবার শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

” উদ্দেশ্য কি তোমার? ”

” আই ওয়ান্ট টু মেক এ ডিল। ”

ল্যায়লা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

” কি ডিল? ”

” এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহর জন্য আমাদের সাথে চলবে তুমি। চারিদিক ঘুরে দেখবে। এখানে দেখার মতো অনেক জায়গা আছে। এই এক সপ্তাহে যদি তোমার সুইসাইড করার ইচ্ছে না বদলায় তাহলে আমি আর তোমার পথে বাধা হবো না। ইউ ক্যান ডাই এজ ইউ ওয়ান্ট। ”

” আমি তোমার এই কথা কেন মানবো? ইট’জ মাই লাইফ। আমার যা ইচ্ছে তাই করবো। হোয়াই ডু ইউ কেয়ার? ”

” তুমি আমার কথা মানতে বাধ্য। কারণ একজন ভীনদেশী হয়েও তুমি এই দেশে সুইসাইড করার ট্রাই করেছো। আর এজন্য তোমার অনেক পুলিশের লিগ্যাল ঝামেলা পোহাতে হবে। এসব কেসে একবার ফাসলে তুমি আর মরার সুযোগও পাবে না। তাই তুমি আমার শর্তে রাজি হয়ে যাও, আর আমি সেইসব ঝামেলা হ্যান্ডেল করে নিবো। ”

ল্যায়লা এবার কিছুটা জোরে বলে উঠে,

” হু আর ইউ? ”

” নো ওয়ান ইম্পোর্ট্যান্ট। ”

ল্যায়লা ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

” ইউ কান’ট চেঞ্জ মাই মাইন্ড। ”

” তোমার নিজের প্রতি যদি এতো আত্মবিশ্বাস থাকে তাহলে তো ভালোই। এখন বলো রাজি নাকি না? ”

” আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আছে। কিন্তু তোমাদের প্রতি বিশ্বাস নেই। আমাকে পাগল মনে হয়, যে তুমি বলবে আর আমি ঢেই ঢেই করতে করতে অপরিচিত দু’জন পুরুষের সাথে চলে যাবো? ”

ফাতিহ এবার কিছুটা উত্তেজিত স্বরে বলে,

” আমাদের অবিশ্বাস করছো? সুযোগ নেওয়ার হলে সেদিন রাতে পর্বত শৃঙ্গে যখন তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে তখনই আমরা নিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের চরিত্র এতটা নিচু এবং জঘন্য না। তবুও তুমি আমাদের বিশ্বাস করতে পারছো না? ”

ল্যায়লা শান্ত স্বরে বলে,

” আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। ”

” ওকে ফাইন। এখানে পাশেই ছিছাওয়া শহরে ইসামের দাদার বাড়ি। আমরা ওখানেই থাকছি। সেখানে ফিরুজে খালা আছেন আমাদের সঙ্গে বাড়ির তত্ত্বাবধানে। তবুও যদি তোমার বিশ্বাস না হয় আমি তোমাকে সেখানে হোটেলের ব্যবস্থা করে দিবো। ”

ল্যায়লা কোনো কথা বলে না। ফাতিহ এবার কিছুটা বিনয়ী স্বরে বলে,

” আমি ৩ বার তোমার জীবন বাঁচিয়েছি। বিনিময়ে আমাকে বিশ্বাস করা যায় না? কেবল ৭ দিন। এর পরেও যদি তোমার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার ইচ্ছা দূর না হয়, তাহলে আমি স্বেচ্ছায় তোমার পথ থেকে সরে যাবো। ”

ল্যায়লা শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় ফাতিহর দিকে। সেই দৃষ্টি হতে ফাতিহ নিজের উত্তর বুঝে নেয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here