মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_১২ #মৌরিন_আহমেদ

0
270

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১২
#মৌরিন_আহমেদ

– এইযে ধ্রুব সাহেব! শুনছেন?..

অনন্যার ডাক শুনে ফিরে তাকালো ধ্রুব। মেয়েটা ওর থেকে কয়েক হাত দূরে দাড়িয়ে আছে। পরনে একটা কমলা রঙের থ্রি-পিস। ফর্সা মেয়েদের কমলা রঙটা খুব মানায়। তাই ওকেও আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই উজ্জ্বল লাগছে। ও কাছে চলে আসতেই ধ্রুব খেয়াল করলো মেয়েটার চুল ভেজা। ঠিক ভেজা না, আধ ভেজা। এই ভরদুপুর বেলা গোসল সেরে কোথায় যাচ্ছে ও?

– কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

ওর কথায় ধ্যান ভাঙে ধ্রুবের। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

– কোথাও না এমনিই হেঁটে বেড়াচ্ছি… আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

– আপনার মতোই… উদ্দ্যেশ্যহীন ঘোরাঘুরি…

ধ্রুব জানে অনন্যা ওকে মিথ্যে বলছে। ও মোটেও উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরির জন্য বেরোয় নি। অবশ্যই কোনো না কোনো কাজে বেরিয়েছে। কারণ এই মেয়েটা অপ্রয়োজনে বাসা থেকে বেরোয় না। তাই আজ হঠাৎ বিনা কারণে সে যে দুপুরবেলা প্রকৃতি দর্শনে বেরোবে না সেটা জানা কথা। আবার ও যে ধ্রুবকে দেখেই নিজের মত বদলে ফেলেছে সেটাও ও বেশ ভালোই বুঝতে পারছে! কিন্তু কিছু বললো না। ওকে সাথেনিয়েই হাঁটতে লাগলো। কারণ আজ ওর বিশেষ কোনো কাজ নেই। অনন্যা সাথে থাকলে কিছু ক্ষতি হবে না।

অনন্যার ধৈর্য শক্তি বেশ ভালো। ধ্রুব তাকে নিয়ে প্রায় দু’ তিন ঘণ্টা হাঁটলো। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। এরমধ্যে ও একবারও বললো না,

– ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

ধ্রুব ওর কাছে এই প্রশ্নটা আশা করেছিল কিন্তু আস আশ্চর্যের ব্যাপার ও জিজ্ঞেস করলো না। তাতেই বেশ বোঝা যায় মেয়ের ধৈর্য আছে। ব্যাপারটা ভেবে মনে মনে একটু খুশিই হলো সে।

ওকে নিয়ে প্রথমেই গেল সিনেমা হলের সামনে। সেখানে অনেক নব্য নব্য তরুণ-তরুণী একসাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পপকর্ন, ফুসকা খেতে খেতে খুনসুটি করছে। মুগ্ধ সেসব তরুণ-তরুণী কে দেখতে সত্যিই ভালো লাগে!

সেখান থেকে ওরা গেল সেনানিবাস এলাকায়। ক্যান্টনমেন্টের গেটের সামনে একটা চায়ের দোকান আছে নাম ‘টুনুর দোকান’। সেখানকার চা ওয়ালা টুনু মিয়ার চা বানানোর দক্ষতা অসাধারণ! তার হাতের অসাধারণ টু দ্যা পাওয়ার ইনফিনিটি চা খাওয়ালো অনন্যাকে। সে বেশ তৃপ্তি নিয়েই সেটা খেল।

ওরা যখন চা খাচ্ছে তখন পেছন থেকে কে যেন এসে বললো,

– ধ্রুব না?

পেছনে ফিরে দেখা হলো এমপি চেকপোস্টের একজন এমপি কে। পরনে তার আর্মিদের সবুজ পোশাক। বুকের উপর নেনপ্লেট লাগানো ‘বশির আলম’। তার চেহারা বিরক্তিতে কুঁচকানো। বোঝাই যাচ্ছে তিনি কোনো কারণে বেশ বিরক্ত।

ধ্রুব অতি বিনয়ের সঙ্গে বললো,

– জ্বি। আমাকে চিনতে পারছেন না?

ভদ্রলোক সে কথার জবাব দিলেন না। বরং অত্যন্ত বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,

– আপনাকে আমি বলেছি চেকপোস্টের ত্রিসীমানায় যদি আপনাকে দেখি তাহলে খবর আছে। আমি আপনাকে আর্মির ফোর্থ ডিগ্রি দিয়ে ছাড়বো!

– চা খেতে এসেছি, স্যার। টুনু মিয়ার চা। খেয়েই চলে যাবো। প্রমিস!..

– না না না। কোন চা খাওয়া হবে না। আপনি যান এখান থেকে।.. সাথে এটা কে? প্রেমিকা? আপনার আবার প্রেমিকাও আছে?

অনন্যাকে ধ্রুবের প্রেমিকা বলাতে বেশ লজ্জা পেল ও। লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললো। কিন্তু ধ্রুবের মধ্যে লজ্জা কিংবা অস্বস্তির ছাপ দেখা গেল না। সে বেশ আনন্দের সাথেই বললো,

– জ্বি, স্যার। খুব দ্রুতই বিয়ে করে ফেলবো। আপনাকেও দাওয়াত দেব। কাচ্চি খেয়ে আসবেন!

বশির আলম সাহেবের কুঁচকানো মুখ সোজা হলো না। উনি সেভাবেই জবাব দিলেন,

– আপনার বিয়ে খাওয়ার সাধ আমার এখনো হয় নি। দাওয়াত না দিলেই খুশি হবো…

তারপর অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,

– আপনাকে দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে। তা এর প্রেমে পড়লেন কী করে? যাই হোক, সাবধান করে দিচ্ছি। সময় থাকতে ভেগে যান। নয় তো ঘাড়ে চড়লে আর নামবে না।

– স্যার, আমি কারো ঘাড়ে চড়ি না। চড়ার মতো বয়স আর নেই, আর চড়তে চাইলেও লাভ নেই। কেউ ভার সইতে পারবে না!..

ভদ্রলোক আর কিছু বললেন না। ধ্রুবের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলেন। তার প্রস্থানে অদ্ভুদ মুচকি হাসি ফুটে উঠল ধ্রুবের মুখে। সে এমপি লোকটাকে বিরক্ত করতে পেরে আনন্দিত!

অনন্যার এমন কিছুই হলো না। সে বেশ অবাক হয়েই পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করলো। এমপি সাহেবের সাথে ধ্রুবের কিসের এতো বৈরিতা সেটা ধরতে পারলো না। তবে সম্পর্ক যে খুব একটা ভালো নয় তাও বেশ বুঝলো।

এরপর ওরা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকেই ফিরে এলো। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে এখন বাড়ি ফেরা দরকার। ধ্রুব অবশ্য বলেছে সে এতদ্রুতই বাড়ি মুখো হবে না। এতে ওর সাথে আরও কিছুক্ষণ থাকার সুযোগ থাকলেও কি যেন ভেবে না করে ফেললো অনন্যা। ধ্রুবের সাথে হাঁটতে হাঁটতেই বাড়ি ফিরে এলো।

অনন্যা বাড়িতে ঢোকার পর আবারও উল্টো রাস্তায় হাঁটা শুরু করলো ধ্রুব। এখন হবে তার সঙ্গীহীন একা একা হাঁটা।

সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে এখন লালিমার আভা ছড়ানো। দূর থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আযানের সুর। সবুজ সবুজ গাছগুলোকে আলো-আঁধারিতে কালো কালো দেখাচ্ছে। ল্যাম্প পোস্টগুলোর আলো জ্বলে উঠেছে। নগরীর রাজপথে শা শা করে ছুটে চলছে গাড়িগুলো। একেকটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে যখন যাচ্ছে তখন তাদের তুমুল গতির দরুণ মনে হচ্ছে যেন উড়িয়েই নিয়ে যাবে! রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে এখন চোখ ধাঁধানো আলো। এমন রাস্তায় হেঁটে শান্তি নেই!

ধ্রুব হাইওয়ে ছেড়ে একটা নির্জন গলিতে ঢুকলো। এটা আবাসিক এলাকা। বিকেল ছাড়া যে কোনো একটা সময়ে এদিকে ঢুকলেই জায়গাটাকে মনে হয় ভুতুড়ে! অদ্ভুদ শান্ত থাকে পরিবেশ। লোকের আনাগোনা কম। গা ছমছমে ভাব ধরে থাকে সব। দু’ একটা কুকুর বিড়ালকে তখন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। শুধু বিকেল হলেই এর রং বদলায়। হৈ হুল্লোড় করতে করতে দালান গুলো থেকে নেমে আসে বাচ্চা-কাচ্চার দল। তাদের চিৎকার চেঁচা-মেচিতে সরব হয়ে উঠে পরিবেশ। সে যেন প্রকৃতির প্রাণবন্ত রূপ!

ধ্রুব এই আঁধার ঘেরা ভুতুড়ে রাস্তায় হেঁটে চলে। একা একা…

________________________

গলায় সদ্য কেনা ক্যামেরা আর পিঠে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন লুৎফর সাহেব ওরফে লেবু মামা। পরনে একটা ফুলতোলা হাওয়াই শার্ট আর নীল রঙের জিন্স। চোখে সানগ্লাস আর মাথায় একটা হ্যাট। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ তার দিলখোশ! প্রফুল্ল হৃদয়ে হেলতে দুলতে তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। গুনগুন করে গানও গাইছেন বোধ হয়। সুর ভেসে আসছে,

– ‘hai apna dil to awaara
na jaane kispe aayega….’

লোকটা কে দেখে মনে মনে কী যেন ভাবলো ধ্রুব। সে যে সম্পর্কে অনন্যার মামা হয় সেটা ও জানে। অনু ডাকে ‘লেবু মামা’। নামটা বড়ই অদ্ভুদ! তবে লোকটার কথায় একটা লেবু লেবু ভাব আছে। লেবুর মতোই টকটে টাইপের কথাবার্তা! আবার ভিটামিন সি এর মতো প্রয়োজনীয় একটা ভাবও আছে!

এর আগে ওনার সাথে দু’বার সাক্ষাতে কথা বলার অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর। তাতেই ওনার সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা চলে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে এই লোকের এমন সাজসাজ ভাব দেখে ঠিক বুঝতে পারলো না যে, সে একচুয়ালী কোথায় যাচ্ছে। নিশ্চয় কোথাও ঘুরতে। কিন্তু ক’দিন আগেই তো উনি ঘুরে এলেন। এমন ঘরকুনো মানুষ হঠাৎ ঘনঘন বাইরে যাচ্ছে, ব্যাপারটা কি?

ধ্রুব দ্রুত হেঁটে মামার খুব কাছে চলে এলো। পিছু পিছু হেঁটে সরস গলায় বললো,

– মামাজী, আছেন কেমন?

অপরিচিত কণ্ঠ শুনে পেছনে ফিরলেন লেবু মামা। ভ্রূ কুটি করে বললেন,

– আছি তো ভালোই।… কিন্তু.. তুমি হঠাৎ আমাকে মামা ডাকছো কেন?… আমি কি তোমার এমন কেউ?..

ধ্রুব অমায়িক হাসি হাসলো। বললো,

– কী যে বলেন না মামা!… আপনি হলেন আমার মুরব্বী।… যদিও বয়সের দিক দিয়ে খুব একটা দুরত্ব নেই, তবুও…

– তবুও কেন মামা ডাকছো?… আমার জানামতে তো জোহরাপা ছাড়া আমার আর কোন বোন নেই…

– ওই তো!… আপনি অনুর মামা, সেইসূত্রে আমারও…

– অনুর সাথে তোমার কি সম্পর্ক?..

– তেমন কিছু না। ওই প্রতিবেশী আর কি…. অন্য কিছু নয়…

– অন্য কিছু না হওয়াই ভালো!.. সেটা হলে আমি খুশি হবো না।… যাই হোক, আমায় মামা ডাকবে না।… যার তার মুখে আমি মামা ডাকা পছন্দ করি না!

তার কণ্ঠেই যেন হাজারও বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি যে ধ্রুব কে মোটেই পছন্দ করেন না তা তার প্রতিটা কথাতেই বেশ স্পষ্ট!

ধ্রুব খেয়াল করে দেখেছে একটা এলাকায় অথবা একটা বাড়ির ঠিক যতগুলো মানুষ ওকে পছন্দ করে ঠিক ততটাই অপছন্দ করে সেখানকার বাকি মানুষগুলো। যেমন- অনন্যাদের বাড়ির ভেতরকার কথাই চিন্তা করা যাক। অনু ওকে ঠিক যতটা পছন্দ করে, ওর জন্য ঠিক যতটা পাগল.. ঠিক তার বিপরীত লেবু মামা। উনি ঠিক ততটাই অপছন্দ করেন ওকে। যেন দু’চক্ষের বিষ! অসহ্য! আর তার ভাগ্নি অনন্যা? ওকে অসম্ভব রকম ভালোবাসে, ওর জন্য কী অসীম প্রেম ওর মনে! প্রেম? হ্যাঁ, প্রেম। অনন্যার মনের কথা, ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতেপারে। মেয়েটা কি অসম্ভব রকমের পাগলামি করে ওর জন্য সেটা ভেবেই অন্যরকম একটা অনুভুতি জাগে ওর!

– ঠিক আছে, আর ডাকবো না।

– বেশ!.. এবার দূর হও চোখের সামন থেকে…

– আচ্ছা।

মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলো ধ্রুব। সামনেই একটা মোড় আছে। ও কিছু না বলে দ্রুত এগিয়ে গেল। মনটা বেশ খুশি খুশি। লেবু মামা কে কিছু একটা বলে ক্ষেপিয়ে দেয়ার জন্যই মনটার এই অবস্থা!

ও ঠিক মোড়ের কাছে চলে আসতেই পেছনে ফিরে বললো,

– তা লেবু মিয়া যাইচ্ছ কই?… যাইচ্ছ যাও… প্যান্টের চেইন যে খোলা সে হুশ থাকে না?.. লাগাও.. লাগাও.. মাইনষে দেইখা ফেলাইলো যে!

বলেই চোখ টিপে দিলো। লেবু মামা মুহূর্তের মতো হতভম্ব হয়ে রইলেন। আশ্চর্যের রেশ কাটিয়ে নিজের কাপড় চেইক করলেন দ্রুত। কই না তো! সবই তো ঠিক আছে। তাহলে ছেলেটা এটা বললো কেন? অসভ্য! বেয়াদব!

#চলবে—–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here