অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৭.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭.

দু’দিন ল্যায়লাকে হসপিটালেই থাকতে হয়েছে। এই দু’দিন ফাতিহ এবং ইসাম পালাক্রমে হসপিটালে থেকেছে। ফিরুজে খালাকে তারা ল্যায়লার ব্যাপারে সব জানায়। সব শুনে উনি বেশ আফসোস করে। পরিচিত হওয়ার জন্য রান্না করে হসপিটালেও যায় তিনি। ল্যায়লার বেশ খেয়ালও রাখেন। রাতে ফাতিহ কিংবা ইসামের সাথে একা হসপিটালের কেবিনে থাকা নিয়ে ল্যায়লার অস্বস্তি বুঝে তিনিই সাথে থেকে গিয়েছিলেন।

ফিরুজে খালার বেশ অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিলো। স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন তিনি। কেবল একটি সন্তানের অভাব ছিলো। আল্লাহর রহমতে বিয়ের দু বছরের মাথায় তার ঘর আলো করে একটি কন্যা সন্তান হয়। কিন্তু কিছু মাসের ব্যবধানেই ৪ দিনের জ্বরে বাচ্চাটা পৃথিবী ত্যাগ করে। তারপর বেশ কিছু শারীরিক জটিলতার কারণে ডাক্তার জানায় উনি আর কখনো মা হতে পারবে না। ধীরে ধীরে সংসারে ঝামেলা বৃদ্ধি পায়। একটা সময় গিয়ে উনার এবং উনার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে যায়। বেশ অনেকদিন হতাশায় ভুগেন তিনি।

নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য একটি চাকরি খুঁজছিলেন তিনি। মোটামুটি শিক্ষিত হওয়ায় ছিছাওয়া শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাচ্চার গভর্নরের চাকরি পান তিনি। সেই বাচ্চাটি ইসাম ছিলো। ইসাম কিছুটা বড় হতেই স্ব পরিবারে তারা রাজধানী রাবাতে শিফট হোন। কিন্তু ফিরুজের কাজে মুগ্ধ হয়েই ইসামের দাদা আর উনাকে বের করে দিতে পারে নি। নিজের বাড়ির তত্ত্বাবধানে ছিছাওয়াতেই থাকার সুযোগ করে দেন।

নিজের মেয়ে সন্তানকে হারানোর দরুন কিনা জানা নেই, কিন্তু দু’দিনে ল্যায়লার প্রতি বেশ মায়া অনুভব করেন ফিরুজে। মেয়েটাকে এতো বিষন্ন থাকতে দেখে তারই মন খারাপ হয়ে যায়। এই বয়সে তো মেয়েটার নিজের জীবন সুন্দর করে উপভোগ করার কথা। কিন্তু কি এমন গোপন কারণে মেয়েটা জীবনের মায়া ত্যাগ করতে চাইছে? মায়া থেকেই হয়তো ফিরুজে ইমামকে অনুরোধ করে যেন ল্যায়লাকে হোটেলে না নিয়ে যায়। একা একজন মেয়ের হোটেলে থাকাটা মোটেও নিরাপদ মনে করেন না তিনি। এই বিষয়ে তিনি ল্যায়লার সাথেও কথা বলে। তাকে আশ্বাস দেয় বাসায় ২৪ ঘন্টা সে তার সাথে থাকবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ল্যায়লা ফাতিহ এবং ইসামকে বিশ্বাস করতে পেরেছে কি-না তা নিশ্চিত না হলেও, সে যে ফিরুজে খালার কথায় আশ্বস্ত হয়েছে তার প্রমাণ হলো তার রাজি হয়ে যাওয়াটা।

__________

ল্যায়লাকে যেদিন হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করা হয় সেদিন তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা ফাতিহই পালন করে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, ল্যায়লাকে নিয়ে যাওয়ার সময়কালটা মধ্যরাতে পরে। সাধারণত মধ্যরাতে কোনো পেশেন্টকে ডিসচার্জ দেয় বলে ল্যায়লার জানা ছিলো না। কিন্তু স্বভাবত এই বিষয় নিয়ে তার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। উল্টো সে ঘুম অনুভব করছে প্রচুর। গত দু’দিন ধরে তার দরকারি কিছু মেডিসিনের পাশাপাশি ঠান্ডার জন্যও মেডিসিন নিতে হচ্ছে। আর সেই কারণেই ঘুমের মাত্রা কিছুটা বেড়ে গিয়েছে।

হসপিটালের ফর্মালিটিস শেষ করে ফাতিহ কেবিন রুমে এসে দেখে ল্যায়লা রেডি হয়ে বসে আছে। ফাতিহ এগিয়ে গিয়ে গিয়ে একটা মাস্ক এগিয়ে দিয়ে বলে,

” এটা পড়ে নাও। ”

ল্যায়লা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

” কেন? ”

ফাতিহ ল্যায়লার ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে উঠে,

” ইট ইজ হসপিটাল। কত ধরনের রোগ জীবাণু চারিদিকে থাকে। এভাবেই এখনো ফুল রিকভার হও নি তুমি৷ ইমিউনিটি পাওয়ার উইক বেশ। তাই ভালোর জন্যই বলছি। ”

কথাটা বলতে বলতেই ফাতিহ ল্যায়লার ক্যামেরা ধরতে নেয়। সাথে সাথে ল্যায়লা চেঁচিয়ে উঠে,

” আমার ক্যামেরা ছুঁবে না। ”

ফাতিহ ভ্রু কুচকে তাকাতেই ল্যায়লা আবার বলে,

” আমি আমার ক্যামেরা নিজেই ক্যারি করতে পারি। ”

” ক্যামেরার ভালোই ওজন আছে। তুমি দূর্বল। নিতে পারবে না। ”

” আমি সারাজীবন ক্যামেরার ভার বহন করেই বড় হয়েছি। আমার থেকে ভালো কেউ ক্যারি করতে পারবে না। ”

ফাতিহ ল্যায়লার মেডিক্যাল ফাইল একহাতে নিয়ে বলে,

” বেশ। তবে তুমিই নাও। ”

ল্যায়লা উঠে দাঁড়ায়। ফাতিহর কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের ক্যামেরা নিজের গলায় ঝুলিয়ে নেয়। ফাতিহ একবার ল্যায়লাকে দেখে নেয়। দেখতে এখনো বেশ দূর্বল লাগছে। ফাতিহ সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে,

” আমাকে ছুঁতে হবে না। কিন্তু আমার কাধে থাকা তোমার ব্যাগ ধরে অন্তত হাঁটো। বেশ দূর্বল দেখাচ্ছে। ”

ল্যায়লা কোনো কথা বলে না। চুপচাপ মাস্ক পড়ে সে ব্যাগের এক কোণ ধরে ফাতিহর পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে। হসপিটালের করিডর সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিলো। তবুও ফাতিহ বারবার আশেপাশে তাকিয়ে সাবধানে হাঁটছিলো। লিফটে করে সোজা গ্রাউন্ড ফ্লোরের পার্কিং এরিয়াতে চলে যায় তারা। হসপিটাল থেকে বাসায় যেতে প্রায় এক ঘন্টার পথ।

গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেডিসিনের জন্য ঘুমে তলিয়ে যায় ল্যায়লা। ফাতিহ সচেতন ভঙ্গিতে ড্রাইভিং করছে। বাহিরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। সে গাড়ি চালানোর পাশাপাশি ঘাড় ঘুরিয়ে ল্যায়লার দিকেও খেয়াল রাখছে। এইটুকু নিয়ে সে নিশ্চিত হতে পেরেছে যে ল্যায়লা বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার হতে এসেছে। কারণ আজ হসপিটালের ডিসচার্জের সময় ল্যায়লা নিজেই জোর করে সম্পূর্ণ বিল পে করে দেয়। তাও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। এই মেয়ে সম্পর্কে যতই ছোট ছোট কিছু তথ্য জানছে, ততই অবাক হচ্ছে ফাতিহ।

__________

বাসার সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে নামে ফাতিহ। ইতিমধ্যে ফিরুজে আর ইসাম এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। ফাতিহ কিছুক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে অবশেষে ল্যায়লাকে সাবধানে পাজাকোলে তুলে নেয়। ল্যায়লার ঘুম গভীর হওয়ায় সে আর টের পায় না৷ কিন্তু সামান্য নড়ে ফাতিহর গলা জড়িয়ে ধরে সে। ইসাম মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে বের হয়ে ল্যায়লার ব্যাগ, ক্যামেরা এবং ফাইল নিয়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করে। ফাতিহ গলা খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করে,

” ফিরুজে খালা, রুম গোছানো আছে তো? ”

” হ্যাঁ আব্বা। ওকে উপরে নিয়ে যাও। ”

ফাতিহ আর কথা না বলে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে আসে। ল্যায়লার জন্য নির্ধারিত কক্ষের দরজা খোলাই ছিলো। সে সেটা পেরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে ল্যায়লাকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দেয়। বের হয়ে যেতে নিয়েও আবার ফিরে এসে ল্যায়লার পায়ের কাছে বসে সে। তার পায়ের শু এবং মোজা খুলে কম্বল টেনে তার গায়ে দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ বিষন্নতার ছায়ায় মোড়ানো সেই মুখশ্রী দেখতে গিয়ে সে কিছুটা বিভোর হয়ে পড়ে।

তখনই কক্ষে ফিরুজে খালা এবং ইসাম প্রবেশ করে। ইসাম ল্যায়লার ব্যাগ রুমের একপাশে রেখে তার ফাইল এবং ক্যামেরা বিনা শব্দে রুমের একপাশের টি টেবিলের উপর রেখে দেয়। ফাতিহ ফিরুজে খালাকে এগিয়ে গিয়ে বলে,

” আমি আর ইসাম আমাদের রুমেই থাকবো। আপনিও অনেকক্ষণ জেগেছেন খালা। এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ”

ফিরুজে স্লান মুখে সুধায়,

” মেয়েটাকে এই অবস্থায় একা ঘুমাতে দেওয়া কি ঠিক হবে? ”

” আমরা ইতিমধ্যে ওর খাতিরেই প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ওর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছি। এইটুকু স্পেস ওকে দেওয়াই উচিত। আর তাছাড়া আমার মনে হয়, ও একা ঘুমাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। আপনি তো ওর পাশের রুমেই থাকছেন। অযথা চিন্তা করবেন না। আল্লাহ ভরসা। ”

ফিরুজে খালা আর কথা বলতে পারে না। তিনি চুপচাপ রুমের আলো জ্বেলে রেখেই ফাতিহ এবং ইসামের সাথে বেরিয়ে আসে। রাত বেশ হওয়াতে সবাই অনেক ক্লান্ত ছিলো। বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতেই ফাতিহ ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে সে লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে। বুক ধরফর করছে তার। ফাতিহ একহাত নিজের বুকের বা পাশে রেখে আতংকিত সুরে আওড়ায়,

” কিছু হয় নি। আই’ল বি অলরাইট। ”

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here